লক্ষ্মীর প্রাচীনতম রূপের সন্ধানে
হিন্দুধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী লক্ষ্মী। তাঁর মন্দির বিশেষ নেই, কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতিতে তাঁর উপস্থিতি সর্বব্যাপী। শুধু হিন্দু নয় বৌদ্ধ সংস্কৃতিতেও। তাঁর প্রাচীনতম রূপগুলি কিন্তু বৌদ্ধ শিল্পকলায়ই দেখা যায়। চলুন, এই কাহিনী শুরু করা যাক ভারতের স্থাপত্যশিল্পের একদম শুরুর যুগ থেকে। ভারতের দুটি প্রাচীনতম স্থাপত্য যাদের নিদর্শন এখনও বেশ ভালভাবে টিকে আছে- তারা হল সাঁচী আর ভরহুত। লক্ষ্মীরও প্রাচীনতম রূপ এই দুই জায়গাতেই। চলুন ক্রমানুসারে দেখি।
১) দেবী লক্ষ্মীর প্রাচীনতম রূপ কলকাতাবাসীরা কিন্তু কলকাতায় বসেই দেখতে পাবেন। ভরহুত বৌদ্ধ স্তূপের প্রাচীরের লক্ষ্মী- কলকাতা জাদুঘরে। ভরহুত লক্ষ্মী হলেন গজলক্ষ্মী। এটি শুঙ্গ রাজত্বকালের- দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকের। ইনি কি সত্যিই লক্ষ্মী? হ্যাঁ। গজলক্ষ্মীর প্রায় সব লক্ষণই এনার মধ্যে আছে। পায়ের নিচে পদ্ম এবং ঘট, দুদিকে হাতি, হাতির পায়ে পদ্ম, হাতিরা শুঁড় দিয়ে ঘটের মাধ্যমে অভিষেক করছে। এর দু’হাজার বছর পরে রাজা রবি বর্মা যে গজলক্ষ্মী এঁকেছেন (যাকে আমরা আজ অনেক ক্যালেন্ডারেই দেখি) তারও একই রূপ। গুডিমল্লমের শিবলিঙ্গ বাদে আর কোনও হিন্দু আইকোনোগ্রাফি প্রায় একই রূপে এরকম সোয়া দুই হাজার বছর টিকেছে বলে মনে হয় না।
ভরহুতের গজলক্ষ্মী
২) দ্বিতীয় প্রাচীনতমা লক্ষ্মীও বৌদ্ধ শিল্পেই- সাঁচীতে- কারণ হিন্দু স্থাপত্য সেই যুগের বিশেষ অবশিষ্ট নেই – ইট- কাঠের মন্দির- সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। সাঁচীর মূল স্তূপে নয়, পাশের একটি ছোট স্তূপ (যেটিকে সাঁচী ২ নং স্তূপ বলা হয়), তার প্রাচীরে ইনি আছেন। আনুমানিক দ্বিতীয় সাধারণ পূর্বশতকের। ইনি গজলক্ষ্মী নন। ইনি ঐতিহাসিক শিল্পবিদ আনন্দ কুমারস্বামীর মতে শ্রী-লক্ষ্মী। এনার হাতি নেই। বাম হাতে পদ্ম, ডান হাত কোমরে, দাঁড়িয়ে আছেন পদ্মের উপর, চারিদিকে পদ্ম। পায়ের কাছে দু’জন ক্ষুদ্রকায় সহচর- অনেকটা ভেনাস দেবীর ক্যুপিডের মত অথবা চন্দ্রকেতুগড়ের যক্ষীদের মত।
সাঁচীর দুই নং স্তূপের শ্রীলক্ষ্মী
৩) সাঁচীর মূল স্তূপের তোরণের গজলক্ষ্মী। প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের। ইনি সাতবাহন যুগের। লক্ষণাদি ভরহুতের লক্ষ্মীর মতই, তবে ইনি দাঁড়িয়ে নেই, পদ্মের উপর বসে আছেন। এখানে দুরকম পদ্মাসীনা লক্ষ্মী আছেন- একজনের পদ্মফুলের নিচে ভরহুতের মত ঘট আছে, আরেকজনের নেই।
সাঁচীর মূল স্তূপের তোরণে গজলক্ষ্মী
৪) ঐ একই সময়কালের সাঁচী ২ নং স্তূপের গজলক্ষ্মী। ভরহুতের মতই ইনি দণ্ডায়মান।
সাঁচীর দুই নং স্তূপের গজলক্ষ্মী
১, ৩, ৪ এর গজলক্ষ্মীকে অনেকে বুদ্ধের মা মায়াদেবী বলে মনে করে। গজলক্ষ্মীর প্রাথমিক উপস্থিতি বৌদ্ধশিল্পেই। অর্থাৎ এটা হতে পারে যে এটি শুরুতে মায়াদেবীর আইকোনোগ্রাফিই ছিল, যা পরে হিন্দুদের গজলক্ষ্মী হয়ে গেছে। পরের দু’হাজার বছর ধরে ঐ স্টাইলটাকেই কিন্তু গজলক্ষ্মী হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে বৌদ্ধধর্মেও লক্ষ্মী ছিলেন। খুদ্দকনিকায়ের অন্তর্গত সিরীকালকন্নিজাতকে সিরীমাতা নামে এক দেবীর উল্লেখ আছে, যিনি নিজেকে লকখি বলে পরিচয় দিচ্ছেন, তিনি ভাগ্য ও রূপের দেবী। এই সিরীকে সংস্কৃত শ্রী শব্দের পালি অপভ্রংশ বলেই মনে করা হয়। দিঘঘনিকায়ের ব্রহ্মজালসুত্তেও রয়েছে ভাগ্যদেবী সিরীর কথা।
৫) মোটামুটি ঐ প্রথম সাধারণ পূর্বশতকেই গান্ধারের শক রাজা আজ়িলিসেসের মুদ্রায় আমরা গজলক্ষ্মীকে দেখতে পাই।
শক রাজা আজ়িলিসেসের মুদ্রায় গজলক্ষ্মী
৬) এবার যাব বিদেশে। রোম। বা বলা ভাল পম্পেই। বিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে পম্পেই নগরীর ধ্বংস হওয়া- প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে একরকমের শাপে বর। আগ্নেয়গিরির লাভার দৌলতে অনেক শিল্পকর্ম রক্ষিত হয়েছিল- যেমন রোমান দেয়ালচিত্র যা রোমের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই ধ্বংসস্তূপেই পাওয়া গেছে হাতির দাঁতের পম্পেই লক্ষ্মী। প্রথম সাধারণ পূর্বশতকের। গান্ধারের আশপাশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল। আফগানিস্তানের বেগরাম গুহায় এরকম বেশ কিছু হাতির দাঁতের শিল্পকৃতি পাওয়া গেছে। এনাকে লক্ষ্মী বলা কতটা যুক্তিযুক্ত সেই নিয়ে আমরা সন্দেহ আছে, কারণ হাতি বা পদ্ম কোনওটাই এনার নেই। পায়ের কাছে দুজন ক্ষুদ্রকায় সহচর আছে- অনেকটা ভেনাস দেবীর ক্যুপিডের মত অথবা চন্দ্রকেতুগড়ের যক্ষীদের মত। পায়ের নিচে খরোষ্ঠী লিপিতে “শি” লেখা যেটাকে অনেকে শ্রী বলে অনুমান করে।
তথাকথিত পম্পেই লক্ষ্মী
লক্ষ করুন, লক্ষ্মীকে আজকের দিনে দুর্গার কন্যা আর বিষ্ণুর স্ত্রী হিসাবে দেখা হলেও, ওনার আইকোনোগ্রাফি কিন্তু দুর্গা আর বিষ্ণুর থেকে অনেক পুরোনো। মহিষমর্দিনীর প্রাচীনতম মূর্তি মথুরার নিকটবর্তী রাজস্থানের নগরে পাওয়া যায়- প্রথম সাধারণ পূর্বশতকে বা প্রথম শতকে। তৃতীয় শতক থেকে ওনাকে আরও ভালভাবে দেখা যায়- মথুরার আশেপাশেই। বিষ্ণুর আইকোনোগ্রাফির বিকাশও মথুরায়ই- ওরকম সময়ই। অথচ এদের অনেক আগেই লক্ষ্মীর বলিষ্ঠ উপস্থিতি আমরা ভরহুত ও সাঁচীতে দেখি।
৭) এবার আসব আমাদের বাংলার চন্দ্রকেতুগড়ে। এখানে বেশ কিছু শ্রী-লক্ষ্মীর মূর্তি পাওয়া গেছে- আনুমানিক প্রথম শতকের- পোড়ামাটির। ইনি পদ্মের উপর দণ্ডায়মান- দুই হাতে পদ্ম- আশেপাশেও পদ্ম- তবে হাতি নেই। মাথায় বিনুনি আছে- খোঁপাও আছে। চন্দ্রকেতুগড়ের যক্ষীদের বিনুনি বিশেষ দেখা যায় না- মূলত খোঁপা থাকে।
চন্দ্রকেতুগড়ের তথাকথিত শ্রীলক্ষ্মী
ভরহুত, সাঁচী, চন্দ্রকেতুগড় আর গান্ধারের গজলক্ষ্মী আর শ্রীলক্ষ্মী আমরা আগের পরিচ্ছেদে দেখেছি। এরা বেশীর ভাগই বৌদ্ধ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেটা স্বাভাবিক- কারণ হিন্দু শিল্পকলার বড় আকারের বিকাশ মূলতঃ গুপ্তযুগের শেষ দিকে- পঞ্চম শতক থেকে শুরু হয়। এবার আমরা গুপ্তযুগের লক্ষ্মী দেখব- তবে এঁদের উপস্থিতি ভাস্কর্যে নয়- মুদ্রা এবং শীলমোহরে। এঁরা গজলক্ষ্মী নন, সিংহবাহিনী লক্ষ্মী।
(৮) প্রথম চন্দ্রগুপ্তর সময় থেকেই স্বর্ণমুদ্রায় লক্ষ্মীর উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। প্রশ্ন হল এই সিংহবাহিনীকে দুর্গা না বলে লক্ষ্মী কেন বলা হয়? কারণ প্রায় সব মুদ্রাতেই পদ্মের উপস্থিতি দেখা যায়, এবং অনেক মুদ্রাতেই শ্রী কথাটার উল্লেখ পাওয়া যায়- মুদ্রার যে পিঠে দেবী থাকেন সেই পিঠে। অন্য পিঠে থাকতেন রাজা। পদ্মের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় পঞ্চম শতকের প্রথম কুমারগুপ্তর স্বর্ণমুদ্রায়- এখানে সিংহের পিঠে পদ্ম আর সেই পদ্মে আসীনা দেবী, তাঁর পায়ের নিচেও পদ্ম। এছাড়া স্কন্দগুপ্তের শিলালেখগুলোতে লক্ষ্মীর বিভিন্ন উল্লেখ থেকে বোঝা যায় গুপ্তসম্রাটরা লক্ষ্মীর অনুমোদনেই রাজা হতেন। তাঁর জুনাগড় শিলালেখে আছে: “ব্যপেত্য সর্বান্ মনুজেন্দ্রপুত্রান্ লক্ষ্মী স্বয়ং যং বরয়াঞ্চকার” অর্থাৎ সব মনুজেন্দ্রপুত্রদের (রাজপুত্রদের) পরিত্যাগ করে লক্ষ্মী তাঁকেই বরণ করলেন। বংশলক্ষ্মী চঞ্চলা হবার উল্লেখ তাঁর শিলালেখে আছে।
পঞ্চম শতকের প্রথম কুমারগুপ্তর স্বর্ণমুদ্রা- এখানে সিংহের পিঠে পদ্ম আর সেই পদ্মে আসীনা দেবী, তাঁর পায়ের নিচেও পদ্ম।
চতুর্থ শতকে প্রথম চন্দ্রগুপ্তর স্বর্ণমুদ্রায় উল্লেখনীয় বিষয় ছিল রাজা ও দেবীর সাথে রানি কুমারদেবীর উপস্থিতি। মুদ্রার একপিঠে রাজা-রানি, অন্যপিঠে লক্ষ্মী। প্রাচীন ভারতের খুব কম মুদ্রায় রানির এরকম গুরুত্ব দেখা যায়। লক্ষ্মী গুপ্তবংশের স্বর্ণমুদ্রায় প্রায় আবশ্যিকই ছিল, এবং সর্বত্রই তাঁর সাথে পদ্মফুল দেখা যায়। ইনি গজলক্ষ্মী নন। বেশীরভাগ মুদ্রায় তিনি সিংহবাহিনী তবে সব মুদ্রায় নয়।
তবে এই মুদ্রাশৈলী কিন্তু গুপ্তদের আগেও ছিল। কুষাণযুগে। হুবিষ্ক, বাসুদেব ইত্যাদি কুষাণরাজাদের মুদ্রায় একদিকে থাকতেন রাজা অন্যদিকে সমৃদ্ধির দেবী আরদোকশো। তিনি পদ্মাসীনা বা সিংহবাহিনী নন। তবে সিংহবাহিনী দেবী ননা ছিলেন কুষাণদের উপাস্য। কেউ কেউ এই ননাকে পরবর্তীযুগের দুর্গা ও লক্ষ্মীর সিংহবাহিনী রূপের আদিরূপ মনে করে। ষষ্ঠ শতকের কাশ্মীরে লক্ষ্মীর একটি গ্রীক প্রভাবিত মূর্তি পাওয়া যায় যেখানে হাতি এবং সিংহ দুটিই দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে বলি, মহিষাসুরমর্দিনীকে নিয়ে রচিত প্রাচীনতম সাহিত্য- ষষ্ঠ শতকের দেবীমাহাত্ম্য (বা শ্রী শ্রী চণ্ডী)- সেখানে সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনীকে মহালক্ষ্মী বলা হয়েছে।
গুপ্তযুগের পরেও স্বর্ণমুদ্রায় লক্ষ্মীর উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। আমাদের বাংলাতেই সপ্তম শতকে শশাঙ্কের স্বর্ণমুদ্রায় পদ্মাসীনা শ্রীদেবী আছেন।
এর পরবর্তী যুগে (সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক- অর্থাৎ আদিমধ্যযুগে) ভারতে স্বর্ণমুদ্রা বিরল হতে থাকে, অন্য ধাতব মুদ্রাও কম দেখা যায়। কড়ি দিয়েই বেশীরভাগ কেনা বেচা হত- অথবা বিনিময় প্রথায়। যার ফলে স্বর্ণমুদ্রার লক্ষ্মীও বিরল হতে থাকেন।
(৯) আদিমধ্যযুগে গজলক্ষ্মীকে আমরা অনেক মন্দিরে দেখতে পাই- বিশেষ করে ওড়িশার দেউলগুলোতে। দেখা যায় ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ার মন্দিরেও। ওড়িশায় প্রায় সমসাময়িক একটি হিন্দু দেউল (পরশুরামেশ্বর মন্দির- সপ্তম শতক) ও একটি বৌদ্ধ মঠ (রত্নগিরি- অষ্টম শতক)- দুই জায়গাতেই একই রকম গজলক্ষ্মী দেখা যায়। সপ্তম শতকে মহাবলীপুরমের বরাহ গুহামন্দিরে আর অষ্টম শতকে ইলোরার কৈলাশনাথ গুহামন্দিরে পাথরে উৎকীর্ণ গজলক্ষ্মী দেখা যায়।
অষ্টম শতকে ইলোরার কৈলাশনাথ গুহামন্দিরের পাথরে উৎকীর্ণ গজলক্ষ্মী
(১০) অষ্টম শতকের পর সামগ্রিকভাবে লক্ষ্মীর স্বতন্ত্র উপস্থিতি কমই- বেশীরভাগ মন্দিরেই তিনি বিষ্ণুর সহচরী, অথবা বিষ্ণুর অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিতা। দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ কর্ণাটকের হোয়সল রাজাদের সোমনাথপুর চেন্নাকেশব মন্দিরের দেয়ালে স্বতন্ত্র লক্ষ্মী দেখা যায়। হাতে নূতন উপাদান- শস্য (জোয়ার বা বাজরা)। কন্নড় ভাষায় যে কোনো শস্যকে ধান্য বলে এবং শস্য হাতে লক্ষ্মীকে ধান্যলক্ষ্মী নামে অনেক সময় চিহ্নিত করা হয়। সোমনাথপুরের এই লক্ষ্মীর হাতি নেই, পদ্ম সামান্যই, অস্ত্রগুলো বিষ্ণুর মত। এই সময়ে এবং পরবর্তী যুগে দাক্ষিণাত্যে লক্ষ্মীর আরএকটি রূপ দেখা যায়- শ্রীদেবী- কিন্তু এই রূপ গজলক্ষ্মী বা পুরোনো শ্রী-লক্ষ্মীর থেকে আলাদা। শ্রীদেবীকে প্রায় সবসময়ই বিষ্ণু এবং সপত্নী ভূদেবীর সঙ্গে গৌণ দেবী হিসাবে দেখা যায়। লক্ষ্মীর নিজস্ব মন্দির দেখা যায় কর্ণাটকে- হোয়সল রাজাদের নির্মিত হাসন জেলার ডোড্ডাগদ্দবল্লিতে অবস্থিত লক্ষ্মী মন্দির- দ্বাদশ শতকে নির্মিত। এই লক্ষ্মী অনেকটা বিষ্ণুরই মত- চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও বরাভয় মুদ্রা। এছাড়া খাজুরাহোতেও দশম শতকের একটি ছোট্ট লক্ষ্মী মন্দির আছে।
হোয়সল রাজাদের সোমনাথপুরের লক্ষ্মী। হাতে নূতন উপাদান- শস্য
বৌদ্ধধর্মের লক্ষ্মী বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। প্রাচীনতম বড় মাপের হিন্দু মন্দির হল পঞ্চম শতকের বিদিশার উদয়গিরি গুহামন্দির। সেখানে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর পায়ের নিচে লক্ষ্মী নেই। গুপ্তসম্রাটরা বৈষ্ণব ছিলেন- তাই অনুমান করা যায় লক্ষ্মীর সঙ্গে বিষ্ণুর সংযোগ মোটামুটি গুপ্তযুগে শুরু হয়। নবম দশম শতকে একদিকে ভাগবতপুরাণ ও অন্যদিকে পাঞ্চরাত্র নামক বৈষ্ণব তন্ত্র সাহিত্যের আবির্ভাব হয়। এখানে লক্ষ্মীর বৈষ্ণব সাহিত্যে উপস্থিতি দেখা যায়। পাঞ্চরাত্রের অন্তর্ভুক্ত লক্ষ্মীতন্ত্রে লক্ষ্মীই প্রধান শক্তি। তার আগের যুগের বিভিন্ন সাহিত্যে যেমন হরিবংশে বিষ্ণুর শক্তি বা সহচরী হলেন একানংশা (যাঁকে সুভদ্রা বলেও ধরা হয়)।
এতক্ষণ যাদের দেখলাম এই লক্ষ্মীদের কেউই কিন্তু বাঙালিদের পরিচিত লক্ষ্মী নন। বাঙালি লক্ষ্মীর এক হাতে ঝাঁপি অথবা গাছকৌটো, অন্য হাতে ধানের ছড়া, এবং পেঁচা বাহন- এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাচীন বা আদিমধ্যযুগের ভাস্কর্যে নেই। শস্য সোমনাথপুরের লক্ষ্মীর হাতে আছে, তাও সেটা ধানের ছড়া নয়। তাই বাঙলার লক্ষ্মী স্বতন্ত্র।
একটা জিনিস লক্ষ করতে হয়- শ্রী লক্ষ্মী, গজলক্ষ্মী, সিংহবাহিনী লক্ষ্মী, বাংলার লক্ষ্মী- এক বিষ্ণুসহচরী লক্ষ্মী বা বিষ্ণুর অনুরূপা লক্ষ্মী বাদে প্রায় সবারই আইকোনোগ্রাফিতে একটা সাদৃশ্য অবশ্যই আছে- সেটা হল পদ্মফুলের ব্যাপকতা। কখনও তিনি পদ্মাসীনা, কখনও তাঁর পায়ের নিচে পদ্ম, কখনও হাতে, কখনও বা হাতিরাও দাঁড়িয়ে থাকে পদ্মের উপর।
যাই হোক, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা কবে থেকে হল খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিছু ভাসা ভাসা উত্তর পেয়েছি। আমার কাছে যে তথ্যগুলো আছে সেগুলো দিচ্ছি-
এক) কনৌজের একাদশ শতকের উলুকবাহিনী যোগিনী। পেঁচার পিঠে বসে শিস দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছেন তিনি। দুই পায়ের নিচে পদ্মফুল আছে- তবে প্রকট ভাবে নয়- লক্ষ্মীর বৈশিষ্ট্য তেমনভাবে এঁর মধ্যে নেই। হাতে অস্ত্র। ইনি তান্ত্রিক ধর্মের যোগিনী। লক্ষ্মী হয়তো বলা যায় না। প্রায় এরকমই আরেকটি যোগিনী দশম শতকের- উজ্জ্বয়িনীতে পাওয়া গেছে।
কনৌজের একাদশ শতকের উলুকবাহিনী যোগিনী
দুই) জৌনপুরের একাদশ শতকের একটি পাখি যাকে দুই দিক থেকে হাতিরা অভিষেক করছে। খালি পাখির ডানা আর একটি হাতি অবশিষ্ট আছে। ডানা দেখে অনেকে পেঁচা মনে করে, তবে পাখিটা কোন পাখি বোঝার উপায় নেই। হাতি পদ্মফুলের উপর দাঁড়িয়ে, যেটা গজলক্ষ্মীর বৈশিষ্ট্য।
জৌনপুরের একাদশ শতকের একটি পাখি যাকে দুই দিক থেকে হাতিরা অভিষেক করছে। (তুলনার জন্য ভরহুতের গজলক্ষ্মী)
তিন) মুঘল যুগের মিনিয়েচার পেইন্টিঙে দেখা যায় গরুড়ের পিঠে চড়ে উড়ছেন বিষ্ণু ও লক্ষ্মী। এই দৃশ্য আগেও দেখা গেছে- যেমন কর্ণাটকের হোয়সল ভাস্কর্যে- তবে সেখানে গরুড় অনেকটা মানুষের মত হত- ডানা থাকত। মুঘল যুগের মিনিয়েচার পেইন্টিঙের গরুড় কিন্তু পাখির মত, ঠোঁট আছে। এটাও পেঁচার উৎস হতে পারে।
উনবিংশ শতকের প্রিন্টের যুগের বাংলার লক্ষ্মী
চার) মেসোপটেমিয়ার চার হাজার বছর পুরোনো দেবী ইশতার (বা ইনানা) ছিলেন সিংহবাহিনী এবং অনেক সময় তাঁকেও পেঁচার সাথে দেখা যেত। আড়াই হাজার বছর পুরোনো গ্রীক দেবী এথেনারও প্রতীক ছিল পেঁচা। এই পেঁচাকে মুদ্রার উপরও দেখা গেছে। তবে এত দূর দূরের সম্পর্ক না টেনে আনাই কাজের।
উনবিংশ শতকের রাজা রবি বর্মার গজলক্ষ্মী
মোট কথা- এই প্রশ্নের খুব স্পষ্ট উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। এক বাংলা আর ওড়িশার গার্হস্থ্য উপাসনায়ই লক্ষ্মীর এই “বাঙালি” রূপ দেখা যায়। আর দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। প্রায় সবই অস্থায়ী প্রতিমা। ইনি মন্দিরের দেবী নন। যার ফলে এই রূপের প্রত্নতাত্ত্বিক উপস্থিতি তেমনভাবে নেই। বাংলার লক্ষ্মীর আইকোনোগ্রাফির বিকাশ অনেকটাই নিজস্ব ও স্বতন্ত্র, এবং স্বতন্ত্রভাবেই তাকে দেখা উচিত। প্রাচীন বা আদিমধ্যযুগের আইকোনোগ্রাফির মাধ্যমে তাঁকে সম্পূর্ণরূপে খুঁজে পাওয়া যায় না।
তথ্যসূত্র:
1. Early Indian Iconography, Ananda K Coomaraswamy
2. http://www.cssmberachampa.org/doc/MUSEUM.pdf
3. Buddhist Architecture, By Huu Phuoc Le
4. Srivastava, A. (1987). Ulūka-Vāhinī Lakṣmī. East and West, 37(1/4), 455-459. Retrieved October 31, 2020, from http://www.jstor.org/stable/29756829
5. https://en.wikipedia.org/wiki/Pompeii_Lakshmi
6. http://people.bu.edu/ptandon/Lion-Conqueror.pdf
7. https://coinweek.com/ancient-coins/coinweek-ancient-coin-series-coinage-of-the-guptas/
8. ICONOGRAPHY OF GAJA-LAKSHMI- O.P. Singh
9. ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
তথ্য বহুল তো বটেই,খুব সুন্দর ভাবে আলোচনাও করা হয়েছে। একাদশ শতকের ঐ উলুকের বর্তমান সংস্করণ পেঁচা বলা যেতে পারে।
Khub bhalo laaglo.. Kojagori laxmi pujo ekanto bhabe purbo bongo r sathe jukto holo ki bhabe seta niye janale khushi hobo.
তথ্যপুর্ণ আলোচনা | সম্পুর্ণ নতুন বিষয়ে জানতে পারলাম | ধন্যবাদ |
Maa amar maa🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🙏🙏🙏🙏🙏🌹🙏
লেখা’টি পড়ে খুব ভালো লাগলো| একটা প্রশ্ন মনে আসছে যে হয়শালা’দের আগের কোন লক্ষ্মীর নিদর্শন কি পাওয়া যায়নি?
গজলক্ষ্মী আর শ্রীলক্ষ্মী তো অবশ্যই পাওয়া গেছে, সেই সাচীর স্তূপের যুগ থেকে।
ভালো লেখা।
বাঙ্গলার লক্ষ্মী স্বতন্ত্র।
অসাধারণ তথ্যবহুল প্রবন্ধ।
পুরোটা পড়ে বুঝলাম, বাংলা ও বাঙালির সবকিছুই একটু বেশিই স্বতন্ত্র আর বোধকরি এর মূলেও সেই তন্ত্র আর আমাদের শাক্ত পরম্পরা।
তথ্যবহুল লেখা, পড়ে খুব ভালো লাগলো।
লেখকের সংযোজন:
গুপ্তসাম্রাজ্যের একটি স্বর্ণমুদ্রায় কর্নোকুপিয়া (মোষের শিঙের মত পাত্র যাতে ফলমূল ও ধনসম্পদ থাকে- অনেকটা লক্ষ্মীর ঝাঁপির মত) সহ লক্ষ্মী দেখা যায়। এরকম এক দেবী টাইকি (গ্ৰিকদের ঐশ্বর্যের দেবী) দেখা যায় আফগানিস্তানের কুষাণ যুগে হড্ডার বৌদ্ধ বিহারে। ইনিও কর্নোকুপিয়া হাতে। এদেরকে আধুনিক লক্ষ্মীর প্রাচীন রূপ ধরা যায়।
হোয়েসলের লক্ষ্মীর মুখাবয়ব দেখে মঙ্গোলীয় মনে হ’লো। বেশ স্পষ্ট মিল। কার্য-কারন কী হতে পারে? নাকি শিল্পীর কল্পনার প্রকাশ?
দক্ষিণ ভারতের মহিলাদের বিশেষ করে তামিলনাড়ু আর দক্ষিণ পূর্ব কর্ণাটকে মহিলাদের মুখ গোল ঘেঁষা হয়। এটা মোঙ্গোল ফিচার নয়। যেমন, জয়ললিতা।
অত্যন্ত তথ্যনির্ভর ও গুছিয়ে লেখা আর ছবির ব্যবহার সত্যিই প্রশংসনীয়। পড়তে ও বুঝতে খুবই সুবিধা হয়েছে।
আপনি সব থেকে জরুরি তথ্যটিই বাদ দিয়ে গেছেন! যাঁর সাথে লক্ষ্মীদেবীর মূর্ত্তির মিল সব থেকে বেশি, তিনি হলেন লিলিথ।
https://www.biblicalarchaeology.org/daily/people-cultures-in-the-bible/people-in-the-bible/lilith/
পুনশ্চ (লেখকের বক্তব্য):
১) সংযোজন: এই লক্ষ্মীর ইতিহাসে যেটা বাদ গেছে সেটা হল আফগানিস্তানের হড্ডায় কর্নোকুপিয়া অর্থাৎ মোষের শিঙের ঝাঁপি হাতে টাইকি।
২) সংশোধন: গুডিমল্লমের শিবলিঙ্গের সোয়া দু হাজার বছরের ইতিহাসের তথ্য ভুল। মথুরা বা অহিচ্ছত্রর শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে একথা তাও বলা যায়। অন্ততঃ ১৭০০-২০০০ বছরের ইতিহাস এদের আছে
পেঁচা আর উলুকবাহিনী যোগিনী প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়লো ,আমাদের চামুন্ডা যিনি ,সেই দেবীরও বাহন কিন্ত পেঁচা।