সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

কৃষ্ণদেবরায়

কৃষ্ণদেবরায়

শান্তনু ভৌমিক

অক্টোবর ১৬, ২০২১ ১৭১৩ 1
শুরুর কথা

আজকাল একটা অদ্ভুত অভ্যাস হয়েছে। একটা বিষয়ের ওপর কোন বই বা লেখা পড়তে পড়তে আচমকা সুইচ করে অন্য বিষয়ের কোন বই বা লেখা পড়তে শুরু করে দিচ্ছি। মনসংযোগের অভাব মনে হয়। এই দিন কয়েক আগে যখন ‘বাবরনামা’, অর্থাৎ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের দিনলিপি পড়ছিলাম, ঠিক সেই রকমই হল। আচমকা বাবরনামা বন্ধ করে দিলাম। বাবরকে ছেড়ে কাকে নিয়ে পড়লাম? আগে ভাগেই বলে দেই যে, সঠিক অনুমানের জন্য কোন পুরস্কার নেই। কারণ তাঁর নাম শিরোনামেই দেওয়া আছে – কৃষ্ণদেবরায়।

কে ছিলেন এই কৃষ্ণদেবরায়? বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। বিজয়নগর সাম্রাজ্য? কবে এবং কোথায়? বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল দিল্লি সালতানাত এবং বাহমনি সালতানাত’এর সমসাময়িক দক্ষিণ ভারত কেন্দ্রিক এক সাম্রাজ্য। কেরালার কিছুটা অংশ ছাড়া তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণের পুরো ভূখণ্ডই একসময় ছিল এই সাম্রাজ্যের অধীনে। এই বিজয়নগরের রাজধানী ছিল হাম্পি যা ছিল সমসাময়িক বিশ্বের সুন্দরতম নগরগুলোর একটি। তা কতটা প্রভাবশালী ছিল এই বিজয়নগর সাম্রাজ্য? সমসাময়িক দিল্লি সালতানাত’এর তুলনায়। এর উত্তর এক কোথায় দেওয়া কঠিন। আসলে দিল্লি সালতানাত ছিল অনেকটা জার্মানির প্রেসিং ফুটবলের মত। দৃষ্টিনন্দন নয় কিন্তু খুব কার্যকরী। আর বিজয়নগর? স্পেন’এর ‘তিকিতাকা’ বা ব্রাজিল’এর ‘যোগা বোনিতো’। এইবার আপনিই ভেবে সিদ্ধান্ত নিন কোন ধরণের ফুটবল আপনার মনে বেশি প্রভাব ফেলে।

হুম……. বিজয়নগর কেমন ছিল সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু, কৃষ্ণদেবরায় কে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা বলা হয় কেন? কারণ তাঁর সময়েই বিজয়নগর সাম্রাজ্য পৌঁছেছিল ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে। তাঁর সময়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক শক্তি, অর্থৈনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যবসাবাণিজ্যের বিকাশ, শিল্প-সাহিত্যের উৎকর্ষতা যে মাত্রায় পৌঁছেছিল; তার তুলনা দক্ষিণ ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া ‘সির্ফ মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়’। তাই অনেকের মতে কৃষ্ণদেবরায় শুধু যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন তাই নয়, ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজাদের মধ্যে একজন ছিলেন বটে।   

তবে কৃষ্ণদেবরায়ের কৃতিত্বের সঠিক আন্দাজ পেতে গেলে, আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও কিছু বছর। জানতে হবে কোন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণদেবরায় ধরেছিলেন বিজয়নগরের হাল। সেখান থেকে মাত্র কুড়ি বছরের শাসনকালে বিজয়নগর কে করে তুলেছিলেন দক্ষিণ ভারতের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজশক্তি।

সাম্রাজ্যের সূচনার দিনগুলি

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সঙ্গম বংশের প্রথম হরিহর, ১৩৪৬ সাধারণ অব্দে। তার পরের এক’শ বছরের ইতিহাস হল বিজয়নগরের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ইতিহাস। কিন্তু, ১৪৪৬ সাধারণ অব্দে দ্বিতীয় দেবরায়ের মৃত্যুর পর বিজয়নগরের বৃদ্ধি গেল থমকে, শুরু হল অবক্ষয়। এর মূল কারণ ছিল সিংহাসনের অধিকার নিয়ে রাজবংশের মধ্যে খেয়োখেয়ি এবং একের পর এক অযোগ্য ব্যক্তির সিংহাসনলাভ। বিজয়নগরের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, সাম্রাজ্যের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বাহমনি সুলতানি ছিনিয়ে নেয় গোয়া, দাভোল এবং চওল। এই একই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ওড়িশার গজপতি রাজারা দখল করে নেন অন্ধ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল যার মধ্যে ছিল রাজামুন্দ্রি, কোন্ডাভিডু, শ্রীসাইলাম সহ বর্তমানের কুর্নুল জেলার অনেকটা অংশ এবং নেল্লোরের নিকটবর্তী উদয়গিরি। গজপতিরা এমনকি পৌঁছে গিয়েছিলেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তেও – কাঞ্চিপুরম আর তিরুচিরাপল্লীতে। তবে গজপতিরা কাঞ্চিপুরম আর তিরুচিরাপল্লী স্থায়ীভাবে নিজেদের অধিকারে রাখেননি, ধনসম্পত্তি লুঠ করে ফিরে গিয়েছিলেন নিজেদের এলাকায়। এই সময় বিজয়নগরের রাজারা এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে তাদের সার্বভৌমত্ব টিকে ছিল কয়েকজন শক্তিশালী প্রাদেশিক শাসকের জোরে। তবে বিজয়নগরের রাজধানীর অর্থাৎ আজকের হাম্পির কখনও পতন হয়নি মূলত দ্বিতীয় দেবরায় এবং তাঁর পূর্বসূরি সঙ্গম বংশের শাসকদের গড়ে তোলা দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণে।

বিজয়নগরের এইরকম এক শক্তিশালী প্রাদেশিক শাসক ছিলেন চন্দ্রগিরির সালুভ নরসিমহা। ১৪৭০ সাধারণ অব্দে তিনি গজপতিদের পাল্টা আক্রমণ করে উদয়গিরি পুনরুদ্ধার করেন। তারপর গজপতিদের রাজা কপিলেশ্বরের মৃত্যুর পর গজপতি রাজ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এগিয়ে যান গোদাবরী নদী পর্যন্ত। ১৪৭৭ সাধারণ অব্দে কোন্ডাভিডু এবং মসুলিপট্টমও চলে আসে তাঁর অধীনে। ততদিনে সঙ্গম বংশের অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল এবং কেন্দ্রীয় শাসন বলতে প্রায় কিছুই ছিলনা। সেই অবস্থা থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে, সালুভ নরসিমহা ১৪৮৫ সাধারণ অব্দে বিজয়নগরের সিংহাসন অধিকার করে নেন এবং শুরু হয় বিজয়নগরের দ্বিতীয় রাজবংশ – সালুভ রাজবংশের শাসন। এই কাজে সালুভ নরসিমহার ডান হাত ছিলেন তাঁর সেনাপতি নারস নায়ক।

ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে চন্দ্রগিরির প্রাদেশিক শাসক হিসাবে সালুভ নরসিমহা যে সমস্ত অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করেছিলেন গজপতিদের কাছ থেকে, বিজয়নগরের সিংহাসনে বসার পর সেই অঞ্চলগুলিই আবার খুইয়ে বসেন সেই গজপতিদের কাছেই। ১৪৮৯ সাধারণ অব্দে গজপতিরা উদয়গিরি দুর্গ অবরোধ করে। কিছুদিন অবরোধ চলার পর শুরু হয় যুদ্ধ, বিজয়নগর এবং গজপতিদের মধ্যে। যুদ্ধে পরাজিত হন সালুভ নরসিমহা। বন্দি হয়ে যান গজপতিদের হাতে। বন্দিদশা থেকে থেকে মুক্তি পেতে গজপতিদের দিয়ে দিতে হয় উদয়গিরি দুর্গ এবং তার সন্নিহিত অঞ্চল।

সালুভ নরসিমহার মৃত্যু হয় ১৪৯১ সাধারণ অব্দে। তারপর প্রথমে সিংহাসনে বসেন জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তিম্মাভুপা এবং তারপরে সিংহাসনে বসেন কনিষ্ঠ রাজপুত্র ইম্মাদি নরসিমহা। কিন্তু প্রকৃত শাসন ক্ষমতা চলে যায় নারস নায়কের হাতে।  এই সময়ে, ১৫০১ সাধারণ অব্দ থেকে, বাহমনি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনির মাথায় চাপে এক নতুন খেয়াল – বছরে এক বার করে বিজয়নগর শাসনাধীন অঞ্চলে হামলা করার। জিহাদের নামে করা এই হামলায়, বাহমানি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনির নেতৃত্বে বাহমনি সুলতানির অভিজাতরা করতেন যথেচ্ছ লুঠতরাজ। বিজয়নগরের অবস্থা আরো সঙ্গিন হয় ১৫০২ সাধারণ অব্দে, যখন বাহমনি সুলতানির অধীনস্থ বিজাপুরে শাসক ইউসুফ আদিল শাহ বিজয়নগরের কাছ থেকে কেড়ে নেন রাইচুর দোয়াব এবং রাইচুর ও মুদগল্ দুর্গ।

১৫০৩ সাধারণ অব্দে নারস নায়কের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র ইম্মাদি নারস নায়ক (“বীর নরসিমহা”) হয়ে ওঠেন কার্যকরী শাসক। ১৫০৫ সাধারণ অব্দে সালুভ বংশের শেষ রাজা ইম্মাদি নরসিমহার গুপ্তঘাতকের হাতে মৃত্যু হলে, বীর নরসিমহা সিংহাসন দখল করে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলুভ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় একই সময়ে মাইসোরের নিকটবর্তী উম্মাত্তুরের গঙ্গারায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে। সঙ্গম রাজবংশ দুর্বল হওয়ার পর থেকেই বিজয়নগর সাম্রাজ্য জুড়ে ছোট খাটো বিদ্রোহ লেগেই থাকতো, কিন্তু গঙ্গারায়ের বিদ্রোহ ছিল বেশ বড়মাপের যা অনেক চেষ্টা করেও বীর নরসিমহা দমন করে উঠতে পারেননি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের এইরকম টালমাটাল অবস্থায় ১৫০৯ সাধারণ অব্দে বীর নরসিমহার মৃত্যু হয়। সিংহাসনে বসেন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই কৃষ্ণদেবরায়। তখন তাঁর বয়স ছিল বছর কুড়ি-পঁচিশ।

সিংহাসন লাভ বা হট সিটে আরোহণ ও প্রথম টঙ্কার

কৃষ্ণদেবরায় সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তাঁর রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান হয়নি। রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৫ দিন পরে, জন্মাষ্টমীর দিনে। কেন? খুব সম্ভবত প্রজাদের এই ধারণা দিতে যে রাজা কৃষ্ণদেবরায় ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণর প্রতিনিধি। তাঁর সর্বপ্রথম যে শাসনটি পাওয়া গিয়েছে তার তারিখ হল ২৬শে জুলাই, ১৫০৯। রাজা হওয়ার পরে পরেই তিনি তাঁর ভাইপো, অর্থাৎ বীর নরসিমহার ছেলেকে এবং তাঁর নিজের তিন ভাইদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বিজয়নগর থেকে ২৫০ মাইল দূরের চন্দ্রগিরিতে। তিনি এই কাজ সম্ভবত করেছিলেন যাতে তাঁর রাজত্বে কোন রকম অন্তর্ঘাত না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে।

সিংহাসনে বসার পরই তাঁর প্রথম কাজ ছিল বাহমনি সুলতানির বাৎসরিক লুঠতরাজের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচানো। আগের বছরগুলোর মতো সেই বছরেও, বাহমনি সুলতানির অভিজাতরা চলে এসেছিলেন বিজয়নগর শাসনাধীন অঞ্চলে বাৎসরিক লুঠতরাজ করতে। কিন্তু সেই বছর পাশার দান গেল উল্টে। নিজেদের খেয়াল খুশি মত লুঠতরাজ করার বদলে, দিওয়ানি বলে এক স্থানে (জায়গাটা ঠিক কোথায় সেইটা এখনো ঠিক করা যায়নি) বিজয়নগর সেনাবাহিনীর হাতে বাহমনি সুলতানির বাহিনীর হল পরাজয়। বাহমনি সুলতানির অভিজাতরা পালাতে শুরু করলেন নিজরাজ্যের দিকে। আর বিজয়নগর সেনাবাহিনী ধাওয়া করলো তাদের বিজাপুরের শাসক ইউসুফ আদিল শাহের বাহিনীকে। ইউসুফ আদিল শাহ কভিলকোন্ডার কাছে বিজয়নগরের বাহিনীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে ঘ্যাচাং ফু হয়ে যায় ইউসুফ আদিল শাহর। এই সুযোগে কৃষ্ণদেবরায় দখল করে নেন কভিলকোন্ডা দুর্গ। বিজয়নগরের ভাগ্যসূর্য আবার ওপরে উঠতে শুরু করে।  

সেনাবাহিনীর অদলবদল ও পর্তুগিজ সম্পর্ক

বাহমনি সুলতানির এই বাৎসরিক লুঠতরাজ সামাল দেওয়ার পর কৃষ্ণদেবরায় নজর দেন বিজয়নগরের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার দিকে। এঁর জন্য তিনি দু’টি পদক্ষেপ নেন। প্রথম পদক্ষেপ – কৃষ্ণদেবরায়ের সিংহাসনলাভের আগে বিজয়নগর সেনাবাহিনী গঠিত হত মূলত প্রাদেশিক শাসকদের সেনাদলকে একত্রিত করে। এর ফলে কি হত, লড়াইয়ের ময়দানে এই মিলিজুলি বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বা সমন্বয় থাকত না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, কৃষ্ণদেবরায়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে এক বড়সড় স্থায়ী সেনাদল গঠন করলেন। এই কেন্দ্রীয় সেনাদলের সেনারা একসঙ্গে থাকতো, একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিত যার ফলে এঁদের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল অনেক জোরালো। প্রাদেশিক শাসকদের সেনাদল তার পরেও ছিল এবং তাঁরাও বিজয়নগরের সৈন্যবাহিনীর অংশ হিসাবে লড়াই করতো পরবর্তীকালের যুদ্ধগুলোয়, কিন্তু সেই সেই লড়াইগুলোয় বিজয়নগরের তরফে মুখ্য ভূমিকা নিত স্থায়ী কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় পদক্ষেপ – বিজয়নগরের সেনাবাহিনীর রণপটুতা বাড়ানোর জন্য কৃষ্ণদেবরায় শুরু করলেন পর্তুগিজদের সাহায্য নিতে। আর পর্তুগিজরাও মন খুলে সাহায্য করলো কৃষ্ণদেবরায়কে কারণ তাঁদেরও দরকার ছিল বিজয়নগরকে।

১৪৯৮ সাধারণ অব্দের ১৪ মে ভাস্কো দা গামা পৌঁছে গিয়েছিলেন কালিকটে। ১৫০০ সাধারণ অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পর্তুগাল থেকে এলেন পেড্রো আলভারেজ কাব্রাল, প্রথমে কালিকটে তারপরে কোচিনে। শুরু হয়ে গিয়েছিল ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক জলপথের দখল নিয়ে ইউরোপীয়দের সাথে আরবদের লড়াই। আরবদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিল তুরস্কের অটোমানরা। ১৫০৭ সাধারণ অব্দে লোহিত সমুদ্র হয়ে ভারতীয় উপকূলে পৌঁছল অটোমান নৌবাহিনী, আমির হুসেইনের নেতৃত্বে। কালিকটের আরব ব্যবসায়ীরাও পাঠালো রসদ। চওলের কাছে হল এক ছোটোখাটো এক জলযুদ্ধ। অপ্রস্তুত পর্তুগিজরা হেরে গেল অটোমান নৌবাহিনীর কাছে। কিন্তু পর্তুগিজরা সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসেছে ভারতে বাণিজ্য করতে। নিয়ে এলো নিজেদের বড় বড় রণতরী। ১৫০৯ সাধারণ অব্দে দু’পক্ষ মুখোমুখি হল গুজরাটের দিউ দ্বীপের কাছে। পর্তুগিজদের উন্নত মানের রণতরী এবং কামানের সামনে অটোমান নৌবাহিনী দাঁড়াতেই পারলো না। যুদ্ধ এক ঘন্টায় শেষ। লক্ষণীয় যে এই যুদ্ধে গুজরাট সুলতানরা নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করেছিল। অটোমানদের সাথে হাত মেলাননি অনেক অনুরোধ সত্যেও।

অটোমানদের সাথে জলযুদ্ধ জিতলেও, তার আগে থেকেই পর্তুগিজরা চেষ্টা করছিল ডাঙায় ডেরা গড়ে তুলতে, নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য। তাই আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বাহমনি এবং গজপতিদের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত কৃষ্ণদেবরায়ের পূর্বসূরি বীর নরসিমহা যখন কান্নানোরে পর্তুগিজদের নেতা আলমেইদার কাছে দূত পাঠান নিজের সৈন্যদের পর্তুগিজদের দ্বারা প্রশিক্ষণ এবং আরবি ঘোড়া সরবরাহের জন্য, পর্তুগিজরা সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ করে দেন। কিন্তু তার বিনিময়ে আলমেইদা চেয়ে বসেন কর্ণাটকের উপকূলবর্তী ভাটকালে দুর্গ নির্মাণ করার অনুমতি। পর্তুগিজদের এহেন পাল্টা শর্ত শুনে পিছিয়ে আসেন বীর নরসিমহা। তারপর, কৃষ্ণদেবরায় সিংহাসনে বসার আগে পর্যন্ত বিশেষ একটা এগোয়নি পর্তুগিজ এবং বিজয়নগরের মধ্যে কথাবার্তা। কৃষ্ণদেবরায় সিংহাসনে বসার পরেপরেই, তৎকালীন পর্তুগিজ প্রশাসক আলবুকার্ক নিজে থেকেই আবার সামরিক সহায়তার প্রস্তাব পাঠান বিজয়নগরকে, বাহমনি সুলতানের বাৎসরিক হামলার ঠিক আগে। তাঁর প্রস্তাব ছিল যে বিজয়নগর যদি পর্তুগিজদের কালিকটের জামোরিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করে, পর্তুগিজরা শুধু বিজয়নগরকেই আরবি এবং পারসি ঘোড়া সরবরাহ করবে এমনকি বিজাপুরকেও নয়। আরবি এবং পারসি ঘোড়ার ওপর একচেটিয়া অধিকারে পেতে কৃষ্ণদেবরায় ছিলেন খুব আগ্রহী। তাও তিনি এই প্রস্তাবে কোন সাড়া দেননি। তারপর, যখন বাহমনি সুলতানির বাৎসরিক হামলা ঠেকিয়ে এবং কভিলকোন্ডা দুর্গ অধিকার করে যখন ফিরে এসেছেন তিনি, তখন পর্তুগিজরা আবার তাঁদের দূত গ্যাসপার চাঞ্চযার মাধ্যমে পেশ করে ভাটকালে দুর্গ নির্মাণের প্রস্তাব। আলবুকার্ক ততদিনে, ১৫১০ সাধারণ অব্দের মার্চ মাসে, বিজাপুরের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন গোয়া। কিন্তু এইবারেও কৃষ্ণদেবরায় নিরুত্তর থাকেন। এরপর ওই একই বছরের মে মাসে গোয়া আবার হাতবদল হয়ে ফিরে যায় বিজাপুরের কাছে। কিন্তু হাল না ছেড়ে দিয়ে পয়লা ডিসেম্বর পর্তুগিজরা আবার গোয়া অধিকার করে নেয় বিজাপুরের কাছ থেকে, বেশ নৃশংসতার সাথে। এরপর কৃষ্ণদেবরায় পর্তুগিজদের প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ করে দেন।

প্রস্তুতিশেষ, এবার গন্তব্য যুদ্ধের ময়দান

নিজের সেনাবাহিনী শক্তিশালী করার পর, কৃষ্ণদেবরায়ের প্রথম লক্ষ্য ছিল বাহমনিদের কাছ থেকে রাইচুর দোয়াব এবং রাইচুর দুর্গ পুনরুদ্ধার। সেই সময় বাহমনি সুলতানিতে চলছিল ক্ষমতা দখলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। ফলে বিজয়নগর বাহিনী খুব সহজেই রাইচুর দোয়াব এবং রাইচুর দুর্গ পুনর্দখল করে নেয়। তারপর বিজয়নগর বাহিনী পৌঁছয় গুলবর্গায়। বাহমনি সুলতানের মন্ত্রী এবং কারাপাল আমির আলী বারিদকে হারিয়ে দখল করে নেয় গুলবর্গা। সেখান থেকে বিজয়নগর বাহিনী যায় বাহমনি সুলতানির রাজধানী বিদারে। কয়েকদিন অবরোধের পর বিদারের পতন হয়। বিদারে সেই সময়, সুলতানের সিংহাসন দখলের জন্য, সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনিকে কারাবন্দি করে রেখেছিলেন তাঁর মন্ত্রী আমির আলী বারিদ। কৃষ্ণদেবরায় দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনিকে মুক্ত করে তাঁকে আবার বিদার’এর সিংহাসনে বসান। এই উপলক্ষে তিনি উপাধি নেন – ‘যবন রাজ্য  স্থাপন আচার্য্য’।

কৃষ্ণদেবরায়ের প্রথম বাহমনি অভিযানের (১৫১১ সাধারণ অব্দ) সম্ভাব্য যাত্রাপথ

বাহমনি সুলতানির হাত থেকে বিজয়নগরের হৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি কৃষ্ণদেবরায় রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করতেও সক্রিয় হন। উম্মাত্তুরের গঙ্গারায়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় ১৫১০ সাধারণ অব্দের আগস্ট মাসে। এই অভিযান চলেছিল সম্ভবত ১৫১২ সাধারণ অব্দের শেষ পর্যন্ত। প্রথমে পেনুগোন্ডা দুর্গ আক্রমণ করা হয়, যা ছিল বিদ্রোহীদের কবলে। পেনুগোন্ডা দুর্গ পুনর্দখল করার পর কৃষ্ণদেবরায় আক্রমণ করেন উম্মাত্তুর এবং গঙ্গারায়ের সদর শিবানাসমুদ্রম্‌। যুদ্ধ চলে প্রায় বছরখানেক। তারপর হার মানেন গঙ্গারায়। কাবেরী নদীতে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর। উম্মাত্তুর আবার চলে আসে বিজয়নগরের অধীনে। সদর দপ্তর হয় শ্রীরঙ্গপত্তনম। সালুভ গোবিন্দরায় নিযুক্ত হন উম্মাত্তুরের প্রশাসক হিসাবে। স্থানীয় প্রশাসন ন্যস্ত হয় তিন স্থানীয় দলপতির ওপর। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জনৈক কেম্পেগৌড়া। এই কেম্পেগৌড়াই পত্তন করেন আজকের বেঙ্গালুরু শহরের। তাঁর নামেই নামকরণ হয়েছে বেঙ্গালুরু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের – কেম্পেগৌড়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।

এরপর কৃষ্ণদেবরায় নজর ঘোরান ওড়িশার গজপতিদের দিকে। প্রথম লক্ষ্য ছিল উদয়গিরি দুর্গ পুনরুদ্ধার। ১৫১৩ সাধারণ অব্দে শুরু হয় উদয়গিরি দুর্গ অবরোধ। প্রায় দেড় বছর অবরোধের পর পতন হয় উদয়গিরির। এরপর আরও কয়েকটি ছোট-খাটো দুর্গ দখল করে, বিজয়নগর বাহিনী অবরোধ করে কোন্দাভিডু দুর্গ। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে নিজেদের শাসন চালানোর জন্য কোন্দাভিডু দুর্গ গজপতিদের জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দুর্গে থাকতেন গজপতি রাজপরিবারের অনেক ব্যক্তি এবং অনেক অভিজাত। বিজয়নগরের সৈন্যবাহিনীর অবরোধের ফলে দুর্গে শুরু হয় খাদ্যাভাব। খাদ্যাভাবে হয় দুর্গের বেশ কয়েকজনের মৃত্যু। অবশেষে হয় কোন্দাভিডুর পতন। বিজয়নগর সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে যান তদানীন্তন গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রর এক স্ত্রী এবং পুত্র এবং বেশ কয়েকজন ওড়িয়া অভিজাত।

এর পর বিজয়নগর বাহিনী আক্রমণ করে বিজয়ওয়াড়ার নিকটবর্তী কোন্ডাপল্লী দুর্গ। এই দুর্গ বাঁচানোর জন্য প্রতাপরুদ্র পাঠান এক সৈন্যবাহিনী। কিন্তু কৃষ্ণা নদীর তীরে এক যুদ্ধে বিজয়নগর সৈন্যবাহিনীর হাতে ওড়িয়া সৈন্যবাহিনী শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হয়। এরপর বিজয়নগর সৈন্যবাহিনী অবরোধ করে কোন্ডাপল্লী দুর্গ এবং মাস দুয়েক অবরোধের পর কোন্ডাপল্লী দুর্গের পতন ঘটে। এই সময় আশেপাশের আরও কিছু দুর্গ বিজয়নগর সৈন্যবাহিনী গজপতিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। নালগোন্ডা এবং ওয়ারাঙ্গাল জেলার অনেকটা অংশ, যা গজপতিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, চলে আসে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে। ১৫১৫ সাধারণ অব্দের শেষাশেষি নাগাদ কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণের সমস্ত অঞ্চলই চলে আসে বিজয়নগরের অধীনে। চিরাচরিত ভাবে কৃষ্ণা নদী ছিল বিজয়নগর আর গজপতিদের মধ্যেকার সীমানা। তাই তেলেঙ্গানা বিজয়ের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছিল বিজয়নগরের সমস্ত হৃত অঞ্চলের পুনরুদ্ধার।

কিন্তু আসল আদায় করেই সন্তুষ্ট থাকলেন না কৃষ্ণদেব রায়। এরপর চললেন সুদ আদায় করতে। অগ্রসর হলেন গজপতিদের আদি এলাকা কলিঙ্গর দিকে। প্রথমে পতন হল রাজামুন্দ্রির। সেখান থেকে বিজয়নগর সেনাবাহিনী এগোতে শুরু করলো পতনুর-সিমহাদ্রির দিকে। রাস্তায় গজপতিদের স্থানীয় সেনারা বিক্ষিপ্তভাবে চেষ্টা করলো বিজয়নগর সেনাবাহিনীকে আটকানোর। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আশেপাশের গজপতিদের এলাকা একরকম গুঁড়িয়ে দিয়ে এগোতে থাকে বিজয়নগর বাহিনী। যথাসময়ে সম্পন্ন হয় পতনুর-সিমহাদ্রি বিজয়। সেখানে কৃষ্ণদেবরায় স্থাপন করেন নিজের বিজয়স্তম্ভ। সাল তখন ১৫১৬ সাধারণ অব্দ।

পতনুর’এ কৃষ্ণদেবরায়ের বিজয়স্তম্ভ

এর পর বিজয়নগর সেনাবাহিনী গিয়ে পৌঁছয় গজপতিদের রাজধানী কটকে। তবে শেষ পর্যন্ত বিজয়নগর সৈন্যবাহিনী কটক শহর আক্রমণ করেছিল কি না অথবা কৃষ্ণদেবরায় সশরীরে বিজয়নগর সেনাবাহিনীর কটক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে ধোয়াঁশা আছে। অবশ্য পর্তুগিজ ঘোড়া ব্যবসায়ী ফের্নাও নুনিজ, যিনি কৃষ্ণদেবরায়ের শাসনকাল শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই ১৫৩৫ সাধারণ অব্দে বিজয়নগর এসেছিলেন, তিনি তাঁর লেখায় কৃষ্ণদেবরায়ের সেনাবাহিনীর হাতে কাটুয়ির শহর অবরোধের কথা উল্লেখ করেছেন। অনেকের মতে নুনিজ’এর কাটুয়ির আর গজপতিদের রাজধানী কটক ছিল একই শহর। নুনিজ’এর বর্ণনা, কৃষ্ণদেবরায়ের নিজের লেখা এবং জনপ্রিয় তেলেগু লোকগীতি অনুযায়ী, বিজয়নগর সেনাবাহিনীর হাতে কটকের বস্তুতই ‘ধাঁই কিড়ি কিড়ি’ হয়েছিল। বিজয়নগরের সেনারা কটক শহর থেকে হস্তগত করেছিল ১৬ লক্ষ সোনার মুদ্রা, প্রাচীর গয়না, প্রচুর ঘোড়া এবং বেশ কিছু হাতি। শহর ছেড়ে প্রতাপরুদ্র পালিয়েছিলেন পাশের পাহাড়ে।

সন্ধি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা প্রতাপরুদ্রর। পাঠালেন সন্ধি প্রস্তাব কৃষ্ণদেবরায়কে। জানালেন নিজের মেয়ের সাথে কৃষ্ণদেবরায়ের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছের কথা। কৃষ্ণদেবরায় স্বীকার করে নেন এই সন্ধি প্রস্তাব। সন্ধি স্বাক্ষরিত হল ১৫১৯ সাধারণ অব্দের আগস্ট মাসে। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী কৃষ্ণা নদী নির্ধারিত হল দুই রাজ্যের সীমানা হিসাবে। কৃষ্ণা নদীর উত্তরের সমস্ত এলাকা, কোন্ডাপল্লি এবং কটক শহর ফিরে পেলেন প্রতাপরুদ্র। প্রচুর উপঢৌকন সমেত নিজের মেয়ের বিয়ে দিলেন কৃষ্ণদেবরায়ের সাথে।

কেন কৃষ্ণা নদীর উত্তরের এলাকা প্রতাপরুদ্রকে প্রত্যর্পণ করেছিলেন কৃষ্ণদেবরায়? কি দরকার ছিল এই মহানুভবতা দেখানোর? কৃষ্ণদেবরায় এই মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন কারণ ‘রাজ্যবিস্তার’ কখনই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিজয়নগরের যে সমস্ত এলাকা গজপতিদের দখলে ছিল, তা উদ্ধার করা। যেহেতু কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণভাগ চিরাচরিতভাবে বিজয়নগরের অধীনে থাকতো, তাই কৃষ্ণদেবরায় কৃষ্ণা নদীর উত্তরের এলাকা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গজপতিদের।

যদি রাজ্যবিস্তার কৃষ্ণদেবরায়ের উদেশ্য ছিলনা, তাহলে বিজয়নগর সেনাবাহিনী কেন ধেয়ে গিয়েছিল কটক পর্যন্ত? কেন করেছিল কটক আক্রমণ? কারণটা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ছিল। প্রতাপরুদ্র ক্ষত্রিয়জাত। তাঁর ধমনীতে বইতো উচ্চ বংশের নীল রক্ত। লিখতেন সংস্কৃততে। পক্ষান্তরে কৃষ্ণদেবরায়ের পিতা নারস নায়ক উঠে এসেছিলেন নিচু জাত থেকে। কৃষ্ণদেবরায়ের মা ছিলেন এক পরিচারিকা। কৃষ্ণদেবরায়ের ভাষা ছিল তেলেগু। তাই প্রতাপরুদ্র কৃষ্ণদেবরায়কে রাজা হওয়ার যোগ্য বলে মনে করতেন না। নিচু চোখে দেখতেন। হেয় করতেন ‘দাসী-পুত্র’ বলে।

তাই কৃষ্ণদেবরায় কটক আক্রমণ করেছিলেন প্রতাপরুদ্রকে শিক্ষা দিতে, প্রতাপরুদ্রর রাজ্য অধিকার করতে নয়। প্রতাপরুদ্রকে পরাজিত করার পর বলেছিলেন – “I want you to realise that I have come solely for sake of increasing my glory, with no desire of annexing your kingdom. The Gajapati kingdom I leave for the Gajapati”। প্রতাপরুদ্রকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, যে বংশমর্যাদা যাই হোক না কেন, তাঁর আর প্রতাপরুদ্রর মধ্যে কোন ফারাক নেই। প্রতাপরুদ্রর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন – “After all, is there any real difference between you and me”?

কৃষ্ণদেবরায়ের কলিঙ্গ  অভিযানের (১৫১৪ সাধারণ অব্দ) আনুমানিক যাত্রাপথ

কৃষ্ণদেবরায় যখন গজপতিদের বিরুদ্ধে আক্রমণে ব্যস্ত ছিলেন তখন ইউসুফ আদিল শাহর পুত্রতদানীন্তন বিজাপুরের শাসক ইসমাইল আদিল শাহ একটা ছোট ভুল করে বসেন। বিজয়নগর সেনাবাহিনীর এই ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে তিনি রাইচুর পুনর্বার দখল করে নেন। এই ভুলের মাশুল তাঁকে দিতে হয় কয়েক বছর পর, ১৫২০ সাধারণ অব্দে। রাইচুর পুনরুদ্ধারের জন্য কৃষ্ণদেব রায় করেন অভিযান। যুদ্ধে বিজাপুর বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়হয়। ইসমাইল আদিল শাহ হাতির পিঠে চড়ে পালিয়ে কোনরকমে প্রাণ বাঁচান। বিজয়নগর বাহিনী হস্তগত করে প্রভূত ধনসম্পদ। ফের্নাও নুনিজ এই যুদ্ধে বিজয়নগরের সাফল্য সম্পর্কে লিখেছিলেন – “The spoil was great and the result decisive”। এই যুদ্ধে পর্তুগিজরা বিজয়নগরকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। প্রতিদানে, পরের মহানবমী উৎসবে, কৃষ্ণদেবরায় পর্তুগিজ সেনাপতি ক্রিস্টোভাও ডে ফিগুইরেডোকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছিলেন।

এই যুদ্ধের পরে, কৃষ্ণদেবরায়ের জীবদ্দশায়, বাহমানি সুলতানি বা তার উত্তরসূরি দক্ষিণ সুলতানের কেউ আর বিজয়নগরকে আক্রমণ করার ভুল করেননি, ‘আঁখ উঠাকে নেহি দেখা বিজয়নগর কি তরফ’। উল্টে ১৫২৩ সাধারণ অব্দে কৃষ্ণদেবরায় আর একবার গুলবর্গা এবং বিজাপুরে গিয়ে ‘দে দনাদন’ করে আসেন। তার কারণ ছিল একটু অদ্ভুত। বিজাপুরের শাসক ইসমাইল আদিল শাহ তাঁর সভাসদ আসাদ খান লারিকে কৃষ্ণদেবরায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে। আসাদ খান লারির কথা মতো ঠিক হয় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তবর্তী এক জায়গায় কৃষ্ণদেবরায়ের সাথে ইসমাইল আদিল শাহ এবং তাঁর মায়ের বৈঠক হবে। নির্দিষ্ট দিনে যথাস্থানে পৌঁছে যান কৃষ্ণদেবরায়। কিন্তু, না ইসমাইল আদিল শাহ, না তাঁর মা উপস্থিত ছিলেন বৈঠকের জন্য। অপমানিত বোধ করেন কৃষ্ণদেবরায়। ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। আক্রমণ করেন গুলবর্গা। মাটির সাথে মিশে যায় গুলবর্গা দুর্গ। এর পর তিনি ফিরুজাবাদ এবং সাগর, এই দুই দুর্গনগরী অধিকার করে নেন। সেখান থেকে তিনি যান বিজাপুরে। বিজয়নগর সৈন্যবাহিনী চালায় ধ্বংসলীলা বিজাপুর শহরে। ইসমাইল আদিল শাহ’র কথার খেলাপের দাম মেটাতে হয় বিজাপুর শহরকে। কিছুদিন বিজাপুর শহর নিজের অধীনে রাখার পর কৃষ্ণদেবরায় ফিরে যান নিজের রাজধানীতে।

কৃষ্ণদেবরায়ের দ্বিতীয় বাহমনি অভিযানের (১৫২৩ সাধারণ অব্দ) আনুমানিক যাত্রাপথ

কৃষ্ণদেবরায়ের এই অভিযানের আগেই, ১৫১৮ সাধারণ অব্দে, পূর্বতন বাহমনি শাসক দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনির মৃত্যু হয়েছিল। ১৫২৩ সাধারণ অব্দে যখন কৃষ্ণদেবরায় গুলবর্গা আক্রমণ করেন সেই সময় দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনির পুত্ররা অভিজাতদের হাতে বন্দি ছিলেন সেখানে। কৃষ্ণদেবরায় দ্বিতীয় মাহমুদ শাহ বাহমনির পুত্রদের কারামুক্ত করে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বাহমনি সুলতানির সিংহাসনে বসান। বাকি পুত্রদের নিজের সাথে নিজের রাজধানীতে নিয়ে আসেন এবং আদর-আপ্যায়নের সাথে রেখে দেন।

বিপক্ষের বাহমনি

প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় যে বাহমনি সুলতানির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৩৪৭ সাধারণ অব্দে। বাহমনি সুলতানির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আলাউদ্দিন বাহমন শাহ। বাহমনি সুলতানির রাজধানী প্রথমে ছিল গুলবর্গায়, বর্তমানে যা কলবুর্গি নামে পরিচিত। পরে তা স্থানান্তরিত হয় বিদারে। বাহমনি সুলতানি ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এদের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১৪৮২ সাধারণ অব্দে সুলতান মুহাম্মদ তৃতীয় লস্করির মৃত্যু হলে বাহমনি সুলতানির কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। নিজ ছত্রছায়ায় বাহমনি সুলতানি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজা কৃষ্ণদেবরায় দু’বার চেষ্টা করলেও, তা কাজে আসেনি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় থাকা বাহমনি সুলতানির উত্তরাধিকারীদের রাজ্যের মুসলিম অভিজাতরা মেনে নেয়নি। ১৫২৭ সাধারণ অব্দে পাকাপাকিভাবে বাহমনি সুলতানির পরিসমাপ্তি ঘটে। সাম্রাজ্য ভেঙ্গে গিয়ে পাঁচটি স্বাধীন রাজত্বর সৃষ্টি হয় – আহমদনগরে নিজাম শাহী,  বিজাপুরে আদিল শাহী, বেরারে ইমাদ শাহী, গোলকুন্ডায় কুতব শাহী এবং বিদারে বারিদ শাহী। এই রাজত্বগুলিকে একত্রে দক্ষিণভারতের সুলতানি বলা হয়। 

যুদ্ধের পরের কথা

১৫২৩ সাধারণ অব্দে করা গুলবর্গা এবং বিজাপুর সামরিক অভিযানই ছিল কৃষ্ণদেব রায়ের শেষ বড় সামরিক অভিযান। এর পর তিনি কোন বড় সামরিক অভিযানে যাননি বা যাওয়ার দরকার পড়েনি। মোটামুটি এই হল কৃষ্ণদেবরায়ের যুদ্ধজয়ের কাহিনী। যুদ্ধজয়ের আখ্যান না হয় জানা হল এতগুলো যুদ্ধ জিতলেন কি করে কৃষ্ণদেবরায়? একটা কারণ ছিল কৃষ্ণদেবরায়ের সুবিশাল সেনাবাহিনী। কত বড় ছিল তাঁর সেনাবাহিনী? তা জানতে পর্তুগিজ অশ্বব্যবসায়ী ডোমিংগো পেসের (যিনি কৃষ্ণদেবরায়ের রাজত্বে কয়েকবছর কাটিয়েছিলেন বিজয়নগরে) লেখাই আমাদের ভরসা – “… this king has continually a million fighting troops, in which are included 35,000 cavalry in armour; all these are in his pay, and he has these troops always together and ready to be dispatched to any quarter wherever such may be necessary.”। আর একটা কারণ ছিল পর্তুগিজদের সহায়তা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ। পর্তুগিজদের থেকে উন্নত অস্ত্র এবং আরবি এবং পার্সি ঘোড়ার সরবরাহ বাড়িয়েছিল বিজয়নগর সেনাবাহিনীর ধার এবং ভার। তবে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলেন সম্ভবত রাজা কৃষ্ণদেবরায় নিজে। সাধারণত রাজা মহারাজারা সেনাপতিদের ওপর যুদ্ধের ভার ছেড়ে দিয়ে নিজেরা নিরাপদ আশ্রয় থেকে যুদ্ধের হালহকিকত জানতেন। কৃষ্ণদেবরায় মোটেই সেইরকম ছিলেন না। তিনি সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন যা সেনাবাহিনীর উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়াতো। তিনি নিজেও ছিলেন সুদক্ষ যোদ্ধা এবং নিজেকে সবসময় যুদ্ধোপযোগী রাখতেন। এই প্রসঙ্গে ডোমিংগো পেস লিখেছিলেন “he takes in his arms great weights made of earthware, and then, taking a sword, he exercises himself with it till he has sweated out all the oil, and then he wrestles with one of his wrestlers. After his labour, he mounts a horse and gallops about the plain in one direction and another till dawn, for he does all this before daybreak”।

কৃষ্ণদেবরায়ের সময়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য

এই তো গেল কৃষ্ণদেবরায়ের সামরিক সাফল্যের কাহিনী এবং কারণ। তবে একজন পরাক্রমশালী রাজা হতে গেলে শুধু বাইরের শত্রুদের শায়েস্তা করলেই কি চলবে? না, কক্ষনো নয়। তার সাথে সাথে নিজের রাজ্য দাপিয়ে শাসন করতে হবে। তাও করেছিলেন কৃষ্ণদেবরায়। তবে তার জন্য তাঁকে কিছুটা হলেও কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল। নিতে হয়েছিল কিছু ব্যবস্থা, যা যুগের হিসাবে একটু বৈপ্লবিক ছিল। কেন বৈপ্লবিক? তা বুঝতে গেলে আমাদের আর একবার পিছিয়ে যেতে হবে সেই সময়ে, যে সময়ে হয়েছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন।

প্রশাসনিক সংস্কারঃ নিউ নর্মাল না কি টিকে থাকার লড়াই?

শুরুতেই লিখেছি যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল ১৩৪৬ সাধারণ অব্দে। তাঁর আগের কুড়ি-তিরিশ বছর ধরে পুরো দক্ষিণ ভারতে, উপকূলবর্তী কেরালা বাদ দিয়ে, তৈরি হয়েছিল এক রাজনৈতিক শূন্যতার। আগের রাজবংশগুলি যেমন মাদুরাই’এর পাণ্ড্য, দ্বারসমুদ্রের হৈসল, ওয়ারাঙ্গলের কাকতীয় এবং দেবগিরির যাদবরা হয় পুরো শেষ হয়ে গিয়েছিল বা ‘নাম কা ওয়াস্তে’ টিকে ছিল। উত্তর ভারত থেকে মাঝে মাঝে হামলা চালাচ্ছিল দিল্লি সালতানাত’এর বাহিনী। কিন্তু তাঁদের কোন ইচ্ছে ছিল না রাজ্যস্থাপন করে শাসনভার গ্রহণ করার। বরং তাঁদের লক্ষ ছিল দক্ষিণ ভারত থেকে যতটা সম্ভব ধনসম্পদ লুঠ করে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ পুরো দক্ষিণ ভারতে কোনো স্থায়ী শাসক ছিলনা। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পত্তন ছিল এই রাজনৈতিক শূন্যতার স্থানপূরণ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের স্বার্থে এবং কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির স্বার্থে যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দরকার পড়ে, পুরো দক্ষিণ ভারত জুড়ে সেই পরিমণ্ডল দেওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের। যদিও অধিকাংশ সময়েই বিজয়নগর সাম্রাজ্য গঠনের পিছনে এই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণের তুলনায় ধর্মীয় কারণকে বড় করে দেখানো হয়।

এই পাণ্ড্য, হৈসল, কাকতীয়, যাদব ইত্যাদি রাজবংশের পতন এবং বিজয়নগরের উত্থানের মাঝে পুরো দক্ষিণ ভারত জুড়ে তৈরি হয়েছিল ছোট ছোট অনেক রাজ্য, যেগুলির শাসনভার নিয়ে নিয়েছিলেন স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা যাঁদেরকে আমরা আজকের ভাষায় বলতে পারি ‘লোকাল স্ট্রং ম্যান’। এই লোকাল স্ট্রং ম্যানদের শক্তির উৎস ছিল নিজেদের জ্ঞাতি এবং স্বজাতি। বিজয়নগর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর শুরু হল এই রাজ্যগুলির সমষ্টিকরণ। এই রাজ্যগুলি হয়ে গেল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রদেশ, যার সরকারি নাম ছিল ‘রাজ্যম’।  কিন্তু রাজ্যমের শাসনকর্তা হলেন সেই লোকাল স্ট্রং ম্যানই। অর্থাৎ তাঁদের স্থানীয় জনভিত্তি এবং শক্তি অটুট থেকে গেল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রথম এক’শ বছরে, এই গঠনকাঠামো সাম্রাজ্যের জন্য কোন অসুবিধে তৈরি করেনি। সমস্যা সৃষ্টি হল ১৪৪৬ সাধারণ অব্দে দ্বিতীয় দেবরায়ের মৃত্যুর পর। একের পর এক অপদার্থ রাজার কারণে কেন্দ্রীয় শাসন তখন হয়ে পড়েছিল দুর্বল। সেই সময় একদিকে যেমন অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্তা রাজবংশের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে বিজয়নগরের পতাকা উঁচু করে রেখেছিলেন, তেমনি অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্তা, বিশেষ করে দক্ষিণ কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুর, নিজেদের স্থানীয় ক্ষমতার জোরে কেন্দ্রীয় শাসনকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে বা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে শুরু করলেন। 

কৃষ্ণদেবরায় সিংহাসনে বসার পর, এই সমস্যার সমাধান করে পুরো রাজ্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দ্বিমুখী কৌশল নিলেন। এক) – যে সব প্রাদেশিক শাসক অবাধ্য ছিলেন, তাদেরকে যুদ্ধ করে হটিয়ে দেন।  দুই) – তাদের জায়গায় স্থানীয় কাউকে নিয়োগ না করে, প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসাবে নিয়োগ করেন ‘নায়ক’দের, যারা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং যাদের কোন স্থানীয় জনভিত্তি ছিলনা। অর্থাৎ রাজ্যমের শাসনভার চলে গেল স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী পরিবারের হাত থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের এক ভুঁইফোড় আধিকারিকের হাতে। এর একটা উদাহরণ লেখার শুরুর দিকেই দিয়েছি –  উম্মাত্তুরের গঙ্গারায়কে পরাজিত করে, তাঁর জায়গায় সালুভ গোবিন্দরায়ের নিযুক্তির। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল তামিলনাড়ুর বীরশেখর চোলকে সরিয়ে তার জায়গায় প্রাদেশিক শাসক হিসাবে নাগাম নায়কের নিযুক্তি, আরেক পুরনো তামিল প্রাদেশিক শাসককে হটিয়ে তার জায়গায় প্রাদেশিক শাসক হিসাবে চেলাপ্পা সালুভ নায়কের নিযুক্তি ইত্যাদি।

নায়কদের ‘রোল’

নায়কদের কেন্দ্র করে গড়ে তোলা এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যা অনেকটা আজকের দিনের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের মত, সেই যুগের হিসাবে ছিল যথেষ্ট অভিনব। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল সালুভ বংশের রাজত্বকালে। আর এর বহুল প্রয়োগ হতে শুরু করে কৃষ্ণদেবরায়ের সময় থেকে। নায়কদের মধ্যে অনেকে নিযুক্ত হতেন রাজ্যমের শাসনকর্তা হিসাবে, আবার অনেকে যুক্ত থাকতেন রাজধানীতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে। নায়কদের যে সমস্ত পদের নাম আমরা পাই, সেগুলি হল মহামণ্ডলেশ্বর (এক বড় অঞ্চলের শাসক), মহাপ্রাধিনী (কোন অঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রী), রাজ্যম-কর্তার (প্রাদেশিক শাসক), দালাভায় (সেনাপতি), ভাসল (প্রাসাদ রক্ষী), বক্কিসাম (হিসেবরক্ষক), কারিয়াত্তু-কাদাভা (রাজা কর্তৃক বিশেষ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ইত্যাদি। নায়করা এক পদ থেকে আরেক পদে, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বদলি হতেন, বিশেষ করে সেই নায়করা যারা প্রাদেশিক শাসক হিসাবে নিযুক্ত হতেন যাতে তারা কোন রাজ্যমে শিকড় গেড়ে বসতে না পারেন। ঐতিহাসিক নোবুরু কারাশিমার মতানুযায়ী, কৃষ্ণদেবরায়ের সময়ে শুধু তামিলনাড়ুতে ছিল ১১০ জন নায়ক। ফের্নাও নুনিজ’এর বর্ণনা অনুযায়ী কৃষ্ণদেবরায়ের পরবর্তী শাসক অচুত্যদেব রায়ের সময়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে ছিল দু’শর বেশি নায়ক।

এই নায়কদের মধ্যে যারা প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন, তাদেরকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মধ্যযুগের ইউরোপের সামন্তদের সাথে তুলনা করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক বার্টন স্টেইন এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উল্টো মত পোষণ করেন। তাঁর মতে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা যত না ছিলেন রাজার নিয়োগ করা আধিকারিক, তার চেয়ে বেশি ছিলেন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসক। তাঁদের ক্ষমতার উৎস ছিল তাদের জ্ঞাতি এবং জাত। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্টেইনের বিশ্লেষণের সাথে একমত নন। এর একটা কারণ হল যে স্টেইন, তাঁর বিশ্লেষণে শুধুমাত্র কয়েকজন বড় নায়ক যেমন সেনজি, তাঞ্জাভুর এবং মাদুরাইয়ের নায়কদের গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ছোট নায়কদের ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। তাই তাঁর বিশ্লেষণ পুরো নায়ক ব্যবস্থার ছবি তুলে ধরে না। স্টেইন সাহেবের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ হল যে, তিনি সবসময় চেষ্টা করে গিয়েছেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে ‘সেগমেন্টারি স্টেট’ হিসাবে দেখাতে। বিজয়নগরের নায়কতন্ত্র নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

এবার কাজের হিসাব

এতক্ষণের আলোচনা থেকে এইটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার যে কৃষ্ণদেবরায় বিজয়নগরের শত্রুদেরও দমন করেছিলেন এবং শক্ত হাতে রাজ্য চালিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে বিজয়নগর রাজনৈতিকভাবে হয়ে উঠেছিল খুব শক্তিশালী। অতএব তাঁকে বিজয়নগরের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক বলা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তাই বলে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ রাজা? সর্বশ্রেষ্ঠ হতে গেলে তো আরও কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় যেমন প্রজাদের সুখ স্বাচ্ছন্দের খেয়াল রাখতে হয়, রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে হয়, শিল্প-স্থাপত্য-সাহিত্যের বিকাশ ঘটাতে হয়। করেছিলেন কি কৃষ্ণদেব রায় এই সব শর্তপূরণ?

মনে হয় তিনি করেছিলেন এবং তাই তিনি ছিলেন এক জনপ্রিয় শাসক। তিনি যে জনপ্রিয় ছিলেন কি করে জানলাম আমরা? সেই ডোমিংগো পেজ’এর লেখা থেকে – “He ……… was able, brave and statesman like and was a man of much gentleness and generosity of character. He was beloved by all and respected by all”। তবে ঠিক কি কি তিনি করেছিলেন বিজয়নগরের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য, তা জানার আগে জেনে নেই কী ছিল তাঁর রাজ্য শাসনের দর্শন। না, না, এইবার ডোমিংগো পেজ’এর লেখা নয়, এইবার আমাদের ভরসা তেলেগু কাব্য রায়াবচকামু। কৃষ্ণদেবরায়ের শাসনকাল নিয়ে ষোড়শ শতকের শেষের দিকে রচিত হয়েছিল রায়াবচকামু। সেই কাব্যে, রাজা তাঁর মন্ত্রীকে বলেছিলেন – “One should tour the country ruled over by one’s ancestors. Nothing can be known if one remains stationary….it is necessary that the people ….. should know your majesty ….. establish your glory by touring the kingdom in all directions, accompanied by the four-fold army so as to create terror in the mind of enemies and sub-ordinate chiefs”। অর্থাৎ কৃষ্ণদেবরায় রাজপ্রাসাদে বসে থেকে রাজ্যশাসনে বিশ্বাসী ছিলেন না। চলে যেতেন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়, প্রজাদের মাঝে। দক্ষ এবং কল্যাণমুখী প্রশাসনের ওপর তিনি যে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় অমুক্তমাল্যদা গ্রন্থ পড়লে, যাতে তিনি প্রশাসক হিসাবে রাজার কর্তব্যগুলির বর্ণনা দিয়েছিলেন।

কৃষ্ণদেবরায়ের সময়ে কৃষিজাত উৎপাদনের জন্য বিজয়নগর সাম্রাজ্য নির্ভরশীল ছিল তিনটি অঞ্চলের উপর – কর্ণাটকের উচ্চ কাবেরী অববাহিকা, উত্তর তামিলনাড়ুর পালার নদীর অববাহিকা এবং দক্ষিণ তামিলনাড়ুর নিম্ন কাবেরী অববাহিকা। সাম্রাজ্যের বাকি অংশ ছিল দাক্ষিণাত্য মালভূমির অংশ – যেখানে ফসল উৎপাদন কম হত এবং সেই সব ফসলের চাষ হতো যাতে জল কম লাগে। সাম্রাজ্যের এই মালভূমি অঞ্চলের কৃষিকাজের উন্নতির জন্য কৃষ্ণদেবরায় অনেক পুকুর/কুয়ো খুঁড়িয়ে সেচের বন্দোবস্ত করিয়েছিলেন। এর ফলে সাম্রাজ্যের মালভূমি অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল অনেকগুলি উচ্চ এবং বহু ফসলী ‘পকেট’। অবশ্য এই পুকুর/কুয়ো খুঁড়ে উচ্চ এবং বহু ফসলি ‘পকেট’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সালুভ নরসীমার সময়ে এবং তা চালু ছিল কৃষ্ণদেবরায়ের পরবর্তী শাসনকালেও। আর কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছাড়াও বেশ কিছু মন্দির কর্তৃপক্ষ, যেমন তিরুপতি এবং কালাহস্তী মন্দির কর্তৃপক্ষ মন্দিরের আশেপাশের গ্রামের জন্য একই কাজ করেছিল। এছাড়াও জঙ্গল সাফ করে কৃষকদের জন্য বাড়তি কৃষিজমিরও বন্দোবস্ত করেছিলেন কৃষ্ণদেবরায়।

তবে সেই সময় বিজয়নগরের আর্থিক সমৃদ্ধির মূল কারণ ছিল বাণিজ্য বিশেষ করে বহির্বাণিজ্য। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে গড়ে উঠেছিল এক ত্রিভুজাকৃতি বাণিজ্য ‘নেটওয়ার্ক’ যার ভরকেন্দ্র ছিল রাজধানী বিজয়নগর। এই ত্রিভুজের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল বাঁকাপুর এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ছিল শ্রীরঙ্গপত্তনম। এই দুই কর্ণাটকী শহর যুক্ত ছিল পশ্চিম উপকূলের সমস্ত প্রধান ব্যবসায়িক লেনদেনের কেন্দ্রর  সাথে – উত্তরে চউল থেকে দক্ষিণে ক্যানানোর। আর এই ত্রিভুজের শীর্ষে ছিল পূর্ব উপকূলের মতুপল্লী থেকে পুলিকটের মাঝের বিভিন্ন বন্দর। এই বন্দরগুলি স্থলপথে যুক্ত ছিল রাজধানী বিজয়নগরের সাথে। পূর্ব উপকূলের এবং পশ্চিম উপকূলের এই সব বন্দর দিয়ে হতো প্রভূত আমদানি-রপ্তানি যা থেকে আদায় করা রাজস্ব ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতির মূল ভিত্তি।  এই বহির্বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য কৃষ্ণদেবরায় কোন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিনা জানা নেই। তবে ডোমিংগো পেজ’এর লেখা থেকে বোঝা যায় যে তিনি বিদেশী এবং বিদেশী প্রতিনিধিদলের বিশেষ খাতিরযত্ন করতেন – “ ….. he is one that seeks to honour foreigners, and receives them kindly, asking about all their affairs whatever their condition may be.” । এই খাতিরদারির কারণ সম্ভবত ছিল বিদেশী বণিকদের বিজয়নগরের সাথে বাণিজ্য করতে টেনে আনা। আর কৃষ্ণদেবরায় যে বহির্বাণিজ্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন, তা আমরা জানতে পারি অমুক্তমাল্যদা গ্রন্থ থেকে– “A king should improve the harbours of his country and so encourage its commerce that horses, elephants, precious gems, sandalwood, pearls and other articles are freely imported ….. He should arrange that the foreign sailors who land in his country on account of storms, illness and exhaustions are looked after in a manner suitable to their nationalities …. Make the merchants of distant foreign countries who import elephant and good horses be attached to yourself by providing them with daily audience, presents and allowing decent profits. Then those articles will never go to your enemies”। বহির্বাণিজ্যের উপর আদায়কৃত শুল্কের সাথে সাথে, বিভিন্ন অন্তর্দেশীয় শিল্পবাণিজ্যকেন্দ্র যেমন মহীশূর, ইক্কেরি, পেনুকোন্ডা থেকেও আদায় হত প্রভূত রাজস্ব।

১৫৭২ সাধারণ অব্দে জর্জ ব্রাউন এবং ফ্রান্স হগেনবার্গের মানচিত্র গ্রন্থে কালিকট

কৃষ্ণদেবরায়ের সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির ফলস্বরূপ ঘটেছিল রাজধানী বিজয়নগরের সৌন্দর্যায়ন। শহরটি হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী নগরগুলির একটি। ডোমিংগো পেজ’এর বর্ণনায় সেই বিজয়নগরের যে ছবি ফুটে ওঠে তা হল – “The size of this city I do not write here, because it cannot all be seen from any one spot, but I climbed a hill whence I could see a great part of it, I could not see it all because it lies between several ranges of hills. What I saw from thence seemed to me as large as Rome, and very beautiful to the sight; there are many groves of trees within it, in the gardens of the houses, and many conduits of water which flow into the midst of it and places there are lakes and the king has close to his palace a palm-grove and other rich bearing fruit trees”। সিংহাসনে বসার প্রায় সাথে সাথেই কৃষ্ণদেবরায় বিরূপাক্ষ মন্দিরের জন্য একটি নতুন গোপুরম নির্মাণ করেন এবং একটি পুরনো গোপুরমের সংস্কার করেন। ১৫১৩ সাধারণ অব্দে তিনি উদয়গিরি থেকে নিয়ে আসা বালকৃষ্ণর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁর সময় বিজয় ভিট্টালা মন্দির এবং হাজার রামা মন্দিরেরও প্রভূত অলংকরণ হয়। কৃষ্ণদেবরায়ের সময়ের শেষ উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি হলো লক্ষ্মী নরসিমহার মূর্তি। ১৫২৮ সাধারণ অব্দে নির্মিত এই মূর্তিটি বানানো হয়েছিল একটি গ্রানাইট পাথর কেটে।

বিরূপাক্ষ মন্দিরের গোপুরম

উদয়গিরি থেকে নিয়ে আসা বালকৃষ্ণর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্মিত কৃষ্ণ মন্দির

লক্ষ্মী নরসিমহার মূর্তি

কৃষ্ণদেবরায় যে শুধু বিজয়নগরের সৌন্দর্যায়ন করেছিলেন তা নয়, নাগরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির দিকেও নজর ছিল তাঁর। বিজয়নগর এবং তাঁর আশেপাশের অধিবাসীদের জলকষ্ট দূর করার জন্য, ১৫২১ সাধারণ অব্দে, তিনি কোররাগালে তুঙ্গভদ্রা নদীর ওপর একটি জলাধার নির্মাণ করান। এই জলাধার থেকে জলবাহিকা দিয়ে জল আসতো বিজয়নগরে। রাজধানীর জল সরবরাহের জন্য ‘বাসবান্না’ নামে আরও একটি জলবাহিকা তৈরিহয়েছিল। তাঁর সময়ে বিজয়নগরের উপকণ্ঠে, একটি সুন্দর শহরতলি নির্মিত হয়। কৃষ্ণদেবের মা নাগাল দেবীর নামে এই শহরতলীর নাম হয় নাগালকোট (আজকের হসপেট)। এই শহরতলিতে যাতে জলের অভাব না হয়, তার জন্য খনন করা হয়েছিল একটি বিশাল জলাধার। ডোমিংগো পেজ’এর বর্ণনা অনুযায়ী – “… the king made a tank there, which, as it seems to me, has the width of a falcon shot, and it is at the mouth of two hills, so that all the water which comes from either one side or the other collects there, and besides this, water comes to it from more than three leagues by pipes which run along the lower parts of the range outside. This water is brought from a lake which itself overflows into a little river”। এই জলাধার নির্মাণে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন পর্তুগিজ বাস্তুকার ‘জোয়াও দে লা পন্তে’ যাঁকে বিজয়নগরে পাঠিয়েছিলেন গোয়ার পর্তুগিজ গভর্নর জেনারেল।

তাহলে বোঝা গেল যে কৃষ্ণদেবরায় যে শুধু মাত্র বীরযোদ্ধা ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন একজন সুশাসক যিনি নিজের প্রজাদের খেয়াল রাখতেন, রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট ছিলেন, রাজধানীর সৌন্দর্যায়ন করিয়েছিলেন এবং রাজধানীর নাগরিক সুযোগ সুবিধে বাড়িয়েছিলেন। তাহলে তাঁকে কি বিজয়নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক বলাযায়? তা হয়তো বলা যাবে, কিন্তু ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজাদের ‘হল অফ ফেম’-এ ওনার নাম অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা যতক্ষণ না জানা যাবে উনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন কিনা। খেয়াল করে দেখুন ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে তাঁদেরই নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাঁরা সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। সেকালের উদাহরণ চান? বিক্রমাদিত্য, আকবর ইত্যাদি। একালের উদাহরণ? না নাম আমি লিখতে পারবো না, কারণ বিতর্ক হবে। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন এযুগে তাঁদেরই আমরা ভালো শাসক বলে মানি যাঁদের চারপাশে লেখক ও সাহিত্যিকরা ঘুরে বেড়ান। অনেক শাসক তো আবার নিজেরাই লেখক বা লেখিকা হয়ে যান।

সাহিত্যে অনুরাগ

মনে হয়ে যে কৃষ্ণদেবরায় জানতেন যে অমর হতে গেলে, তাঁকে সাহিত্যানুরাগী হতে হবে। সুতরাং নিজ রাজত্বকালে সাহিত্যের যাতে বিকাশ হয়, সেদিকে কোন কার্পণ্য করেননি তিনি। তাঁর সময়ে তেলেগু সাহিত্য যে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁর আমলে সংস্কৃত রচনার অনুবাদের পরিবর্তে তেলেগু ভাষায় মৌলিক রচনা রচিত হতে শুরু করে। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার মত তেলেগু ভাষার আটজন দিকপাল লেখককে নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন অষ্টদিগগজ সভা। এই সভার চূড়ামণি ছিলেন আলাসানি পেড্ডানা, যাঁকে কৃষ্ণদেবরায় অন্ধ্রকবিতা-পিতামহ (তেলেগু পদ্যের পিতামহ) উপাধি দেন। এই অষ্টদিগগজ সভার আরেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তেনালি রামকৃষ্ণ, যাঁকে নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে নির্মিত হয়েছে টিভি সিরিয়াল ‘তেনালি রামা’। তাঁর সময়ে রচিত হয়েছিল অমুক্তমাল্যদা গ্রন্থ। এই অমুক্তমাল্যদা গ্রন্থকে তেলেগু ভাষায় রচিত সর্বোত্তম পাঁচ কাব্যের মধ্যে একটি বলে গণ্য করা হয়। অনেকের মতে অমুক্তমাল্যদা গ্রন্থের লেখক ছিলেন কৃষ্ণদেবরায় নিজেই। এই বিষয়ে অন্য মত হচ্ছে যে অমুক্তমাল্যদা গ্রন্থের বিষয়বস্তু কৃষ্ণদেবরায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত হলেও, তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন অন্য কেউ। তেলেগু সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার সাথে সাথে, তিনি কন্নড় এবং সংস্কৃত সাহিত্যেরও কদর করতেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ভাষার  দ্বৈতবাদ দর্শনের উপর দুই বিখ্যাত গ্রন্থ ভেদজ্জীবন এবং তৎপরায়াচন্দ্রিকার রচয়িতা ভাস্বরের পৃষ্ঠপোষক। 

মুদ্রার ওপিঠ

মোটের ওপর এই হল কৃষ্ণদেবরায়ের ইতিহাস। এইবার চলুন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে একটু উঁকি মারা যাক। কেমন দেখতে ছিলেন কৃষ্ণদেব রায়? কেমন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব?  এর একটা আভাষও আমরা পাই পেজ’এর লেখা থেকে – “ The king is of medium height and fair complexion and good figure, rather fat than thin; he has on his face signs of small pox. He was the most feared and perfect king that could possibly be, cheerful of disposition and very merry;  …..”। কৃষ্ণদেবরায়ের অবয়বের যে বর্ণনা আমরা পেজ’এর লেখা থেকে পাই, তার সাথে অবশ্য কৃষ্ণদেবরায়ের বিভিন্ন স্ট্যাচু বা তিরুপতি মন্দিরে দুই পত্নীর সাথে কৃষ্ণদেবরায়ের যে ব্রোঞ্জ মূর্তি রয়েছে সেগুলির বিশেষ মিল নেই। আজকালকার স্ট্যাচু এবং তিরুপতি মন্দিরের ব্রোঞ্জ মূর্তি অনুযায়ী কৃষ্ণদেবরায় ছিলেন ‘টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম’।

তিরুপতি মন্দিরে কৃষ্ণদেবরায়, তিরুমালা দেবী এবং চিন্নাম্মা দেবীর ব্রোঞ্জ মূর্তি

কৃষ্ণদেবরায়ের পাটরানী ছিলেন তিরুমালা দেবী। তিরুমালা দেবীকে কৃষ্ণদেবরায় কিছুটা হলেও রাজনৈতিক কারণে  করেছিলেন। তিরুমালা দেবী ছিলেন শ্রীরঙ্গপত্তনমের শাসক কুমার বিজয়ের মেয়ে। নিজের রাজত্বকালের একেবারে প্রত্যোম দিকে কৃষ্ণদেবরায় যখন উম্মাত্তুরের গঙ্গারায়ের বিদ্রোহ দমন করতে  গিয়েছিলেন,তখন এই কুমার বিজয়কে হারিয়ে শ্রীরঙ্গপত্তনমকেও নিয়ে এসেছিলেন বিজয়নগরের অধীনে। এই সব অঞ্চল পরবর্তীকালে যাতে  না বিদ্রোহ করে, অনেকটা সেই কথা মাথায় রেখেই কৃষ্ণদেবরায় বিয়ে করেছিলেন তিরুমালা দেবীকে।

তিরুমালা দেবী পাটরানী হলেও কৃষ্ণদেবরায়ের মনের মানুষ ছিলেন চিন্নাম্মা দেবী। চিন্নাম্মা দেবী ছিলেন এক নর্তকী। তিরুমালা দেবীকে বিয়ে করার আগে থেকেই তাঁর সাথে গড়ে উঠেছিল কৃষ্ণদেবরায়ের প্রেমের সম্পর্ক। কৃষ্ণদেবরায় তাঁকে কথা দিয়েছিলেন বিয়ে করার। কিন্তু একজন প্রাক্তন নর্তকী তো রাজ্যের পাটরানী হতে পারে না। তাই তিরুমালা দেবীকে বিয়ে করার পরই কৃষ্ণদেবরায় চিন্নাম্মা দেবীকে বিয়ে করেন। তবে চিন্নাম্মা দেবীকে অধিকতর ভালোবাসলেও, কৃষ্ণদেবরায় কখনও পাটরানী হিসেবে তিরুমালা দেবীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেননি। তিরুমালা দেবী নিজেও ছিলেন খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্না। চিন্নাম্মা দেবীর সাথে কৃষ্ণদেবরায়ের সম্পর্ক নিয়ে ঈর্ষান্বিত হলেও, রাজসভায় এবং প্রজাদের সামনে তিনি বজায় রেখেছিলেন পাটরানী হিসাবে নিজের মর্যাদার।

প্রতাপরুদ্রর মেয়ের সাথে কৃষ্ণদেবরায়ের বিয়ে অবশ্য সুখের হয়নি। লোকগাথা অনুযায়ী প্রতাপরুদ্রর উস্কানিতে,  তাঁর মেয়ে একবার কৃষ্ণদেবরায়কে মারার চেষ্টা করেছিলেন, কৃষ্ণদেবরায়কে দাসী-পুত্র বলে সম্বোধন করতেন। এর প্রতিদানে, শাস্তিস্বরূপ কৃষ্ণদেবরায় তাঁকে কাম্ভাম’এ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে, দারিদ্র্য এবং একাকিত্বের মাঝে কেটেছিল প্রতাপরুদ্রর মেয়ের বাকি জীবন।

তিরুমালা দেবীর গর্ভে কৃষ্ণদেবরায়ের দুই ছেলে এবং এক মেয়ের জন্ম হয়। কৃষ্ণদেবরায় যখন সিংহাসনে বসেছিলেন তখন তাঁকে অনেক মদত করেছিলেন আরাবিদু বুক্কা বলে এক প্রাদেশিক শাসক। অনেকটা তাঁর প্রতিদানস্বরূপ আরাবিদু বুক্কার ছেলে রাম রায়ের সাথে নিজের মেয়ে তিরুমালাম্বার বিয়ে দেন কৃষ্ণদেবরায়। বিয়ের পর জামাইয়ের নতুন নাম হয় আলীয়ারাম রায়। তিরুমালাদেবীর গর্ভে জন্মানো জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল তিরুমালা। ১৫১৮ সাধারণ অব্দে জন্ম হয় তাঁর। তিনিই ছিলেন কৃষ্ণদেবরায়ের ঘোষিত উত্তরসূরি। ১৫২৩ সাধারণ অব্দে, কৃষ্ণদেবরায় তিরুমালাকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে নিজেকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করেন। তিরুমালার সিংহাসনারোহণকে উদযাপন করতে আট মাস ব্যাপী উৎসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই উৎসব চলাকালীন, ১৫২৪ সাধারণ অব্দে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন তিরুমালা, খাদ্যে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে। তিরুমালার এই অকালমৃত্যুর পর থেকে, রাজকার্যে কৃষ্ণদেব রায়ের আগের মত উৎসাহ ছিলনা। পরবর্তীকালে তিরুমালা দেবীর গর্ভে আরও এক ছেলের  হয়। কিন্তু সেই ছেলেও মাত্র ১৮ মাস বেঁচে ছিল।

ব্যক্তিগত জীবনে কৃষ্ণদেবরায় ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তাঁর বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল তিরুপতির ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির। একই কারণে তিনি উদয়গিরি থেকে বালকৃষ্ণর মূর্তি নিয়ে এসে বিজয়নগরে বানিয়েছিলেন কৃষ্ণমন্দির। তাঁর সময় থেকেই তেলেগু সাহিত্যের ওপর বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কৃষ্ণদেবরায় ধর্মান্ধ ছিলেন না। বৈষ্ণব হলেও, তিনি বিভিন্ন শৈব মন্দিরের উন্নতিসাধন করেছিলেন। তিনি বিরূপাক্ষ মন্দিরের গোপুরম নির্মাণ করিয়েছিলেন, কালাহস্তী মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের বন্দোবস্ত করেছিলেন, তামিলনাড়ু অঞ্চলের বিভিন্ন মন্দিরে দান করেছিলেন ১০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। তাই পর্তুগিজ আধিকারিক দুরাতে বারবোসা, যিনি ১৫১৮ সাধারণ অব্দে বিজয়নগরে এসেছিলেন, কৃষ্ণদেবরায় সম্পর্কে লিখেছিলেন – “The King allows such freedom that every man may come and go and live according to his own creed, without suffering any annoyance and without enquiry whether he is a Christian, Jew, Muslim or Heathen”।

কোন মানুষই ভগবান নয়। প্রত্যেকেরই কিছু বা কিছু দোষ থাকে। কৃষ্ণদেবরায়েরও ছিল। তাই তাঁকে ‘ডেমি  গড’ না বানিয়ে, তাঁর দোষগুলোও জানা উচিৎ। তাঁর স্বভাবের সবচেয়ে বড়ো নেতিবাচক দিক ছিল যে রেগে গেলে তাঁর মাথার ঠিক থাকতো না, ডোমিংগো পেজ’এর ভাষায় – “He ……, but subject to sudden fits of rage ……”। এই মাত্রাহীন ক্রোধের কারণে নিজপুত্র তিরুমালার গুপ্তঘাতকের হাতে মৃত্যু হওয়ার পর, সন্দেহের বশে তিনি অন্ধ করে দেন তাঁর মন্ত্রী সালুভ টিম্মাকে। অথচ এই সালুভ টিম্মাই করিয়েছিলেন কৃষ্ণদেবরায়ের রাজ্যাভিষেক। তাঁর স্বভাবের আরেকটা খারাপ দিক ছিল দম্ভ। বিজাপুরের আদিল শাহীদের একাধিকবার পরাজিত করার পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন অহংকারী। পরাজিত শত্রুপক্ষদের কাছে তিনি অযৌক্তিক দাবি দাওয়া শুরু করেন। শত্রুপক্ষের দূত কোন রাজনৈতিক প্রস্তাব নিয়ে এলে, তাঁদের অপেক্ষা করতেন দিনের পর দিন। যখন ইসমাইল আদিল শাহের দূত আসাদ খান লারি শান্তি প্রস্তাব নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন, তিনি আসাদ খান লারিকে এক মাস অপেক্ষা করিয়েছিলেন। তাঁর দাবি ছিল যে ইসমাইল আদিল শাহ তাঁর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে তবেই তিনি বিজাপুরের অধিকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দেবেন। সম্ভবত সেই কারণেই ইসমাইল আদিল শাহ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেননি যার উল্লেখ পূর্বেই করেছি। তাঁর এই ব্যবহারের কারণে বিজয়নগরের শত্রুদের মনে বিজয়নগর সম্পর্কে চিরস্থায়ী বৈরিতার সৃষ্টি হয়েছিল যার ফল ভুগতে হয়েছিল তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে।

১৫২৯ সাধারণ অব্দে কয়েক দিন রোগভোগের পর কৃষ্ণদেবরায়ের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভাই অচ্যুতদেবরায়কে সিংহাসনের জন্য মনোনীত করে যান। এতদসত্বেও, তাঁর মৃত্যুর পর রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। বিজয়নগরের শত্রুরা, যারা এতদিন কৃষ্ণদেবরায়ের ভয়ে চুপচাপ ছিল, তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিজাপুরের আদিল শাহীরা কৃষ্ণদেবরায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রীতিমত উৎসব পালন করে। বিজয়নগর সাম্রাজ্য আবার দুর্বল হতে শুরু করে, যার অন্তিম পরিণতি ছিল ১৫৬৫ সাধারণ অব্দে তালিকোটার যুদ্ধে বিজয়নগরের পরাজয় এবং হাম্পির পতন।

তুলুভ শাসকদের পঞ্জি

এই হল রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের বৃত্তান্ত। আপনাদের খুব একঘেয়ে লাগলো বোধহয়। আমারও লেগেছিল পড়ার সময়ে এবং লেখার সময়েও। আপনারা পড়ে খুব বিরক্ত হলেন জানি। আমিও হয়েছি – পড়তে এবং লিখতে। তাও পড়লাম ও লিখলাম। কারণ ওই বাবরনামার বিবরণ। ওহ! আপনাদের তো আসল ব্যাপারটা বলাই হয়নি। এমন ভোলা মন আমার!

অন্তমিল

বাবরনামার তিনটে অংশ – ফারগানা, কাবুল এবং হিন্দুস্থান। তিনটি অংশর নাম দেখেই বোঝা যায় এক একটা অংশ সেই জায়গায় বাবরের কাটানো জীবনের দিনলিপি। তা বাবর তখন ইব্রাহিম লোদীকে যুদ্ধে হারিয়ে দিল্লি জয় করে নিয়েছেন। তারপর হিন্দুস্তান অংশের এক জায়গায়, বাবর তাঁর সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখছেন – “At the day of my conquest of Hindustan it was governed by five Musalman rulers (padshah) and two Pagans (kafir). These were the respected and independent rulers, but there were also, in the hills and jungles, many rais and rajas, held in little esteem (kichikkarim)। এর পর তিনি পাঁচ জন মুসলিম শাসকের নাম উল্লেখ করে তাঁদের সম্পর্কে তাঁর অভিমত লিপিবদ্ধ করেছেন বাবরনামাতে। তারপর তৎকালীন ভারতের দুই হিন্দু রাজা সম্পর্কে তিনি লিখছেন – “Of the Pagans the greater both in territory and army is the Raja of Bijanagar. The second is Rana Sanga who in these latter days had grown great by his own valour and sword” ।

Bijanagar বলতে বাবর বিজয়নগরকে বুঝিয়েছেন, এইটা বোঝার মত জ্ঞানগম্যি আমার ছিল। হঠাৎ মনে হল ‘আচ্ছা দিল্লি থেকে বিজয়নগরের দূরত্ব কত’? পাশেই ছিল ল্যাপটপ। খুললাম গুগল ম্যাপ। উরিব্বাস, প্রায় ১৯০০ কিলোমিটার! কম দূরত্ব নয় সেই যুগের হিসাবে। কে ছিলেন বিজয়নগরের সেই রাজা যিনি অত দূর থেকে বাবরের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন? আবার ফিরে গেলাম বাবরনামায়। বাবর কবে লিখেছিলেন বাবরনামার এই অংশ? ১৫২৬ সাধারণ অব্দের অক্টোবর মাসে। কে ছিলেন তখন বিজয়নগরের রাজা? বিজয়নগরের ইতিহাস একটু ঝাড়পোঁছ করতেই নাম বেরিয়ে এলো – কৃষ্ণদেবরায়। তখন শুরু করলাম কৃষ্ণদেবরায়কে নিয়ে পড়তে। তার ফলশ্রুতি? এই অত্যন্ত বিরক্তিকর লেখাটি। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রবল প্রতাপান্বিত বাবর যাঁকে সমীহ করতেন, তাঁর সম্পর্কে আমাদেরও তো কিছু জানা উচিত যদি আমরা ভারতের ইতিহাস বলতে ‘ভারতের’ ইতিহাস বুঝি। হলইবা তা একঘেয়ে আর বিরক্তিকর।

তথ্যসূত্র:

১) K. A. NilakantaSastri, The Illustrated History of South India: From Prehistoric Times to the Fall of Vijayanagar, Oxford India Press, 2009.

২) Burton Stein, The New Cambridge History of India: Vijayanagara, Cambridge University Press, 2008.

৩) Noboru Karashima (Ed.), A Concise History of South India, Issues and Interpretations, Oxford India Press, 2014.

৪) Meenkashi Jain (Ed.), The India They Saw (Vol – III), Prabhat Books (Kindle Edition).

৫) Robert Sewell, A Forgotten Empire: Vijayanagara, Published in 1900 A.D.

৬) Srinivas Reddy, Raya – Krishnadevaraya of Vijaynagara, Juggernaut Books, 2020

৭) Manu S. Pillai, The Deccan from Khilji to Shivaji – Rebel Sultans, Juggernaut Books, 2020

৮) John Keay, India – A History: From the Earliest Civilisation to the Boom of the Twenty-First Century, Harper Press, 2010.

৯) Sanjeev Sanyal, The Ocean of Churn – How The Indian Ocean Shaped Human History, Penguin Books, 2017.

১০) Annette Susannah Beveridge, Baburnama – A Memoir, Translated from the Original Turkish Text, Rupa Publications India Pvt. Ltd., 2020.

১১) https://en.wikipedia.org/wiki/Krishnadevaraya

১২) https://en.wikipedia.org/wiki/Tirumala_Devi

লেখক মুম্বাইতে স্বনিযুক্ত শান্তনু কারিগরিবিদ্যায় স্নাতক এবং ফিনান্স'এ এম.বি.এ। পেশার বাইরে শান্তনু'র শখ হলো নতুন জায়গা ঘুরে দেখা এবং ইতিহাসচর্চাকরা।

মন্তব্য তালিকা - “কৃষ্ণদেবরায়”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।