সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

আধুনিকতার আলোকে প্রাচীন ভারতের বিচার ব্যবস্থা

আধুনিকতার আলোকে প্রাচীন ভারতের বিচার ব্যবস্থা

নবাঙ্কুর মজুমদার

ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ ১৩৫ 0

আদালত হল সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায়ে রাখার এক ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রযন্ত্র। যেকোনো যুগের সমাজকেই সমকালীন অনুশাসনে বেঁধে রাখতে বেশ কিছু নিয়ম নীতি অনুসরণ করতে হয়। অনুশাসনের নজরদারি শিথিল হলে সেই সমাজে বিশৃঙ্খলা নেমে আসে যা শাসকের কাছে মোটেই বাঞ্ছনীয় ব্যাপার নয়। তাই এযাবৎ ভিন্ন সমাজব্যবস্থায়, বিভিন্ন যুগে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে অভিযাত্রা কালে ন্যায়ালয় নামে প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্ব সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থেকে এসেছে।    

‘মানুষের বিচার মানুষ করে, মানুষই দণ্ডদাতা’, তবু বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতায় আজও বিচারের বাণী কখনো নিরবে নিভৃতে, কখনো আবার সরবে সোচ্চারে কেঁদে চলে। সুবিচারের প্রত্যাশা সেকালের মত পথ চেয়ে থাকে, একালেও। আর প্রত্যাশার চাপে দণ্ড-সংহিতাকে কর্কটকালীন রাত আঁধারে মুখ লুকাতে হয়। যখন দেখি আধুনিক বিচার ব্যবস্থা গাদা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে অসহায়ভাবে পথ হাতড়ায় তখন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয় ভারত নির্মাণের শুরুর সেসব দিনের দিকে। কেমন ছিল সেদিনকার বিচার পদ্ধতি? বিচারালয়গুলিই বা কিভাবে তৈরি হত? একবার ফিরে দেখা যাক।

‘প্রাচীন ভারতের আধুনিক রাষ্ট্র’ মৌর্য সাম্রাজ্য বা তার পরবর্তীকালীন বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার মূল অবলম্বন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। এছাড়াও আছে কয়েক’শ বছর ধরে ধীর পদক্ষেপে গড়ে ওঠা নানান শাস্ত্র ও সংহিতাগুলি।

মৌর্যকালীন বিচার ব্যবস্থায় অবশ্য রাজাই ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক, কিন্তু বুনিয়াদি বিচার প্রক্রিয়ার মূল দায়িত্ব থাকত সুবিন্যস্ত বিচারালয়গুলির উপর। বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে ছোট স্তরে ‘গ্রামিক’ ও ‘গ্রামবৃদ্ধ’রা রাজসরকারের থেকে দায়িত্ব পেয়ে ছোটোখাটো বিসম্বাদের বিচার করতে, সাব্যস্ত অপরাধীকে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করতে বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারতেন। এর উপরের স্তরে ছিল ‘ধর্ম্মস্থীয়’ নামের আদালত। তিনজন ‘ধর্ম্মস্থা’ এই আদালতের বিচারক ছিলেন। এরা সকলেই রাজসরকার থেকে নিয়োগ পেতেন। ধর্ম্মস্থীয়-গুলির অধিকার ক্ষেত্রের মধ্যে তুলনামূলক লঘু অপরাধ যেমন—কোন চুক্তিপত্রের বৈধতা, মানহানি, মারামারি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক, নিয়োগকর্তা-কর্মচারী সম্বন্ধ, ক্রীতদাস সংক্রান্ত বিষয়, ঋণ ও সুদ সম্পর্কিত বিরোধ, ছোটোখাটো চুরি-ডাকাতি, বিষয়-সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ, সীমানা নিয়ে মতবিরোধ, জমি বিবাদ, কোন মামলার বিচার পদ্ধতি বৈধ কিনা এসব বিষয় থাকত। ধর্ম্মস্থীয়তে প্রধানত জরিমানা বা অন্য কোন লঘু দণ্ড দেবার নিয়ম ছিল, এই আদালত প্রাণদণ্ডের মত কঠিন শাস্তি দিতে পারত না।

গুরুতর অপরাধের বিচার ‘কন্টকশোধন’এ করা হত। এখানেও রাজদরবার থেকে তিনজন বিচারক নিয়োগ পেতেন, এদের বলা হত ‘প্রদেষ্টা’। কন্টকশোধন আদালতের বিচারের এক্তিয়ার আর কাজগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—বণিক ও শিল্পীদের স্বার্থসংক্রান্ত বিষয়, দেশদ্রোহ সমাজদ্রোহ ইত্যাদি, গুপ্তচর নিয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের খুঁজে বের করা, দুর্বৃত্ত দমন, বড় ধরনের লুটপাট ও ডাকাতির মত বিষয়, সাক্ষীদের জেরা, ‘আশুমৃতক’ বা মৃতদেহ পরীক্ষা, অবৈধ সহবাস সংক্রান্ত মামলা, সরকারি বিভিন্ন বিভাগের দুর্নীতি দমন, দণ্ড মকুব বা দণ্ড সংক্ষেপ করা ইত্যাদি । কন্টকশোধনে গুরুতর জরিমানা, অঙ্গচ্ছেদ বা দৈহিক সাজা এমনকি প্রাণদণ্ডও হতে পারত। সঠিক অপরাধীকে চিহ্নিত করতে এই আদালত মৃতদেহ পরীক্ষার (আজকের সুরতহাল তদন্ত) আদেশ পর্যন্ত জারি করতে পারতো, যাকে প্রাচীন ভারতের বিচারব্যবস্থার এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি ধর্ম্মাস্থীয় এবং কন্টকশোধনের বিচারে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চতর আদালতে পুনর্বিচার চাইতে পারতেন। এসব উচ্চতর আদালত—যাকে ‘সর্বোচ্চ ধর্ম্মাধিকরণ’ বলা হত—এর বিচারক থাকতেন স্বয়ং রাজা অথবা তার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ অমাত্যবৃন্দ এবং বহুশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা। সর্বোচ্চ ধর্ম্মাধিকরণের পীঠ সাম্রাজ্যের বিশেষ কয়েকটি জায়গায় থাকতো যাতে বিচারপ্রার্থীর সুবিধা হয়। কোথায় কোথায় এর পীঠ স্থাপিত হবে তার নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল:

 (ক) ‘সংগ্রহণ’ অর্থাৎ পাশাপাশি অনেকগুলি গ্রামের কেন্দ্র যে নগর সেখানে

 (খ) ‘দ্রোণমুখ’ অর্থাৎ চার’শ গ্রামের কেন্দ্র হিসেবে যে নগর কাজ করত সেখানে

 (গ) ‘স্থানীয়’ অর্থাৎ আট’শ গ্রামের কেন্দ্র হিসেবে যে নগর কাজ করত সেখানে

 (ঘ) ‘জনপদসন্ধি’ অর্থাৎ দুটি প্রদেশের মধ্যবর্তী স্থানে এবং

 (ঙ) অবশ্যই দেশের রাজধানীতে।

আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগেকার ভারতীয় আদালতগুলি ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে আইনের চারটি স্তম্ভ বা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রায়দান করত—

(১) ধর্ম্ম— বিচারের প্রথম ভিত্তি ছিল ধর্মশাস্ত্রের বিধান। শাস্ত্রীয় বিধান ছিল বিচার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোন মোকদ্দমার রায়দানের আগে সে সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র ও সংহিতার বিধান খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তার ভিত্তিতে মামলার নিষ্পত্তি করা হত।

(২) ব্যবহার— ব্যবহারের বিভিন্ন অংশ ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল চুক্তিপত্র। বাদী ও বিবাদী পক্ষের মধ্যে হওয়া বিভিন্ন ধরণের চুক্তি বা উভয় পক্ষের সম্মতিতে  একে অপরকে করা অঙ্গীকার এবং যে চুক্তি ‘নিয়ম’ মেনে করা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে রায়দান করা হত। কি ধরণের নিয়ম মেনে কোন চুক্তি করতে হত তা পরে বিশদে আলোচনা করা যাবে।

(৩) চরিত্র— এর অর্থ প্রচলিত সামাজিক রীতি। যেসব মামলায় ‘ধর্ম্ম’ ও ‘ব্যবহার’ এর কোন ভূমিকা নেই সেসব ক্ষেত্রে প্রচলিত ও চিরাচরিত সামাজিক রীতিনীতিকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরে মামলার বিচার করা হত।

(৪) রাজশাসন— রাজার তৈরি নিয়ম, আদেশ বা রাজকীয় নির্দেশনামাকে ‘রাজশাসন’ বলা হত। এটি ছিল ন্যায়বিচারের শেষ অস্ত্র। আগের তিনটি ভিত্তি অর্থাৎ ‘ধর্ম্ম’, ‘ব্যবহার’ ও ‘চরিত্র’এর যদি কোন মোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতা না থাকত, তখন সেই সেই বিষয়ে কোন রাজকীয় অনুজ্ঞা বা আদেশ আছে কিনা খতিয়ে দেখে তাকে ভিত্তি করে বিচার চালানো হত।

কোন মামলার বিচারের ক্ষেত্রে যদি উপরের কোন একাধিক ভিত্তি কার্যকর থাকত এবং তাদের মধ্যে কোন প্রসঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হবার সম্ভাবনা দেখা দিত, তবে ক্রম অনুসারে যে ভিত্তিটি আগে আসবে তার গুরুত্ব বেশি হবে। এ সংক্রান্ত শ্লোকটি হল—

“ধর্ম্মশ্চ ব্যবহারশ্চ চরিত্রং রাজশাসনম্।

বিবাদার্থশ্চতুষ্পাদঃ পশ্চিমঃ পূর্ব্ববাধকঃ”।।

অর্থাৎ রায়দানের ক্ষেত্রে কোন দুটি ভিত্তির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে পশ্চিমদিকের ভিত্তি বা আগের ক্রমিক সংখ্যার ভিত্তি রায়দানের জন্য বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।

কোন মোকদ্দমা বিচারের জন্য আদালতে উপস্থাপিত হলে প্রথমেই আদালতের মুহুরি বা করণিক নিচের বিবরণগুলি লিখে  নিতেন—

(ক) ঘটনার তারিখ—এক্ষেত্রে বছর, ঋতু, মাস, পক্ষ ও দিনের হিসেব নেওয়া হত।

(খ) কি ধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে

(গ) অকুস্থল বা ঘটনাস্থল কোথায়

(ঘ) যদি অর্থ সংক্রান্ত মোকদ্দমায় কোন ঋণ করা হয়ে থাকে তার পরিমাণ

(ঙ) বাদী ও বিবাদীর নাম, জাতি, গোত্র, তাদের পেশা ও বসবাসের ঠিকানা

(চ) সবশেষে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের জবানবন্দি।

বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষী এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল। ব্রাহ্মণ, জলপাত্র এবং অগ্নি স্পর্শ করে সত্য কথা বলার অঙ্গীকার করে সাক্ষীকে তার জাতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন শপথ বাক্য পাঠ করতে হত।

ব্রাহ্মণ সাক্ষীকে “সত্যং ব্রুহীতি” বলতে বলা হত, অর্থাৎ সে বলত সত্য কথা বলব। ব্রাহ্মণ হওয়ার সুবাদে শুধুমাত্র এটুকু বলেই সে নিস্তার পেত।

ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সাক্ষীর শপথ একটু জটিল। সে বলত, “মা তবেষ্টা পূর্ত্তফলং কপালহস্তশ্ শত্রুবলং ভিক্ষার্থী গচ্ছে রিতি”। অর্থাৎ যদি মিথ্যা কথা বলি, আমার কামনা কখনো পূর্ণ হবে না। ভিক্ষাপাত্রের বদলে নরকরোটি হাতে শত্রুর কাছে আমাকে ভিক্ষা করতে যেতে হবে।

শূদ্র সাক্ষীর শপথ আবার অন্যরকম। সে এরকম হলপ করতো—  “মরনান্তরে যদ্বঃ পুণ্যফলং তদ্রাজানং গচ্ছেৎ। রাজ্ঞশ্চ কিল্বিষং যুষ্মান্ অন্যথাবাদে দণ্ডশ্চানুবন্ধঃ। পশ্চাদপি জ্ঞায়েত যথাদৃষ্টশ্রুতম্”।।  [ঋণদানম্, ৩য় ভাগ]

এর অর্থ করলে দাঁড়ায়,– যদি মিথ্যা কথা বলি, আমার সমস্ত পুণ্য রাজার এবং রাজার সব পাপ আমার হবে। মিথ্যা সাক্ষী দিলে আমি শাস্তি পাব। যা আমি দেখেছি ও শুনেছি তা আদ্যোপান্ত আদালতকে জানাব।

কাছাকাছি উপস্থিত সাক্ষীদের বিচারপ্রার্থীরা নিজেরাই আদালতে হাজির করাতে পারত। তবে দূর প্রবাসী বা আদালতে আসতে না চাওয়া সাক্ষীদের জন্য ‘স্বামিবাক্য’ বা সমন জারি করার ব্যবস্থা ছিল।

যে বা যারা মোকদ্দমায় হেরে যেত, তাদেরকে সাক্ষীদের খরচাপাতি বইতে হত। ‘পুরুষভৃতি বা আহার খরচ নামে একধরণের খরচের কথা জানা যায়। সাক্ষীদের জন্য আটদফা খাবার বরাদ্দ থাকত, তবে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। এছাড়া যাতায়াত বা রাহাখরচও সাক্ষীদের দেওয়া হত।

মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে সাক্ষীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মোকদ্দমার সাক্ষী হতে গেলে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের ‘অনুমত’ ও ‘প্রাত্যয়িকা’ বা ‘শুচয়ঃ’ অর্থাৎ উভয়পক্ষের অনুমোদিত, বিশ্বাসযোগ্য হওয়া, সেই সঙ্গে চরিত্রবান হওয়াও আবশ্যিক ছিল।

“প্রাত্যয়িকাংশশুচয়োহনুমতা। বা ত্রয়োহবরার্য্যাঃ। পক্ষানুমতৌ বা দ্বৌ ঋণং প্রতি প ত্বেবৈকঃ।।

কারা সাক্ষী হতে পারবে না তার তালিকা দেখে বোঝা যায় সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যাপারে আদালতগুলির সংবেদনশীলতা কতটা—

বাদী বা বিবাদীর শ্যালক, অনুচর, খাতক, মহাজন, বন্দি, শত্রু, পরনির্ভরশীল ব্যক্তি, শাস্তি পাওয়া অপরাধী– এদের সাক্ষী হওয়ার অধিকার ছিল না। এছাড়া খুব আবশ্যিক না হলে বা স্বজাতীয়দের মধ্যে মামলা না হলে যাদের কাউকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা যেত না—

রাজা, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, স্ত্রীলোক এবং রাজপুরুষ, অনাথ, দরিদ্র, কুষ্ঠ রোগী বা অন্য ছোঁয়াচে রোগ আছে এমন ব্যক্তি, পতিত, চণ্ডাল, নীচ বৃত্তি অবলম্বনকারী ব্যক্তি, নিজের মতকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে এমন ব্যক্তি।  

মারামারি, চুরি এবং বলাৎকার সংক্রান্ত মামলায় শত্রু, শ্যালক আর অপরাধের সহায়ক ছাড়া যেকেউ সাক্ষী হতে পারত। একমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত অনুসন্ধানে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সাক্ষ্যদানের অধিকারী ছিল।

আর্থিক মোকদ্দমাগুলির ক্ষেত্রে ধর্ম্মাস্থীয়তে সাক্ষীকে জেরা করে যদি জানা যেত বাদীপক্ষ যে পরিমাণ অর্থের দাবি করছে, প্রকৃত  অর্থের পরিমাণ তার থেকে কম, তাহলে অবশিষ্ট টাকা রাজকোষে জমা রেখে বিচার চলত, বিচারে সাক্ষীর দাবী প্রমাণিত হলে অতিরিক্ত টাকা রাজসরকার বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারত।

একাধিক সাক্ষীদের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী হলে ‘অনুমত’ ও ‘শুচয়ঃ’ সাক্ষীদের বক্তব্য অগ্রাধিকার পেত। তবে অন্য কোন সূত্র পাওয়া গেলে তার ভিত্তিতে আদালতের রায় বদলে যাওয়াও সম্ভব ছিল। আর যদি এমন পরিস্থিতি হত যে, কোন সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না, সাক্ষীরাও ভিন্ন বক্তব্য পেশ করছে, চেষ্টা করেও সমাধানে আসা যাচ্ছে না, তবে বিবাদ কোন স্থাবর বস্তু নিয়ে হলে তা রাজসরকার বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারত।

অনুমত, প্রাত্যয়িকা ও শুচয়ঃ সাক্ষী ছাড়াও যদি মামলার প্রতিপক্ষ পিতা-পুত্র, গুরু-শিষ্য, প্রভু-ভৃত্য হত তবে প্রথম পক্ষের কথা বেশি গুরুত্ব পেত। অর্থাৎ বাবা, গুরু ও প্রভুর কথার গুরুত্ব ছেলে, শিষ্য বা চাকরের তুলনায় বেশি হবে।  

বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়, আদালত কিন্তু শুধুমাত্র সাক্ষীদের জবানবন্দির উপর নির্ভর করত না, গোপনে তথ্যসংগ্রহের জন্য আদালত গুপ্তচরও নিয়োগ করার অধিকারী ছিল। সাক্ষীরা পরস্পরবিরোধী জবানবন্দি দিলে বা জটিল মামলার বিচারের ক্ষেত্রে গুপ্তচরদের খবরের উপর বিচারকেরা অনেকটাই নির্ভর করতেন।

আদালতে মামলা উঠলে বিচারপ্রার্থীদের সচেতন থাকতে হত যাতে ‘পরোক্তদোষ’ না ঘটে। পরোক্তদোষের মধ্যে যেসব বিষয়গুলিকে গণ্য করা হত সেগুলি হল—

(১) বিচার্য বিষয় ছাড়া অন্য বিষয় আলোচনা করা যাবে না।

(২) আগের দেওয়া জবানবন্দি প্রত্যাহার বা অস্বীকার করা যাবে না।

(৩) মামলায় এমন কোন তৃতীয় পক্ষ—যার মতামতের কোন গুরুত্ব নেই, তার মতকে গ্রাহ্য করার জন্য জিদ করা যাবে না।

এছাড়াও অন্যান্য পরোক্তদোষগুলি হল,

(৪) আদালতের আদেশ সত্ত্বেও কোন প্রশ্নের উত্তর শেষ না করা

(৫) বিচার্য বিষয়ে প্রশ্নোত্তরের বাইরে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন

(৬) নিজ পক্ষের সাক্ষীর কোন সাক্ষ্য গ্রহণে অসম্মতি

(৭) আদালতের অনুমতি না নিয়ে সাক্ষীদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ করা।

আরও বেশ কিছু বিষয় পরোক্তদোষ হিসেবে গণ্য হত। বিবাদীর জবাবদিহির দিনই বাদীকে প্রত্যুত্তর দিতে হত। না পারলে বাদীর পরোক্তদোষ ঘটত। তবে বিবাদীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রয়োজনে তিন রাত বা সাত রাত সময় দেওয়া হত। এর মধ্যে সে যদি আত্মপক্ষ সমর্থন না করতে পারত তবে তার তিন পণ থেকে বারো পণ পর্যন্ত জরিমানা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে আদালত জরিমানার সিদ্ধান্ত জানাত।  তিন পক্ষকালের মধ্যেও যদি বিবাদী অভিযোগের সদুত্তর দিতে না পারত তবে সে পরোক্তদোষে দোষী হত। সেক্ষেত্রে বাদী তাকে দিয়ে যেকোনো কাজ করিয়ে নিতে পারত বা বিবাদীর সম্পত্তি থেকে দাবিমত টাকা আদায় করার অধিকার পেত। আবার বাদীর ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সময়ে তার অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে তারও পরোক্তদোষ ঘটত। আদালতের নজরদারি এসব ব্যাপারে বেশ কড়া ছিল।  

খুব গুরুত্বপূর্ণ যেটা— এক অপরাধের জন্য কারো বিরুদ্ধে একবারের বেশি অভিযোগ করা যেত না। আবার দাঙ্গা হাঙ্গামা, জবরদস্তি সম্পদ হরণ বা বণিকদের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবাদ ছাড়া কোন মোকদ্দমায় বিবাদী পক্ষ পালটা মোকদ্দমা দায়ের করতে পারত না।

কোন মামলা বিচারের ক্ষেত্রে বাদী ও বিবাদীর মুখে ঘটনার বর্ণনা, সংশ্লিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ, বিভিন্ন ব্যক্তিকে জেরা, সাক্ষীদের জবানবন্দি, প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান ও গুপ্তচরদের খবরের উপর ভিত্তি করে রায়দান হত।

প্রাচীন ভারতের আদালতগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, স্বয়ং বিচারকেরাও বিচারের আওতায় থাকতেন। পক্ষপাত না করে, বিশেষ অনুসন্ধান ও যত্ন সহকারে তাদের বিচারের কাজ চালানো বাঞ্ছনীয় ছিল। বিচারকদের মধ্যে অসাধু মনোবৃত্তি, পক্ষপাত দোষ, কর্তব্য বিচ্যুতি, বিচারপ্রার্থীর সাথে রূঢ় ব্যবহার ইত্যাদি লক্ষ্য করা গেলে তাদেরও বিভিন্ন ধরণের অর্থদণ্ড এমনকি পদচ্যুতির সম্ভাবনা ছিল। তবে বিচারকদের বিচারের অধিকার কার ছিল সে সম্বন্ধে অস্পষ্ট যে ধারণা পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় স্বয়ং রাজা বা সহযোগী বিচারপতিরাই তার বিচার করতেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতাকেও প্রয়োজন কাঁদতে হত।

এবারে আলোচনা করা যাক বিচারপ্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ভিত্তি ‘ব্যবহার’ এর উপর। ‘ব্যবহার’ অর্থাৎ দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত কোন চুক্তি। চুক্তিগুলিকে বৈধ হতে গেলে চুক্তিকারীদের বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হত, নয়তো সেসব চুক্তি আদালত মাধ্যমে অবৈধ বলে ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

(ক) চুক্তির ধারাগুলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

(খ) চুক্তি প্রকাশ্য স্থানে ও দিনের আলোয় সম্পাদিত হতে হবে।

(গ) চুক্তিপত্র সাক্ষীদের সামনে সই সাবুদ হতে হবে।

(ঘ) কোনভাবেই রাজার স্বার্থ বা রাজাদেশ বিরোধী কোন চুক্তি করা যাবে না।

(ঙ) রাজা বা আদালত নিযুক্ত গুপ্তচর ছাড়া বাকি সকলের জন্যই প্রতারণামূলক চুক্তি অসিদ্ধ।

কোন কোন উপলক্ষে বৈধ চুক্তিগুলি সম্পাদিত হতে পারতো সেদিকে নজর দেওয়া যাক—

(১) ঋণদান  (২) কোন কিছু কেনাবেচা  (৩) ‘নিক্ষেপ’ (প্রকাশ্যে কারো কাছে কোন কিছু গচ্ছিত রাখা)  (৪) ‘উপনিধি’ (সুরক্ষিত ও সিলমোহরের ছাপ দেওয়া অবস্থায় কোন কিছু গচ্ছিত রাখা)  (৫) বন্ধক রাখা  (৬) ভাড়া দেওয়া  (৭) সমবায় সংক্রান্ত বিষয়  (৮) চাকরিতে বা কোন কাজে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় বা  (৯) অন্যান্য আবশ্যক চুক্তি।

কেনাবেচা সংক্রান্ত কিছু নিয়ম উল্লেখ না করলেই নয়। যদি কোন ব্যক্তি তার স্থাবর সম্পত্তি অর্থাৎ চাষের জমি, বাগান, ঘেরা জায়গা বা জলাশয় ইত্যাদি বিক্রি করতে চায় তবে তাকে সবার আগে নিজের জ্ঞাতিদের কাছে প্রস্তাব দিতে হবে। তারা রাজি না হলে প্রতিবেশীরা অগ্রাধিকার পাবে। তারাও আগ্রহী না হলে ‘ধনিকা’ বা মহাজনদের কাছে বিক্রির প্রস্তাব করা যেতে পারে। বিক্রির ঘোষণা অন্তত চল্লিশ ঘর লোকের সামনে করা বাঞ্ছনীয় ছিল। তারপর আজকের দিনের নিলামের মত ‘প্রতিক্রোষ্টা’ বা ঘোষক নির্দিষ্ট দাম ঘোষণা করে ক্রেতাদের আহ্বান করতেন। যদি কোন শরিকি আপত্তি বা সম্পত্তি বিবাদ জনিত আপত্তি না থাকে তবে ক্রেতা সকলের সামনে নির্দিষ্ট মূল্যে সম্পত্তিটি খরিদ করবেন। বিক্রয়কর বাবদ টাকা আদায় করে প্রতিক্রোষ্টা রাজকোষে জমা দিতেন। কর ফাঁকিতে চব্বিশ পণ জরিমানা হত। বিক্রির সাত দিনের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তর করা আবশ্যক ছিল।

অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে বিক্রি করতে রাজি হয়েও পিছিয়ে এলে বারো পণ জরিমানা হত। আবার সঠিক কারণ থাকলে বিক্রি সংক্রান্ত চুক্তি প্রত্যাহার করাও যেত। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা এক রাত্রি, চাষিরা তিন রাত্রি, গোয়ালারা পাঁচ রাত্রি ও খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিক্রেতারা সাত রাত্রি সময় পেত। কেনার পরেও সঠিক কারণ ছাড়া জিনিস নিতে বা দাম দিতে অস্বীকার করলে ক্রেতার বারো পণ জরিমানা হত।

এবারে আদালত বা রাজসরকার যেসব গুপ্তচরদের নিয়োগ করত, তদন্ত চালানোর ক্ষেত্রে তাদের কী ভূমিকা ছিল তার কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। কোন ‘নিক্ষেপ’ বা ‘উপনিধি’ অর্থাৎ কারো কাছে গচ্ছিত রাখা কোন সম্পদ সে ফেরত দিতে অস্বীকার করলে আদালত নিযুক্ত চর বৃদ্ধ বা রুগ্ন বণিকের ছদ্মবেশে সেই ব্যক্তির কাছে গিয়ে দীর্ঘ বনপথে হেঁটে আসা, দস্যুর ভয় ইত্যাদি অজুহাতে কিছু জিনিস তার কাছে রেখে আসতো। পরে সেই বণিকের ভাই বা সন্তান সেজে গিয়ে সেসব জিনিস যদি ফেরত পাওয়া যায়, তবে সন্দেহভাজনের সততা প্রমাণিত হবে। অন্যথায় গচ্ছিত সম্পদ অপহরণের অভিযোগে প্রতারক উপযুক্ত শাস্তি পাবে।

আবার এমনও হতে পারে, প্রতারণায় অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে অভিযোগকারী দেখা করতে গেল, কাছাকাছি আত্মগোপন করে রইল গুপ্তচরেরা। এবারে অভিযোগকারী কথার জালে প্রতারককে জড়িয়ে ফেলে তার মুখ থেকে সত্য কথা বের করে ফেলল। গুপ্তচরেরা তা শুনে আদালতে সাক্ষ্য দিলেই মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।

আজ থেকে প্রায় আড়াই বা দুই হাজার বছর আগেকার প্রাচীন ভারতের আধুনিক বিচার ব্যবস্থা সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা দেখে হতবাক হতে হয়। হিন্দু দণ্ডসংহিতা গুলিকে বিশ্লেষণ করলে জটিল ভাবে বিন্যস্ত বহুধা বিভক্ত বিচার পদ্ধতির হদিস মেলে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সঠিক অপরাধীকে চিহ্নিত করে নাগরিকদের সুবিচার দেওয়া। অন্যায় ও দুর্নীতি হয়তো ছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তোবা নিরপরাধ নাগরিক শাস্তিও পেত তবে এই দণ্ডসংহিতায় যে বিষয়গুলি আজও নজর কাড়ে তার মধ্যে অন্যতম হল—স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের যুগেও রাজাদেশকে বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বের দিক থেকে সবার শেষে রাখা। মনে রাখতে হবে আমরা আলোচনা করছি আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে শুরু হওয়া এবং বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এক দণ্ডসংহিতার প্রসঙ্গ, যে পদ্ধতিটির সৃষ্টি, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়েছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। আজকের সময়ের বিচারে বেশ কিছু নিয়মনীতি অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও তাই সময়ের কষ্টিপাথরে পরখ করে প্রাচীন ভারতীয় আইনি ও বিচার ব্যবস্থাকে সম্মান জানাতেই হয়। একালের সময় খেলাপি ন্যায়ালয় আর ন্যায়বিচারের অপব্যবহারের যুগে তাই হাজারো বছর আগেকার গড়ে ওঠা ন্যায়সংহিতা যেন এক বিষাদমুক্তির ঘোষণাপত্র।

তথ্যসূত্র:

ডঃ নরেন্দ্রনাথ লাহা. অনুবাদ শ্রী কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্ত. সম্পাদনা তরুণ মুখোপাধ্যায়. প্রাচীন হিন্দু দণ্ডনীতি (প্রথম ভাগ). তুহিনা প্রকাশনী, কলকাতা

Dr. Radhagovinda Basak. The Arthasastra of Kautilya (Vol.II) অনুবাদ ডঃ রাধাগোবিন্দ বসাক কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র(দ্বিতীয় খণ্ড). জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যান্ড পাব্লিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা

শ্রী যোগেন্দ্রনাথ তর্ক-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ. প্রাচীন ভারতের দণ্ডনীতি. কলিকাতা ওরিয়েন্টাল প্রেস লিঃ, কলিকাতা

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।