সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

জব চার্নক কি কলকাতায় পা রাখা প্রথম বিদেশি?

জব চার্নক কি কলকাতায় পা রাখা প্রথম বিদেশি?

তিলক পুরকায়স্থ

অক্টোবর ৩১, ২০২০ ১৮১৯ 3

অনেক উচ্চাশা এবং স্বপ্ন নিয়ে ইংরেজ বণিক জব চার্নক এদেশে আসেন ১৬৫৮ সালে, ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে একথা আমরা সবাই পড়েছিলাম। বহুদিন তিনি ভারতের মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সাধারণ কর্মচারী হিসাবে। ১৬৮৬/৯০ সালে শুরু হয় কোম্পানির সঙ্গে মুঘলদের ধুন্ধুমার লড়াই। প্রাণ হাতে নিয়ে কোম্পানির লোকজন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি তে পলায়ন করে। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া তো ইংরেজদের রক্তে নেই। তাই ইতিহাসে দেখতে পাই আবার সেই মুঘলদেরই খুশি করে কোম্পানির কুঠি তৈরি হয় সুতানুটিতে ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগস্ট। চার্নক তখন কোম্পানির সর্বেসর্বা। তবে ব্যক্তিগত ভাবে চার্নক আদৌ খারাপ লোক ছিলেন না। নইলে কি সতীদাহের চিতা থেকে এদেশীয় মেয়েকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, নিজেরও তো প্রাণ সংশয় হতে পারত, ধর্ম- উন্মাদ ব্যক্তিদের হাতে। শুধু উদ্ধার করাই নয়, হিন্দুরা যখন সেই মেয়েকে ঘরে নিয়ে যেতে অস্বীকার করে তখন তাকে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে নাম দেন ‘মারিয়া’, এবং একেই বিয়ে করেন। এতবড় ঔদার্য তখন দেখানো সহজ কথা ছিল না।

মারিয়ার গর্ভেই তাঁর চার কন্যার জন্ম হয়, যাদের প্রত্যেককে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে বিয়ে দেন। জব চার্নক দেহত্যাগ করলেন এই কলকাতাতেই ১০ জানুয়ারি, ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে। জব চার্নকের পরে গভর্নর হন জনৈক ফ্রান্সিস এলিস। এর পরের গভর্নর হন জব চার্নকের  এক জামাতা ক্যাপ্টেন চার্লস আয়ার- ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর, কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর নামক তিনটি গ্রামের প্রজাস্বত্ব খরিদ করেন, সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের কাছ থেকে। অর্থাৎ টেকনিক্যালি এই দিনটিতেই ভবিষ্যতের কলকাতা শহরের পত্তন হয়। তাই আমরা যাঁরা চিরকালীন ইংরেজ ভক্ত, তাঁরা মনে করি আধুনিক Calcutta City-র প্রচলন হয়েছিল প্রথমে জব চার্নক এবং পরে তাঁর জামাতা চার্লস আয়ারের হাত ধরে এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য।

সেসব তো ঠিক আছে, কিন্তু আর্মেনিয়ান গির্জার চত্বরে একটা টম্ব স্টোনের আবিষ্কার তো পুরো ব্যাপারটাকে ঘেঁটে দিল। ১৮৯৪ সালে আবিষ্কার হয় এক আর্মেনিয়ান মহিলা রেজা বিবির অতি প্রাচীন সমাধি ফলক, আবিষ্কারকর্তা জনৈক মেসরোভ জ্যাকব সেথ। কবরের লিপি আর্মেনিয়ান ভাষায় লেখা, তার ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে – This is the tomb of Rezabeebeh the wife of the Late charitable sookias who departed from this world to life eternal on the 11th July, 1630. (মেসরোভ জ্যাকব সেথ এর আর্মেনিয়া থেকে ইংরেজি অনুবাদে নির্ধারণ করেছিলেন তারিখটি 1630 এর 21 st July)।

অর্থাৎ 1630-এ রেজাবিবি মারা গেছেন এই কলকাতায়, তাঁর আগে বা পরে তাঁর দানবীর স্বামী সুকিয়া ও নিশ্চয়ই এই শহরের কোথাও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, তাহলে সুতানুটিতে ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগস্ট কুঠি তৈরি করে, ইংরেজ এবং জব চার্নক Calcutta-র প্রথম বিদেশি দাদা হলেন কিভাবে? ইংরেজ আসার বহু আগেই তো আর্মেনিয়ানরা কলকাতা এবং বাংলায় এসে গেছেন, দেখতে পাচ্ছি। অবশ্যই ব্যবসায়িক কারণেই হবে, কিন্তু ইতিহাস তাঁদের ভুলে গেল কিভাবে! কারণ ইংরেজরা এসেছিল লুটতে, তাই পদে পদে তাঁদের সঙ্গে মোগল থেকে বাংলার নবাবদের  স্বার্থের সংঘাত বেঁধেছিল। ইতিহাস সেই যুদ্ধ বিগ্রহ মনে রেখেছে। অথচ ইংরেজদের থেকে কমপক্ষে ৬০ বছর আগেই কলকাতায়  আসে আর্মেনিয়ানরা, ব্যবসা করতে, লুণ্ঠন করতে নয়। সুভদ্র আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে কখনও দিল্লির সুলতান বা বাংলার নবাবের  স্বার্থের সংঘাত ঘটেনি। আর্মেনিয়ানরা ছিলেন সুলতান ও নবাবের প্রিয়পাত্র। তাই এদেশে নিজেদের কোম্পানির শিকড় গাঁড়তে, চতুর ইংরেজ সুকৌশলে আর্মেনিয়ানদের গুড উইল ব্যবহার করে।

আর্মেনিয়ান জাতি যেন ইহুদীদের মতন অভিশপ্ত একটি জাতি। ইরান-তুরস্ক-রাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত এই দেশের উপরে যুগে যুগে ইরানি ও তুরস্কের সেনাবাহিনীর অত্যাচার চলেছে। পরে দেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ  রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথমে আর্মেনিয়া প্রদেশ এবং ১৯৯০ সালের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ সালে । 

আর বৃহৎ মূল ভূখণ্ডের গরিষ্ঠ অধিবাসীরা জানপ্রাণ বাঁচাতে ভারত, বার্মা, জর্জিয়া, রাশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আশ্রয়ের খোঁজে। সেই অভিশপ্ত জীবন এঁরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। আজকেও, মাত্র ১০০ বছর আগে ১৯১৫ সালে ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের বর্ণনা রয়েছে Britannica তে- “The greatest single disaster was the Armenian Genocide, which occurred during World War I. In 1915 the Ottoman government, regarding the Armenians as a dangerous foreign element, decided to deport the entire Armenian population of eastern Anatolia to Syria and Mesopotamia. Most estimates of the total number of Armenians killed en route, either by troops and police or by starvation and disease, range from 600,000 to 1,500,000.”

পারস্য অর্থাৎ ইরানি ও তুর্কিদের দ্বারা নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত আর্মেনিয়ানরা বহুদিন ধরে ভারতে রয়েছেন। সম্রাট আকবরের আমলে ১৫৬২ সালে  তাঁরা আগ্রায় একটি গির্জা নির্মাণ করেন। আকবরের সভার মুখ্য বিচারপতি ছিলেন জনৈক আর্মেনিয়ান – আবদুল হাই। বোম্বে, সুরাট , মাদ্রাজ এরকম বহু জায়গায় ব্যবসার জন্য আর্মেনিয়ানরা ছড়িয়ে পড়েন।

জব চার্নক যখন কলকাতা আসেন তার আগে থেকেই আর্মেনিয়ানরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করেছিলেন, যদিও তাঁদের মূল ব্যবসার ঘাঁটি ছিল চুঁচুড়া। বর্তমানে আর্মানি গির্জার স্থলেই ছিল আরমানি বসতি। ইংরেজরা গায়ের জোরে আর্মেনিয়ানদের দাবিয়ে দিয়ে Calcutta-তে প্রথম আসার দাবি করলেও, এই টম্ব স্টোনটি সেই মিথ্যাচারের বিপরীতে সবচেয়ে বড় সাক্ষী। 1898 সালে লন্ডন থেকে একটি বই প্রকাশিত হয়- “The Sultan’s Mandate, An Armenian Romance” নামে। লেখকের নাম C. Olynthus Gregory, ইনি একজন আর্মেনিয়ান সাহিত্যিক। বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি -“I may assert without contradiction that we are the founders of Calcutta, and an English professor wrote an article on this point in the leading daily paper of the city. In the churchyard of St.Nazareth in Calcutta there is a very old tomb stone, situated by the side of the door of entrance. The tombstone dates back to the year 1630, to a time anterior to the advent of the English in Calcutta. It was placed there to the memory of Rezabeebeh, described as the wife of the charitable Spokes. Moreover , in that part of Calcutta where the church stands, which was formerly the most fashionable quarter, and which is now known as China Bajar, there is a narrow street named Sookeas’s Lane, which evidently has some connection with the name of the tombstone. In very truth I repeat that the Armenians are the founders of the city of Calcutta.”

‘ফাউন্ডার’ শব্দটি হয়ত একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ইংরেজরা নয়, আর্মেনিয়ানরাই প্রথম এদেশে আসেন। চতুর ইংরেজরা , আর্মেনিয়ানদের জনপ্রিয়তাকে ভাঙিয়ে প্রথমে খোজা ইজরায়েল সারহাদ নামক এক নবাবের প্রিয় পাত্র আর্মেনিয়ানের  মধ্যস্থতায় ১৬৯৮ সালের ১০ ই নভেম্বর, আওরঙ্গজেবের পৌত্র, বাংলার সুবেদার আজিম-উস-সানের কাছ থেকে মাত্র ষোল হাজার টাকা নজরানা দিয়ে, কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর তিনটি গ্রামের প্রজাস্বত্ব কেনার সনদ হাসিল করেন। জমিদার বিদ্যাধর রায়  কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটির প্রজাস্বত্ব  হস্তান্তর করেন কোম্পানিকে। বর্তমানের চিৎপুর, বাগবাজার, শোভাবাজার ও হাটখোলা অঞ্চল ছিল সুতানুটির অঙ্গ, ধর্মতলা, বৌবাজার, বড়বাজার, মির্জাপুর, সিমলা, জানবাজার ইত্যাদি অঞ্চল ছিল কলকাতার মধ্যে, আর হেস্টিংস, ময়দান ও ভবানীপুর অঞ্চল ছিল গোবিন্দপুরের অংশ। কলকাতা কিন্তু বহু প্রাচীন জায়গা , তার প্রমাণ Calcutta তৈরির বহু আগেই কলকাতার উল্লেখ আছে প্রাচীন গ্রন্থাদি বিশেষ করে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি কাব্য গ্রন্থগুলিতে।

ইংরেজদের চতুরতার প্রমাণ আবার দেখা যাচ্ছে ১৭১৭ সালে,  পুনরায় সেই আর্মেনিয়ান খোজা ইজরায়েল ফরহাদ এর সাহায্যে ও সম্রাট ফারুকসিয়ার চিকিৎসা করা ২৪ টাকা বেতনের কোম্পানির ডাক্তার হ্যামিল্টন এর মধ্যস্থতায় তৎকালীন সম্রাট ফারুকসিয়ারের কাছ হতে বাণিজ্যের অধিকার, সনদ এবং কলকাতার আসে পাশে ৩৮ টি গ্রাম কেনার অধিকার পাওয়া এবং গঙ্গার ধারে এখনকার জি পি ও-র কাছে একটি দুর্গ নির্মাণের অধিকার লাভ করে  কোম্পানি এই সনদের মাধ্যমে। আর্মেনিয়ান খোজা ইজরায়েল ফরহাদ এর সাহায্যের মধ্যে দিয়েই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ভীত স্থাপিত হয়। 

এরপরে আসি চতুর ইংরেজদের কথায়। আর্মেনিয়ানদের সহযোগিতায় প্রজাস্বত্ব লাভ করা ইংরেজরা , মনে প্রাণে চাইত, সুলতান ও নবাবের সুনজরে থাকা লোকগুলি যেন চুঁচুড়া ছেড়ে কলকাতায় এসে ওঠে, কারণ ইংরেজরা বাণিজ্যের সঙ্গে দেশ দখলের খেলায় মেতে উঠেছিল, আর্মেনিয়ানরা দেশ দখলের জন্য লালায়িত ছিল না, তাঁরা নিজেরাই তো ইরানি, তুরস্কের সেনা এবং নাদির শাহের অত্যাচারে নিজভূমি ছেড়ে আসা উদ্বাস্তু। অধিকাংশ কলকাতার আর্মেনিয়ান, ইরানের জুলফা নামক স্থান থেকে আগত অভিবাসীদের অংশ, আর্মেনিয়া বা সেই দেশের  Etchmiadzin Apostolic Church এর সঙ্গে এঁরা যুক্ত ছিলেন না। তাই নবাব ও সুলতানের রোষানল থেকে বাঁচতে, নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য লোকের সংখ্যা বাড়ানোর দরকার ছিল ইংরেজদের।

সেই সময় কলকাতা থেকে চুঁচুড়ার আর্মেনিয়ানদের সংখ্যা বেশি ছিল। সেখানেও দা চার্চ অফ সেন্ট জন নামক আর্মেনিয়ান চার্চ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৬৯৫ সালে। কলকাতার আর্মেনিয়ানরা থাকতেন মুখ্যত বর্তমান আর্মেনিয়ান গির্জা ও সংলগ্ন গোরস্থানের  আশেপাশেই। এঁদের মন জয় করতে চতুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ১৬৮৮ সালের, ২২ জুন। এই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল কোম্পানির তরফে স্যার জসিয়া চাইল্ড এবং আর্মেনিয়ান দের তরফে খোজা সারহাদ এবং খোজা ফানুসের মধ্যে।

সেই চুক্তি অনুসারে ঠিক হয়, আর্মেনিয়ানদের উপাসনার জন্য  কোম্পানি জমি ও কাঠের গির্জা নির্মাণ করে দেবে। গির্জা নির্মাণের পরে প্রথম সাত বছর, গির্জা ও পাদ্রীদের খরচের ব্যয়ভার বহন করতে কোম্পানি বছরে ৫০ পাউন্ড করে দেবে। এভাবেই বর্তমান গির্জার ১০০ গজ দক্ষিণ দিকে ইংরেজরা তৈরি করে আর্মেনিয়ানদের জন্য কাঠের গির্জা।  বর্তমান গির্জার স্থানে তখন ছিল আর্মেনিয়ানদের কবরখানা।

মজার কথা হচ্ছে, যখন নিজেদের ধান্দায় ইংরেজরা, আর্মেনিয়ান গির্জা নিজেদের পয়সায় নির্মাণ করছে, তখন কিন্তু তাঁদের নিজেদের প্রার্থনার জন্য কোন গির্জা নেই কলকাতায়। ইংরেজরা নিজেদের জন্য প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম গির্জা ( সেন্ট এনন্স চার্চ) তৈরি করেন ১৭০৯ সালে চাঁদা তুলে। আর আর্মেনিয়ান গির্জা চালু হয় ১৭০৭ সালে। তবে এই সাল তারিখ নিয়ে মতবিরোধও আছে। অনেকেই  বলেন ১৬৯০ সালেই তৈরি হয়ে যায় কাঠের গির্জা এবং ১৭০৭ সালে এক ভয়ঙ্কর আগুনে নাকি গির্জাটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এবারে আর ইংরেজরা কিছুর মধ্যে নেই, আর্মেনিয়ানদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের যা পাবার, সব পাওয়া হয়ে গেছে।

তাই ১৭২৪ সালে চার্চটিকে পুনর্নির্মাণ করেন জনৈক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী আগা (জেকব) নাজার, গির্জা নির্মাণ করতে পারস্য দেশ থেকে আর্মেনিয়ান স্থপতি গা ভোনাকে নিয়ে আসা হয়। আগা নাজারের নামেই গির্জাটির নামকরণ হয় সেন্ট নাজারাথ গির্জা। চার্চটির সঙ্গে পরে একটি বড় অংশ তৈরি করেন  ১৭৬৪ সালে উমিচাঁদের শ্যালক হুজুরিমল (তার নামেই নেবুতলায় রয়েছে হুজুরিমল লেন)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই হুজুরিমল আবার কালীঘাটের মন্দিরের কাছে কয়েক বিঘা জমির উপরে বাঁধান ঘাট এবং  আর্মেনিয়ান ঘাট নির্মাণ করেন।

বিংশ শতকের শুরুতে গির্জার আধুনিকীকরণ  সম্পূর্ণ করেন আর্মেনিয়ান ধনকুবের আরাতুন স্টিফেন মহাশয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, একক উদ্যোগে এই আরাতুন স্টিফেন মহাশয় কলকাতার অসংখ্য ল্যান্ড মার্ক হেরিটেজ বিল্ডিং নির্মাণ করেছিলেন যেমন গ্র্যান্ড হোটেল, স্টিফেন কোর্ট, স্টিফেন ম্যানশন, স্টিফেন হাউস ইত্যাদি। আরেক আর্মেনিয়ান সাহেব জে সি গালসতুন তৈরি করেন কুইন্স ম্যানশন, পার্ক ম্যানশন তৈরি করেন আর্মেনিয়ান টি এম থাডিয়াস।

একটি লেখায় পড়লাম, ১৮৭২ সালে অবিভক্ত বাংলায় ৮৭৫ জন আর্মেনিয়ান বাস করতেন। এঁদের মধ্যে কলকাতায় ছিলেন ৭১০ জন। বাকিরা ছিলেন ঢাকায়।

কলকাতার ধনকুবের স্টিফেন আরাতুন, ১৮২৫ সালে ঢাকা শহরের পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি চমৎকার প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তখন বাড়িটির নাম ছিল “আরাতুন হাউস”। পরে কি কারণে জানিনা, মাত্র ১৫ বছর পরেই তিনি এই বাড়িটি বিক্রি করে দেন।

থমাস কানা হচ্ছেন প্রথম আর্মেনিয়ান ব্যক্তি যিনি সম্ভবত প্রথম (৭৮০ সালে) ভারতে এসেছিলেন। সপ্তম শতকে মালাবার উপকূলে আরমানি উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। ১৫ শতকে পারসিক ও অটোমান সম্রাটের হাত থেকে বাঁচতে বহু আর্মেনিয়ান দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট আকবরের খ্রিস্টান বিবি মেরিয়াম বেগম ছিলেন আর্মেনিয়ান। আর মেরিয়মের বোন জুলিয়ানা ছিলেন আকবরের হারেমের চিকিৎসক।

আরেকজন আর্মেনিয়ান আব্দুল হাই ছিলেন আকবরের বিচার সভার মুখ্য কাজী। মীর কাশিমের মুখ্য সেনাপতি ছিলেন খোজা গরগিন খান। মুর্শিদাবাদের সৈদাবাদ অঞ্চলে আর্মেনিয়ান কলোনি গড়ে উঠেছিল স্বয়ং সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ফরমানে। ১৭৫৮ সালে এখানেও চার্চ অফ দা ভার্জিন মেরি নামক আর্মেনিয়ান চার্চের পত্তন হয়। সুরাট ও মাদ্রাজেও বড় আর্মেনিয়ান কলোনি গড়ে উঠেছিল।

এবারে আসি কলকাতার আদি আর্মেনিয়ান যুগের কথায়। হুজুরিমল (ইনি অবশ্য শিখ ব্যবসায়ী, উমিচাঁদের শ্যালক), সুকিয়াস ইত্যাদি পরিবারের লোকজনেরা নিজেদের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে কলকাতা শহরের উন্নতির জন্যেও অনেক কিছুই করেছিলেন। হুজুরিমল- আরমানি গির্জার সংস্কার , আরমানি ঘাট, কালীঘাটে গঙ্গার ঘাট বাঁধিয়ে দেওয়া ইত্যাদি বহুবিধ কাজ করেছেন। হাওড়াতে ট্রেন ধরতে, টিকিট কাউন্টার ছিল আর্মেনিয়ান ঘাটেই। এখান থেকে টিকিট কেটে, লঞ্চে চেপে, গঙ্গা পেরিয়ে  চড়তে হত ট্রেনে। কলকাতার ট্রাম রুট  বহুদিন অবধি ছিল, শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট অবধি। 

আর্মানি গির্জার রাস্তা বা আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের নাম কলকাতা পুরসভা ১৯৫৮ সালে বদলে দিয়েছিল অক্ষয় কুমার মল্লিক স্ট্রিট নাম দিয়ে। তবে এখনও তো দোকান পাট সর্বত্রই দেখলাম আর্মেনিয়ান স্ট্রিট নামই লেখা আছে।

কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার ম্যালকম  পিটার গাস্পার ছিলেন ১৮৬৯ সালে পাসকরা প্রথম আর্মেনিয়ান আই সি এস। মাত্র ৪২ বছর বয়সে দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে ইনি দেহত্যাগ করেন। আর্মেনিয়ান চার্চ প্রাঙ্গণে তার সমাধি দেখতে পাবেন।

জোসেফ ডেভিড বেগলার – বাংলার টেরাকোটা মন্দির বিশেষজ্ঞ , এই বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন আর্মেনিয়ান। গ্রেগরি চার্লস পল ছিলেন এডভোকেট জেনারেল অফ বেঙ্গল। সেন্ট জনস এম্বুলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আর্মেনিয়ান সাহেব স্টিফেন ওয়েন মসেস। বিশ্ব বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ আর্থার জোরাব গ্লোকমা অপারেশন করার এক বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যাকে বলা হয় “জোরাব অপারেশন” পদ্ধতি।

অপর্ণা সেনের ‘36 চৌরঙ্গী লেন’ সিনেমাটি দেখেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল কলকাতার ফেয়ারলন হোটেলে যার মালিক ছিলেন এক আর্মেনিয়ান  দম্পতি টেড ও ভায়োলেট।

কলকাতার বহু আর্মেনিয়ান তাঁদের বাচ্চাদের শিক্ষিত করার জন্য নিজেদের বাড়িতেই প্রাইভেট আর্মেনিয়ান স্কুল খুলতেন। এরকম স্কুল সম্ভবত জনৈক মার্গার সাহেব সর্ব প্রথম ১৭৬৩ সালে চালু করেন। পরে আর্মেনিয়ান বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে ১৮২১ সালের ২ এপ্রিল তৈরি করেন বর্তমানের আর্মেনিয়ান স্কুল (তবে এটির নাম আর্মেনিয়ান কলেজ)। বর্তমানে স্কুলের ঠিকানা ৫৬ বি, মির্জা গালিব স্ট্রিট। কলকাতার মধ্যে যে আরেকটি কলকাতা রয়েছে, জানিনা কতজন আমরা তার খোঁজ রাখি!

এবারে চলুন সুকিয়াস নামক আর্মানীদের খোঁজে। একজন সুকিয়াস তো দানবীর বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন, যার স্ত্রী ছিলেন রেজাবিবি। আরেকজন দানবীর পণ্ডিতের নাম দেখছি পিটার সুকিয়াস। এরকম সব বিখ্যাত আর্মেনিয়ান সুকিয়াসরা কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, এবং তাঁদের নামে বিভিন্ন স্থানে গলি বা রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল- সুকিয়াস স্ট্রিট, সুকিয়াস রো, সুকিয়াস লেন ইত্যাদি। 

সুকিয়াস স্ট্রিটের নাম, স্বাধীনতার আগেই ইংরেজরা বদলে দেয় দুই ভারতীয়র নামে- কৈলাশ বোস স্ট্রিট এবং মহেন্দ্র শ্রীমানি স্ট্রিট। জানিনা কি কারণ ছিল এই নাম বদলের প্রেক্ষিতে। এভাবে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে মুছে ফেলতে চাওয়া কি খুব যুক্তিযুক্ত মনে হয় ?

সুকিয়াস রো- কলকাতা করপোরেশন ১৯৮১ সালে এই নাম মুছে দিয়ে করে দাউদ আলী দত্ত সরণি। খালি রাধাবাজার স্ট্রীটের সুকিয়াস লেন এখন অবধি বেঁচে আছে মুক ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে।


তথ্যসূত্র-

১) কলকাতা বিচিত্রা, রাধারমণ রায়, দেব সাহিত্য কুটির, জানুয়ারি ২০১১।

২) ইতিহাসের কলকাতা, সংগ্রহ সম্পাদনা কমল চৌধুরী।

৩) Armenian Church, Wikipedia.

৪) Armenians in India-Wikipedia.                                            

৫) Armenian (people) l Description , Culture, History, & Facts l Britannica.

ছবি- রেজা বিবির সমাধিফলক এবং কলকাতার আর্মানি গির্জা বিভিন্ন ছবি।

মন্তব্য তালিকা - “জব চার্নক কি কলকাতায় পা রাখা প্রথম বিদেশি?”

  1. এমন তো হতেই পারে আর্মেনিয়দের আগেও বহু বিদেশি কলকাতায় পা রেখেছিল। আর সেটাই স্বাভাবিক। যাই হোক লেখার মুল উদ্দেশ্য বোধহয় ছিল কারা প্রথম কলকাতা শহরে নিজেদের পা রেখেছে নয়, আধিপত্য স্থাপন করেছে। মুশিকল হল সেই কাজটি করেছে ইংরেজ। ছলে, বলে, কৌশলে, তারাই করেছে। সেই সরল সত্য অস্বীকার করার জন্য প্রতিপদে চতুর ধুর্ত এই শব্দগুলো বারবার ব্যবহার না করলে লেখাটে এতটা একপেশে মনে হতনা, মনে হতনা যে লেখার প্রধান উদ্দেশ্য বোধহয় কেবল মাত্র ইংরেজ নিন্দা।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।