ইসলাম, সংশয়বাদ ও আল গাজ্জালি
‘ইসলাম’ শব্দের একটি অর্থ হল আত্মসমর্পণ। এই যে নিজেকে সমর্পণ তা হবে নিঃসংশয় অর্থাৎ এতে কোনও সংশয় থাকবে না। নিশ্চিন্ত ও সংশয়শূন্য চিত্তে আল্লাহ-র প্রতি নিজেকে সমর্পিত করেন একজন মোমিন বা বিশুদ্ধ মুসলমান। সেখানে সন্দেহ বা সংশয়ের কোনও স্থান থাকে না। কিন্তু যদি সৃষ্টির আদিতে চলে যায়, সেমেটিক পুরাণে আদমের যে আদি পাপ তা হল এক ধরণের সংশয়বাদ। একনিষ্ঠ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সন্দেহ। আদম ও ইভ যে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলেন তা ঈশ্বরের নিয়মের বিরুদ্ধে চলে গেল। সদা প্রভুর প্রতি প্রথম মানব ও মানবীর যে আনুগত্য তা রক্ষিত হল না। ঈশ্বর তাঁদের সামনে রিয়ালিটি বা দুনিয়ার যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন তাতে আদম ও ইভ সন্তুষ্ট না হয়ে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে দেখতে চাইলেন কী হয়। এখানে শয়তান তাঁদের প্রলুব্ধ করেছিল। আবার ঈশ্বর তাঁদের বারণ করেছিলেন। ঈশ্বরের বারণ এবং শয়তানের প্রলোভন এই দুয়ের মধ্যে আদম ও ইভ বেছে নিলেন একটিকে। এতে করে বোঝা যায় যে সংশয়বাদ হল আদম ও ইভের চরিত্রের একটি মূল বৈশিষ্ট্য। এটি শুধু পুরুষের ক্ষেত্রে ঘটেনি, ঘটেছে নারীর ক্ষেত্রেও। এটা মনে রাখা দরকার যে, ইসলামি পুরাণে ইভ বা হবা বিবি আদম থেকে একটি পৃথক সত্তা এবং তিনি আদমের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্ট নন। হবা বিবিকে আদমের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য তৈরি করা হয়নি। যদিও এমন কথা ইহুদি ও খ্রিস্টান পুরাণে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হজরত আদম ইসলাম ধর্মের প্রথম পয়গম্বর, শেষ হলেন মুহাম্মদ। মুহাম্মদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ কোরান অবতীর্ণ হয়।
কোরানে সংশয়বাদ আদৌ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা বেশ দুরূহ। তার কারণ হল একই কোরানের নানা রকম ভাষ্য। কোরানে দু ধরনের আয়াত আছে, মুহকামাত ও মোতেশাবেহাত। প্রথম প্রকার আয়াতের ক্ষেত্রে সহজ শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করা হয় কিন্তু মোতেশাবেহাত আয়াতের অর্থ হল দুরূহ এবং রূপক।
ইসলাম অনুসরণকারী দার্শনিকদের সকলেই যে কেবলমাত্র কোরান ও হাদিস মেনে দর্শন চর্চা করেছেন এমন নয়। বরং গ্রিক দর্শনের প্রতি বহু দার্শনিকের বেশি আগ্রহ দেখা গিয়েছে এবং তাঁদের লেখালেখিতেও গ্রিক দর্শনের প্রভাব কোরান-হাদিসের তুলনায় বেশি। এমনকি গ্রিক দর্শনের সঙ্গে যেখানে ইসলামের বিরোধ আছে সেখানেও কেউ কেউ গ্রিক দর্শনের পক্ষপাতিত্ব করেছেন। এই সব মুসলিম দার্শনিকদের নাম আল কিন্দি, ইবনে সিনা, আল ফারাবি, ইবনে রুশদ প্রমুখ। তাঁরা সকলেই মুসলিম দার্শনিক, ইসলামীয় দার্শনিক নন। এই সকল ভাবুকদের মধ্যে ইবন রুশদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেননা তাঁকে ইউরোপের নবজাগরণের পিতামহ বলা হয়।
এইখানে আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১) বাকিদের তুলনায় একেবারেই পৃথক ছিলেন। তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বই হল– তহাফুত আল ফালাসিফা—দার্শনিকদের অসঙ্গতি। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ইসলামি ধর্মতত্ত্বের আশারীয় সম্প্রদায়ের একজন ছাত্র ছিলেন তিনি। আশারীয় স্কুল সুন্নি ইসলামের একটি শাখা, যাঁরা শরিয়তি বাধানিষেধকে মান্য করে একটি গোঁড়া নির্বিচারবাদী বিধি রচনা করেছিলেন। আশারীয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন আবু হাসান আল আশারী (মৃত্যু ৯৩৬ খ্রি)।
আশারীয় স্কুলের সদস্য হিসাবে গাজ্জালি অ্যাভিসিনীয় সম্প্রদায় (ইবনে সিনা সম্প্রদায়)-এর সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন। ইবনে সিনা ছিলেন একজন পলিম্যাথ বা বহুমুখী প্রতিভাধর চিন্তক। তাঁকে আধুনিক মেডিসিনের জনক বলা হয় বটে, কিন্তু তাঁর বড় পরিচয় হল তিনি একজন অ্যারিস্টটলপন্থী দার্শনিক। তাঁর মতে, উপলক্ষবাদ ও ইসলামি দর্শন পরস্পরবিরোধী। গাজ্জালির লেখা তাহফুত আল ফলাসিফা গ্রন্থে ইবনে সিনার পাশাপাশি আল ফারাবির সমালোচনাও আছে। আল ফারাবিও ইসলামি চিন্তার তুলনায় গ্রিক দর্শনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আল ফারাবি (৮৭২-৯৫১) ইবনে সিনার তুলনায় প্রবীণ এবং তাঁকে অ্যারিস্টটলপন্থীরা ‘দ্বিতীয় গুরু’ বলে অভিহিত করেন, যেখানে অ্যারিস্টটল হলেন ‘প্রথম গুরু’।
আল গাজ্জালির তাহফুত আল ফলাসিফা ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি এই গ্রন্থে মূলত অ্যারিস্টটলীয় দর্শনকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন।
আল গাজ্জালির যে সংশয়বাদ তা তাঁকে একটি ধর্মীয় উপলক্ষবাদের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই উপলক্ষবাদ বলে যে কার্যকারণ কোনও অনিবার্য সংযোগ নয় বরং তা হল ঈশ্বরের অমাধ্যম ও বর্তমান ইচ্ছা। যদিও গাজ্জালি ছিলেন প্রথাগত দার্শনিকদের বড়োসড়ো সমালোচক, তবু এই মত প্রমাণ করে যে তিনি দর্শনের একজন বড় বোদ্ধা এবং দর্শনের ক্ষেত্রকে তিনি ভালভাবে অধ্যয়ন করেছেন। দীর্ঘকাল দর্শনের নিবিড় পাঠ তাঁকে দার্শনিক পদ্ধতির সমালোচনায় উদ্বুদ্ধ করে। সেই সমালোচনা মূলত সংশয়াত্মক যুক্তিসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত।
জীবনের শেষ ভাগে গাজ্জালি একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। সেই আত্মজীবনীর নাম হল আল মুনকিদ মিন আল-দালাল—ভ্রান্তি থেকে মুক্তি বা নিরসন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যা থেকে কীভাবে তিনি মুক্তি পেলেন। একটা ঐশ্বরিক আলো বা নুর ই ইলাহি তাঁকে সংশয়বাদ থেকে মুক্তি দেয়। কালামের যুক্তিসমূহ, ইসলামি দর্শন ও ইসমাইলি মতবাদ এই বিষয়ে তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করে।
কালাম হল বাণী, ইসলামি ধর্মতত্ত্বের একটি বৌদ্ধিক রূপ। কেউ কেউ একে বলেন সায়েন্স অব ডিসকোর্স বা প্রকরণ বিজ্ঞান অর্থাৎ আলোচনার বিদ্যা। ইসলামি দর্শন হল ফলাসাফা। ফলাসাফা যুক্তিবিজ্ঞান, গণিত এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফালাসিফা বলতে দার্শনিক বোঝানো হয়।
ইসমাইলিরা শিয়া সম্প্রদায়ের একটি শাখা। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ২৩ বছর ধরে দেবদূত জিব্রাইলের মাধ্যমে হজরত মহম্মদের কাছে কোরান প্রেরিত হয়েছিল। ঐশী গ্রন্থ কোরানের ব্যাখ্যা করার কর্তৃত্বের অধিকারী হলেন ইমামগণ। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেই ভাষ্য তাঁরা রচনা করে থাকেন। ইসমাইলিরা জাহির ও বাতিনের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। জাহির হল প্রকাশ্য অর্থাৎ সেই সব বস্তু যাদের প্রকাশ্য অর্থ আছে, অন্য দিকে বাতিন হল সেই সব বস্তু যাঁদের অন্তরঙ্গ অর্থ আছে। এই প্রসঙ্গে কোরানের দু ধরনের আয়াতের কথা স্মরণীয়—মুহকামাত ও মোতাশেবেহাত।
গাজ্জালি মনে করেন, তত্ত্ব নির্মাণ ও বোঝার ক্ষেত্রে কালাম ও ফালাসাফার বেশ গুরুত্ব আছে কিন্তু কালাম, ফালাসাফা ও ইসমাইলি তত্ত্ব চিন্তার ক্ষেত্রে আবশ্যিক হলেও পর্যাপ্ত নয়। চরম সত্যকে বা মূল্যকে জানতে গেলে এইগুলির সঙ্গে প্রয়োজন মরমিয়াবাদী অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি। আর এই দুটি আসে সুফি অনুশীলন থেকে।
উইলিয়ম জেমস তাঁর ভ্যারাইটি অব রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স নামক গ্রন্থে আল গাজ্জালির আত্মজীবনী (মুনকিদ মিন আল-দালাল—ভ্রান্তি থেকে মুক্তি)-কে তাঁদের পক্ষে জরুরি নথি বলেছেন যাঁরা হলেন “the purely literary student who would like to become acquainted with the inwardness of religions other than the Christian”। সাহিত্যের সেই সব শিক্ষার্থীরা যাঁরা খ্রিস্ট ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের অন্তর্মুখিনতা সম্পর্কে জানতে চান তাঁদের এই গ্রন্থ পাঠ করা কর্তব্য কারণ এই বইতে ধর্মীয় স্বীকারোক্তি ও আত্মজৈবনিক সাহিত্য রয়েছে যা খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যে কমবেশি দেখা যায়।
মধ্যযুগের সংশয়বাদের ইতিহাসে দু জন ইসলামি চিন্তাবিদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন নিঃসন্দেহে আল গাজ্জালি, যাঁকে পাশ্চাত্য দুনিয়া আল গাজেল বলে অভিহিত করে থাকে। তিনি সারা জীবন জুড়ে মধ্য এশিয়ার নানা জায়গা ভ্রমণ করেছেন এবং সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন এখনকার ইরান ও ইরাকে। আল হায়তাম হলেন দ্বিতীয় চিন্তাবিদ, তাঁর সময়কাল ৯৬৫ থেকে ১০৩৯ খ্রিস্টাব্দ। জন্ম হয় বর্তমান ইরাকের বসরা শহরে। আল হায়তাম মূলত বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে চর্চা করেন। সে বিষয়ে তাঁর বহু গ্রন্থ আছে। গাজ্জালি ও হায়তাম ছাড়া রাজি (১১৪৯-১২১০ খ্রি) এবং তূসী (১২০১—১২৭৪ খ্রি)-র নাম করা যায়, যদিও তাঁরা সংশয়বাদী নন কিন্তু তাঁরা সারা দুনিয়ার বিভিন্ন সংশয়বাদ সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং তাঁদের ফার্স্ট প্রিন্সিপল সম্পর্কে যথার্থ ও সুনিশ্চিত জ্ঞান ছিল। এই দুই জ্ঞানের জন্য সংশয়বাদের বৃহত্তর আঙিনায় তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়।
আল হায়তাম ইবনে সিনার সমসাময়িক চিন্তাবিদ। তাঁর লেখা কিতাব আল-মানাজির ( দৃষ্টিসংক্রান্ত গ্রন্থ) পরবর্তীকালের সংশয়বাদ সংক্রান্ত ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য বই। তাঁর আরবি পাঠক ছাড়াও এই বইটি পাশ্চাত্যে বহুল পঠিত ও চর্চিত। রোজার বেকন (১২১৪—১২৯৪ খ্রি) এই বইটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। মধ্যযুগে তাঁর এই প্রত্যক্ষসংক্রান্ত সন্দর্ভ প্রায় সব চিন্তাবিদকে স্পর্শ করেছিল।
আল হায়তাম মনে করতেন, আমাদের বহু প্রত্যক্ষ হল অনুমানমূলক। এমন অনেক উদাহরণ তিনি তাঁর বইতে ব্যাখ্যা করেছেন। ওই প্রত্যক্ষগুলিকে আমরা সহসা অপ্রত্যক্ষ অনুমানের দ্বারা অনুভব করি, অপরোক্ষভাবে উপলব্ধি করি না। এই অনুমান প্রক্রিয়া এত তাড়াতাড়ি ঘটে যে আমরা সেগুলোকে অপরোক্ষ বলে মনে করে থাকি, আসলে তা অপ্রত্যক্ষ। আপাত স্বতঃসিদ্ধ বচনগুলিও অনুমানমূলক, যেমন—সমগ্র হল অংশের চেয়ে বৃহত্তর। এই অনুমানপ্রক্রিয়ায় জ্ঞানীয় ভ্রান্তি থেকে যাওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়ে যায়।
আল হায়তাম তাঁর গ্রন্থে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিসংক্রান্ত অধ্যাসের উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন, চাঁদ যখন নিম্ন দিগন্তে থাকে তখন তাকে উঁচু আকাশের তুলনায় অনেকটা বড় দেখায়। নদীতে ভাঁটার দিকে যখন নৌকা এগোয় তখন তীরবর্তী গাছগুলোকে চলমান বলে প্রতীত হয়। যদিও আল হায়তাম সংশয়বাদী নন, তবু তাঁর দেওয়া উদাহরণগুলি পরবর্তীকালে সংশয়বাদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উপাত্ত বলে বিবেচিত হয়।
আল গাজ্জালির মুনকিদ মিন আল-দালাল বা ভ্রান্তি থেকে মুক্তি নামক আত্মজীবনীর বহু অংশ পড়লে বোঝা গাজ্জালি ছিলেন কার্তেজীয়। অবশ্য দেকার্ত আল গাজ্জালির অনেক পরবর্তী এবং কার্তেজীয় মতবাদও তাই।
দর্শনের দুটি মৌল সমস্যার সমাধান খুঁজতে আল গাজ্জালি পদ্ধতিগত সংশয়বাদ ব্যবহার করেছিলেন। সেই দুই সমস্যা হল—১) জ্ঞান কীভাবে পাওয়া যায়, এবং ২) কীভাবে জ্ঞানের যথার্থতা নির্ণয় করা যায়।
নিশ্চিত জ্ঞানের দরজায় পৌঁছনোর জন্য তিনি ভ্রান্তি ও বিপর্যয়রহিত জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। নিশ্চয়তামূলক জ্ঞান বলতে তিনি বোঝেন সংশয়শূন্য জ্ঞান। তাঁর কাছে নিশ্চিত জ্ঞান হল “that in which what is known is laid bare in such a way as to leave no room for doubt, and is unaccompanied by the possibility of error or illusion, to the point that the mind cannot even conceive it.” (ভ্রান্তি থেকে মুক্তি ৮২)
আল গাজ্জালি ও দেকার্তের মধ্যে সংযোগের জায়গাটি হল সংশয়বাদের পদ্ধতিগত ব্যবহার। তাঁরা দুজনেই আত্মনিষ্ঠাকে আশ্রয় করে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক প্ল্যাটফর্ম রচনা করেছিলেন। এবং বস্তুর নিশ্চয়তাকে সন্দেহ করার বেশ কয়েকটি হেতু গাজ্জালি বলেছেন।
এক, পরস্পর প্রতিযোগী তত্ত্বসমূহ আমাদের মনে প্রাথমিক সন্দেহ জাগিয়ে তোলে।
দুই, ইন্দ্রিয়জ সংশয়বাদের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র ( যেমন, সূর্যের প্রেক্ষিতে যে ছায়া পড়ে তাকে নিশ্চল বলে মনে হলেও আসলে তা চলমান অর্থাৎ দিনের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি বাড়তে বা কমতে থাকে)। এই প্রত্যক্ষসংক্রান্ত তথ্যসমূহ তাঁকে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর এই সন্দেহ থেকে তিনি বলেন—
তিন, জ্ঞানের আর একটি বৃত্তি হল যুক্তি যা ত্রুটিপূর্ণ। প্রতীত যৌক্তিক সত্যও মিথ্যা হতে পারে।
শেষে গাজ্জালি স্বপ্ন সংশয়ের কথা বলেন। তিনি বলছেন–
“When these notions occurred to me and made an impression on my mind, I sought a cure but found none. For they could only be rebutted with a proof, and a proof can only be constructed by combining the first [principles of] knowledge. If these are not given, then it is impossible to arrange a proof. This disease defied all cure and lasted for almost two months, during which I embraced the [skeptical] creed in actual fact, though not in speech or expression. Eventually, God cured me of this disease and my mind was restored to health and balance. The rational necessary beliefs were once again accepted and trusted, both securely and certainly. This did not come about by composing a proof or by an arrangement of words, but rather by a light that God almighty cast into my breast, which is the key to the greater part of cognizance. Whoever supposes that enlightenment depends upon explicit proofs has narrowed the expanse of God’s mercy.” (ভ্রান্তি থেকে মুক্তি ৮৬)
এর বাইরে গাজ্জালি তাঁর তাহফুত আল ফালাসিফা গ্রন্থে কার্যকারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, যদিও তাঁর সিদ্ধান্ত হল, সমস্ত কার্যকারণ শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরে গিয়ে শেষ হয়। তিনি মনে করেন, কার্য ও কারণের মধ্যে কোনও অনিবার্য সংযোগ নেই। যে সতত সংযোগ তাদের মধ্যে দেখা যায় তা হল মানুষের অভ্যাস এবং কারণ ও কার্যের মধ্যে কোনও আবশ্যকি সম্পর্ক নেই। এই তত্ত্ব আমাদের পরবর্তীকালের ডেভিড হিউমকে মনে করিয়ে দেয়। যদিও তিনি হিউমের মতো অভিজ্ঞতাবাদী বা কান্টের মতো বুদ্ধিবাদী ছিলেন না। যুক্তি বা প্রমাণের উপর তাঁর বিশ্বাস সাধারণ চিন্তাবিদের মতো ছিল না। গাজ্জালির লেখা বিখ্যাত বই ‘ভ্রান্তি থেকে নিরসন’-এ তিনি বলছেন, যুক্তি বা প্রমাণ নয়; বরং আমার অন্তরাত্মায় উদ্ভাসিত ‘খোদায়ি আলোক রশ্মি’ (নুর ই ইলাহি) আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছে। এই নুর ই ইলাহি কী, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তা কি স্বজ্ঞা নাকি অতীন্দ্রিয় কোনও অনুভব?
গাজ্জালির ভাষায়, যুক্তি নয়, এমনকি কোনও প্রমাণও নয়, নুর ই ইলাহি বা ঈশ্বরের আলো আমাকে সঠিক পথের দিশা দেয়। জ্ঞান হল বিশ্বাসের বস্তু, বুদ্ধির বিষয় নয়। তিনি ইসলাম-স্বীকৃত প্রথম নবি হজরত আদমকে স্মরণ করে বললেন, জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া নিষিদ্ধ। বিনা বিচারে খোদার ইচ্ছাকে সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে হবে। গাজ্জালি এই ভাবে সংশয়বাদ ছেড়ে নির্বিচারবাদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। আদি মানব নির্বিচারবাদ থেকে সংশয়বাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন।
আমরা এখন ফিরে যাব আল গাজ্জালির বিখ্যাত বই তাহফাত আল ফালাসিফায়। সেখানে তিনি কুড়িটি যুক্তি দিয়ে দার্শনিকদের যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করেছেন। এই কুড়িটি যুক্তিই সংশয়াত্মক যুক্তি বা skeptical argument। তাঁর এই যুক্তিসমূহে খ্রিস্টীয় দার্শনিক বা বলা ভাল ধর্মবেত্তা জন ফিলোপোনাস (John Filoponous)-এর প্রভাব আছে। চিন্তাবিদদের দুটো ট্রাডিশন—একটি দার্শনিক বা ফিলোসফিক্যাল এবং অন্যটি ধর্মীয় বা থিওলজিক্যাল। অ্যারিস্টটল, আল কিন্দি, আল ফারাবি, ইবন সিনা প্রমুখ হলেন ফিলিসফিক্যাল বা দার্শনিক। আল গাজ্জালি হলেন ধর্মীয় বা থিওলজিক্যাল ধারার। ফিলসফিক্যাল ট্রাডিশন আবার দুই ভাগে বিভক্ত—বৌদ্ধিক বা র্যাশনাল এবং সংশয়াত্মক বা স্কেপিটিক্যাল। আল গাজ্জালির সিদ্ধান্ত হল থিওলজিক্যাল। প্রথম যুক্তিতে তাঁর সিদ্ধান্ত—বিশ্ব হল সৃষ্ট বা world is created. তিনি ‘জগৎ অনাদি’ দার্শনিকদের এই সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করছেন যে যুক্তি দিয়ে তা হল সংশয়াত্মক বা স্কেপ্টিক্যাল।
অ্যারিস্টটল প্রমুখ দার্শনিক বলছেন, ঈশ্বর অনাদি এবং জগৎ অনাদি। জগৎ সৃষ্ট নয়। তাহলে একটি অন্যটির কারণ হবে কী করে? আরিস্টটলের চার কারণ দেখলে বোঝা যায়, ঈশ্বর হলেন নিমিত্ত কারণ এবং তিনি উপাদান কারণ নন বরং ঈশ্বর হলেন প্রধান চালকযন্ত্র বা God is prime mover.
সেমীয় ধর্ম ও পুরাণে বিশ্ব হল সৃষ্ট। সেখানে বলা হয়েছে, আদিতে ঈশ্বর আকাশ ও দুনিয়া সৃষ্টি করলেন। দুনিয়া আকারবিহীন ও শূন্য ছিল এবং অন্ধকারে ঢাকা গভীর জলের উপরে ছিল… ইত্যাদি। মোট ছয় দিনে এই সৃষ্টি কাজ শেষ করে সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম করলেন। পুরনো ও নতুন টেস্টামেন্ট সে কথাই বলে। ইসলাম ধর্মের গ্রন্থ কোরানের বিভিন্ন আয়াতে এই ‘বিশ্ব সৃষ্ট’ মতকে সমর্থন করা হয়েছে।
সুরা নমল-এর ৬৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আচ্ছা কে সৃষ্টির সূচনা করেন তার পর তার পুনরাবর্তন ঘটান, আর কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিজক দান করেন? আল্লাহ-র সঙ্গে কি অন্য উপাস্য আছে? বলো—‘নিয়ে এসো তোমাদের দলিল দস্তাবেজাদি তোমরা সত্যবাদী হও’।”
এছাড়া কোরানের ষষ্ঠ সুরা (অধ্যায়)-র ৭৩ নং আয়াত (verse)-এ, ৪১ অধ্যায়ের দ্বাদশ আয়াতে, সপ্তম অধ্যায়ের ৫৪ আয়াতে জগৎকে সৃষ্ট বলা হয়েছে যার সৃষ্টিকর্তা হলেন আল্লাহ। অ্যারিস্টটল ও তাঁর অনুগামী দার্শনিকরা বিশ্বকে সৃষ্ট বলতে সম্মত নন।
দার্শনিকদের প্রথম যুক্তিঃ
জগৎ সৃষ্ট নয়, তা অনাদি। কারণ ঈশ্বর অনাদি, তিনি সৃষ্ট নন। সুতরাং ঈশ্বর থেকে নির্গত জগৎ অনাদি হবেই। বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পূর্বেই ‘সম্ভব’ (latent) ছিল, ঈশ্বর ইচ্ছে করলেই তা সৃষ্টি করতে পারতেন। সর্বদায় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব এমন কিছুকে নতুন বলা যায় না। ঈশ্বরের সত্তার মধ্যে নতুন ইচ্ছা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। প্রথমে আল্লাহ-র ইচ্ছা ছিল না, পরে তাঁর জগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা হল—এমন ভাবলে আল্লাহ-র সত্তায় পরিবর্তন সূচিত হয়।
প্রথম যুক্তির উত্তরঃ
বিশ্বজগতের অনাদিত্ব সম্পর্কে দার্শনিকদের মতবাদকে গাজ্জালি নিতান্ত অনুমান বলে আখ্যায়িত করেন। এই অনুমানের ভিত্তিও অযৌক্তিক। আল গাজ্জালি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ‘অনাদি ইচ্ছা’ এবং ‘বিশ্বজগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা’—এই দুই ভাগে বিভক্ত করেন। তিনি বলেন, বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের ‘বিশ্বজগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা’ একমাত্র ইচ্ছা। জগৎ সৃষ্টির কারণ হল ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির বাসনা। আর এই কারণটির কারণ হল ঈশ্বরের ‘অনাদি ইচ্ছা’। ‘অনাদি ইচ্ছা’-র যে কারণ থাকার প্রয়োজন নেই, সে কথা দার্শনিকরা স্বীকার করেন। অতএব, ঈশ্বরের ‘বিশ্বজগৎ সৃষ্টির ইচ্ছা’-র দ্বারাই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই একে অনাদি বলা আবশ্যক নয়, এর আদি বা আরম্ভ আছে। জগৎকে সৃষ্ট বলাই যুক্তিযুক্ত। দার্শনিকদের মতে, অনাদি বিষয় শুধুমাত্র একটি—তিনি ঈশ্বর। পাশাপাশি, বিশ্বজগৎকে অনাদি বলায় তাঁদের নীতি স্ববিরোধী হয়ে পড়ে।
গাজ্জালি দাবি করেন, ঈশ্বর এবং বিশ্বজগৎ দুটোকে অনাদি বলা যাবে না। একটিকে সৃষ্ট বলে মানতে হবে। আর এই যুক্তিতে বিশ্বজগৎকে অনাদি বলে অস্বীকার করতে হবে, তাঁকে সৃষ্ট বলতে হবে। নচেৎ ঈশ্বর সৃষ্ট হয়ে পড়েন। তা হবে আরও অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন সিদ্ধান্ত। ঈশ্বরকে সৃষ্ট বলে মানতে দার্শনিকরাও নারাজ।
গাজ্জালি জগতের অনিত্যতা বিষয়ে বহু যুক্তির অবতারণা করেছেন। তিনি আত্মার একত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রত্যেক মানুষের আত্মা ভিন্ন বা স্বতন্ত্র। যা স্বতন্ত্র তা বিভক্ত হতে পারে এবং সে জন্য আত্মা হল সৃষ্ট। এই প্রসঙ্গে স্মরণে রাখা দরকার যে, গাজ্জালি সর্বেশ্বরবাদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সর্বেশ্বরবাদ জগৎকে নিত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
দার্শনিকরা বলেন, নিত্য বা অনাদি ঈশ্বরের থেকে কোনও সৃষ্টি সম্ভব নয়। গাজ্জালি এই মতকে খারিজ করেন। এখানে তিনি কোরানের সাহায্য নিয়ে যুক্তি দিয়েছেন। খোদার পক্ষে নতুন জিনিস সৃষ্টি করা সম্ভব। এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টির কাহিনি পুরনো, নতুন টেস্টামেন্টের পাশাপাশি কোরানে উল্লিখিত হয়েছে।
দার্শনিকদের মতে, কাল ও গতি কোনও নব সৃষ্টি নয়; এ দুটিই হল অনাদি অর্থাৎ এদের শুরু নেই। দার্শনিকরা এও বলেন যে, দেশ হল সসীম কিন্তু কাল হল অসীম। গাজ্জালি এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, দেশ ও কাল খোদা সৃষ্টি করেছেন। গতিও তাঁর সৃষ্টি।
চতুর্থ সমস্যা ২৯
দার্শনিকরা বলেন, প্রতিটি কার্যের পিছনে একটি কারণ থাকে এবং এই ভাবে পিছোতে থাকলে একটিমাত্র কারণে সব কারণের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এই কারণটি হল আদি কারণ বা আদি নিয়ম (First cause or first principle)। এই আদি কারণ বা আদি নীতি হলেন ঈশ্বর যিনি অনাদি।
গাজ্জালি বলেন, দার্শনিকদের এই আদি কারণটি কোরান হাদিসে বর্ণিত আল্লাহ হতে পারেন না। আদি কারণ কী করে অনাদি হবে? আদি কারণ যদি অনাদি হয় তবে আদি কারণ থেকে নির্গত জগতের বস্তুগুলিও অনাদি হবে। অনাদি থেকে অনাদি এবং সৃষ্ট থেকে সৃষ্ট বস্তু নির্গত হয়। জগতের কোনও বস্তুই অনাদি নয়, সবই সৃষ্ট। ঈশ্বরের ইচ্ছাশক্তিই সকল কিছুর সৃষ্টির কারণ। এর জন্য আদি কারণ হিসাবে অনাদি ঈশ্বর মানার দরকার নেই। দার্শনিকরা কার্য-কারণ নীতিকে কেবলমাত্র কাল হিসাবে প্রয়োগ করেন, দেশ হিসাবে একে দেখেন না। তাঁদের করণসমূহ ‘পূর্ব’, ‘পর’ এই ভাবে বর্ণিত। অমুক রাজার পূর্বে বা পরে তমুক শাসক রাজত্ব করতেন। দেশের উল্লেখ না থাকায় এই কার্যকারণ ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে।
পঞ্চম সমস্যা
যে যুক্তি ও পদ্ধতি দিয়ে ঈশ্বরের একত্ব প্রমাণ করেছেন দার্শনিকরা তাকে খণ্ডন করেছেন গাজ্জালি। দার্শনিকরা বলেন, ঈশ্বর যদি দু জন হন তাহলে দু জনই সব দিক থেকে সমান হতেন এবং একই গুণের অধিকারী হতেন। দুটি জিনিস যদি সব দিক থেকে যদি একই হয় তাহলে তাদের আর ভিন্ন বলা যায় না, তারা এক। গাজ্জালি বলছেন, দুটি বিষয়ের মধ্যে দেশ, কাল ও গুণ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে পার্থক্য না থাকলে তার অভিন্ন হবে। কিন্তু তাদের আদি কারণের মধ্যে এরূপ গঠন রয়েছে বলে প্রমাণ নেই।
ষষ্ঠ সমস্যা
দার্শনিকরা বলেন, ঈশ্বরের কোনও গুণ নেই, ঈশ্বর হলেন নির্গুণ। এই মতের বিরোধিতা করেন গাজ্জালি। তিনি ঈশ্বরের গুণাবলী স্বীকার করেন এবং বলেন, ঈশ্বরের গুণাবলী তাঁর অন্তর্নিহিত, বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
বিংশ সমস্যা
দার্শনিকগণ বলেন, পুনরুত্থান সম্ভব নয়। দৈহিক পুনরুত্থান তো নয়ই। গাজ্জালি বলেন, পুনরুত্থান সম্ভব কারণ ঈশ্বর ছাড়া আর কোনও কারণ নেই।
দৈহিক পরিবর্তন সাধিত হলেই একজন মানুষ অন্য মানুষের পরিণত হন না। মানুষ শিশু থেকে কিশোরী/কিশোর, যুবতী/যুবক ও বৃদ্ধা/বৃদ্ধ হয়। প্রতি স্তরে তাঁদের দৈহিক পরিবর্তন ঘটে। একটি শিশু যখন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হন তখন তাঁর দৈহিক পরিবর্তন এত বেশি হয় যা অকল্পনীয়। কিন্তু ওই বৃদ্ধই সেই শিশু, এই ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দিগ্ধ হই। মৃত্যুর পরে একজন মানুষকে পুনরায় জীবিত করা হলে তার দৈহিক পরিবর্তন আসতে পারে কিন্তু সে আরেক জন মানুষে রূপান্তরিত হবে না। বিশ্ব-আত্মা বলে কিছু নেই যেখানে মানুষের আত্মা মিশে যাবে। একজন মানুষের মৃত্যুর পরেও তার আত্মা অস্তিত্বশীল থাকে, অসীমে বিলীন হয়ে যায় না।, বরং অন্যান্য আত্মা থেকে স্বতন্ত্রভাবেই অবস্থান করে।
দার্শনিকরা বলেন, কার্য পদ্ধতি একটি সুষ্ঠু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলে। গাজ্জালি এই সুষ্ঠু বা আবশ্যিক কার্য-কারণের বিরোধিতা করেছেন। নিয়ম অনুসরণ করে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করলেও নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ঈশ্বর দৈহিক পুনরুত্থান ঘটাতে পারেন। কার্যকারণ প্রসঙ্গে এখানে গাজ্জালি যে যুক্তি দিয়েছেন তাতে তার বক্তব্যের সঙ্গে হিউমের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়।
তাহফুত আল ফালাসিফায় এই হল গাজ্জালির বক্তব্য। এই গ্রন্থ লেখার বেশ কিছু কাল পরে আল গাজ্জালি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এটা ঘটেছিল তাঁর সফল কর্মজীবনের মধ্য গগনে। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে (ভ্রান্তি থেকে মুক্তি) বলছেন, এটা ঘটেছিল সংশয়ের জন্য। সংশয় তাঁকে অসুস্থতার মতো, like an illness, আক্রমণ করেছিল। এই সংশয় এসেছিল গাজ্জালির তালিমিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য। তালিমিয়া হল কর্তৃত্ববাদী বিধি। এই ঘটনায় তিনি অধ্যাপনার চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছু দিন একাকী কাটিয়ে তিনি কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পান যখন তিনি সংশয়কে জ্ঞানের গভীর অর্থ খোঁজার একটি উপায় বলে মেনে নিলেন। তিনি তাঁর ‘মুক্তি ও পূর্ণতা’ (Freedom and Fullfilment) নামক গ্রন্থে লিখছেন–
“There upon I investigated various kinds of knowledge that I had and found myself destitute of all knowledge with characteristic of infallibility…My reliance on sense perceptions was also destroyed….Perhaps behind intellect perception there is another judge who, if he manifests himself, will show you the falsity of judging.”
আল গাজ্জালি হলেন মুশরিকিয়া বা আলোকপ্রাপ্তি আন্দোলনের একজন পুরোধা পুরুষ। এই আন্দোলন পারস্য থেকে গোটা বিশ্বে একাদশ শতকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনের প্রধান দিকটি দেখা যায় সতেরো শতকের ইউরোপীয় নবজাগরণে। সত্যতার মানদণ্ডের খোঁজে গাজ্জালি মতসমূহের অন্ধকার দিকটি সম্যকভাবে বুঝেছিলেন। আল গাজ্জালি বার বার তাঁর অন্তরঙ্গ সঙ্কটের কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন যে একটা সময় তিনি সব কিছুকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। এটা প্রায় অসুখের পর্যায়ে চলে যায়। প্রায় দু মাস ধরে এটা চলে। তাঁর এই সংশয়বাদ কিন্তু তত্ত্ব-সম্পর্কিত বা বহিরঙ্গ প্রকাশে নয়। তাঁর নিজের ভাষায়, “the disease was baffling, and lasted almost two months, during which I was a sceptic in fact though not in theory, nor outward expression”. যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন তখন এই সঙ্কটের কথা লিখলেন, জানালেন কীভাবে পরিত্রাণ পেলেন–
“To begin with, what I am looking for is knowledge of what things really are, so I must undoubtedly try to find what knowledge really is. It was plain to me that sure and certain knowledge is that knowledge in which the object is disclosed in such a fashion that no doubt remains along with it, that no possibility of error or illusion accompanies it. I saw that the mind cannot even entertain such a supposition. Certain knowledge must also be infallible; and this infallibility or security from error is such that no attempt to show its falsity of the knowledge can occasion doubt or denial, even though the attempt is made by someone who turns stones into gold and rods into a serpent. Thus I know that ten is more than three […] of doubt about my knowledge there is no trace. […] I investigated the various kinds of knowledge I had and found myself destitute of all knowledge of infallibility except in the case of sense perception and necessary truths.” (Freedom and Fulfilment)
শেষ পর্যন্ত আল গাজ্জালি ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও কৃপা পেলেন এবং তা দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করলেন যতটা দৃঢ় ছিলেন দেকার্ত তার চেয়েও। তিনি এর জন্য সুফি ধ্যানকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। সুফি চিন্তাধারা তাঁকে জ্ঞানের সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। গাজ্জালির ভাষায়–
“It is customary with weaker intellects to take men as the criterion of the truth and not the truth as the criterion of men. The intelligent man follows ‘Ali who said ‘Do not know the truth by the men, but know the truth and then you will know those who are truthful’.”
এই জায়গাটি হল গাজ্জালির চিন্তাধারার একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এখান থেকে তাঁর ভাবনা বৈজ্ঞানিক নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে এগিয়েছে এবং জাগতিক বিজ্ঞানকে তিনি দেখেছেন বিচারগত বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে।
সত্যে পৌঁছতে সুফিবাদ ছিল তাঁর কাছে শেষ আশা। গাজ্জালি সুফি ধ্যানের অনুশীলন করেছিলেন এই জন্য যে এই অনুশীলন হল যুক্তি ও নীতির সমন্বয়। গাজ্জালির নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে কী ধারণা তা জানা যায় যখন তিনি মুতাজিলাদের সমালোচনা করেন। মুতাজিলা হল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় যা অষ্টম শতাব্দীর বসরায় পুষ্ট হয়। ‘মুতাজিলা’ শব্দের অর্থ হল এমন অবস্থান যা দুটি পৃথক অবস্থানের মধ্যে অবস্থিত। এই বিন্দুটি হল ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বা কালামের একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান। রাজনৈতিক নানা কারণে মুতাজিলা সম্প্রদায় পরবর্তীকালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। মুতাজিলা আন্দোলন সম্পর্কে গাজ্জালি বলেছেন, নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে মুতাজিলাদের বক্তব্য হল—আত্মা বা রুহের লক্ষণগত বৈশিষ্ট্য ও নৈতিক গঠন দেখে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মুতাজিলারা এটা পেয়েছিলেন সুফি মরমিয়াবাদ থেকে। গাজ্জালির ভাষায়, “This they borrow from the mystics…”
জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে গাজ্জালির অনুসন্ধিৎসা তাঁকে অনৈক্য ও সংশয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ধর্মীয় আলোচনা থেকে তিনি নির্বিচারবাদকে পরিহার করার বলেন। এবং সেটা করতে গেলে বৌদ্ধিক উপায়ের দ্বারস্থ হতে হয়। এই বৌদ্ধিক উপায় কিন্তু খুব সাধারণ মানের নয়, তাকে স্বজ্ঞার স্তরে উন্নীত হতে হবে। নির্বিচারবাদী কর্তৃত্ববাদকে বর্জন করে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি বলেন, এই কর্তৃত্ববাদী বা তালিমিয়াহ এক সময় তাঁর জীবনে অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে এসেছিল। সেখান থেকে বেরোতে পেরেছিলেন বলে তিনি কর্মের মানদণ্ড এবং প্রকৃত ভারসাম্য (Criterion of Action and The Just Balance) নামক দুটি অমূল্য গ্রন্থ তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন।
আল গাজ্জালির ধর্মতাত্ত্বিক সংস্কারকে ইসলামের মূল ধারা গ্রহণ করেছিল। আর এই মূল ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এমন এক আদর্শ যা সুফি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে নির্মিত এবং যা নির্বিচারবাদের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ শোধক।
গ্রন্থপঞ্জী—
১। কোরান শরিফ : সরল বঙ্গানুবাদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৫
২। Al-Ghazali’s Deliverance from Error and Other Works: Five Key Texts Including His Spiritual Autobiography, Al-Munqidh Min Al-Dalal, 2001
৩। James, William; The Varieties of Religious Experience: A Study in Human Nature Modern Library, 1999
৪। Sabra, A. I., ed., The Optics of Ibn al-Haytham, Books I–II–III: On Direct Vision. The Arabic text, edited and with Introduction, Arabic-Latin Glossaries and Concordance Tables, Kuwait: National Council for Culture, Arts and Letters, 1983
৫। Sabra, A. I., ed., The Optics of Ibn al-Haytham. Edition of the Arabic Text of Books IV–V: On Reflection and Images Seen by Reflection. 2 vols, Kuwait: The National Council for Culture, Arts and Letters, 2002
৬। The Optics of Ibn al-Haytham. Books I–II–III: On Direct Vision. English Translation and Commentary. 2 vols, Studies of the Warburg Institute, vol. 40, translated by Sabra, A. I., London: The Warburg Institute, University of London, 1989.
৭। sharif, M. M., History of Muslim Philosophy Hardcover – Import, 1 August 2007
৮। Al-Ghazali, Tahafut Al-Falasifah: Incoherence Of The Philosophers, Adam Pubisher and Distributor, 2007
৯। Abd Rahman, Mohd Rosmizi Bin; Yucel, Salih (2016), “The Mujaddid of His Age: Al-Ghazali and His Inner Spiritual Journey”, Umran, 3 (2), doi:10.11113/umran2016.3n2.56
১০। Saritoprak, Zeki (2018), “Al-Ghazali”, Islamic Spirituality : Theology and Practice for the Modern World, doi:10.5040/9781474297820.0013, ISBN 978-1-4725-7204-2
১১। Parrott, Justin (2017), “Al-Ghazali and the Golden Rule: Ethics of Reciprocity in the Works of a Muslim Sage”, Journal of Religious & Theological Information, 16 (2): 68–78, doi:10.1080/10477845.2017.1281067, S2CID 171854695
ইসলাম সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার দরুন লেখাটি পুর বুঝতে না পারলেও পড়ে ভালো লাগলো|
গাজ্জালী নারী সম্পর্কে কি বিধান দিয়েছিলেন? নারীদের জঘন্য এবং নীচু অবস্থানেই দেখেছেন। সেই সংস্কারের প্রশংসা কিভাবে করি!