জালিয়াঁওয়ালা বাগের জার্নাল
(বইয়ের নাম: জালিয়াঁওয়ালা বাগের জার্নাল; লেখক: শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত; প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং; প্রকাশ সাল: ২০২২)
আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে কলেজে পড়াতে গিয়ে পাঞ্জাবের কৃষির অর্থনৈতিক বিবর্তন আলোচনার একটি বিষয়বস্তু ছিল। সেখানে কী করে গ্রামাঞ্চলে ক্যানেলের জল গেল, বন্ধ্যা মরুভূমি আধুনিক কৃষিযোগ্য ভূমিতে পরিণত হলো, দূর দূর থেকে কৃষকরা ছুটে এলো এবং সেই জমি চাষ করে বহু সোনার ফসল ফলালো—এগুলো আলোচনার বিষয় ছিল। এই অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের পাশাপাশি আরেকটা ছবি মনে পড়ে যেটা ক্লাসে বলতাম। কৃষি ঋণটা একটা ভীষণ উদ্বেগের কারণ হয়ে গেল যার ফলে অনেক কৃষক ঘটিবাটি, নিজের জমিজায়গা বন্ধক রেখে অথবা বেচে দিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল বা সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে হংকং, মালয় এমনকী ফ্রান্সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেল। যুদ্ধ শেষ হলো ১৯১৮-এ। যখন তারা ফিরে এলো তখন চাকরি চলে গেছে, বরখাস্ত হয়ে গেছে সেনাবাহিনী থেকে, ফলে তারা বিক্ষুব্ধ। তখন জিনিসপত্রের দাম প্রচণ্ড বাড়ছে, দুর্মূল্য বাজার, বাড়িতে অশান্তি, চারদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বাতাবরণ গড়ে উঠেছে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। এটা নতুন নয়। এর আগে ১৯০৭ সালে চেনাব কলোনিতে যারা একসময় সবচেয়ে বেশি ইংরেজ সরকারের অনুগত ছিল, তারা বলে উঠলো যে ইংরেজ সরকার অত্যাচার করছে এবং তখন ভগৎ সিং-এর কাকা অজিত সিং নেতৃত্ব দিলেন, লালা লাজপৎ রাই নেতৃত্ব দিলেন। তখন একটা নতুন শ্লোগান উঠেছিল ‘পাগড়ি সামাল ও জাঠঠা’ অর্থাৎ ‘তুমি সাবধান হও, প্রতিরোধের দিন এসে গেছে’।
সেই ১৯০৭-এর বিদ্রোহ কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজরা বাধ্য হয়ে দমন করল খানিকটা নরমগরম নীতি দেখিয়ে। কিন্তু সেই বিদ্রোহের রেশটা থেকে গেল। ১৯১৯-এ রাওলাট সত্যাগ্রহ শুরু হয়। আইন অমান্য আন্দোলনের হাওয়া তখনও ওঠেনি কিন্তু পাঞ্জাবের কৃষকরা আকালি আন্দোলনে যোগ দেবে কিনা সে নিয়ে একটা চিন্তাভাবনা চলছিল। একসময় অবশ্য তারা গান্ধীজীর মতে মত দিয়ে অহিংস নেতৃত্ব শুরু করল এবং কংগ্রেসের সমান্তরালভাবে নিজস্ব কমিউনিটি আইডেন্টিটি বজায় রেখে তারা আন্দোলন চালাতে লাগল। এইরকম প্রেক্ষিতে যখন পাঞ্জাবের রাজনৈতিক হাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন এপ্রিল মাস। মনে রাখতে হবে পাঞ্জাবে তখন বৈশাখের আবহাওয়া এসে গেছে। উৎসবের মধ্যে এই উত্তপ্ত আবহাওয়ায় ডায়ারের নির্দেশে গুলি চলল, মারা গেলেন প্রচুর লোক এবং সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদে হলো। আমরা শুধু এইটুকুই জানতাম। কিন্তু ‘জালিয়াঁওয়ালা বাগের জার্নাল’ বইটি আমাদের নতুন ইতিহাসের সন্ধান দিল যে ইতিহাস পথচলতি, যে ইতিহাস অনেকের দেওয়া, যে ইতিহাসে অশ্রুত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, এবং যে ইতিহাস পুরুষকেন্দ্রিক নয়। তার ইতিহাস রচনার ভঙ্গিটিও ভিন্ন ধরনের কারণ আলোচ্য বইটি দিনলিপির আঙ্গিকে লেখা।
লেখক মহাফেজখানাতে গিয়েছেন, দলিল দস্তাবেজের ওপর নজর রেখেছেন কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক উপাদানের সংগ্রহ করে ইতিহাসকে তিনি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। সেই উপাদানগুলির মধ্যে আছে সাহিত্য, সংগীত, ছবি, চিঠিপত্র, জীবনী/স্মৃতিকথা এবং স্থানীয় মৌখিক আখ্যান। বইটি লেখার দু-বছর আগে তিনি একটা নতুন জিনিস, যাকে আমরা বলি পাবলিক হিস্ট্রি, সেই পাবলিক হিস্ট্রিকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শিল্পী সঞ্চয়ন ঘোষের সঙ্গে যৌথভাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সহায়তায়। রানির প্রাসাদে জালিয়াঁওয়ালা বাগকে কেন্দ্র করে সেটা ছিল এক অভূতপূর্ব প্রতিস্পর্ধী বয়ান। ভিক্টোরিয়ায় কীভাবে নির্মিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক রীতি ভেঙ্গে জালিয়াঁওয়ালা বাগ নিয়ে একটি ইন্সটলেশন-প্রদর্শনী, বইটি পড়লে তা অনুভব করা যায়। এই নির্মাণে যাঁরা তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পথ-চলার গল্প লেখা ও অনেক ছবির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে।
এই বইয়ে লেখক এমন কিছু দিকের উল্লেখ করেছেন যেগুলো জালিয়াঁওয়ালা বাগ নিয়ে মূলস্রোতের ইতিহাস রচনায় কখনো স্থান পায়নি আগে, যেমন অমৃতসরের মানুষদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্মৃতিকথন। শুধু একশ বছর আগের ইতিহাস নয়, এই বইয়ে ইতিহাসের একটা চলমান গতি আছে যেখানে বারবার লেখক সমকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ, রাষ্ট্রিক চেহারার সঙ্গে তখনকার রাষ্ট্রিক রূপের সাদৃশ্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই সমকালের যে সমস্ত চিত্রশিল্পীরা ছবি এঁকেছেন কাশ্মীরের মানুষদের নিয়ে অথবা বাংলাদেশের যেসব ছায়াছবিতে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষদের কথা শোনা যায়, সেগুলো আলোচনা প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন।
তিনি পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাসের প্রতি একটু কড়া নজর হেনেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের কীভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে, এমনকি সরলা দেবী চৌধুরানীর মত ব্যক্তিত্বকে কীভাবে দেখা হয়েছে জালিয়াঁওয়ালা বাগের ইতিহাসে তার আলোচনা রয়েছে। সমুদ্র মন্থন করে ইতিহাসে উপেক্ষিতা কয়েকজন সাধারণ মহিলার কথা বইটি তুলে ধরেছে আমাদের সামনে।
আমাদের মত সাধারণ বাঙালিরা জানি যে রবীন্দ্রনাথ জালিয়াঁওয়ালা বাগের পর নাইট উপাধি পরিত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর নিজস্ব ভাষায় প্রতিবাদপত্র পেশ করে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের দেওয়া ওই সম্মান থেকে। এই প্রসঙ্গে লেখক দেশে-বিদেশে অনেককে লেখা রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো চিঠিপত্রের কথা এনেছেন যেগুলো নানা মহাফেজখানায় ছড়িয়ে রয়েছে। এটাও আমার জানা ছিল না যে জালিয়াঁওয়ালা বাগে যে স্মারকটি গড়ে তোলা হয়েছিল পরবর্তীকালে, সে সম্পর্কে ১৯২০ সালে গান্ধীর আনা প্রস্তাব রবীন্দ্রনাথের মনঃপূত ছিল না। তিনি চাননি এরকম একটি রাষ্ট্রিক অত্যাচারের প্রতিবাদ ঠিক ইউরোপের স্মারকসৌধের ধাঁচে গড়ে উঠুক। রবীন্দ্রচিন্তার এই দিকটা নিয়ে লেখক বিশদে জরুরি আলোচনা করেছেন।
এই বইটা পড়তে গিয়ে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে, যে এই ইতিহাস যেন দূরের কোনও বিষয় নয়, এ যেন আমাদের অতি আপন। ইতিহাস এখানে অতীত এবং বর্তমান, দুই সহোদর ভাইয়ের মতো একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। লেখক আমাদের নতুন পথ দেখিয়েছেন। ইতিহাস কী করে লিখতে হয় এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষের কাছে কীভাবে পৌঁছোনো যায়, এই বইটির পাঠ আমাদের তা নিয়েও ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।
dhanyabad parno nischaya
সত্যি কথা বলতে জালিয়ানওয়ালা ভাগ এর ইতিহাস আমাদের কাছে একটু ধোঁয়াশার মত। পরিস্কার বোঝা যায় না এর ব্যাকগ্ৰাউন্ড এবং এর চলমান দিকগুলো।এই রিভিউ তে কিন্তু অনেক কিছু ইংগিত পাওয়ার আশা জাগায়। মনে হচ্ছে অবশ্য পাঠ্য।