ক্যাতিন গণহত্যা রহস্য, প্রমাণাদি ও রহস্যের সমাধান
(এই প্রবন্ধটির যুগ্ম লেখক হলেন আলী নাঈম। আলী নাঈম সক্রিয়ভাবে ঢাকায় পাঠাগার আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত। তিনি তিনটি বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন।)
ক্যাতিন, এক ছোট্ট গ্রাম্য বনাঞ্চল, রাশিয়ার স্মলেন্সক থেকে আনুমানিক ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বন-জঙ্গলের এই ছোট্ট জায়গাটির নাম দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে জড়িত। এ জায়গাটির সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার পোলিশ সৈনিক, সেনাকর্মকর্তা আর বুদ্ধিজীবী গণহত্যার ঘটনা, যার জন্য দায়ী করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের এন. কে. ভি. ডি.-কে। এই এন. কে. ভি. ডি. বা ‘পিউপিলস কমেসারিয়েত অফ ইন্টারনাল এফেয়ারস’ সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ হিসাবেও পরিচিত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, বহু বছর ধরে নাৎসি জার্মানিকে ক্যাতিন গণহত্যার জন্য দায়ী করলেও ১৯৯০ সালে মিখাইল গর্বাচেভ স্বীকার করেন যে এন. কে. ভি. ডি. পোলিশ সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করেছিল এবং তার পরে মেডোনোয়ী ও পিয়াটিখাটকি নামের দুটো গণকবরের বাইরে আরও দুটো গণকবরের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক গবেষক এবং সরকারি সংস্থা এই ক্যাতিন গণহত্যার সাথে জোসেফ স্ট্যালিনের নামও জড়িয়ে দেন এবং বলা হয়ে থাকে যে ক্যাতিন গণহত্যার নির্দেশ সরাসরি দিয়েছিলেন জোসেফ স্ট্যালিন। যদিও ক্যাতিন গণহত্যার ঘটনাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যান্য গণহত্যার তুলনায় অনেক কম আলোচনাতে এসেছে কিন্তু স্ট্যালিনের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার প্রমাণের জন্য সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিরোধী বুদ্ধিজীবীসহ সারা বিশ্বের বহু প্রগতিশীল উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীও ক্যাতিন গণহত্যাকে সামনে তুলে আনেন।
এই ক্যাতিন গণহত্যা সম্পর্কে সি. আই. এ.-র লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে [১] বলা হচ্ছে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথমদিকে এবং নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে কুখ্যাত– যুদ্ধবন্দী গণহত্যার ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি ঘটনা যুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধের উত্তেজনাতে ঘটেনি বরং ঘটেছিল ঠাণ্ডা মাথায় রাজনৈতিক হত্যা হিসাবে। এই হত্যাকাণ্ডের বলি হয়েছিল পোলিশ সৈনিক, সেনাকর্মকর্তা এবং বেসামরিক নাগরিক; যাদেরকে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে রেড আর্মি পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার পর বন্দী করে। গ্রেফতারকৃত পোলিশ সেনা সদস্যরা যুদ্ধবন্দি ছিল না। ইউ. এস. এস. আর. তখনো যুদ্ধই ঘোষণা করেনি এবং পোলিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ পোলিশ বাহিনীকে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে না জড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সি. আই. এ.-র মতানুযায়ী পোলিশ সেনাবাহিনীর করার ক্ষমতা ছিল খুবই অল্প। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং নাৎসি জার্মানি, যারা আগস্ট মাস থেকে মিত্রতা বজায় রেখে আসছিল, পোলিশ রাষ্ট্রকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং পোলিশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়। এর পরেই শুরু হয় সোভিয়েত এবং নাৎসি জার্মানির নিজ নিজ দখলকৃত এলাকাতে পোলিশ প্রতিরোধ শক্তি ও পোলিশ এলিটদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। সোভিয়েত এন. কে. ভি. ডি. এবং জার্মান গেস্টাপো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবন্দি বিনিময় এবং পারস্পরিক কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমে পোলিশদের উপর দমন চালিয়েছিল। ব্রেস্ট-লিটোভস্ক নামের জায়গাতে জার্মান এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী যৌথভাবে বিজয় প্যারেডও করেছিল।
এই বিজয় প্যারেড সংগঠিত করেছিলেন সোভিয়েত কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) সেমিয়ন ক্রিভোসচিয়েন এবং জার্মান জেনারেল হেইঞ্জ গুডেরিয়ান। দুজনেই ছিলেন সুবিদিত ট্যাঙ্ক কমান্ডার, যার একজন সিমিয়ন ক্রিভোসচিয়েন তাঁর ট্যাঙ্ক নিয়ে ১৯৪৫ সালে প্রথম বার্লিনে পৌঁছোন আর অন্যজন জার্মান জেনারেল হেইঞ্জ গুডেরিয়ান তাঁর প্যাঞ্জার ট্যাঙ্ক গ্রুপ নিয়ে প্রথম মস্কোকে আক্রমণ করেছিলেন। সি. আই. এ.-র রিপোর্ট মোতাবেক, সোভিয়েত মিলিটারি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স জেনারেল সেমিয়ন ক্রিভোসচিয়েনের সাথে জেনারে হেইঞ্জ গুডেরিয়ানের করমর্দন রত ফটো দেখে জার্মান গুপ্তচর হিসাবে সন্দেহ করেছিল কিন্তু পরে সি. আই. এ.-র মতে সিমিয়ন ইহুদী ধর্মাবলম্বী হওয়াতে এ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।
সি. আই. এ.-র এই ওয়েবসাইটে ক্যাতিন গণহত্যার সাথে স্ট্যালিনের সম্মতির প্রমাণ হিসাবে এন. কে. ভি. ডি.-র লেটারহেডে এল. বেরিয়া প্রেরিত এক মেমোরেন্ডামের ছবি দেওয়া হয়েছে যেখানে বেরিয়া কমরেড স্ট্যালিনকে প্রস্তাব করেছিলেন যে পোলিশ সেনাকর্মকর্তা, সৈনিক এবং অন্যান্য বন্দীদের গুলি করে মেরে ফেলা হোক। মেমোরেন্ডামের উপরে স্ট্যালিনের হাতের স্বাক্ষরের পরে পলিটব্যুরোর সদস্য কে. ভরোশিলভ, ভি. মলোটভ এবং এ. মিকোইয়ানের স্বাক্ষর আছে। বাম দিকে আছে এম. কালিনিন এবং এল. কাগানোভিচের স্বাক্ষর। সি. আই. এ.-র মতে এসব স্বাক্ষর এ গণহত্যার সম্মতির প্রমাণ।
নিচে মেমোরেন্ডামটির ছবি দেওয়া হল:
অক্টোবর ১৫, ১৯৯২ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয় যে, ওইদিন রাশিয়ার সরকার প্রথমবারের মতো সরকারি গোপন দলিল সাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করেন। এই প্রকাশিত দলিলে দেখা যায়, মার্চ, ১৯৪০ সালে স্ট্যালিনের পলিটব্যুরোর বিশেষ নির্দেশে ২০,০০০ পোলিশদের খুন করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল প্রায় ৫০০০ পোলিশ সেনাকর্মকর্তা যাদের মৃতদেহ ক্যাতিন জঙ্গলের গণকবরে ফেলা হয়েছিল। ওইদিনেই বরিস ইয়েলৎসিনের মুখপাত্র মিখাইল গর্বাচেভকে, ক্যাতিন গণহত্যাতে স্ট্যালিনের ভূমিকা গোপন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য ১৯৯০ সালে মিখাইল গর্বাচেভ, ক্যাতিন গণহত্যার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের দায় স্বীকার করেন।
রয়টার প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে প্রায় ১৫,০০০ পোলিশ সৈনিক, সেনাকর্মকর্তা এবং বুদ্ধিজীবীর মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল এবং তিনটি গণহত্যার জায়গাগুলোর মধ্যে একটি ছিল পশ্চিম রাশিয়ার স্মলেন্সকের কাছে ক্যাতিন জঙ্গল। ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের পরে ৭০০০ পোলিশ বন্দীর মৃতদেহের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।[২]
এই ক্যাতিন গণহত্যা নিয়ে লিখিত জর্জ স্যানফোর্ড-এর লেখা ‘ক্যাতিন এবং ১৯৪০ সালের সোভিয়েত গণহত্যা: সত্য, বিচার এবং স্মৃতি’ নামের বইতে লেখেন যে ১৯৪০ সালের বসন্তকালে স্ট্যালিনের সিকিউরিটি পুলিশ এন. কে. ভি. ডি. ১৫,০০০ পোলিশ কয়েদীকে গণহারে খুন করেছিল যারা ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ডের সাথে নাৎসি-সোভিয়েত যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। জার্মানরা ১৯৪৩ সালে সোভিয়েত আক্রমণের সময় এই ক্যাতিন গণকবর আবিষ্কার করে।
সত্যিই কি সোভিয়েত লালফৌজ পোলিশ বন্দীদের গণহারে হত্যা করেছিল? সত্যিই কি জোসেফ স্ট্যালিন এই হত্যাকাণ্ডে সম্মতি দিয়েছিলেন? সি. আই. এ.-র হাজির করা এই মেমোরেন্ডাম তাহলে কীসের মেমোরেন্ডাম? মিখাইল গর্বাচেভ এবং বরিস ইয়েলৎসিনের দেওয়া গোপন দলিল-পত্রাদি ও তাঁদের বক্তব্য তাহলে কি মিথ্যা? এত গবেষণা, এত বই, এত লেখালেখি তাহলে কি মিথ্যার উপর ভিত্তি করে লেখা?
ক্যাতিন গণহত্যার জন্য এন. কে. ভি. ডি.কে দায়ী করে জার্মান পোস্টার
এমনতর হাজারো প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক কারণেই উত্থাপিত হতে পারে। তারও পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসে ক্যাতিন গণহত্যার বিষয়টি তেমন করে সারা বিশ্বের সাধারণের সামনে আসেনি যেমনটি জার্মানদের ইহুদী নিধনের ঘটনাগুলো এসেছে। জার্মানদের আবিষ্কৃত গণকবর এবং জার্মানদের প্রচারিত ‘পোলিশবন্দীদের হত্যা করেছে সোভিয়েত’– এই বক্তব্যকে সত্য ধরে নিয়েই আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ সকল পুঁজিবাদী ও পুঁজিবাদী মননে আচ্ছন্ন প্রগতিশীলরাও বিশ্বাস ও প্রচার করেছেন। খুব সামান্য কয়েকজন রাশিয়ান ও আমেরিকান গবেষক, বহুল প্রচারিত ‘সোভিয়েত কর্তৃক পোলিশ গণহত্যা’র এই ‘অফিসিয়াল হিস্ট্রি অব ক্যাতিন’-এর [৩] বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন গ্রোভার ফার।
গ্রোভার ফার ‘দ্যা মিষ্ট্রি অফ দ্যা ক্যাতিন ম্যাসাকার: দ্যা এভিডেন্স, দ্যা সলিউশান’ বইতে বলেছেন যে, ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে নাৎসি জার্মানি দাবি করে যে ১৯৪০ সালে সোভিয়েত বাহিনী হাজারো পোলিশ সেনাকর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল; জার্মান সেনাবাহিনী সেই নিহত পোলিশদের গণকবর আবিষ্কার করেছে। জার্মানরা আরো দাবি করে যে আবিষ্কৃত গণকবর, পশ্চিম রাশিয়ার স্মলেনস্ক শহরের কাছে ক্যাতিন জঙ্গলে। ইতিহাসে এটাই ক্যাতিন গণহত্যা নামে পরিচিত। নাৎসি জার্মানদের প্রচারিত এই ঘটনাটি সবাই সত্য হিসাবে গ্রহণ করেন।
নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিন, যার নেতৃত্বে ছিলেন জোসেফ গোয়বলস, এই দাবীকৃত গণকবর আবিষ্কারকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালান। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে এই প্রচারকে কেন নাৎসি জার্মানি এত গুরুত্ব দিয়েছিল বা কেনই বা তা করেছিল? ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোভিয়েত সেনাবাহিনী যখন জার্মানদের হাত থেকে স্ট্যালিনগ্রাদ মুক্ত করে নেয়, তখন সোভিয়েত সেনাবাহিনী এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্ম দেওয়াসহ পশ্চিমী মিত্র শক্তির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কে ফাটল ধরানো ছিল একটা উদ্দেশ্য।
জোসেফ স্ট্যলিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার নাৎসি জার্মানির এই অভিযোগকে সজোরে অস্বীকার করেন। প্রবাসী পোলিশ সরকার, যারা ছিলেন কমিউনিস্ট ও সোভিয়েত বিরোধী, তারা জার্মান নাৎসিদের প্রচারণার সপক্ষে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখেন, এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত সরকার তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সোভিয়েতের সাথে সুসম্পর্কপূর্ণ পোলিশ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও পোলিশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠাতে সাহায্য করেন।
১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লালফৌজ জার্মান সেনাবাহিনীকে ক্যাতিন এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বারডেঙ্কো কমিশন তাঁদের রিপোর্টে জার্মান সেনাবাহিনীকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ক্যাতিন গণহত্যা নিয়ে গ্রোভার ফার বর্ণনার একদিকে আছে ‘অফিসিয়াল হিস্ট্রি অব ক্যাতিন’, যাতে গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে এবং স্ট্যালিনকে, আর অন্য দিকে আছে, যাকে আমরা বলতে পারি ‘বারডেঙ্কো কমিশন ভার্সান’, যাতে দাবি করা হয়েছে জার্মানরা এই গণহত্যার জন্য দায়ী।
এখন আমরা দেখবো গ্রোভার ফার, তাঁর বইতে কীভাবে একের পর এক ক্যাতিন গণহত্যার ‘অফিসিয়াল হিস্ট্রি’-কে চ্যালেঞ্জ করেছেন, দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাথমিক সূত্রবিহীন তথ্যাবলীর উপর ভিত্তি করে একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্ট্যালিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ক্যাতিন গণহত্যার ‘অফিসিয়াল ভার্সান’ মোতাবেক, পোলিশ বন্দীদের রাখা হয়েছিল কোজেলস্ক, স্টারবোলেস্ক, এবং অস্টাশখোব নামের তিনটি ক্যাম্পে এবং এই তিন ক্যাম্প থেকেই বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয় স্মলেনস্ক, খারকিব বা খারকোভ (রাশান উচ্চারণে) এবং কালিনিন নামের জায়গাতে যেখানে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করার পর গণকবর দেওয়া হয়েছিল অন্য জায়গায়– ক্যাতিন, পিয়াটাইখটকি এবং মেডনোই নামের জায়গাতে।
নিচে একটা মানচিত্র দেওয়া হলো যাতে ‘অফিসিয়াল ভার্সান’ অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্প এবং গণকবরের স্থানগুলো দেখানো হয়েছে এবং এখানে লক্ষণীয় ক্যাম্প এবং গণকবরের দূরত্ব (প্রায় ৭০০ মাইল!)। মনে রাখতে হবে এ সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট-বিরোধী পোলিশদের সাথে যুদ্ধ হয়নি বা হত্যার ঘটনা ঘটেনি এমন নয়, কিন্তু যখন বলা হয় যে সোভিয়েতরা গণহত্যা করেছে, তখন এই দূরত্বের বিষয়টি সংশয়ের এবং প্রশ্নের জন্ম দেয়।
যদি ধরেই নেওয়া যায় যে সোভিয়েত সেনাবাহিনী পোলিশদের গণহত্যা করেছে, (যদিও এভাবে ধরে নিয়ে আলোচনা করা সঠিক পদ্ধতি নয়), তাহলেও কি প্রশ্ন জাগে না যে কোন কারণে সোভিয়েতের যুদ্ধবন্দিদের গুলি করে খুন করার জন্য, গণহত্যা করার জন্য ৭০০ মাইল দূরে নিয়ে আসবে? মহাযুদ্ধকালীন সময়ে পরিবহন ব্যবস্থা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর চলাচল ব্যবস্থা সুষ্ঠ রাখাই যথেষ্ট কষ্টকর ছিল, সেখানে যুদ্ধবন্দীদের গণহত্যার জন্য ৭০০ মাইল দূরে নিয়ে যাওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য?
১৯৯০, ১১৯১, এবং ১৯৯২ সালে তিন বয়োবৃদ্ধ এন. কে. ভি. ডি.-র তিন সদস্যকে চিহ্নিত করে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তাঁরা তাঁদের সাক্ষাৎকারে জানান যে ১৯৪০ সালের এপ্রিল এবং মে মাসের দিকে তাঁরা পোলিশদের গুলি করে হত্যার কথা জানতেন কিন্তু গুলি করে হত্যার এসব ঘটনা ক্যাতিন জঙ্গলে ঘটেনি, যা জার্মানরা প্রচার করেছে।
১৯৯২ সালে বরিস ইয়েলেৎসিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়ার সরকার পোলিশ সরকারের কাছে ইতোপূর্বে উল্লেখিত স্ট্যালিন ও পলিটব্যুরোর মেম্বারদের স্বাক্ষরকৃত মেমোরেন্ডামটি হস্তান্তর করে। গ্রোভার ফার সংশয় নিয়েই বলেন যে, যদি এ দলিলটি আসল হয় তবে ক্যাতিন গণহত্যার জন্য সোভিয়েত যে দায়ী নিঃসন্দেহে তা প্রমাণ হবে।
বলা হয়ে থাকে এই দলিলটি পাওয়া গিয়েছিল ‘ক্লোজড প্যাকেট নং ১’-এর মধ্যে। ক্লোজড বলতে এখানে সর্বোচ্চ গোপনীয় দলিল বোঝানো হয়েছে। কিন্তু গ্রোভার ফার, যিনি রুশ ভাষা জানেন ও অভিজ্ঞ, বলেন যে সরবরাহকৃত একটি দলিলও একার্থক ও সুনির্দিষ্ট নয়। প্রমাণপত্রগুলো, তা হোক দলিল অথবা অন্য কোনো সামগ্রী, প্রত্যেকটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ‘ক্লোজড প্যাকেট নং ১’-এর অস্তিত্ব ১৯৯২ সালের আগে ছিল না, হঠাৎ করে ১৯৯২ সালে এর উদ্ভব। এর পরেও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়, আর তা হল যদি সোভিয়েত এই গণহত্যার জন্য দায়ীই হয় অথচ তা অস্বীকার করতে থাকে তবে বহু বছর ধরে কোন কারণে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এই দলিলকে ধ্বংস না করে বরিস ইয়েলেতসিনের জন্য সংরক্ষণ করবে? এই দলিল নিয়ে সোভিয়েত গবেষক ইউরি মুখিন, ১৯৯৫ সালে ‘ক্যাতিন রহস্য’ [৪] নামের প্রকাশনাতে এই দলিলকে বানানো দলিল বলে আখ্যায়িত করেন। ইউরি মুখিনের বইটি প্রকাশের সাথে সাথে অনেকেই তাঁর পক্ষাবলম্বন করেন।
গ্রোভার ফার তাঁর বইতে জার্মানদের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করেন এবং এ রিপোর্ট ও জার্মানদের অন্যান্য দলিলপত্রে যে অনেক শুভংকরের ফাঁকি আছে তা তুলে ধরেন।
১৯৪৩ সালের জার্মান রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে ক্যাতিন গণকবরে জার্মান সৈনিকদের ব্যবহৃত গুলির খোসা পাওয়া গিয়েছিল।
জার্মানরা নিশ্চয় তাঁদের রিপোর্টে এ তথ্যটি বানিয়ে দেয়নি। গোয়েবলস তার ডায়রিতে এই ব্যাপারে প্রচণ্ড অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। জার্মানদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল এটা বিশ্বাস করাতে যে সোভিয়েত সৈন্যরা জার্মান বুলেট ব্যবহার করেছিল গণহত্যা করার জন্য। আমরা এ ব্যাপারে পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করব।
জার্মান রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে ক্যাতিনের জঙ্গলে পাওয়া পোলিশ সেনাসদস্যদের দেহাবশেষের সাথে যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্প অস্টাশখোব-এর ব্যাজ পাওয়া গিয়েছিল । জার্মানরা তাদের রিপোর্টে আরো উল্লেখ করে যে সম্ভবত অস্টাশখোব থেকে আসা যুদ্ধবন্দীদের থেকেই এ ব্যাজ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এই ব্যাজধারী অর্থাৎ অষ্টাশখোব থেকে আসা কোনো যুদ্ধবন্দীর কোনো প্রমাণ জার্মানরা হাজির করতে পারেনি।
পোলিশ যুদ্ধবন্দী যাদের মৃতদেহ কাতিনের গণকবরে পাওয়া গিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে এ সব বন্দীদের স্মলেন্সক শহরের কাছে কোজেলস্ক নামের সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্পেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু ক্যাতিন গণকবরে আবিষ্কৃত মৃতদেহের তালিকাতে এমন সব পোলিশ যুদ্ধবন্দির নাম ছিল যাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল স্টারবেলস্ক অথবা অস্টাশখোব যুদ্ধবন্দি ক্যাম্পে।
গ্রোভার ফারের মতে, জার্মানরা খুব তাড়াতাড়ি তাদের রিপোর্ট তৈরি ও প্রকাশ করতে গিয়ে এ নামগুলো বাদ দিতে পারেনি। এখানে মনে রাখা দরকার, এর কিছুদিন পরেই সোভিয়েত লালফৌজ, জার্মানদের ক্যাতিন এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে যুদ্ধকালীন সময়ে যখন জার্মানরা বুঝতে পেরেছিল যে লালফৌজের সাথে যুদ্ধে তারা টিঁকতে পারবে না, পিছু হটতে হবে, তখন দ্রুততার সাথে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে এ ধরনের ভুল করেছিল।
১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে দাখিলকৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের বারডেঙ্কো প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট দলিল দস্তাবেজ
জার্মানদের মতো সোভিয়েত কর্তৃপক্ষও পোলিশ মৃতদেহগুলো উদ্ধার এবং দলিলপত্র ও প্রমাণাদির জন্য অনুসন্ধান চালায়। বারডেঙ্কো প্রতিবেদনে চারটি মৃতদেহ থেকে উদ্ধার করা নমুনা ও প্রমাণের বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
একজন পোলিশ বন্দীর মৃতদেহ থেকে পাওয়া থেকে দেখা যায় যে বন্দীকে অস্টাশখোব ক্যাম্প থেকে কালিনিন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত তদন্তকারীরা দলিলপত্র থেকে বন্দীর পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উদ্ধার করতে পারেননি। কারণ প্রাপ্ত দলিলে বন্দীর নামের প্রথম অংশটি পাঠযোগ্য ছিল না। ফলে সোভিয়েত তদন্তকারী দল এটা বুঝতে পারেননি যে মৃত এই বন্দী অস্টাশখোব যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে ছিল। তবে সেদিন এটা প্রমাণ করা গেলে, ক্যাতিনে পাওয়া এই মৃতদেহের অস্তিত্ব জার্মান তদন্ত প্রতিবেদনের দুর্বলতা উন্মোচিত করে দিত। কিন্তু এ বিষয়টিকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেননি।
গণকবরে পাওয়া বুলেটের খোসর শতকরা ৯৬ ভাগ থেকে ৯৮ ভাগ ছিল জার্মানির তৈরি এবং বুলেটের প্রস্তুতকাল ১৯৪১ সাল।
২০১১ সালের নভেম্বরে ইউক্রেনের ভোলডিমির-ভোলিন্সকাই নামের স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন প্রতিবেদনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য বেরিয়ে আসে। সেগুলো হল :
১. পশ্চিম ইউক্রেনের এই শহরের গণকবর থেকে পাওয়া দুজন পোলিশ যুদ্ধবন্দীর ব্যাজ থেকে দেখা যায়, এই যুদ্ধবন্দী দুজনকে অস্টোসভস্কি থেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। অথচ জার্মানদের রিপোর্ট বা অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী এ দুজনকে কালিনিনে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তাদেরকে হত্যার পর মেডনোইতে কবর দেওয়া হয়। এদের নাম ওখানকার পোলিশ কবরস্থানের স্মৃতিস্তম্ভেও লেখা আছে! সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়া এবং স্ট্যালিনের নামে যাদের জ্বর হয়, তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য যে জার্মান অফিসিয়াল রিপোর্ট, সেই রিপোর্টের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে বলে এ ব্যাজ দুটি নিয়ে বা দেহাবশেষের ডি. এন. এ. পরীক্ষা নিয়ে পোলিশ-ইউক্রেনের প্রত্নতাত্ত্বিকরা একটি মন্তব্যও করেননি।
২. পোলিশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা গণহত্যার পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে দেখান যে জার্মান এস. এস.-এর অন্যতম কমান্ডার ফ্রেডরিক জ্যাক্লন যে পদ্ধতিতে গণহত্যা চালাত, সেই ‘সারডিন প্যাকিং’ পদ্ধতিই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। কমান্ডার জ্যাক্লন অতিরিক্ত কবর খনন এড়ানোর জন্য বিশাল গর্তে প্রথমে এক ব্যাচ বন্দিকে নামিয়ে শুয়ে থাকার নির্দেশ দিতেন। এরপর গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলার পর আরেক ব্যাচ বন্দিকে মৃতদেহের পায়ের দিকে মাথা রেখে শুয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে একইভাবে গুলি করে মেরে ফেলতেন। প্রক্রিয়াটি পুরো গর্তটি না ভরা পর্যন্ত চলতে থাকত। এটাকেই তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘সারডিন প্যাকিং’ পদ্ধতি (বাংলাদেশের জেলখানায় ‘ইলিশ ফাইল’ পদ্ধতির সাথে তুলনীয়)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এই কমান্ডার সোভিয়েত বাহিনীর হাতে বন্দী হলে বিচারে নিজের দোষ স্বীকার করেন এবং ফাঁসিতে তাঁর মৃত্যু হয়।
৩. নিরপেক্ষ গবেষকদের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে জার্মান বাহিনী ১৯৪১ সালে ইউক্রেন দখলের পর ইউক্রেন জাতীয়তাবাদীদের সহায়তায় অনেক সোভিয়েত নাগরিক ও ইহুদীদের হত্যা করা হয়েছিল।
৪. এই প্রত্নতাত্ত্বিক খননের রিপোর্টটি জার্মান রিপোর্ট বা অফিসিয়াল রিপোর্টের অনেক মিথ্যাকে উন্মোচিত করেছিল বিধায় প্রকাশনাটি তুলে নেওয়া হয়, খননস্থানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ এ রিপোর্টে স্ট্যলিনকে বা এন. কে. ভি. ডি.-কে দায়ী করা যাচ্ছিল না, যা এত দিনের সোভিয়েত-বিরোধী প্রচারণাগুলোকে ডাহা মিথ্যা হিসাবেই চিহ্নিত করছিল।
জার্মান প্রতিবেদন বা ক্যাতিন হত্যাকাণ্ডের অফিসিয়াল প্রতিবেদন
ক্যাতিন গণহত্যা নিয়ে জার্মান প্রতিবেদন বা অফিসিয়াল প্রতিবেদনে অনেক অসঙ্গতি দেখা যায়। স্থানীয় অনেক বাসিন্দার যে সাক্ষাৎকারের উল্লেখ প্রতিবেদনে করা হয়েছিল, সেই সাক্ষাৎ প্রদানকারীরা অনেকেই তাঁদের বক্তব্য পরে অস্বীকার করেন। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী দলের তিন সদস্য, যারা জার্মানির অনুরোধে মৃতদেহগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সোভিয়েতকে দায়ী করে দেওয়া বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁরা জার্মান প্রতিবেদনের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেন। ভিন্ন একটি দলের দুই পোলিশ বিজ্ঞানীও তাঁদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন।
এসব তথ্য থেকে মনে হতেই পারে যে জার্মান প্রতিবেদন হচ্ছে মিথ্যায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এসব তথ্যের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তোলা যায়। স্থানীয়দের এবং বিজ্ঞানীদের বক্তব্য পরিবর্তন বা সমর্থন প্রত্যাহারের কারণ সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের ভীতিও হতে পারে অথবা এমনও হতে পারে যে জার্মানরা ভয় দেখিয়েই প্রথমে তাঁদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছিল। আবার, এমনকী দুটোই হতে পারে!
গণকবরে ডায়রি, ক্যালেন্ডার, নোটবুক, এনভেলাপ, চিঠি, সংবাদপত্র, টিকার সনদপত্রসহ আরো অনেক রকম দলিল পাওয়া গিয়েছিল। জার্মান প্রতিবেদন বা অফিসিয়াল প্রতিবেদনে এ সমস্ত দলিলের বা প্রমাণপত্রে উল্লেখিত তারিখের কোনটাই ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসের পরের নয় কোনো তারিখ ছিল না। জার্মান এবং পোলিশরা এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত প্রাপ্ত দলিলপত্রের তারিখের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে যে, গণহত্যা হয়েছিল ১৯৪০-এর এপ্রিল মাসের আগেই।
পাঠক, এখানে তারিখটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেন?
প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজে এই তারিখ বা বছরের উল্লেখ মানেই হচ্ছে এই তারিখ বা সময়ের অব্যবহিত পরেই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই তারিখটি হচ্ছে ‘terminus post quem’ বা সম্ভাব্য সবচেয়ে নিকটতম সময়। কারণ ওই সময়ে পোল্যান্ড, জার্মান ও সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। আর এর পরপরই জার্মানরা সোভিয়েত আক্রমণ মোকাবেলার পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। গণকবরের দেহাবশেষের সাথে প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজের সময় যদি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ে হয়, তখন তো স্বাভাবিক কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে সোভিয়েতই এ গণহত্যা ঘটিয়েছে।
গ্রোভার ফার জার্মান তদন্ত প্রতিবেদন বা অফিসিয়াল তদন্ত প্রতিবেদনের বিভিন্ন মিথ্যা চিহ্নিত করার পরেও বলেন যে পোলিশদের কারা হত্যা করেছিল, সেটাই বেশি জরুরি। এ গণহত্যার রহস্য ভেদ করার জন্যই দরকার প্রত্যেকটি দলিল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং যে সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ ও প্রমাণাদি নিয়ে কোনো জুয়াচুরি সম্ভব নয়, সেগুলোর ভিত্তিতে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা। জার্মান তদন্ত প্রতিবেদন বা সোভিয়েত তদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে কোনটি অধিকতর মিথ্যায় পরিপূর্ণ, সেটা খুব জরুরি নয়।
গ্রোভার ফার জার্মান তদন্ত প্রতিবেদনের বেশ কিছু অংশ জার্মান ভাষাতেই উদ্ধৃত করে তাঁর ইংরেজি অনুবাদও দেন। আমরা সকল উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখের প্রয়োজন দেখছি না, শুধু আমাদের আলোচনার সপক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতিগুলোই উল্লেখ করা হল:
Außerhalb der Gräber wurden eine Anzahl beschossener Pistolenhälsen mit dem Bodenaufdruck “Geco 007.65” gefunden; desgleichen vereinzelt in den Gräbern zwischen den Leichen. (35)
ইংরেজি অনুবাদ: “Outside the graves were found a number of pistol shells with the headstamp ‘Geco DD 7.65.” Individual examples were also found in the in the graves among the corpses.”
বাংলা অনুবাদ: “কবরের বাইরেই বেশ কিছু পিস্তলের গুলির খোসা পাওয়া যায়, যেগুলোতে ‘Geco DD 7.65.’ খোদাই করা ছিল। কবরের মধ্যে মৃতদেহ থেকেও স্বতন্ত্র প্রমাণাদি পাওয়া যায়।”
1m Grab 2 war nämllich beim Bergen der Leichen noch eine Originalpatrone auffindbar gewesen, bei der es sich um Pistolenmunition mit der Hülsenbodenprägung “Geco 7,65 0” handelte. (73)
ইংরেজি অনুবাদ: “During the retrieval of the corpses there was found in the grave 2 an original cartridge, pistol ammunition with the ‘Geco 7.65 D” headstamp.”
বাংলা অনুবাদ: “দুই নং কবর থেকে মৃতদেহগুলো উদ্ধারের সময়ে একটা অরিজিনাল কার্টিজ, পিস্তলের গুলি পাওয়া যায়, যেটাতে খোদাই করা ছিল ‘Geco 7.65 D ।”
Die in Katyn nachgewiesenermaßen benutzte Pistolenmunition Geco Kaliber 7,65 mm飞gleicht der Munition, wie sie seit vielen Jahren in der Munitionsfabrik Gustav Genschow & Co. in Durlach bei Karlsruhe (Baden) hergestellt wird. (75)
ইংরেজি অনুবাদ: “The Geco Caliber 7.65 mm pistol ammunition used at Katyn, is the same as the ammunition which has been manufactured for many years in the ammunition factory of Gustav Genschow & Co. in Durlach, near Karlsruhe [Baden].”
বাংলা অনুবাদ: “কার্লশ্রু (বাডেন)-র কাছে ডারলাশে অবস্থিত গুস্তাভ জেন্সচৌ অ্যান্ড কোং-এর অস্ত্র কারখানাতে বহু বছর ধরে; ক্যাতিন এ ব্যবহৃত গুলির ঠিক একই রকম ৭.৬৫ মিমি ক্যালিবার গেকো পিস্তলের গুলি উৎপাদিত হয়েছিল।”
গুস্তাভ জেন্সচৌ ছিলেন জার্মানির স্ট্রালসান্ডের একজন প্রথিতযশা আইনবিদ। ১৮৮৭ সাল থেকে এই আইনবিদ প্রতিষ্ঠিত এই জার্মান গুস্তাভ জেন্সচৌ অ্যান্ড কোং অস্ত্র ও গুলির ব্যবসা শুরু করে। এ কোম্পানি তাদের অস্ত্র ব্যবসাতে দ্রুত সাফল্য পায় এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করে। এ কোম্পানি এক পর্যায়ে এও দাবি করে যে দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ দেশের পুলিশ তাদেরই তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায় যে নাজিদের অস্ত্র সরবরাহে এই কোম্পানির বড় ভূমিকা ছিল। জার্মানির পরাজয়ের পর কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় যা ১৯৫১ সালে আবার চালু হয়।
জার্মানরা তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে শুধুমাত্র জার্মান ‘গেকো’ গুলির খোসা ক্যাতিনের গণকবরে ও আশেপাশে পাওয়া গিয়েছিল। গ্রোভার ফার যুক্তি দেখান যে যদি সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি কোনো বুলেট পাওয়া যেত তাহলে জার্মানরা তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদনে অবশ্যই সেটা উল্লেখ করত। যেহেতু সেটা উল্লেখ না করে, জার্মান গুলির খোসার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সেহেতু অন্তত এটুকু সত্য বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে ক্যাতিনে শুধু জার্মানিতে তৈরি গুলির খোসাই পাওয়া গিয়েছে।
জার্মানরা দাবি করে যে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে নিজেদের উৎপাদিত গুলি রফতানি করেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তা অস্বীকারও করেনি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, জার্মান বা সোভিয়েত তদন্ত প্রতিবেদনের কোথাও এই গুলির খোসা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ কোনো আলোচনাই করা হয়নি।
কিন্তু একমাত্র জার্মান গুলির আলামতই কী প্রমাণ করে যে জার্মানরাই গণহত্যার জন্য দায়ী? যেহেতু জার্মানরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে ক্যাতিনের বধ্যভূমিতে জার্মানদের তৈরি গুলির খোসাই শুধু পাওয়া গিয়েছে– সেহেতু প্রাথমিকভাবে হলেও জার্মানদের দায়ী করা যায়।
কীভাবে?
সেটাই তুলে ধরেছেন গ্রোভার ফার।
গুলির একেবারে নিম্নভাগের মধ্যের গোলাকৃতি অংশটি, অর্থাৎ প্রাইমার, যা কার্টিজের অভ্যন্তরস্থ বারুদ জ্বালাতে ভূমিকা রাখে, তার চারপাশেই গুলির ক্যালিবার ও কোম্পানির চিহ্ন খোদিত থাকে। অর্থাৎ গুলির পেছন দিকেই থাকে গুলির পরিচয়। জার্মানদের তদন্ত প্রতিবেদনে গুলির যে ছবি সংযোজিত ছিল তা কিন্তু গুলির পেছনের বা নিম্ন অংশের নয়, বরং ছবি তোলা হয়েছিল পাশ থেকে। ফলে গুলির পরিচয় অর্থাৎ গুলির ক্যালিবার কি, কখন, কোন কোম্পানি উৎপাদন করেছিল তা তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা সম্ভব হবে না। যদিও গুলির উৎপাদন সময়টি, সত্য উদ্ঘাটনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জার্মান তদন্ত প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে ক্যাতিনের গণকবর ও তার আশপাশ থেকে ‘গেকো ৭.৬৫ ডি’ অথবা ‘গেকো ৭.৬৫ ডিডি’ খোদাই করা গুলির খোসা পাওয়া গিয়েছিল এবং এও তারা দাবি করেছিল যে এই বুলেট বা গুলি ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে রফতানি করা হয়েছিল। এখন কারা গুলি করেছে, সেটিকে যদি এ মুহূর্তে বিবেচনায় না-ও রাখি, তখন এটা ভাবা কি কষ্টসাধ্য নয় যে ছয় সপ্তাহ ধরে সোভিয়েত বাহিনী হাজার হাজার পোলিশকে হত্যা করেছে হুবহু একই রকম ছাপ বা খোদাই করা এবং কমপক্ষে নয় বছরের পুরোনো গুলি ব্যবহার করে!
জার্মান তদন্তকারী দলের কাছে পাঠানো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘গেকো ৭.৬৫ ডিডি’ উৎপাদিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। অর্থাৎ জার্মানদের দাবি করা রফতানির সময়ের পরে এর উৎপাদন! তাহলে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর কাছে তো এই গুলি ছিল না বলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
তারপর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুস্তাভ জেন্সচৌ অ্যান্ড কোং-এর গুস্তাভ জেন্সচৌ পরবর্তীতে মার্কিন ম্যাডেন কমিশনের কাছে জানান যে ‘গেকো ৭.৬৫ ডি’ ছাপ দিয়ে এই কোম্পানি কখনই কোনো গুলি উৎপাদন করেনি। তাঁদের ছাপ ছিল হয় ‘গেকো ৭.৬৫ ডিডি’ অথবা ‘গেকো ডি ৭.৬৫ ডি’ । গ্রোভার ফার তাই প্রশ্ন তোলেন, কী করে জার্মান তদন্তকারীরা এ রকম একটা বড় ভুল করে, যখন তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ীই হাজার হাজার গুলির খোসা পাওয়া গিয়েছিল?
তাহলে কেন এই মিথ্যা বা কেন গুলির খোসার পাশের চিত্র সংযোজন? কেন গুলির পরিচয়বাহী গুলির খোসার নিম্নভাগের ছবি তদন্ত প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হয়নি? এসব প্রশ্নের উত্তর বা এ রহস্যের একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে কমিউনিস্ট-বিরোধীদের মাঝে এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে সোভিয়েত ইউনিয়নই ক্যাতিন গণহত্যার জন্য দায়ী।
হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস ঠিকই ক্যাতিন গণহত্যা নিয়ে জার্মান তদন্ত প্রতিবেদনের দুর্বলতা ধরতে পেরেছিলেন। গ্রোভার ফার গোয়েবলসের ডায়রি থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরেন :
Unfortunately German munitions were found in the graves of Katyn. The question Of how they got there needs clarification. It is either a case of munitions sold by us during the period of our friendly arrangement with Soviet Russians, or of the Soviets themselves throwing these munitions into the graves. In any case it is essential that this incident be kept top secret. If it were to come to the knowledge of the enemy the whole Katyn affair would have to be dropped. [৫]
“দুর্ভাগ্যবশত ক্যাতিনের কবরগুলোর মধ্যে জার্মানির তৈরি যুদ্ধোপকরণ পাওয়া গিয়েছে। এসব কী করে সেখানে পাওয়া গেল, এ প্রশ্নের একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। এটা হয় সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতার সময় আমরা যে যুদ্ধোপকরণ বিক্রি করেছি সেসব অথবা সোভিয়েতরা নিজেরাই এগুলো কবরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছিল। কারণ যাই হোক না কেন, এ ঘটনাটি অতি গোপনীয় হিসাবেই দেখতে হবে। যদি শত্রুপক্ষ এ ঘটনা জানতে পারে তবে ক্যাতিনকে ঘিরে সমস্ত প্রচেষ্টার ইতি ঘটাতে হবে”। (গোয়েবলসের ডায়রি, ১৯৪২-১৯৪৩, প্রেইগার, ১৯৭০, পৃষ্ঠা ৩৫৪)
গ্রোভার ফার মন্তব্য করেন যে গোয়েবলস সঠিক ছিলেন। হত্যার জন্য জার্মান গুলি ব্যবহার এবং ক্যাতিনের কবরগুলোতে একমাত্র এবং একমাত্র জার্মান গুলি ও গুলির খোসা হচ্ছে প্রাথমিক ধারণা মোতাবেক এবং অন্য কোনোভাবে ভুল প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত ‘প্রাইমা ফেসি এভিডেন্স’। এর ভিত্তিতেই বলা যায়, জার্মানরাই ক্যাতিন গণহত্যার জন্য দায়ী।
টীকা
১. https://www.cia.gov/library/center-for-the-study-of-intelligence/csi-publications/csi-studies/studies/winter99-00/art6.html#rft1
২. https://www.reuters.com/article/us-poland-russia-katyn-factbox-idUSHO75959820070917
৩. পোলিশ গণহত্যার জন্য সোভিয়েত দায়ী এবং স্ট্যালিনের সম্মতিতেই তা করা হয়েছিল– এমন ইতিহাসকে গ্রোভার ফার ‘অফিসিয়াল হিস্ট্রি অব ক্যাতিন’নামে অভিহিত করেছেন, তাঁর ক্যাতিন গণহত্যা নিয়ে লেখা বইতে।
৪. http://www.patriotica.ru/history/muhin_antiros_.html
৫. The Goebblels Diaries, 1942-1943. Praeger, 1970, p 354
তথ্যসূত্র :
১. Grover Furr, The “Official” Version of the Katyn Massacre Disproven? : Discoveries at a German Mass Murder Site in Ukraine ( দেখুন : https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/08854300.2013.795268)
২. Katyn massacre : wikipedia
৩. Kenneth F. Ledford, Mass Murderers Discover Mass Murder: The Germans and Katyn, 1943 ( দেখুন : https://scholarlycommons.law.case.edu/cgi/viewcontent.cgi?article=1125&context=jil&fbclid=IwAR0JzODvnBaEsBejvRsDDv1zF-Ecvxyx2mXGJI1BAT8bFJJrQEiDXA7ehjY
৪. https://www.cia.gov/library/center-for-the-study-of-intelligence/csi-publications/csi-studies/studies/winter99-00/art6.html#rft1
আমি কখন ই লেনিনের রাশিয়া দায়ী
ভাবতে পারবো না। হিটলার এর জার্মানির ই এই নৃশংসতার কাজ করতে পারে। সাধারণ ভাবে ভিভিন্ন দৃষ্টিকোণ
থেকে চিন্তা ভাবনা করলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পক্ষে এ ধরণের জঘন্য ও
ঘৃণ্য কাজ সম্ভব ই নয়।