মণিপুরি নৃত্যের মৈত্রীর বন্ধন
ভারতের আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের অন্যতম হল মণিপুরি নৃত্য। মণিপুরি নৃত্যের জন্মস্থান উত্তর-ভারতের মণিপুর রাজ্যে যা কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালা, পাহাড় থেকে ঝরে পড়া ঝর্ণাধারা, সুবিস্তৃত সবুজ জঙ্গলে ভরা অণুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সজ্জিত।
যে মণিপুর ১৮২৮ সালে রাজা গম্ভীর সিং-এর আমলে বর্মার আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল— সেই মণিপুরকে পরে দেশ স্বাধীন হলে ১৯৪৭ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিং তাঁর রাজ্যকে স্বাধীন হিসাবে ঘোষণা করেন। অবশ্য দু’ বছর পর ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে মণিপুরকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রশাসিত রাজ্য এবং তারও পরে ১৯৭২ সালে পূর্ণরাজ্যের অধিকার পেয়েছিল।
যে মণিপুর রাজ্যের মাটিতে পা রেখে ১৯৪৪ সালের ১৮ মার্চ নেতাজি ভারতে প্রবেশ করেছিলেন— সেই মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকেই স্বতন্ত্রভাবে তাদের ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা করে চলেছে। আজ সাংবিধানিক সুবিধা পাবার জন্য নিজেদের মধ্যে যতই দ্বন্দ্ব থাক বহুদিন ধরেই মিজো, নাগা, কুকি প্রভৃতি বহু উপজাতি বসবাস করে আসছে এই মণিপুরে। অনেকে বলেন, এখানে আগে সাতটি জাতি অর্থাৎ সাত সালাই একসঙ্গে বাস করত। প্রথম দিকে এদের প্রত্যেকের ভাষা ও জীবন যাপন আলাদা থাকলেও দীর্ঘদিন একসঙ্গে বসবাসের ফলে তারা একত্রিত হয়ে মৈতৈ সমাজ গঠন করে। এই মৈতৈ সমাজের অধিবাসীরা মূলত মণিপুরে বসবাস করে বলেই মণিপুরকে মৈতৈ ভূমি আর মৈতৈদের মণিপুরি বলে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ পরবর্তীতে অন্যান্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও মৈতৈ সম্প্রদায় বহুদিন বৈষ্ণবধর্মেই আত্মনিবেদন করে আছে। মণিপুরে শুধু মৈতৈরাই থাকে না, থাকে কুকি, নাগা, বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের মানুষও। মণিপুরে বৈষ্ণব, হিন্দু, খ্রিস্টান ছাড়াও কিছু ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনবসতিও রয়েছে যারা পাঙ্গাল নামে পরিচিত।
মণিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি নামে এক সম্প্রদায় আছে তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে, তারা বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় কথা বলে। তবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসাবে চিহ্নিত। মূলত মৈতৈ জাতি এই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, এদের ভাষা মৈতৈ ও বাংলা। মণিপুরি নৃত্যও মূলত এই মৈতৈদের নৃত্য। মৈতৈরা নৃত্যকে জগোই বলে। তাই মণিপুরি নৃত্যের আর এক নাম মৈতৈ জগোই। মণিপুরি জনজীবনের সঙ্গে নৃত্য বিশেষভাবে সম্পর্কিত, মণিপুরের মৈতৈ সম্প্রদায়ের কাছে নৃত্য হল পূজার অংশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মৈতৈদের এই নৃত্যকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরাও আপন করে নিয়েছে।
তবে মণিপুর সংস্কৃতিতে শুধু নৃত্য-গীতের চর্চা হয় না, সেই সঙ্গে এখানকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের অতি সূক্ষ ও সুন্দর হাতের কাজও করে থাকে। অশান্ত মণিপুর বরাবরই প্রসব করেছে মহিলাদের নগ্নতা। তাদের ‘ইমান দিয়ে’, ‘ইজ্জত দিয়ে’, অঙ্গের কাপড় দিয়ে অশান্তির ধ্বজা উড়েছে বারবার। মণিপুরের মহিলারা যেমন নগ্ন মিছিলে হাঁটতে জানে তেমনি নিজেদের কাপড় নিজেরাই তৈরি করতে জানে। তাদের প্রত্যেকের ঘরে তাঁত রয়েছে। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকেই তারা তাঁতবোনা শিখে নেয়। শিখে নেয় হাতের সূক্ষ কাজও। মণিপুরি মেয়েদের তাঁতে বোনা পর্দা, টেবিলের আচ্ছাদন, কাপড় দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুগ্ধ হয়েছিলেন, যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন শ্রীহট্টে বসে রাসনৃত্যের শান্ত ও কোমল রূপ দেখে। মৈতৈ জগোই বা মণিপুরি নৃত্যের ছন্দ, প্রকৃত সৌন্দর্যের রূপায়ণ মণিপুরবাসী যেভাবে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সঙ্গে পরিবেশন করে থাকে সেই ভক্তিরসেই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
লোকনৃত্য থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যে উত্তরণ
মণিপুরের প্রাকবৈষ্ণব যুগ ও বৈষ্ণব যুগের ধর্মীয় জীবনযাত্রায় যেমন বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তেমনি এই দুই যুগের নৃত্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। আবার রয়েছে বিশেষ সম্পর্কও।
প্রাকবৈষ্ণব যুগে মৈতৈরা ছিল শৈব, এই যুগে প্রচলিত ছিল– লাইহারাউবা, হাও জগোই, থাংতা নামক নৃত্য। এদের আদি নৃত্য হল লাইহারাউবা। যেহেতু প্রাচীনকাল থেকে মৈতৈ জাতি ভগবানের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন ও আত্মনিবেদনের জন্য নৃত্য পরিবেশন করে আসছে তাই মণিপুরের এই মৈতৈ জাতির মধ্যে অসংখ্য লোকগাথা প্রচলিত ছিল। এই লোকগাথার প্রতি তারা বরাবর শ্রদ্ধাশীল। প্রাকবৈষ্ণব যুগের আদিনৃত্য লাইহারাউবা আসলে ছিল লোকনৃত্য। ‘লাই’ শব্দের অর্থ দেবতা, ভগবান শিবের আর এক রূপ হিসাবে পূজিত হত। আর ‘হারাউবা’ শব্দের অর্থ আনন্দ। এই লাইহারাউবা নৃত্যের মাধমে দেবতাকে আনন্দ দান করা হত বা সন্তুষ্ট করা হত। এই অনুষ্ঠানে পেনা নামের একটি ছড় দিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হত। এর সঙ্গে লাগানো ঘুঙুর একই সঙ্গে তাল রক্ষা করত। এই পুজোর অনুষ্ঠানে যে নৃত্য পরিবেশন করা হত তাতে যে সমস্ত মুদ্রার ব্যবহার হত তার সঙ্গে তান্ত্রিক হস্তমুদ্রার মিল পাওয়া যায়। এই অনুষ্ঠানের পুরোহিতকে বলা হত মাইবা আর মহিলা পুরোহিতকে বলা হত মাইবি। এই মাইবা ও মাইবিরা সারা জীবন দেবতার উদ্দেশ্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করত সে অর্থে তারা ছিল দেবদাস ও দেবদাসী। নৃত্যের সময় মাইবারা পেনা বাজাত আর মাইবিরা জলে নেমে কঠিন নিয়মে হস্তমুদ্রার মাধ্যমে নৃত্য করত। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচলিত হবার পর শৈব ধর্মের মত এই নৃত্যও অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে মাইবিদের নৃত্যপদ্ধতিকে উদ্ধার করে তাদের সেই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই ধ্রুপদী মণিপুরি নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছে। মাইবা জগোই হয়েছে মৈতৈ জগোই।
আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে অথবা ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় মণিপুরের রাজা সেনবি কিয়াম্বা (১৪৬৭-১৫০৮) তাঁর রাজ্যে বিষ্ণুমূর্তি সহ একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেই মন্দিরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বৈষ্ণব ভবানীনাথ ভট্টাচার্যকে। সেই সঙ্গে তাঁর মন্দিরে বাংলাদেশের বৈষ্ণবদের আমন্ত্রণ করেও নিয়ে আসেন। এই বৈষ্ণবদের কয়েকজন মন্দিরে নিয়মিত বাংলার কীর্তন গান গাইতেন। বাংলার গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রচারকরা এ দেশে এলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে মৈতৈরা প্রভাবিত হয়। বাংলার কীর্তন ও মৈতৈদের সঙ্গীত মিলিত হয়ে মণিপুরের নিজস্ব ধারার কীর্তনের প্রচলন হয়। দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন হয়। এভাবেই যুগ যুগ ধরে দেশে বিদেশে বহু জাতির সংস্কৃতির মেল বন্ধনই মানবজাতির ফুসফুসে অক্সিজেন জুগিয়েছে।
১৭৬৩ সালে রাজা পন্থৈবার পৌত্র রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র (চিং থাং খাম্ব) মণিপুরের রাজা হন। এই সময় গৌড়ীয়বৈষ্ণব ধর্ম পূর্বভারতে বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের শাসনকালে মণিপুরে বৈষ্ণবধর্মের সমাদর বেড়ে যায়। তখন নরোত্তম দাসের শিষ্যরা মণিপুরে এসে গৌড়ীয়বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেন। রাজা ভাগ্যচন্দ্র শ্রীপরমানন্দ ঠাকুরের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ফলে মৈতৈরা সকলে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়। পরে বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরের রাজধর্মে পরিণত হয়। ১৭৭৯ সালে রাজা ভাগ্যচন্দ্র কৃষ্ণমূর্তি সহ গোবিন্দজির মন্দির স্থাপন করেন এবং সেখানে পাঁচদিন ধরে রাসলীলার আয়োজন করেন। প্রথম বছরের রাসলীলায় রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন তাঁর কন্যা রাজকুমারী শিজা লাইলইবি (বিম্ববতী মঞ্জরী)। তখন থেকেই প্রতিবছর এখানে রাসপূজা ও নৃত্য পরিবেশিত হয়ে চলেছে। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর অন্যান্য রাজারা শ্রীকৃষ্ণের পুজো ও নৃত্যের বিভিন্ন পালার আয়োজন করে মণিপুরি নৃত্যচর্চাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও এই কীর্তনের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল চন্দ্রকীর্তি মহারাজের আমলে।
রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসেন ১৮৫০ সালে। তাঁর সময়ে (১৮৫০-১৮৮৬) রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। এই রাজার আমলেই তৈরি হয় উন্নতমানের পরিমার্জিত কীর্তন ও নৃত্যরূপ। এই সময়কে মণিপুরি নৃত্যের স্বর্ণযুগ বলা যায়। তাঁর আমলেই প্রবর্তিত হয়েছিল নর্তনরাস বা নৃত্যরাস। এই সময় নৃত্যগুরুরা নৃত্য নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। নটপালায় নতুন নতুন তাল সৃষ্টি করে লয়ের সঙ্গে বেঁধে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। মণিপুরি নৃত্য এই সময় সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষতা লাভ করে। এই মণিপুরি নটসংকীর্তন মূলত বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের, নরোত্তম দাসের প্রচারিত লীলা সংকীর্তনের ধারার প্রভাবে প্রভাবিত। বলা যায় বাংলার সংকীর্তন মণিপুরের মৈতৈদের হাতে নতুনরূপে জন্ম লাভ করে। বাংলার সংকীর্তনের সঙ্গে দেশি সংগীতের মেলবন্ধনে নতুন এক ধারার প্রবর্তন হয়। এই নৃত্য মাইবী নৃত্যকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রূপ। এই নতুন নৃত্যধারার রাসগোষ্ঠীর নৃত্যগুলিকেই শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্য বলা হয়।
বৈষ্ণবযুগে প্রচলিত হল- বঙ্গদেশ পালা, নট সংকীর্তন, ধ্রুমেল, রাস নৃত্য। বৈষ্ণব যুগে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের সংকীর্তন ও রাসলীলা তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রাসলীলা মৈতৈ সমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়। এই রাসলীলা ও সংকীর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মৈতৈ জগোই ধ্রুপদী মণিপুরি নৃত্যে পরিণত হয়। মৈতৈ জগোই বা মনিপুরি নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট হল কোমনীয়তা। এটি একটি শান্ত, স্নিগ্ধ, অবনত নেত্র সমন্বিত, লাবন্যময় মাধুর্যে ভরা এক নৃত্যশৈলী। বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবেই মণিপুরের মৈতৈ নৃত্যশৈলী বিবর্তিত হয়। বিবর্তিত হয় নৃত্যের ব্যাকরণ, সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক বাদ্যযন্ত্র এমনকি সঙ্গীতও। সমগ্র মণিপুরি সমাজজীবনে নৃত্যের যে ভূমিকা ছিল তাতেও পরিবর্তন এল। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবেশের ফলে মণিপুরে যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এল তাতেই মৈতৈ জগোইয়ের লোকনৃত্য থেকে মণিপুরি শাস্ত্রীয় নৃত্যের উত্তরণ ঘটল।
মৈতৈ জগৈ যখন শাস্ত্রীয় নৃত্য
মণিপুরের রাসনৃত্য বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস’-কে রাসনৃত্যের আদি গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়। এই গ্রন্থানুসারে মণিপুরি রাসনৃত্যকে পাঁচটি ভাগ করা হয়, যথা- মহারাসক, মঞ্জুরাসক, নিত্যরাসক, নির্বেশরাসক ও গোপরাসক। বর্তমানে এই রাসগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপরাস বা গোষ্ঠরাস এবং উলুখল রাস নামে পরিচিত।
মণিপুরে সারা বছর ধরে নট সংকীর্তন ও পাঁচ রকম রাস নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয় মহারাস, চৈত্রের পূর্ণিমায় বসন্ত রাস, আশ্বিন মাসের অষ্টমীতে কুঞ্জরাস, সারা বছর ধরে নিত্যরাস, কৃষ্ণের বাল্যলীলা নিয়ে রচিত গোষ্ঠ লীলা ও উলুখল রাস। এছাড়া শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলাসমৃদ্ধ গৌরলীলা সহ ধ্রুপদী মণিপুরি নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। রাসলীলা শুরু হয় নট সংকীর্তন দিয়ে আর শেষ হয় নিতাই পদ দিয়ে। এই নৃত্যে পুং ও করতাল বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে বাজানো হয়। নৃত্যের কীর্তন গায়ককে নট বলা হয়। কীর্তনের পর পরিবেশিত হয় রাস। রাসনৃত্য মূলত গোপীদের নৃত্য। ভঙ্গী ও ভঙ্গিপরেং বা নৃত্যমালিকা নিয়ে রাসনৃত্য রচিত হয়।
ভঙ্গী হল একক দেহভঙ্গীমা। এই নৃত্য শৈলীতে চার রকমের ভঙ্গী ব্যবহৃত হয়- ১) সমভঙ্গি ২) আভঙ্গি ৩) ত্রিভঙ্গি ৪) অতিভঙ্গি। সমভঙ্গিতে দেহ সোজা বা স্থিতিশীল থাকে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে ভঙ্গী করতে হয়। আভঙ্গীতে মেরুদণ্ড নমনীয় ও সক্রিয় করতে হয়। ফলে বিভিন্ন রকম দেহভঙ্গী ফুটে ওঠে। ত্রিভঙ্গিতে লাস্যভাব ফুটে ওঠে। দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম দেহভঙ্গিমা পরিবেশন করা হয়, যেমন- শ্রীকৃষ্ণের বংশীধারী ভঙ্গিমা। অতিভঙ্গি উদ্দাম ভঙ্গীর প্রকাশক। বিশেষ করে তাণ্ডব নৃত্যে এই ভঙ্গীর প্রয়োজন হয়।
এই চার ভঙ্গির সমন্বয়ে হয় ভঙ্গিপারেং। মণিপুরের নৃত্যের যেহেতু দুটি ভাগ- লাস্য ও তাণ্ডব, সেহেতু ভঙ্গিপরেংও দুই প্রকার। লাস্য ভঙ্গিপরেং ও তাণ্ডব ভঙ্গিপরেং। আবার লাস্যভঙ্গিপারেং দুই প্রকার- সিমিতাঙ্গ ও স্ফুরিতাঙ্গ। তাণ্ডবের ভঙ্গিপারেং তিন প্রকার- গুণ্ঠন, চলন ও প্রসরণ।
অনেকে মনে করেন এই নৃত্যের লাস্য অঙ্গের পাঁচটি ভঙ্গিপরেং। যেমন – ১) অচৌবা বা বড় ভঙ্গি ২) গোপী বৃন্দাবন পরেং ৩) খুরুম্বা পরেং বা প্রণাম নৃত্য ৪) গোষ্ঠ ভঙ্গি ৫) গোষ্ঠ বৃন্দাবন পরেং। তবে শেষ দুটো ভঙ্গি পরিবেশিত হয় সুকুমার ভঙ্গিতে তাণ্ডব অঙ্গ হিসাবে। এ ছাড়াও খোলের বোলের সঙ্গে পরিবেশিত হয় পুংলোল জাগোই নৃত্য। কীর্তন ও রাস নৃত্যের মাধ্যমেই মণিপুরি নৃত্যশিল্পীরা তাদের ভক্তি অর্ঘ্য নিবেদন করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে। আগে মণিপুরের সমাজিক রীতি অনুযায়ী রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকায় কেবল ছোট বাচ্চারা অংশগ্রহণ করত, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল এই নৃত্য দেবতাকে আরাধনা কিংবা দেবতাকে তুষ্টির জন্য পরিবেশন করা হয় তাই কোনো পার্থিব বস্তু বা আসক্তি যেন এটিকে দূষিত করতে না পারে। সেই কারণে ছোট ছোট বাচ্চারাই রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করত। পরবর্তীতে এই রীতির পরিবর্তন হয়।
মণিপুরি নৃত্যের অভিনয় অনেকটা জাভা, বালি ও থাইল্যান্ডের নৃত্যের মত। এই নৃত্যে শরীরের ভঙ্গিমাই প্রধান, সেই কারণে মুখের অভিব্যক্তি খুব কম। মুখ ও চোখ থাকে অবনত। নৃত্যে স্নিগ্ধতা আনতে ঘুঙুরের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। নৃত্যে প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শান্তশ্রী ভাবযুক্ত ভক্তিময় প্রকাশভঙ্গী।
ঘুঙুরের ব্যবহার না থাকলেও বেশকিছু বাদ্যযন্ত্র এই নৃত্যে ব্যবহার করা হয়, যেমন – পুং, হারাউপুং, ধলক, খোল, খঞ্জরী, দফৎ, ঢোল, রামতাল, মন্দিলা, মাঙ্গঙ, করতাল, ঝাল, বাঁশি, পেনা, এসরাজ, তানপুরা, শেম্বুং, মোইবুং প্রভৃতি।
মুদ্রা
প্রাক্ বৈষ্ণব যুগে লাইহারাওয়া নৃত্যে মাইবী বা স্ত্রী পুরোহিতরা হাতের কিছু স্বাভাবিক মুদ্রা ব্যাবহার করতেন। মণিপুরি নৃত্যের মুদ্রাগুলি সেই উৎস থেকেই উদ্ভুত বলে অনেকে মনে করেন। মণিপুরি নৃত্যে মুদ্রার সংখ্যা ৩৬৪টি হলেও সব মুদ্রার ব্যবহার সব সময় দেখা যায় না।। মণিপুরি নৃত্যে মুদ্রাকে বলে ‘খুৎলোন’। খুৎ মানে হাত, লোন মানে ভাষা। হাতের ভাষা। হাতের ভাষা এই নৃত্যে তিন রকমের হয়- খুৎলোন, খুৎথেক, খুতচা জগোই। খুৎলোন তিন প্রকার। এক হাতের সাহায্যে করা মুদ্রাকে বলে খুৎনামসি খুৎলোন। দুই হাতের সাহায্যে যে মুদ্রা করে তাকে বলে খুৎ অনীগী খুৎলোন। এছাড়া নৃত্যহস্ত মুদ্রা আছে, তার নাম পুংলোন জগোইগি খুৎথেক।
তাল
মণিপুরী নৃত্যে কথক নৃত্যের মত পায়ের কাজ বিশেষ একটা দেখতে পাওয়া যায় না। তবে এতে বিভিন্ন রকম তাল এবং লয়ের প্রয়োগ থাকে। এই নৃত্যে যে তাল ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- তাণ্চেপ, মেনকুপ, রূপক, দশকোশ, তিনতাল দশকোশ, তিনতাল মাচা, তেবড়া, রাজমেল, দুতাল, অছুবা, যাত্রা রূপক, তিনতাল অছৌবা, তিনতাল মেল, ভঙ্গদাস, গাজন, মদন, মৈতৈ, সুরফাঁক, ঝাঁপ, রাস, চারতাল। চার মাত্রা থেকে আটষট্টি মাত্রা পর্যন্ত বিভিন্ন ভাগে অলঙ্কার পুংলোন বা প্রস্তর ছন্দ বদ্ধ হয়। অনেক সময় দুই বা ততোধিক তালের সমন্বয়ে, নৃত্যালঙ্কার প্রয়োগে করে তালপ্রবন্ধ ও নৃত্যপ্রবন্ধ তৈরি করা হয়।
রাস
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে একমাত্র মণিপুরি নৃত্যেই রাসলীলার দর্শন পাওয়া যায়। ‘রস্যতে অনেন ইতি রাস্যঃ’ অ্রথাৎ যার দ্বারা রস জন্মায় তাইই রাস। রস হল সার, নির্যাস, আনন্দ, আহ্লাদ অমৃত ও ব্রহ্ম। এই রাসলীলা পরিবেশনে তাল, মুদ্রা, চালি, অভিনয়ের মাধ্যমে নৃত্যশিল্পী যে আস্বাদনীয় রসের উত্পাদন করে। বৈষ্ণবদের কাছে রাস হল ভক্ত ও ভগবানের মিলন উৎসব। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কার্তিক পূর্ণিমার রাতে যমুনার তীরে গোপিনীদের আহবান করেন, গোপিনীরাও সব কাজ ফেলে ছুটে এসে বিশ্বাস ও ভক্তিতে মিলিত হয়। আবার শ্রীকৃষ্ণকে পেয়ে গোপিনীদের মনে আহংকার জমলে ভগবান শ্রীকৃ্ষ্ণ তাদের ছেড়ে চলে যায়। পরে গোপিনীরা ভুল বুঝতে পেরে অহংকার মুক্ত হলে শ্রীকৃষ্ণ আবার ফিরে আসে। রাধা সহ বহু গোপিনীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নৃত্যকে রাস নৃত্য বলে।
পোশাক
মণিপুরবাসীদের পোশাকের মত তাদের নৃত্যের পোশাকও বেশ চমত্কার। ভারতের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের পোশাক ও সাজসজ্জার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের পোশাক ও সাজসজ্জা এই নৃত্যধারাকে স্বতন্ত্রতা দান করেছে। তবে এই নৃত্যে রাধা ও গোপিনীদের সাজসজ্জা একইরকম হয়। মহিলারা ঘাগরা বা কুমিন পরে। কুমিনে জরীর বা কাঁচের কাজ করা থাকে। বড় ঘাগরার ওপরে একটা স্বচ্ছ ছোট ঘাগরা বা পাশোয়ান পরে, এর সঙ্গে জরীর বর্ডার দেওয়া ভেলভেটের ব্লাউজ পরে, একে রেশম ফুরিৎ বলে। এঁদের কাঁধ থেকে ব্যাগের মত খাওন ঝোলে। কোমরের খবাননের সামনে সুন্দর কাজ করা কাপড় ঝোলে। মহিলারা মাথায় খোপার ওপর জরীর কাজ করা টুপি বা কোকতুম্বি পরে, মাথার চারিদিকে জরীর ফিতে বা কোকনাম দেয়। মাথার পাশ দিয়ে জরীর ফিতে বা চুবারৈ ঝুলিয়ে রাখা হয়। মুখের ওপর দেওয়া থাকে ওড়নার নাই বা মাইমুখ। গলায় লিক নামের হার পরে। কানে পরে কুন্দর নাইন, কনুইয়ের ওপর জরির গহনা তাল, তার ওপরে তানথাক পরে। কপালে আঁকে চন্দনের ফোঁটা চন্দন থিনবা। এই নৃত্যে পুরুষ শিল্পীকে বা প্রধান চরিত্র কৃষ্ণকে হলুদ রঙের সোনাফিজেৎ কোঁচা দিয়ে পরতে হয়। কোমরের ঝালর খবাংগোই, বেল্ট ও কোঁচা খবানপ, দুই কাঁধ থেকে ব্যাগের মত খাওন ঝোলাতে হয়। এছাড়া থাকে উত্তরীয়। মাথায় চূড়ার নিচে পরে ঝালর লেইত্রেং, এর নিচে থাকে কোকনাম, মাথার চূড়ায় থাকে ময়ূরের পালক।
মণিপুরি নৃত্য ও নৃত্যগুরুদের ভূমিকা
মনিপুরি নৃত্য বা মৈতৈ জগোই প্রাচীন কাল থেকে মণ্ডপে পরিবেশিত হয়ে আসছে। মণিপুরবাসী এই মৈতৈ জগোইয়ের মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিবেদন করে বলে মণ্ডপেই তা পরিবেশন করে। মণ্ডপ নামটি এই নৃত্যে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মণিপুরি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে মণ্ডপ একটি পবিত্র জায়গা। বৈষ্ণবদের মন্দির সংলগ্ন বড় ঘরকে মণ্ডপ বলে, সাধারণত সেখানেই মণিপুরিরা নৃত্য পরিবেশন করে। শুধু তাই নয় মণ্ডপ তাদের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে মণিপুরি সমাজের যাবতীয় ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান এই মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিবাহ, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ যেমন অনুষ্ঠিত হয় তেমনি ঝুলন, রথযাত্রা, সংকীর্তন ইত্যাদি উপলক্ষে নৃত্য প্রদর্শনও হয়। মণিপুরে সাধারণত তিন ধরনের মণ্ডপ থাকে— লাইহারাওবা মণ্ডপ, মন্দিরের সংলগ্ন লাইসংগ কন্নবা মণ্ডপ এবং পুজো উপলক্ষে বিভিন্ন কাজের জন্য তৈরি হয় অস্থায়ী মণ্ডপ। ঈশ্বরের পুজো উপলক্ষে মন্দির সাজানোর মত করে নৃত্য পরিবেশনের আগে মণ্ডপকেও সাজানো হয়। মণিপুরি নৃত্য ভক্তিপ্রধান নৃত্য হাওয়ায় এই নৃত্যের মণ্ডপ সজ্জা আধুনিক যুগের মঞ্চসজ্জা বা ও অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের মঞ্চসজ্জার তুলনায় ভিন্ন।
মৈতৈরা যেমন নৃত্যকে ধর্মীয় আচার মনে করে তেমনি নৃত্যের গুরুকেও তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তাদের কাছে নৃত্যগুরু দেবতার সমান। শুধু নৃত্যশিক্ষার ক্ষেত্রে নয় তাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। শুধু তাইই নয় সমাজে গুরুর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। মৈতৈ জগোই বা মণিপুরের নৃত্যের প্রচারও প্রসারের ক্ষেত্রেও তাদের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। মণিপুরি নৃত্য যে ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ সম্পদ তা সাধারণের জ্ঞাতার্থে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এর প্রদর্শন করেন বেশকিছু মণিপুরের নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যগুরু। তাদের প্রচারের কারণে মণিপুরি নৃত্য মণিপুরের সীমানার বাইরে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর তিনজন গুরুর আন্তরিক প্রচেষ্টা মণিপুরি নৃত্যকে মণ্ডপ থেকে মঞ্চে এনেছেন, সমবেত নৃত্যকে একক নৃত্যের উপযোগী করে তুলেছে, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এঁরা হলেন গুরু মাইস্নাম আমুবি সিং, গুরু হাওবাম অতম্বা সিং, গুরু তখেলচংবম অমুদন শর্মা। এই তিনজন গুরুর অবদান মনিপুরি নৃত্যে অনস্বীকার্য। তাঁদের একসঙ্গে ত্রিমূর্তি বলা হয়। ভারতের প্রাধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর আমলে মনিপুর ডান্স একাডেমির সামনে এই তিনজন নৃত্যগুরুর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
যে সকল নৃত্যগুরুর বিশেষ অবদানের জন্য মণিপুরি নৃত্য মণ্ডপ থেকে মঞ্চে স্থান পেয়েছে তাঁদের মধ্যে গুরু মাইস্নাম আমুদি সিং অন্যতম। তিনি মণিপুরি নৃত্যের প্রাচীনত্বকে বজায় রেখে নতুনত্বের রূপ দিয়েছেন। তাঁর নৃত্যশৈলীতে নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি ও আঙ্গুলের কাজ রেখেছেন। তাঁর নৃত্যশৈলীতে চালি নৃত্যে হাত, পা, গলা, চোখ একসঙ্গে সঞ্চালিত হয়। ১৯২১ সালে কলকাতায় প্রিন্স অফ ওয়েলসের সামনে তিনিই প্রথম পাঁচ ঘন্টার মণিপুরী নৃত্যকে মঞ্চের উপযোগী করে পনের মিনিটের নৃত্যরূপ দিয়ে মঞ্চে উপস্থিত করেন। পরে মঞ্চে একক নৃত্য পরিবেশনের উপযুক্ত নৃত্যরূপও গড়ে তোলেন। তিনি দিল্লির সঙ্গীত ভারতী শিক্ষাকেন্দ্রে নৃত্যগুরুর পদে আসীন থেকে নৃত্য শিক্ষা দেন। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচ বছর উদয় শংকরের আলমোড়া নৃত্যশিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। সেখানে তিনি নৃত্যগুরুরূপে মণিপুরি নৃত্য শিক্ষা দেন। ১৯৪০ সালে আলমোড়ায় গুরু আমুবি সিংয়ের নেতৃত্বে বৈষ্ণব কবি গোপিচরণ দাসের লেখা ‘নীল কমল দল শ্যাম’ এই গানটির সঙ্গে প্রথম একক নৃত্য সংযোজন করা হয়। তাঁর নির্দেশে একাধিক এককনৃত্য নির্মান ও মঞ্চস্থ হয়- যেমন শ্রীতকমল, দশাবতার, খণ্ডিতা প্রভৃতি। অভিনয়ে তাঁর বিশেষ জ্ঞান থাকায় তিনি অভিনয় বিষয়ক নৃত্য সৃষ্টি করেন। গুরু সূর্যমুখী দেবী, গুরু দেবযানী চলিহা, গুরু থৌরানি সাবি দেবী তাঁর যোগ্য শিষ্য।
গুরু হাওবাম অতম্বা সিং মণিপুরি নৃত্যকে সরল সৌন্দর্যে প্রকাশ করেন। তিনি সাধারণত নিত্যরাস, বসন্তরাস ও তাণ্ডব নৃত্য শেখাতেন। শুধু শান্তিনিকেতনই নয় তিনি আসাম, ত্রিপুরা, পূর্ব বাংলার কিছু জায়গা, পশ্চিমবাংলা, বৃন্দাবন, রাধাকুঞ্জ, জয়পুর, দিল্লি বিভিন্ন স্থানে মনিপুরি নৃত্যের প্রচার ও প্রসার করেন। তিনি শান্তিনিকেতনেও শিক্ষকতা করতে এসে সেখানকার মুক্ত ও প্রাকৃতিক পরিবেশে নৃত্যকে পরিবেশন করার উপযোগী নৃত্যশৈলী নির্মান করেন। তিনি মণিপুরের বাইরে মণিপুরি নৃত্যকে জনপ্রিয় করার জন্য যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি মণিপুরি নৃত্য কে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। মণিপুরের রাজা এই অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গোড়া মণিপুরি ব্রহ্মসমাজ থেকে বহিষ্কার করেন। তবু তিনি নৃত্যচর্চা ও প্রচার থেকে সরে আসেননি। পরে অবশ্য রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে সম্মান ফিরিয়ে দেন। তিনিই গুরু সেনারিক সিংহ, বিপিন সিংহ, সবিতা বেন মেহতা, গুরু পাকা সিং, গুরু প্রহ্লাদ দাস, রিতা দেবীকে যোগ্য শিষ্য হিসাবে রেখে গেছেন।
গুরু অমুদন শর্মা মণ্ডপের চেনা পরিবেশ ও রাজপ্রাসাদে পরিবেশনের উপযুক্ত নৃত্যশৈলী নির্মান করেছেন। তাঁর নৃত্যে তাণ্ডব নৃত্যের অঙ্গিক দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর নৃত্যে বোলের সঙ্গে গলা, হাত, পা একসঙ্গে তাল ও লয়ের বিন্যাস অনুযায়ী হয়। তানচপ, মেনকূপ এবং যে কোনো কঠিন তালের বোলের বিষয়ে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এছাড়াও আছেন নবকুমার সিংহ, বিপিন সিংহ ও তার শিষ্য দর্শনা ঝভেরি, কলাবতী দেবী, বিনোদিনী দেবী প্রমুখের আবদান।
শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্য
মনিপুরী নৃত্যকে মণ্ডপ থকে মঞ্চে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যেমন নৃত্যগুরুদের অবদান রয়েছে তেমনি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ অবদান রয়েছে। মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা বলা যায়। শান্তিনিকেতনের গুরুদেব ও মণিপুরি নৃত্যগুরুদের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় মণিপুরি নৃত্য শুধু মণ্ডপ থেকে মঞ্চে উপস্থাপিত হয়নি, মনিপুরের সীমানা পেরিয়ে সারা ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালের অক্টোবরে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধু প্রতিমাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে শিলং গিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল শিলং থেকে শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা ও মণিপুর হয়ে শান্তিনিকেতন ফেরার। শিলং-এ কিছুদিন কাটিয়ে ৫ নভেম্বর শ্রীহট্টে পৌঁছেছিলেন। শ্রীহট্টবাসী কবিকে সুরমা নদীর ঘাট থেকে বিশেষ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। পরের দিন ৬ নভেম্বর টাউন হলে দেড়ঘন্টা বক্তৃতা দেন যা পরবর্তীতে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙালির সাধনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় শ্রীহট্টে নয়াসড়ক টিলার ওপর ফাদার টমাসের বাংলোয়, যেখানে তিনি উঠেছিলেন, রাসনৃত্যের শান্ত ও কোমল রূপ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। এই সময় তিনি মণিপুর যেতে চেয়েও যেতে পারেননি সেখানকার রাজা চূড়াচান্দ সিংহের অনুমতির অভাবে। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে স্যার উপাধি ত্যাগ করেছিলেন বলে ব্রিটিশ শাসকের রাজনৈতিক প্রতিনিধির প্ররোচনায় তিনি মণিপুরে যাবার অনুমতি পাননি। এরপরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেননি। মণিপুর সেদিন তাকে গ্রহণ না করলেও তিনি মণিপুরের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে, আপন করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। (পরে অবশ্য এই রাজা চূড়াচান্দের কন্যা রাজকুমারী বিনোদিনী দেবী শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থেকে শিক্ষালাভ করতে আসেন এবং রাজার ঐ ব্যবহারের জন্য লজ্জা প্রকাশ করেন।)
শ্রীহট্ট থেকে তিনি ত্রিপুরা গিয়েছিলেন সেখানকার রাজার আমন্ত্রণে, এই ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বহুদিন থেকেই সখ্যতা ছিল। রাজা বীরচন্দ্র সিংহ (১৮২৬ থেকে ১৮৯৬) নিজেও কবি ছিলেন, তার চারট কাব্যগ্রন্থ ছিল বলে জানা যায়। প্রথম পত্নী-বিয়োগের পর যখন তিনি তার বিরহে লিখছিলেন প্রেম মরিচীকা নামে শোকগাথা তখন রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এরপরই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শান্তিনিকেতনে নিজস্ব সচিব রাধারমন ঘোষকে পাঠিয়ে প্রিয় কবিকে অভিনন্দন জানান। সেই থেকে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্যতা শুরু হয়। পরে রাজা বীর চন্দ্রের পুত্র রাজা রাধাকিশোরের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম ১৯০০ সালের বসন্তকালে ত্রিপুরা আসেন। অনেকের দাবি তিনি প্রথম মণিপুরি নৃত্য সেইসময় উপভোগ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ত্রিপুরার রাজার পৃষ্টপোষকতায় রাজ দরবারে সেই সমইয় মণিপুরি নৃত্যচর্চা হত। তাই ত্রিপুরা গিয়ে তত্কালীন রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রথমে ত্রিপুরা থেকে মণিপুরি নৃত্যের শিক্ষাগুরু আনলেন। তবে তা কেবল মণ্ডপে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আত্মনিবেদনের জন্য। শুধুমাত্র রাজার নির্দেশে একবার ত্রিপুরায় আর একবার শ্রীহট্টে মণ্ডপের বাইরে রবীন্দ্রনাথের সামনে প্রথম কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির মনোরঞ্জনের জন্য উপস্থাপিত হয়েছিল এই নৃত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরি রাসনৃত্যে আকৃষট হয়ে প্রথমে ত্রিপুরা পরে আসাম ও মণিপুর থেকে শিক্ষকদের এনে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষার ব্যবস্থা করলেন।
তিনি বরাবরই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিশিষ্ট নৃত্যপারদর্শীদের এনে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নৃত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। শান্তিনিকেতনে শাস্ত্রীয় নৃত্যকে জনপ্রিয় করতে স্থাপিত হয় ‘নৃত্য কলা লয়’ নামে একটি সংস্থা। পরে সব শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে মণিপুরি নৃত্য শান্তিনিকেতনে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষার জন্য আলাদা বিভাগ খোলা হয়।
রবীন্দ্রনাথের উত্সাহে উত্সাহিত হয়ে ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য তাঁর রাজ দরবার থেকে ১৯১৯ সালের শেষে কিংবা ১৯২০ সালের শুরুতে বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে পাঠান। তিনি শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়ে প্রথমে শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের পরে ছাত্রীদের মণিপুরী নৃত্যশিক্ষা দেন। কিছুদিন পরে বুদ্ধিমন্ত সিংহ গরমের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ত্রিপুরার রাজার শিল্পাশ্রমের দায়িত্ব পেয়ে সেখানেই থেকে যান।
বুদ্ধিমন্ত সিংহ চলে যাবার প্রায় পাঁচ বছর পর ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যকে চিঠি লিখে আর একজন নৃত্যগুরু চেয়ে পাঠান। ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে সেখান থেকে আসেন গুরু নবকুমার সিং রাজকুমার। কিছুদিন পর নবকুমার সিংহ এর সঙ্গে কাজ করতে তাঁর ভাই বৈকুণ্ঠ সিংহ আসেন। এরা শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের মণিপুর রাসের চালি (মণিপুরী নৃত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সঞ্চালন) শিক্ষা দেন। এই চালি হল মণিপুরি বা মৈতৈ জগোইয়ের প্রাথমিক এবং অবশ্য শিক্ষনীয় পর্যায়। সাধারণত চালি বলতে চারটি শিক্ষনীয় নাচকেই বোঝাই। সেই সঙ্গে তারা ভঙ্গি পরেং (নৃত্যের সময় ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ বিন্যাস করাকে ভঙ্গি বলে আর পরেং বলতে ভঙ্গির সারিকে বোঝায়) শিক্ষা দেন। যদিও প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনের অনেকেই এই নৃত্যকে সঙ্গীতের ব্যায়াম বলেছেন তবু ধীরে ধীরে মণিপুরি নৃত্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবকুমার সিংহ শান্তিনিকেতনের সেরা ছাত্রীদের মেয়েদের নিয়ে আলাদা একটি নৃত্যদল তৈরি করেন। তাদেরকে আলাদা করে নৃত্যশিক্ষা দিতে শুরু করেন আড়ালে। এই বছর নভেম্বর মাসে তত্কালীন বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতন এলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে অভ্যর্থনা জানান গুরু নবকুমার সিংহের শেখানো ছাত্রীদের পরিবেশিত মণিপুরি নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে।
প্রতিমাদেবী ১৯২৬ সালের ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৬৫তম জন্মদিনে কথা ও কাহিনীর পূজারিণী কবিতার গল্পকে অবলম্বন করে একটি নাটিকা পরিবেশনের পরিকল্পনা করলেন। রবীন্দ্রনাথ পূজারিণীর নাট্যরূপ দেওয়াতে সে পরিকল্পনার বাস্তবে রূপদান আরো সহজ হয়। নবকুমার সিংহর পরিচালনায় প্রথম শান্তিনিকেতনের ছাত্রীদের পরিবেশিত ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্ত হয় মণিপুরি নৃত্যধারা সহযোগে। পূজারিণীর ভূমিকায় নন্দলাল বসুর সদ্যবিবাহিতা কন্যা গৌরীদেবীর নৃত্যাভিনয় সকলের মন কেড়েছিল। বিশেষ করে এই নৃত্যনাট্যের শেষ গান ভৈরবী রাগিনীতে গীত ‘আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো’তে মণিপুরি নৃত্যাভিনয় সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে এই নৃত্যনাট্য কলকাতায় মঞ্চস্থ করতে অনুরোধ করেন বিশিষ্টরা। ১৯২৭ সালে কলকাতায় আবার মঞ্চস্থ হয় এই নৃত্যনাট্য। মণিপুরি নৃত্যের সুললিত ভাব ও অভিনয় সকলকে আবারও মুগ্ধ করে।
নটীরপূজার সাফল্যের পর রবীন্দ্রনাথ নবকুমারকে দিয়ে করালেন দোল উত্সব উপলক্ষে ছয়টি ঋতুর গান নিয়ে ‘নটরাজ’ নৃত্যানুষ্ঠান। এরপর নৃত্যগুরু নবকুমারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। ১৯২৭ সালেই আহমেদাবাদের বিখ্যাত শিল্পপতি আম্বালাল সারাভাই তার কন্যাদের মণিপুরি নৃত্য শেখাতে বিশেষ আগ্রহী হন। রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করে শিক্ষক নবকুমারকে আহমেদাবাদে নিয়ে যান ১৯২৯ সালের জুন মাসে মেয়েদের মণিপুরি নৃত্য শেখাবার জন্য। সেখানে সাত বছর আম্বালাল সারাভাইয়ের দুই কন্যা মৃদুলা সারাভাই ও লীলা সারাভাইকে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা দিয়ে পারদর্শী করে তোলেন। এ দিকে নবকুমার সিংহ চলে যাবার পর ১৯২৯ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মণিপুরের ইম্ফল থেকে আর এক নৃত্যগুরু হাওবাম অতম্বাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। তিনি শান্তিনিকেতনে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করান। তাঁর নৃত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সরল সৌন্দর্যের বিস্ময়কর রূপ।
১৯৩৪ সালে সিংহল থেকে নৃত্যানুষ্ঠানের আমন্ত্রণ এলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শাপমোচন’ পরিবেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মত আহমেদাবাদ থেকে নবকুমারকে সময়িক ভাবে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। শাপমোচনের নৃত্যরূপ দেন সম্পূর্ণ মনিপুরি ভঙ্গিতে। এবারে গানের প্রাসঙ্গিকতা মেনে গানের কলির মাঝেও বসালেন নাচের ভাব ও মুদ্রা। সিংহলেও বিশেষ জনপ্রিয়তা পায় শাপমোচন, সেই সঙ্গে মণিপুরি নৃত্য। সিংহল সফরের পর নবকুমারের নৃত্য পরিচালনায় বোম্বের ‘বসন্ত সেনা’ সিনেমায় প্রথম মণিপুরি নৃত্যের প্রদর্শন হয়। ১৯৫৫ সালে নবকুমার আবার শান্তিনিকেতনে শিক্ষকের পদে যোগ দেন।
নবকুমার বোম্বে থাকাকালীন শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা দিতে শিলচর থেকে আসেন আসামের আর এক নৃত্যগুরু রাজকুমার সেনারিক সিং ও মহিম সিংহ। সেবার পুজোর ছুটিতে মাদ্রাজ ও ওয়াল্টেয়ারে তার পরিচালনায় নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। কিছুদিন পর সেনারিক সিংহ শান্তিনিকেতন ছেড়ে গেলে ১৯৩৫ সালে শিলচর থেকেই আসেন গুরু নীলেশ্বর মুখার্জি। এই নীলেশ্বর মুখার্জি শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে রাখাল নৃত্য পরিবেশন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি হয়ে তাকে সেদিন পাঁচ টাকা উপহারও দিয়েছিলেন। পরে তিনিই শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হয়ে এলেন। শান্তিনিকেতনে মহিম সিংহ ও নীলেশ্বর মুখার্জি বছর দু’য়েক নৃত্যশিক্ষা দেন। ১৯৩৫-৩৬ সালে ত্রিপুরার আগরতলা থেকে মণিপুরি নৃত্যগুরু শাপম বসন্ত সিংহ আসেন এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের স্বার্থক রূপদান করেন।
শান্তিনিকেতনে সেই সময়ে দু’বছরের জন্য আসেন ত্রিপুরা থেকে নৃত্যগুরু রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ইন্দিরা গান্ধী, লীলা সারাভাই, নন্দলাল বসুর আর এক কন্যা যমুনা, রথীন্দ্রনাথের পালিত কন্যা নন্দিনী তার কাছে নৃত্যশিক্ষা করেন। তিনি রবিন্দ্রনাথ রচিত ভানুসিংহের পদাবলির কিছু গানের নৃত্যরূপ দেন এবং তাসের দেশ নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন। এভাবেই একের পর এক নৃত্যগুরুদের সাহায্যে শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যচর্চা যেমন চলেছে তেমন চলেছে রবীন্দ্রনৃত্যে তার ভাব প্রয়োগের কাজ।
শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন সময়ে নৃত্যশিক্ষা দিতে এসেছেন নৃত্যগুরু রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহ, পাঙনবম নবকুমার সিংহ, পাঙনবম বৈকুন্ঠ সিংহ, হওবম অতম্বা সিংহ, রাজকুমার সেনারিক সিংহ, মহিম সিংহ, নীলেশ্বর মুখার্জি, কামিনী সিংহ, শাপমবসন্ত সিংহ, রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ, সুধীর সিংহ, সরোকখাইবম পাকা সিংহ, অরাম্বম অমুবী সিংহ, কে যতীন্দ্র সিংহ, প্রফুল্ল সিংহ, মাধব মুখার্জি প্রমুখ। সম্প্রতি যাঁরা মণিপুরি নৃত্যচর্চা করছেন এবং শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেছেন বা করছেন তাঁরা হলেন অধ্যাপক আইখোম হেমন্ত, অধ্যাপক কে সুনীতা দেবী, অধ্যাপক শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়, সহকারী অধ্যাপক ড সুমিত বসু ও টি জ্ঞানপতি দেবী। মণিপুর নৃত্যশিক্ষায় কন্ঠ সঙ্গীত দিয়ে সহযোগিতা করছেন কে এইচ প্রেমজিৎ সিংহ, এম কেন্দ্র সিংহ, ও এল রাসেশ্বরী দেবী।
১৯১৯/২০ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যগুরুদের সহযোগিতায় মণিপুরি নৃত্যশিক্ষার যে প্রচলন করেছিলেন তা পরবর্তিতে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র/ছাত্রীরা বিশ্বভারতীতে পড়তে এসে মণিপুরি নৃত্য শিখে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। সেখানে গিয়ে তারা মণিপুরি নৃত্যশৈলীকে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তুলেছে। শান্তিনিকেতন ছাড়াও উদয় শংকর ও ম্যাডাম মেনকা তাঁদের নিজেদের নৃত্য প্রতিষ্ঠানে মণিপুরী নৃত্যের চর্চা করে দেশ বিদেশে তার প্রচার করেন।
ভারতীয় নৃত্যে বিংশ শতাব্দীর মত এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন সমাজের পাঁকে পতিত হওয়া নৃত্যশিল্পীদের উদ্ধার করে তাদের হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, নৃত্যশিল্পীদের জন্য, শিল্পের জন্য আন্দোলন হয়, যখন সকল শাস্ত্রীয় নৃত্যকে অবলুপ্তি থেকে রক্ষা করা হয় তখন শান্তিনিকেতনে সকল ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হয় স্বাধীন ভারতের মুক্ত বাতাসে এর সুবাস ছড়িয়ে দেবার স্বপ্নে। ভরতনাট্যম, ওড়িশি নৃত্যকে মন্দির থেকে, কথক নৃত্যকে দরবার থেকে, মণিপুরি নৃত্যকে মণ্ডপ থেকে বার করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার আন্দোলন হয় এই সময়।
মণিপুরি নৃত্যের জন্য এই শতাব্দি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শতাব্দীর শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নৃত্যগুরুদের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই নৃত্যকে বাংলা সহ সারা ভারতে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেন। শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্য সমাদর পাওয়ার কারণে বা মণিপুরি নৃত্যের দ্বারা রবীন্দ্রনৃত্য প্রভাবিত হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনৃত্যের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরি নৃত্যও পরিচিতি পায়। বাঙালির প্রাণের সঙ্গে মিশে যায় মণিপুরি নৃত্যের ভাব। ঐ সময় থেকেই শান্তিনিকেতন ও কলকাতা ছাড়া আহমেদাবাদ, জামশেদপুর সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখে মণিপুরের অপরূপ পোশাকে, ছন্দ, তাল, মুদ্রায় মোড়া এই রাসলীলা। নৃত্যগুরুরা মণিপুরি নৃত্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুললে ছাত্রছাত্রীর অভাব হয়নি। পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে একাধিক মণিপুরি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে দিল্লিতে সঙ্গীত নাটক একাডেমি, ১৯৫৪ সালে ইম্ফলে জওহরলাল নেহেরু ডান্স একাডেমি, ১৯৫৭ সালে দিল্লিতে শ্রীরাম ভারতীয় কলাকেন্দ্র স্থাপিত হয়। এর ফলে মণিপুরি নৃত্যচর্চা অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে গুরু আমুদন শর্মার শিষ্য বিপিন সিংহ ও তার শিষ্য দর্শনা ঝভেরি, কলাবতী দেবী, বিনোদিনী দেবী, গুণেশ্বরী দেবী, শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্দ্রানী দেবী, বিম্বাবতী দেবী, দ্রৌপদী দেবী, পৌষালী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা মণিপুরি নৃত্য চর্চাকে ধরে রেখেছেন। শুধু তাইই নয় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন নৃত্যনাট্য ও চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত হচ্ছে এই নৃত্যশৈলী।
ভারতীয় সংস্কৃতির বিশেষ আহ্লাদের সম্পদ এই শাস্ত্রীয় নৃত্য তার স্নিগ্ধতার জন্য আজ বিশ্বের দরবারে বিশেষভাবে সমাদৃত। উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট্ট রাজ্যের পরিবেশ আজ যতই অশান্ত হোক সেখানকার শান্ত, স্নিগ্ধ, সুললিত, ভক্তিরাসাশ্রিত নৃত্যশৈলী সারা বিশ্বের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির হয়ে শান্তির বার্তা দিয়ে চলেছে…।
হে মোর চিত্ত, পূণ্য তীর্থে
জাগো রে ধীরে-
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।
তথ্যসূত্র
১) রবীন্দ্রজীবন কথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ সংস্করণ
২। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য – শান্তিদেব ঘোষ, আনন্দ, কলকাতা
৩। রবিজীবনী, ৭ম খণ্ড – প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ, কলকাতা
৪। গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভারতের নৃত্যকলা, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৮৫
৫। শান্তিদেব ঘোষ- রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিশ্বভারতী, ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ, ষষ্ঠ সংস্করণ
৬। অনুপ শংকর অধিকারী, নৃত্যবিতান
৭। তানিয়া চক্রবর্তী, শাস্ত্রীয় মণিপুরী নৃত্যের নির্মিতি এবং ব্যাপ্তিতে বিংশ শতাব্দীর ত্রিমূর্তি গুরুর ভূমিকা, লোকগান্ধার, ১ নভেম্বর ২০২০, এই এস এস এন নম্বর- ২৫৮২-২৭০৫
খুব ভালো পোস্ট। আমি যেটুকু বুঝি, মণিপুরী নৃত্যের সমস্ত কারিগরী নিবেদিত ছিল দেবপ্রেমে, তা থেকে মানব প্রেমে উন্নীত করার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথকেও আকৃষ্ট করেছিল। তিনি মোহিত হয়েছিলেন। বলতে গেলে শান্তিনিকেতনী ধারায় মণিপুরী নৃত্যকলার সাথে আমাদের পরিচয়। সেই মণিপুর আজ অশান্ত। শান্তশিষ্ট মনিপুরকে কাশ্মীর গড়ে তোলা হয়েছে। ৬ মাস হয়ে গেল, আজও সেখানে ইন্টারনেট বন্ধ, স্বাভাবিক জীবনযাত্রাঅসম্ভব চাপের মধ্যে। বাকি ভারত মণিপুরকে ভুলে গেছে। আর এখানে উৎসবের আবহে অবিরত বেজে চলেছে নূপুর। আমরাও সব ভুলেছি, ভুলে গেছি মণিপুর।। মনে করিয়ে দেবার জন্য লেখিকাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।