ভারতীয় রেলপথের প্রথম সাত দশক – একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা
The first time I saw a train, I was standing on a wooded slope outside a tunnel, not far from Kalka. Suddenly, with a shrill whistle and great burst of steam, a green and black engine came snorting out of the blackness. I had turned and run towards my father. ‘A dragon !’ I had shouted. ‘There’s a dragon coming out of its cave !’
জীবনে প্রথম রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা এইভাবেই তাঁর সুনিপুন অক্ষরের নকশায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন রাস্কিন বন্ড। সেই বয়সেই তাঁর দেখার চোখ ছিল। পরিতাপের বিষয়, এই ঈশ্বরপ্রদত্ত দৃষ্টি, বর্তমান লেখকের কস্মিনকালেও ছিল না। তবুও এইটুকু মনে আছে, ছোটবেলায় পুজোর সময় ভোরবেলার আকাশ যখন আস্তে আস্তে গোলাপী হয়ে উঠত, তখন হ্যামলিনে বাঁশির মতো রেলগাড়ির হর্নের মায়াবী সুরের টানে বাবা মা-এর হাত ধরে দাঁড়াতাম শেয়ালদার কোনও প্ল্যাটফর্মে। আরব্য রজনী থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য যান প্রবল বেগে ছুটে চলত গন্তব্যের দিকে। জানলা দিয়ে অবাক হয়ে দেখতাম গাছ, বাড়ি, পুকুর, মানুষ, ধানক্ষেত – সবেরই পেছন দিকে দৌড়। আর যখন জুবিলি সেতু আসত, রেলগাড়ি তার উর্ধ্বশ্বাস দৌড় থামিয়ে, ধীর শ্বাস ফেলতে ফেলতে, সকালের সোনাগলানো রোদে চিকচিক করতে থাকা গঙ্গা পার হতো, তখন রাস্কিনের মতোই, পুরো ব্যাপারটাই মনে হতো রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা।
এমন অদ্ভুত রূপকথার জিনিস বানালো কারা ? এই জালের মতো রেললাইন, এই বিদ্যুতের মতো ছুটে চলা রেলের কামরা, এই গঙ্গার দুই পাড় এক করে দেওয়া সেতু ? কারা বানালো প্রত্যেক স্টেশনের ঐ লাল রাঙা বাড়িগুলো ? কারা সেই ময়দানব ? প্রশ্ন করেছিলাম আরেকটু বড়ো হয়ে। উত্তরও এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে। ইংরেজরা। ইংরেজ !? তখন ইতিহাস বিষয়টা সঙ্গে একটু আধটু পরিচয় হয়েছে। যেটুকু বুঝেছি, ইংরেজরা তো আমাদের শত্রু ! তারা প্রায় দুশো বছর আমাদের দেশকে পরাধীন করে রেখেছিল। তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করে মুক্তির মন্দিরে আহুতি দিয়েছে কত প্রাণ। রেলগাড়ির মতো এত সুন্দর জিনিস তারা আমাদের জন্য বানালো কেন ? এই প্রশ্নের উত্তর আসত নানা রকম। কেউ বলতো – আসলে বানানো হয়েছে ভারতীয়দেরই শ্রমে, কেউ বা বলতো – ইংরেজরা যে কয়েকটা ভালো কাজ করেছিল এইটা তার মধ্যে একটা। মনে আছে, বাবা বলেছিলেন – ‘ইংরেজদের জন্যই আজ ভারত জুড়ে জালের মতো রেলপথ ছড়িয়েছে একথা ঠিক। পরে এতে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে, সেও ভুল না। কিন্তু ঐ উপকার করাটা ওদের উদ্দেশ্য ছিল না। এই দেশের মানুষের ভালো করার জন্য ওরা বাংলা থেকে পাঞ্জাব আর কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি রেলের লাইন ছড়িয়ে দেয়নি।‘ সে না হয় বুঝলুম, আমাদের ভালো চায়নি ইংরেজরা। কিন্তু কিছু তো চেয়েছিল ? সেটা কি ? আমাদের এই দেশ জুড়ে রেল লাইনের এই লোহার জাল এতো কষ্ট করে তারা পেতেছিল ঠিক কি উদ্দেশ্যে ?
এর উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে বেশ কিছুটা পেছনে। উনিশ শতক তখন সবে পা রেখেছে পাঁচের দশকে। পলাশীর প্রান্তরের রক্তের আলপনার পর্বের পর কেটে গেছে প্রায় এক শতক। এই একশো বছর পাঞ্জাব কেশরী রাণা রণজিৎ সিং-এর ভবিষ্যৎবাণী সত্যি করে কোম্পানির লাল রং বোম্বে, কলকাতা আর মাদ্রাজ থেকে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিয়েছে ভারতের প্রায় গোটা মানচিত্রকেই। লিডনহল স্ট্রিটের বণিকরা মানদণ্ডের পাট অনেকদিন আগেই চুকিয়েছেন। রাজদণ্ডতেই এখন তাঁদের রুচি। তবে, বণিকের মাথায় হঠাৎ রাজমুকুট পরিয়ে দিলেই সে রাজার মতো ভাবতে শুরু করে না। কোম্পানির মাথায় ভারতের মুকুট উঠেছে অনেকদিন ঠিকই, কিন্তু তার নীতি তখনও নির্ধারিত হয়ে চলেছে বণিকের ব্যবসার স্বল্পমেয়াদের লাভক্ষতির দাঁড়িপাল্লা মেপে। ‘Grand Vision’ বলতে আমরা যা বুঝি, ভারত ভাগ্য বিধাতাদের মধ্যে তখন তার একান্তই অভাব। ভারতের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ও জনবহুল দেশ অধিকার করার পরেও তার সম্পদকে পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগানোর কোনও প্রচেষ্টাই তাদের নেই। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা উনিশ শতকের তিনের দশক থেকেই দরবার করে যাচ্ছেন ভারতের উপকূলীয় এলাকার বাইরে উপমহাদেশের যে বিশাল অভ্যন্তরীণ অঞ্চল (Interior), তার দ্বার পুঁজির জন্য উন্মুক্ত করতে । কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ – এই তিন বন্দরকে যদি ভারতের বিশাল পশ্চাদভূমির সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে ব্রিটিশ পণ্যের জন্য উন্মুক্ত হবে বিপুল এক বাজার। শুধু কি তাই ? এই কাজ যদি একবার করা যায়, অতি সহজেই প্রাকৃতিক সম্পদ ও ফসলে সমৃদ্ধ গঙ্গার দেশ থেকে কাঁচামাল স্পঞ্জের মতো শুষে নিয়ে নিংড়ে দেওয়া যাবে টেমসের দেশে। কিন্তু কিভাবে ? কোন জাদুমন্ত্র ব্রিটিশ পুঁজির জন্য ভারতের বাজারের দরজা খুলবে ? ব্রিটিশ চল্লিশ চোরেরা সমস্বরে উত্তর দিলেন – ‘রেলগাড়ি’। সস্তায় পণ্য পরিবহনে রেলগাড়ির যে জুড়ি নেই, তা নিজেদের দেশেই তাঁরা হাতে কলমে দেখেছেন। ভারতের বিশাল বাজার আর কাঁচামালের দরজা খোলার চাবিকাঠি যে রেল পরিবহণ, এই বিষয়ে তাই তাঁদের সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। খোদ লর্ড ডালহৌসী তাঁর মিনিটে সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরলেন ভারতের তুলোর জন্য বিভুক্ষ ম্যাঞ্চেস্টারের আকাঙ্খার কথা – ‘England is calling aloud for the cotton which India does already produce in some degree, and would produce sufficient in quality and plentiful in quantity, if only there were provided the fitting means of conveyance for it for distant plains to the several ports adopted for its shipment.’
ভারতীয় রেল ব্যবস্থার অগ্রদূত। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী। চিত্র ঋণ – উইকিমিডিয়া কমন্স
এই ‘the fitting means of conveyance’, অর্থাৎ রেলপথ যে জরুরি, এই নিয়ে কারোরই সন্দেহের অবকাশ ছিল না। ১৮৩১-৩২ সালে মাদ্রাজে প্রথম রেলপথ খোলার পরিকল্পনা হয়। আরেকবার প্রচেষ্টা হয় ১৮৪৩ সালে। দুই ক্ষেত্রেই বিষয় খুব বেশি দূর অবধি গড়ায় নি। আসলে রেলপথ তৈরি মানেই প্রাথমিক ভাবে প্রচুর টাকা লগ্নি করতে হবে, প্রথম দিকে মুনাফা হবে খুবই কম হবে কিন্তু ঝুঁকি নিতে হবে অনেকটা। কোম্পানি বোঝে লাভ আর লোকসান। তাই বেড়ালের গলায় বাঁধা দরকার জেনেও ঝুঁকি নিয়ে অল্প লাভে বা একেবারে ক্ষতিতে বিপুল অর্থ লগ্নি করার ঘন্টাটি বাঁধতে তাঁদের বিশেষ উৎসাহ ছিল না। এদিকে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ী আর পুঁজিপতিরাও নাছোড়বান্দা। তাঁদের চাপের কাছেই শেষ পর্যন্ত মাথা নত করতে হল কোম্পানি বাহাদুরকে। ১৮৪৯ সালে তারা ‘Great Indian Peninsula Railway’ নামক বে-সরকারী সংস্থার সঙ্গে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করল। ভারতে রেলপথ আরম্ভ করল তার জাল বিস্তার করা। এই জাল বাড়তে শুরু করলে তিনটি বন্দরকে কেন্দ্র করে, যে বন্দর তিনটি ছিল ভারতে ব্রিটিশদের মূল প্রবেশপথ ও শাসনশক্তির কেন্দ্র। ১৮৫৩ সালে বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত প্রথম রেলপথ নির্মিত হয়। ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত পাতা হয় রেললাইন, পরের বছরই তা প্রসারিত করা হয় রাণীগঞ্জ পর্যন্ত। ১৮৫৬ সালে আর্কটকে মাদ্রাজের সঙ্গে সংযুক্ত করে আরেকটি রেললাইন।
সাম্রাজ্যবাদের রথ। পশ্চিম ঘাটের কাসারার নিকট Great Indian Peninsula Railway’ পরিচালিত একটি মালগাড়ি। চিত্র ঋণ – উইকিমিডিয়া কমন্স
রেলপথ বিস্তারের উদ্দেশ্য শুধু ভারতীয় বাজার আর কাঁচামালকে ইংল্যান্ডের পুঁজিপতিদের নাগালে আনা ছিল না। ভারত সাম্রাজ্য বিস্তারের ও তাকে রক্ষা করার হাতিয়ার হিসেবে রেলপথের গুরুত্ব লর্ড ডালহৌসীর মতো পাকা সাম্রাজ্যবাদীর নজর এড়ায় নি। তিনি বুঝেছিলেন, রেলপথ যত বিস্তৃত হবে ততই ভারতের গায়ে এঁটে বসবে ব্রিটিশ শৃঙ্খল। ভারতের অতি প্রত্যন্ত এলাকাও চলে আসবে লাল কোর্তা বাহিনীর এনফিল্ড রাইফেল-মাস্কেটের পাল্লায়। ডালহৌসী দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর ভাবনা কতটা সঠিক ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রক্ষায় রেলপথ যে কতটা অপরিহার্য, তা প্রমাণ হয়ে যায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময়। বিদ্রোহ দমন করতে অপরিহার্য ছিল খিপ্রতা। বিদ্রোহীরাই প্রাথমিক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও, রেলপথ ব্রিটিশ বাহিনীকে যে গতি দিয়েছিল তা মহাবিদ্রোহের ফলাফল নির্ধারণে ছিল নির্ণায়ক। তাই মহাবিদ্রোহের পর, রানী ভিক্টোরিয়া যখন ভারত সাম্রাজ্ঞী ঘোষিত হলেন, ভারত সাম্রাজ্যের শাসনভার যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি ন্যস্ত হলো ব্রিটিশ সরকারের হাতে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই রেলপথ বিস্তারের প্রশ্নটি আর নিছক অর্থনৈতিক লাভক্ষতির দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখার মতো বিষয় রইল না। লর্ড হার্ডিং এবং লর্ড ডালহৌসী যে পথ দেখিয়েছিলেন, সেই পথেই সরকার অগ্রসর হল। বাণিজ্যিক গুরুত্ব নেই, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এমন স্থানেও রেলপথ বিস্তারের কাজে মন দেওয়া হল। বিশেষ জোর দেওয়া হল ভারত সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে। রুশ সাম্রাজ্য এই সময় দ্রুত মধ্য এশিয়ার দেশগুলিকে গ্রাস করে এগিয়ে আসছে আফগানিস্তানের দিকে। ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের আশঙ্কা ছিল এই ‘রুশ স্টিমরোলার’-এর অন্তিম লক্ষ্য হল প্রথমে কাবুল, তারপর দিল্লি। এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল, এমন নয়। হিন্দুকুশ পেরিয়া রুশ বাহিনীর কসাকদের ঘোড়া একদিন সিন্ধু আর গঙ্গার জল পান করবে, এই উচ্চাকাঙ্খা জারের অফিসাররা প্রকাশ্যেই বহুবার ব্যক্ত করেছেন। তাই রুশদের বোখারা আর সমরখন্দকে সেন্ট পিটার্সবার্গের সঙ্গে রেল মারফত যুক্ত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্রিটিশরা প্রচেষ্টা করল রাওয়ালপিন্ডি আর কলকাতাকে রেল-এর মাধ্যমে জুড়ে দেওয়ার।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঢাল। বোলান গিরিপথের নিকট ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেলপথ নির্মাণ। চিত্র ঋণ – উইকিমিডিয়া কমন্স
ভারত জুড়ে রেলপথ বিস্তারের এই প্রচেষ্টার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রভূত পরিমাণ পুঁজির। এই পুঁজি আসবে কোথা থেকে ? সরকার সরাসরি এই পুঁজির যোগান দিতে পারত ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তখনও তার ‘মুক্ত বাণিজ্য’-এর নীতি থেকে বেরোতে পারেনি। তাঁদের কাছে তখনও প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারী উদ্যোগে রেলপথ নির্মাণের বিষয়টি অস্বস্তিকর ছিল। অথচ ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা রেলপথ নির্মাণের পর তার সুবিধা গ্রহণ করতে আগ্রহী থাকলেও, প্রাথমিক পুঁজি বিনিয়োগের ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে রাজি ছিলেন না। এই অবস্থায় সরকার এক অদ্ভুত নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এই নীতি অনুসারে, রেলপথ নির্মাণে বিনিয়োগ করার পর, যদি বিনিয়োগকারী বেসরকারী সংস্থার লগ্নিকৃত অর্থে আয়ের পরিমাণ তার শতকরা পাঁচ ভাগের কম হয়, তাহলে আয়ে যতটা ঘাটতি, তা সরকার নিজের রাজস্ব থেকে প্রদান করবে। এই নীতি পরিচিত হয় ‘গ্যারান্টি প্রথা’ নামে। এর মাধ্যমে বেসরকারী সংস্থা ও বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম আয় ব্রিটিশ সরকার সুনিশ্চিত করে। এও বলা হয় রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সরকার ৯৯ বছরের ইজারার ভিত্তিতে বিনামূল্যে বেসরকারী সংস্থাগুলিকে প্রদান করবে। তবে শর্ত হলো, এক, স্বল্পমূল্যে সামরিক বাহিনীকে রেলপথ ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে আর দুই, মেয়াদ অন্তে বিনা ক্ষতিপূরণে এই সব রেলপথ সরকার অধিগ্রহণ করবে। তবে এও বলা হয়, যদি প্রয়োজন হয়, সরকার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেও এই সংস্থাগুলির কাছ থেকে রেলপথ কিনে নিতে পারবে। এর পাশাপাশি, বেসরকারী সংস্থাগুলিরও অধিকার থাকবে ছয় মাসের নোটিশে তাদের সম্পূর্ণ লগ্নিকৃত অর্থ সরকারের থেকে ফেরত নিয়ে রেলপথ তাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার।
‘গ্যারান্টি প্রথা’-এর সর্ববৃহৎ উপভোক্তা। East Indian Railways এর প্রথম রেলগাড়ি। চিত্র ঋণ – উইকিমিডিয়া কমন্স
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ‘গ্যারান্টি প্রথা’-তেই ভারতের রেলপথ বিস্তার লাভ করে। এই প্রথা নতুন ছিল না, অন্যান্য দেশেরও রেলপথ বিস্তারে এইপ্রকার নীতি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু পরাধীন ভারতের রাজস্বের অর্থ অপচয় করতে ব্রিটিশ শাসকদের তেমন অনীহা ছিল না, যা অন্যান্য দেশের শাসকদের ছিল। তাই অন্যত্র এই প্রথায় সরকার যেভাবে বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির আয়-ব্যায়ের উপর কড়া নজর রাখত, ভারতে তা রাখা হয়নি। পরিণাম ছিল লাগাম ছাড়া দুর্নীতি। অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য যথার্থ ভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন এই ‘গ্যারান্টি প্রথা’ এমন এক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল, যাতে ঝুঁকি সবই ছিল ভারতের ব্রিটিশ সরকারের, যে ঝুঁকি ভারতের রাজস্ব ব্যবহার করে তারা নিত, আর নিশ্চিত মুনাফা সবই ছিল ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের। তারা ‘গ্যারান্টি’-এর সুযোগ নিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে আয় কম দেখাতো,অ-প্রয়োজনীয় নির্মাণ করে খরচ বাড়াত এবং বেগতিক দেখলে যে কোনও সময়ে মাত্র ৬ মাসের নোটিশে পুরো বিনিয়োগ করা পুঁজিই সরকারের কাছ থেকে ফেরত পেয়ে যেত। ভারতের রেলপথে বিনিয়োগ অচিরেই বিনা ঝুঁকিতে ফাটকা পুঁজির লাভের একটা বড়ো জায়গা হয়ে দাঁড়ালো। একথা ঠিক, রেলপথ বিস্তারের গতিবেগ অনেক বেড়েছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতের মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য যেখানে ছিল ৪৩৯ কিলোমিটার, ১৮৭০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭,৬৭৮ কিলোমিটার। কিন্তু এই বিস্তারের খরচ ছিল, স্বাভাবিক ভাবেই, আকাশছোঁয়া। মাইলপ্রতি যেখানে ৮০০০ পাউন্ড রেলপথ নির্মাণে লাগার কথা, সেখানে খরচ দাঁড়িয়েছিল মাইলপ্রতি প্রায় ১৮,০০০ পাউন্ড। ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের গ্যারান্টি প্রথার অপব্যবহার করে মুনাফা তোলার অর্থনৈতিক বোঝা শেষ অবধি চেপেছিল দুস্থ ভারতবাসীরই কাঁধে।
ভারতের ব্রিটিশ শাসকরাও ক্রমে উপলব্ধি করতে শুরু করে এই বিশাল অর্থ খরচ করে রেলপথ নির্মাণ আর সাদা হাতি পোষা একই ব্যাপার। তাঁরাও নীতি পরিবর্তন করেন। ১৮৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার প্রত্যক্ষ ভাবে রেলপথ বিস্তারে হাত লাগায়। ভারত জুড়ে রেল লাইনের জাল বোনা হতে থাকে আরও দ্রুত গতিতে। ১৮৭৯ সালে সরকার দেশের বৃহত্তম বেসরকারী রেল সংস্থা ‘East Indian Railways’ অধিগ্রহণ করে। রেলপথের মালিকানার সরকারী -বেসরকারী ভারসাম্য সরকারের দিকেই ক্রমশঃ ঝুঁকছিল। কিন্তু উনিশ শতকের সাতের দশকের শেষের দিকে দুর্ভিক্ষ, ব্যয়সাধ্য বৈদেশিক যুদ্ধ ও অন্যান্য কিছু কারণে সরকার রেল ব্যবস্থায় সরাসরি বিনিয়োগ করতে সাময়িক ভাবে অক্ষম হয়। এমতাবস্থায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে গ্যারান্টি প্রথা পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। এইবার অবশ্য মূলধনের উপর ৩১/২ শতাংশ লাভের সরকার গ্যারান্টি দিয়েছিল। পূর্বের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম হলেও, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের অভাব দেখা যায়নি। তবে সরকার রাশ একেবারে বেসরাকারী হাতে ছেড়ে দিতেও রাজি ছিল না। ঠিক হয় যে রেলপথ নির্মিত হবে, তা ব্রিটিশ সরকারের মালিকানায় অর্থাৎ ভারত সচিবের প্রত্যক্ষ দায়িত্বে থাকবে, শুধু সেই লাইনে রেল পরিবহন পরিষেবা প্রদানের স্বত্ত্ব থাকবে বিনিয়োগকারী বেসরকারী সংস্থার হাতে। এই দায়িত্বও ২৫ বছরের মাথায় সরকার নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে সংস্থাকে তার লগ্নিকৃত মূলধন ফিরিয়ে দিয়ে। এই সরকারী-বেসরকারী বোঝাপড়ায় রেলপথ বিস্তারের গতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল, একথা অনস্বীকার্য। ১৮৭০ সালে যেখানে ভারতে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল, পূর্বে উল্লেখিত ৭,৬৭৮ কি.মি., ১৮৯০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫,৪৯৫ কিলোমিটার।
‘গ্যারান্টি প্রথা’-য় সরকারের এই প্রত্যাবর্তন কিন্তু সাময়িক বলেই বিবেচিত হলো। অন্যের সম্পদ হলেও, এই প্রথায় কি পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়, তা ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা বুঝেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে তাঁরা আবার সরকারী নিয়ন্ত্রণে রেল ব্যবস্থাকে নিয়ে আসতে প্রয়াসী হলেন। এই সময় ভারতে তিন ধরণের রেলপথ আমরা লক্ষ্য করতে পারি – ১) এমন রেলপথ যা পুরোপরি সরকার নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত, ২) এমন রেলপথ যার মালিকানা সরকারের কিন্তু পরিষেবা পুরোপুরি বেসরকারী কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত, এবং ৩) গ্যারান্টি প্রথাভুক্ত রেলপথ যা সম্পূর্ণ ভাবে বেসরকারী মালিকানাধীন ও তাদের দ্বারাই পরিচালিত। বলা বাহুল্য এই জটিল মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের ভাগাভাগি রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রসারের আর অনুকূল ছিল না। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড কার্জন টমাস রবার্টসনের নেতৃত্বে এই জটিল রেলব্যবস্থা পরিচালনা করার সমাধান সন্ধানে গঠন করেন এক অনুসন্ধান কমিটি। এই কমিটির সুপারিশ মেনে ১৯০৫ সালে প্রথম একটি তিন সদস্যের ‘রেলওয়ে বোর্ড’ গঠিত হয়, এই বোর্ডের উপরই রেলপথ নির্মাণের বরাদ্দ অর্থ যথাযথ ও সঠিক ভাবে খরচ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। জটিলতা কমানোর জন্য বেসরকারী রেলপথগুলি সরকারের আওতায় আনার চাপ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম অ্যাকওয়ার্থের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটির সুপারিশে রেল পরিবহনকে সম্পূর্ণ ভাবে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯২৫ সালে এই কমিটির সুপারিশ মেনেই প্রথম পেশ করা হয় স্বতন্ত্র সর্ব-ভারতীয় রেল বাজেট। প্রায় সাত দশক পূর্বে ভারতের রেল ব্যবস্থা ‘গ্যারান্টি প্রথা’-এর মাধ্যমে বে-সরকারী উদ্যোগে যে যাত্রা শুরু করেছিল, সরকারী অধিগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার একটি পর্যায়ের ইতি হল এইভাবেই। ভারতীয় রেলব্যবস্থার প্রাথমিক এই অধ্যায় যখন শেষ হচ্ছে, তখন তা দৈর্ঘ্যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ৭৮% অঞ্চল তার আওতার মধ্যে এবং কয়েক লক্ষ কর্মী তার সঙ্গে যুক্ত।
এখন দেখা যাক, এই প্রথম সাত দশকে ব্রিটিশ উদ্যগে রেলব্যবস্থার বিস্তারে ভারতীয়দের অর্জন ঠিক কি ছিল। কার্ল মার্কস ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন – ‘The railway system will become in India truely the forerunner of modern industry.’ তাঁর এইরকম মনে হওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এর পূর্বে বিশ্বের যে দেশেই রেলপথ বিস্তার লাভ করেছে, তার হাত ধরে এসেছে দ্রুত শিল্পায়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি ও যন্ত্র নির্মাণে অভাবনীয় উন্নতি ও অর্থনীতির আধুনিকীকরণ। ভারতে তার অন্যথা হতে পারে, তা স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মনে হয়নি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অন্যথা হয়েছিল। একথা ঠিক রেলপথ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে বৈপ্লবিক ভাবে বদলে দেয়। দেশের আঞ্চলিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাজার গুলি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়,অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহণ হয় পূর্বের তুলনায় বহুগুণ দ্রুত এবং সুলভ। কিন্তু ভারতের অর্থনীতির মূলগত কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করতে পারি না, যা অন্যান্য দেশে রেলপথ ব্যবস্থা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়। এমন কেনো হলো ? এর উত্তর দিতে এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের প্রথম যুগের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীরা – দাদাভাই নওরোজী, জি. ভি. যোশী, ডি.ই. ওয়াচা, জি. এস. আয়ার, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রাণাডের মতো ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে ছিলেন অগ্রগণ্য। এই প্রবন্ধের সূচনাতেই বলা হয়েছে, ছোটোবেলায় এই লেখককে তার বাবা যে কথা বলেছিলেন, ভারতীয়দের উপকার করা ইংরেজদের রেললাইন পাতার উদ্দেশ্য ছিল না। এই দেশের ভালো করার জন্য তারা রেলের লাইন ছড়িয়ে দেয়নি দেশ জুড়ে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দুটো – ১) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় কাঁচামাল ও বাজারকে ব্রিটিশ শিল্পের ও পুঁজির আওতায় আনা, আর ২) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করা। রেলপথ ব্যবহার করে যদি ভারতের শিল্পায়ন হয়, তাহলে প্রথম উদ্দেশ্য সফল হবে কি করে ? ভারত উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্যের জন্য ব্রিটেনের কাছে মুখাপেক্ষী থাক, এইটাই তো ব্রিটিশ শাসকদের কাছে কাম্য। ভারতে শিল্পায়ন হলে তা হতো না। রেলব্যবস্থার পরিবহণ রাজস্ব এটি মাথায় রেখেই স্থির করা হয়। এর ফলে, রেলপথ ব্যবহার করে ভারত থেকে কাঁচামাল বিলেতে রপ্তানি করার ও বিলেত থেকে উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্য ভারতে আমদানি খরচ রাখা হয় অত্যন্ত কম, কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ শিল্পের জন্য দেশের মধ্যে থেকেই কাঁচামাল পাঠানো ও ভারতে উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্যাদি বিদেশে রপ্তানি করার উপর শুল্ক চাপানো হয় আকাশছোঁয়া। এর ফলাফল ঠিক কি দাঁড়িয়েছিল তা একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে – এই সময় পশ্চিম ভারতে যে স্বল্প কিছু শিল্প গড়ে উঠছিল, তাদের পক্ষে পূর্ব ভারত থেকে কয়লা আমদানি করার থেকে ইংল্যান্ড থেকে কয়লা আমদানি করা ছিল অনেক সস্তা। এদিকে ভারতের বিস্তীর্ণ পশ্চাৎভূমি থেকে স্পঞ্জের মতো কাঁচামাল শুষে নিয়ে অতি স্বল্প শুল্কে রেলগাড়ি চলে আসত কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ অথবা করাচী বন্দরে। সেখান থেকে সুয়েজ মারফত তা চালান করা হয় ইংল্যান্ডে। এই একই পথে উল্টোদিকে ইংল্যান্ড থেকে উৎপাদিত শিল্পজাত দ্রব্য ঢুকে পড়ত ভারতের একদম অভ্যন্তরীণ বাজারগুলিতে। সস্তা এই পণ্যের সঙ্গে ভারতীয় শিল্প, সে কুটির শিল্পই হোক বা স্বল্প কিছু উপস্থিত যন্ত্রশিল্প – প্রতিযোগিতায় পারত না। তাই আমরা দেখি, শিল্পায়ন দূরে থাক, রেলপথ ভারতের অবশিল্পায়নে এবং তাকে অবশিল্পায়িত অবস্থাতেই দীর্ঘকাল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ভারতীয় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের জনক। দাদাভাই নওরোজী। চিত্র ঋণ – উইকিমিডিয়া কমন্স
ব্রিটিশ সরকার অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে, রেলপথ বিস্তারের ফলে ভারতে আর দুর্ভিক্ষ হবে না। খাতায় কলমে তাই হওয়া উচিৎ ছিল। কারণ রেলপথের বিকাশের অর্থই ছিল সহজে খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে এমন অঞ্চল থেকে দ্রুত দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে সহজে খাদ্য প্রেরণ। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং ভারতে খাদ্য শস্য উৎপাদন হ্রাস পায়, বহু অঞ্চল আরও দুর্ভিক্ষ পীড়িত হয়ে পড়ে। কেন এমন হলো, তার উত্তর খোঁজার একটি প্রচেষ্টা হয় ১৯০১ সালের ২৮ এপ্রিল সুরেন্দ্রনাথের ‘Bengalee’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় অর্থকরী ফসল, যা কাঁচামাল হিসেবে উপযোগী, তার উৎপাদন ও রেল মারফত বিদেশে রপ্তানির দিকে জোর দেওয়াই ভারতে খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাসের মূল কারণ। যেখানে চাষিরা আগে ধান, গম, জোয়ার বা বাজরা চাষ করত, সেখানে তারা পাট বা তুলোর মতো ফসল চাষ করছে সরকারের চাপে পড়ে। স্বভাবতঃই, এই অভিযোগ লর্ড কার্জন ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাস্তব ইতিহাস কিন্তু এই বিতর্কে শেষ অবধি রায় দিয়েছিল ‘Bengalee’-এর দিকেই ঝুঁকে, লর্ড কার্জনের দিকে নয়।
সরকারের সচেতন নীতির কারণেই ভারতে রেলপথ নির্মাণের সূত্র ধরে গড়ে ওঠেনি লৌহ-ইস্পাত, যন্ত্রপাতি বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প – যা গড়ে ওঠা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। রেলপথ ও রেলগাড়ি বানাতে যা প্রয়োজন, এমন কোনও কিছুই সরকার ভারতে উৎপাদনের পক্ষপাতি ছিল না। তাঁদের শ্লোগান ছিল – ‘Buy British !’। একটি পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ১৮৬৫ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে রেল ইঞ্জিন তৈরি হয়েছিল মাত্র ৭০০ টি। এই একই কালপর্বে ভারতীয় রেলপথের চাহিদা মেটাতে ব্রিটেন থেকে আমদানিকৃত রেল ইঞ্জিনের সংখ্যা ছিল ১২,০০০। রেল ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য কয়লা শিল্পের বিকাশ একেবারে রোধ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেখানেও দ্রুত বৃদ্ধি ছিল অনুপস্থিত। ভারতীয় রেলপথ লৌহ-ইস্পাত শিল্পের দ্রুত উন্নতি ঘটিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা ভারতে নয় – ইংল্যান্ডে। ভারতীয় রেল ব্যবস্থার জন্য ইঞ্জিন, লাইন, বগি ইত্যাদি নির্মাণের বরাত পেয়ে কপাল খুলে গেছিল বহু বিলেতি কোম্পানির। ইংল্যান্ডের রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানাগুলিকে বলা হত ‘যান্ত্রিক কারিগরি শিক্ষার বিশ্ববিদ্যালয়’ (University of Mechanical Engineering)। ভারত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণের সুযোগ পায় নি, তাকে সচেতন ভাবেই সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। উনিশ শতকে ইউরোপের সকল শিল্পোন্নত দেশে রেলপথ বিস্তারের পেছনে গড়ে ওঠে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, তার সূত্র ধরে লৌহ-ইস্পাত শিল্প এবং অবশেষে তার সূত্রে আকরিক লোহা আর কয়লা সহ বিভিন্নপ্রকার খনিজ নিষ্কাশন শিল্প। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয় ‘Backward Linkage’। মার্কস এই অভিজ্ঞতা থেকেই আশা করেছিলেন ভারতে রেল ব্যবস্থার বিস্তার তার দ্রুত শিল্পায়নের সহায়ক হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা সেই সুযোগ ভারতকে দেয় নি। ভারতের রেলপথ বিস্তারের ‘Backward Linkage’ থেকে যে লাভ হল, তা পুরোটাই ভোগ করল ব্রিটেনের লৌহ-ইস্পাত, ইঞ্জিনিয়ারিং ও খনিজ শিল্প। রেলপথের হাত ধরে ভারতের ভারি শিল্পের কোনও দ্রুত বিকাশ লক্ষ্য করা গেল না।
এই বাস্তবতা সাক্ষী দেয়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের রেলপথ নিয়ে যে প্রাথমিক অভিযোগগুলি ছিল, তা একেবারেই অমূলক ছিল না। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতের রাজকোষ থেকে রেলপথ বিস্তারের খাতে ব্রিটিশ শাসকরা প্রথম সাত দশকে ব্যয় করেছেন, তার থেকে ভারতের বস্তুগত ভাবে লাভ হয়েছে অতি সামান্য, ক্ষতির হিসেবই বরং দীর্ঘ। কিন্তু রেলপথের অস্তিত্বের একটি ইতিবাচক দিক হয়তো তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছিল। তাঁরা এটা ভেবে দেখেননি, যে জাতীয় চেতনা তাঁদেরকে ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে কলম ধরতে উদ্বুদ্ধ করছিল,রেলপথ না থাকলে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ত না। রেলপথ, শুধু পণ্য আর কাঁচামালই পরিবহণ করে না। তার সঙ্গে সঙ্গে বয়ে নিয়ে যায় মানুষ ও মানুষের ভাবনাকেও। এই উনিশ শতকের ইউরোপের ইতিহাস ঘাঁটলেই আমরা দেখতে পাবো, রেলপথের বিস্তার ও চিন্তার আদানপ্রদানের হাত ধরে কিভাবে ব্যাভেরিয়ান, স্যাক্সন, রাইনল্যান্ডার আর থুরিঞ্জিয়ানরা জার্মান এবং ভেনিশিয়ান, নিওপলিটান, পিডমন্টিনিয়ান, প্যাডুয়ান আর সার্দিনিয়ানদের ইতালিয়ান জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। একই ভাবে ব্রিটিশরা না চাইলেও, ইতিহাসের নিয়মেই রেলপথ বাঙালি, মারাঠি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, তামিল প্রভৃতি জনজাতিকে ক্রমশঃ বেঁধে দিল এক সূত্রে। সুরেন্দ্রনাথ যে নির্মিয়মান জাতি (Nation in making)-এর কথা বলেছিলেন, তার ভিত্তি ছিল ১৯০১ সালে সারাবছর রেলপথ ব্যবহার করা ভারতের সকল প্রান্তের ১৮ কোটি ৩০ লক্ষ যাত্রী। কূমমন্ডুক ভাব পরিত্যাগ করে পারস্পরিক ভৌগলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দূরত্ব তারা বহুলাংশে কমিয়ে আনল ভারতব্যাপী বিস্তৃত রেল ব্যবস্থারই সৌজন্যে। জাতীয় কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় সংগঠন, প্রতি বছর যার অধিবেশন হত ভারতের একেক প্রান্তের শহরে – রেল ব্যবস্থা ছাড়া তার অস্তিত্ব কি কল্পনা করা যায় ?
যে পাশে বাঁধা পড়ল খন্ড-বিখন্ড ভারত। ভারতীয় রেল, ১৯০৯। চিত্র ঋণ – উইকিমিডিয়া কমন্স
একথা সম্পূর্ণ ভাবে সত্যি, যে রেলপথ ভারতের সম্পদের বহির্গমনের অন্যতম উপায় হিসেবেই নির্মিত হয়েছিল, নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দোসর হিসেবে। ‘Drain of wealth’ ভারতীয় রেল ব্যবস্থা ছাড়া অকল্পনীয়। ‘De-Industrialisation’ বা ‘অবশিল্পায়ন’ এবং গ্রামীণ ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির ধ্বংসসাধনকেও আমরা রেলব্যবস্থার বিস্তারের ইতিহাসের থেকে আলদা করতে পারি না। এই দিক দিয়ে রেলপথ সত্যিই ভারতের অভিশাপ রূপেই প্রথম এদেশে এসেছিল। উপকার করার জন্য নয়, ব্রিটিশরা এই ব্যবস্থা নির্মাণ করে ভারতীয়দের শোষণের উদ্দেশ্যেই। একই সঙ্গে ‘The Cambridge Economic History Of India’-তে ঐতিহাসিক জন হার্ড যে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাকেও আমরা অস্বীকার করি কিভাবে ? তিনি বলেছেন রেল ব্যবস্থা নির্মাণের ফলেই – ‘জাতীয় ভূখন্ড হিসেবে ভারতের স্থানীয় এলাকাগুলি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সেই এলাকাগুলি আবার বহির্জগতের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যায়।’ রেলপথ ব্যবস্থার বিস্তার ভারতীয়দের বিশ্বের সঙ্গে জুড়ে দিল, ‘ভারতীয়’-এই পরিচয়কে যোগাযোগের মাধ্যমে করল আরও শক্তিশালী। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তার, রেলপথের বিস্তার ব্যতীত কিভাবে সম্ভব হতো ? নিঃসন্দেহে, এ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রেলপথ নির্মাণের নীতির অনিচ্ছাকৃত পরিণাম, তারা ভেবে চিন্তে এই কাজ করেনি। তাদের ভূমিকা ছিল, মার্কসের ভাষায় ‘unconscious tool of history’-এর। কিন্তু অন্তিম ফলাফল অস্বীকার করা যায় না।
তাই সাম্রাজ্যবাদী গরলের বাহক রূপেই রেললাইন প্রথম ভারতের ধমনীতে প্রবেশ করলেও কালক্রমে দেখা দেয় পশ্চিমের খোলা দ্বার দিয়ে এই দেশে আগত সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার রূপে। ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছর পরেও শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি বজায় রাখতে ভারতীয় রেল আজও অপরিহার্য, আমাদের দেশের বন্ধনের মূর্ত প্রতীক। বর্তমান লেখকের জীবনের বহু জাদুমাখা মুহূর্তের সাক্ষী ভারতীয় রেল। তার গুরুত্ব ও দীর্ঘ ইতিহাসের নানা দিক সম্পূর্ণ আলোচনা করার পরিসর একটি বৃহৎ গ্রন্থেও পাওয়া কঠিন, এই প্রবন্ধে তো তা নেই-ই। তাই ভারতীয় রেলব্যবস্থার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে তার প্রথম সাত দশকের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনার ইতি টানা যাক আজ এইখানেই।
তথ্যসূত্র –
১) The Cambridge Economic History of India, Volume – 2: c. 1757- c. 1970, edited by Dharma Kumar with the editorial assistance of Meghnad Desai, Cambridge University Press, 1989
২) From Plassey to Partition – A History of Modern India, Sekhar Bandyopadhyay, Orien Longman Private Limited, 2006
৩) Raj – The Making of British India, Lawrence James, Abacus, 1998
৪) Modern Times : India 1880s-1950s, Sumit Sarkar, Permanent Black, 2015
৫) আধুনিক ভারতের রূপান্তর – রাজ থেকে স্বরাজ (১৮৫৮-১৮৪৭), সমর কুমার মল্লিক, ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, ২০১৫-২০১৬
৬) আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস – ১৭০৭-১৯৬৪, সিদ্ধার্থ গুহ রায়, সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০১২
সমৃদ্ধ হলাম পড়ে।