মৈমনসিংহ গীতিকার আঁতুড় ঘর
‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মৈমনসিংহ জেলা থেকে সংগৃহীত দশটি পালাগানের এই সঙ্কলনটি শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিদেশের সাহিত্য জগতেও সমাদৃত হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল পালাগানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। মৈমনসিংহ গীতিকার ইংরাজি অনুবাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে সমাদৃত হওয়া এবং ২২টি বিদেশি ভাষায় অনুদিত হওয়া একই কারণে। ছড়া-পাঁচালীর ঢঙ্গে লেখা এই পালাগানগুলিকে দীনেশচন্দ্র সেন কখনও ‘গাথা’ কখনও ‘গীতিকা’ বলেছেন।
পুথির আকারে না পাওয়া গেলেও মৈমনসিংহের নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বাতাসে আখ্যানধর্মী লোকগীতির সুর নরনারীর প্রেমের সুর হয়ে ভেসে বেড়াত। সুরে সুরে গীত হয়েই এ গান কালজয়ী হয়েছিল। সপ্তদশ- অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত এই গ্রাম্যগাথাগুলি এখানকার নিম্নবর্গ ও নিম্নবিত্ত মানুষের বাস্তব জীবনচিত্র সম্বলিত যা তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছিল। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে গায়েনদের, তারাই গানগুলিকে মুখস্থ করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করত। পালাগানগুলি রচিত হবার দু-তিনশো বছর পরেও লোকসমাজে সমানভাবে জনপ্রিয় থেকেছে মূলত এই গায়েনদের কারণেই। তাদের স্মৃতির লাঠিতে ভর করেই কয়েকশো বছরের রাস্তা পার করে এসেছে পালাগানগুলি। এ কারণেই স্মৃতিনির্ভর আখ্যানগুলির কাহিনী ও ভাষা কিছুক্ষেত্রে পরিবর্তিতও হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেন এগুলিকে গীতিকা বলে অভিহিত করলেও স্থানীয় মানুষের কাছে তা পালাগান বলেই পরিচিত ছিল। এগুলি কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য বা কোনো বিশেষ দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য রচিত হয়নি। রচিত হয়েছিল স্থানীয় লোকসমাজের মনোরঞ্জনের জন্য। এগুলি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত কবির রচনা, রচনা মহিলা কবিরও। শুধু তাই নয় সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে পালাগানের আসরে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই উপস্থিত থাকত, পরিবেশন করত উভয় সম্প্রদায়ের গায়েনরা। অন্ত্য-মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় রচিত মৈমনসিংহ জেলার পালাগানগুলি তত্কালীন বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাহিত্যসৃষ্টি থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগানগুলি পাঠককে দিয়েছে এক নতুন সমাজের, নতুন যুগের সন্ধান। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে এই গীতিকার আয়নায় দেখা গেছে কয়েকশো বছর আগের পূর্ব মৈমনসিংহ জেলার সমাজচিত্র। দেখা গেছে নদী, হাওর- বিল, জঙ্গলে ঘেরা জনজীবন, হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি, মাতৃ্তান্ত্রিক সমাজের ছায়া, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, প্রাপ্তবয়স্ক নারীর জীবনসঙ্গী বেছে নেবার স্বাধীনতা, জমিদারের অত্যাচার, ঐক্যবদ্ধ সমাজের অঙ্গীকার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমপ্রান্তের গোটা বঙ্গসমাজে যে বৈশিষ্ট্য আনার জন্য মনীষীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, কখনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান গেয়ে, কখনও সতীর গায়ের আগুন নিভিয়ে, বিধবার হাতে শাখা পরিয়ে, বালিকার হাতে বিদ্যা ধরিয়ে নতুন করে সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন, সেই বৈশিষ্ট্য ব্রহ্মপুত্র নদীর পূর্বদিকের প্রকৃতিপটে কয়েকশো বছর আগের সমাজচিত্রে পাওয়া গেল। লোকসাহিত্যের নতুন সংযোজন এই গীতিকা মৈমনসিংহ জেলা সম্পর্কে কৌতূহল বাড়িয়ে তুলল। তবে মৈমনসিহ জেলার ভৈগোলিক অবস্থান এবং তার রাজনৈতিক ইতিহাস ফিরে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয়না এই গীতিকার বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্রতার কারণ।
ভৌগোলিক অবস্থান
যে মৈমনসিংহ জেলায় বসে দ্বিজকানাই, নয়ানচাঁদ, রঘুসূত, দামোদর, শ্রীনাথ বেনিয়া, চন্দ্রাবতী দেবীর মত কবি পালাগানগুলি রচনা করেছিলেন সেই মৈমনসিংহ জেলা এখন আর নেই। শাসকের হাত ধরে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে তার আকার, আয়তন, পরিবর্তিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পরিচয় ও শাসনতন্ত্র। ব্রিটিশশাসিত ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা ছিল মৈমনসিংহ। যখন দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার খোঁজ পেলেন তখন এই জেলা আয়তনে অবিভক্ত বাঙলার তৃতীয় বৃহত্তম হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে ছিল প্রথম জেলা। এই জেলা থেকে সরকার রাজস্বও পেত সবচেয়ে বেশি। কেদারনাথ মজুমদারের মতে ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে তখন মৈমনসিংহ জেলার উত্তরে এখনকার মতই ছিল গারো পাহাড়, তবে পূর্বে ছিল শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা জেলা। দক্ষিণে ঢাকা জেলা আর পশ্চিমদিক পাবনা, বগুড়া ও রঙপুর জেলা দিয়ে ঘেরা। তবে ১৮৭৯ সালে ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার একটি নোটিফিকেশন জারি করে যমুনানদীকে মৈমনসিংহ জেলার পশ্চিমসীমান্ত বলে নির্ধারণ করেছিল। মানচিত্রে বাঁকা চতুর্ভূজের মত দেখতে এই জেলার দৈর্ঘ্য উত্তর দক্ষিণে ৫৯ – ৯৩ মাইল এবং পূর্ব পশ্চিমে ৭০ – ৭৬ মাইল বিস্তৃত ছিল, মোট আয়তন ছিল ৬৩৩২ বর্গমাইল। ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ জেলা ইয়র্কসায়রের তুলনায় ১/১২ গুণ বড় ছিল। এরও দ্বিগুণ আয়তন ছিল যখন ১৭৮৭ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার মৈমনসিংহ জেলা স্থাপন করে। এই বিশাল মৈমনসিংহ জেলার প্রায় মাঝ বরাবর ব্রহ্মপুত্র নদীর বিশাল জলরাশি বয়ে যাওয়ায় জেলাটি দুটিভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল প্রাকৃতিক নিয়মেই। নদীর পূর্বদিক পূর্ব মৈমনসিংহ এবং পশ্চিমদিক পশ্চিম মৈমনসিংহ বলে পরিচিত ছিল। পূর্ব মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ সহ দক্ষিণ-পূর্ব দিকটি ছিল স্যাঁতসেঁতে জলাকীর্ণ কর্দমাক্ত নিম্নভূমি। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জঙ্গল ছিল উপরে লালরঙের কাদামাটি আর নিচে বালিমাটি সহ মধুপুরগড়। মূলত পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলিমাটিতে তৈরি এ অঞ্চল। পূর্ব মৈমনসিংহের এই কর্দমাক্ত জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলটি হল মৈমনসিংহ গীতিকার আঁতুরঘর। গীতিকাগুলি মূলত পূর্ব মৈমনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ থেকে পাওয়া গেছে সেই কারণে একে পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকা বলাই সঙ্গত বলে মনে হয়। জেলার এই ভৌগোলিক অবস্থান গীতিকার বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্রতা দানে সাহায্য করেছে। গীতিকার কাহিনিগুলিতে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্ণিত হয়েছে, তাতে এই অঞ্চলের একাধিক নদীর নাম পাওয়া যায়। যেমন মহুয়া পালায় হুমরা বেদে ধনু নদী পাড়ের কাঞ্চনপুর থেকে মহুয়াকে চুরি করে, চাঁদ বিনোদের বাড়ি ছিল ‘সুত্যা’ নদীর তীরে। আবার মহুয়া পালাতেও বিনোদ মলুয়াকে বিয়ে করার আগে ঘর বানায় ‘সূত্যা নদীর কানে’। বাস্তবিকই দক্ষিণ – পূর্ব দিকটি নদী-খাল-বিল পরিবেষ্টিত। অঞ্চলটি ধনু, কংশাই, ফুলেশ্বরী, রাজেশ্বরী, সুতি, সুরনন্দা, ঘোরাউত্রা, আড়িয়ল খাঁ, মেঘনা প্রভৃতি নদনদী ও খাল বিল প্লাবিত ‘হাওড়’ নামে পরিচিত ছিল। গীতিকাতেও ‘তলার হাওড়’, ‘জেলের হাওড়’, ‘বাঘরার হাওড়’ প্রভৃতি হাওড়ের উল্লেখ আছে। সেহেতু এখানে বিল বেশি আর এই অঞ্চলে বিল হাওড় নামে পরিচিত তাই এই অঞ্চলকে হাওড় বলা হয় বলে অনেকের ধারণা। আবার অনেকে মনে করেন ‘হাওড়’ শব্দটি ‘সাগর’ শব্দের অপভ্রংশ (সাগর>সাওর>হাওড়)। তবে অঞ্চলে মূলত আদিবাসী ও পাহাড়ি জাতির আনাগোনা ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর অনেক আগে থেকেই ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ ধরে তিব্বত, কোচবিহার, কামরূপ হয়ে বৃহত্তর মৈমনসিংহ জেলার পাহাড়, টিলা, জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে, ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য ছোট নদীর পারে গারো, হাজং, কোচ, পলিয়া, রাজবংশীরা কৌমভিত্তিক বসবাস শুরু করেছিল। এরা মূলত ইন্দো-মোঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর অন্যতম গোত্র বোড়ো সম্প্রদায়ভুক্ত। পরবর্তীতে গারো, রাজবংশী উপজাতিরাই অঞ্চলটি ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ করে শাসন করত, এর ফলে তাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাবও পড়েছে গোটা মৈমনসিংহের সমাজব্যবস্থায়, যার ছায়া দেখতে পাওয়া যায় মৈমনসিংহ গীতিকায়। তবে আর একটু স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে পিছন ফিরে দেখতে হবে কয়েকশ বছর আগের ইতিহাস।
জেলার ইতিহাস
মৈমনসিংহ জেলার ইতিহাস খুঁজতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না । একে প্রাগৈতিহাসিক যুগের জেলা বলে দাবি করতে পারেনি কেউই। মূলত গুপ্তযুগ থেকে এই জেলার ইতিহাস প্রামাণ্য তথ্যসহ জানা যায়। চতুর্থ শতাব্দীতে এই জেলা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তবে এরও আগে পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থের মানচিত্রে কামরূপ রাজ্যের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ও যুক্ত ছিল অর্থাৎ তখন পূর্ববঙ্গ কামরূপ রাজ্যের অধীন ছিল। ভারত ভ্রমণের পর মেগাস্থিনিস দেশে ফিরে যাবার কিছুদিন পর অশোক সিংহাসনে বসেন। ২৬০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে অশোকের রাজত্বকালে আসাম, মনিপুর, কাছাড়, শ্রীহট্ট কামরূপ রাজ্যের অধীনে থাকলেও এই কামরূপ অশোকের হস্তগত ছিল না বলে জানা যায়। পরে গুপ্তযুগে সমুদ্রগুপ্তের খদিতলিপি থেকে জানা যায় বাংলা এমনকি কামরূপ ও সমতট থেকে রাজস্ব পেতেন গুপ্তরাজারা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরী সমতট ও কামরূপের অবস্থান। সুয়াং ঝাং (হিউ এন সাং) তাঁর ভারত পরিভ্রমণে এই কামরূপ ও সমতটের বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর ভারত ভ্রমণকালের (৬২৯খ্রি:- ৬৪৫খ্রি:) বিবরণ অনুযায়ী বাংলা মোট ৬ ভাগে বিভক্ত ছিল- সমতট, কলিঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ, পৌণ্ড্র্ ও কামরূপ। তখন সমতট বলা হত ঢাকা ও ফরিদপুরকে, কলিঙ্গ বলা হত ত্রিপুরা ও কুমিল্লাকে, তাম্রলিপ্ত দক্ষিণবঙ্গকে, কর্ণসুবর্ণ পশ্চিমবঙ্গকে, পৌণ্ড্র বলা হত উত্তরবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ ও ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমভাগকে এবং কামরূপ বলা হত পূর্ব মৈমনসিংহ ও আসামকে। তখন এই কামরূপ ছিল প্রায় দু হাজার মাইল বিস্তৃত অঞ্চল। সুয়ান ঝাং-এর বর্ণনা অনুযায়ী তখন কামরূপের শাসক ছিলেন কুমার ভাস্কর বর্মণ। অনেকের মতে এই পৌণ্ড্র্ ও কামরূপের সীমা ছিল ব্রহ্মপুত্র নদী, এর পশ্চিম ভাগ পশ্চিম মৈমনসিংহ পৌণ্ড্রের এবং পূর্বভাগ পূর্ব মৈমনসিংহ কামরূপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অঞ্চলটি কামরূপের শাসনাধীন হওয়ার ফলে হিন্দুদের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর মৈমনসিংহ জেলা পুরোপুরি প্রাগজ্যোতিষপুরের (কামরূপের) অধীনে চলে যায়। পরে প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্য পাল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। পালবংশের রাজত্বকালের শেষের দিকে এই রাজ্যটি স্বাধীনকামী হতে শুরু করে এবং সেনদের রাজত্বকালে এই জেলা পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যায়। আরো পরে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা দুর্বল হয়ে পরলে পূর্ব মৈমনসিংহের পার্বত্যজাতির নেতারা ছোট ছোট এলাকা ভাগ করে স্বাধীনরাজ্য স্থাপন করেছিলেন যেমন- কাপাসিয়া, দুর্গাপুর, অটিয়া, শেরপুর, মধুপুর, জঙ্গলবাড়ি, মদনপুর, বোকাইনগর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি। খ্রিস্টিয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন ছোট ছোট উপজাতির রাজার কথা জানা যায়, যেমন- কাপসিয়াতে এই সময় শিশুপাল রাজত্ব করতেন, অটিয়াতে যশোপাল, মধুপুরে ভগদত্ত এবং বংশী নদীর পাড় রাজত্ব করতেন হরিশচন্দ্র নামে এক রাজা। এঁরা কখনই সেনরাজাদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। বরং এই বাংলার একেবারে পূর্বদিকের পার্বত্য অঞ্চলটি হয়ে উঠেছিল সেনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি। আঢ্য ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সেখানে নিরাপদে সেন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে পারত। তাই সেনরা এই অঞ্চলের ছোট ছোট রাজাদের আক্রমণ করে বশ্যতা পাবার চেষ্টা করত। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হত। দীনেশচন্দ্র সেন এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন- ‘সেন রাজাগণ এই সকল রাজাদের বশ্যতা পাইবার জন্য বিশেষ চেষ্টিত ছিলেন; শুধু যদি বঙ্গের এক দূর সীমান্তে ক্ষুদ্র একটা রাজ্য তাঁহাদের গণ্ডীর বহির্ভূত থাকিত, তবে বিশেষ ক্ষতির কারণ ছিলনা। কিন্তু অসুবিধা এই দাঁড়াইল যে যাঁহারা সেনদের বিদ্রোহী ছিলেন, সেই রূপ আঢ্য ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মৈমনসিংহের পার্বত্যপ্রদেশে আসিয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ অবস্থায় ষড়যন্ত্র করিবার সুযোগ পাইতেন। সেন রাজাগণ কয়েকবার এই রাজ্য অধিকার করিবার প্রচেষ্টা পাইয়াছিলেন। শরত্কালে সম্রাটসৈন্য অনায়াসে এই ক্ষুদ্র দলপতিদের সৈন্য জয় করিয়া সেনরাজাঙ্গকিত পতাকা উড়াইয়া ধ্বজা -দণ্ড প্রোথিত করিত। বর্ষাগমে সেই দণ্ডকে উত্তোলন করিয়া কে কোথায় ফেলিয়া দিত, তাহার ঠিকানা নাই। …কয়েকবার এইভাবে বহু অর্থ ও লোকক্ষয় সহ্য করিয়া সেন রাজাগণ মৈমনসিংহের পূর্বাংশ জয়ের আশা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন।‘
এছাড়া ‘পশ্চিমে বল্লালী পুবে মসনদালী’ এই প্রবাদ থেকে অনুমান করা যায় যে পশ্চিম মৈমনসিংহ বল্লাল সেন শাসন করতেন এবং পূর্ব মৈমনসিংহ ইশা খাঁ মসনদালি শাসন করতেন। সুতরাং সেন রাজারা পশ্চিম মৈমনসিংহ অধিগ্রহণ করলেও পূর্ব মৈমনসিংহ অধিগ্রহণ করতে পারেননি। ঐতিহাসিকরা একমত যে এই পার্বত্য ও জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলটি স্বাধীন ছোট ছোট আঞ্চলিক শাসকদের কাছ থেকে সরাসরি মুসলমান শাসকদের অধীনস্থ হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পাহাড় ঘেরা দুর্গাপুর অঞ্চলটি কোচবংশীয় ‘গারো’ নামের এক শাসকের অধীনে ছিল। এই রাজ্যটি বেশ বড় ছিল। ১২৮০ খ্রিঃ নাগাদ এক ব্রাহ্মণযোদ্ধা সোমেশ্বর সিংহ ঐ রাজাকে পরাজিত করেন। জানা যায় কন্যকুব্জ থেকে সোমেশ্বর পাঠক এসে তাঁকে পরাজিত করে সুসঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। সেন রাজাদের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আবার ‘ভাটি’ অঞ্চলটি ‘লম্বোদর’ নামে এক ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসী শাসন করতেন বলে জানা যায়। এদিকে শেরপুর বা দশকাহানীয়া অঞ্চলের শেষরাজা ছিলেন রাজবংশী সমাজের ‘দিলীপ সামন্ত’। দিলীপ সামন্তর প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এখনও ‘গড়জরিপা’ নামে পরিচিত। ১৪৯১ সালে রাজা দিলীপ সামন্তকে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সেনাপতি পরাজিত ও হত্যা করলে রাজ্যটি তাঁর অধীনে যায় এবং মুসলমান শাসন শুরু হয়। অপরদিকে জঙ্গলবাড়ি রাজ্যটিও কোচ রাজার থেকে মুসলমান শাসকের হাতে আসে। ১৫৮০ সালে রাম ও লক্ষণ হাজরার রাজত্ব ঈশা খাঁ অধিগ্রহণ করে দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ইতিহাস থেকেই হয়ত মৈমনসিংহ গীতিকায় বেশ কয়েকটি কাহিনীতে দেওয়ানদের কথা এসেছে। ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি জয় করার পরও কালিয়াজুড়ি, মদনপুর, বোকাইনগর বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট রাজবংশের রাজারা শাসন করেছেন।
১৪৯৩ সালে গৌড়ের সিংহাসনে বসার পর হুসেনশাহ (১৪৯৩- ১৫১৯) কামরূপ এবং সমগ্র মৈমনসিংহ অধিগ্রহণ করলে তা মুসলমান রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। পরে বাংলা থেকে কামরূপকে আলাদা করে পুত্র নসরতশাহকে (১৫১৯-১৫৩৫) সেই রাজ্যের শাসনভার দেন। আর ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে যে রাজ্য জয় করেন সেই পূর্ব মৈমনসিংহের শাসনভার খোয়াজ খাঁকে দেন, যিনি মুয়াজ্জমাবাদ থেকে রাজ্য পরিচালনা করতেন। তবে কিছুকাল পরে কামরূপের ছোট ছোট শাসকরা তাঁদের হারানো রাজ্য ফিরে পেতে নসরতশাহকে আক্রমণ করলে পরিস্থিতি বুঝে গারো পাহার পেরিয়ে সসৈন্য প্রস্থান করেন তিনি। পূর্ব মৈমনসিংহের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে এসে লুকিয়ে থাকেন এবং মুয়াজ্জামাবাদে পৌঁছে এই অঞ্চলটি শাসন করতে থাকেন। এই অঞ্চলটি পরবর্তী কালে ‘নসরতশাহী’ বলে পরিচিত হয় সুতরাং সমগ্র পূর্ব মৈমনসিংহ জেলায় একসময় নসরত শাহের আধিপত্য ছিল এ কথা বলা যায়।
পরে ১৫৭৬ সালের দিকে মোঘলদের অধীনে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল এলেও পূর্বমৈমনসিংহ আসেনি। তার আগে থেকেই কামরূপকে বারোজন ভূইঁয়া বা জমিদাররা ভাগ করে শাসন করতেন। এঁদের মধ্যে চান্দরার কেদার রায়, ভুলুয়ার লক্ষণ মানিক, চন্দ্রদ্বীপের কন্দর্প নারায়ণ, ভাওয়ালের ফজলগাজী, খিজিরপুরের ঈশা খাঁ যথাক্রমে ঢাকা, নোয়াখালি, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর ও মৈমনসিংহ শাসন করতেন। সম্রাট আকবরের বাংলার রাজস্বসচিব টোডরমল তাঁর সমস্ত নথিতে এই অঞ্চলকে নসরতশাহী ‘সরকার বাজুহা’ বলে উল্লেখ করেছেন। টোডরমল বাংলাকে ১৯ টি সরকার ও ৬৮২টি মহালে ভাগ করলেও নসরতশাহীর আয়তন ছোট করেননি। সম্রাট জাহাঙ্গীর এই ভাটিমুলুকের ‘পাঞ্জাফরমাস’ পেতেন বলে জানা যায়। ভাটি সাধারণত মেঘনা নদীর পশ্চিম ও পূর্ব মৈমনসিংহের খালিয়াজুরিকে বলা হত। যেখানে একসময় ‘লম্বোদর’ বলে এক ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসী শাসন করতেন। বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈশা খাঁ জাহাঙ্গীরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করার পর বারোভূঁইয়াদের শাসনের অবসান হলে বাংলা ও কামরূপ মোঘলদের অধিগত হয়। মাঝে কিছুদিন ছোট বড় জমিদারি শাসনের পরে ইংরেজরা আগের টোডরমলের ৬৮২টি মহালের মধ্যে ৩২টি মহাল নিয়ে নতুন করে বাজুহার’ গঠন করে। মোঘল আমলে ‘সরকার বাজুহা’র একটি অংশ মোমেনশাহ শাসন করতেন বলে জানা যায়। এই মোমেনশাহের নাম থেকে মৈমনসিংহ নাম এসেছে বলে ধারণা করা হয়। আইন- ই- আকবরিতে এই অঞ্চলকে ‘মোমেন শাহী’ মহাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকের ধারনা অষ্টাদশ শতাব্দীর পুথিকারের এবং নকলকারের বোঝা এবং লেখার ভুলে মোমেন শাহী, (বানান ভেদে ‘মোমেন সাহী’) ‘মৈমন সিংহ’ রূপ নিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ‘সরকার বাজুহা’কে ‘জেলা মৈমনসিংহ’ বলে উল্লেখ করেছে। বলা বাহুল্য ইংরেজ আমলে ১৭৮৭ সালের ১ মে জন্ম হয়েছিল জেলা মৈমনসিংহ। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ইংরেজদের ইচ্ছাতেই বঙ্গভঙ্গ হলে পূর্ববঙ্গ ও আসাম লেফটেন্যান্ট শাসনাধীন হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদী এই জেলাকে সেন রাজবংশের শাসন থেকে রক্ষা করার ফলে স্থানীয় উপজাতি গারো, হাজং, রাজবংশী, কোচ রাজাদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে সরাসরি চলে গিয়েছিল এর শাসনভার। রাজবংশী রাজারা কামরূপের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকলেও হিন্দু ধর্মের আদর্শকে ত্যাগও করতে পারেনি আবার পুরোপুরি গ্রহণও করেনি। পরবর্তীতে কামরূপ তন্ত্রসাধনার কেন্দ্রে পরিণত হলেও ততদিনে পূর্ব মৈমনসিংহ কামরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই তন্ত্রাধিকারের আগে কামরূপে যে প্রাচীন হিন্দুধর্ম প্রচলিত ছিল মৈমনসিংহ জেলায় তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা বেশী। সেই উদার সনাতন ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের মিশ্রণ ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেন রাজাদের প্রবর্তিত হিন্দুধর্ম বাংলার হিন্দুদের কাছে অভিশাপ হয়ে এল। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, কৌলীন্য প্রথা, গৌরীদান, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, ছুৎমার্গ, খাদ্যাখাদ্যের বিধিনিষেধ, পঞ্জিকার কাছে আত্মসমর্পণ প্রচলিত হল। চিরদিনই রাজ্যের শাসকের হাতে ধর্মপ্রবর্তনের চাবি থাকে আর তাঁরা ইচ্ছে মত সেটাকে ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে, সেখানে জনগণ হয়ে যায় নিরুপায়। তাই বাংলার মানুষও নিরুপায় হয়ে মানতে বাধ্য হয়েছিল শাসকের নির্দেশ। মানতে হয়েছিল সেন রাজাদের প্রবর্তিত ব্রাহ্মণ্যধর্ম। তবে যেহেতু পূর্ব মৈমনসিংহ সেনদের দখলে কোনোদিন আসেনি তাই তাদের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্তচক্ষুও এরা দেখেনি। তাদের পালাগানে অনায়াসে ব্রাহ্মণের মেয়েকে চণ্ডাল পালন করে আর চণ্ডালমাতাকে পালিত ব্রাহ্মণসন্তান প্রণাম করে, সতের বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েরা অবিবাহিত থাকে, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বাবা মায়ের আদেশ অমান্য করে নিজের পছন্দের পাত্রকে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করে। সেনরাজাদের প্রচলিত হিন্দু ধর্মে বাল্যবিবাহের নির্দেশ থাকায় মেয়েদের সাত থেকে আট বছরে বিয়ে দিতে হত, বড়জোর নয় বছর, নয় বছরেও বিয়ে দিতে না পারলে কন্যার পিতাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। এই গীতিকাগুলি প্রমাণ করে সেনযুগের বাল্যবিবাহে তারা অভ্যস্ত ছিল না। মহুয়া পালায় স্পষ্ট লেখা আছে, ‘এক দুই তিন করি শুল বছর যায়’। এখানে সতেরো বছর বয়সে নায়িকার প্রেম কাহিনী শুরু হয়েছে। বরং সে সমাজে অনুলোম বিলোম বিবাহরীতি প্রচলিত ছিল বলা যেতে পারে। সেই সমাজ শুধু পুরনো সনাতন ধর্মাচারে নয় বরং হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, সকল ধর্মের মিশ্রণে এক সুষ্ঠু সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত ছিল। আর ছিল গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব। গারোদের সমাজে নারীর মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। সন্তান তার মায়ের পরিচয়ে, মায়ের পদবীতে পরিচিত হয়। পরিবারের সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়ে মায়ের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এদের পরিবারের ছোট মেয়ে সবচেয়ে বেশি আদরের হয় এবং তারা বাবামায়ের সম্পত্তির অধিকারী হয়। ‘মলুয়া’ পালায় এই আদরের ছোট মেয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। মলুয়ার সুখের জন্য তার বাবা ও পাঁচ ভাই বেশ তৎপর থাকত। মহুয়ার সংসারে ও জীবনে চরম বিপদ এলে ভাইয়েরা এসে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছে এমন কি সম্পত্তির ভাগ দিতে চেয়েছে। রূপবতী পালাতেও রয়েছে পৈতৃক সম্পত্তিতে রূপবতী অধিকার পাবার ইঙ্গিত। গারোদের নারীর নিজের জীবন এমনকি বিবাহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। বিবাহিতা নারী ইচ্ছে করলে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারে বা স্বামীকে তালাক দিতে পারে। তাদের গোষ্ঠীগুলি মায়ের পক্ষ থেকে উদ্ভূত হয় বলে একে ‘মাচাং’ বা ‘মাহারী’ বলে। গারোরা দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে বাস করার ফলে, সেই সঙ্গে গারো শাসকদের শাসনের ফলে তাদের সমাজব্যবস্থার প্রভাব পড়ে পূর্ব মৈমনসিংহ জেলার মানুষের মধ্যে। সেখানকার মেয়েদের কাছে সেনদের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জীবাণুমিশ্রিত পবিত্র গঙ্গাজল পৌঁছায়নি, তারা ব্রহ্মপুত্রের স্বচ্ছ নির্মল জলে জীবন ধৌত করেছে।
আবার হিন্দু মুসলমান দীর্ঘদিন একসঙ্গে মিশমিশে বসবাস করেছে এই সমাজে তার চিত্রও ফুটে উঠেছে। মলুয়া পালায় কাজী, দেওয়ানের অত্যাচার প্রসঙ্গ থাকলেও তা ক্ষমতাসীন ব্যক্তির ক্ষমতার অপপ্রয়োগের নিদর্শন, তা কখনই হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচার নয়। এদিকে দেওয়ান যেমন হিন্দু মলুয়ার উপর অন্যায়, অত্যাচার করেছে, তেমনি মুসলমান কাজীকেও বিনা বিচারে শূলে চড়িয়ে দিয়েছে। আবার দেওয়ান ভাবনা পালায় দেওয়ান ভাবনা সোনাইকে জোর করে নিয়ে যেতে চাইলে সোনার মামা ভাটুক ঠাকুর সাহায্য করেছে। এই গীতিকার একদিকে অত্যাচারী কাজী, দেওয়ান জাহাঙ্গীর, দেওয়ান ভাবনা আছে তেমনি অন্য দিকে বিশ্বাস ঘাতক, অত্যাচারী, পরস্ত্রী কাতর হীরণসাধু, মগাধিপতি রাংচাপুরের আবু রাজাও রয়েছে। সুতরাং সবলের উপর দুর্বলের অত্যাচারের ছবি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় নিম্নবিত্তের প্রতি উচ্চবিত্তের প্রভাব বিস্তারের ছবি। তবে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে বসবাস করলেও তাদের জীবন যাপনের মধ্যে অদৃশ্য একটি ব্যবধান বজায় থাকত। মলুয়াকে মুসলমান দেওয়ান নিজের বাড়িতে আটকে রাখলে তাকে আর তার স্বামী ফিরিয়ে নেয় না। এ সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র পরপুরুষের ঘরে ছিল বলেই নয়, মুসলমানের ঘরে ছিল বলেও ‘মুসলমানের অন্ন খাইয়া গেল তার জাতি’। আবার জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হবার পর হিন্দু ধর্মে ফিরে আসতে চাইলে তা অসম্ভব হয়ে গেছে। চন্দ্রাবতীর বাবা তার ছোঁয়া সব জিনিস অচ্ছুৎ ঘোষণা করেছে। হিন্দুর ছেলে কঙ্ক মুসলমান পীরের কাছে যাতায়াত করে বলে তাকে সমাজপতিরা জাতিচ্যুত করেছে। এই সামাজিক জীবনে ধর্মীয় কারণে ব্যবধান ছাড়াও সম্প্রীতির চিত্র আছে যা মিলন ও সহাবস্থানকে চিহ্নিত করে। পালার শুরুতে বন্দনা করা হয় হিন্দু দেবদেবী ও মুসলমান পীরকে কারণ দর্শকাসনে বা শ্রোতার আসনে থাকত হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই। তখনও ব্রিটিশের বিষাক্ত ভেদনীতির প্রভাবে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরোধ শুরু হয়নি। এই নিম্নবিত্তের হিন্দু মুসলমানরা বেশিরভাগ নিরক্ষর হলেও বোকা ছিল না। মূল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও বাঙ্গালীর সংস্কৃতিকে যেমন রক্ষা করেছে তেমনি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকেও বহন করেছে। তবে একথাও বলতে হয় উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান (মুসলমানদেরও বর্ণভেদ আছে যেমন সৈয়দ, পাঠান, মোঘল, কুলু, প্রভৃতি) সম্প্রদায় এই পূর্বমৈমনসিংহের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের নিম্নশ্রেণির মানুষের থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখত। তারা কাশি-বারাণসী, মক্কা-মদিনার মহাসাগরের নোনাজলে তর্পণ-দোয়া করার নেশায় ঘরের পাশের মিষ্টি জলের মৎসসমৃদ্ধ পুকুরকে অবহেলাই করত। তাই নিম্নবর্ণ ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো নিজেদের সুখ দুঃখের ভাগ করে নিত নিজেদের মধ্যেই। আর এই সুখ দুঃখের আগুনে পুড়েই তাদের বিশুদ্ধমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধাগা পড়েছিল।
আশুতোষ ভট্টাচার্য ভাষায়- “মৈমনসিংহ গীতিকার চরিত্রগুলি হিন্দুও নহে, মুসলমানও নহে; কারণ হিন্দুর সমাজ-নীতি যেমন ইহারা স্বীকার করে নাই, মুসলমান-সমাজনীতিও ইহাদের মধ্যে অস্বীকৃত হইয়াছে। অতএব ইহাদের যদি কোনও পরিচয় প্রকাশ পাইয়া থাকে তবে তাহা এই যে তাহারা মানুষ।” তাই অনায়াসে হিন্দু মেয়ে মুসলমান ছেলের প্রেমে পড়ে, আবার হিন্দু ছেলে মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে। বুঝতে অসুবিধা হয়না মৈমনসিংহ গীতিকা কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি নয়, গানগুলি ধর্ম-বোধ নিরপেক্ষ মানব সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। আর এই ধর্ম-বোধ নিরপেক্ষ মানব সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছে যে ক্ষেত্রে তাকে আগলে রেখেছিল তার ভৌগোলিক অবস্থান, পালন করেছিল রাষ্ট্রের ইতিহাস, আর বৈমাত্রেয় দুগ্ধ পান করিয়ে পুষ্ট করেছিল গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। তাই তথাকথিত চাষিদের গানে যেমন পাওয়া যায় না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ছবি তেমন কোনো নায়িকাকেই বলতে শোনা যায়না, ‘আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার!”
তথ্যসূত্র-
১) মৈমনসিংহের ইতিহাস- কেদারনাথ মজুমদার।
২) মৈমনসিংহের বিবরণ- কেদারনাথ মজুমদার।
৩) মৈমনসিংহ গীতিকা- দীনেশচন্দ্র সেন।
৪) মৈমনসিংহ গীতিকা পুনর্বিচার- মুনমুন সেন।
৫) মৈমনসিংহ ও প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা- আশিস ঘোষ।
মূল্যবান রচনা। পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কিছু প্রশ্ন জাগলো। মৈমনসিংহের গীতিকাররা কী রাজানুগ্রহ পেয়েছিলেন? সেই সময় যে কাব্য রচিত হয় সবই কী পুঁথি আকারে সংগৃহীত হয়েছিল? হিন্দু বৌদ্ধ ইসলাম ধর্মের মেলবন্ধন ঘটলেও সেখানে কী বিষ্ণু দেবতা হিসেবে বিশেষ স্থান পাননি? আবার তন্ত্রসাধনা একেবারেই উপেক্ষিত হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ ছিল কী? আর একটা কথা- যেখানে নদীমাতৃক সংস্কৃতির প্রভাব, সেখানে নারীর সমানাধিকার প্রশ্নটি উল্লেখযোগ্য হলো কী করে? এমন তো সুন্দরবনের মানুষদের মধ্যে চোখে পড়ে না। একটু যদি আলাদা করে বলেন, ভালো হয়। খুব ভালো লিখেছেন। সমৃদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ।
মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হবে ‘না’। তবে রচনাকারদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হল যে গান গুলো সংগ্রহ করা গেছে সেগুলি সবই গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে, যেমন পূর্ব বঙ্গ গীতিকা, প্রাচীন পূর্ব বঙ্গ গীতিকা, রংপুর গীতিকা ইত্যাদি। আপনার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর হবে হ্যাঁ বৈষ্ণব ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছিল। তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান কামরূপ থেকে রাজনৈতিক কারণে মৈমনসিংহ আলাদা হয়ে গেলে ঐ অঞ্চলে তন্ত্রসাধনা কিছুটা হলেও উপেক্ষিত হয়। পরের প্রশ্নটি আমার কাছে স্বচ্ছ না হওয়ায় উত্তর দিতে পারলাম না, আর একটু পরিষ্কার করে লিখলে হয়ত দিতে পারব। ধন্যবাদ ।
প্রবন্ধটার হিন্দু মুসলিমদের সামাজিক আচারের আলোচনাটা ভালো লাগলো। কিছু জায়গায় খটকা লাগলো:
১. ঈশাখান মারা যান ১৫৯৯ তে আর বল্লাল সেন ১১৭৯, মধ্যে ৪০০ বছর।
২. হাওর না দেখলে হাওরকে বিল বলা যায়। ভাটি এলাকার অনেক হাওরেই দিগন্ত দেখা যায় না।
৩. ১৫৭৫ এ গৌড়ের পতন হলেও পূর্ববাংলার প্রায় পুরোটাই স্বাধীন ছিল। টোডার মলের যে হিসাব আমরা আইনে আকবরীতে পাই সেটা দাউদ কররানীর হিসাব যা দাউদের বিশ্বাসজ্ঞাতক মন্ত্রী মোঘলদের দে। বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধের জন্য ঢাকা মোগলদের হাতে পরে ১৬১০এ ইসলাম খানের নেতৃত্বে। ভাটিতে মগোলরা ১৫৭৫/৭৬ এ যুদ্ধ করলেও ভাটি তাদের হাতে আসে ওই ঢাকা জয়ের পরপর, সিলেটে ওসমান খানের পরাজয়ের পর।
প্রবন্ধটার হিন্দু মুসলিমদের সামাজিক আচারের আলোচনাটা ভালো লাগলো। কিছু জায়গায় খটকা লাগলো:
১. ঈশাখান মারা যান ১৫৯৯ তে আর বল্লাল সেন ১১৭৯, মধ্যে ৪০০ বছর।
২. হাওর না দেখলে হাওরকে বিল বলা যায়। ভাটি এলাকার অনেক হাওরেই দিগন্ত দেখা যায় না।
৩. ১৫৭৫ এ গৌড়ের পতন হলেও পূর্ববাংলার প্রায় পুরোটাই স্বাধীন ছিল। টোডার মলের যে হিসাব আমরা আইনে আকবরীতে পাই সেটা দাউদ কররানীর হিসাব যা দাউদের বিশ্বাসজ্ঞাতক মন্ত্রী মোঘলদের দে। বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধের জন্য ঢাকা মোগলদের হাতে পরে ১৬১০এ ইসলাম খানের নেতৃত্বে। ভাটিতে মগোলরা ১৫৭৫/৭৬ এ যুদ্ধ করলেও ভাটি তাদের হাতে আসে ওই ঢাকা জয়ের পরপর, সিলেটে ওসমান খানের পরাজয়ের পর।
৪. মোগল, সৈয়দ, খান এরা ভিন দেশি আর শাসক গোষ্ঠীর অংশ। এদেরকে ঠিক জাত পাতের হিসাবের মধ্যে নেয়াটা ঠিক হবে না।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্য থেকে অনেক সমৃদ্ধ হলাম। প্রথমত বলি, বল্লাল সেনের সময় ব্রহ্মপুত্রের পূর্বদিকে কারা রাজত্ব করতেন এবং তাদের সঙ্গে বল্লাল সেনের কী সম্পর্ক ছিল তা এখানেই আলোচনা করেছি। পরে একটি প্রবাদ উল্লেখ করেছি যেখানে বল্লাল সেন ও ইশা খাঁ র কথা রয়েছে। মনে রাখতে হবে এটি একটি প্রবাদ যা সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়, মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে। তা আমি বা কোনো লেখক রচনা করেন নি। প্রবাদ যে এখানে সমসাময়িকতা বুঝিয়েছে তা নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে সাধারণ মানুষ এই প্রবাদের মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে একসময় পশ্চিম মৈমনসিংহে বল্লাল সেনের যে প্রতাপ ছিল পরে সেই রকম প্রতাপ পূর্ব মৈমনসিংহ তে ইশা খাঁ র ছিল। সেখানে যুগ বা কাল বড় নয়। তাদের কাছে প্রতাপটাই বড়। যেমন অনেকে বলেন, ‘যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ ‘। এর মানে এটা বোঝায় না যে অযোধ্যার রাম ও দ্বারকানাথ কৃষ্ণ একই যুগের বা একই ব্যক্তি। আসলে এই কথাটির অর্থ অন্য, যারা বলে তাদের ধারণা দুজনেই বিষ্ণুর অবতার, সেই হিসাবে এক। আপনার আর একটি কথা লাগল সেটা হল বিল বা হাওর। মৈমনসিংহ যাবার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও আমার যাবার সৌভাগ্য হয়নি। তাই হাওর দেখা হয়নি। তাই তথ্যসূত্র গুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। তবে আমার বাড়ির পাশে একটি বিল আছে সেখানেও দিগন্ত দেখা যায় না । তার নাম চাঁদবিল। যাইহোক আপনার মন্তব্য আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। ধন্যবাদ নেবেন।
ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর চমৎকার উপস্থাপনায় মুগ্ধ হলাম।
মৈমনসিংহ গীতিকাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে জেলার ভৌগোলিক অবস্থান ও ইতিহাস জানা জরুরী, পাঠকদের সামনে সেটা তুলে ধরতে এই লেখা। ধন্যবাদ নেবেন।