বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য
১৯২২ সাল, প্যারিসের ‘ইকোল নরমাল সুপেরিয়র’ (ইএনএস) বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হলেন ১৬ বছরের ছাত্র অঁদ্রে আবহাম ভেই (১৯০৬-১৯৯৮)। গণিত তাঁর প্রিয় বিষয় হলেও প্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়েও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন তিনি। বিশেষত সংস্কৃত ভাষা ও ভারত ছিল তাঁর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্যারিসে বসে কী আর সংস্কৃত ভাষা শেখা সম্ভব? ভেই তাই ভাবছেন, কীভাবে, কার কাছ থেকে ভারত ও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়? সেই সময়ে প্যারিসের ‘প্র্যাকটিক্যাল স্কুল ফর হায়ার স্টাডিজ’-এ অধ্যাপনা করতেন বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি (১৮৬৩-১৯৩৫)। সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি তাঁর। বছর দুয়েক আগে, ১৯২০ সালে, ইউরোপ ভ্রমণের সময়ে লেভির সাথে পরিচয় ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রণ জানান রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেছিলেন লেভি। ২৩ ডিসেম্বর ১৯২১, বিশ্বভারতীর উদ্বোধনের দিন শান্তিনিকেতনে উপস্থিত ছিলেন লেভি। অগস্ট, ১৯২২ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর ফরাসি, চিনা ও তিব্বতীয় ভাষার আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে পাঠদানও করেছিলেন তিনি। সম্প্রতি বিশ্বভারতীর পাট চুকিয়ে ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করেছেন তিনি। এহেন লেভিকেই তাঁর পথ প্রদর্শক বলে বিবেচনা করলেন ভেই।
অঁদ্রে আব্রাহাম ভেই, ১৯২১ সালের ছবি
অধ্যাপক লেভির সাথে কোনও পরিচয়ই ছিল না ভেই’র। তাতে অবশ্য বিন্দু মাত্র দমেননি ভেই। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে একদিন লেভির বাড়ি হাজির হলেন। অপরিচিত এক তরুণকে দেখে কৌতুহলী লেভি জিজ্ঞেস করলেন, “বলো, কী চাও?” ভেই’র সটান জবাব, “ভারত সম্পর্কে জানতে চাই, পড়তে চাই সংস্কৃত সাহিত্য”। আগন্তুক তরুণের কথা শুনে খানিকটা অবাকই হলেন লেভি। “বটে, সংস্কৃত সাহিত্য পড়বে? আচ্ছা, দেখি কত দম আছে তোমার!” বিড়বিড় করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে, নিজের বুকসেলফের দরজা খুলে, লাল রঙের ছোটোখাটো একটা বই বার করে যুবকের হাতে দিয়ে বললেন, “নাও, এটা পড়ে ফেলো। এটা না পড়লে ভারতকে কিছুই বুঝতে পারবে না তুমি।” বইটা হাতে নিয়ে পাতা উলটাতেই ভেই দেখেন মূল সংস্কৃত ভাষায় লেখা গীতা! ভেই’র দু’চোখে তখন রোমাঞ্চ ঝরছে। এ যেন হাতে অমৃত পেয়েছেন তিনি। যদিও সংস্কৃত ভাষার কিছুই জানেন না তিনি তখনও। তাতে কী হয়েছে, সংস্কৃত-ফরাসি অভিধান আছে না। ওটা সংগ্রহ করে নেবেন। আর আছেন স্বয়ং অধ্যাপক লেভি। উত্তেজিত ভেই দ্রুত বিদায় নেন লেভির কাছ থেকে। আজই গীতা পড়া শুরু করতে হবে তাঁকে।
পড়লেন তিনি গীতা। সম্পূর্ণ গীতা। মূল দেবনাগরী অক্ষরেই। ওই সব অভিধান আর লেভির সাহায্য নিয়েই পড়লেন তিনি। পরে, নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, “আই রেড দ্য গীতা ফ্রম কভার টু কভার”। ছাত্র ভেই’র কাণ্ডে বিস্মিত লেভি। আর লেভির প্রশ্রয়ে ভেই’র উৎসাহ যেন দিনকে দিন বেড়েই চলল। ভারত নিয়ে ভেই’র উৎসাহ এমন জায়গায় পৌঁছল যে এখন তিনি মনে করছেন, সশরীরে ভারতে না গেলে তাঁর লক্ষ্য পূরণ হবে না কোনও দিনও। কিন্তু বললেই কী আর দুম করে ভারতে যাওয়া যায়? অগত্যা প্যারিসে বসেই ভারতকে যতটা জানা যায় সেই চেষ্টাই করতে থাকেন ভেই। অধ্যাপক লেভি তখন কালিদাসের মেঘদূত নিয়ে নিয়মিত পাঠদান করতেন তাঁর কলেজে। লেভির সেই কলেজের ছাত্র ছিলেন না ভেই। ভেই তো গণিত নিয়ে পড়ছেন ইএনএসে। নিজের গণিত ক্লাসে নিয়মিত হাজির হতেন বা না হতেন, লেভির লেকচার শুনতে ভেই কিন্তু নিয়মিত হাজির হতেন লেভির কলেজে। শুধু কী তাই? ‘স্কুল ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস’এ তখন বেদ নিয়ে লেকচার দিতেন অধ্যাপক জুল ব্লোচ। ব্লোচের সেই ক্লাসেও নিয়মিত হাজির হতেন ভেই।
সৈয়দ রস মাসুদ
১৯২৯ সালের শরৎকাল, প্যারিস শহরে এসে অধ্যাপক লেভির আতিথ্য গ্রহণ করেছেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ রস মাসুদ (১৮৮৯-১৯৩৭)। আলিগড় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সৈয়দ আহমেদ খানের নাতি সৈয়দ রস মাসুদ নিজে কলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯১০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বিএ (অনার্স) পাশ করেন মাসুদ। ইংরাজি, ফরাসি, আরবি, উর্দু সহ একাধিক ভাষায় বুৎপত্তি ছিল তাঁর। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিত ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। তিনি চাইতেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেন উদার ও বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে উঠেন। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব নেওয়ার পরই তাই বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন মাসুদ। এই সমস্ত বিষয়ে পাশ্চাত্যের জ্ঞানকে কাজে লাগাবার কথা ভাবতেন তিনি। সেই মতো কথা প্রসঙ্গে অধ্যাপক লেভিকে বললেন, “আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপযুক্ত অধ্যাপকের খোঁজ করছি। এই ব্যাপারে আপনার কোনও সাহায্য পেতে পারি?” বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ভেই’র কথা মনে পড়ে গেল লেভির। মাসুদের দিকে চেয়ে- “একটু অপেক্ষা করুন” বলেই দ্রুত হাতে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন।
-“হ্যালো” অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ভেই’র কণ্ঠস্বর।
– “যদি ভারতে যেতে চাও তো এক্ষুনি আমার সাথে দেখা করো”। ব্যাস এইটুকু বলেই ফোনটা নামিয়ে রাখেন লেভি।
ভারতে যাওয়া!? এ যে তাঁর স্বপ্নের যাত্রা! আর কিছু ভাবেন নি ভেই। টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে, মুহূর্তের মধ্যে ট্যাক্সি ধরে সোজা লেভির বাসায় হাজির। সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর মাসুদের সাথে ভেই’র আলাপ করিয়ে দেন লেভি। মাসুদ বললেন, “ভারতের আলিগড়ে গিয়ে পড়াতে হবে আপনাকে। আপনি কি ভারতে যেতে রাজি আছেন?”
‘রাজি আছেন’! ‘রাজি আছেন’ মানে কী? ভারতে যাওয়ার জন্য তো পা বাড়িয়েই আছেন তিনি।
ফসল
১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ইতালির জেনোয়া থেকে সমুদ্র পথে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ভেই। সপ্তাহ দু’য়েক পর বোম্বেতে অবতরণ করেন। বোম্বে থেকে ট্রেনে ধরে দিল্লি। দিল্লি থেকে আলিগড়। আলিগড় স্টেশনে তাঁকে ফুলের মালা পড়িয়ে অভ্যর্থনা জানান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের অনতিকাল পরেই ভেই বুঝতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিকাঠামো যথেষ্ট আধুনিক নয়। গ্রন্থাগারে পুস্তক সংখ্যা শুধু অপর্যাপ্তই নয়, ইউরোপের বাজারে এগুলো এখন অচল। হালফিল গণিতের বইয়ের জন্য ইউরোপের বাজার থেকে বেশ কিছু বই ডাকযোগে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন তিনি। ভেই এও বুঝলেন গণিত বিভাগে আরও অধ্যাপকেরও প্রয়োজন তাঁর। সেই সূত্রে তরুণ ভারতীয় গণিত প্রতিভার খোঁজ করতে থাকেন তিনি। ঘটনাচক্রে এই সময়েই তিন তরুণ ভারতীয় গণিতজ্ঞের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। সেই তিন তরুণ গণিতজ্ঞরা হলেন- মাদ্রাজের তিরুককান্নানপুরম বিজয়রাঘবন (১৯০২-১৯৫৫), লাহোরের সর্বদমন চাওলা (১৯০৭-১৯৯৫) এবং গোয়ার দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি (১৯০৭-১৯৬৬)।
দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি
কোসাম্বির থেকে বছর খানেকের বড় ছিলেন ভেই। হয়তো বা সেই কারণেই কোসাম্বির সাথে একটু বেশিই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ভেই’র। গণিত চর্চার পাশাপাশি তাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায়ই হাসি ঠাট্টা হতো তাঁদের মধ্যে। এমনই এক হাসি ঠাট্টার ছলে, কোসাম্বিকে বুরবাকির উপপাদ্যর কথা শোনান ভেই। সেটা ছিল ১৯২২ সাল, প্যারিসের ইএনএস কলেজের গণিত বিভাগে তখন সদ্য ভর্তি হয়েছেন ভেই। গণিতের প্রথম বর্ষের ছাত্রদের একদিন জানানো হয়, এক আমন্ত্রিত বক্তা আসছেন গণিতের উপর বক্তব্য রাখতে। সমস্ত ছাত্ররা যেন ঐ দিন উপস্থিতি থাকেন। নির্দিষ্ট দিনে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা উপস্থিত হলেন সেমিনার কক্ষে। এক মুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হলেন সেই আমন্ত্রিত বক্তা। এক বিচিত্র উচ্চারণ ভঙ্গিতে ভাষণ শুরু করলেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি যা বললেন তার অধিকাংশই ভুলে ভরা। উপস্থিত প্রথম বর্ষের ছাত্ররাও প্রফেসরের সেই ভুল ধরতে পারছেন সহজেই। হলে তো তখন রীতিমতো গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। এ সব কী বলছেন প্রফেসর? প্রফেসরের কিন্তু কোনও হেলদোল নেই। তিনি স্বকীয় মেজাজে ভাষণ দিয়েই চলেছেন। আর থাকতে না পেরে বিরক্ত ছাত্ররা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেন, “এই সব তত্ত্ব কোথা থেকে পেয়েছেন আপনি?” ছাত্রদের প্রশ্ন শুনে মুহূর্ত জন্য থামলেন প্রফেসর। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে প্রফেসর বলে উঠলেন – “এগুলো সব বুরবাকির উপপাদ্য”।
বুরবাকি? তিনি আবার কে? এমন কোনও গণিতজ্ঞের নাম তো শোনে নি কেউ। ছাত্ররা ভাবলেন, হয়তো বা বড় কোনও গণিতজ্ঞ হবেন বুরবাকি। তাঁরাই হয়তো বুরবাকির নাম শোনেন নি। ঘাবড়ে গিয়ে তাই চুপ করে গেলেন সবাই। প্রফেসর কিন্তু তখনও দ্বিধাহীন চিত্তে ভুলভাল তথ্য দিয়ে বক্তব্য রেখেই চলেছেন। সভাগৃহে তখন ফের শুরু হলো কোলাহল। কে এই বুরবাকি? কেই বা এই প্রফেসর? কোথা থেকে তিনি পেয়েছেন এই বুরবাকির উপপাদ্য? তুমুল চিৎকার চেঁচামিচির মধ্যে অবশেষে ফাঁস হলো পর্দা। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের হেনস্থা করতে, তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র নকল প্রফেসর সেজে তাঁদের সাথে মজা করেছেন মাত্র।
ভেই বলে চললেন, বুরবাকি নামটা কিন্তু আগে কখনও শুনি নি আমি। পরে জানলাম, তৃতীয় নেপোলিয়নের মিলিটারি জেনারেল ছিলেন শার্লে ডেনিস সুতে বুরবাকি। ১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে যিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু জেনারেল বুরবাকির সাথে গণিতের কোনও সম্পর্কই নেই। অর্থাৎ বুরবাকির উপপাদ্য বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই পৃথিবীতে। পুরোটাই সাজানো গল্প। ছাত্রমহলের কাছে যেহেতু বুরবাকির নামটা অজানা ছিল, প্রফেসর বেশী সিনিয়র ছাত্র তাই বুরবাকির নামটা বেছে নিয়েছিলেন, স্রেফ তাঁদের ভাঁওতা দেওয়ার জন্য।
ভেই’র এই গল্প শুনে মজা পান কোসাম্বিও। তবে নিছক মজার মধ্যেই কিন্তু থেমে থাকল না ব্যাপারটা। বুরবাকির গল্পটা বলার পর থেকে, ওই রকম ভাবে লোককে বোকা বানিয়ে ‘ননসেন্স’ কিছু করার জন্য কোসাম্বিকে প্রায়ই উসকাতে থাকেন ভেই। বুরবাকির মতো কিছু একটা লেখো তো দেখি, বলতে থাকেন ভেই। লিখব? কী লিখব? তাছাড়া, বললেই কী আর ‘ননসেন্স’ কিছু লেখা যায়? ভেই’কে যে কীভাবে বোঝাবেন তার কিছুই ভেবেই পান না কোসাম্বি।
অবশেষে ভেই’ই পথ বাতলে দিলেন। বললেন, “বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য’ লিখে ফেলো।”
– দ্বিতীয় উপপাদ্য? বিস্মিত কোসাম্বি জিগেস করেন, “আবার ‘দ্বিতীয়’ কেন?”
– আরে বাবা, প্রথম উপপাদ্যটা তো ১৯২২ সালে ইএনএস কলেজে পাঠ করা হয়ে গেছে। এখন তুমি দ্বিতীয় উপপাদ্যটা লিখে ফেলো।
– উফফফ, কী ঝামেলা রে বাবা। কোসাম্বি বলে উঠে, লিখে ফেলো বললেই কি আর লিখে ফেলা যায়? ভুলভাল কিছু লিখলে তো আর চলবে না। তাহলে তো ধরে ফেলবে সবাই সেটা।
-ভাবো, ভাবো। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। একটা পথ নিশ্চয় বেরোবে। চোখ বুজিয়ে বিজ্ঞের মতো বলে উঠেন ভেই।
বুলেটিন অফ দ্য আকাদেমি অব সায়েন্সস অব দ্য ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অফ আগ্রা অ্যান্ড আউধের প্রথম খণ্ডের প্রচ্ছদ
ভেই’র নিরন্তর খোঁচানি খেয়ে বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য নিয়ে সত্যি সত্যি ভাবতে বসলেন কোসাম্বি। তাঁরা দুজনে মিলে ঠিক করলেন ‘ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস’-এর উপর কিছু লেখা যেতে পারে। নিজের মনে আঁক কষতে কষতে আর ভেই’র খোঁচানিতে শেষমেশ ‘বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য’ লিখেই ফেললেন কোসাম্বি। ‘ডিফারেনশিয়াল জিওমেট্রি’র কিছু সমীকরণ ব্যাখা করলেন তাতে তিনি। বলা বাহুল্য সেই ‘ননসেন্স’ উপপাদ্যে গণিত বিষয়ে চার লাইন লিখলেন তো আবোলতাবোল লিখলেন পাঁচ লাইন। ‘অন আ জেনারালাইজেশান অফ দ্য সেকেন্ড থিয়োরেম অফ বুরবাকি’ শীর্ষক দু’ পাতার এই উপপাদ্যে কোসাম্বি লিখলেন, “আমার জানা ছিল না যে স্বল্প-খ্যাত রাশিয়ান লেখক ডি. বুরবাকি, বিপ্লবের সময়ে তীব্র সীসা-বিষে যাঁর মৃত্যু হয়েছিল, এই উপপাদ্যের কিয়দংশ অনুমান করেছিলেন এবং এটা নিয়ে বিস্তারিত লেখার একটা উপায়ও নির্দেশ করেছিলেন।” রচনার ২ নং পাদটীকায় তিনি আরও লেখেন, “এটা অত্যন্ত প্রত্যাশিত যে বুরবাকির মরণোত্তর পেপারগুলো, বর্তমানে যা লেনিনগ্রাড আকাদেমিতে সংরক্ষিত আছে, সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ হওয়া উচিৎ। বেসরকারি সূত্রে প্রকাশ মেককিশ নাক ঘটনার পর ‘রুসকো- অ্যাংলিস্কি স্লোভার’-এর অন্যান্য সদস্যদের সাথে গুলি করে হত্যা করা হয় বুরবাকিকে”।
“সাবাস”, কোসাম্বির প্রতিপাদ্য পড়ে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেন ভেই, “খাসা লিখেছ ভায়া”।
“আচ্ছা, সে তো নয় বুঝলাম খাসা হয়েছে, কিন্তু এই উপপাদ্য পড়াবো কাকে?” কোসাম্বি বলে চললেন, “ব্যক্তিগত ভাবে দু’ এক জনকে পড়িয়ে আর কী হবে? তাছাড়া ক’জনই বুঝবে এই সব তত্ত্ব কথা? শেষমেশ তো নিজের কাছেই পড়ে থাকবে এই উপপাদ্য।”
“আরে না, না, তা কেন হবে?” ব্যগ্র হয়ে বলে উঠেন ভেই, “নিজের কাছে পড়ে থাকবে কেন? এই লেখা ছাপা হবে। আর তা ছাপা হবে বিজ্ঞান বিষয়ক কোনও নামিদামি পত্রিকাতেই।” ভেই’র মাথায় তখন ঘুরছে আর-এক ফন্দি।
মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে, এলাহাবাদ শহরে তখন সদ্য (২৭ নভেম্বর ১৯৩১) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘আকাদেমি অফ সায়েন্সেস অফ দ্য ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অব আগ্রা অ্যান্ড আউধ’। সাহাই হলেন আকাদেমির প্রথম সভাপতি। এহেন মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলো কোসাম্বির লেখা। কোসাম্বি ভেবেছিলেন, তাঁর চালাকি ধরা পড়ে যাবে। কোনও দিনও ছাপা হবে না তাঁর এই প্রবন্ধ। ১৬ এপ্রিল ১৯৩২, আকাদেমির দপ্তরে এসে পৌঁছোয় কোসাম্বির লেখা। এলাহাবাদ থেকে তখন প্রকাশিত হতো আকাদেমির মুখপত্র ‘বুলেটিন অফ দ্য আকাদেমি অফ সায়েন্সেস অফ দ্য ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অব আগ্রা অ্যান্ড আউধ’। এই পত্রিকাতেই ছাপা হলো কোসাম্বির নিবন্ধ ‘বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য’। পত্রিকার সেই সংখ্যা হাতে পেয়ে তো হতবাক কোসাম্বি! পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাঁর মাথামুণ্ডহীন প্রবন্ধটা। বিস্মিত নয়নে ভেই’র দিকে তাকিয়ে দেখেন মিচকি মিচকি হাসছেন ভেই, ভাবখানা, “কী, কেমন দিলুম?”।
ইতিহাস
কোসাম্বির লেখা বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্যটা নিয়ে যে খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল তা কিন্তু মোটেও নয়। একেই বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকার পাঠক সংখ্যা নগণ্যই হয়ে থাকে। তার উপরে কোনও এক অখ্যাত বুরবাকির উপপাদ্যর জটিল গাণিতিক ব্যাখ্যা। কে পড়বে সেই লেখা? ফলে কোসাম্বির সেই লেখা প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যায়। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? পত্রিকায় লেখা ছাপানোর পর, সেই লেখা তো ইতিহাসে পরিণত হয়ে গেছে। বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য আজ এক মজার ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে।
কোসাম্বির লেখা বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্যর প্রথম পাতা। নিচের দিকে ডি বুরবাকির মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করেছেন কোসাম্বি।
আদতে ‘বুরবাকি’ কিন্তু কোনও নাম নয়, এটা একটা ফরাসি পদবি। অথচ কোসাম্বি লিখলেন বুরবাকি হলেন রাশিয়ান লেখক। শুধু তাই নয়, তাঁর রচনায় ‘ডি. বুরবাকি’ নামটা ব্যবহার করেছেন কোসাম্বি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ‘ডি’ কেন? এতো অক্ষর থাকতে ‘ডি’ অক্ষরটা কেন পছন্দ করলেন কোসাম্বি? পাঠক নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন যে, ‘ডি’ ফর ‘দামোদর’। কোসাম্বির পুরো নাম তো দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি। ‘ডি’ তে দামোদর হয়, আবার ‘ডি’ তে ধর্মানন্দও হয়। তিনি তো ডিডি কোসাম্বি নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। নিজের নামের আগে দুটো ‘ডি’ থাকতে অন্য অক্ষর কেন ব্যবহার করবেন কোসাম্বি? অবশ্য এই ‘ডি’ অক্ষর ব্যবহারের কারণ নিয়ে, কোসাম্বি বা ভেই, কেউই কিন্তু একটা শব্দও খরচা করেন নি। সবটাই পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
লক্ষ করে দেখুন, বুরবাকির মৃত্যু প্রসঙ্গে দু’টো ভিন্ন ভিন্ন গল্প ফেঁদেছেন কোসাম্বি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন সীসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছিল বুরবাকির। পরে আবার তিনি লেখেন, গুলি করে মারা হয়েছিল বুরবাকিকে। এই পরস্পর বিরোধী বয়ান বুঝতে গিয়ে ধন্দে পড়েন প্রায় সব পাঠকই। আসলে সীসার বিষক্রিয়া বলতে গুলির কথাই বুঝিয়েছেন কোসাম্বি। যেহেতু বন্দুকের গুলিতে সীসা ব্যবহার করা হয়ে থাকত, তাই সীসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বলতে গুলিতে মৃত্যুই বুঝিয়েছেন তিনি। সাধারণত এতটা তলিয়ে ভাবা কোনও পাঠকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই আজও বুরবাকির মৃত্যু রহস্য স্পষ্ট নয় অনেক পাঠকের কাছে। বলা বাহুল্য, বুরবাকির মৃত্যু নিয়ে ফাঁদা কোসাম্বির বক্তব্য দু’টোই আদতে সাজানো গল্প।
বুরবাকিকে গুলি করে মারা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “মেককিশ নাক ঘটনার পর ‘রুসকো- অ্যাংলিস্কি স্লোভার’-এর অন্যান্য সদস্যদের সাথে গুলি করে হত্যা করা হয় বুরবাকিকে”। লক্ষণীয়, এখানে ‘মেককিশ নাক’ এবং ‘রুসকো-অ্যাংলিস্কি স্লোভার’-এর মতো দু’টো দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করেছেন কোসাম্বি। আসলে ‘মেককিশ নাক’ এবং ‘রুসকো-অ্যাংলিস্কি স্লোভার’ দু’টোই হল রাশিয়ান শব্দ। ‘মেককিশ নাক’ একটা রাশিয়ান (সিরিলীয়) বর্ণ যা নরম উচ্চারণ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। বাংলায় ট-ঠ, ড-ঢ উচ্চারণের ক্ষেত্রে যে ফারাক রয়েছে, রাশিয়ান ভাষায় সেই উচ্চারণের ফারাক বোঝাতে ‘মেককিশ নাক’ বর্ণ ব্যবহার করা হয়। আর ‘রুসকো-অ্যাংলিস্কি স্লোভার’ কথাটার মানে ‘রাশিয়ান-ইংরেজি অভিধান’। হা, হা, হা, ব্যাপারটা তলিয়ে জানার পর হাসি তো পাবে যে কোনও পাঠকেরই। বোঝাই যাচ্ছে ‘মেককিশ নাক’ এবং ‘রুসকো-অ্যাংলিস্কি স্লোভার’ শব্দ দুটোর সাথে গণিতের কোনও সম্পর্কই নেই। শুধুমাত্র পাঠককে বোকা বানাবার জন্যই এই সমস্ত দূর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করেছেন কোসাম্বি। তবে তাঁর এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের পিছনে যে ভেই’র মাথা কাজ করেছে, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কারও। আর সেই জন্যই রচনার পাদটীকায় ‘গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স’ দেওয়ার জন্য ড. এ. ভেই’র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোসাম্বি।
প্রত্যাবর্তন
আমরা জেনেছি, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণের পরই তরুণ ভারতীয় গণিতজ্ঞের খোঁজ করতে থাকেন ভেই। ইউএসএ-র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তখন সদ্য দেশে ফিরেছেন তরুণ গণিতজ্ঞ ডিডি কোসাম্বি। দেশে ফিরেই বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন তিনি। ভেই’র কানে পৌঁছয় কোসাম্বির খবর। খবর পাওয়া মাত্রই ভেই দৌড়লেন বেনারস, কোসাম্বির সাথে দেখা করতে। এমনিতেই ভারতের সংস্কৃতিকে, ভারতের আচারকে, ভারতের ভাষাকে বোঝার নেশাতেই ফ্রান্স থেকে ভারতে ছুটে আসা তাঁর। ভারতকে বোঝার নেশায় বুঁদ ভেই, বেনারস যাবেন না – তা তো হয় না। বেনারসে গেলে তাঁর রথ দেখা আর কলা বেচা দু’টো কাজই হবে। ভেই গেলেন বেনারস। সেখানে গিয়ে দেখা করলেন কোসাম্বির সাথে। কোসাম্বিকে বুঝিয়ে বললেন আলিগড়ে ভীষণই প্রয়োজন তাঁকে। কোসাম্বি যেন আলিগড়ে এসে অধ্যাপনা করেন। ভেই’র ডাকে সাড়া দিয়ে বেনারস ছেড়ে আলিগড়ে যোগদান করেন কোসাম্বি। এ পর্যন্ত কাহিনি আমাদের জানা। জানা নেই এই কাহিনির পরবর্তী অংশের কথা।
শুধু কোসাম্বির সন্ধানেই নয়, যেখানে যখনই গণিত সংক্রান্ত কোনও খবর পেয়েছেন ভেই তখন সেখানেই ছুটে গেছেন তিনি। ১৯৩০ সালে কেরলের ত্রিবান্দ্রাম শহরে অনুষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক অধিবেশন। ভারতের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণতম প্রান্তে ছুটে গেছেন ভেই। কেরলের মানুষজনকে কাছ থেকে জানার সুযোগ হারাবেন কেন তিনি? গণিতও যেমন তাঁর লক্ষ্য, ভারতকে জানাও তো তাঁর লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে প্রায় সারা বছর ধরেই ছুটে গেছেন তিনি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, আসাম থেকে গুজরাট। দেদার ঘুরেছেন তিনি। ঘুরেছেন শান্তিনিকেতন, কলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লি, বোম্বে সহ ভারতের প্রায় সব বড় শহরই। আর ভেই’র এই ঘোরা নিয়েই গোল বাঁধল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে। সারা বছর যদি ঘুরেই বেড়াবেন ভেই তবে ক্লাসটা কখন নেবেন তিনি? এই নিয়েই শুরু হলো আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর তিক্ত বাদানুবাদ। এছাড়াও ঘন ঘন বই কেনার টাকা দাও, এটা দাও, সেটা দাও দাবি করতেই থাকেন ভেই। গণিত বিভাগের জন্য যদি এতো অর্থ বরাদ্দ করতে হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগগুলো চলবে কী করে? ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক পরিকাঠামো তো আর ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক পরিকাঠামোর মতো নয় যে, যে যখনই যা চাইবে তখনই তাই পাওয়া যাবে। এখানে চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না। অনেক কষ্ট করে এখানে অধ্যাপনা করেন অধ্যাপকরা। বহু কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে দিয়ে গবেষণা করতে হয় এখানে। ফলে টাকা চাইলেই টাকা পাওয়া যায় না। এদিকে, ভেই ভাবছেন কিছুই যদি বরাদ্দ না করা হয় তাহলে তিনি এখানে পড়াবেন কী নিয়ে? ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার সেজে বসে থাকতে পারবেন না তিনি। এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে ক্রমেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল ভেই’র ঝামেলা। পরিণতিতে, ১৯৩২ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায় ইস্তফা দিয়ে ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তন করেন ভেই। ভেই’র প্রত্যাবর্তনের পরই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্তফা দেন তাঁর তিনি সহকর্মী- বিজয়রাঘবন, চাওলা ও কোসাম্বি।
প্রহেলিকার আরেক নাম বোধহয় অঁদ্রে আব্রাহাম ভেই। অফুরন্ত মজা করাই ছিল গণিতের পর তাঁর সব থেকে প্রিয় চিন্তার খেলা। আর সেই মজার খেলার অন্যতম নিদর্শনই হল ‘বুরবাকির দ্বিতীয় উপপাদ্য’। সেই ঐতিহাসিক মজার স্বাদ আজও অটুট, তাই না?
তথ্যসূত্র:
- Andre Weil, ‘The Apprenticeship of a Mathematician (Autobiography)’; Springer Basel AG, 1992.
- S G Dani, “Kosambi, the Mathematician”; in ‘Resonance, Vol. 16, Issue 6, June 2011’; Indian Academy of Sciences, pp. 514-528.
- ‘Sylvain Levi’; Visva-Bharati website.
- ‘About Sir Ross Masood’; Aligarh Muslim University website.
- ‘Bulletin of the Academy of Sciences of the United Provinces of Agra and Oudh, Volume 1, 1931-32’; Allahabad: Academy of Sciences of the United Provinces of Agra and Oudh, 1932.
- R. Ramachandran, “Beyond Ramanujan” in ‘Frontline, Sept 2010’.
The book ‘Naming Infinity’ by Loren Graham and Michel Kantor deals with Bourbaki, wherein it was treated not just as fun.
A monastery of mystic saints in Russia that used to study Bourbaki incurred Stalin’s wrath and gunned down.