ইনকা সভ্যতার আদ্যোপান্ত
আমি বাচুই, এক সাধারণ ইনকা নারী। কোন ষাট সত্তর বছর আগে জন্মেছিলাম পেরুর এক দূরতম অখ্যাত গ্রামে, তারপর থেকে এতগুলো বছর জীবনসংগ্রামেই কেটে গেল। একসময় ছিলাম ইনকা সাম্রাজ্যের সূর্যদেবতা ইন্তি-র জন্য মনোনীত নারী আকলা কুনা (সূর্যকুমারী), কিন্তু ভাগ্যের তাড়নায় আজ আমি এস্প্যানিওল নাবিক কারিনো মাতিয়াসের স্ত্রী ফিওরেলা। আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানিনা, ইন্তি (সূর্য দেব) আর মামাক্যুলিয়া-র (চন্দ্র দেবী) আনুকূল্য ছেড়ে আমাকে পরম পিতার চরণে আশ্রয় নিতে হল। আমাদের দেশের মানুষ লিখতে জানে না, কিন্তু এস্প্যানিওলদের কল্যানে আমি লিখতে শিখেছি, জেনেছি অক্ষরের মাধ্যমে কিভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে হয়।
দুনিয়া আমাদের ইনকা নামে জানে, তবে বিশ্বাস করুন আমাদের দেশটার কোন নামই ছিল না, দেশের চার প্রান্তের চারটে আলাদা নাম ছিল—পূর্বভাগ আনতিসুয়ূ, পশ্চিমভাগ কুনতিসুয়ূ, উত্তরভাগের নাম চিনচাসুয়ূ আর দক্ষিণের নাম ছিল কোলাসুয়ূ। মহান ইনকা সম্রাটদের রাজধানী কুসকো, যেখানে ‘মনোনীতদের বাড়ি’তে থাকতাম আমি।
আমার স্বামীর মুখে শুনেছি, প্রথমবারের জন্য এক এস্প্যানিওল জাহাজ বিষুব রেখা পার হয়ে আমাদের দেশে চলে এসেছিল। তটভূমি দেখে তারা এগিয়ে যায়, হটাৎ দেখতে পায় নদী যেখানে সাগরে মিশেছে সেখানে একজন ‘রেড ইন্ডিয়ান’ মাছ ধরছে। কয়েকজন ভাল সাঁতারু নাবিক চুপিসাড়ে জলে নেমে রেড ইন্ডিয়ানটিকে ঘিরে ধরে যাতে সে পালাতে না পারে। কিন্তু লোকটি পালাবার চেষ্টা তো করলই না, বরং অবাক বিস্ময়ে একরাশ কৌতূহল নিয়ে সাদা মানুষদের সাথে বিশাল এক জাহাজে গিয়ে উঠলো। ভাষা বড় সমস্যা, তাই আকারে ইঙ্গিতে কথা চলতে থাকে। নাবিকরা তাকে বেশ যত্নআত্তি করে নানারকম প্রশ্ন করে। কিন্তু তার পক্ষে সাদাদের ভাষা বোঝা সম্ভব ছিল না। আকারে ইঙ্গিতে আর কিছু শব্দের মাধ্যমে কথা চলতে থাকে। একসময় নাবিকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করে দেশটির নাম কি? সে প্রশ্ন বুঝতে না পেরে নিজের মত করে বলে যেতে থাকে যে, সে পেলু (নদী)তে মাছ ধরেছিল আর তার নাম বেরু। ‘পেলু’ ও ‘বেরু’ শব্দ দুটি মিলে মিশে ইউরোপীয় জিভে বিকৃত হয়ে দেশটির নাম হয়ে গেল পেরু।
আমাদের দেশটা পাহাড়ি মালভূমি অঞ্চল, তাই আমরা কখনো চাকার ব্যবহার করিনি। কোনো ধরনের যানবাহনও আমাদের ছিল না, মূলত হেঁটেই যাতায়াত হত আর মালপত্র পরিবহনের জন্য লামা (ভেড়া গোত্রীয় দক্ষিণ আমেরিকান প্রাণী বিশেষ) ব্যবহার করা হত। যানবাহনের ব্যবহার ছিল না তো কি, ইনকা সম্রাটদের দেশ আয়তনে মোটেই ছোট নয়। উত্তর দক্ষিণে এ দেশটি ছিল ৪০০০ কিমি বিস্তৃত। উত্তরে এর সীমানা ছিল, পেরু থেকে উপরের দিকে ইকুয়েডর হয়ে আরো উত্তরে কলম্বিয়ার নিম্নভাগে আনগাসমাইও নদী পর্যন্ত। দক্ষিণ দিকে বলিভিয়ার একটা বড় অংশ, আর্জেন্টিনার কিছুটা অঞ্চল হয়ে এর বিস্তার ছিল চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো ছাড়িয়ে মাউলি নদী পর্যন্ত। আর পূর্ব পশ্চিমে আমাদের দেশের সীমানা ছড়িয়ে পড়ে ছিল আন্দেজ পর্বতমালা থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অবধি। এত বিশাল ভূভাগে সূর্যের সন্তান সাপা ইনকা-রা নিজেদের নৈপুণ্যে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপন করতে পেরেছিলেন। সুশাসনের স্বার্থেই দেশ জুড়ে চওড়া চওড়া রাস্তাঘাট নির্মিত হয়েছিল। ইনকা সাম্রাজ্যের পরিকল্পিত রাস্তা গুলির আয়তন দেখে এস্প্যানিওল (স্পেনীয়) রা শুরুর দিকে অবাক হয়ে যেত।
প্রথম সাপা ইনকা মানকো কাপাক (আনুমানিক ১২০০ থেকে ১২৩০ সাধারণ অব্দ) ও তাঁর স্ত্রী কয়া (সম্রাজ্ঞী) ওকলিও হুয়াকো নিজেদের সূর্যের সন্তান ঘোষণা করে প্রথম রাজ্য স্থাপন করেন। নিজেদের সূর্য বংশীয় রক্তের শুদ্ধতা বজায়ে রাখার জন্য ভাই বোনের মধ্যে বিবাহেরও প্রচলন করেন তাঁরা। বাকি বিশ্বের কানে অদ্ভুত ঠেকলেও ভাইবোনের বিবাহ আমাদের সমাজে পবিত্র বলে গণ্য হত।
রাজধানী কুসকো নগরীর বিশালকায় স্বর্ণমণ্ডিত সূর্য মন্দির ছাড়াও তিতিকাকা, মাচুপিচুর মন্দির ছিল সুবিখ্যাত। সমস্ত মন্দির গুলো ছিল সোনায় মোড়া, চারিদিকে সোনা রুপোর ছড়াছড়ি। মূল মন্দির সূর্যদেবতা ইন্তির। আদ্যপান্ত সুবর্ণময়, পাশেই চন্দ্রদেবী মামাক্যুলিয়ার মন্দির—রুপো দিয়ে মোড়া। সূর্যমন্দিরের অংশ হিসেবে পাশেই অবস্থিত ছিল সূর্যের পরিচারক শুক্র বা চাসকা এবং সপ্তর্ষি মণ্ডলকে উৎসর্গ করা হলঘর। পরের হলটি তৈরি হয়েছিল বিদ্যুৎ চমক ও বজ্রপাতের দেবতা ইল্যাপার নামে। রামধনুর জন্য বরাদ্দ ছিল একটা আলাদা হল আর সর্বশেষ হলঘরটি পুরোহিতরা ধর্মকথা ও বাণী বিতরণের জন্য ব্যবহার করতেন।
কুসকো তে সূর্যমন্দিরের কাছাকাছিই ছিল ‘মনোনীতদের বাড়ি’—আমার মত আকলা কুনা(মনোনীত সূর্যকুমারী) দের বাসস্থান। আমাদের বাড়িটি ছিল আয়তনে বিশাল, সবরকম সুযোগ সুবিধা যুক্ত, কিন্তু আমরা কখনও বাইরে বেরোতে বা কারো সাথে দেখা করতে পারতাম না। জীবনটা ছিল খাঁচায় পোরা সোনার শেকল বাঁধা ফ্লেমিঙ্গো পাখির মত। আকলা কুনারা সকলেই সূর্যদেবের সেবার জন্য উৎসর্গীকৃত, মামাকুনার (তত্ত্বাবধায়ক বয়স্কা নারী, প্রাক্তন আকলা কুনা) নজরদারিতে তাদের শিক্ষাদান চলত।
এই পরিণত বয়সে এসে স্মৃতি যখন ভারাক্রান্ত, মাঝে মাঝে ফিরে যাই আবছা হয়ে যাওয়া ছেলেবেলার সেই দিনগুলোতে। মনে পড়ে আনতিসুয়ূর এক সুদূর অখ্যাত গ্রামের কথা। চাঁদনী রাত। উঠোনে আগুনের পাশে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। কতই বা বয়স হবে আমার, বড়জোর সাত কি আট। মা পাশে বসে শোয়া অবস্থাতেই আমার মুখে গুঁজে দিচ্ছে কাঁটা বাছা মাছ, ভুট্টা সেদ্ধ। বাবা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে চলেছে মামাক্যুলিয়ার গল্প। পরম আবেশে চোখ বুজে আসছে আমার।
এ সুখ বেশিদিন সইতে পারলাম না। হটাৎ ধেয়ে আসা টাইফুনে যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ছোটবেলার সেসব সুখের দিনগুলো। একদিন ভোরে দেখলাম বাড়ির উঠোনে অনেক লোক, সৈন্য। বাজনা বাজছে চারিদিকে। কয়েকজন লোক এসে বাবা আর দাদুর সাথে কথা বলতে শুরু করল। সকলের নজর আমার দিকে। ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জাপটে ধরলাম। দেখি বাবাও আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। পাশে মা এসে দাঁড়ালো, নিস্তব্ধ নিথর। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না, ওরা এমন করছে কেন? একটু পরে কাকা এসে ঘরে ঢুকল, তার চোখেও জল। অনেক খাবার দিল আমায়। আদর করে বলল, আমাকে নাকি স্বয়ং সূর্যদেব ইন্তি নির্বাচিত করেছেন তাঁর সেবার জন্য। পরম সৌভাগ্যবতী নাকি আমি। ঐ বয়সে আমি এসব কথার মানে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এতই যখন সৌভাগ্য তবে সবাই কাঁদছে কেন? একটু পরে আমার জন্য দামি দামি পোশাক ও গহনা এল। একজন অপরিচিত মহিলা এসে আমাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন। সুন্দরী ছিলাম আমি, কিন্তু ওসব রাজবেশ পরার পরে নিজেকে রামধনুর দেশের পরীর মত লাগছিল যেন। আনন্দ করে মাকে দেখাতে গেলাম। আমার ডাক শুনে নিথর নিষ্প্রাণ মায়ের সম্বিৎ ফিরলো, চুমপিতে (রেড ইন্ডিয়ানদের পোশাকের এক বিশেষ বেল্ট) জড়িয়ে নিজের সাথে বেঁধে ফেললো মা আমাকে। বলল, মেয়েকে আমার কোল থেকে কোথাও যেতে দেব না। মায়ের চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল পড়ছে, কিন্তু চোয়াল শক্ত। এবারে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। খুব ভয়। কিন্তু কাঁদলাম না। কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম, তবুও ঠিক করলাম মায়ের মত শক্ত হতে হবে, দৃঢ় হতে হবে। যেখানেই যেতে হোক না কেন মা বাবা তো সঙ্গে থাকবে, ভয় কি? সবাই যে বলে আমি খুব সাহসী?
সময়ের চাকা ঘুরে চলে। ইনকাদের বহু উত্থান পতনের সাক্ষী থাকি আমি, ভূষণ্ডি কাকের মত। শরীর মনকে বিধ্বস্ত করা টাইফুন যেন চলতেই থাকে। খুব তাড়াতাড়ি জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে শিখে গেলাম আমি। একঘেয়ে জীবনযাত্রা। মনোনীতদের বাড়িতে ইনকার জন্য পোশাক সেলাই করা, পবিত্র অগ্নি রচনা, সূর্যের উপাসনা করা, ভোগের জন্য নানারকম রান্নাবান্না—বহু শিক্ষাই সমাপ্ত হয়ে গেছে আমার। এ বাড়িতে কয়া(সম্রাজ্ঞী) ছাড়া বাইরের কারো ঢোকার অনুমতি নেই, এমনকি স্বয়ং ইনকারও নয়। সেই সেদিনের পরে বাবা মায়ের দেখা পাওয়া তো দূর কোনো খবরও পাইনি। কালের নিয়মে একসময় পরিবারের জন্য মনখারাপ কমতে থাকে, এখানকার মেয়েদের নিয়ে মেতে থাকি। আমাদের বাসস্থানে নিত্যনতুন মেয়েদের আনাগোনা লেগেই থাকে, আবার কেউ কেউ অজান্তে হারিয়েও যায়।
বারো চোদ্দ বছর বয়সী একটি মেয়েকে খুব ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম, নিজের বোনের মত। খুব ন্যাওটা ছিল আমার। একদিন কোয়া পাসকার (সূর্যকুমারী দের প্রধানা পুরোহিত) মুখে শুনলাম তাকে কাপাকোচা উৎসবের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। শেষ পর্যন্ত আমার প্রিয়তম বোনটাকেও? আমাকে যেদিন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল সেদিনও বোধহয় এতটা দুঃখ পাইনি। এ তোমার কেমন বিচার ইন্তি? কি করব ভেবে পাইনা আমি। চোখের জলকে বাগ মানানো অসম্ভব। চাইলেও কিচ্ছুটি করারও নেই। ইনকা সাম্রাজ্য কঠোর অনুশাসনে চলে। বুক ফেটে গেলেও মুখ বন্ধ রাখলাম। নিজেকে শক্ত করতে হবে।
ইনকা সম্রাটের সিংহাসন আরোহন, যুদ্ধজয়, রাজপুত্র বা রাজকন্যার জন্ম অথবা রাজ্যে ভাল ফসলের জন্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাপাকোচা উৎসব পালন করা হয়। এজন্য প্রয়োজন একটি নিখুঁত সুন্দরী কুমারী কন্যা। কন্যা সংগ্রহে কোন সমস্যাই নেই, আমাদের বাসস্থানের সকল কিশোরীই এজন্য উপযুক্ত। কোয়া পাসকা আমাদের মধ্যে থেকে কাউকে বাছাই করে দেন। এবারের ভাগ্যবতী যেমন আমার এই প্রিয় বোনটি। তার খাবার স্বয়ং ইনকার পাকশাল থেকে আসতে লাগল। অত্যন্ত মহার্ঘ সব খাবার, মহার্ঘ পোশাক। আমি জানি ওকে এখন রাজকীয় মর্যাদায় রাখা হবে। প্রচুর সম্মান, যত্ন বরাদ্দ হবে ওর জন্য। কাপাকোচা উৎসবের ঠিক ৪২ থেকে ৫৬ দিন আগে থেকে ওর খাবারে একটু একটু করে কোকা পাতা (কোকেন) মেশানো শুরু হবে। সঙ্গে প্রচুর চিচা-ও(কড়া মদ) পান করানো হবে ওকে। উৎসবের দিন যত এগিয়ে আসবে মাদকের পরিমাণও বাড়তে থাকবে। শেষে মেয়েটি এমন মাদকাসক্ত হয়ে পড়বে যে, স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনার ক্ষমতাও লোপ পাবে তার। তখনই আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
দেখতে দেখতে এসে গেল উৎসবের দিন। ইতিমধ্যে দূরবর্তী কোন গ্রাম থেকে দুটি ছয় সাত বছরের বালক বালিকাকে ধরে আনা হয়েছে, সূর্যকুমারীর সেবক সেবিকা রূপে। তাদেরও মাদক জাতীয় খাবার খাইয়ে তৈরি করে নেয়া হয়েছে। এবারকার উৎসব স্থল আরেকিপার পাহাড়ের লুলাইমাকো। আমি আমার বোনটিকে শেষ বিদায় জানাতে চাইলাম কিন্তু মামাকুনা অনুমতি দিলেন না। রাজ্য জুড়ে আনন্দের ঢেউ। নাচ-গান, খানাপিনা চলছে, বাজনা বাজছে চারিদিকে। মেয়েটিকে ভক্তি সহকারে মিছিল করে পাহাড়ের উপর নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে পৌঁছে পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে সারাদিন বিভিন্ন রকম আচার অনুষ্ঠান পালিত হল। বিকেলে ইন্তির সন্তুষ্টি বিধানের জন্য মেয়েটিকে পাতলা পোশাক পরিয়ে ওই হিমশীতল পাহাড়ে রেখে সকলে চলে এল। এবারে ইন্তি গ্রহণ করবেন ওকে। বিনিময়ে রাজ্যে মঙ্গল নেমে আসবে। কোকেনের প্রভাবে মেয়েটি তখন চলশক্তিহীন। কয়েক ঘন্টা পরে একজন রাজপুরুষ গোপনে গিয়ে দেখেন প্রবল ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকলেও তখনও মেয়েটির মৃত্যু হয়নি। প্রবল শৈত্য জনিত (হাইপোথার্মিয়া) মৃত্যু হলে তো মিটেই যেত, তা যখন এখনও হয়নি, তখন ইন্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটা ভারী কাঠ দিয়ে মেয়েটির মাথায় আঘাত করে চলে এসেছিলেন সেই রাজপুরুষ। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পার্থিব জগৎ ছেড়ে ইন্তি দেবের কাছে পৌঁছে গেল সৌভাগ্যবতী মেয়েটি। পরদিন সূর্যকুমারীর দেহ কাপড়ে মুড়ে এক বরফ ঢাকা গর্তে সমাধিস্থ করা হল। সঙ্গে দেয়া হল পরজন্মে মেয়েটির প্রয়োজন হতে পারে এমন কিছু বস্তু।
সূর্যকুমারীর সেবক ও সেবিকা সেই বালক বালিকা দুটিকেও পাহাড়ের পাদদেশে পাতলা পোশাকে রেখে আসা হয়েছিল। পরকালে সূর্যকুমারীর সেবা করতে হবে যে! প্রবল শীতে (হাইপোথার্মিয়া) শিশু দুটিরও গোলক যাত্রা সুচারু ভাবে সম্পন্ন হতে সময় লাগল না। এদের মধ্যে একটি শিশু তো আবার পরম সৌভাগ্যবান, ইল্যাপা দেবের কৃপা (বজ্রপাত) বর্ষিত হল তার দেহে। তিন তিনটে শিশুর বলি গ্রহণ করে ইন্তি কি সন্তুষ্ট হলেন?
(১৯৯৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর প্রত্নতাত্ত্বিক জোহান রেইনহার্ড ও তাঁর সহকারী মিগুয়েল জারাতে পেরুর আরেকিপার মাউন্ট এমপ্যাটে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি পরিদর্শন ও পর্বত শীর্ষের বরফের উপর আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে ওঠেন। জায়গাটির উচ্চতা ছিল ২০৬৩০ ফিট মত। সেখানে পাহাড় চূড়ার ঢালে বরফের ফাঁক দিয়ে হটাৎ তাঁদের কাপড় জাতীয় কিছু একটা নজরে পড়ে। সেখানে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন একটি মমি, কাপড়ে জড়ানো। মানব ইতিহাসের অন্যতম সুরক্ষিত এই মমিটি ছিল ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীর, যে অন্তত পাঁচশো বছর আগে মারা গেছে। মমিটির হাতের চামড়া খানিক বিবর্ণ হয়ে গেলেও বাকি শরীরে কোন ক্ষয় ছিল না, চুলগুলিও ছিল সুবিন্যস্ত। এই মমিটির নাম দেয়া হয় হুয়ানিতা।
সে বছরেই অক্টোবর মাসে প্রত্নতাত্ত্বিক দুজন ২য় অভিযান চালান ও ঐ পাহাড়েরই নিম্নদেশে একটি বালক (বয়স আনু: ৭ বছর) ও একটি বালিকার (বয়স আনু: ৬ বছর) মমি খুঁজে পান। এদের মধ্যে একটি দেহ বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত শিশু দুটিকে হুয়ানিতার সেবক রূপে উৎসর্গ করা হয়।)
ইনকা সাম্রাজ্যে অক্ষরের প্রচলন ছিল না। বিদ্যালয় শিক্ষা শুনে শুনেই হত, কিন্তু সাম্রাজ্যের যাবতীয় তথ্য ও হিসেব নিকেশ খুব সুচারু ভাবে রাখা হত। কিভাবে? এক অদ্ভুত উপায়ে। ‘কিপু’। কিপুর সাহায্যে অক্ষরজ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ইনকাবাসীরা তথ্যভাণ্ডার সুরক্ষিত রাখতে পারত। কেচুয়া ভাষায় কিপু শব্দের অর্থ গ্রন্থি বা গিঁট। রেড ইন্ডিয়ানরা বিভিন্ন রকম সুতো তৈরি করত—এক রঙের, দুই তিন বা ততোধিক রঙের। প্রত্যেক একক রং বা মিশ্র রঙের আলাদা আলাদা অর্থ। সুতোগুলো মিশিয়ে মিশিয়ে অর্থবোধক ভাবে পাকানো হত। গিঁট গুলি সাজানো হত দশের ক্রমপর্যায়ে—দশ, একশো, এক হাজার, দশ হাজার ইত্যাদি। প্রতিটি গ্রাম আলাদা তথ্য রাখত, রাজধানীগুলিতে অধীনস্ত জেলার তথ্য আলাদাভাবে সংরক্ষিত হত। তথ্যভাণ্ডারও যথেষ্ট আধুনিক ছিল। রাজস্বের পরিমান থেকে জনগণনা, অস্ত্রভাণ্ডার থেকে সৈন্যসংখ্যা সবই কিপুর মাধ্যমে নিপুণভাবে সংরক্ষণ করা যেত। যারা এই কাজটি করত তাদের বলা হত কিপুকামায়ু। কিপুকামায়ুরা শুধুমাত্র কিপুর সাহায্যেই এমনকি কোন এক বছরে বিবাহিত পুরুষ বা মহিলার সংখ্যা, বিপত্নীক কিংবা বিধবা নারী পুরুষের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা, মৃতদের বয়সের হিসাব, সদ্যোজাত শিশুর সংখ্যা যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করতে পারতেন।
ইনকা সম্রাটরা নিজেদের সূর্যের সন্তান বলে মনে করতেন। তাদের বংশে রক্তের বিশুদ্ধতার জন্য ভাই বোনের বিবাহের উল্লেখ তো আগেই করা হয়েছে, বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী ইনকারা ছিলেন সাপা ইনকা। বাকিরা সাপা নন, শুধুমাত্র ইনকা। ইনকা সম্রাটদের মৃত্যুর পর মৃতদেহ মমি করে সূর্য মন্দিরে ইন্তির দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখা হত। একইভাবে সম্রাজ্ঞীদের মমিকৃত মৃতদেহ চন্দ্র মন্দিরে মামাক্যুলিয়ার দিকে মুখ করে রাখা থাকত।
ইনকা পাচাকুতিকের (আনু: ১৪৩৮–১৪৭১ সাধারণ অব্দ) অবকাশ যাপন কেন্দ্র রূপে মাচুপিচুর নির্মাণ করা হয়। এখানকার বিখ্যাত স্থাপত্য ইন্তিউয়াতানা পাথর বা সূর্যঘড়ি, ইন্তির মন্দির, তিন জানালা ঘর সবই সোনা ও রুপোয় মোড়া ছিল। মাচুপিচুতে মাত্র ৭৫০ জন লোক বসবাস করতে পারত যারা ইনকা পাচাকুতিকের সেবার জন্য নিয়োজিত ছিল।
ইনকারা সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন ঠিকই, একইসঙ্গে প্রজাদের সুখ সুবিধার খেয়ালও যথেষ্টই রাখতেন। অশক্ত, বৃদ্ধ বা বিকলাঙ্গদের জমি রাষ্ট্রের তরফে চাষ করে দেওয়া, বাঁধ ইত্যাদি জনকল্যাণ মূলক নির্মাণ কাজ ইনকাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিল বটে, তবুও প্রজা বিদ্রোহ যে একেবারে হয়নি তা বলা চলে না। ইনকা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রজা বিদ্রোহ ছিল চানকা বিদ্রোহ।
ইনকা ইয়াহুয়ার হুয়াকাক (আনু: ১৩৮০–১৪১০ সাধারণ অব্দ) তার পুত্র উইরাকোচাকে দুর্বিনীত ব্যবহারের জন্য শাস্তির উদ্দেশ্যে নির্বাসনে পাঠান। তিন বছর নির্বাসনে কাটানোর পরে একদিন উইরাকোচা হটাৎ নির্বাসন ভেঙে প্রাসাদে এসে হাজির হলেন। তিনি অবিলম্বে সাপা ইনকা তথা তার পিতা ইয়াহুয়ার হুয়াকাকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। উইরাকোচার স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হলেও কৌতূহল বশত সাপা ইনকা তার সাথে দেখা করলেন। ইনকার উদ্দেশ্য ছিল ছেলের মতলব আন্দাজ করা। কিন্তু উইরাকোচা তখন এক অন্য মানুষ। সৌজন্যের প্রতিমূর্তি যেন। নম্র ভাবে তিনি পিতাকে সংবাদ দিলেন চিনচাসুয়ূ প্রদেশ থেকে বিদ্রোহীরা এক বিশাল বাহিনী নিয়ে রাজধানী কুসকো আক্রমণ করতে আসছে। তাদের উদ্দেশ্য ইনকাকে সিংহাসন চ্যুত করা। ইনকা যেন অবিলম্বে সেনাবাহিনী একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।
ইনকা ইয়াহুয়ার হুয়াকাক রাজকুমারের কথা বিশ্বাস করলেন না, কারণ চারিদিকে ইনকার গুপ্তচর ছড়িয়ে ছিল। এত বড় একটা খবর গুপ্তচরেরা জানবে না তা কি করে হয়। তিনি ভাবলেন এটা রাজকুমারের নির্বাসন ভেঙে ফেলার ও সহানুভূতি আদায়ের একটা কৌশল মাত্র। রাগে ফেটে পড়ে ইনকা পুত্রকে তিরস্কার করে পুনরায় নির্বাসনে পাঠালেন। তাঁর ধারণা ছিল সূর্য সন্তানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার দুঃসাহস কেউ দেখাতেই পারে না!
চিনচাসুয়ূর বেশ কিছু জাতি চানকাদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে স্থানীয় ইনকা প্রশাসকদের হত্যা করে ৪০ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী নিয়ে সত্যি সত্যিই কুসকো অভিমুখে যাত্রা করেছিল। চানকারা এক সময়ে স্বাধীন ছিল। যুদ্ধবাজ জাতিরূপে তারা উত্তরপ্রান্তের কেচুয়া দের উপরেও অত্যাচার চালাত। ইনকা রোকা (আনু: ১৩৫০ থেকে ১৩৮০ সাধারণ অব্দ) এদের দমন করলে কেচুয়ারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যাইহোক, চানকা বিদ্রোহের সংবাদ সত্যিই যখন সাপা ইনকার কাছে পৌঁছল তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কুসকোতে কোনো দুর্গও ছিল না, সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিও ছিল না। এরকম অবস্থায় হতবুদ্ধি ইনকা কুসকো ছেড়ে পালিয়ে আনগোসতুরা নামে জায়গায় চলে গেলেন। রাজধানী কুসকো সম্পূর্ন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রইল। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা নগরবাসীদের একাংশ নির্বাসিত রাজকুমার উইরাকোচাকে খবর দিলে তিনি পিতার পলায়নের সংবাদে খুব লজ্জা পেলেন। প্রজাদের আশ্বস্ত করে এবারে তিনি রাজধানী রক্ষার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। অস্বাভাবিক দ্রুততায় সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের আদেশ জারি হল। রাজ্য জুড়ে এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাজার হাজার সাধারণ মানুষ উইরাকোচার নেতৃত্বে রাজধানী রক্ষায় অস্ত্র হাতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। নিজের বুদ্ধির ভরসায় উইরাকোচা এই অসম যুদ্ধে নামতে দ্বিধা করলেন না। যুদ্ধ চলাকালীন চানকা দের শত্রু কেচুয়ারা এসে ইনকা পক্ষে যোগ দিলে বিদ্রোহীরা হতভম্ব হয়ে পড়ল। এবারে তাদের পরাজয় ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। রাজধানীকে চরম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে উইরাকোচা পিতার অনুমতি নিয়ে সাপা ইনকার দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন (আনু: ১৪১০ থেকে ১৪৩৮ সাধারণ অব্দ)। বিড়ম্বিত ইয়াহুয়ার হুয়াকাক আর কখনো জনসমক্ষে আসেননি।
পরবর্তী একশো বছর নানা ঘাত প্রতিঘাত সত্ত্বেও ইনকা সাম্রাজ্য ভালোমতোই নিজের অস্তিত্ত টিকিয়ে রেখে ছিল। ১৫৩২ সাধারণ অব্দে সাপা ইনকা হুয়াসকার ও তাঁর সৎ ভাই আতাহুয়ালপা—যিনি জন্মসূত্রে সাপা ছিলেন না, এঁদের সিংহাসন নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে ইনকা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগায় এস্প্যানিওলরা। ১৫৩২ থেকে ১৫৭২ সাধারণ অব্দের মধ্যে তারা ইনকাদের চিহ্নটুকুও মুছে ফেলে। সোনার লোভে লুন্ঠিত হয় কুসকো সহ যাবতীয় শহর। ইন্তির মন্দির ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। বহু রেড ইন্ডিয়ান দাস বাজারে বিক্রি হয়ে যায়।
একরাতে হটাৎ স্থানীয় জেনারেলের নির্দেশে একদল স্পেনীয় সৈন্য মনোনীতদের বাড়ির দখল নেয়। সকল যুবতীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি বাচুইও সেই সময় দস্যুদের কবলে পড়ি। আমার জীবনের অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা সামলানো মাথায় তখন কেবল একটা কথাই ঘুরছিল। বিপদ যতই আসুক না কেন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ক্রীতদাসী হিসেবে সাদাদের দাসবাজারে বিক্রি হওয়া থেকে বাঁচাতেই হবে নিজেকে, যেমন করেই হোক। মনোনীতদের বাড়িতে থাকাকালীনই খবর পেতাম দুর্বৃত্ত এস্প্যানিওলদের মধ্যেকার কিছু ভালো মানুষ কয়েকজন রেড ইন্ডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এটাই আমার জন্য বাঁচার সেরা পথ হবে মনে হল। ছোটবেলা থেকে অন্যদের মুখে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে এসেছি। এই রূপ একদিন আমার ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিল, আজ এই রূপকে কাজে লাগিয়েই মুক্তির পথ খুঁজবো আমি।
বহুদিন পরে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছে প্রাক্তন আকলা কুনা রূপে ইনকা সাম্রাজ্যের বহু না জানা কাহিনী লিখে রাখতে পেরে তৃপ্তি বোধ করছি। ইনকাবাসীদের লিখতে না জানা আর এস্প্যানিওলদের নির্বিচার ধ্বংসলীলা এই দুইয়ের অভিঘাতে ইনকা সাম্রাজ্যের বহু কাহিনী ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাবে। তবু ভবিষ্যৎ পৃথিবী আমার নতুন শেখা অক্ষরের মাধ্যমে ইনকাদের সম্পর্কে অতি সামান্য কৌতূহলী হলেই নিজেকে স্বার্থক বলে মনে করব।
ইতি
বাচুই ওরফে কারিনো ফিওরেলা
লিমা
১৫৮১ খ্রিস্টাব্দ
তথ্যসূত্র:
• The Royal Commentaries Of The Incas & General History Of Peru: Garcilaso De La Vega; Hackett Publishing (2006)
• Sacred Mountains, Ceremonial Sites & Human Sacrifice Among The Incas: Johan Reinhard; Archaeoastronomy (June 2005)
• পেরুর প্রাকৃত ইতিহাস: গার্সিলাসো দে লা ভেগা, অনুবাদ: অশেষ রায়; রেডিক্যাল, কলকাতা
সমৃদ্ধ হলাম নতুন তথ্য জেনে। অবাক হলাম প্রচীন বিশ্বাস জেনে। সেই সময় সায়েন্সের অগ্রগতির প্রমান হলো মমি ও তার সংরক্ষণ।
অসাধারণ লেখা
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। ইনকা রা গাড়ি বানাতে জানতো না, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কোন পর্যায়ে গিয়েছিল তা ওদের শহর পরিকল্পনা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি দেখলেই বোঝা যায়।