স্বাধীনতা ও শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলন – চন্দ্রশেখর বসুর সঙ্গে আলাপচারিতা
ইতিহাস আড্ডা পোর্টাল ও ইতিহাস তথ্য ও তর্ক গ্রুপের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে স্বাধীনতার যাত্রাপথের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।স্বাধীনতা ও তার পরবর্তী কালের বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপচারিতা এরই একটি অংশ। এই পর্বে আমাদের আলাপচারিতা শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলনের এক উল্লেখনীয় ব্যক্তিত্ব চন্দ্রশেখর বসুর সঙ্গে। ইতিহাস আড্ডার পক্ষে এই আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করেছেন কৃশানু নস্কর।
ইতিহাস আড্ডা: প্রথমেই ইতিহাস আড্ডার পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের সময় দেবার জন্য। আপনার নিজের সম্পর্কে প্রথমে কিছু জানতে চাইব, আপনার নাম, পরিবার, জন্মস্থান এবং শৈশব ইত্যাদি বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
চন্দ্রশেখর বসু: আপনারা জানেন আমার নাম চন্দ্রশেখর বসু। আমার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার পাঞ্জিয়া বা পাঁজিয়া গ্রামে, ১৯২২ সালে। আমার মা সেই গ্রামের এক বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে ছিলেন। আমার দাদু ছিলেন বিহারের হসৌলিতে তহশিলদার। সেকালে কোনও জমিদার যদি নিজের জমিদারিতে না থাকতেন তাহলে সেই জমিদারির খাজনা আদায়ের জন্য একজন নায়েব বা তহশিলদার নিয়োগ করা হত। আমার দাদু শ্যামবাজারের মিত্র এবং বাগবাজারের পশুপতি বসুদের (এঁরা তখন একই পরিবার ছিলেন) জমিদারি দেখতেন। আমার মা ছিলেন তাঁর প্রথম সন্তান, এছাড়াও তাঁর আরও দুই মেয়ে আর পাঁচ ছেলে ছিল। আমার বাবা ছিলেন খুলনা জেলার এশড়া গ্রামের এক তুলনামূলক গরিব ঘরের সন্তান। তিনি মেধাবী ছিলেন, সেই কালে সাতক্ষীরা সাব-ডিভিসনে (সেসময় খুলনা জেলায় তিনটি সাব-ডিভিসন ছিল, সাতক্ষীরা, বাঘেরহাট ও খুলনা সদর) এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। বাবা কলকাতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলি মানে এখনকার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে আইএ পাস করেন, বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হন এবং আইন পাস করেন; সেটা নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে। আমার জন্ম পাঁজিয়া গ্রামে এবং ছোটোবেলায় পড়াশোনাও শুরু সেখানেই যদিও আমার দুই দাদা গয়া জেলা স্কুলে পড়তেন, কারণ বাবা গয়াতেই প্র্যাকটিস করতেন এবং সেখানেই থাকতেন। মা আমাকে নিয়ে বাবার দেশের বাড়ি এশড়া গ্রামে যেতেন। সেখানে ছোটোবেলায় দেখেছি, গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহের সমর্থক কিছু যুবক বাড়ি বাড়ি গিয়ে কপোতাক্ষ নদের নোনা জল থেকে লবণ তৈরি করতে বলছে বা শেখাচ্ছে। কপোতাক্ষ নদের জল নোনা ছিল কারণ সমুদ্র কাছেই ছিল। আমাদের বাড়িতেও আমরা লবণ তৈরি করেছিলাম। হলদে ডেলা ডেলা লবণ হয়েছিলো। ওরা বলেছিল যে কলাপাতা পুড়িয়ে সেই ছাইয়ের ভেতর রেখে দিলে ঐ হলদে লবণ সাদা হয়ে যাবে। পরে পুলিশ এসে তাদের গ্রেপ্তার করে। এটুকু মোটামুটি মনে আছে।
ইতিহাস আড্ডা: আপনার পড়াশোনার বিষয়ে কিছু বলুন।
চন্দ্রশেখর বসু: আমার হাতেখড়ি হয়েছিল পাঁজিয়া গ্রামেই। কিছুদিন পর আমাকে গয়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমি আর আমার বৈমাত্রেয় দাদা দুজনে মাইল খানেক হেঁটে ‘রাজাবাবু’ নামে পরিচিত এক জমিদারের তৈরি করা স্কুলে পড়তে যেতাম। এক বৃদ্ধ মাস্টারমশাই কিছু বাংলা, কিছু ইংরেজি, কিছু হিন্দি এসব পড়াতেন। কিছুদিন পর মা আমাকে নিয়ে আবার পাঁজিয়াতে নিজের বাপের বাড়ি চলে আসেন এবং সেখানকার স্কুলে আমাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে ঐ একটিই হাইস্কুল ছিল যদিও তা কোনও সরকারি অনুদান পেত না। বাইরের কোনও ভালো শিক্ষক সেখানে আসতেন না। স্থানীয় কিছু শিক্ষিত ব্যক্তিই পড়াতেন। একমাত্র হেডমাস্টার ছিলেন গ্র্যাজুয়েট, অন্যরা আইএ পাস। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সুশীল কুমার বসু, যিনি বাংলার শিক্ষক ছিলেন। এঁকে আমার রাজনৈতিক গুরু বলা যেতে পারে। ইনি বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।
ইতিহাস আড্ডা: বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টি বলতে?
চন্দ্রশেখর বসু: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়েছিল কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার পরে। আইনি হয় আবার ১৯৪২ সালে যুদ্ধের সময়। সেই সময় যশোর জেলার পাঁচটা সাব-ডিভিসনে সতেরো জন মাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তাঁরা আবার কংগ্রেসেরও সদস্য ছিলেন, কংগ্রেসের কাজও করতেন। যা বলছিলাম, ঐ গ্রামের স্কুল থেকেই ১৯৩৯ সালে আমি ম্যাট্রিক পাস করি, যদিও পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল যশোর সদর শহরে। এরপর আইএ পড়তে হলে যেতে হত কলেজে, কিন্তু সেসময় কাছেপিঠে ভালো কলেজ বলতে ছিল একমাত্র খুলনার কাছে দৌলতপুর কলেজ যেখানে ভবতোষ দত্ত প্রথম অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানে পড়তে হলে হোস্টেলে থাকতে হবে বলে সেখানে আমার পড়া হয়নি। দু-বছর আমি ঘুরে বেড়াই। এরমধ্যে কিছুদিন পাটনা গিয়ে কিছু হাতের কাজ, যেমন সাবান তৈরি এসব শিখেছিলাম মানে এখনকার দিনে যাকে ভোকেশনাল ট্রেনিং বলে আর কি। তারপর আবার গ্রামে, মানে পাঁজিয়ায় ফিরে আসার পর একদিন সুশীল কুমার বসু আমাকে এসে বললেন, “তোকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলাম”। কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক এবং অমৃতবাজার পত্রিকার এডিটোরিয়াল বোর্ডের মেম্বার মহীতোষ রায়চৌধুরী ও আরো কয়েকজন মিলে যশোরে একটা কলেজ খুলেছিলেন ঐ ১৯৪১ সালে, যেটা এখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজ নামে পরিচিত। সেই কলেজেই সুশীল কুমার বসু আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন। আমার থাকার ব্যবস্থা হল যশোর শহরের উকিল কৃষ্ণবিনোদ রায়ের বাড়িতে। ইনিও বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন আবার এআইসিসিরও (অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি) সদস্য ছিলেন। পরে সিপিআই-এর (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) হোলটাইমার হয়ে প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি হন। তাঁর বাড়িতে থেকেই ১৯৪৩ সালে আমি আইএ (ইন্টারমিডিয়েট) পাস করি।
ইতিহাস আড্ডা: এই সময় কি আপনি কোনো গণ–আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
চন্দ্রশেখর বসু: সে কথা প্রসঙ্গে একটু আগের কথা বলে নিতে হয়। ঐ যে সুশীলবাবুর কথা বলেছিলাম, তিনি ১৯২১ সালে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলনের সময় কলেজ ছেড়ে সেই আন্দোলনে যোগ দেন। তিনিই পরে আমার দাদুর বাড়ির গ্রাম পাঁজিয়াতে ‘সারস্বত পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন চালু করেন। একটা বড়ো চালা ঘর বানিয়ে সেখানে ওঁরা নাটক এসব করতেন, পাশে একটা লাইব্রেরি বানিয়েছিলেন যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘চারুচন্দ্র পাঠাগার’ – গ্রামের একজন মেধাবী, অকালমৃত যুবকের নামে। সুশীল বাবু অনিলা দেবী, যিনি পরে শিক্ষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর স্বামী। পাঁজিয়া ছিল একটি জমিদার প্রধান গ্রাম। সুশীল বাবু এবং অনিলা দেবীর নেতৃত্বে সেখানে কিছু কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। পরে, গান্ধিজি অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে এঁরা পাঁজিয়াতেও সার্বজনীন ভোজ বা সবাই এক সারিতে বসে খাওয়া ও খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন। কৃষক আন্দোলনের জন্য তাঁদের আগেই কিছুটা পরিচিতি ছিল, ফলে গ্রামের কিছু ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারও এতে শামিল হয় এবং এটা বেশ সাফল্যও পেয়েছিল। কিন্তু গ্রামের জমিদাররা এতে খুশি ছিলেন না। তাঁরা বোধহয় ভাবছিলেন, এভাবে চাষাভুষোদের মাথায় তুললে তাদের দমন করা মুশকিল হবে বা হতে পারে তাঁরা সনাতন ধর্ম রক্ষা করতে চাইছিলেন। এর কিছুদিন পরেই তাঁরা ভাটপাড়ার পণ্ডিতদের ডেকে এনে একটা সভা করান। এ নিয়ে সুশীল বাবুদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হলে একদিন জমিদারের লোকেরা সারস্বত পরিষদের চালাঘর এবং লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেয়। আমি যখন সেভেন-এইটে পড়ি তখন থেকেই খবরের কাগজ বা পত্র-পত্রিকা পড়ার দিকে আমার ঝোঁক যায়। মনে আছে, সে সময় প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা পড়েছিলাম যখন ওটি প্রথম বেরোয়। ওখানে তো কোনও ছাত্র ফেডারেশন ছিল না, আমি এবং আমার এক সহপাঠী বিমল ঘোষ সুশীলবাবুর সঙ্গে ঘুরতাম। টুকটাক কাজ করতাম, এই কোনও চিঠি দিয়ে আসা, কোথাও যেতে হলে যাওয়া; এই ভাবে আস্তে আস্তে বামপন্থী ভাবধারার সঙ্গে আমার একটা পরিচিতি হয়। ১৯৩৮ সালে তখন আমরা দশম শ্রেণিতে পড়ি, স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব ছিল আমাদের ওপর। পুজো হয়ে গেলে দেখা গেল বারো আনা বেঁচে গেছে। সেই দিয়ে আমরা একটা পতাকা তৈরি করেছিলাম, ছাত্র ফেডারেশনের পতাকা বলা যায়। সাদা কাপড়ের ওপর লাল বর্ডার দেওয়া এবং লাল অক্ষরে লেখা ছিল ‘ফ্রিডম, পিস, প্রগ্রেস’! ঐ ১৯৩৮ সালেই খুলনাতে অল ইন্ডিয়া ছাত্র ফেডারেশনের (জন্ম হয়েছিল ১৯৩৬ সালে লখনউতে) প্রথম অধিবেশন হয়, যেখানে জে ডি আসলাম, তাঁর স্ত্রী, বঙ্কিম মুখার্জি প্রমুখ নেতারা এসেছিলেন। আমি আর বিমল সাইকেল নিয়ে সেখানে গেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে তখন ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন কে এম আসলাম, যিনি পরে ঐতিহাসিক রূপে খুব নাম করেন। এবং প্রশান্ত সান্যাল ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারি। পরে যখন যশোরে কলেজ হল, তখন বেশিরভাগ ছাত্রই ফেডারেশনে যোগ দিল, কিন্তু মুসলিম লীগ আবার একটা পালটা ছাত্র ফেডারেশন খুলেছিল ঐ যশোরেই, যাদের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই বিরোধ লাগত। কলেজের ম্যাগাজিন যখন বেরোলো (নাম ছিল ‘উদয়ন’, আমি তার ছাত্র সম্পাদক ছিলাম) তখন প্রচ্ছদে একটা পদ্ম ফুলের ছবি ছিল। ওরা বলল, এটা হিন্দুদের চিহ্ন সুতরাং রাখা যাবে না। সেই নিয়ে গোলমাল, ঝামেলা হল। ১৯৪২ সালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি আবার আইনি হল, তখন আমি যশোরে পার্টি অফিসেও বসেছি, যদিও আমি তখনো অফিসিয়ালি সদস্য ছিলাম না। সে সময় যখন কংগ্রেসিরা কমিউনিস্ট পার্টির ওপর খুব হামলা করছে তখন পি সি যোশী একটা সার্কুলার জারি করেছিলেন, “এক লাঠির বদলে দশ লাঠি”। সেই মতো পার্টি অফিসে অনেক লাঠি জোগাড় করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু যেদিন সত্যি হামলা হল সেদিন অফিসে বিমল একা ছিল। ও সেই “এক লাঠির বদলে দশ লাঠি” চালানোর চেষ্টা করে শেষ অবধি হাসপাতালে গেল। ১৯৪৩ সালে আমি ফার্স্ট ডিভিসনে আইএ পাস করে কলকাতায় চলে আসি এবং নৈহাটি সিটি কমার্স কলেজে ভর্তি হই। কলকাতায় এসে আমি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার একজন কর্মীরূপে যোগদান করি। ২৪৯বি বউবাজার স্ট্রীটে আরও অন্যান্য ইউনিয়ন অফিসের সঙ্গে কৃষক সভারও অফিস ছিল। তখন তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়েছে। চারদিক থেকে খবর আসত যে পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে, গুলি চালাচ্ছে, চাষিদের রক্ত ঝরছে। সেইসময় সদ্য পাস করা ডাক্তার বা ডাক্তারি ছাত্র যারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের কমিউনিস্ট পার্টি বিভিন্ন জেলায় পাঠাত চাষিদের চিকিৎসা করার জন্য। এজন্য তাদের সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হত।
ইতিহাস আড্ডা: এই সময়টা বেশ অস্থির সময়, দেশে-বিদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে দুটো বড় ঘটনা, ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং তেতাল্লিশের মন্বন্তর, এ দুটো ঘটনার বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাইব।
চন্দ্রশেখর বসু: হ্যাঁ, সে বিষয়ে বলি, জাপান যখন যুদ্ধে যোগ দিল তখন সরকার কলকাতাকে বানালো নেভাল হেডকোয়ার্টার। অফিস করা হল এখনকার হিন্দুস্তান বিল্ডিংকে, সেটা তখনও পুরো তৈরি হয়নি। সেই অসমাপ্ত বাড়িতেই অফিস করা হয়েছিল। ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি কলকাতা ভরে গেল গ্রাম থেকে আসা দুর্ভিক্ষপীড়িত চাষি পরিবারে। যখন শহর জুড়ে “ফ্যান দাও, ফ্যান দাও” রব শোনা গেল, তখন বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে ‘জনরক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই সমিতির সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক রাজশেখর বসু এবং সেক্রেটারি ছিলেন স্নেহাংশু আচার্য। এই সমিতির উদ্যোগে নানা জায়গায় লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। নৈহাটিতে এমন একটি লঙ্গরখানার তদারক করতেন রতিকান্ত বাবু নামে এক অমায়িক ভদ্রলোক যাঁর সঙ্গে আমিও ঐ কাজে যুক্ত ছিলাম। এছাড়া কলকাতার পথে ঘাটে অহরহ দুর্ভিক্ষের ছবিতো নিজের চোখেই দেখেছি। এ সময়ের কথা নিয়ে প্রথম লেখা হয় ‘জবানবন্দী’ নাটক, লিখেছিলেন ‘নবান্ন’-এর নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রীটে সাহিত্যিকদের একটি আড্ডা ছিল, যেখানে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন খোলা হয়। এসময়ই আইপিটিএ খুলছেন দেবব্রত বিশ্বাস; এঁর সঙ্গে পরে হিন্দুস্তান ইনস্যুরেন্সে একসঙ্গে কাজও করেছি। এছাড়াও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীপাম দত্ত প্রমুখদেরও দেখা পেয়েছি ঐ ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রীটের অফিসে।
ইতিহাস আড্ডা: বেয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন।
চন্দ্রশেখর বসু: ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রভাব যশোর-খুলনা অঞ্চলে তেমন পড়তে আমি দেখিনি। একদিন শুধু যশোর শহরের চৌমাথায় কংগ্রেসের একটা মিটিং হচ্ছিলো, চন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায় তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা করছিলেন, পুলিশ এসে তাঁদের ধরে নিয়ে গেল। ব্যস এটুকুই। তবে হ্যাঁ, আমার পরবর্তীকালের সহকর্মী সুনীল মৈত্রের কথা বলতে পারি, সে ফরোয়ার্ড ব্লকের ভালোরকম ছাত্রনেতা ছিল। ৪২-এর আন্দোলনের সময় আরও কয়েকজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে টেলিফোনের তার কাটতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তার সঙ্গীরা সকলে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়ে গেলেও সুনীল তাতে রাজি হয়নি। শেষে ওর কলেজের প্রিন্সিপাল এক ইংরেজ ভদ্রলোক নিজে বন্ড দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে আনেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩, এই সময় রেডিওতে যখন জার্মানির জেতার খবর প্রচারিত হত তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি খুব উল্লসিত হত কারণ তারা একে ব্রিটিশের পরাজয় মনে করত ও জার্মানিকে বন্ধু ভাবত। এ কারণে জার্মানি যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ার পক্ষ নেয় তখন পার্টির জনপ্রিয়তা একদম কমে গেছিল। বিশেষত সেসময় ‘পিপলস ওয়ার’ কাগজে তোজো ও সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে কার্টুন বেরিয়েছিল যা লোকে মোটেই ভালভাবে নেয়নি। ঢাকায় সোমেন চন্দ এবং যশোরে বিজন সেন নামে দুই কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকে কংগ্রেসিরা পিটিয়ে খুন করেছিল।
ইতিহাস আড্ডা: গান্ধিজির সঙ্গে আপনাদের কোনও যোগাযোগ হয়েছিল কি? সে বিষয়ে কিছু বলুন।
চন্দ্রশেখর বসু: গান্ধিজি যখন কলকাতার বেলেঘাটায় এলেন তখন উনি প্রতিদিন প্রার্থনাসভা করতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই সভাগুলোয় উপস্থিত থাকতাম। সেখানে সোরাবর্দি সাহেবকে দেখেছি ওঁর সঙ্গে বসে থাকতে, কথাবার্তা বলতে। যখন গান্ধিজিকে হত্যা করা হয়, সেই সময় আমি বিকেলবেলায় প্রাদেশিক কৃষক সভার অফিসে বসতাম। সেখানে একটা রেডিও ছিল, তাতে শুনলাম বিধান চন্দ্র রায় বলছেন, এইমাত্র খবর পাওয়া গেছে যে গান্ধিজিকে একজন হত্যা করেছে, সে হিন্দু। এই হিন্দু কথাটা উনি বার বার জোর দিয়ে বলছিলেন। তারপর আবেদন জানালেন, যেন কোনো দাঙ্গা না হয় তার জন্য। কলকাতায় প্রায় তিনদিন অরন্ধন চলেছিল। তবে, কমিউনিস্ট পার্টি এ নিয়ে কোনো অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়েছিল কিনা বা কমিউনিস্ট পার্টির অফিসিয়াল অবস্থান কী ছিল তা বলতে পারব না। এই প্রসঙ্গেই এসে যায় রায়টের কথা, যখন দাঙ্গা শুরু হল তখন আমরা একটা রিলিফ পার্টি খুলেছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে আমাদের একটা হুডখোলা জীপ দেওয়া হয়েছিল। আমরা দাঙ্গার খবর পেলে বা কোথাও কোনো খুন-খারাপি হচ্ছে শুনলে সেখানে ছুটতাম। মনে আছে, একদিন এমন খবর এলো, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীট আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর মুখে একজন মুসলমানকে মারা হচ্ছে। শুনে আমরা ছুটলাম, তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় তুলে এনে ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ফেরার পথে আবার আমাদের ওপর হামলা হল। কোনো রকমে বেঁচে ফিরলাম। একটা শান্তি মিছিল করেছিলাম শ্রদ্ধানন্দ পার্ক থেকে মীর্জাপুর স্ট্রীট ধরে শিয়ালদহ যাবার সময় দেখেছি রাস্তার দুপাশে মুসলমান দপ্তরিদের লাশ পড়ে আছে। সেই সময় বিনা কারণে কত যে সাধারণ মানুষ খুন হয়েছে। এক বুড়ো ভিখারিকে লোকে পিটিয়ে মেরে ফেলল কারণ সে লুঙ্গি পরে ভিক্ষা করছিল। আবার এর উল্টোদিকে অন্য ঘটনাও আছে। ঐ যে কৃষ্ণবিনোদ বাবুর কথা বলেছিলাম, যশোরের উকিল এবং প্রাদেশিক কৃষক সভার সভাপতি, উনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজে কলকাতায় এলে পার্টি ওঁর থাকার জন্য পার্ক সার্কাস অঞ্চলে একটি ঘর ভাড়া করে দেয় যেখানে উনি পরিবারসহ এসে উঠেছিলেন। ওঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই ছিল সঙ্গে। বাড়িওয়ালা ছিলেন হানিফ সাহেব। যেদিন ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ শুরু হয় তার আগের দিন আমি ঘটনাচক্রে নৈহাটি চলে গেছিলাম। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং শুরু হতে হানিফ সাহেব কৃষ্ণবিনোদ বাবু এবং তাঁর পরিবারকে বাড়ির একতলায় নিজের পরিবারের সঙ্গে নিয়ে রাখেন এবং দু-তিন দিন বাদে মুসলমানের বেশে সামনের থানায় পৌঁছে দেন। হানিফ সাহেবের নিজের ছেলেরা এদিকে ছোরা তরোয়াল নিয়ে বেরিয়ে রোজ হিন্দু খুন করে আসছে কিন্তু কৃষ্ণবিনোদ বাবুর পরিবারের গায়ে কেউ হাত দেয়নি। মানে, আশ্রিতদের প্রতি যে দয়া বা করুণা দেখাতে হবে সেটা ঐ প্রায় অশিক্ষিত মুসলমান পরিবারও জানত। এটা মানুষের একটা উজ্জ্বল দিক যা কোথাও কোথাও দেখা গেছে, আবার কোথাও দেখা যায়নি।
ইতিহাস আড্ডা: ১৯৪৭ সাল, ১৫ই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস। ঐ দিনটি আপনার জীবনে কেমনভাবে এসেছিল যদি একটু বলেন।
চন্দ্রশেখর বসু: হ্যাঁ, সেইসময় আমি, আমার মা, মেজদা ও ছোটো ভাই কালিঘাটের একটা বস্তিতে থাকতাম দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে, ছোটো ঘর, টিনের চাল, পনের টাকা ছিল ঘর ভাড়া। মেজদা সে সময় বিয়ে করেছে আর সেন ও রায় নামে একটা বইয়ের দোকানে চাকরি করে। ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন মানুষের উত্তেজনা আর উল্লাস ছিল দেখার মতো। আমার মনে আছে দলে দলে মানুষ পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে ছুটছে, আমিও আছি তাদের মধ্যে। রাজভবনের দরজাগুলো সব খুলে দেওয়া হয়েছিল সেদিন। সব লোক ভেতরে ঢুকে সব ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে, সোফা, টেবিল এসবের ওপর উঠে লাফালাফি করছে। কি যেন এক বাঁধভাঙ্গা উল্লাস! কেউ বাধা দিচ্ছে না, কোনও বারণ নেই। হয়তো সবাই মনে মনে জানতো যে এই মাতামাতি বেশিদিন থাকবে না, এটা সাময়িক, সুতরাং বাধা দেবার কোন প্রয়োজন নেই।
ইতিহাস আড্ডা: আমরা এই যে ইতিহাসের বাচিক দলিলের একটা আর্কাইভ বানাতে চাইছি, এতে আপনি নিজের বিষয়ে আর কোনও কথা যোগ করতে চান?
চন্দ্রশেখর বসু: হ্যাঁ। এই কথা প্রসঙ্গে বলি, ১৯৪৪ সালে আমি হিন্দুস্থান ইনস্যুরেন্সে চাকরি পাই। তখন ওখানে কোনো ইউনিয়ন ছিল না। তখনকার ব্যাংকের যে সমস্ত বড় বড় নেতা, যেমন নরেশ পাল, যতীন ভট্টাচার্য তাঁরা ওখানে ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেও পারেননি। তার প্রধান কারণ ছিল এই যে তৎকালীন মধ্যবিত্তদের চোখে মালিক ছিল ভগবান, অন্নদাতা। কিন্তু যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা ইত্যাদির ফলে নতুন কর্মচারীদের মানসিকতায় একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। ‘সেন্স অফ এক্সপ্লয়টেশন’ বিষয়টা আমরা মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলাম। আস্তে আস্তে সবাই বুঝতে পারছিল, যে একা একা বলে কেউ কিছু পাবে না। ইউনিয়ন করে জোরের সঙ্গে বলতে না পারলে কিছুই পাওয়া যাবে না। যুদ্ধের ফলে ব্যবসা বাণিজ্য অনেকেরই ফুলে ফেঁপে উঠল, কিন্তু জিনিষপত্রের দাম বাড়ল, কালোবাজারি শুরু হল। বিভিন্ন অফিস থেকে যে রেশন দেওয়া হত তা বন্ধ হয়ে গেল। তখন কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবি, না দাবি বলব না, আবেদন নিয়ে ম্যানেজমেন্টের কাছে হাজির হলে দেখা যেত যে ম্যানেজমেন্টের কোনও সহানুভূতি নেই। আমরা যারা নতুন ছিলাম, তারা এটা দেখিয়েই মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলাম যে এই সিস্টেমে দয়া দাক্ষিণ্য কিছুই পাওয়া যাবে না। ইউনিয়ন করতেই হবে। তবে ব্যাপারটা সহজ ছিল না। মেট্রোপলিটান ইনস্যুরেন্সে ইউনিয়ন করতে গিয়ে বিরাট ঝামেলা হয়েছিল। পুলিশ ডেকে অ্যারেস্ট করানো হয়েছিল। সেই ঝামেলায় আমিও জড়িয়ে গেছিলাম কারণ আমি স্টেট অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। হিন্দুস্থানে হলো কি, তখনকার অর্থমন্ত্রী নলিনী সরকার, পোড়খাওয়া কংগ্রেসি, একটা অন্য পন্থা নিলেন। তিনি দেখলেন যদি সোজাসুজি আমাদের বাধা দিতে যান তো প্রথম থেকেই বিরোধটা বেড়ে উঠবে। তাই আমরা যখন ওখানের রিক্রিয়েশন ক্লাবটাকে পুরোদস্তুর ইউনিয়ন করার কথা বললাম তখন বাধা দেওয়া হল না, কিন্তু ইউনিয়নের মাথা করা হল ওঁর সব নিজের কাছের লোকেদের, যারা অনেক সিনিয়র। এর ফলে প্রথম পাঁচ বছর আমাদের লড়াইটা ছিল নিজেদের মধ্যে। যখনই আমরা নতুনরা কোনো দাবি-দাওয়া তুলতাম, ইউনিয়নের ঐ মাথারা বাধা দিতেন। পাঁচ বছর লেগেছিল তাদের সরিয়ে ইউনিয়নের নেতৃত্বে আমাদের নতুনদের উঠে আসতে।
ইতিহাস আড্ডা: স্বাধীনতার সঙ্গেই উঠে আসে আরো একটা বিষয়, সেটা হলো দেশভাগ। এই দেশভাগ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
চন্দ্রশেখর বসু: আমি তো ১৯৪৪ সালে কলকাতা চলে আসি তা আগেই বলেছি। আমাদের পরিবার তখনও পূর্ব-পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশে ছিল। আমার ওপরের যে দাদা তার বিয়েও হয়েছিল ঐ দেশে থাকতে। পরে দাদা চলে আসে কলকাতায় বউদিকে নিয়ে, আমরা সেসময় কালিঘাটের একটা বস্তিতে থাকতাম সে কথা আগেই বলেছি। আমরা কলকাতায় থাকায় আমাদের ওপর দেশভাগের প্রভাব তেমন পড়েনি তবে আমাদের অফিসের অন্যান্য কর্মচারী, যাদের বেশিরভাগের দেশ ছিল ময়মনসিংহ, তারা সবাই এখানে থাকলেও তাদের পরিবার ঐ দেশে থাকত। তাদের পরিবার দেশভাগের পর বা ঐ সময় যখন এখানে এল, তারা এল প্রায় নিঃস্ব হয়ে। শিয়ালদহ স্টেশন এবং আশপাশ ভরে গেছিল রিফিউজিতে, সে সময়ই বিভিন্ন জায়গায় রিফিউজি কলোনিগুলো গড়ে ওঠে।
ইতিহাস আড্ডা: আপনারা একটা গণ–আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, দেশভাগের ফলে সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়েছিল কি?
চন্দ্রশেখর বসু: না, সেই অর্থে ছেদ বলা যায় না। বরং তখন আন্দোলন সবে গড়ে উঠছে। ব্রিটিশদের থেকে দেশ মুক্ত হচ্ছে, কিন্তু আরেক শ্রেণির লোক তখন ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় আছে, যারা হল বড় বড় ব্যবসায়ী বা মালিকপক্ষ বলা যায়। আমাদের হিন্দুস্থান ইনস্যুরেন্সে কেমন করে ইউনিয়ন তৈরি হল আর আমরা কেমন করে সেখানে সত্যিকারের বামপন্থী আন্দোলন শুরু করলাম তা আগেই বলেছি। এটা সম্ভব হয়েছিল কিন্তু দেশভাগের ফলে ওপার বাংলা থেকে চলে আসা নতুন যুব কর্মচারীদের জন্য। তারা প্রকৃত অর্থে সব হারিয়ে এসেছে, তারা আগের কর্মচারীদের মতো মালিক ভক্ত ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল যে চেয়ে কিছু পাওয়া যাবেনা। দাবি আদায় করতে হলে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে। এই সময়েই বামপন্থী আন্দোলন গতি পায়, এবং আমি বলবো, দেশভাগের পর এখানে তেমন করে কমিউনাল রায়ট বা দাঙ্গা হয়নি তার কারণ বামপন্থী ভাবধারার উত্থান।
ইতিহাস আড্ডা: আপনি স্বাধীনতার আগের যুগ দেখেছেন এবং স্বাধীনতার পরে আবার এতদিন ধরে দেখছেন। আপনার কী মনে হয়? স্বাধীনতার আগে এবং পরে কী পাল্টেছে আর কী পাল্টায়নি?
চন্দ্রশেখর বসু: দেখুন, এত বছরে উন্নতি নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু সে উন্নতি কাদের? কেমন সে উন্নতি? আগে ভাবুন আমরা স্বাধীনতা পেলাম কেমন করে? আদতে তো ওটা ব্রিটিশের সগে একটা আপোষ বা সন্ধি গোছের জিনিষ। বিভিন্ন বই-পত্র দেখলে আপনিও দেখতে পাবেন যে সে সময় দেশের নেতারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, আর দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মতো মানসিকতা তাঁদের ছিল না। ওদিকে ব্রিটিশও বুঝতে পারছিল যে আর তারা কলোনিগুলোকে ধরে রাখতে পারবে না। তাদের ছেড়ে যেতেই হবে, ফলে দুপক্ষই একটা সম্মানজনক পথ খুঁজে নিয়েছিল বলা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ ছেড়ে যাবার পরেই বা কি পরিবর্তন হল? বহুদিন অবধি আমরা বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ছিলাম। নতুন ইন্ডাস্ট্রি করা বা চাষিদের উন্নতি কিছুইতো হলনা। আসলে কংগ্রেসের মধ্যে প্রচুর জমিদার ইত্যাদি ছিল। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আর সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখা হলনা। ক্যাপিটালিজমেও যদি যেতে হয় তাহলে আগে সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করতে হবে, কিন্তু এখানে সেটাই তো হল না। স্বাধীন ভারতে মূলত কয়েকটা পরিবারই সব সুবিধা পেয়ে গেলো। বিড়লারা, যারা গান্ধিজির অতি ঘনিষ্ঠ ছিল, যমুনালাল বাজাজ, যিনি কংগ্রেসের ট্রেজারার ছিলেন, তারাই তো স্বাধীন ভারতে মূল সুবিধাভোগী হয়ে গেল। গরিব চাষি বা মজুর পরিবারের কি উন্নতি হল? একারণে স্বাধীনতার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস স্তিমিত হলে দেখা গেল মানুষের মধ্যে প্রচুর অসন্তোষ বা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
ইতিহাস আড্ডা: আপনি মানুষের ক্ষোভ বা অসন্তোষের কথা বললেন, এই প্রসঙ্গেই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে। এর বিষয়ে কিছু বলুন।
চন্দ্রশেখর বসু: তেভাগা আন্দোলন যে সময় হয় তখন আমি প্রাদেশিক কৃষক সভার একজন কর্মীরূপে যোগদান করি তা আগেই বলেছি। তেভাগা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল বলতে হবে। মানে জমিদার, চাষি এবং চাষের খরচ যে দিচ্ছে, এই তিনজনের মধ্যে লাভের টাকা সমান ভাগে মানে তিনটে ভাগে ভাগ হবে, এ প্রথা চালু করা গেছিল, তবে স্বাধীনতার পর কিন্তু এসব আর চালু রাখা যায়নি। একটা সদ্য স্বাধীন সরকারকে কেউ হয়ত বিব্রত করতে চায়নি। যে কারণে তেভাগা বন্ধ হয়ে গেল, একই কারণে তেলেঙ্গানা আন্দোলনও ব্যর্থই বলতে হবে। তাছাড়া যেখানে যেখানে প্রাদেশিক কৃষক সভার শক্তিশালী সংগঠন ছিল সেসব জায়গা যেমন যশোর, খুলনা, রংপুর সব ওপারে পড়ে গেল। পাটের চাষ বেশিরভাগ হত ওপার বাংলায় আর জুট মিলগুলো ছিল এপারে, ফলে সেগুলো ধুঁকতে শুরু করলো।
ইতিহাস আড্ডা: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসি আমলে আপনারা কেমন করে, কি রকম গণ–আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন তা যদি বলেন।
চন্দ্রশেখর বসু: স্বাধীনতার আগেই যখন নৌবিদ্রোহ হয় তখন তো বল্লভ ভাই প্যাটেল নৌসেনাদের বলেছিলেন যে তোমরা সারেন্ডার করো, আমরা তোমাদের ব্যাপারটা দেখবো, তোমাদের পাশে থাকব। কিন্তু পরে আর তাঁরা সে কথা রাখেননি। অর্থাৎ কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। কিন্তু এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তেমন প্রভাবিত হয়নি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি সহজে বড় গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হত না। তাদের ভূমিকা বেশিরভাগ সময়েই দোদুল্যমান। তারা কখনো শ্রমিকদের পক্ষে, কখনো মালিক পক্ষে আবার কখনো নিরপেক্ষ। ফলে পার্টি প্রথম অবস্থায় অন্তত এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল যে তারা যেন মালিকদের পক্ষে বা শ্রমিকদের বিরোধী পক্ষে না যায়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ ধারণা ছিল যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আন্দোলনে টেনে আনা যাবে না। সেসময় হিন্দুস্তান ইনস্যুরেন্সে বেশ কিছু বড় মাপের কমিউনিস্ট নেতা চাকরি করতেন, যেমন চিন্মোহন সেহানবিশ, রবি গুহ প্রমুখ, কিন্তু তাঁরাও কোনও দিন মধ্যবিত্তদের আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করেননি। আমরা নতুন যারা ঢুকেছিলাম তারা কিন্তু চোখের সামনে আমাদের সহকর্মীদের ওপর মালিকপক্ষের অত্যাচার দেখে চুপ করে থাকতে পারিনি। প্রতিবাদ করতাম, আন্দোলনে নামতাম এবং এই মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের নিয়েই সে আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করতাম। এর ফলেই কিছু বছরের মধ্যেই দেখা গেল, বিভিন্ন জায়গায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে এবং ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স, সওদাগরি অফিস এসব জায়গায় আন্দোলন চালাচ্ছে এইসব মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে আসা ট্রেড ইউনিয়নগুলোই।
ইতিহাস আড্ডা: এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও আমাদের এখনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা জাতপাতের মতো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় বা কথা বলা হয়। আপনার কী মনে হয়, স্বাধীনতার সময় বা তার আগের সময়, আর এখন, এই সমস্যাগুলোর কতটা পরিবর্তন হয়েছে?
চন্দ্রশেখর বসু: ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে একটা ঘটনা আমি আগেই বলেছি, সেই গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময়ে হানিফ সাহেব কেমন করে কৃষ্ণবিনোদ বাবুর পরিবারকে বাঁচিয়েছিলেন। আরেকটা ঘটনা বলি, আমাদের গ্রাম ছিল মূলত মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে ভর্তি, তারা তাদের ধান জমি চাষ করতে দিত পাশের গ্রামের গরিব মুসলমান চাষিদের। এখন, আমাদের গ্রামের এক উকিল ছিলেন শরৎ ঘোষ, যিনি নিজের জমি এক মুসলিম চাষিকে দিয়েছিলেন টাকার বদলে চাষ করতে। সেই চাষি একবার সময়মত টাকা দিতে পারেনি, তাই শরৎবাবু একদিন লাঠিয়াল নিয়ে সব পাকা ধান কাটতে লেগে গেলেন। সেই ধান উনি ব্যবহার করতে পারবেন না, কারণ তা তখনও ঠিকমত পাকেনি, কিন্তু নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আর কি। এবার সেই চাষি নিজের কষ্টের ফসল নষ্ট হতে দেখে আর থাকতে না পেরে হাঁসুয়া দিয়ে শরৎবাবুর গলা কেটে দিল। এক মুসলমান চাষি মারল এক হিন্দুকে, কিন্তু তা নিয়ে গ্রামে বা কোথাও রায়ট লাগেনি। সেই চাষির জেল হয়েছিল, আন্দামানে সাজা কাটিয়ে ফেরার পর সেই বুড়ো চাষিকে আমরাও দেখেছি। আবার আমার বড়মামার বাড়ি ছিল নৈহাটিতে, সেখানে একবার শুনলাম হিন্দু আর মুসলমান শ্রমিকদের মধ্যে খুব মারামারি হয়েছে। আমরা তখন ছোটো, কাছেই থানা ছিল, আমরা গিয়ে দেখেছিলাম প্রায় হাজারখানেক লাঠি থানার সামনে জড়ো করা, কোনও কোনওটা রক্তমাখা। এইরকম বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটতই, কিন্তু এখনকার মতো কেউ সেসব নিয়ে এত মাথা ঘামাত না। তবে, বাংলাদেশ থেকে চলে আসা হিন্দুদের মনে একটা ক্ষোভ ছিলই, এপার বাংলায়। কলকাতার পাইকপাড়ায় আমি দীর্ঘদিন ছিলাম। সেখানে সাময়িক উত্তেজনার বশে হিন্দুরা মুসলিমদের দোকানপাট দখল করছে বা ভাংচুর করছে এমন দেখেছি, আবার সব শান্ত হলে মুসলমানেরা ফিরে এসেছে এবং দোকান খুলেছে, আবার সব ঠিকঠাক চলছে এমনটাই দেখেছি। আসলে দেখুন, কিছু কিছু ইন্ডাস্ট্রি এমন আছে যেখানে মুসলমান ছাড়া কাজ চলে না। মুসলমান শ্রমিকরাই তার চালিকাশক্তি। তো সেসব জায়গায় হিন্দুরা মুসলমানদের দিব্যি মেনে নিয়েছে। এই পারস্পরিক বোঝাপড়াটা চিরকালই ছিল, এর মধ্যে রাজনীতি ছিল না। যখন, এই ধর্ম ব্যাপারটার মধ্যে রাজনীতি ঢুকল এবং এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠল, তখন থেকেই সব সমস্যার শুরু, সে দেশভাগ বলুন, দাঙ্গা বলুন, সবকিছু। অন্য প্রদেশের কথা বলতে পারি না কিন্তু আমরা বাঙালিরা কখনোই অন্য প্রদেশ, অন্য ভাষা, অন্য ধর্ম বা অন্য সংস্কৃতি বিষয়ে সেভাবে জানার বা বোঝার আগ্রহ দেখাইনি। সামান্য ভাবুন, আমাদের পাশের প্রদেশ ওড়িশার সংস্কৃতি বা সমাজ সম্পর্কে আমরা কি জানি? আমাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাসে মুসলিম সমাজ বা সংস্কৃতির কতটুকু ধরা পড়েছে? আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সমস্যার শুরু এই না জানা থেকেই।
ইতিহাস আড্ডা: আর জাতপাত বা জাতিভেদের সমস্যা?
চন্দ্রশেখর বসু: মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মধ্যে জাতপাতের আচার-বিচার আর ছোঁয়া বাঁচানোর ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই ছিল। পৌন্ড্রক্ষত্রিয়দের “পোদ” আর ঐ ঠাকুরনগরের ওদিকের যারা তাদের “চাঁড়াল” বলা সাধারণ ব্যাপার ছিল। এদের নিজেদের সম্পত্তি তেমন কিছু ছিল না। লোকের বাড়িতে কাজে যেত এরা, কিন্তু এদের বাড়িতে উঠতে দেওয়া হত না। ছোটোবেলায় দেখেছি, আমার মামার বাড়িতে যারা এমন কাজে আসতো তারা দুপুরে খাবার সময় কলাপাতা কেটে এনে উঠোনে বসে থাকত আর মামীরা খাবার নিয়ে গিয়ে আলগোছে যাতে ছোঁয়া না লাগে এমনভাবে এদের পাতে খাবার ঢেলে দিত। খাওয়া হলে এরা আবার নিজেরাই সে জায়গা ধুয়ে, মাটির উঠোন ছিল তাই গোবর নিকিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। এদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ ছিল না যে এদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটাই সবাই স্বাভাবিক ভাবত।
ইতিহাস আড্ডা: কমিউনিস্ট পার্টি কি কখনো এই সাম্প্রদায়িকতা বা জাতিভেদের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করেছে? মানে এগুলো দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে?
চন্দ্রশেখর বসু: না, আমার ধারণা তেমন উদ্যোগ পার্টি কখনোই নেয়নি। আসলে আগে একটা জেনারেল আইডিয়া ছিল যে শ্রমিক বা কৃষক সবাই শোষিত বা অত্যাচারিত। এরা সবাই একই ক্লাস বা শ্রেণিতে অবস্থিত। হিন্দু শ্রমিকও শোষিত, মুসলিম শ্রমিকও শোষিত, উচ্চবর্ণের শ্রমিকও শোষিত, নিম্নবর্ণের শ্রমিকও শোষিত, সুতরাং এরা সবাই একসঙ্গে মিলেই মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়বে। এদের মধ্যে জাতি, ধর্ম ইত্যাদি আসবে না। কিন্তু তেমনটা হয়নি, আবার পার্টি কখনও এই সামাজিক সমস্যাটার দিকে নজরও দেয়নি বা অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করেনি।
ইতিহাস আড্ডা: আর একটা বিষয়ে জানতে চাইব, সেটা হলো, জরুরী অবস্থা, মানে ইন্দিরা গান্ধি যেটা জারি করেছিলেন। সে সময়কার কথা কিছু বলুন।
চন্দ্রশেখর বসু: জরুরী অবস্থার আগে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিল। জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধি সবকিছু নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে নিলেন, বিরোধী নেতাদের জেলে ভরলেন, এসব তো আপনারা জানেন। সেসময় জিনিষপত্রের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, অফিসে হাজিরার কড়াকড়ি করা হয়েছিল, এতটাই কড়াকড়ি যে বাড়ির গিন্নিরা বলতেন, “আমাকে এমার্জেন্সির ভাত রাঁধতে হচ্ছে!” কিন্তু এ সময় আবার অন্য কিছু বিষয়ে লোকের মনে প্রচুর ক্ষোভ জমা হয়েছিল। যেমন, স্যালারি সিলিং, ডিএ সিলিং, যার ফলে লোকের মাইনে বাড়তো না। ইন্দিরা গান্ধি বোধহয় বুঝতে পারেননি যে লোকের মনে কতটা ক্ষোভ জমা হয়েছে। পারলে হয়তো তিনি ইলেকশনে যেতেন না। আমরা সেসময় ভেবেই নিয়েছিলাম যে হয়তো ট্রেড ইউনিয়ন বেআইনি ঘোষিত হবে, পার্টির নেতারা অ্যারেস্ট হতে পারেন। সেকারণে একটা সেকেণ্ড লাইন অব নেতা রেডি রাখা হয়েছিল। এমনকি পাছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিজ করে টাকা পয়সা বাজেয়াপ্ত করে নেয়, সেই ভয়ে পার্টি ফান্ডের টাকা কিছু ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, যাতে টাকার অভাবে ইউনিয়নের কাজ না বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের পার্টি মিটিং হয়েছিল সে সময় আজমিরে, গোপনে, আমরা আলাদা আলাদাভাবে, বিভিন্ন পোষাকে সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে তিনদিন মিটিং করে এসেছিলাম একটা গোপন জায়গায়, জানাজানি হয়নি।
ইতিহাস আড্ডা: স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা এই যে একটা উদ্যোগ নিয়েছি, আপনার এবং আপনাদের মতো প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের কাছ থেকে পুরনো সময়টাকে জেনে, একটা বলা যায় ইতিহাসের বাচিক দলিল তৈরি করার, এটার বিষয়ে কি আর কোনো কিছু বলতে বা যোগ করতে চান?
চন্দ্রশেখর বসু: এটা যখন জিজ্ঞেস করলেন তখন বলি, আমি কয়েক বছর আগে একটা বই লিখেছিলাম। একটা স্মৃতিকথামূলক বই। কারণটা বলি, আমাদের ইনস্যুরেন্সে বেশ কিছু বছর নতুন নিয়োগ বন্ধ ছিল। এবং একটা সময় দেখা গেল যে ইউনিয়নের মাথা যারা এমনকি সদস্যদের ও গড় বয়স পঞ্চাশের ওপর। তারপর বেশ কিছু নতুন নিয়োগ হলো। নতুন সদস্য এলো, কিন্তু তারা আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম বা অতীত ইতিহাস কিছুই জানে না। এদিকে ইউনিয়নের ক্ষমতা খুবই বেড়ে গেছে, ফান্ড অনেক ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, বলতে গেলে অঢেল টাকা এবং ক্ষমতা ইউনিয়নের হাতে। এমন অবস্থায় নতুনদের হাতে যখন ইউনিয়নের দায়িত্ব যাবে তখন ঐ টাকা এবং ক্ষমতার কারণে একটা অরাজকতা শুরু হতে পারে। ইউনিয়নের মূল উদ্দেশ্য এবং আমাদের এতদিনের এত পরিশ্রম সবই বৃথা যাবে যদি আমরা নতুনদের ঠিক মতো তৈরি না করে যেতে পারি। তাই আমি ভেবেছিলাম, একটা স্মৃতিকথামূলক লেখার মাধ্যমে যদি ইউনিয়নের অতীত সংগ্রাম, ঐতিহ্য এবং উদ্দেশ্য নতুনদের সামনে তুলে ধরা যায়। ১৯৯৪ সাল অবধি আমি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলাম, ইউনিয়নের শুরু থেকে ঐ সময় অবধি আমার স্মৃতিতে যা যেটুকু আছে তা নিয়ে বইটা লিখেছিলাম। প্রথমে বাংলায় বেরোয়, পরে ইংরেজি ও শেষে হিন্দিতেও অনুবাদ হয়। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব সাহেব সেটি পড়ে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন (হিন্দি অনুবাদে এই চিঠিটির কপি আছে) যে এই বইটি প্রতিটি ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর হাতে থাকা উচিৎ। আপনারা চাইলে সেই বইটির একটি কপি নিতে পারেন, সেখানে ১৯৯৪ সাল অবধি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ইতিহাস ধরা আছে।
ইতিহাস আড্ডা: আপনি নিজে থেকে এমন অমূল্য বইটি আমাদের দিতে চাইছেন, আমরা অবশ্যই এই বইটি নিতে চাইব। আমাদের সম্পাদকমণ্ডলী এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ইতিহাস আড্ডার পক্ষ থেকে আমি আপনাকে আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমাদের এতটা সময় দেবার জন্য।
চন্দ্রশেখর বসু: ধন্যবাদ আপনাকেও।
Very informative
মন্বন্তর, দেশ ভাগ, ভাতৃঘাতি দাঙ্গা ও তেভাগা সংগ্রামের আবহে গড়ে ওঠা দুর্বার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা জিজ্ঞাসা করা হলোনা বা বলাও হলোনা। যদিও চিন্মোহন সেহানবিশ বা স্নেহাংশু আচার্য র ভিন্ন ভূমিকায় উল্লেখ আছে।