মুখ্য ‘মজুমদার’ জীভাভু: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একমাত্র মহিলা রাজস্ব আদায়কারী
১৬১৩ সাল…, শান্ত শরৎ বাতাস বইছে আরব সাগরময়। এমনই এক দিনে সুরাটের পর্তুগিজ বণিকরা, পশ্চিম উপকূল আর লোহিত সাগরের মধ্যে নিত্য যাতায়াত করা, ‘রহিমি’ নামের সুবিশাল জাহাজটিকে আটক করলেন। জাহাজে ভরা ‘নীল’ রঞ্জকের ভাণ্ডারের লোভে বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে থাকলেও, হিন্দুস্তানের জাহাঁপনার মায়ের জাহাজের পথ আটকানো ছিল এক প্রবল স্পর্ধার বিষয়। হ্যাঁ, ‘রহিমি’ নামের ১৫৩ ফুট লম্বা-৪২ ফুট চওড়া আর হাজার টন ওজনের মহাজাহাজটি ছিল বাদশাহ আকবরের অন্যতমা স্ত্রী তথা সম্রাট জাহাঙ্গীরের মা, মরিয়ম-উস-জামানির নিজস্ব জাহাজ। এই জাহাজটি সহ আরও অনেকগুলি জাহাজের মাধ্যমে মরিয়ম পশ্চিমে নীলের ব্যবসা আর মক্কাগামী হজযাত্রীদের আনা-নেওয়ার ব্যাপক লাভজনক ব্যবসা চালাতেন দীর্ঘদিন ধরে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে মুঘল অভিজাত নারীদের জোরালো উপস্থিতির দিনকাল শুরু হয়েছিল মূলত বেগম মরিয়মের সময় থেকেই। সম্রাজ্ঞী নূরজাহানও আরব সাগর মারফত নিজস্ব জাহাজে নীল আর দামি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। ভুটান আর আসাম থেকে আসা রাজস্বের একটা বড় অংশ প্রবেশ করত তাঁর কোষাগারে। শাহজাহানের সুখ্যাত কন্যা জাহানারাও ছিলেন মোঘল যুগের সফল ব্যবসায়ী। অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি দিল্লির আশপাশে সরাইখানার ব্যবসাও চালাতেন তিনি। পর্তুগিজদের সঙ্গে মোঘল সম্রাটদের বৈরিতা থাকলেও, তাঁদের ঘরের মহিলারা ব্যবসায়িক স্বার্থে সবসময় পর্তুগিজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন।
১৮ শতক থেকে খোদ মোঘল রাজপরিবারের বাইরের দেশের অন্যত্র কিছু সংখ্যক অভিজাত মহিলা সরাসরি কৃষিব্যবস্থাপনা আর লাভজনক নানা ব্যবসার হাত ধরে যে একক রোজগারের এক শক্তিশালী বৃত্তে ঢুকে পড়ছিলেন, এই বাস্তবতার মূর্ত প্রমাণ ছিলেন মিরাটের সারধনার বেগম সমরু থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একমাত্র রাজস্ব আধিকারিক গুজরাটের জীভাভু। ১৪ বছর বয়সী কাশ্মীরি ফারজানা ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি হয়ে সেকালের নামজাদা (বা কুখ্যাত) সেনানায়ক তথা এক বিশাল ভাড়াটে সেনাবাহিনীর প্রধান ওয়াল্টার রেইনহার্ট-এর হারেমে ঢুকে পড়ে। এখানে নাম বদলে বেগম সমরু হয়ে ওঠা ওই কিশোরীটি, ওয়াল্টারের মৃত্যুর পর পুরোপুরি নিজেদের কৃতিত্বের জোরে সার্ধানায় প্রায় ৪ হাজার ভাড়াটে সেনাদলের পরিচালিকা আর বিপুল ভূ-সম্পত্তি আর নগদ টাকার মালকিন হয়ে উঠেছিলেন।
তবে এই নিবন্ধটি যেহেতু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের একমাত্র মহিলা রাজস্ব আধিকারিক গুজরাটের জীভাভুর ব্যতিক্রমী জীবন ও আদ্যন্ত লড়াকু যাপনকে বর্তমানের পাঠকের কাছে ফিরিয়ে আনার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই লিখিত হয়েছে, তাই এবার সরাসরি জীভাভুর দিকে মনোনিবেশ করা যাক।
১৭৭০-এর দশক। একদিকে দ্রুত ভাঙছে মোগল সাম্রাজ্য, অন্যদিকে ব্যবসা, রাজনীতি আর যুদ্ধের ত্রিফলা হাতিয়ারে বিশাল ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তকে ধাপে ধাপে গ্রাস করছে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পশ্চিমের আরব সাগরের তীরে গুজরাট প্রদেশও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। সেই কোন ১৬১২ সালে গড়ে তোলা সুরাট বন্দরের বাণিজ্যকুঠির সীমানা ছাড়িয়ে আজ গুজরাটের বুকের ভিতর গ্রামদেহাতের সর্বত্র চেপে বসেছে ইংরেজ শাসনের বজ্রমুষ্টি। ১৭৭২-তে তারা দখল করেছে কৃষি-শিল্প-ব্যবসা সমৃদ্ধ বিশাল পরগণা ভারুচ।
মোঘল আমল থেকে বংশানুক্রমে ভারুচের প্রধান ‘মজুমদার’ পদে আসীন ছিলেন লাল্লুভাই ভূখনদাসের পরিবার। মজুমদারদের দায়িত্ব ছিল ভূমিরাজস্ব অর্থাৎ কৃষিকর আদায়, জমির হিসাব পরীক্ষা আর সে সবকিছুর তথ্য সংরক্ষণ করা। এই কাজের বিনিময়ে মজুমদারেরা করমুক্ত বিশাল কৃষিজমি আর নানা সম্মানসূচক অধিকার বা ‘হক দস্তুর’ ভোগ করতেন। ১৮ শতকের ৫০ ও ৬০-এর দশকে রাজনৈতিক ডামাডোলে গুজরাটের নবাবেরা একের পর এক ক্ষমতাচ্যুত হলেও লাল্লুভাইয়ের মতো মজুমদারদের প্রতিপত্তি অটুটই ছিল। কারণ এদেশে পুরোনো মোঘল আদলকে বদলে ফেলে নতুন করে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য এঁদের মত অঞ্চলের অর্থনীতির সকল খুঁটিনাটি নখদর্পণে রাখা সাবেকি কর্মচারীদের তোয়াজ করার প্রয়োজন ছিল ইংরেজদের। আর এঁরাও সেই সুযোগে নিজেদের ভূসম্পত্তি আর ব্যক্তিগত ব্যবসার বড়সড় সাম্রাজ্য তৈরি করে ফেলেছিলেন সহজেই।
কূটকৌশলী লাল্লুভাইয়ের প্রতিপত্তি কেবল ভারুচ নয়, গোটা গুজরাট জুড়েই ছড়িয়ে ছিল। তাঁর জীবনযাপনও ছিল সমানুপাতিক ভাবে রাজকীয়। তিনি থাকতেন আলিশান এক প্রাসাদে, ব্যক্তিগত টাঁকশালে তৈরি হত তাঁর নিজস্ব মুদ্রা, কর্মসূত্রে যাতায়াতের পথে সর্বদা ব্যবহার করতেন অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত পালকি। যে পালকি যাওয়ার আগে জনতার মাঝে উঁচু গলায় হেঁকে তাঁর উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য থাকতেন ‘চুপদার’ আর প্রহরীর দল আর পিছনে পিছনে সার বেঁধে চলতেন তাঁর তল্পিবাহক ও সহকারীরা।
যদিও লাল্লুভাই যতই দরকারি হোন না কেন, ভারুচের অহংকারী ইংরেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষে তাঁর এহেন রাজকীয় জীবনযাপন ছিল চরম স্পর্ধারই নামান্তর। তাই তাঁকে পদচ্যুত করতে তলে তলে প্রস্তুতি সেরে ফেলেছিল কোম্পানি। দীর্ঘ দুই দশক লাল্লুভাইয়ের সাহায্যে পরগণার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাকে শক্তপোক্ত করে নেওয়ার পর, কৃষিজমির জন্য গৃহীত ৪ লক্ষ টাকা ঋণ দ্রুত শোধ করতে না পারার অজুহাতে তাঁকে ১৭৯৪ সালে মজুমদারীর দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করে কারারুদ্ধ করেন ভারুচের ইংরেজ প্রধান আলেকজান্ডার ওয়াকার। একই সাথে তাঁর সমস্ত জমিজমা, ব্যবসা, ধনসম্পত্তি এমনকি বাড়িটিকেও কেড়ে নিয়ে ভারুচ থেকে নির্বাসিত করা হয় লাল্লুভাইয়ের গোটা পরিবারকে।
কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই চরম স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না লাল্লুভাইয়ের দ্বিতীয়া স্ত্রী জীভাভু। প্রতিকারের জন্য তিনি নিজে রওনা দিলেন বহু শত মাইল দূরের মারাঠা পেশোয়া দ্বিতীয় মাধব রাওয়ের দরবারে। কিন্তু জীভাভুর সাথে সাক্ষাতের ক’দিন আগেই একদিকে যেমন মৃত্যু হল পেশোয়ার আর অন্যদিকে সেই অন্ধকার সময়েই পাভাগড়ের জেলে অসুস্থ ও অপমানিত অবস্থায় মারা গেলেন বন্দী লাল্লুভাইও। কিন্তু তাঁর এই দুঃখজনক পরিণতিতে জীভাভুর লড়াই সাঙ্গ তো হলোই না বরং প্রাথমিক ধাক্কা সামলে তিনি শুরু করলেন অন্যরকম এক বীরত্বের কাহিনী।
স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত অন্যায়ের হিসেব নেওয়ার জন্য এবার খোলাখুলি ভারুচের ব্রিটিশ প্রশাসনযন্ত্রের ভিতরে পা রাখলেন জীভাভু। তিনি আগাগোড়াই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী রকমের বলিষ্ঠ চরিত্র। প্রথম স্বামী গত হলে তিনি সেই রক্ষণশীল যুগের সামাজিক সমস্ত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে শিশুকন্যা ললিতাকে সাথে নিয়ে বিবাহ করেছিলেন লাল্লুভাইকে। কাজেই শুরু থেকেই তাঁদের সাহসী দাম্পত্য গড়ে উঠেছিল পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিতের ওপর। লাল্লুভাইয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের আড়ালে জীবদ্দশায় তাঁর প্রধান সহায়িকা ছিলেন জীভাভু। স্বামীর মজুমদার পদের দায়-দায়িত্ব থেকে বিস্তৃত পারিবারিক জমিদারির পরিচালনা, ব্যবসার দেখভাল থেকে লাল্লুভাইয়ের রোজকার বিপুল দানধ্যান পরিচালনা — সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। প্রখর বুদ্ধিমতী স্ত্রীর বিচার বিবেচনার প্রতি অগাধ আস্থা ছিল স্বামীরও। কাজেই ব্যক্তিত্বময়ী জীভাভু যে স্বামীর মৃত্যুর পরেও সহজে তাঁর পারিবারিক মজুমদারীর উত্তরাধিকার আর সম্মানসূচক ‘হক দস্তুর’গুলির অবলুপ্তি মেনে নেবেন না তা বলাই বাহুল্য।
লাল্লুভাইয়ের করুণ পরিণতির জন্য যিনি দায়ী ছিলেন, ভারুচের সেই ইংরেজ আধিকারিক ওয়াকার কিন্তু জীভাভুকে একেবারেই বুঝে উঠতে পারেননি। এবার তাঁর চোখে চোখ রেখেই জীভাভু শুরু করলেন নিজের লড়াইয়ের নতুন ধাপ। ১৮০৩ সাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এক দীর্ঘ চিঠি লিখলেন তিনি। লিখলেন, পদচ্যুত লাল্লুভাইয়ের মতোই ভারুচের কৃষি ও বাণিজ্য অর্থনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতির সবদিকগুলি নিখুঁত ভাবে জানেন তাঁর বিধবা পত্নীও; কাজেই নির্বিঘ্নে পরগণার শাসন চালাতে হলে তাঁর সহায়তা ইংরেজদের পক্ষে আবশ্যক। জীভাভু বললেন, প্রশাসনের কাজে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহায়তা করতে রাজি, কিন্তু বিনিময়ে তাঁকে পরগণার মুখ্য মজুমদার পদ ও পারিবারিক ‘হক দস্তুর’ ফিরিয়ে দিক ইংরেজরা। নিজের দাবীর যথার্থতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন জীভাভু কারণ তিনি জানতেন, বাস্তববাদী ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থেই মেনে নেবে তাঁর প্রস্তাব। ফলস্বরূপ, মুঘল সাম্রাজ্যের তো বটেই ইংরেজ আমলেরও প্রথম ও একমাত্র মহিলা ভূমিরাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী হিসেবে ১৮০৩-এ আইনানুগভাবে ভারুচের মুখ্য মজুমদার পদে বহাল হলেন জীভাভু। পদে ফিরেই দ্রুত নির্বাসিত পরিবারকে ফিরিয়ে আনলেন সাবেক হাভেলিতে, উদ্ধার করলেন হৃত পারিবারিক ধন-সম্পদ। রাজস্ব আদায়ের কাজের পাশাপাশি এরপর নিজের কৃষি ও বাণিজ্যিক প্রতিপত্তিকেও ছড়াতে শুরু করলেন তিনি।
পরগণার মজুমদারের পদমর্যাদা ইংরেজদের মনে করিয়ে জীভাভু তাঁর চিঠিতে কাজের জন্য প্রাপ্য ভাতা, রাজস্বমুক্ত বিশাল কৃষিজমি, ‘ভেরা’ নামক উপরি কর, পারিবারিক বন্ধকীব্যবসা বা ‘মানোতি’র অধিকার, লাল্লুভাইয়ের গড়ে তোলা টাঁকশালগুলি থেকে নির্মিত প্রতি একশো মুদ্রার ২.৬ ভাগ, পরিবারের সাবেকি পালকি দু’টি ব্যবহারের অধিকার, নিজের অধীনস্থ কর্মচারীদের বেতন সহ একগুচ্ছ দাবি রেখেছিলেন। লাল্লুভাই তাঁর জীবদ্দশায় যে বিপুল পরিমাণ জনকল্যাণমূলক কাজগুলি করেছিলেন, সেগুলিকে নতুন করে সংস্কার করার দাবি করলেন তিনি। নর্মদা নদীর উপর লাল্লুভাইয়ের বানানো ৮টি স্নানঘাট, ভারুচের সড়কগুলির পাশে পথিকদের বিশ্রামস্থল, অসুস্থ পশুদের জন্য বানানো পিঞ্জরাপোলগুলিরও মালিকানা দাবি করলেন জীভাভু। সুদীর্ঘকাল ধরে মজুমদার পরিবারকে দশেরা ও দিওয়ালী উৎসবে গ্রামপ্রধান প্যাটেলদের প্রদত্ত উৎকৃষ্ট ঘিয়ের পার্বণী আর পরগণার দোকানী, কারিগর ও চাষিদের দেওয়া নানা নজরানা লাভের ‘হক’-ও তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করলেন জীভাভু।
স্বামীর সময় থেকেই দানশীলতা আর সুব্যবহারের গুণে ভারুচের জনতার কাছের মানুষ ছিলেন জীভাভু। কাজেই তাঁর দাবিগুলি ইংরেজদের কাছে অগ্রহণীয় মনে হলেও তাঁকে চটিয়ে ভারুচে নতুন করে অশান্তি তৈরি করার ইচ্ছে তাদের ছিল না। তাই উপায়ান্তর না দেখে ১৮০৩ থেকে ১৮১০ পর্যন্ত ভারুচ পরগনার প্রধান মজুমদার হিসেবে জীভাভুর একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিয়েছিল ইংরেজরা। তবে তাঁর ওপর সরকারী চাপ বজায় ছিল নিরন্তর, যা স্বভাবসিদ্ধ তেজে মোকাবিলা করতেন জীভাভু। যেমন, ১৮০৫-এ তাঁর পালকি ব্যবহারের অধিকার ও মানোতি ব্যবসাকে ইংরেজরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে জীভাভু তাঁর অধীনস্থ ২৫০টি গ্রামের প্যাটেল অর্থাৎ গ্রাম প্রধানদের নিজের স্বপক্ষে নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন। সাথে নিলেন দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক রাজস্ব কর্মচারী বা দেশাই দৌলত রাইকেও। দ্রুত ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠল ভারুচ। সেনা ডেকে সেই আগুন নেভানো গেলেও বাধ্য হয়েই সে যাত্রায় ইংরেজদের মেনে নিতে হয়েছিল জীভাভুর দাবি।
১৮০৫ থেকে ১৮১১ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর স্বেচ্ছাচারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এভাবেই প্রতিদিন লড়াই করে তাঁর হকগুলিকে বজায় রাখতে পেরেছিলেন জীভাভু। কিন্তু সময় বদলে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। বোম্বে প্রেসিডেন্সির নতুন গভর্নর ইভান নেপিন এসময় মোগল আমলের পুরোনো রাজস্ব কর্মচারীদের পদমর্যাদা ও সাবেক সুযোগ-সুবিধাগুলিকে দ্রুত সংকোচন করে তাঁদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে মুখ্য মজুমদার হিসেবে জীভাভুকে বরখাস্ত করা তাঁলেও-এর পদ হারালেন কিন্তু ভারুচের ইংরেজ প্রধান জে. এইচ. বেলাসিসের দৌলতে দৌলত রাইকে বহাল রাখা হোলো একই পদে। বেলাসিস অন্যায়ভাবে জীভাভুর যাবতীয় হক-দস্তুর, তাঁর বিপুল পারিবারিক সম্পত্তি ও ব্যবসার বড় অংশ দখল করে নিলেন আর তার ফলে নিজের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে অনেকটাই একঘরে হয়ে যান প্রাক্তন মুখ্য মজুমদার। সরকারি দলিল দস্তাবেজগুলি থেকেও ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে তাঁর নাম। ১৮১৯-এ মৃত্যুর পর তাঁর জামাই ভুখনদাস ভারুচের নতুন মজুমদার নিযুক্ত হলেও সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছিল তামাম ব্রিটিশ ভারতের একমাত্র মহিলা রাজস্ব আধিকারিক জীভাভুর অস্তিত্ব। এরপর বেশ কয়েক দশক পর জীভাভুর বিপুল সম্পত্তি তাঁর কন্যা ললিতার দত্তকপুত্র ব্রজভুখনদাস আর লাল্লুভাইয়ের পরিবারের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছিল।
মহিলা হিসেবে এক আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক তথা বিদেশী অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিপক্ষের সামনে নিজের পদমর্যাদা ও অধিকারগুলিকে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিপদে কঠিন লড়াই লড়তে হয়েছিল জীভাভুকে। তাঁর পরিস্থিতি প্রয়াত লাল্লুভাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি জটিল হলেও কখনও হাল ছাড়েননি তিনি, বরং মাথা উঁচু করে আজীবন চলেছেন নিজের শর্তে। নিজের হক দস্তুর আদায়ের পথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জীভাভুর এই অন্যরকম যুদ্ধ নিঃসন্দেহে তাই ভারতীয় ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে চিরকাল।
তবে একদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিযুক্ত একমাত্র প্রধান মজুমদার পদাধিকারী আর অন্যদিকে নিজের হক দস্তুরের জন্য আপোষহীন লড়াইতে জীভাভু যেমন অনন্যা হয়ে রয়েছেন, ১৮২২-এ গুজরাটের প্রভাবশালী ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ী শ্রীকৃষ্ণ ত্রাবাড়ির মৃত্যুর পর বেআইনি ব্রিটিশ দখলদারির গ্রাস থেকে পারিবারিক ব্যাঙ্ক ব্যবসার মালিকানা বাঁচানোর জন্য অনেকটা একইরকম লড়াই করতে হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ ত্রাবাড়ির বিধবা স্ত্রী রানী বহুকেও। জীভাভু বা রানী বহুদের মতো আরও ছকভাঙা মহিলারা গুজরাটের আর্থসামাজিক আর নারী ইতিহাসের অনাবিষ্কৃত অলিন্দের আনাচে-কানাচে আবছা হয়ে রয়েছেন আজও। কারণ, মধ্যযুগ থেকে নিজস্ব ব্যবসার জোরে ধনবতী হয়ে ওঠা মহিলাদের যে ঐতিহ্য গুজরাটে চলে এসেছিল, একজন জীভাভু বা রানী বহুতেই সেই মহিলা ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোগীদের দীর্ঘ তালিকা সাঙ্গ হওয়ার নয়।
উৎস সূত্রঃ
১) Jibhabhu’s Rights To Ghee : Land Control And Vernacular Capitalism In Gujarat, Circa 1803 -10 – Samira Sheikh ; Cambridge University Press, April 2017
২) We know all about warrior queens like Lakshamibai. Now, let’s talk of medieval India’s businesswomen : Aparna Kapadia : www.scroll.in
৩) In the lockdown, a reminder of the missing histories of women at work : Aparna Kapadia : www.scroll.in
খুব ভালো, তথ্যপূর্ণ লেখা।
অসাধারণ তথ্যসম্বলিত একটি প্রতিবেদন। এই ইতিহাস সম্পূর্ণ অজানা ছিল। নারী ক্ষমতায়নের এমন ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসুন বারংবার। আমরা প্রতীক্ষায় থাকবো।
খুব ই তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।
অনেক ঘটনা ই জানার বাইরে ছিলো।
রেফারেন্স বই গুলো র দাম কেমন হবে জানতে পারলে ভালো হয়।
ধন্যবাদ।
একেবারে অজানা তথ্য দিয়ে হতবাক করে ফেললেন।
যদি ও মুর্শিদাবাদ এর পালা বদলের সাথে সাথে অনেক রকমের কূট বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে ইংরেজদের আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। ঘৃণিত স্বভাবের প্রভাব ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার কাজে ও ব্যবহৃত হয়েছে।
ভাল লাগা শুধু না সমৃদ্ধ ও করলেন।
চমৎকার প্রবন্ধ।
সমৃদ্ধ হলাম।