মৈমনসিংহ গীতিকাঃ বাঙালের প্রেমগাথার ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বাংলার লোকগীতিকাগুলি একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বাংলা গীতিকাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছেন – ক) নাথ গীতিকা, খ) মৈমনসিংহ গীতিকা, গ) পূর্ববঙ্গ গীতিকা। জনপ্রিয়তার রাজপথে নাথ সাহিত্যকে পিছনে ফেলে মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সহস্র যোজন এগিয়ে গেছে। মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকাতে জাতি সম্প্রদায়হীন মানব প্রেমের মহিমা এবং লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাস্তব জীবনের সুখ দুঃখের কথা বর্ণিত আছে। আর আছে শতাব্দী- প্রাচীন মাটি, জল, বাতাস, বন-জঙ্গল আর ইতিহাসের গন্ধ।
ব্রিটিশ শাসিত বাংলার “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির” অন্তর্ভুক্ত মৈমনসিংহ জেলা ছিল বড় জেলাগুলির একটি। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে তখন মৈমনসিংহ জেলার উত্তরে ছিল গারো পাহাড়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকটিতে ছিল স্যাঁতসেঁতে জলাকীর্ণ কর্দমাক্ত নিম্নভূমি। ধনু, কংশাই, সুতি, সুরনন্দা, ঘোরাউত্রা প্রভৃতি নদনদী প্লাবিত অঞ্চল। এ অঞ্চলটিতে ছিল আদিবাসী ও পাহাড়ি জাতির আনাগোনা। এর ফলে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির ছোঁয়া এই অঞ্চলের মানুষ খুব বেশি পায়নি। মৈমনসিংহের নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বাতাসে ভেসে বেড়াত এক বিশেষ ধরনের আখ্যানধর্মী কাব্য বা গাথার সুর – নরনারীর প্রেমের সুর। সপ্তদশ – অষ্টাদশ শতাব্দীতে মানুষের মুখে মুখে রচিত এই গানে গায়েনরা সুর দিয়ে গেয়ে বেড়াত। তার ফলে মুখে মুখেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এই গান। এখানকার নিম্নবর্গ ও নিম্নবিত্ত মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছিল এই গান বা গাথাগুলি। পূর্ববাংলার মৈমনসিংহ ছাড়াও সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কবিরা (বেশির ভাগই প্রথাগত শিক্ষাহীন) এই গান রচনা করেছিলেন। এঁরা হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবি ছিলেন। মূলত প্রণয় ঘটিত রোমান্টিক ঘটনা ও অন্যান্য সামাজিক ঘটনা নিয়ে ছড়া পাঁচালির ঢঙে আখ্যান কাব্যগুলি রচিত হয়েছিল। এগুলি কাহিনীমূলক হওয়ার কারণে অভিনীত হত। এই অঞ্চলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই পালাগানের আয়োজন করা হত। সেখানে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের মানুষ পালাগান শুনতে আসত। “মহুয়া” নামের পালার প্রথম দিকে আছে-
“সভা কইর্যা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান ।/
সভার চরণে আমি জানাইলাম সেলাম।”
এখানে হিন্দু অর্থে “ইন্দু” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। পালাগানগুলি রচনা পরিবেশনা ও আস্বাদনে হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মের মানুষের সমান ভূমিকা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানরা ভারতবর্ষ শাসন করার ফলে হিন্দু ও মুসলমানের সামাজিক মেলবন্ধন ঘটেছিল। সমাজে তারা মিলেমিশে বসবাস করত এবং তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তার প্রমাণ বহন করে এই পালাগানগুলি। “মহুয়া” পালায় দ্বিজ কানাই বন্দনা অংশে আরও বলেছেন-
“উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্ব্বত।/
যেখানে পড়িয়া আছে আলি সালামের পাথ্থর ।।/
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এনস্থান।/
উর্দিসে বাড়াইছিলাম মোমিন মুসলমান।।”
দ্বিজ কানাই কৈলাসের বন্দনার পাশাপাশি মক্কারও বন্দনা করেছেন। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছেন ।
এই পালা গানের গায়েনদের বায়না করে আনা হত। গানের শেষে পারিশ্রমিকও দেওয়া হত। অর্থাৎ এক শ্রেণির মানুষের জীবিকা ছিল এই পালাগান। কঙ্ক ও লীলার কাহিনীর শেষে এক জায়গায় গায়েনের নিবেদনে আছে-
“দারুণ মাঘের শীতে অঙ্গে বস্ত্র নাই।/
কর্ম্মকর্তার কাছে একখান শীতের কাপর চাই।/
ইনাম বকসিস চাই কর্ম্মকর্তার বাড়ি।/
বছর বছর যেন গান গাইতে পারি।”
এই গানগুলির মধ্যে বেশির ভাগ গানের বিষয়বস্তু ছিল পূর্ববাংলার পাড়াগাঁয়ের নরনারীর প্রেম। অন্যান্য বিষয় নিয়েও গান রচনা করা হয়েছিল, যেমন- জমিদারের সঙ্গে বিরোধ, হাতী-খেদা, তীর্থস্থান নিয়ে কলহ ইত্যাদি। বেশির ভাগ গানে মৈমনসিংহ জেলার নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্ণের মানুষের প্রেমের কথা, সুখ দুঃখের কথা রয়েছে। এগুলি সবই লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনী। তবে বেশি জনপ্রিয় ছিল প্রেমের কাহিনীগুলি। এখানে প্রেমিক/প্রেমিকা শুধু প্রেমের জন্য জাতি, ধর্ম, বিসর্জন দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে অভিভাবকের অমতে বেদের মেয়েকে বিয়ে করেছে। দেখা যায় “মহুয়া” পালায় নদের চাঁদের আত্মনিবেদন —
“জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।/
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।।”
আবার মহুয়ার প্রেমে মাতয়ারা নদের চাঁদ বলেছে-
“কোথায় পাইবাম কলসী কইন্যা ,/
কোথায় পাইবাম দড়ি।।/
তুমি হও গহীন গাঙ,
আমি ডুইব্যা মরি।।”
আবার মহুয়াকে বিয়ে করতে চেয়ে বলেছে-
“মা ছাড়বাম বাপ ছাড়বাম ছাড়বাম ঘর বাড়ী ।/
তোমারে লইয়া কইন্যা আইয়াম দেশান্তরী ।।”
অসাধারণ কাব্যগুণে ভরপুর এই পালাগানটি মৈমনসিংহ গীতিকার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ।
“কঙ্ক ও লীলার” কাহিনীতে লীলা কঙ্ককে ভালোবেসে বলেছে-
“তুমি লে ভোমরা বন্ধু আমি বনের ফুল/
তোমার লাইগ্যা রে বন্ধু ছাড়বাম জাতি কূল।।”
গানগুলিতে মূলত প্রেমের জয়গান গাওয়া হয়েছে হয়েছে।
“পথ নাহি দেখিরে বন্ধু ঝুরে আঁখি জলে।/
পাগলিনী হইয়া ফিরি তিলেক না দেখিলে।।”
স্বাধীনভাবে জীবনসঙ্গী বেছে নেবার স্বীকৃতি রয়েছে গানের মধ্যে। ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধে গিয়ে জীবনসঙ্গী মনোনয়নের জন্য গৃহ ত্যাগ করেছে – এমন বাস্তবতায় ভরা এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে গানগুলিতে। এই গানের কাহিনীতে নারী চরিত্রকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই নারী চরিত্রের মূল আদর্শ হল একনিষ্ঠ প্রেম।
আর সেই প্রেমেই ভেসে গেছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সাম্প্রদায়িকতা ও জাত্যভিমান। বেশ কিছু পালার নামকরণ করা হয়েছে প্রধান নারী চরিত্রের নামে, যেমন- মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, কাজলরেখা, রূপবতী। এ থেকে বোঝা যায় যে ঐ সময়ে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নারীদের বিশেষ সম্মান দিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসিত বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে যখন শিক্ষিত ব্যক্তিরা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে, নারী শিক্ষা চালু করতে আর সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে প্রাণপণ লড়াই করছেন, তখন এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নারীকে স্বাধীন ভাবে জীবন সঙ্গী বেছে নেবার স্বীকৃতি দিয়েছে। নারীর সুখ দুঃখকে প্রাধান্য দিয়েছে।
পূর্বোক্ত প্রেমগাথার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল “মহুয়া” পালা। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে (দিল্লির সিংহাসনে শাহজাহান কিংবা ঔরঙজেব) পূর্ববাংলার নমশূদ্র ব্রাহ্মণ কবি দ্বিজ কানাই এই পালাটি রচনা করেন। এতে যে কাহিনী পাওয়া যায়, তা হল-
“হুমরা বেদে নামের এক ডাকাত এক ব্রাহ্মণের শিশুকন্যাকে চুরি করে নিয়ে যায় এবং নিজের কাছে রেখে বড় করে। হুমরা বেদে মেয়েটির নাম দেয় মহুয়া। বেদেদের খেলা দেখতে গিয়ে মহুয়াকে দেখে ভালো লেগে যায় ব্রাহ্মণের ছেলে নদের চাঁদের। মহুয়াও নদের চাঁদকে ভালোবেসে ফেলে। ওদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হুমরা বেদে জানতে পেরে ঐ গ্রাম থেকে চলে যায়। নদের চাঁদ মহুয়ার বিরহে উন্মাদের মত হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কংশাই নদীর তীরে মহুয়ার দেখা পায়। কিন্তু হুমরা বেদে বিয়ে দিতে অসম্মত হয়। হুমরা বেদে মহুয়ার হাতে একটি ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে খুন করতে বলে। মহুয়া তা না করে নদের চাঁদকে সব কথা খুলে বলে। পরে দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। অনেক বিপদ কাটিয়ে তারা সংসার পাতে। হুমরা বেদে ওদের খোঁজ পায়। মহুয়াকে আবার একটা ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে খুন করতে বলে। মহুয়া এবার ঐ ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে হত্যা করে। তারপর কবর খুঁড়ে এক কবরে দুজনকে কবর দেয়। মোট ৯৮৬ ছত্রে ২৪টি অঙ্কে দ্বিজ কানাই প্রেমগাথাটি রচনা করেন।
মহুয়া পালার একটি গ্রাম্যরূপ রয়েছে। তার নাম “বাদ্যানীর গান”। মৈমনসিংহের “মালো” গ্রাম নিবাসী পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে এই বাদ্যানীর গান রচনা করেন। এখানে মহুয়ার নাম “মেওয়া” এবং হুমরা বেদের নাম “উন্দরা বেদে”। এটি প্রাচীনতর এবং আয়তনে মহুয়া পালার দ্বিগুণ। এই পালাটি পূর্ববঙ্গে এতটাই জনপ্রিয় যে, এই কাহিনী নিয়ে যাত্রা পালা ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
মহিলা কবি চন্দ্রাবতী রচিত “মলুয়া” পালায় আছে – গ্রামের মোড়লের সুন্দরী মেয়ে মলুয়া আর গরিবের ছেলে বিনোদের প্রেমের কথা। তাদের প্রেমের কথা জানিয়ে মলুয়ার বাড়িতে বিয়ের সম্মতি চাইলে মলুয়ার বাবা গরিব বিনোদের সঙ্গে বিয়ে দিতে অসম্মত হয়। একবার অতিথি বিনোদকে আপ্যায়নের জন্য মলুয়ার বাপের বাড়ির পাঁচ বৌ মিলে বত্রিশ রকমের পদ রান্না করেছিল। তা থেকে মলুয়ার বাপের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা যেমন জানা যায়, তেমন সেই সময়ের কিছু খাবারের নামও পাওয়া যায়।
“মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার।/
মাছের সুরুয়া রান্ধে জিরার সম্বার।।/
কাইট্টা লইছে কই মাছ চরচরি খারা।/
ভালা কইরা রান্ধে বেনুন দিয়া কালাজিরা ।।/
একে একে রান্ধে সব বেনুন ছত্রিশ জাতি ।/
শুকনা মাছ পুইড়া রান্ধে আগলে বেসাতি।।/
পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিনোদ পিড়িত বস্যা খায়।/
এমন ভোজন বিনোদ জন্মে নাই সে খায়।।/
শুকত খাইল বেনুন খাইল আর ভাজা বরা।/
পুলিশ পিঠা খাইল বিনোদ দুধের শিস্যায় ভরা।।”
বড়লোকের মেয়ে ও পাঁচ ভাইয়ের আদরের বোন মলুয়াকে বিয়ে করার জন্য বিনোদ কুড়া (এক ধরনের পাখি) শিকার করে অনেক অর্থ উপার্জন করে এবং ফিরে এসে মলুয়াকে বিয়ে করে। বিনোদ নিজের গ্রামে সংসার পাতে। গ্রামের দেওয়ান মলুয়ার রূপে আকৃষ্ট হয়ে মলুয়াকে বিয়ে করতে চায়। মলুয়া রাজি না হলে দেওয়ান ও কাজীর চক্রান্তে বিনোদ সম্পত্তি হারায়। মলুয়ার গায়ের গয়না বেচে সংসার চলে-
“নাকের নাকছাবি বেচ্যা মলুয়া আষাঢ় মাস খাইল।/
গলার সে মতির মালা তাও বেচ্যা খাইল।।/
শাওন মাসেতে মলুয়া পায়ের ঘাড়ু বেচে।/
এত দুঃখ মলুয়ার কপালেতে আছে।।”
অর্থ উপার্জনের জন্য বিনোদ বাইরে গেলে দুষ্টু কাজী মলুয়াকে তুলে নিয়ে গিয়ে দেওয়ানকে ভেট দেয়। দেওয়ান মলুয়াকে বিয়ে করতে চাইলে বিভিন্ন অজুহাতে মলুয়া নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু বিনোদ আর মলুয়াকে ঘরে নিতে চায় না। সে আবার বিয়ে করে। মলুয়া বাপের বাড়ি না গিয়ে বিনোদের ঘরে দাসীর মত পড়ে থাকে। বিনোদকে সাপে কামড়ালে মলুয়া ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে তোলে। বিনোদ মলুয়াকে ঘরে নিতে চায়। কিন্তু বিনোদের আত্মীয়স্বজন বিরোধিতা করে। মলুয়া অভিমান করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে। মোট ১২৪৭ ছত্রে ১৯টি অঙ্কে কবি চন্দ্রাবতী এই পালাটি রচনা করেন।
কবি দ্বিজ ঈশান ১৩২০ ছত্রে ১৭টি অঙ্কে রচনা করেন “কমলা” নামে একটি প্রেমগাথা। এখানে রাজা জানকী নাথ স্ত্রীর আবদার মেটাতে কমলার নামে একটি সায়রদিঘি খনন করান। কিন্তু দিঘীতে জল না ওঠায় কমলা আশঙ্কিত হয়। স্বামীর অমঙ্গল হবে ভেবে সে ঐ দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেয়। কমলার শোকে রাজাও প্রাণ ত্যাগ করেন। এই পালার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এই পালায় দেবী সরস্বতীর আহ্বান করা হয়েছে । কবি দ্বিজ ঈশান লিখেছেন –
“আইসো মাগো সরস্বতী তোমার গুণ গায়।/
তোমার গান গাইতে আমি অমৃত সুধা পায়।।/
তুমি হও তালযন্ত্র, আমি বাদ্য কর।/
আজিকার আসরে মোর কণ্ঠে করো ভর।।”
“চন্দ্রাবতী” পালায় আছে চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের প্রেমের কাহিনী। চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দ ছিল বাল্যকালের খেলার সাথী। পরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জয়ানন্দ ঘটকের মাধ্যমে চন্দ্রাবতীর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। চন্দ্রাবতীর বাবা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়। বিয়ের আয়োজন চলাকালীন জয়ানন্দ এক সুন্দরী মুসলমান রমণীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করে। চন্দ্রাবতী একথা জানতে পেরে শোকে দুঃখে পাথর হয়ে যায়।
“না কান্দে না হাসে কইন্যা নাহি কয় বাণী।/
আছিল সুন্দরী কইন্যা হইল পাষাণী।।/
এমনিতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।/
জানিতে না দেয় কইন্যা জ্বইল্যা মরে মনে।।”
তার বাবা তাকে মহাদেবের পূজা করতে ও রামায়ণ রচনা করতে উপদেশ দেন। চন্দ্রাবতী বাবার আদেশ পালনে মন দেয়। কিছু দিন পরে জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে দেখা করার জন্য চিঠি দেয়। চন্দ্রাবতী বাবাকে জানালে তার বাবা তাকে মহাদেবের ধ্যান করার নির্দেশ দেন। চন্দ্রাবতী মন্দিরের দরজা বন্ধ করে মহাদেবের ধ্যান করতে লাগে। তখন জয়ানন্দ এসে মন্দিরের দরজার বাইরে থেকে অনেক অনুরোধ করলেও চন্দ্রাবতী দরজা খোলে না।
জয়ানন্দ বলে-
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।/
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই।।/
আর না দেখিব তোমায় নয়ন চাহিয়া।/
দোষ ক্ষমা কর কইন্যা শেষ বিদায় দিয়া।।”
পরে মন্দিরের গায়ে বিদায়বাণী লিখে রেখে নদীর জলে প্রাণ বিসর্জন দেয়। চন্দ্রাবতীর ধ্যান শেষ হলে সেই বাণী পড়ে। কিন্তু মুসলমান জয়ানন্দের স্পর্শে মন্দির অপবিত্র হয়েছে বলে নদীর জলে স্নান করতে গেলে জয়ানন্দের মৃত দেহ ভাসতে দেখে। তারপর শোকে দুঃখে চন্দ্রাবতী পাথর হয়ে যায়।
“দেখিতে সুন্দর নাগর চান্দের সমান ।/
ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নুমাসী চান।।/
আখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।/
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উন্মত্ত্যা কামিনী।।
স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দন নয়ান চান্দের গায়।/
নিজের অন্তরের দুঃখু পরকে বুঝান দায়।।”
এই পালার রচয়িতা নয়ানচাঁদ ঘোষ। ১২টি অঙ্কে ৩৮৩টি ছত্রে প্রেমের কাহিনীটি রচিত হয়েছে। এই পালার নায়িকা চন্দ্রাবতীই বাংলায় রামায়ণ অনুবাদ করেন (সপ্তদশ শতাব্দীতে)। তাঁর অনুবাদ করা রামায়ণ “চন্দ্রাবতী রামায়ণ” নামে খ্যাত। মনসা মঙ্গলের অন্যতম রচয়িতা বংশী দাস এই চন্দ্রাবতীর পিতা ছিলেন।
“কাজলরেখা” একটি রূপকথা মূলক প্রেমকাহিনী। কাজলরেখা ছিল বিত্তশালী ব্যবসায়ীর মেয়ে। রূপে অসামান্য সুন্দরী ছিল কাজলরেখা। কবি বর্ণনা দিয়েছেন-
“হীরা মোতি জ্বলে কইন্যা যখন নাকি হাসে।/
নূতন বর্ষায় যেমন পদ্ম ফুল ভাসে।।”
কাজলরেখার পিতা জুয়া খেলে নিঃস্ব হয়ে গেলে কাজলরেখাকে শুকপাখির কথায় গভীর বনে রেখে আসে। সেখানে সে একটি ভাঙা মন্দিরে অসংখ্য সূচ ফোটানো মৃতপ্রায় এক রাজকুমারকে শুয়ে থাকতে দেখে। সূচকুমারকে বিয়ে করতে বলে এক সন্ন্যাসী। সূচকুমারকে বিয়ে করে তাকে জীবন দান করলেও স্বামী হিসাবে তাকে পায় না। কঙ্কনাদাসীর কৃতঘ্নতার কারণে সে স্বামীর রাজ্যে দাসীর মতো থাকে। পরে অবশ্য সূচকুমার সব জানতে পারে। কাজলরেখা কাহিনীর রচয়িতার নাম জানা যায় না। তবে পালাটি রূপকথাধর্মী হলেও কাজলরেখা আর কঙ্কনাদাসীর প্রতি পিতার অন্যায়, নিষ্ঠুর পিতার কন্যা সন্তানকে অনিশ্চিত জীবনে ফেলে যাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনার কুশলতা কবির বাস্তববোধ ও বিশেষ কবিত্ব-শক্তির পরিচয় বহন করে।
চন্দ্রাবতী, কঙ্ক লীলা, কাজলরেখা, রূপবতী এসব পালার মূল কাহিনীও নরনারীর প্রেম। এর মধ্যে কাজলরেখা পালাটি রূপকথার গল্প হলেও সে কাহিনী বাস্তবতার উপাদানে ভরপুর। এই প্রেমে কোনও আধ্যাত্মিকতা নেই, প্রেমের তপস্যা আছে কিন্তু আড়ম্বর নেই। এ প্রেম স্বর্গীয় নয়, পার্থিব। পারিজাতের মত মোহনীয় নয় শতদলের মত মনোলোভা। এ প্রেম দেব-দেবীর বা সাধক-সাধিকার নয়, বরং পাড়াগাঁয়ের নরনারীর প্রেম-
“ধেনু বত্স হইয়া তুমি যাওরে বাথানে।/
বন্দের লাইগ্যা থাকি চাইয়া পথ পানে।/
কয়েকশো বছর ধরে মৈমনসিংহের বাতাসে ভেসে থাকা এই গাথাকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মৈমনসিংহের সন্তান চন্দ্র কুমার দে কলমবন্দী করেন। তিনি তা বাংলার তথা কলকাতার শিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। চন্দ্র কুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬) মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনা উপজেলার আইথর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় বাবা মা দুজনেই মারা যাওয়ার ফলে প্রথাগত শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তিনি অল্প স্বল্প সংস্কৃত জানতেন। অল্প বয়সে গ্রামের একটি মুদির দোকানে মাসিক একটাকা বেতনে কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু কাজে মনোযোগ না থাকায় কাজ ছেড়ে যায়। পরে ঐ গ্রামে তারকনাথ তালুকদারের কাছে কর আদায়ের কাজ পান মাসিক দু’টাকা বেতনে। আরও পরে গৌরীপুরের জমিদারিতে গোমস্তার কাজ পান মাসিক আট টাকা বেতনে। এই সময় কর আদায়ের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হত তাঁকে। তখনই এই গ্রামে প্রচলিত পালাগানের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। দরিদ্র চাষিদের মুখ থেকে অনেক অনেক গান সংগ্রহ করতেন। কর আদায় করতেন কম, গান শুনতেন বেশি। তিনিই প্রথম এই গান বা আখ্যানকাব্যগুলি সংগ্রহ করে লিখে রাখেন। এই সময় মৈমনসিংহ থেকে “সৌরভ” নামে একটি অতি উত্কৃষ্ট মানের পত্রিকা প্রকাশিত হত। কেদারনাথ মজুমদার পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। বাইশ/তেইশ বছরের যুবক চন্দ্র কুমার দে ১৯১২ খ্রিঃ থেকে প্রবন্ধ লিখতেন এই পত্রিকায়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল সংখ্যা থেকে “মালীর যোগান” নামে লোকসাহিত্যের ওপর লেখা প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রচলিত কতগুলো গান কবিতার মতো করে প্রকাশ করেন।
এই প্রবন্ধ পড়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার ও সেনেটের সদস্য দীনেশচন্দ্র সেন অত্যন্ত উত্সাহিত হন। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামের সন্তান ড. দীনেশচন্দ্র সেনও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। বাংলাদেশের কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ ছেড়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯০৫ খ্রিঃ-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পরীক্ষকের পদে যোগ দিয়েছিলেন। পরে বাংলা রিডারের পদে যোগ দেন (১৯০৯)। পরের বছর সেনেটের সদস্য হন। ১৯১৩ খ্রিঃ-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ পান। ১৯২১ খ্রিঃ-এ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে “রায় বাহাদুর” উপাধি লাভ করেন। তিনি চন্দ্রকুমার দে-কে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাহকের কাজ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যন্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সম্মতিতে সত্তর টাকা মাসিক বেতন দিয়ে তাকে নিয়োগ করা হয়। মৈমনসিংহ তথা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে এই ধরনের আখ্যান কাব্য বা গাথা সংগ্রহ করার কাজে আরও কয়েক জনকে নিয়োগ করা হয়। কবি জসীমউদ্দীন, আশুতোষ চৌধুরী, নগেন্দ্র চন্দ্র দে, বিজনবিহারী লাল, রজনীকান্ত ভদ্র প্রমুখ ব্যক্তিকে এই কাজে নিযুক্ত করা হয়। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কাজে দীনেশচন্দ্র সেনকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করে ছিলেন। অবশেষে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ দীনেশচন্দ্র সেন, চন্দ্র কুমার দের সংগ্রহ করা গানগুলি হাতে পান। এই গানগুলি বেশির ভাগই মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ থেকে সংগৃহীত। ১৯২৬ খ্রিঃ-এ মোট দশটি গানকে লিপিবদ্ধ করে দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এই খণ্ডটির নাম দেন “মৈমনসিংহ গীতিকা”। এখানে যে দশটি আখ্যানকাব্য আছে তা হল- মহুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ানা মদিরা, দস্যু কেনারামের পালা, মলুয়া, কঙ্ক ও লীলা, দেওয়ান ভাবনা, কাজলরেখা ও রূপবতী। এর মধ্যে চন্দ্রাবতী, দেওয়ান ভাবনা ও কমলা -এই পালা তিনটি পত্রাকারে রচিত। বিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মানুষ এই কাব্যের খুব প্রশংসা ও সমাদর করলেন। পরে মৈমনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে আরও অনেক গান পাওয়া যায়। আশুতোষ চৌধুরী ‘নিজাম ডাকাতের পালা’, ‘কফিনচোরা’, ‘ভেলুয়া’, ‘হাতী-খেদা’, ‘কমল সদাগর’ ও ‘সুজা-তনয়ার বিলাপ’ সংগ্রহ করেন। বিহারীলাল রায় ‘মানিকতারা বা ডাকাইতের পালা’, ‘বার তীর্থের ডাক’ সংগ্রহ করেন। নগেন্দ্র চন্দ্র দে ‘মাঞ্জুর মা’, ‘রাজা রঘুরপালা’, ‘বীর নারাণের পালা’ সংগ্রহ করেন। সেগুলি সঙ্গে আরও পালা সংগ্রহ করে তিনটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এদের নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’। চারটি খণ্ড মিলে (প্রথম খণ্ডে ১০টি, দ্বিতীয় খণ্ডে ১৪টি, দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় সংখ্যায় ১১টি, চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় সংখ্যায় ১৯টি) মোট চুয়ান্নটি গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয় খণ্ডের গীতিকাগুলি হল- ‘ধোপার পাট’, ‘মইষাল বন্ধু’, ‘কাঞ্চনমালা’, ‘শান্তি’, ‘নীলা’, ‘ভেলুয়া’, ‘কমলারাণীর গান’, ‘মানিকতারা বা ডাকাতের পালা’, ‘মদনকুমার ও মধুমালা’, ‘সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া’, ‘নিজাম ডাকাইতের পালা’, ‘দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনদালি’, ‘সুরৎ জামালও অধুয়া’ এবং ‘ফিরোজ খাঁ দেওয়ান’। দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় সংখ্যায় আছে- ‘মাঞ্জুর মা’, ‘কাফেন চোরা’, ‘ভেলুয়া’, ‘হাতী- খেদা’, ‘আয়না বিবি’, ‘কমল সদাগর’, ‘শ্যাম রায়’, ‘চৌধুরীর লড়াই’, ‘গোপিনীকীর্তন’, ‘সুজা-তনয়ার বিলাপ’ এবং ‘বার তীর্থের গান’। চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় সংখ্যায় আছে- ‘নছর মলুম’, ‘শিলাদেবী’, ‘রাজা রঘুর পালা’, ‘নূরন্নেহা ও কবরের কথা’, ‘মুকুট রায়’, ‘ভারইয়া রাজার কাহিনী’, ‘আন্ধা বন্ধু’, ‘বগুলার বারমাসী’, ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’, ‘সন্নমালা’(স্বর্ণমালা), ‘বীরনারাণের পালা’, ‘রতন ঠাকুরের পালা’, ‘পীর বাতাসী’, ‘রাজা তিলক বসন্ত’, ‘মলয়ার বার মাসী’, ‘জিরলিনী’, ‘পরীবানুর হাঁহলা’, ‘সোণারায়ের জন্ম’ এবং ‘সোণা বিবির পালা’।
এগুলিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার জন্য ড. দীনেশচন্দ্র সেন পূর্ববঙ্গ গীতিকার ইংরাজি অনুবাদ করলেন। এর নাম দিলেন- “Eastern Bengal Ballads”। বিদেশি পণ্ডিতরা এর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। পরে এই আখ্যান কাব্যগুলিকে ২২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মৈমনসিংহ গীতিকার একজন আধুনিক পাশ্চাত্য গবেষক হলেন ড. দুসান জবাভিতেল। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম- ‘Bengali Folk-Ballads from Mymensingh’। রোমাঁ রোলাঁর ভগ্নী মেডেলাইন রোলাঁ ‘Eastern Bengal Ballads’-এর ফরাসি অনুবাদ করেন। এছাড়া রোমা রোলাঁ, সিলভাঁ, লেভি, পজিটর, জুল বলখ্ প্রভৃতি বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ উচ্চ প্রশংসা করেন। তাঁরা দেখিয়েছেন মহুয়া পালার সঙ্গে ইউরোপের মধ্যযুগীয় রোমান্স ‘ইসাল্ট’ ও ‘অক্সাসিন’ এবং ‘নিকোলেটে’র প্রেম কাহিনীর সাদৃশ্য আছে ।
অন্যান্য দেশের গাথার চেয়ে এই গাথাগুলিতে উচ্চতর আবেগ, পবিত্রতা, ত্যাগ ও রচনার সরলতার দিক থেকে অধিকতর প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেছেন বিদেশী পণ্ডিতরাই। তাঁরা এও স্বীকার করেছেন যে মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনী অনেক বেশি মানবকেন্দ্রিক। আবার ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিক ১৯১৬ খ্রিঃ এর কাছাকাছি সময়ে মৈমনসিংহ জেলায় মহাখালী বাজারে পূর্ববঙ্গের প্রাচীন পালা ‘সুনাই সুন্দরী’র গান শুনে মুগ্ধ হন এবং এগুলি সংগ্রহে ব্রতী হন। পরে ১৯৩৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৭০ খ্রিঃ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তারপর প্রকাশিত হয় ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ -প্রথম খণ্ড (১৯৭০), দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৭১), তৃতীয় খণ্ড (১৯৭১), চতুর্থ খণ্ড (১৯৭২), পঞ্চম খণ্ড (১৯৭৩), ষষ্ঠ খণ্ড (১৯৭৪), সপ্তম খণ্ড (১৯৭৫)। ‘দেওয়ানী-ভাবনা’ পালাটি তাঁর সম্পাদনায় ‘সুনাই সুন্দরী’ নাম পেয়েছে। তিনি মূলত দীনেশচন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ গীতিকার ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দূর করার উদ্দেশ্যে এই পরিশ্রম করেন। দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় মহুয়া পালার ছত্র সংখ্যা ৭৫৫। কিন্তু ক্ষিতিশচন্দ্র মৌলিকের সম্পাদনায় মহুয়া পালার মোট ছত্র ৯৮৬। মোট ৭৭টি পালার পাঠান্তর হয়েছে এখানে।
সিলেট, রংপুর, মৈমনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের মুখের ভাষা এই গানগুলিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘প্রাকৃত’ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। এই অঞ্চলে প্রচলিত ছড়া, প্রবাদ, রূপকথা, ধাঁধা, স্থানীয় ঘটনার ইতিহাস এখানে লোকসাহিত্যের মোড়কে রক্ষিত হয়েছে। আর এই গানগুলিতে প্রাণভোমরা হয়ে লুকিয়ে আছে জাতি সম্প্রদায়ের সীমানা পার করা প্রেম আর ভালোবাসার মন্ত্র। যে মন্ত্রে এই অঞ্চলের মানুষ ভুলে থাকত সাম্প্রদায়িকতার হিংসা, সংসারের অভাব অনটন, জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতা। এই বৈশিষ্ট্যই লোকগীতিকা হিসাবে অনন্য করে তুলেছে মৈমনসিংহ গীতিকাকে।
তথ্যসূত্রঃ-
1) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত – ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
2) মৈমনসিংহ গীতিকা – রমজান আলি সম্পাদিত।
3) মৈমনসিংহ গীতিকা – ড. দীনেশচন্দ্র সেন।
4) সেন বাহাদূর দীনেশচন্দ্র সেন – সৈয়দ আজিজুল হক।
5) Estern Bengal Ballads Mymensing – Dinesh Chandra sen, Raibahadur, B.A. D. Llit. Head Examiner and Lecturer of Calcutta University.
অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। উপকৃত হলাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ ।
বাঙালির আবহমানকাল ও শাশ্বত লোকজীবনের জীবন-বন্দনার দলিল-পত্র অক্ষয় হয়ে আছে দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত “মৈমনসিংহ-গীতিকা ” তে। … এই মহাকীর্তি, আকর গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা টি হলো এর অতুলনীয় সৃজনমূখর ‘ভূমিকা’… লিপিকা ঘোষ 💅💅💅 আপনার নিবিড় অবলোকন ও পুনঃ পাঠ এর সুবাদে এ লেখাটি আমাদের মুগ্ধ করে ❤️❤️❤️ আশাবাদী আমাদের জন্য প্রেমপর্ব গত হলে আমাদের জন্য বইয়ের ভূমিকার সাহিত্যিক তাৎপর্য নিয়ে আবারও লিখুন ❤️ আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানবেন প্রিয় দিদি ভাই ।
আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আমি মুগ্ধ ।নমস্কার জানবেন।
লেখাটি আমার ভালো লেগেছে, লিপিকা ঘোষ আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি