সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মানব বিবর্তন ও করোনা

মানব বিবর্তন ও করোনা

জয়ন্ত দাস

মে ২১, ২০২২ ৫৬৬ 2

একটি প্রশ্ন বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই শোনা যায়: আধুনিক মানুষের বিবর্তন কি আদৌ হচ্ছে? অনেকে মনে করেন, বিবর্তন হচ্ছে, এবং এর ফলে কোনও এক ভবিষ্যতের দিনে আমরা এক শুঁটকো মানুষকে পাব, যাদের মাথা বিরাট হবে আর হাত-পা হবে চিমড়ে। বিবর্তন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রাণীকে বেশি খাপ খাওয়ানোর মত করে তৈরি করে। মানুষের মস্তিষ্কের কাজ বাড়ছে আর দৈহিক কাজ কমছে, অতএব এমনটাই হওয়া যৌক্তিক বলে তাঁদের মনে হয়। সমস্যা হল, ভাল করে অঙ্ক কষতে কিংবা ইংরাজি বলতে পারলে ভাল চাকরি মেলে ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধি জিনিসটা কেবল আকাদেমিক পাণ্ডিত্যের জন্য কাজে লাগে এমন নয়; ফুটবলারের গোল করতে বা পর্বতারোহীর শৃঙ্গ আরোহণ করতে বুদ্ধি কম কাজে লাগে না। তার ওপরে ভাল রোজগার করলে তার অনেক সন্তান হবে ও ‘বড় মাথার’ বংশগত প্রবণতা পরের প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে, অভিজ্ঞতা এমন দেখায় না।

আর এক দল মানুষ বলেন, বিবর্তন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন উন্নত জীবনযাত্রা, (প্রায়) সকলের জন্য খাদ্য-বস্ত্র-আবাসের সংস্থান ও আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা সবাইকে বাঁচিয়ে রাখছে। ফলে ডারউইনের সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট বা যোগ্যতমের টিকে থাকা’, আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সব মানুষ টিকে থাকছে ও বংশবৃদ্ধি করছে। ফলে মানুষদের মধ্যে ‘যোগ্যতমের’ জিন পরের প্রজন্মে বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ছে না। অতএব মানুষের বিবর্তন, বা তাঁদের ধারণায় ‘উন্নতি’, আর হচ্ছে না। এ নিয়ে বেশ হা-হুতাশও শোনা যায়।

দেখা যাক ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক তথ্য কী বলে।

করোনার ইতিহাস 

করোনা মহামারী আমাদের হাড়ে হাড়ে একটা শিক্ষা দিয়েছে। রোগ হলে সবাই বাঁচে না। এমনকি আধুনিক টিকা ও চিকিৎসাও সবাইকে বাঁচাতে পারে না। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন বটে, ম্যালেরিয়া ত লোক চিনে ধরে না (‘দত্তা’ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু কথাটা সত্যি নয়, সমস্ত মারণ রোগই লোক চিনে ধরে ও লোক চিনে মারে।

কেমন করে? আসুন, করোনার ইতিহাস ঘেঁটে দেখি।

সম্রাট অশোকের শিলালিপি আছে, আর করোনার আছে জিনলিপি। প্রাচীনকালে ভাইরাস-ঘটিত একাধিক মহামারী হয়েছিল। জিনোমের অতীত মিউটেশনের চিহ্ন থেকে সেই মহামারী-আক্রান্ত মানুষদের সনাক্ত করা যায়। পূর্ব এশিয়ার মানুষের জিনোম থেকে ২৫ হাজার বছরের পুরানো এক ভাইরাস-ঘটিত মহামারীর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। জিনোমের বিশ্লেষণ থেকে মনে হয়, সেই মাহামারী ছিল একটি প্রাচীন করোনা বা তার নিকট-সম্পর্কিত ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত এক মহামারী।

অনেকগুলো ভারি ভারি কথা একসঙ্গে বলা হয়ে গেল। জিনোম কী? সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী লিপির পাঠোদ্ধার করা আমরা বুঝি, কিন্তু জিনোমের পাঠ কেমন করে উদ্ধার করতে হয়? কেমন করে জিনোম লিপি থেকে বোঝা যায় ২৫ হাজার বছর আগে করোনা মহামারী হয়েছিল? এবং সর্বোপরি, তার সঙ্গে মানুষের বিবর্তনের কী সম্পর্ক?

একে একে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।

আমাদের শুরু করতে হবে বর্তমান সময় থেকে। যে করোনা মহামারী এখন চলছে তার নাম কোভিড ১৯, কেন না ২০১৯ সালে সেটি শুরু হয়। সেই মহামারীর কারণ একটি ভাইরাস, তার পুরো নাম সার্স কোভ-২ (SARS-CoV-2)। এটি একটি করোনা ভাইরাস। ভাইরাসদের কোটি কোটি রকমফের আছে, একটি রকম হল করোনা ভাইরাস। তাদের প্রত্যেকটির মধ্যে আছে একাধিক ধরন; করোনা ভাইরাসের একটি ধরন হল সার্স কোভ-২।

চিত্র – সার্স কোভ-২ ভাইরাস, চিত্র ঋণ – ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানিজশন 

করোনা ভাইরাস সাম্প্রতিক তিনটি বড় মহামারীর জন্য দায়ী।

  • সার্স-কোভ (SARS-CoV) হল প্রথম মহামারী যা চীনে ২০০২ সালে প্রথম উদ্ভূত হয়। এতে ৪ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রামিত হয়েছিল এবং ৪০০ জনের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।
  • তার ৪ বছর পরে, মার্স-কোভ (MARS-CoV) মধ্য প্রাচ্যে উদ্ভূত হয়, এবং সম্ভবত এটি এসেছিল উট থেকে। (তথ্যসূত্র ১) তাতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ সংক্রমিত হয় ও ৮৫০ জন মারা যায়।
  • ২০১৯ সালের শেষে বর্তমান অতিমারী সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) চীনে শুরু হয়েছিল।

বর্তমানের সার্স কোভ-২ (SARS-CoV-2) মহামারীটি দেখিয়েছে, মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন এই ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য প্রায়শই যথেষ্ট নয়, তার ওপরে মানুষে মানুষে এ-ব্যাপারে বিস্তর ফারাক আছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, আধুনিক মানুষের জিনোমে কয়েক হাজার বছর আগেকার বিবর্তনের তথ্য রয়েছে, আর সেই তথ্য থেকে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে বড় ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনাগুলি সনাক্ত করতে পারি। এই নতুন করোনা ভাইরাস খুব সম্ভবত একটি জুনোটিক রোগের (পশু-পাখিদের রোগ) ভাইরাস থেকে পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের ফলে উদ্ভূত, এবং এই ভাইরাস থেকে SARS অর্থাৎ Severe Acute Respiratory Syndrome (বাংলায় ‘মারাত্মক তীব্র শ্বসনতন্ত্র রোগ’) হয়। তবে রোগসৃষ্টিকারী অন্যরকম করোনা ভাইরাস ছিল, এবং তারা আগেও মানুষকে আক্রমণ করেছে।

চিত্র ২ – সম্ভাব্য মধ্যবর্তী হোস্ট সহ মানব করোনভাইরাসগুলির উৎস, চিত্র ঋণ CC BY 4.0

কেমন করে সেই ইতিহাস বোঝা গেল? বোঝা গেল মানুষের কোষের সমস্ত জিন-কে পরীক্ষা করে। জিন হল আমাদের বংশগতির একক, তারা পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মাধ্যমে সন্তানের মধ্যে বহন করে। কোনও জীবের সমস্ত জিন মিলে হয় তার জিনসমূহ বা জিনোম।

ভাইরাস বনাম মানুষের লড়াই

মানুষের জিনোম পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তার মধ্যে অনেকগুলো জিন আছে যারা সার্স-কোভ-২ সহ অন্যান্য নানা করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে। কেমন করে এই জিনগুলো মানুষের শরীরে এল?

  • অতীতে এক করোনা ভাইরাস (বা করোনা ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ কোনও জ্ঞাতি ভাইরাস) মানুষকে আক্রমণ করেছিল, তখন কিছু মানুষের মধ্যে সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম বিশেষ কিছু জিন ছিল। সেই বিশেষ জিন-ওয়ালা মানুষরা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বেঁচে যায় ও পরের প্রজন্মে তাদের সন্তান বেশি হয়।
  • অন্যদিকে, এই বিশেষ জিন-ওয়ালা মানুষের ওপর সফল আক্রমণ করার জন্য ভাইরাসের জিন বদলে যায়, অর্থাৎ তাদের মিউটেশন হয়।
  • তারপর সেই পরিবর্তিত বা মিউট্যান্ট ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মানুষের দেহে কিছু জিনের পরিবর্তন বা মিউটেশন হয়। সেই মিউট্যান্ট মানুষদের আয়ু ও সন্তান সংখ্যা বেশি হয়।
  • আবার তার সাথে লড়াই করতে ভাইরাসদের জিনে মিউটেশন ঘটে, এবং
  • তার প্রত্যুত্তরে মানুষের জিনে আরও মিউটেশন হয়।

এ যেন মানুষে-ভাইরাসে বংশ-পরম্পরায় চলা এক যুদ্ধ। একেই বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন। মোটামুটি ২৫ হাজার বছর আগে মানুষের দেহে এই জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটেছিল। এর ফলে মানুষের পরিবর্তনকে আমরা ভাইরাস-বিরোধী অভিযোজন বলতে পারি।

চিত্র – জিন মিউটেশন

চিত্র—করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধ-সংক্রান্ত সমস্ত জিন। পূর্ব এশিয়ার মানুষদের এই সমস্ত জিনের মধ্যে প্রাচীন করোনা ভাইরাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিহ্ন থেকে গেছে।

পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মধ্যে একইভাবে এই মিউটেশন ঘটলে বিজ্ঞানীরা সেটা সহজে ধরতে পারতেন না। কারণ মিউটেশন ঘটেনি এমন মানুষের জিনের সঙ্গে তুলনা করে যে মিউটেশন ঘটেছে তা সহজে বোঝা যায় বর্তমানে পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী যারা, তাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে এই মিউটেশন বা ভাইরাস-বিরোধী অভিযোজন সীমাবদ্ধ ছিল। তারা কালক্রমে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু এই মিউটেশন তাদের উৎস-পরিচয় বহন করছে। সম্ভবত কাকতালীয়ভাবেই (বা অজানা কোনও কারণে) সেই পূর্ব এশিয়াই দুটি আধুনিক করোনা ভাইরাস মহামারীর ভৌগোলিক উত্স।

এক কথায় বলা যায়,

  • সুদূর অতীতে আজকের অতিমারীর ভাইরাসের কাছাকাছি কোনও ভাইরাস একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীদের আক্রমণ করেছিল ও তাদের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল।
  • সেই পরিবর্তন প্রাচীন সেই করোনা-আত্মীয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সাহায্য করেছিল।
  • সেই জিনের পরিবর্তন আজও বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আছে, কিন্তু তা বর্তমান ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর নয়।

অবশ্য বর্তমান করোনা ভাইরাস রোগ (COVID-19) এর সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক কারণগুলির প্রভাব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটি আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়।  

বিজ্ঞানী হরকরারা খুঁজে চলেছেন জিনের ঠিকানা

বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণায় সমসাময়িক ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীতে সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ও রোগের তীব্রতাকে প্রভাবিত করার মতো বেশ কয়েকটি জিন বা জিনের ‘লোকাস’ বা অবস্থান পাওয়া গেছে। ‘লোকাস’-কে আমরা বাংলায় বলতে পারি ‘জিন-স্থান’—একটি ক্রোমোজোমে একটি জিন যে বিশেষ স্থানটি দখল করে। তুলনা হিসেবে বলা যায়, আমার বাড়িটি যদি একটি জিন হয়, তাহলে তার জিন-স্থান বা লোকাস হল ‘৫০/এ কলেজ রোড’। এরকম হতেই পারে যে অন্য এক শহরে ‘৫০/এ কলেজ রোড’ ঠিকানায় অন্যরকম একটি বাড়ি আছে। তেমনই, অন্য একজনের দেহের একই ক্রোমোজোমের একই জায়গায় অন্য একটি জিন থাকতে পারে। একই ঠিকানায় সম্ভাব্য একাধিক জিন হল একে অপরের অ্যালিল।

চিত্র – হোমোলোগাস ক্রোমোসোমে অ্যালিল এবং একটি জিনের অবস্থান (লোকাস)

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের সম্ভাবনা ও রোগের তীব্রতা কমাতে অক্ষম একটি অ্যালিল সম্ভবত নিয়ান্ডারথালদের কাছ থেকে হোমো সেপিয়েন্সদের শরীরে এসেছিল। অর্থাৎ মোটামুটি ২৫,০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্সদের মধ্যে প্রজনন সম্পর্কের ফলে সেই জিন কিছু মানুষের শরীরে এসেছিল, এবং তাদের উত্তরসূরি হল আধুনিক ইউরোপের কিছু মানুষ।

বেচারারা ভাবতে পারেনি এই মিলনের জন্য উর্দ্ধতন শত শত পুরুষ শাস্তি ভোগ করে যাবে।

ভালো মিউটেশন

কী ধরনের মিউটেশন করোনা-জাতীয় ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করতে মানুষের শরীরকে সাহায্য করেছে?    

আমাদের কোষে ঢুকে ভাইরাস কোষের নানা যন্ত্রপাতি হাইজ্যাক করে নিজের বংশবৃদ্ধি ঘটায়। কোষের গায়ে এমন কিছু প্রোটিন আছে যাদের সঙ্গে ভাইরাস সহজে আটকে যেতে পারে, ও এইভাবে ভাইরাস কোষের অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে পারে। মানুষের বিবর্তন এই ধরণের প্রোটিনের গঠন কেবলই পরিবর্তন করে গেছে, যাতে ভাইরাস তাকে ধরে কোষে প্রবেশ না করতে পারে। অন্যদিকে, ভাইরাসের বিবর্তন নতুন গঠনের প্রোটিনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর মতো মিউটেশন বেছে নিয়েছে।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণ মানুষের প্রাগিতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা অন্য কোনও সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায়নি, বোঝা গেছে মানুষের জিনের পরিবর্তনের হার দেখে। লক্ষ লক্ষ বছরের মানব বিবর্তনে সমস্ত ধরণের জিনের মিউটেশন-জনিত পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তাদের পরিবর্তন-হার সমান নয়।

ধরা যাক দুটি ভাইরাস-ঘটিত সংক্রমণের কথা।

  • একটি মৃদু সংক্রমণ মানুষের বাঁচা-মরা বা তার প্রজননের সম্ভাবনাকে বিশেষ প্রভাবিত করে না, কিন্তু অন্য একটি গুরুতর সংক্রমণ এই হারকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। মৃদু ধরনের ভাইরাস সংক্রমণকে প্রভাবিত করে এমন মানব-জিন বংশানুক্রমে তেমন বাড়বে-কমবে না। কিন্তু তীব্র ধরনের ভাইরাস সংক্রমণকে ঠেকাতে পারে এমন মানব-জিন বংশানুক্রমে দ্রুত বাড়বে, আর ঠেকাতে অক্ষম জিন দ্রুত কমে যাবে।

অতীতে করোনা ভাইরাস মহামারী হয়েছিল, ও তার জন্য মানুষের জিনে অভিযোজন-জনিত মিউটেশন হয়েছিল। সেই মিউটেশনগুলির চিহ্ন আজকের মানুষের মধ্যে আছে কিনা, গত বছরে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। (তথ্যসূত্র ২) বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করায় জড়িত জিনগুলির পরিবর্তন হয়েছে অন্য সব জিনের চাইতে তিনগুণ দ্রুত হারে। এই জিনগুলো হল ‘ভাইরাস-ইন্টারেক্টিভ প্রোটিনের’ (ভিআইপি) সঙ্কেত বহনকারী জিন।  

  • নানা মানব জনগোষ্ঠীতে ভিআইপি-প্রোটিনের দ্রুত পরিবর্তন বিগত ৫০ হাজার বছরে অব্যাহত রয়েছে। ভাইরাসের দুটি প্রধান ভাগ, ডিএনএ ভাইরাস ও আরএনএ ভাইরাস। আরএনএ ভাইরাস নিজে খুব দ্রুত মিউটেট করতে পারে, এবং এদের প্রতিহত করার কাজে যুক্ত ভিআইপি-গুলির পরিবর্তনও হয়েছে দ্রুততর হারে। অন্যদিকে ডিএনএ ভাইরাসের মিউটেশন হার কম, তার সঙ্গে জড়িত ভিআইপি-র পরিবর্তনের হার একটু কম। করোনা ভাইরাসগুলি হল আরএনএ ভাইরাস।

এই গবেষণাপত্রে (তথ্যসূত্র ২) ২৬টি মানগোষ্ঠীর জিনোম নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। তার মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত ৪২০টি ভিআইপি বেছে নেওয়া হয়েছে। ৪২০টি ভিআইপি-র মধ্যে ৩৩২টি এখনকার মহামারী সার্স-কোভ-২ এর সঙ্গে সম্পর্কিত, আর বাকি ৮৮টি আগেকার দুটি করোনা ভাইরাস মহামারীরে সঙ্গে সম্পর্কিত। (পাদটীকা ১)

এই গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত যে মানুষের বিবর্তনের সময় প্রাচীন আরএনএ ভাইরাসজনিত মহামারী ঘন ঘন ঘটেছিল, এবং করোনা ভাইরাসগুলির জন্য ঘটা মিউটেশনগুলো মানব জিনোমে স্থায়ী ছাপ রেখেছে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ভিআইপি নিয়ে জিনগত অভিযোজন একাধিক পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীতে উপস্থিত রয়েছে, এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীতে এটি অনুপস্থিত। এ থেকে মনে হয় যে, একটি প্রাচীন করোনা ভাইরাস মহামারী পূর্ব এশীয়দের পূর্বসূরীদেরর মধ্যে জিনগত অভিযোজন এনেছিল (পাদটীকা ২)। বিশেষ করে ৪২টি করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ভিআইপি-জিন প্রায় ৯০০ প্রজন্ম, অর্থাৎ ২৫ হাজার বছর আগে নির্বাচিত হয়েছিল। এই গবেষণা থেকে আরও দেখা যায়, এই করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত ভিআইপি-জিনগুলি আধুনিক ব্রিটিশ জনগোষ্ঠীর কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ও রোগলক্ষণকে এখনও প্রভাবিত করছে।

তবে কেবল করোনা রোগ নয়, জিনগতভাবে মানব বিবর্তনের অন্য সাক্ষ্যও রয়েছে। সেগুলো থেকে আমরা জানি, মানুষের জিনগত বিবর্তন সত্যি ঘটনা। শুধু তাই নয়, মানুষের (প্রাগ-)ইতিহাসের অন্য যে কোনও সময়পর্বের তুলনায় এই বিবর্তন সম্ভবত দ্রুততর বেগে হয়ে চলছে। (তথ্যসূত্র ৩) 

শেষ কথা

করোনা প্রমাণ করেছে যে—

) মানুষের বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া

) আমরা যে সব বৈশিষ্ট্য দিয়েযোগ্যতমবাফিটেস্টমানুষ মাপি, বিবর্তন সেই বৈশিষ্ট্য দিয়ে যোগ্যতা মাপে না

) প্রাকৃতিক নির্বাচন মানুষের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের তোয়াক্কা করে না

পাদটীকা

১) নানা ভাইরাসের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় যুক্ত মোট ৫২৯১টি ভিআইপি প্রোটিন জানা গেছে, এই ৪২০টি প্রোটিন হল তাদের একটি ভাগ। অবশ্য করোনা ভাইরাসের থেকে পৃথক ধরণের ভাইরাস একই রকম ভিআইপি ব্যবহার করতে পারে, এই সম্ভাবনা একেবারে বাদ দেওয়া যায় না।

২) একটি প্রাচীন করোনা ভাইরাস হবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে এটি একটি ভাইরাস এবিষয়ে সন্দেহ নেই। করোনা না হলে এটি অনুরূপ ভিআইপি ব্যবহার করে এমন একটি পৃথক ভাইরাস। এতে এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বদলায় না।

তথ্যসূত্র

১) https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/middle-east-respiratory-syndrome-coronavirus-(mers-cov)

২) An ancient viral epidemic involving host coronavirus interacting genes more than 20,000 years ago in East Asia. Yassine Souilmi, M. Elise Lauterbur, Ray Tobler, et al. Current Biology. Published: June 24, 2021. DOI:https://doi.org/10.1016/j.cub.2021.05.067 ৩) https://www.science.org/content/articl

লেখক চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য-আন্দোলনের কর্মী, প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “মানব বিবর্তন ও করোনা”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।