ষড়যন্ত্রের দিনগুলিতে প্রেম: গান্ধিহত্যার আবর্তে দুই নারী
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির বিড়লা হাউসে নাথুরাম গোডসের পিস্তলের গুলিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির কর্মময় জীবনের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটল। শুধু তা-ই নয়, এই অঘটন ও পরবর্তী ঘটনাক্রম জাতীয় রাজনীতিতে তো বটেই, হত্যার ষড়যন্ত্রকারী কুশীলবদের জীবনে, এমনকি তাঁদের পরিবারের সদস্য ও অন্তরঙ্গ মানুষদের জীবনেও অনপনেয় ছাপ রেখে গেল। তারই সূত্র ধরে বর্তমান নিবন্ধে আমরা পড়তে চেষ্টা করব ঘটনার অদূরে, ইতিহাসের এক কোণে পড়ে থাকা দুই অখ্যাত নারীর কথা। এই দুই নারী গান্ধিহত্যা ষড়যন্ত্রের দুই চরিত্রের প্রেমাস্পদ। প্রথমজন নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তে, ষড়যন্ত্রের অন্যতম চক্রী, আম্বালা জেলে নাথুরাম গোডসের ফাঁসির অব্যবহিত আগে তাঁর ফাঁসি হয়। বস্তুত, স্বাধীন ভারতে দণ্ডপ্রাপ্ত প্রথম ফাঁসির আসামী নারায়ণ আপ্তে। দ্বিতীয়জন হলেন মদনলাল পাহ্বা, স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর নবগঠিত পাকিস্তানের মন্টগোমারি জেলার পাকপাটন থেকে আগত ২১ বছরের পাঞ্জাবি যুবক— এক হতোভাগ্য উদ্বাস্তু। মদনলাল জানুয়ারির ২০ তারিখ, অর্থাৎ গান্ধিহত্যার মাত্র দশদিন আগে বিড়লা হাউসেই গান্ধিজির প্রার্থনাসভায় বিস্ফোরক সহযোগে হামলা করার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তাঁর কাছ থেকে একটি তাজা হ্যান্ড গ্রেনেডও উদ্ধার করা হয়। গান্ধিহত্যা ষড়যন্ত্রকারীদের দলের সদস্য হিসেবে মদনলাল পাহ্বার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি মুক্তি পান ও ২০০০ সালে মুম্বইয়ের দাদরে তাঁর মৃত্যু হয়। গান্ধিহত্যার এই দুই ষড়যন্ত্রীর জীবনের দুই নারী, যাঁরা এই ঘটনাপ্রবাহের দুই অপ্রধান চরিত্র, তাঁদেরকে নিয়েই এই দীর্ঘ নিবন্ধের অবতারণা। কিন্তু এই দুই নারীর সঙ্গে আপ্তে ও মদনলালের সম্পর্কের আলোচনা এই ষড়যন্ত্রীদ্বয়ের মনোজগতের ওপর কিছুটা আলো ফেলবে, আলো ফেলবে সমসাময়িক দেশকালের ওপর, তা বলাই বাহুল্য। যদিও হত্যা-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আলোচ্য দুই নারীর কোনও সংযোগ ছিল না, কিন্তু গান্ধিহত্যা এঁদের দুজনের জীবনকেও বরাবরের মতো বদলে দিয়েছিল, দুটি জীবনকে চরম বিড়ম্বনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ইতিহাসের মার্জিনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সাধারণ নারীর চোখ দিয়ে সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত রাষ্ট্রের এক মহাঘটনাকে ফিরে দেখার প্রচেষ্টাই বর্তমান নিবন্ধের চালক।
এক
প্রথম নারীর নাম- মনোরমা সালভি। মনোরমার পিতা দৌলতরাও সালভি ছিলেন তৎকালীন বোম্বাই-এর ৫০০ কি.মি. দূরে মহারাষ্ট্রের ছোট শহর শেগাঁও-এর সরকারি হাসপাতালের সহকারী চিকিৎসক। মনোরমার সঙ্গে তরুণ স্কুল শিক্ষক নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তের প্রথম পরিচয় ১৯৪১ সালে। মনোরমা তখন তেরো বছরের শান্তশিষ্ট পড়ুয়া এবং লাজুক স্বভাবের কিশোরী আর নারায়ণ আপ্তে এক পরিপূর্ণ যুবক, বয়স আঠাশ। ১৯৩২-এ পুণের খ্যাতনামা ফার্গুসন কলেজ থেকে বিজ্ঞানের স্নাতক নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তে তিনের দশকের মধ্যভাগে আমেরিকান মিশন স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। একই বছর পুণের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে চম্পা ফেড়তারের সঙ্গে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৯৪১-এ আপ্তে পুণেয় মিশন স্কুলেই কর্মরত ছিলেন, সেখানেই শিক্ষক আপ্তের সঙ্গে স্কুলের ছাত্রী মনোরমার প্রথম পরিচয়। সুপুরুষ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আপ্তের ঠিকানা কিশোরী মনোরমা তখন থেকেই গোপনে নিজের খাতায় টুকে রেখেছিলেন। মনোরমা আপ্তের বিবাহের খবর জানতেন না।
নাথুরাম গোডসের মতো নারায়ণ আপ্তেও একজন চিতপাবন ব্রাহ্মণ, অর্থাৎ উচ্চবর্ণ মরাঠা এবং নিজ গোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের সদস্যদের মতোই একসময়ের মহারাষ্ট্রে পেশোয়ারাজের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে উৎসাহী। গোডসের মতোই আপ্তেও সাভারকরের অনুগামী, যদিও ১৯৪২-এর আগে পর্যন্ত গোডসে ও আপ্তে, দুজনের সাক্ষাৎ হয়নি। হিন্দু মহাসভার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে সাভারকরের সঙ্গে নারায়ণ আপ্তের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও রীতিমতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। গত শতকের দুইয়ের দশক থেকেই হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবার যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তাতে আপ্তের যোগদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপ্তের নেতৃত্বে ১৯৩৯ সালের মে মাস নাগাদ আহমেদনগর, পুণে, সাতারা, শোলাপুরে রাইফেল ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল এবং চালিশগাঁও, জলগাঁও, ডম্বিভালি সহ মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি জেলায় রাইফেল ক্লাব শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছিল। এখানে বলে রাখা দরকার মতাদর্শ হিসেবে হিন্দুত্ববাদের প্রতি আপ্তের মোহ বা আনুগত্য কতখানি ছিল তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, সামাজিক পরিসরে ব্যক্তিগত ক্ষমতা, সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভের আকাঙ্খা যে বরাবর আপ্তের সমস্ত কাজের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে গেছে৷ ধনীর সন্তান, পোশাক পরিচ্ছদে সৌখিন, ইংরেজি শিক্ষিত, সিগারেট ও হুইস্কিপ্রেমী, নারীসঙ্গে স্বচ্ছন্দ নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তের সঙ্গে নাথুরাম গোডসের আর্থসামাজিক, মনন ও চরিত্রগত পার্থক্য ছিল অনেকখানি, কিন্তু ‘হিন্দুর শত্রু’ গান্ধিকে হত্যার চরম লক্ষ্য তাঁদের পথদুটি জুড়ে দিয়েছিল।
আপ্তেকে পুণেয় আমেরিকান মিশন স্কুলে মনোরমা অল্প সময়ের জন্য গণিতের শিক্ষক হিসেবে পেলেও, তাঁদের যোগাযোগ পরেও অটুট ছিল। আপ্তে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন ও ১৯৪৩ সালে কিছুদিনের জন্য ব্রিটিশ রাজের অধীনে রয়াল এয়ার ফোর্স-এ যোগ দেন। সেইসময় মনোরমার সঙ্গে আপ্তের চিঠিপত্রের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় ছিল। ১৯৪৪-এ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর মনোরমা বোম্বাই চলে আসেন এবং সেখানকার উইলসন কলেজে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। বোম্বাইয়ে মনোরমার নতুন আস্তানা হলো আলেকজান্দ্রা রোডে পণ্ডিতা রামবাই মহিলা হস্টেল। ঠিক এই সময় মনোরমা-আপ্তের সম্পর্কের দ্বিতীয় ও ঘনিষ্ঠ পর্বটি শুরু হয়।
গোডসে ও নারায়ণ আপ্তে
১৯৪৪-এর জুলাই মাসে নারায়ণ আপ্তে বোম্বাই আসেন এবং মনোরমা ও তাঁর দুই বান্ধবীকে রক্সি সিনেমার বিকেলের শো-এ ছবি দেখাতে নিয়ে যান। সিনেমা দেখার পর সকলে মিলে চৌপট্টির সমুদ্রতটে অল্প কিছুক্ষণের জন্য হাঁটতে যান। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে আপ্তে আবার বোম্বাই আসেন এবং এবার শুধুমাত্র মনোরমাকে সেদিন সন্ধেবেলা একটি ছবি দেখতে নিয়ে যেতে চান। সম্ভবত নিজের পড়াশুনোর ক্ষতি হতে পারে ভেবে মনোরমা এই প্রস্তাবে রাজি হননি, তবে আপ্তের পীড়াপীড়িতে পরের দিনের লাঞ্চের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান৷ পরের দিন আপ্তে আসেন মনোরমাকে স্যান্ডহার্স্ট রোডের একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান। পুরো দুপুর জুড়ে গল্প-আড্ডায় দুজনের দারুণ সময় কাটে ও সন্ধেবেলা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা বোম্বাই ভিটি স্টেশনে তাঁরা পরস্পরের থেকে বিদায় নেন।
সেই দুপুরের পর থেকে আপ্তের চিন্তা মনোরমার মনোজগত সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে নিল। মনোরমা বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর সঙ্গে আপ্তের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতার দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শেষোক্ত দুপুরটি আপ্তের সঙ্গে কাটানোর পর থেকে মনোরমা তাঁকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেন। মনোরমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে ১৯৩২ সাল থেকে অর্থাৎ বিগত ১২ বছর যাবৎ আপ্তে বিবাহিত ও তাঁর একটি পুত্রসন্তান আছে। প্রসঙ্গত, আপ্তের পুত্র পাপানের বয়স দু-বছর পেরোনোর সময় বোঝা যাচ্ছিল যে, তার মানসিক বিকাশ বয়স অনুপাতে হচ্ছে না, তার মধ্যে নানা বিকলন দেখা যাচ্ছে। এই বিকলন মাঝেমধ্যে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে পাপানকে বেশ কিছুটা সময় মনোচিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি রাখতে হয়। পুত্রসন্তানের দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে আপ্তের পারিবারিক জীবন সুখের হয়নি, তিনি তাঁর স্ত্রী চম্পার থেকেও দূরে সরে আসেন, কিন্তু আপ্তের পারিবারিক খবরাখবর গান্ধিহত্যার তদন্ত শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত মনোরমার কানে এসে পৌঁছয়নি।
এর পরের কয়েক মাস পুণে থেকে আপ্তের ঘন ঘন বোম্বাই আসা, মনোরমাকে নিয়ে দুপুরে লাঞ্চ ও তারপরে দুজনে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। এছাড়া দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্রের আদানপ্রদান তো ছিলই। আপ্তে এই সময় একটি মোটরবাইক কেনেন এবং পুণে থেকে বোম্বাইয়ের ১২০ কিলোমিটার দূরত্ব নিয়মিত বাইকে চড়ে পাড়ি দিতে থাকেন। আপ্তের সঙ্গে মনোরমার গভীর মেলামেশা তাঁর হোস্টেল ওয়ার্ডেন ড. মিস হেওয়াট-এর নজরে পড়ে ও তিনি কিছুদিনের মধ্যে মনোরমার পিতার কাছে অভিযোগ জানান। দৌলতরাও কন্যাকে আপ্তের সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করে দেন। এরপর থেকে মনোরমা ও আপ্তেকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখতে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ১৯৪৪-এর অক্টোবরের প্রায় এক মাসব্যাপী ছুটিতে মনোরমা শেগাঁও-তে গিয়ে বাবার কাছে ছিলেন, তখন ‘নির্মলা’ নামের যে বান্ধবীটি মনোরমাকে নিয়মিত চিঠি লিখত, সে আর কেউ নয়, নারায়ণ আপ্তে স্বয়ং। এই একমাসের বিরহ আপ্তের প্রতি মনোরমার প্রেম ও আকর্ষণ আরও তীব্র করে তোলে। নভেম্বর মাসে মনোরমা বোম্বাই ফেরার অব্যবহিত পরে তাঁদের দেখা হয়৷ আপ্তে মনোরমার হোস্টেলে দেখা করতে আসেন, মনোরমাও স্যান্ডহার্স্ট রোডের আর্য পথিক আশ্রমে (বোম্বাইতে সাধারণভাবে এটাই ছিল আপ্তের আস্তানা) আপ্তের সঙ্গে দেখা করতে যান। আপ্তের সঙ্গে মনোরমার জীবনের প্রথম রাতটি কাটে গুজরাট নিবাসে। পরদিন সকালে আপ্তে পুণে ও মনোরমা হস্টেলে ফিরে গেলেও, এরপর থেকে মানসিকভাবে আপ্তেকে ছেড়ে থাকা আর মনোরমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ১৬ বছরের নাবালক ও অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ মেয়েটি সেদিন থেকে নারায়ণ আপ্তেকে নিজের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই ভেবে নিয়েছিল। আপ্তের প্রতি মনোরমার সমর্পণ ছিল চূড়ান্ত ও নিঃশর্ত।
মনোরমা ও আপ্তের প্রেমপর্বের পাশাপাশি আপ্তের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একইসঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলছিল। ১৯৪২-এ হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস-এর যৌথ উদ্যোগে হিন্দু রাষ্ট্র দলের (এইচ আর ডি) প্রতিষ্ঠা হয় ও তাতে প্রধানত গোডসে ও আপ্তের কার্যকরী ভূমিকা ছিল। এইসময় গান্ধিজী তথা জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সারা দেশে বিপুল জনসমর্থন পাচ্ছিল, ঠিক সেইসময় গণআন্দোলনের উত্তাপ থেকে দূরে সাভারকরসহ দেশের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের মাথারা ইংরেজ রাজত্বের শেষে ভারতবর্ষে পুনরায় হিন্দু রাষ্ট্র পত্তনের নীল নকশা তৈরি করতে ব্যস্ত ছিলেন। হিন্দু রাষ্ট্রের মতাদর্শ প্রচারের লক্ষ্যেই বন্ধ হয়ে যাওয়া মারাঠি সংবাদপত্র ‘অগ্রণী’-র সত্ত্ব কিনে নিয়ে সেটিকে পুনঃপ্রকাশ করার উদ্যোগ নেন আপ্তে-গোডসে জুটি৷ ‘অগ্রণী’-র প্রথম সংখ্যা বেরোয় ১৯৪৪-এর ২৫ মার্চ, সেখানে পত্রিকার জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে নারায়ণ আপ্তে ও পত্রিকা সম্পাদক নাথুরাম গোডসের নাম নথিবদ্ধ ছিল। বস্তুত ‘অগ্রণী’ আপ্তে ও গোডসের গডফাদার সাভারকরের আশীর্বাদ ও তাঁর কাছ থেকে নগদ পনের হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয়েছিল। প্রসঙ্গত, আগের বছর অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে সাভারকর নিজের ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুগামীদের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ দুই লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন, তাই তাঁর পক্ষে পনের হাজার ঋণ দেওয়া সমস্যাজনক ছিল না৷ প্রতিদিন অগ্রণী-র প্রথম পাতার শীর্ষচিত্রে সাভারকরের ছবি ছাপা হতো এবং সংবাদপত্রটি সাভারকর তথা হিন্দু রাষ্ট্রদলের অলিখিত মুখপত্র হিসেবেই কাজ করত। অগ্রণী-র সংবাদ পরিবেশনের অভিমুখ ছিল মূলত কংগ্রেসের রাজনীতির সমালোচনা করা, গান্ধির প্রতিটি কাজের তীব্র ও ধারাবাহিক নিন্দা করা, বিশেষত তাঁর অহিংসা নীতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যভাবনার চরম বিরোধিতা করা৷ যেমন, ১২ এপ্রিল, ১৯৪৭-এ অগ্রণী-তে প্রকাশিত দুটি লেখার শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘The thirst for blood of the advocate of non-violence has not been quenched’ এবং ‘Mr. Gandhi, commit suicide’। দুটিরই লেখক পত্রিকা সম্পাদক নাথুরাম গোডসে।
সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর কারণে ব্রিটিশ সরকার প্রেস এমারজেন্সি পাওয়ারস আইনে একাধিকবার অগ্রণী-কে জরিমানা করে ও জুলাই ৩, ১৯৪৭-এ অগ্রণী বরাবরের মতো বন্ধ হয়ে যায়৷ কিন্তু অনতিবিলম্বে জুলাই ১৫ থেকে আইন বাঁচিয়ে ও নতুন নাম ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নিয়ে কাগজটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে৷ হিন্দু রাষ্ট্র-এর শেষ সংখ্যাটি বেরোয় ১৯৪৮ সালের ৩১ শে জানুয়ারি সকালে, নাথুরামের সহোদর গোপাল গোডসের তত্ত্বাবধানে, প্রথম পাতায় গান্ধিহত্যার সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে। নাথুরাম গোডসে তার আগেরদিন বিকেলে গ্রেফতার হয়েছেন, ম্যানেজিং ডিরেক্টর নারায়ণ আপ্তে ধরা পড়বেন আর মাত্র ক’দিন পর। বস্তুত, ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ এর পর ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ পত্রিকাটির আর কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না। সম্ভবত পত্রিকাটির বেঁচে থাকারও আর দরকার ছিল না, কারণ ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার পথে প্রধানতম বাধাটিকে স্বয়ং পত্রিকা সম্পাদক আগেরদিন বিকেলে নিজে হাতে উৎপাটিত করেছেন।
নারায়ণ আপ্তে বোম্বাইতে মনোরমার সঙ্গে অভিসারে এলেই অগ্রণী-র সর্বশেষ প্রকাশিত সংস্করণটি তাঁকে পড়তে দিতেন৷ সেই সময়কার রাজনীতির বিষয়ে খুঁটিনাটি না জানলেও আপ্তের মনের হিন্দুত্ববাদী অভিমুখ সম্বন্ধে মনোরমার কিছুটা ধারণা ছিল৷ আপ্তের দেওয়া অগ্রণী-র কপি তিনি মন দিয়ে পড়তেন। তাতে উল্লিখিত অনেক প্রসঙ্গই মনোরমার মনঃপূত হতো না৷ কখনও-সখনও মনোরমার সঙ্গে সেসব বিষয়ে আপ্তের কথাবার্তাও হতো। তিনি জানতেন যে নারায়ণ আপ্তে ছিলেন সাভারকরের অন্ধ অনুগামী। মনোরমা ভাবতেন, আপ্তে মানুষটা সহজ-সরল কিন্তু সাভারকরের বশীভূত হয়েই এমন বিপথগামী হয়ে পড়ছেন। একবার সাভারকর সম্বন্ধে কিছু অপ্রিয় কথা আপ্তেকে চিঠিতে লিখে মনোরমা তাঁর কাছে প্রবলভাবে তিরষ্কৃত হয়েছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি এটা ভেবে মনোরমা নিজেকে আশ্বস্ত করতেন যে দেশের এই উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক পরিবেশ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলে আপ্তেও নিজের মানসিক স্থিতি ফিরে পাবেন।
সাভারকরকে পছন্দ করতে না পারলেও তাঁকে ঘিরে একটি ঘটনায় মনোরমা খুশি না হয়ে পারেননি। ১৯৪৬-এ একবার বোম্বাই থেকে নিজের বাড়ি শেগাঁও যাওয়ার পথে মনোরমা পুণেতে পৌঁছে বিরতি নেন ও আপ্তের সঙ্গে দুটি রাত কাটান। আপ্তে মনোরমাকে নিয়ে যে হোটেলে উঠেছিলেন, ঘটনাচক্রে, ঠিক সেই সময় সাভারকরও সেই হোটেলে রাত্রিবাস করছিলেন৷ আপ্তে মনোরমাকে সাভারকরের ঘরে নিয়ে যান ও তাঁকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় করান। হোটেলের খাতাতেও আপ্তে মনোরমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু সাভারকরের সামনে তাঁকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করানো মনোরমার মনে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দেয় যে আপ্তে তাঁকেই বিয়ে করবেন বলে স্থির করেছেন।
প্রসঙ্গত, পুণেতে এই হোটেল-বাসের সময়ে নাথুরাম গোডসের সঙ্গেও আপ্তে ও মনোরমার দেখা হয়েছিল। গোডসের কাছে কিন্তু আপ্তে মনোরমাকে স্ত্রী বলে পরিচয় করালেন না— কারণ গোডসে জানতেন যে আপ্তে পূর্বেই বিবাহিত। হয়তো আপ্তের বিবাহিত স্ত্রীকেও তিনি দেখেছেন৷ তাছাড়া নারীসঙ্গ গোডসের চরিত্রে ছিল না, বিষয়টিকে তিনি রীতিমতো ঘৃণা করতেন। মনোরমা এর পরেও নাথুরাম গোডসেকে কয়েকবার দেখবেন, যদিও তাঁদের মধ্যে কোনওদিন বাক্যালাপ হবে না। কথাবার্তা না হলেও গোডসে লোকটিকে দেখে মনোরমার কখনও তাঁকে মন্দ বলে মনে হয়নি।
পুণের সাভারকর-সাক্ষাতের কয়েকমাস পরে মনোরমার সঙ্গে এক আলাপচারিতায় আপ্তের গান্ধিবিদ্বেষ তীব্রতর হয়ে প্রকাশ পায়। আগেও বলা হয়েছে, রাজনীতির বিষয়ে মনোরমা খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু অন্য সংখ্যালঘুদের মতো ভারতের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষরাও সাধারণভাবে গান্ধিজিকে শ্রদ্ধা করতেন, মনোরমাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। ফলত, আপ্তের তীব্র গান্ধিবিদ্বেষ মনোরমার পছন্দ ছিল না। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৪৮-এর আগে পর্যন্ত তাঁর আদতে কোনও ধারণাই ছিল না যে আপ্তে ও তাঁর সঙ্গীরা কী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছেন!
১৫ জানুয়ারি রাতে আপ্তের অন্যান্য সঙ্গীরা বিভিন্ন ট্রেনে বোম্বাই থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। একমাত্র আপ্তে বোম্বাইতে থেকে যান, সঙ্গীদের জানান তিনি শীঘ্র দিল্লিতে পৌঁছে সঙ্গীদের সঙ্গে যুক্ত হবেন, তবে তার আগে বোম্বাইয়ে সমমনস্ক মানুষজনের কাছ থেকে কিছু অর্থসংগ্রহ করা প্রয়োজন। কিন্তু আপ্তের আসল উদ্দেশ্য ছিল মনোরমার সঙ্গে দেখা করা এবং ঘটনার আগে দুজনে একান্তে কিছুটা সময় কাটানো। দু-রাত সি গ্রিন হোটেল-এর (দক্ষিণ) ৬ নং রুমটি তাঁর ও মনোরমার জন্য বুক করে রাখা ছিল। কিন্তু এইবার তাঁদের একসঙ্গে কাটানো সময় মোটেই সুখের হলো না। কারণ এই সাক্ষাতে আপ্তে মনোরমাকে জানিয়ে দিলেন, তাঁদের লক্ষ্য কী অর্থাৎ তাঁরা আগামী ক’দিনের মধ্যে ঠিক কী কাজ করতে চলেছেন। মনোরমা আপ্তের সঙ্গে তাঁর তিন বছরের সম্পর্কের সবচেয়ে সেরা সময় কাটাচ্ছেন, ঠিক তখনই তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মনোরমা আপ্তেকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু নারায়ণ আপ্তে বারবার মনোরমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ‘কাজ সেরে’ আপ্তে আবার তাঁর কাছেই ফিরে আসবেন।
মনোরমা বুঝলেন, তিনি নিজের অজান্তে এক বিরাট সঙ্কটের জালে জড়িয়ে গেছেন, এমন এক গভীর সঙ্কট যা মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই মনোরমার জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। এবং তাঁর নিজের জীবনই শুধু নয়, মনোরমার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ-ও একই সূত্রে জড়িয়ে গেছে। মনোরমা তখন কয়েক মাসের গর্ভবতী। তাঁর গর্ভে আপ্তের সন্তান আসছে। তাই এই মুহূর্তে আপ্তেকে আঁকড়ে ধরে থাকা ছাড়া মনোরমার অন্য কোনও উপায় নেই।
দুই
দ্বিতীয় নারী – শেওন্তী বা সেবন্তী। শেওন্তী মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর শহরের এক গণিকা বা যৌনকর্মীর সন্তান। মদনলাল পাহ্বা যখন প্রথমবার তাঁর কাছে আসে, শেওন্তীর বয়স তখন উনিশ বছর৷ শেওন্তীকে নিয়ে কথা বলার আগে মদনলালের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের দিকে আমরা একবার ফিরে তাকাব।
মদনলাল কাশ্মীরিলাল পাহ্বা-র জন্ম ১৯২৭-এ, অবিভক্ত ভারতে পঞ্জাবের মন্টোগোমারি জেলার পাকপাটন শহরে। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ঠিক আগে ১৭ বছরের মদনলাল বাড়ি থেকে পালান। উদ্দেশ্য ছিল লাহোরে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের রয়াল ইন্ডিয়ান নেভিতে যোগ দেওয়া। সে উদ্দেশ্য সফল হয় না। বোম্বাইতে নেভির তদারকিতে এক মাস ব্যাপী ট্রেনিং-এর পর মূল নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন ও বোম্বাই ত্যাগ করে পুণে চলে যান। সেখানে ব্রিটিশ সেনা মহাযুদ্ধের কারণে স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে কিছু কাজের জন্য ভারতীয়দের নিযুক্ত করছিল। মদনলাল পুণেতে সেনাবাহিনির সেরকম এক সিভিল ইউনিটে যোগ দেন। যুদ্ধ থামার পর ১৯৪৬-এর শেষের দিকে মদনলালের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তিনি পাকপাটনে নিজগৃহে ফিরে আসেন। ততদিনে সারা দেশে অপ্রীতিকর সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, এবং দেশ যতই স্বাধীনতা লাভের দিকে এগোচ্ছে, পরিবেশ ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দেশভাগের অব্যবহিত আগে মদনলাল তাঁর মাসির সঙ্গে ছিলেন এবং ১৯৪৭-এর অগাস্টের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি নবনির্মিত পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
মদনলাল কাশ্মীরিলাল পাহ্বা
আর পাঁচজন উদ্বাস্তুর মতোই শুরু হয় মদনলালের ভ্রাম্যমান, দুঃখী জীবন। কাজের সন্ধানে পঞ্জাব ও গোয়ালিয়ের কিছুদিন কাটিয়ে তিনি অক্টোবর মাসে আবার বোম্বাইতে এসে পৌঁছন। সেখানে তাঁর আলাপ হয় স্বশাসিত রামনারায়ণ কলেজের অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র জৈনের সঙ্গে। ইনিই সেই অধ্যাপক জৈন, যাঁকে পরবর্তীকালে মদনলাল গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্রের আগাম আভাস দেবেন এবং অধ্যাপক ঘটনার দশদিন আগে খবরটি প্রশাসনের উচ্চপদাধিকারীদের জানিয়ে ও সর্বতোভাবে চেষ্টা করেও হত্যাকাণ্ডটি নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হবেন।
মদনলাল ছেলেটিকে অধ্যাপক জৈনের সৎ ও উদ্যমী বলেই মনে হয়, তিনি তাঁকে একটি কাজের সুযোগ করে দেন। তিনি মদনলালকে তাঁর লিখিত কিছু বই বিক্রি করতে বলেন। মদনলাল সারাদিন ধরে ট্রেনে করে নানা ছোট বড় শহরে গিয়ে ফেরি করে বই বিক্রি করতেন, দিনের শেষে অর্জিত উপার্জনের একাংশ অধ্যাপককে দিতেন, তাঁর নিজেরও কিছু উপার্জন হতো এবং পরের দিন বিক্রির জন্য অধ্যাপকের কাছ থেকে আবার নতুন বই তুলে নিতেন। বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের মাধ্যমে পরিশ্রমী ও সুদর্শন মদনলালের যোগাযোগ বাড়তে লাগল, বইয়ের পাশাপাশি তিনি ফল বিক্রির রাস্তা ধরলেন। আর এই যোগাযোগই ক্রমে তাঁকে পৌঁছে দিল মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর শহরে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও হিন্দু মহাসভার সদস্য বিষ্ণু কারকারের সঙ্গে এখানে এসেই মদনলালের প্রথম পরিচয় হলো।
বিষ্ণু কারকারে উদ্বাস্তু যুবকটির মধ্যে প্রচুর ‘সম্ভাবনা’ দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি মদনলালকে আহমেদনগরে উপযুক্ত স্থানে একটি ডাব-নারকেলের দোকান গড়ে তুলতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। শুধু তাই নয়, কারকারে মদনলালকে বিনা খরচে স্থানীয় হিন্দু মহাসভা অফিসে থাকার ও কারকারের নিজের সস্তার সরাইখানা ‘ডেকান গেস্ট হাউস’-এ দুবেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। অধ্যাপক জৈন এবং অপর এক পরিচিত জনৈক শ্রীমতী মোদক মদনলালকে বোম্বাই শহরেই থেকে যেতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু বিষ্ণু কারকারের প্রস্তাব ও আহমেদনগরে উপার্জনের সুযোগ অধিকতর লাভজনক মনে হওয়ায় মদনলাল বোম্বাই ছেড়ে পাকাপাকিভাবে আহমেদনগরে চলে আসেন।
মদনলাল পাকাপাকিভাবে আহমেদনগরে চলে এলেন ১৯৪৭-এর মাঝ-ডিসেম্বরে। বিষ্ণু কারকারে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তাঁকে কাজে লাগিয়ে দিলেন৷ মদনলালের প্রথম কাজ ছিল আহমেদনগরের অনতিদূরে বিসাপুর নামক মফস্বলে আগত হিন্দু উদ্বাস্তুদের সংগঠিত করার কাজে কারকারেকে সাহায্য করা। ধীরে ধীরে পাহ্বা কাজের ধরন বদলাতে থাকে। যেমন ক্রমশ পাহ্বার নতুন দায়িত্ব হলো, স্থানীয় মুসলমান হকার ও দোকানদারদের বিরক্ত করা, মুসলিমদের বসতিতে বোমা ফেলা, এবং হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধমত পোষণকারী রাজনৈতিক দলের ও নেতাদের জনসভায় দলবল নিয়ে উপস্থিত থেকে গোলমাল পাকানো, সভা ভণ্ডুল করে দেওয়া ইত্যাদি। দেশভাগের কারণে মদনলালের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সঙ্কট তাঁর মনে যে বিদ্বেষের বীজ পুঁতে দিয়েছিল, কারকারের প্ররোচনায় ও উপযুক্ত পরিবেশে তা বেড়ে উঠে দ্রুত ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করল। ছোটবেলায় স্কুলে পড়াকালীন বন্ধুদের মধ্যে একটু মাতব্বর গোছের ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল যে কিশোর, আহমেদনগরে এসে যুবক মদনলালের সেই আধিপত্যকামী চরিত্র ক্রমশ একটি বিকৃত আকার নিতে শুরু করল।
মদনলালের আহমেদনগরে চলে আসার ও থেকে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ছিল শেওন্তী। ২৫ শে ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ছটায় চিত্রা টকিজে একটি সিনেমা দেখতে গিয়ে মদনলালের সঙ্গে তাঁর পুরোনো বন্ধু ‘চাব্বু’-র দেখা হয়। চাব্বু এই আহমেদনগরেরই বাসিন্দা। সিনেমা দেখে বেরিয়ে আড্ডা দিতে দিতে চাব্বু মদনলালকে এক সুন্দরী গায়িকার কথা বলে, তাঁকে গান শোনার প্রস্তাব দেয়, এবং তখনই মদনলালকে মেয়েটির বাড়িতে নিয়ে যায়, শেওন্তী সেইসময় বাড়ি ছিলেন না। কিন্তু চাব্বুর কাছে শেওন্তীর সৌন্দর্যের বর্ণনা মদনলালকে আগ্রহী করে তোলে। ২৭ তারিখ রাতে মদনলাল আবার শেওন্তীর বাড়ি যান এবং দুজনের দেখা হয়।
মদনলালের সঙ্গে যখন শেওন্তীর দেখা হয় তখন তাঁর বয়স সবে উনিশ। শেওন্তীর প্রথাগত সৌন্দর্য যেমন তাঁর পাঁচ ফুটের বেশি উচ্চতা, গোলাকার মুখ, লম্বা চুল ও তীক্ষ্ণ নাক এবং মিষ্টি সুরেলা গানের গলা কম বয়সেই শেওন্তীকে কিঞ্চিৎ পরিচিতি দিয়েছিল। শেওন্তী এই সৌন্দর্য পেয়েছিল তাঁর মায়ের কাছ থেকে। শেওন্তীর মা ছিলেন চিত্রা টকিজের পাশে ভগত গলি নামক যৌনপল্লীর একজন সুপরিচিত যৌনকর্মী। প্রথম পরিচয়েই শেওন্তী ও মদনলালের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বস্তুত, প্রথম দর্শনেই মদনলাল শেওন্তীর ‘প্রেমে পড়েন’ এবং তারপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় শেওন্তীর বাড়ি যাওয়া তাঁর অবশ্যকর্তব্য হয়ে ওঠে। শেওন্তীও সুপুরুষ মদনলালের প্রতি আকর্ষিত হন এবং ধীরে ধীরে তাঁকে ভরসা করতে শুরু করেন। সুমনবাঈ, শেওন্তীর সুহৃদ, যিনি আমৃত্যু তাঁর পাশে ছিলেন, ২০১৯-এ লেখক ধীরেন্দ্র ঝা-কে এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন মদনলাল শেওন্তীকে নিয়মিত প্রচুর উপহারে ভরিয়ে দিতেন, এমন সব উপহার যা শেওন্তী আগে কোনওদিন দেখেননি। মাত্র উনিশ বছরের সদ্য-সাবালিকা শেওন্তী মনে মনে তাঁর মায়ের পেশা ও পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার গোপন ইচ্ছা লালন করতেন। এমনকি গত দু’বছর ধরে যৌনপেশায় যোগ দেওয়ার জন্য তাঁর মায়ের উপর্যুপরি অনুরোধ-উপরোধ শেওন্তী আটকে রেখেছিলেন। শেওন্তী মনে মনে এমন একজন পুরুষের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন যার হাত ধরে সে এই দেহব্যবসার অন্ধকার জগত থেকে চিরদিনের মতো বেরিয়ে যেতে পারবেন। মদনলালকে পেয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শেওন্তীর মনে সেই আকাঙ্খা আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠল। মাত্র এক পক্ষকাল সময়ে মদনলাল শেওন্তীর অস্তিত্বকে এমনভাবে অধিকার করে নিয়েছিল যে তাঁকে বাদ দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করা শেওন্তীর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আহমেদনগরের নতুন জীবন ও শেওন্তীর উপস্থিতি মদনলালের দেশভাগের যন্ত্রণাময় স্মৃতির ওপর ধীরে হলেও কিছুটা প্রলেপ ফেলতে শুরু করেছিল। কিন্তু বিষ্ণু কারকারে বা ‘কারকারে শেঠ’ মদনলালের মতো সম্পদকে হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না। কারকারের অধীনে মদনলালের কাজই ছিল দিনের বেলায় আহমেদনগরের মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু উদ্বাস্তুদের সংগঠিত করা ও সন্ধেবেলা শেওন্তীর বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো। শেওন্তী মদনলালের কাছে ‘কারকারে শেঠ’-এর কথা শুনেছিলেন, এবং লোকটিকে বিশেষ পছন্দ করতে পারেননি। শেওন্তীর আশঙ্কা ছিল কারকারের নির্দেশে মদনলালের এই নিয়মিত মুসলিম পীড়ন তাঁকে একদিন কঠিন সমস্যায় নিয়ে ফেলবে৷ শেওন্তীর ভয় অমূলক ছিল না। ১ জানুয়ারি, ১৯৪৮ এ কারকারের নির্দেশে মদনলাল আহমেদনগরের এক মুসলিম দোকানির কাছ থেকে তাঁর ডাব-নারকেলের দোকান কেড়ে নিয়ে এক হিন্দু উদ্বাস্তুকে দিয়ে দেন। এই গণ্ডগোলের জেরে সে রাতেই পুলিশ ডেকান গেস্ট হাউসে হানা দেয় ও বিষ্ণু কারকারেকে গ্রেফতার করে৷ মদনলাল ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে তাঁর রাতের খাওয়া সারতে ব্যস্ত ছিলেন। মদনলাল খাওয়া ফেলে কারকারে শেঠকে বাঁচাতে উদ্যোগী হন ও পুলিশ ইনস্পেকটরের সঙ্গে বিতণ্ডায় লিপ্ত হন। সেই সময় কারকারের গ্রেফতারির খবর পেয়ে প্রায় পঞ্চাশজন হিন্দু উদ্বাস্তুদের একটি দল গেস্ট হাউজের বাইরে জমা হয় এবং পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করে। কারকারেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলে গোলমাল আরও বাড়তে পারে এই আশঙ্কায় পুলিশ খালি হাতে ফিরে যায়৷
পরদিন অর্থাৎ ২ রা জানুয়ারি সন্ধের কিছু পরে বিষ্ণু কারকারে মদনলালকে ডেকান গেস্ট হাউজে ডেকে পাঠান, এবং সেখানে উপস্থিত দুই যুবককে মদনলালের পরিচয় দেন। এই দুই যুবকের সঙ্গে কারকারে গেস্ট হাউসের সবচেয়ে ওপরের তলায় একটি ছোট ঘরে দরজা বন্ধ করে কথা বলছিলেন। মদনলাল সেই প্রথমবার নাথুরাম গোডসে ও নারায়ণ আপ্তেকে চাক্ষুষ দেখেন। মদনলালের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এই দুজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ভাগ্যও একই সূত্রে গাঁথা হবে৷ অতি সংক্ষিপ্ত সেই দেখাসাক্ষাৎ-এর পর মদনলাল হিন্দু মহাসভা অফিসে রাত্রিবাসের জন্য চলে যান। প্রসঙ্গত, গান্ধিহত্যার পর তদন্তে হত্যা ষড়যন্ত্রের প্রায় প্রতিটি কুশীলবের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার সক্রিয় যোগাযোগের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
৪ জানুয়ারি মদনলাল বিষ্ণু কারকারেকে শেওন্তীর প্রতি তাঁর অনুভূতির কথা জানান ও তাঁকে উপহার কিনে দেওয়ার জন্য কিছু টাকা চান। বিষ্ণু কারকারে মদনলালের প্রেম-সম্পর্কের কথা শুনে কী ভেবেছিলেন জানা যায় না, তবে তিনি মদনলালকে টাকা দিলেন। সেই টাকা নিয়ে মদনলাল প্রথম উনিশ টাকা খরচ করে শেওন্তীর জন্য একটি সুন্দর ওড়না কেনেন, তারপর তাঁর বাড়ি যান। সন্ধেবেলা তাঁরা দুজনে চিত্রা টকিজে ছবি দেখেন ও রাত দশটায় শেওন্তীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে হিন্দু মহাসভার অফিসে ফিরে আসেন।
এরপর ঘটনাক্রম দ্রুত মোড় নেয়। ৫ জানুয়ারি বিকেলে অনেকটা সময় মদনলাল শেওন্তীর সঙ্গে কাটান। সেদিনই রাত নটায় স্থানীয় কংগ্রেস নেতা রাওসাহেব পটবর্ধনের সভায় মদনলাল ও তাঁর উদ্বাস্তু সঙ্গীরা গোলমাল শুরু করেন। পুলিশ আসে, সভাস্থলের গোলমাল থামাতে লাঠিচার্জ করা হয়। পাহ্বা-সহ তাঁর বেশ কিছু উদ্বাস্তু সঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয় এবং গোটা রাত পুলিশি হেফাজতে কাটাতে হয়। পরদিন সকালে পুলিশ বিষ্ণু কারকারেকে ডেকে পাঠায় ও তাঁকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সঙ্গীসাথীসহ আহমেদনগর ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। কারকারে ও মদনলাল ডেকান গেস্ট হাউসে ফিরে আসেন ও সেদিন বিকেলের ট্রেনে পুণে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে মদনলালের দুই হিন্দু উদ্বাস্তু বন্ধু চোপড়া ও ভাটিয়াও ছিল। ঠিক এই সময়, চোপড়া ও ভাটিয়ার উপস্থিতিতেই বিষ্ণু কারকারে মদনলাল পাহ্বাকে প্রথমবার গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। কারকারে মদনলালকে জানান যে গান্ধিকে মরতে হবে কারণ গান্ধিই ভারতবর্ষে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে একমাত্র বড় বাধা। অতএব তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মদনলাল তখনও জানত না এই হত্যা ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা ঠিক কী হতে চলেছে। মদনলাল এও বুঝতে পারেনি শেওন্তীর সঙ্গে কাটানো তাঁর সুখের সময় সহসা শেষ হয়ে এল।
তিন
৩০ জানুয়ারি সন্ধেবেলা অর্থাৎ গান্ধিহত্যার অব্যবহিত পরে নাথুরাম গোডসেকে প্রথমে তুঘলক রোড থানা এবং কিছু পরে পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে রাতের দিল্লির তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় গোডসে একটি কম্বল ও রাতের খাবার দেওয়া হয়। এক ফাঁকে পুলিশ হসপিটালের এক চিকিৎসক এসে গোডসের প্রাথমিক শারীরিক পরীক্ষা সেরে নেন এবং ক্ষতস্থান পরিচর্যা করেন। রাত বারোটা নাগাদ দিল্লি পুলিশের এক বড়কর্তা লালা ঋষিকেশ এসে নাথুরাম গোডসের দায়িত্ব নেন। আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারের উপস্থিতিতে লালা ঋষিকেশ গোডসের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। প্রশ্নগুলির মাধ্যমে মূলত গান্ধিহত্যার বিশদ বিবরণ ও তার আগের ঘটনাক্রম সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয়েছিল। গোডসে উত্তর দিতে না চাওয়ায় পুলিশ অফিসারেরা তাঁকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেন৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যে ষড়যন্ত্রের প্রায় সমস্ত কুশীলবদের নাম পুলিশের হাতে চলে আসে ও একইসঙ্গে দিল্লি, বোম্বাই ও পুণেসহ দেশের নানা শহরে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে যায়।
প্রথম রাতের সেই শারীরিক নির্যাতনের পর গোডসেকে আর কখনও নিগ্রহ করা হয়নি, বা বলা ভালো করার দরকার পড়েনি৷ নাথুরাম গোডসে সমস্ত তথ্যসহযোগে পরবর্তী নয় মাস প্রশাসনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। প্রসঙ্গত, নয় মাস পর ৮ নভেম্বর ১৯৪৮ গ্রেফতার হওয়া সঙ্গীদের তাঁর প্রতি সমবেত ক্রোধে ও অসন্তোষে, আত্মগ্লানিতে এবং আইনজীবীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নাথুরাম তাঁর আগের বয়ান সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছিলেন। তিনি আদালতকে জানান, গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্র তাঁর এবং একমাত্র তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত এবং সাভারকর-সহ তাঁর কোনও সঙ্গীই এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নন। এই দায় তাঁর একার, তাই শাস্তি একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। বলা দরকার, গান্ধিহত্যা মামলায় গোডসের তথা আসামিপক্ষের অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন বোম্বাইয়ের প্রখ্যাত বার-এট-ল যমুনাদাস মেহতা, একজন একনিষ্ঠ সাভারকর-অনুগামী। গান্ধিহত্যা মামলায় তাঁর গুরু সাভারকর গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে যমুনাদাস সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য, সাভারকরকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত করার জন্য গোডসের বয়ান বদল একান্ত জরুরি ছিল।
গোডসে বোম্বাই সিআইডি স্পেশাল শাখার তদন্তকারী তরুণ অফিসার জে ডি নাগরওয়ালাকে মনোরমার কথা উল্লেখ করেন ১২ ফেব্রুয়ারি। নাথুরামকে ততদিনে দিল্লি থেকে তদন্তের সুবিধার জন্য ষড়যন্ত্রের উৎসস্থল বোম্বাইতে নিয়ে আসা হয়েছে। হত্যার পরদিন অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি বিকেলে অস্ত্র বিক্রেতা দিগম্বর বাড়্গে ধরা পড়েছেন। সেদিনই সাভারকর সদনে খানাতল্লাশি হয়েছে, সমস্ত কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে যদিও সাভারকরকে তখনও গ্রেফতার করা হয়নি। নাথুরামের ভাই গোপাল গোডসে তাঁদের গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়েছেন ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ, বিষ্ণু কারকারের ভৃত্য শঙ্কর কিস্তৈয়া পুলিশের জালে ধরা পড়েছেন ৬ তারিখ। কিন্তু ষড়যন্ত্রের দুই প্রধান কুশীলব নারায়ণ আপ্তে ও বিষ্ণু কারকারে তখনও ফেরার। আপ্তের বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই নাথুরাম উইলসন কলেজের ছাত্রী মনোরমার নাম করেন, বলেন যে মেয়েটি আপ্তের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। নাথুরাম জানান, আপ্তে বোম্বাই এলেই এই মেয়েটির সঙ্গে হোটেলে দেখা করত। নাগরওয়ালা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে কলেজে যোগাযাগ করেন। কিন্তু সেদিন, ১২ ই ফেব্রুয়ারি গান্ধিজির চিতাভস্ম বিসর্জনের সূত্রে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছিল, উইলসন কলেজও সেদিন বন্ধ ছিল। কিন্তু নিকটবর্তী পণ্ডিতা রামবাঈ মহিলা হস্টেলে খোঁজ করে মনোরমার খোঁজ মেলে। জানা যায়, মনোরমা সালভি উইলসন কলেজে কলা বিভাগের অন্তিম বর্ষের ছাত্রী এবং তাঁর বাবা পুলিশ হাসপাতালের ডাক্তার। বস্তুত, মনোরমার বাবা বদলি হয়ে বোম্বাইর বাইকুল্লায় নর্থকোট পুলিশ হাসপাতালে আসার পর থেকে মনোরমা হস্টেল ছেড়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছেই থাকেন।
সেদিনই দুপুরের পরে মনোরমা সালভিকে নিয়ে তাঁর বাবা ডা. সালভি সিআইডি দপ্তরে এসে হাজির হলেন। আপ্তের ঘৃণ্য অপরাধের খবরে মনোরমার বাবার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল চূড়ান্ত অবিশ্বাসের। এমনকি তিনি কয়েকমাস আগে পর্যন্ত জানতেনও না যে মনোরমা পুণের সেই আমেরিকান মিশন স্কুলের অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে সম্পর্কে এতখানি এগিয়ে গেছে। চার ঘণ্টা ধরে মনোরমার জেরা চলে। এর আগে মনোরমা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া অন্য কারও কাছে তাঁর প্রেমিক আপ্তে সম্বন্ধে কোনওদিন কোনও আলোচনা করেননি। আজ আপ্তে সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য পুলিশকে দেওয়ার পর মনোরমা নিজের চেয়ারে ক্ষোভে ও বেদনায় ভেঙে পড়েন। জেরা চলাকালীন মনোরমা কয়েকমাসের গর্ভবতী, যা তাঁর নিজের পরিবারের সদস্যরাও বহুদিন জানতে পারেননি। আপ্তের বোম্বাই ফিরে আসার পর তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলেন মনোরমা। পুলিশ অফিসারেরা মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করেন, শেষবার দেখা হওয়ার সময় আপ্তের আচার-ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়েছিল কিনা! মনোরমা জানান যে, তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, আপ্তের চিরকালের পরিধেয় পশ্চিমি পোষাক অর্থাৎ শার্ট ও ট্রাউজার হঠাৎ বদলে গেছে সাবেকি মহারাষ্ট্রীয় বেশভূষায়। দ্বিতীয়ত, মনোরমার একবার মনে হয়েছিল, অথবা এখন ভালো করে ভাবলে মনে হচ্ছে, আপ্তের চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসে কোথাও যেন একটু ঘাটতি চোখে পড়ছিল, আর মনে হচ্ছিল সে সবমসময় খুব সতর্ক ও সন্ত্রস্ত, কেউ যেন তাঁর পিছু নিয়েছে।
নারায়ণ আপ্তের প্রতি মনোরমা সালভির নিঃশর্ত ভালোবাসা ও সমর্পণ অসহায় তিক্ততায় বদলে যেতে থাকে। তিনি তাঁর জেরাকর্তা অফিসারকে জানান, আপ্তে যেখানেই থাকুন, দিনকয়েকের মধ্যে তাঁকে ফোন করবেনই। নাগরওয়ালা কালক্ষেপ না করে পুলিশ হাসপাতালে ডা. সালভির ৩০৫ ফোন নম্বরে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করেন। বেশিদিন অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না। ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় মনোরমার জন্য ওই নাম্বারে একটি ফোন আসে, খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ফোনটি এসেছে বোম্বাইর অ্যাপোলো হোটেল থেকে। তৎক্ষণাৎ অ্যাপোলো হোটেলের সামনে সাদা পোষাকের পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আপ্তের শারীরিক বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এমন একজনকে হোটেলে ঢুকতে দেখা যায়। ডেপুটি ইন্সপেক্টর সাওন্ত পেছন থেকে লোকটির কাঁধ স্পর্শ করেন ও বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করেন, “কি হে আপ্তে, বম্বে কবে এলে?” লোকটি বলে ফেলে, “এই তো, দু-দিন আগেই!” নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তের আর পালাবার পথ ছিল না।
মনোরমা ও আপ্তের সম্পর্কের কথা জানাজানি হওয়ার পর মনোরমার আত্মীয়স্বজন পত্রপাঠ তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেন। দেশভাগ ও নবনির্মিত স্বাধীন দেশের পটভূমিতে দেশের প্রতিটি সংখ্যালঘু ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে মহাত্মা গান্ধির প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যবোধ ছিল অপরিসীম। তাঁরা গান্ধিজিকে নিজেদের অভিভাবক জ্ঞান করতেন। স্বাধীন ভারত হিন্দুরাষ্ট্র না হয়ে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের স্বীকৃতি দানকারী গণতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পেছনে এক বিরাট ভূমিকা ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির। দেশের সংখ্যালঘু জনগণ, তারা মুসলিম হোন অথবা খ্রিষ্টান নাগরিক, নিশ্চিন্ত ছিলেন যে মহাত্মা গান্ধি যতদিন মাথার ওপর আছেন, এই দেশে তাঁদের সমান অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। অতএব গান্ধিহত্যা তাঁদের চেতনায় এক চরম আঘাত হিসেবে নেমে এসেছিল। মনোরমার এক আত্মীয়, যিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মনোরমা একজন অপরাধীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল, এটা তাঁর প্রতি আমাদের ঘৃণার একমাত্র কারণ নয়। কারণ সেই অপরাধ কোনও মামুলি অপরাধ নয়। যে ঘৃণ্য অপরাধী মহাত্মা গান্ধিকে, এমন যীশু খ্রিষ্টের মতো একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে, মনোরমা তেমন একজন সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল, তাই তাঁকে আমরা আর কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না।
মনোরমা সালভির পরিবার ধর্মান্তরিত এবং ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান পরিবার। এছাড়াও তিনি সালভি পরিবারের প্রথম স্নাতক হতে চলেছিলেন, তাঁর সম্প্রদায়ে সেই প্রথম একজন নারী যে পড়াশুনো করে কলেজ অবধি পৌঁছতে পেরেছে। তিনি স্থানীয় চার্চের সঙ্গে নানা কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে, স্থানীয় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মনোরমা সালভি সামাজিক উপস্থিতি ছিল চোখের পড়ার মতো। আপ্তের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ঝোঁক মনোরমার অপছন্দ হলেও, আপ্তেকে ভালোবসে তিনি ভেবে নিয়েছিলেন আপ্তে একদিন না একদিন এই মতাদর্শের গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবেন। মনোরমা ভুল ভেবেছিলেন। আপ্তের চূড়ান্ত পদক্ষেপ এবং তাঁর ফলে মনোরমার এই মর্মান্তিক মোহভঙ্গ তাঁকে চিরকালের মতো ভেঙেচুরে দেয়। এতদসত্ত্বেও কদিন পরে তাঁর গর্ভে আপ্তের অবৈধ সন্তান জন্ম নেবে। সঠিক জানা নেই, মনোরমা ঠিক কবে ও কোন পরিস্থিতিতে তাঁর পরিবারকে জানিয়েছিলেন যে তিনি সন্তানসম্ভবা। এই সংবাদ পরিবারের কাছে বজ্রপাতের মতো ঘটনা। মনোরমার এই চরম হঠকারিতা ও ‘কলঙ্কময়’ আচরণ নিম্নমধ্যবিত্ত রক্ষণশীল খ্রিষ্টান পরিবারটির পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। মনোরমার সমাজ এমনকি তাঁর নিজের পরিবার অবিলম্বে তাঁকে কুষ্ঠরোগীর মতো দূরে ঠেলে দেয়। মনোরমা পড়াশুনোয় যবনিকা পড়ে যায়, আর তাঁর স্নাতক স্তরের পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ১৫ নভেম্বর, ১৯৪৯ আম্বালা জেলে নারায়ণ আপ্তের ফাঁসির পর মনোরমা নিজের জন্য চরম একাকিত্বের জীবন বেছে নেন, তাঁর বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গেও আর তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিল না। গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্রে মনোরমার কোনও অংশীদারিত্ব ছিল না, কিন্তু মূল অপরাধীদের চেয়ে তাঁর প্রাপ্য শাস্তিও কিছু কম হলো না। প্রসঙ্গত, তাঁর গর্ভে যে কন্যাসন্তানটি জন্ম নিয়েছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে, শৈশবেই অসুস্থ হয়ে মারা যায়। একটি অসমর্থিত সূত্রের খবর অনুযায়ী মনোরমা সালভিকে শেষবারের মতো ১৯৭৬ সালে আহমেদনগর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ছোট শহর সোনাই-এ একটি ওষুধের দোকানে বিক্রয়-কর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা গিয়েছিল।
চার
মদনলালের সঙ্গে শেওন্তীর শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ। আহমেদনগরে কারকারে শেঠের মালপত্র নিতে আসার সুযোগে মদনলাল অল্প সময়ের জন্য শেওন্তীর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। শেওন্তীও অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে ১৫ জানুয়ারি বোম্বাইতে অধ্যাপক জৈনের ঠিকানায় শেওন্তী মদনলালকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লেখেন। এই একটি ঠিকানাই মদনলাল তাঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন। মারাঠিতে লিখিত সেই চিঠির বয়ান মোটামুটি এইরকম- ‘এখানে আমার দিন কাটতে চাইছে না। এই চিঠিকে তুমি টেলিগ্রাম ভেবে নাও আর শিগগির আহমেদনগরে ফিরে এস। দয়া করে আসার চেষ্টা করো। আর ফেরার আগে অতি অবশ্যই জানাবে কোন তারিখে তুমি আসছ। তুমি সবই জানো। এই চিঠিতে আমার আর বেশি কিছু লেখার দরকার নেই। আমার এই কথাগুলোর অর্থ যে কতখানি গভীর তা তুমি দয়া করে বুঝে নিও।’
চিঠিটি ডাকে পাঠিয়ে শান্তি পান না শেওন্তী। তিনি সম্ভবত চিন্তিত ছিল কারণ মদনলাল বিষ্ণু কারকারের সঙ্গে দিল্লি গেছিলেন। কারকারের কাজকর্ম সম্বন্ধে শেওন্তী যেটুকু শুনেছিলেন, তাতে তাঁকে তাঁর পছন্দ হয়নি। পরের দিনই শেওন্তী মদনলালকে আরেকটি চিঠি লেখেন। এবার তাঁর চিঠির বক্তব্য আরও স্পষ্ট ও খোলামেলা।
‘দয়া করে পত্রপাঠ আমার এই চিঠির উত্তর দিও, আমি আর এত উদ্বেগ নিতে পারছি না। আমি এখানে এমনিতে ভালোই আছি, কিন্তু তোমার স্মৃতি আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। যত তাড়াতাড়ি পার আহমেদনগরে ফিরে এসো। যখন আসবে, আমার জন্য মনে করে একজোড়া চটি এনো, আর অবশ্যই একটা ছয় হাত শাড়ি আনবে। ভুলে যেও না কিন্তু। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমার মন খুব খারাপ।’
অধ্যাপক জৈন চিঠিদুটি হাতে পান যথাক্রমে জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ ও ১৯ তারিখ। কিন্তু মদনলালের সঙ্গে অধ্যাপক জৈনের শেষবার দেখা হয়েছিল ১৫ তারিখ। সেদিন রাতেই তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে বোম্বাই ছেড়ে দিল্লি চলে যান। ফলে এই চিঠিগুলি মদনলালের আর পড়া হয়নি। এই চিঠিগুলির কথা মদনলাল পাহ্বা প্রথমবার জানতে পারেন যখন গান্ধিহত্যা মামলা চলাকালীন সেগুলি নথি হিসেবে বিচারপতির কাছে নথি হিসেবে পেশ করা হয়। ২০ জানুয়ারির আগে শেওন্তির চিঠিদুটো মদনলালের হাতে পৌঁছলে কি তাঁর হৃদয় পরিবর্তিত হতো? আমরা জানি না। তবে বোম্বাই থেকে দিল্লিতে আসার পরের ক’দিন মদনলালের কাজকর্ম দেখে মনে হয় না যে শেওন্তীর আবেগমথিত চিঠি তাঁর মনে বিশেষ দাগ কাটতে পারত। বরং এ কথাই বলা যায়, সামান্য সময়ের পরিচয়ে শেওন্তী মদনলালকে তাঁর মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু শেওন্তীর প্রতি প্রেমে মদনলাল মোটেই বিশ্বস্ত ছিলেন না। দিল্লিতে আসার পরে মদনলাল ও বিষ্ণু কারকারে ১৭ জানুয়ারি চাঁদনী চকের কাছে ফতেপুরে একটি হোটেলে ঘরভাড়া নেন। মদনলাল সেদিনই হোটেলের খুব কাছে তাঁর মামা বালমুকুন্দ আহুজার সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানেই মদনলালের বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে। মদনলালের মামা নাকি তাঁর জন্য ইতিমধ্যেই একটি সুশীল মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছেন, মদনলালের বাবাও এ বিয়েতে সম্মত। শ্রী আহুজা মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে অনতিবিলম্বে মদনের দেখা করিয়ে দিতে চান। পরের দু-দিন অর্থাৎ ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি মদনলাল মেয়েটির পরিবারের সঙ্গেই বেশি সময় কাটান। এমনকি ১৮ জানুয়ারি, রবিবার, শেওন্তীর এই ‘simple-minded hunter’ তাঁর নবপরিচিতা বাগদত্তাকে উপহার দেবেন বলে বিষ্ণু কারকারেকে অনুরোধ করে তাঁকে দিয়ে একজোড়া পাঠানী চপ্পল কেনান। ১৯ জানুয়ারি সন্ধেবেলা আবার মেয়েটির সঙ্গে অনেকটা সময় কাটানোর পরিকল্পনা ছিল মদনলালের, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা তাঁকে বাতিল করতে হয় কারণ ততক্ষণে তাঁর ‘Call of duty’ এসে গেছে। সেই দিন সন্ধ্যাতেই তাঁদের চাঁদনি চকের হোটেল ছেড়ে হিন্দু মহাসভার অফিস মহাসভা ভবনে চলে যেতে বলা হয়। পরেরদিন অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি গান্ধিহত্যার নির্ধারিত পরিকল্পনায় বিড়লা হাউসে মদনলালকে নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অতএব বিষয়টি স্পষ্ট যে মদনলাল শেওন্তীর প্রতি বিশ্বস্ত না থাকতে পারলেও তাঁর কারকারে শেঠের প্রতি চির-অনুগত ছিলেন।
শেওন্তী এসব কিছুই জানতে পারেননি। গান্ধিজির প্রার্থনাসভা বিস্ফোরক-সহ হামলা ও হত্যা-ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে মদনলালের গ্রেফতারের খবর তিনি পান বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে। খবর জানার পর শেওন্তীর মনের মধ্যে ঠিক কী চলছিল তা আমাদের জানা নেই। তবে, এই আঘাত তাঁর জীবনেও কতখানি গুরুতর ছিল তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। মদনলাল পাহ্বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর অসহায় শেওন্তী তাঁর মায়ের পেশায় যোগ দেন— শেষ পর্যন্ত যৌনকর্মীর জীবনকেই বেছে নেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আহমেদনগরের অন্যতম চর্চিত ও কাঙ্খিত রূপপোজীবিনী হিসেবে শেওন্তী বাঈ-এর নাম শোনা যেতে থাকে। ১৯৬৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে মদনলাল পাহ্বা দময়ন্তী নামের এক মহারাষ্ট্রীয় ভদ্রমহিলাকে বিবাহ করেন। ১৯৮৮ সালে ৫৯ বছর বয়সে শেওন্তীর মৃত্যু হয়। আমৃত্যু তাঁর সুহৃদ সুমনবাঈ পরে জানাচ্ছেন যে শেওন্তী জীবনে আর কাউকে কোনওদিন ভালোবাসতে পারেননি।
তথ্যসূত্র
১। Dhirendra K. Jha, ‘Gandhi’s Assassin: The making of Nathuram Godse and his idea of India’, Penguin Random House, (2021).
২। Manohar Malgaonkar, The Men Who Killed Gandhi, Roli Books, (2008).
৩। The Assassination of Mahatma Gandhi, Trial & Verdict 1948-49, The Hindu History Series, THG Publishing Private Limited, (2020).
৪। Jagadish Chandra Jain, ‘I could not save Mahatma Gandhi’, Frontpage, (2010).
৫। S. Padmavathi & D. G. Hariprasath, ‘Mahatma Gandhi Assassination: J. L. Kapur Commission Report– Digitised, Illustrated, & Annotated Original Version (Vol I & II)’, Notion Press, Chennai, (2017)
আহা! কী অসাধারণ। দেশদ্রোহী অথবা দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী অথবা বিশ্বাসঘাতক তাঁদের আড়ালে এরকমই বহু মানুষ থেকে যান। ইতিহাসের অনালোক থেকে এই দুটি চরিত্র কে আমাদের সামনে আনার জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন। আরও চাই কিন্তু।
অনেক ধন্যবাদ। লেখাটার জন্য।
খুবই ভালো লাগলো। অজানা ইতিহাস।
ভাস্কর বসু
বড় ভালো লাগল। এক অজানা অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করার জন্য ধন্যবাদ।