সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সংস্কৃত বিভাগ—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়; ফিরে দেখা

সংস্কৃত বিভাগ—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়; ফিরে দেখা

বিজয়া গোস্বামী

সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪ ১২৮ 2

প্রথমেই বলে রাখি—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে অত্যন্ত আপন। আমার জন্মের বহু আগে, ব্রিটিশ রাজ যখন আমাদের দেশকে লৌহশৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, তখনই এর প্রথম বীজ রোপিত হয়েছিল, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর (National Council of Education) মাধ্যমে। ১৯০৬ সালের ১১ই মার্চ এই প্রতিষ্ঠানের সূত্রপাত হয়, সে সময়ের যত জ্ঞানীগুণী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন সবাই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছিলেন। এসব কাহিনী আগে এক সময় বলেছি। এই বিদ্বজ্জনের মধ্যে আমার প্রপিতামহ মহারাজা সূর্য্যকান্ত আচার্য্যও ছিলেন। তিনি বড়ো রকমের অর্থসাহায্যও করেছিলেন। প্রসঙ্গত বলি, রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক এবং আমার প্রপিতামহ—এই দুজনের জমি নিয়ে এখনকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্যাম্পাস তৈরি হয়েছিল। বিশেষত এই কারণেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ।

১৯৫৫ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আত্মপ্রকাশ। ডা ত্রিগুণা সেন ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা বিধানচন্দ্র রায়ের বিশেষ উদ্যোগে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নিবন্ধক (রেজিস্ট্রার) ছিলেন প্রবীরচন্দ্র বসু মল্লিক। আমার বাবা স্নেহাংশুকান্ত আচার্য্য ছিলেন পরিচালন সমিতির সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয় হবার আগে তিনি প্রথমে পরিচালন সমিতির সম্পাদক এবং পরে কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় শিশুকাল থেকেই আমার ঘরবাড়ি হয়ে উঠেছিল। সাধারণের কাছে যেসব বিষয় অজ্ঞাত, তাও আমার কাছে ঘরের কথা!

বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের আগে থেকে এখানে স্বদেশী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল। সেটিই ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি নাম নিয়ে পরবর্তী কালে শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হবার পর সায়েন্স ও আর্টস ফ্যাকাল্টি জন্ম নেয়। আর্টস ফ্যাকাল্টিরই অন্তর্ভুক্ত আমার প্রিয় বিভাগ—সংস্কৃত।

আর্টস ফ্যাকাল্টির সূচনায় বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ শিক্ষাক্ষেত্রের দিকপালেরা পাঠ্য বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তবেই বিভিন্ন বিভাগ ও তাদের পাঠক্রম স্থির করেন। তার মধ্যে অবশ্যই বাংলা ও ইংরেজি ছিল, কারণ এই দুটি ভাষা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যপাঠ্য ছিল। অন্যান্য যে বিভাগগুলি শুরুতেই রাখা হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি নতুন বিভাগ তৈরি হয়—যা অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তখন ছিল না। সে’দুটি হল তুলনামূলক সাহিত্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এছাড়া ইতিহাস, দর্শন ও সংস্কৃত ছিল অন্যতম প্রধান বিভাগ।

সংস্কৃত বিভাগের সত্যকারের শুভারম্ভ হয়েছিল—এই বিভাগ গড়ে তোলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অধ্যাপক গৌরীনাথ শাস্ত্রীকে। তিনি তখন সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁর শুধু অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তাই নয়, অসামান্য প্রশাসনিক দক্ষতাও ছিল। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর কথাই ভাবা হয়েছিল। তিনি ১৯৫৬ সালে ‘লিয়েন’-এ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেই সময়েই যোগ দেন অধ্যাপক সদানন্দ ভাদুড়ী। ১৯৫৮ সালে শাস্ত্রীমশায় তাঁর স্বস্থানে ফিরে যান। তখন অধ্যাপক ভাদুড়ীই বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৬১ সাল অবধি এই দায়িত্ব পালন করে অবসর নেন। তাঁকে দেখার আমার সৌভাগ্য হয়নি, তবে তিনি যে শুধু মজবুত ভিতের উপর বিভাগকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তা নয়, তাঁর অমূল্য পুস্তক সংগ্রহ তিনি বিভাগকে দান করেন। এই বইগুলি নিয়েই সংস্কৃত বিভাগের গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। বিভাগের এই প্রাথমিক অবস্থায় শাস্ত্রীমশায় বেছে বেছে ভালো ছাত্রদের বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন। যাঁদের নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় অধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের। ইনি অধ্যাপক সদানন্দ ভাদুড়ী অবসর নেবার পর দীর্ঘ সময় (১৯৬১-৭০, ১৯৭১-৭২) বিভাগের প্রধান ছিলেন। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা অভূতপূর্ব—বিশেষত সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কার বিষয়ে তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। শুধু সংস্কৃত নয়, প্রাচ্য পাশ্চাত্য বহু ভাষা ও তার সাহিত্যে তিনি পারদর্শী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসাবে যোগ দেন, পরে রীডার ও আরও পরে প্রফেসর হন; যাদবপুর থেকেই তিনি ডি লিট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

সে আমলে বিভাগের অধ্যাপকদের মধ্যে শুধু প্রফেসরেরাই বিভাগের প্রধান হতেন। তার মধ্যেও যিনি সর্বাপেক্ষা ‘সিনিয়র’, তিনিই এই দায়িত্ব পালন করতেন। অধ্যাপক সদানন্দ ভাদুড়ী অবসর নেবার পরে বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তিনি শুধু বিদ্যাবত্তায় নয়, প্রশাসনিক কাজেও সমান পটু ছিলেন। উপরন্তু তিনি সুবক্তা৷ সবার সঙ্গে মধুর ব্যবহারের কারণে তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল অসীম। বিভাগের উন্নতির মূলে ছিল তাঁর অক্লান্ত উদ্যম। ১৯৬৯ সালে তাঁরই উদ্যোগে All India Oriental Conference-এর অধিবেশন হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭০ সালে তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময়ে রাজনৈতিক টালমাটাল চলছিল, যার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রেও অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সে পরিস্থিতিতে রমারঞ্জন বর্ধমান ছেড়ে চলে আসেন। পরবর্তীকালে অবশ্য কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি আবার বর্ধমানে ফিরে যান এবং ১৯৮৪ পর্যন্ত সেখানে উপাচার্য ছিলেন। ১৯৮৪ সালের শেষের দিক থেকে তিনি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে ১৯৮৭ পর্যন্ত থাকেন। এর পরেও তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, সংস্কৃত ভাষার প্রচার ও প্রসার, নানা প্রশাসনিক কার্যকলাপ ইত্যাদিতে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সম্মান এবং পদ্মশ্রী উপাধিও লাভ করেন। তিনি আজীবন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি সাধন করতে সচেষ্ট ছিলেন। এই বিভাগ যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ‘Department of Special Assistance’-এর সম্মান দু’দুবার লাভ করে এবং Centre for Advanced Study in Sanskrit ঘোষিত হয় দু বার, সেও তাঁর সক্রিয়তার ফলে।

রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় যাদবপুরে আসার পরে পরেই আসেন অধ্যাপক সীতানাথ গোস্বামী। তিনি ছিলেন বেদান্ত বিশেষজ্ঞ এবং সুপণ্ডিত। তাঁর লেখা বেদ-বেদান্ত সংক্রান্ত বেশ কিছু গ্রন্থ এখনও ছাত্রসমাজে জনপ্রিয়। আর আসেন অধ্যাপক গোপিকামোহন ভট্টাচার্য। এঁর বিষয় ছিল নব্য ন্যায়, কিন্তু নানান বিষয়ে তাঁর যে অবাধ বিচরণ ছিল, তা সবাই জানতেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ভিয়েনা যান দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রি সংগ্রহ করতে। ১৯৭০ সালে রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিলে তিনি ও অধ্যাপক সীতানাথ গোস্বামী যুগ্মভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্ব নেন। অবশ্য তার পরেই তিনি কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হয়ে চলে যান। সেখানে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব সম্মানের সঙ্গে পালন করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিনি একাধিক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর বরাবর যোগ ছিল—একাধিকবার সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে গেছেন। ভিয়েনা শহরেই তিনি প্রফেসর জি ওবারহ্যামার-এর সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের অভিধান নিয়ে কাজ করতে করতে আকস্মিকভাবে পরলোকগমন করেন।

শুরুতেই বলেছিলাম, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক পর্বে বাংলার বহু বিদ্বজ্জন এখানকার গঠনপ্রণালী ও বিন্যাসের বিষয়ে আগ্রহী ও সক্রিয় ছিলেন। এঁদেরই সদিচ্ছায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য।

সেমিনারে সংস্কৃত বিভাগের চার অধ্যাপক—নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয়া গোস্বামী, সুকুমারী ভট্টাচার্য, চিন্ময়ী চট্টোপাধ্যায়

তিনি আবাল্য সংস্কৃত চর্চায় অনুরাগী, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক প্রাচীনপন্থী অধ্যাপক সুকুমারী ভট্টাচার্য জন্মসূত্রে ক্রিশ্চান এবং মহিলা বলে তাঁকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করেন। এই অবস্থায় এম এ পরীক্ষার অল্পদিন আগে তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে ইংরেজিতে এম এ করেন। পরে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ-এ ইংরেজির অধ্যাপিকা থাকাকালীন তিনি প্রাইভেটে সংস্কৃত নিয়ে এম এ পাশ করেন। পরবর্তী সময় বৈদিক দেবতাদের উপরেই পিএইচডি করেছিলেন, তাঁর সেই গ্রন্থ বিদেশেও সমাদৃত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রভৃতি নিয়ে যে পণ্ডিত ব্যক্তিরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদেরই আগ্রহে অধ্যাপিকা ভট্টাচার্য প্রথমে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে এবং পরে সংস্কৃত বিভাগে নিযুক্ত হন। সুকুমারীদি অনেকগুলি বিষয় পড়াতেন। বেদ, সংস্কৃত সাহিত্য এবং বৌদ্ধ সাহিত্য তাঁর দখলে ছিল। তার উপরে পাশ্চাত্য সাহিত্য নিয়েও প্রচুর পড়াশোনা ছিল—শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়, গ্রীক, ল্যাটিন পর্যন্ত। আমি পড়াতাম কাব্য, অলংকার, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, ললিতবিস্তর, আবেস্তা ইত্যাদি।

দুঃখের বিষয়, এখানেও তাঁকে বিরোধিতার সামনে পড়তে হয়—এবার রাজনৈতিক কারণে। ভিত্তিহীন কিছু অভিযোগ এনে তাঁর পদোন্নতিতে বাধা দেন বিভাগের জনৈক অধ্যাপক। এই সময়টা ’৭০ এর দশক, তখন শিক্ষা জগতে দুর্নীতি এসে গেছে। সৌভাগ্যবশত পরবর্তীকালে বিচারপতি অজয় বসু পরিচালিত কমিশনের রায় অনুযায়ী তাঁকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকেরা তাঁকে প্রফেসর নিযুক্ত করেন—যদিও তা তাঁর অবসর গ্রহণের মাত্র কয়েকমাস আগে। ইতিমধ্যে যাকে বলা যায় পর্যায়ক্রমিক প্রধানপদ (rotational headship)—যে নিয়মে বিভাগের সব প্রফেসর ও রীডার পদের অধ্যাপকেরা প্রত্যেকে দু বছর করে বিভাগীয় প্রধান থাকবেন—সেই নিয়ম চালু হবার ফলে সুকুমারীদি ছ’ মাসের জন্য বিভাগের দায়িত্ব পান। ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিভাগের পঠন-পাঠন বিষয়ে উন্নতিসাধনের পদক্ষেপ নিতে থাকেন। সুকুমারীদির সমাজ চেতনা ছিল প্রবল, বিশেষত মেয়েদের ও নিপীড়িত জাতিগুলির তিনি মুখপাত্র ছিলেন। মেয়েদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। অপর দিকে তিনি ছিলেন কোমল মনের মানুষ। বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন, কেউ কোনো সমস্যায় পড়ে তাঁর কাছে এলে কখনও শুধু হাতে ফেরেনি। বিভাগে থাকাকালীন তিনি দুঃস্থ ছাত্রদের জন্য একটি ‘ফাণ্ড’ তৈরি করেছিলেন, আমরা সবাই তাতে যোগ দিয়েছিলাম। সেই ফাণ্ড বিভাগে বোধহয় এখনও রয়েছে।

নিমপীঠ আশ্রমে ছাত্ররা

সংস্কৃত বিভাগে যে সব পাঠ্যবস্তু তখন ছিল—তা বহুমুখী। এর মধ্যে যুক্তি এবং বুদ্ধির স্বচ্ছতা আনার জন্য ছিল বিভিন্ন দর্শন ও ব্যাকরণ, প্রাচীন ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি—এই বিষয়গুলিতে পারদর্শী ছিলেন অধ্যাপক হেমন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। অত্যন্ত কঠিন বিষয়কে কীভাবে বুদ্ধির আলোয় সরল করে দেখা যায় তা স্যারের কাছে ‘মহাভাষ্য’, ‘বাক্যপদীয়’ ইত্যাদি গ্রন্থ পড়ার সময় বুঝেছি। ইনি শুধু সংস্কৃত বিদ্যার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন না, তাঁর মধ্যে সমাজ সচেতনতা ছিল পূর্ণমাত্রায়। তিনি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, এককালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হয়ে নির্বাচনেও অংশ নেন। স্যার সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। ৭০-এর দশকে যখন শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতার চূড়ান্ত অবস্থা তখন কিছু লোক স্যারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারা সফল হতে পারেনি। সে সময় এসব আশ্চর্য ঘটনা ছিল না, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য স্বয়ং, অধ্যাপক গোপালচন্দ্র সেন, আততায়ীদের হাতে নিহত হন।

স্যারের প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে আসে তাঁর একমাত্র কন্যা অধ্যাপিকা নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। স্যারের হাতে তৈরি নন্দিতাদি ছিলেন অসাধারণ মেধাবিনী ছাত্রী। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে বি এ পরীক্ষায় ঈশান স্কলার হলেও তিনি যাদবপুরে চলে আসেন। সেখানেও তিনি এম এ-তে গোটা আর্টস ফ্যাকাল্টির মধ্যে প্রথম হন। তারপর এখানেই অধ্যাপক হিসাবে যুক্ত হন। তাঁর স্বভাব ছিল মধুর—ছাত্রছাত্রীরা তাঁর বিশেষ অনুগত ছিল। আমি যদিও এক সময়ে তাঁর ছাত্রী ছিলাম, তিনি আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়ো বলে বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেওয়ার অল্প পরেই আমরা দুজন অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর অকালমৃত্যুতে বিভাগের বড়ো রকমের ক্ষতি হয়েছিল। নন্দিতাদি তাঁর বাবার মতো দর্শন ও ব্যাকরণে অভিজ্ঞ ছিলেন, উপরন্তু কাব্যেও তাঁর সমান দখল ছিল। এক সময় নন্দিতাদি বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন দু বছরের জন্য। সেই সময়টা আমার পক্ষে খুব আনন্দের ছিল। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতি বছর আলোচনা সভা (সেমিনার) আয়োজন করার জন্য বিভাগ পিছু টাকা দিত। সেই টাকায় আমরা প্রতি বছর সেমিনার করতাম—এটা যেন বাৎসরিক উৎসব হয়ে গিয়েছিল। অনেক নতুন বিষয় জানা যেত, অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ হত।

আমি বিভাগে যোগ দেওয়ার সময় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবার কথা এই পরিসরে বলে ওঠা যাবে না, তাই কয়েকজনের কথা বলছি। সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কার পড়াতে এসেছিলেন চিন্ময়ীদি (অধ্যাপক চিন্ময়ী চট্টোপাধ্যায়)। খুব শান্ত মানুষ, কখনও উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি—আমরা যখন ছাত্রাবস্থায় তাঁর ক্লাস করেছি, তখনও দেখতাম, পিছনের বেঞ্চিতে যারা বসত, তারা দিদির গলা শুনতে পেত না—বার বার জিজ্ঞাসা করত, “দিদি, কি বললেন?” পোশাক আশাক, চালচলন সবই খুব সাধারণ, তাঁকে দেখলে বোঝা যেত না, কি অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাঁর! বিশেষ করে বৈষ্ণব সাহিত্য ও ভক্তিরস নিয়ে তাঁর অসাধারণ গবেষণার কাজ আছে। চিন্ময়ীদি যতক্ষণ বিভাগে থাকতেন, ক্লাসের সময়টুকু বাদে বাকি সময় লেখাপড়া নিয়েই থাকতেন—এসবই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। প্রশাসনিক কাজে তাঁর কোনো উৎসাহ ছিল না, দু’দুবার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এ ব্যাপারে খোদ উপাচার্যের অনুরোধও তাঁকে টলাতে পারেনি। আমি মাঝে মাঝেই কোনো বিষয় তাঁর কাছে বুঝতে যেতাম, কিছু লিখলে তাঁকে দেখাতে যেতাম। কী খুশি যে হতেন, কেউ লেখাপড়ার চর্চা করলে!

আমার ছাত্রজীবনের আর একজন ‘স্যারে’র কথা বলি, তিনি অধ্যাপক বিধুভূষণ ভট্টাচার্য। আমি আগেও কলেজে পড়ার সময় এঁর কাছে ‘তর্কসংগ্রহ’ পড়তে গেছি। নব্য ন্যায়ে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। এমন সরলভাবে বুঝিয়ে দিতেন, যে কোনো সমস্যাই কঠিন লাগত না। আমাদের বিভাগে একটি অধ্যাপকের পদ ছিল, Traditional Scholar-এর, অর্থাৎ যে অধ্যাপকেরা পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষা লাভ করেননি—টোল থেকে আচার্য প্রভৃতি প্রাচীন ধারার পরীক্ষাগুলি পাশ করেছেন, সেরকম অধ্যাপকদের একটা পদ ছিল। এই ধারায় যাঁরা পড়াশোনা করতেন, তাঁদের একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পড়ানো হত, যাকে বলা হত ‘পংক্তি লাগিয়ে’ পড়ানো। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি পদ, প্রতিটি মাত্রার যে প্রয়োজনীয়তা আছে, তা ছাত্রকে বোঝানো হত। আমরাও কিছু কিছু বিষয় এই ধারায় পড়েছি। অধ্যাপক ভট্টাচার্যও খুব সাধারণভাবে থাকতেন। তাঁর একটি নেশা ছিল, সিগারেট! তিনিও কট্টর বামপন্থী ছিলেন। পুজোর ছুটির পর বিশেষ করে আমাদের সহপাঠিনীদের মধ্যে অধ্যাপকদের প্রণাম করার ধুম পড়ে যেত! সুকুমারীদি কখনো কারো প্রণাম নিতেন না। পণ্ডিতমশায় বলতেন, “পায়ের ধুলো নিয়ে কিসু হবে না রে মা, পড়াশোনা করতে হবে!”

সংস্কৃত পড়তে হলে আবশ্যিক ছিল বেদ পড়া। এই বেদের পুরো পাঠ্যাংশই প্রায় পড়াতেন ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। রোগা পাৎলা মানুষ, ডায়াসের উপর ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে চক হাতে বোর্ডের উপর খসখস করে অঙ্ক কষার মতো করে মন্ত্রের পদপাঠ লিখে যেতেন—বইপত্র কিছুই দেখতে হত না। প্রশাসনিক কাজেও দক্ষ ছিলেন, দু বার সফল ভাবে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর মাথাটা বোধহয় অঙ্কেরই ছিল, প্রতি বছর পরীক্ষা দপ্তরে ট্যাবুলেশনের দায়িত্ব তিনিই পেতেন।

এই ভবানীবাবুর সহপাঠী ছিলেন রবিশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর কথা না বললে বিভাগের ইতিহাস অসমাপ্ত থেকে যাবে। ইনি সংস্কৃত অলঙ্কার ও কাব্যের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, আমি এঁর কাছেই পিএইচ ডি করেছিলাম। কিন্তু নিজের বিষয়ের বাইরেও বহু কিছু নিয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল। সংস্কৃত কাব্য ছাড়াও ব্যাকরণ, প্রাকৃত সাহিত্য, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, পুঁথি—কিছুই তাঁর অনধিগত ছিল না। যখন কোনো ছাত্রছাত্রী আমাদের কাছে গবেষণার জন্য আসত, তাকে কী বিষয় নিয়ে কাজ করতে বলা যায়, এ বিষয়ে আমরা তাঁর পরামর্শ নিতাম। বিভাগের উন্নতির জন্য তিনি সর্বদা উদ্যোগী ছিলেন; রমারঞ্জনবাবুর পর বোধহয় বিভাগের জন্য এত কেউ করেননি। তাঁরই প্রচেষ্টায় সংস্কৃত বিভাগ Department of Special Assistance (DSA) এর সম্মান লাভ করে উপরি উপরি দু বার। এর জন্য অবশ্য রমারঞ্জনবাবু সে সময় সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন। তৎকালীন বামফ্রণ্ট সরকারেরও সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল। এই প্রোগ্রাম পাওয়াতে আমরা আরও দুটি অধ্যাপকের পদ পাই, এবং প্রতি বছর বই কেনার ও গবেষণার কাজের জন্য টাকার সংস্থান হয়।

সময়টা ছিল খুব আনন্দের। অনেকগুলি ভালো সেমিনার হয় এবং বহু গবেষণার কাজ হয়, যার প্রমাণ রয়েছে সেই সময় প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থে। রবিশঙ্করবাবু নিজেও বামপন্থী এবং সমাজ সচেতন ছিলেন। তিনি যেখানে থাকতেন, সেই নিমতায় অনেক কাজ করেছেন। যাদবপুরে জাতীয় সেবা প্রকল্পের (National Service Scheme–NSS) তিনি আমৃত্যু পরিচালক ছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের দল নিয়ে তিনি প্রায়ই এখানে ওখানে যেতেন, ড্রেন পরিষ্কার করা, পথঘাট সংস্কার করা, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষার সহায়তা করা—এই সব কাজ নিয়মিত করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও ঝিল ও ময়দান সংস্কার করা, গাছ লাগানো, এসব করতেন। তাঁদের হাতে লাগানো দেবদারু গাছ বোধহয় এখনো আছে।

এই প্রসঙ্গে আমাদের বিভাগের আর একজন অধ্যাপকের নাম করতে হয়, তিনি মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বিষয়েও বলতে হয়, তাঁর অনধিগত কোনো বিষয়ই ছিল না। বিশেষ করে পুঁথি, ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, সামাজিক পরিবেশ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র—সবই তাঁর নখাগ্রে ছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি দীর্ঘকাল এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। দুঃখের বিষয়, এই দুজনেরই অকালমৃত্যু হওয়ায় তাঁরা অনেক কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।

এর পর বিভাগের ইতিহাসের কথা বলতে হলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের কথা দু একটি বলতে হয়। এই সময়টাতে আমরা চারজন—রবিশঙ্করবাবু—আমার ‘মাষ্টারমশায়’, মানবদা, নন্দিতাদি ও আমি—এই চারজনে মিলে কাজ করতাম। ভালোই চলছিল, কিন্তু এর পরে নন্দিতাদি কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। নন্দিতাদির অকালমৃত্যু ঘটেছিল কম বয়সে।

মোটামুটি এই সময়ের কিছু পূর্বে আমাদের নতুন কয়েকজন সহকারী যোগ দেন, তাঁরাও কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপিকা শর্বাণী গঙ্গোপাধ্যায় (নব্য ন্যায়), পিয়ালী প্রহরাজ (স্মৃতি ও ধর্মশাস্ত্র), ললিতা সেনগুপ্ত (কাব্য ও বেদান্ত), দেবার্চনা সরকার (লিপিবিদ্যা, পুঁথি, কাব্য ও অর্থশাস্ত্র), প্রদ্যোৎকুমার দত্ত (বেদ), ঋতা চট্টোপাধ্যায় (কাব্য) ও আরও কয়েকজন।

১৯৯৭ সালে রবিশঙ্করবাবুর উদ্যোগে ‘All India Oriental Conference’-এর আয়োজন করা হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে দ্বিতীয়বার এই সভার আয়োজন। রবিশঙ্করবাবু ছিলেন স্থানীয় সম্পাদক, মানবদা সহকারী স্থানীয় সম্পাদক। আমি ছিলাম কোষাধ্যক্ষ—আজব ব্যাপার, কারণ কোষে কিছুই ছিল না। তবে আমাকে অনেকগুলি কাজ করতে হয়েছিল বলে একটা পদের প্রয়োজন ছিল। এ সময় অর্থের প্রয়োজন ছিল, কারণ সভার পরিচালন সমিতি খুব সামান্য টাকা আমাদের দিয়েছিলেন। সভার ব্যবস্থা করা, যে সব যোগদানকারী নানা দিক থেকে আসছেন তাঁদের থাকার ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি ব্যবস্থা করবার প্রয়োজন ছিল। দুঃখের বিষয় সে সময় যিনি উপাচার্য ছিলেন, তিনি আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। যাই হোক, আর্টস ফ্যাকাল্টির ডীন, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সাহা, অর্থসচিব প্রমুখ সাহায্য করেছিলেন। আর্থিক দিকটাও সামাল দেওয়া গেল তৎকালীন বামফ্রণ্ট সরকারের সহায়তায়। ক্রীডামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী যুবভারতীর অতিথি নিবাসে খুব কম খরচে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী, সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন অর্থমন্ত্রী (প্রাক্তন) অশোক মিত্র। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত কিছু ব্যয় হয়নি। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ও অন্যান্য প্রাক্তন ছাত্রীরা গানের অনুষ্ঠান করেন বিনা পারিশ্রমিকে। আমার ছোট মাসি সুচিত্রা মিত্র বিনা পারিশ্রমিকে গান গাইতে আসেন। শেষ দিনে সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের সদস্যরা নাট্যাভিনয় করেন। এত বড়ো অনুষ্ঠান হল অথচ কোনো দুর্বচন শুনতে হল না, এ তো হয় না। সেরকম অভিজ্ঞতাও হয়েছিল, তবে সেসব ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। নানা বিষয়ের উপর আলোচনা হয়েছিল, আমাদের সহকর্মীরাও তাতে যোগ দিয়েছিলেন। আমারও একটি পেপার পড়ার বাসনা ছিল, কিন্তু আগেকার দিনে যেমন নিমন্ত্রণ বাড়িতে পরিবেশনকারীদের খাওয়া হত না, তেমনি কাজের চাপে আমারও পেপার পড়া হয়নি!

আমি যখন বিভাগে প্রথম শিক্ষকতায় আসি, তখন ছাত্রসংখ্যা খুব কম ছিল। বিশেষ করে স্নাতক বিভাগে কখনও একজন, কখনও দুজন, কখনও বা একজনও থাকত না। স্নাতকোত্তর শ্রেণীতেও মাত্র সাত আট জন ভর্তি হল—এমনও দেখেছি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করতাম যাতে ভালো ছাত্রছাত্রী বিভাগে আসে। বিশেষত এসএসসি চালু হবার পর চাকরির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় দলে দলে ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করে। এখন সেই এসএসসি পাশ করা হতভাগ্য ছাত্রদের অবস্থা দেখলে কষ্ট পাই।

বিভাগে ডিএসএ চালু হবার কথা আগেই বলেছি। এর পর দ্বিতীয় কিস্তিতে রবিশঙ্করবাবুর নিরলস উদ্যমে ও রমারঞ্জনবাবুর সহৃদয় সহায়তায় আবার আমরা ডিএসএ পাই। এবার রবিশঙ্কর বাবু মানবদাকে নিজের সহকারী করে নিলেন। দুঃখের বিষয়, ২০০১ সালে তাঁর অকালমৃত্যু হয়। এর পরে মানবদা ডিএসএ’র ভার নেন। কিন্তু বয়স তাঁরও বাড়ছিল, অবসর নেবার সময় এগিয়ে আসছিল, তাই শেষ ছমাস আমি ডিএসএ’র পরিচালনভার নিতে বাধ্য হই। ডিএসএ পর্ব শেষ হলে আমরা চেষ্টা করতে থাকি Centre for Advanced Study in Sanskrit (CASS) বিভাগে আনতে। অগ্রজপ্রতিম অধ্যাপকদের সহায়তায় আমরা শেষ পর্যন্ত এই সম্মান লাভ করি—সে সময় পূর্বভারতে এই ধরনের কেন্দ্র এই একটিই ছিল। এর আগেই আমাদের বিভাগীয় প্রধান ললিতা সেনগুপ্তের উদ্যমে AHSISS (Assistance for the Strengthening of the Infrastructure of the Humanities and Social Sciences) পেয়েছিলাম। সময়টা সমৃদ্ধির কাল।

তারপরে আমরা একে একে বিভাগ থেকে বিদায় নিলাম। অনেকেই চলে গেলেন। আমার অবসর গ্রহণের পরে CASS আর এক কিস্তি পাওয়া গিয়েছিল, তখন আমার সহকর্মী দেবার্চনা সরকার এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন এসব অনুদান আর পাওয়া যায় না। এ রাজ্যেও শিক্ষাব্যবস্থার প্রবল দুর্দিন। তবু আমাদের বিভাগে এখনও সেই আগের উদ্যমে কাজ করার প্রচেষ্টা যখন দেখি, খুব আনন্দ হয়।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: অধ্যাপক সুকুমারী ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক হেমন্ত গাঙ্গুলি, সংস্কৃত বিভাগের পুনর্মিলন উৎসব

মন্তব্য তালিকা - “সংস্কৃত বিভাগ—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়; ফিরে দেখা”

  1. এতদিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালযের সংস্কৃত বিভাগের একটা নির্ভরযোগ্য ঠিকুজি পাওযা গেল, এই ঐতিহ্য পরম্পরা রক্ষায দায আমাদের সকলের।🙏

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।