সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

জাহাজ ভাসে সাগর জলে – পর্ব ২

জাহাজ ভাসে সাগর জলে – পর্ব ২

ভাস্কর দাস

ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪ ১২৩ 0

মুখবন্ধ

বাংলাদেশ, মানে একসময়ের অবিভক্ত ভূখণ্ড (যার সীমানা অবশ্য বার বার পরিবর্তিত হয়েছে) সেই কোনো এক সময়ে ছিল বিপুল শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। বস্তুত, বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল একসময়ে প্রায় সারা পৃথিবীর শ্লাঘার বিষয়। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এর একটি ছিল বাংলার জাহাজশিল্প। আজকের তাম্রলিপ্ত অঞ্চল, কিছুটা মোগল শাসন কেন্দ্রিক ঢাকা অঞ্চল আর মূলত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীরবর্তী অঞ্চল ছিল এর উৎস। পরবর্তীকালে সপ্তগ্রাম, হুগলী ও কলকাতায় এর রেশ ছিল। এর ইতিহাস দীর্ঘ, বিচিত্র এবং শেষ অবধি প্রায় গ্রিক ট্র্যাজেডির তুল্য বিয়োগান্তক পরিণতির শিকার, সৌজন্যে ইংরেজ বানিয়া ও রাজশক্তি। আজ তাকেই কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। 

চট্টগ্রামের জাহাজশিল্প

আজকের বাংলাদেশের মানচিত্রের সীমানার বিচারে সেকালের বাংলার জাহাজ শিল্পের একটা বাহু যদি হয় মোগলশাসন-কেন্দ্রিক ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চল, তবে আর একটি বাহুর বিস্তার ছিল মগ, আরাকান, ওলন্দাজ পর্তুগিজ কেন্দ্রিক চট্টগ্রামে। কর্ণফুলীর তীরে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার চট্টগ্রামের নৌ-শিল্পের সুচনার সময়টা নিশ্চিতভাবে অনিশ্চিত। কিছু বিদগ্ধজনের মতানুসারে ৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্লিনির ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থে ‘গঙ্গাবাজার’ বলে উল্লিখিত স্থানটিকে এই বন্দরের প্রথম আনুষ্ঠানিক উল্লেখ বলে ধরা হলেও তারও আগে আরবদেশের সঙ্গে তার বানিজ্যের বিষয়টি ব্যাখ্যার বাইরে থেকে যায়। এটা ঐতিহাসিকদের মতো যে সাধারণ পূর্বাব্দ দুই শতক থেকেই এয়মন ও ব্যাবিলনীয় অঞ্চল থেকে আরব বণিকেরা চিন আর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের অধিকারি ছিল। পরবর্তী নানা লেখকের গ্রন্থে ‘জলবন্দর’, ‘সমন্দর’, ‘সুলুকবহর’, ‘ষোলশহর’, ‘হালিশহর’ ইত্যাদি অনেক নামে এই অঞ্চল ইতিহাসের কাছে পরিচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুটি তথ্য উল্লেখ করি। সাধারণাব্দ ৮ম শতকে প্রাচীন কর্নফুলি নদীর তীরে যেখানে আরবদের জাহাজ এসে ভিড়ত, সে স্থানটি পরিচিত হয়েছিল ‘সুলকুলবহর’ নামে। আরবি ‘সুলকুলবহর’ শব্দের অর্থ বাণিজ্য তরীর বিরতি স্থান—অর্থাৎ পোতাশ্রয়। ক্রমে লোকমুখে ‘সুলকুলবহর’ বিবর্তিত হয়ে ‘সুলুকবহর’-এর জন্ম হয়।

পেরিয়ে আসা কয়েক শতাব্দীতে কর্ণফুলি নদী তার গতিপথের ব্যাপক পরিবর্তন করেছে। ফলে বারবার পালটে গেছে বন্দরের অবস্থান। প্রাচীন কালে জাহাজ যেখানে দাঁড়াত, সেখানে স্থানীয় মানুষ তড়িঘড়ি বাঁশ, পাতা, চটের তৈরি অস্থায়ী ছাউনি বানিয়ে বাণিজ্যের কাজ শেষ করে ছাউনি গুটিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলে চলে যেত—এটা স্বাভাবিক অভ্যেস ছিল। তাই বন্দরের অবস্থান পালটে যাওয়া অনিবার্য ছিল। ফলে আজকের বন্দর অঞ্চলে পুরানো জাহাজঘাটার স্মৃতি অবশেষ খোঁজার চেষ্টায় হতাশা ভিন্ন আর কোনো সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

বাংলার হিন্দু আমলের তাম্রলিপ্ত বন্দরের মতো প্রাচীন কাল থেকে বন্দর চট্টগ্রামও পালের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল। সেকালের পালবাহী, দাঁড় টানা কাঠের তৈরি জাহাজকে সরের জাহাজ বলা হত। ‘সর’ অর্থ পাল—সম্ভবত আরবি শব্দ। নির্মাণশৈলীতেও মিল ছিল আরবি জাহাজের সঙ্গে। প্রধান উপকরণ লোহাকাঠ, সেগুন আর জারুল চট্টগ্রামের পার্বত্য অরণ্যে পাওয়া যেত অপর্যাপ্ত। এ শিল্পের শেকড় তাই শক্ত হয়ে বসে গিয়েছিল চট্টগ্রামের মাটির গভীরে।  

আরবি প্রভাবে এখানকার সরের জাহাজের বিভিন্ন অংশের নাম আরবি আর ফারসি নামে হত। যেমন এরাক, তাড়া, সুকান, বাদাম। জাহাজ পরিচালনার মানুষদের পরিচয় মালুম, সারাং, সুকানি, কছপ, লস্কর, খালাসি।

বন্দর শহর চট্টগ্রামের জাহজ নির্মাণ শিল্পের কারিগররা ছিলেন ডবলমুড়িং থানার হালিশহর গ্রামের বালামী পাড়ার নিম্নবর্ণের হিন্দু ও আগ্রাবাদ গ্রামের কিছুসংখ্যক মুসলমান। প্রসঙ্গত, সেকালের জাহাজ নির্মাণকর্মীদের বসতি এলাকাকে বালামী নামে ডাকা হত। এমন এলাকা ছিল ‘সুলুকবহর’, ষোলশহরের গুদীর পাড়া আর হালিশহর পতেঙ্গার কর্ণফুলীর তীরভূমি—যেখানে মুসলমান কারিগরদের বাস ছিল। সুনিপুণ এই কারিগররা ছিলেন নিরক্ষর, কারিগরি শিক্ষার পরম্পরা বয়ে যেত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। এদের যন্ত্রপাতি সীমিত ছিল করাত, হাতুড়ি, বাটালি, বাইস, দাও ও ব্রম-এ। গ্রীষ্মের ঘুঘুডাকা দুপুরে কী বর্ষার মেঘলা দিনে গ্রামের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ভেসে বেড়াত হাতুড়ির ঠুং ঠাং, করাতের কাঠ চেরার কর্কশ শব্দ। এই সামান্য উপকরণেই এরা তৈরি করে ফেলত একডোলী (ডোল = মাস্তুল) থেকে পাঁচডোলী বিদেশগামী সরের জাহাজ। আর ওই বিশাল জাহাজ তৈরির জন্য নিরক্ষর কারিগরদের কোনো প্রকৌশলী বা ব্লু-প্রিন্টের প্রয়োজন পড়ত না।

যে মাপের জাহাজ হবে, সেই মাপের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ অনুযায়ী একখানি ধারি বা তলই তারা প্রথমে তৈরি করে নিতেন । তারপর সেটি সমতলে বিছিয়ে দিয়ে তার উপর চকখড়ি দিয়ে জাহাজের নকশা আঁকতেন। পরে তাতে গুঁড়ো রঙ লাগিয়ে নকশাকে আরও স্পষ্ট ও অর্থবহ করে তোলা হত। তারপর জাহাজ যত লম্বা, সেই মাপের একটি বা দুটি সোজা গাছ চৌপাট করে একটি বা দুটি জোড়া দিয়ে প্রথমে দাড়া বা মেরুদণ্ড তৈরি হত। তারপর এক একটি আস্ত বাঁকা গাছ চৌপাট করে তাদের ভাষায় ‘বাঁক’ ‘চাবা’ বা ‘গোছা’ তৈরি করা হত। মেরুদণ্ডের সঙ্গে উল্লম্বভাবে পরপর বাঁক লাগিয়ে গজাল দিয়ে মেরে জাহাজের কাঠামো তৈরি হত। গজাল হত লোহার—এক একটি দেড় থেকে দুফুট পর্যন্ত লম্বা। তাতে পৌনে এক থেকে এক ইঞ্চি মোটা সেগুন, জারুল বা লোহাকাঠের তক্তা সাঁটিয়ে প্রস্তুত হত জাহাজের খোল। তারপর ডেক, কেবিন আর খোলের পাটাতন বা ছাউনিতে তক্তা লাগান হত। শেষে লাগান হত হাল আর ডোল বা মাস্তুল। জাহাজের নোঙ্গর তোলা বা ফেলার জন্য জাহাজের সামনের দিকে বসান হত ‘কাবিস্তান’—যা সম্ভবত ইংরাজি ক্যাপস্টান শব্দের অপভ্রংশ। জাহাজ তৈরির শেষ পর্যায়ের কাজ হল ‘কালপাত’ দেওয়া। এতে প্রতি দুটি তক্তার জোড়ে যে ফাঁক থাকে, কাঠের বাটামের সাহায্যে তাকে সুতো দিয়ে বন্ধ করা হত। তারপর তাতে ধুপধুনোর তৈরি পুলটিস দিয়ে ‘ওয়াটারটাইট’ করে ফেলা হত। জাহাজের ভেতরে বাইরে মেটে তেলের পালিশ, তার ওপরে নানা রঙে বাইরেটা চিত্রিত করে জাহাজ ভাসান হত জলে।

জাহাজ ভাসানর পর্বটি আজও যেমন, সেদিনও ছিল তেমন এক উৎসবের দিন। ‘আমেনা খাতুন’ নামের এক জাহাজের জলে ভাসানর ইতিবৃত্ত আমরা পাই আব্দুল হক চৌধুরীর লেখা ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বইটিতে। যদিও এটি ১৯১৫ সালের বৃত্তান্ত, তবু পরম্পরাকে অবিকৃত ধরে রাখার যে অভ্যাস বজায় ছিল চট্টগ্রামের জাহাজি মানুষদের মধ্যে, তাতে ভাবাই যায় যে এক দু’শো বছর আগেও ঘটনা অন্যভাবে ঘটত না। সেই ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী লিখছেন,

‘সেদিন আমেনা খাতুনের জলে ভাসানোর দৃশ্য দর্শনের জন্য কর্ণফুলী নদীর তীরে বহু জনসমাগম হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে বোমের (গোল্লার) আওয়াজ হইতেছিল। পূর্বে কামান দাগা হইত। মঙ্গলবাদ্যের মধ্যে পার্শ্ববর্তী স্থানবাসী জেলে রমণীরা ‘বরণকুলা’ নিয়া জয়-জয়কার রবে শুভ কাজের শুভ কামনা করিতেছিল। কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এক উচ্চ ভূমিখণ্ডে (কোনো ডকে নয়) উক্ত জাহাজ নির্মিত হয়েছিল।… বেলা তিনটার সময় কর্ণফুলী পূর্ণ জোয়ারে ভরিয়া উঠিলে মিস্ত্রিরা ক্রমে সবগুলি ঠেকনা ফেলিয়া দিতে লাগিল। লোকে মনে ভাবিল এত বড় জাহাজ কেমন করিয়ে থাকিবে, একদিকে হেলিয়া পড়িতে পারে। কিন্তু তা হইল না। মিস্ত্রিরা জাহাজের তলা হইতে দুইখানা খুব পালিশ করা লম্বা তক্তা ঢালুভাবে নদীর ধার পর্যন্ত সাজাইয়া রাখিয়াছিল এবং তাহার ঠিক সমভাবে দুইখানা চৌকা গাছ পালিশ করিয়া জাহাজের দৈর্ঘ্যের সামনে বড় বড় কড়া সংযোগে দড়ি দিয়ে জাহাজের তলায় দুই পার্শ্বে বাঁধিয়াছিল।… উক্ত তক্তা ও গাছগুলিকে চর্বি দ্বারা অত্যন্ত পিচ্ছিল করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাহাতে এমন এক কৌশলপূর্ণ কাষ্ঠনির্মিত চাবি ছিল যে, বিনা ঠেকনায়ও জাহাজ স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া ছিল। ডাক্তার গোয়েল ও তাঁহার পত্নী দুইটি দুগ্ধপূর্ণ বোতল জাহাজের অগ্রভাগে ভাসাইয়া দিবামাত্র প্রধানমিস্ত্রি একটু হাতুড়ির আঘাতে উক্ত চাবি ভাঙিয়া দিল। এবং এক মিনিটের মধ্যে জাহাজ যাইয়া জলে পড়িল। যেন একটা উড়ন্ত চিল মৎস্যলোভে যাইয়া জলে ছোঁ মারিল।… চৌদ্দটি হাতির সমবেত শক্তিতে যে কার্য সাধন করা সম্ভব নহে, তাহা যে কি কৌশলে সাধিত হইল তাহা চিন্তার বিষয়।’

সরের জাহাজের এই উৎকর্ষের স্বীকৃতি মিলেছিল বিশ্বজুড়ে। তুরস্কের সুলতানরা আলেকজান্দ্রিয়ায় তৈরি জাহাজের থেকে পছন্দ করতেন এখানকার জাহাজ। একসময়ে নৌবহরের জন্য একসঙ্গে ১৩টি জাহাজ চট্টগ্রামে তৈরি করান তাঁরা। ১৮১৮তে জার্মানি এখান থেকে একটি সরের জাহাজ তৈরি করায়, নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে নাম দেয় ‘ডয়েসল্যান্ড ফ্রিগেট’। কার্যকাল শেষ হবার পর ‘ব্রেমাহাফেন শিপ বিল্ডিং মিউজিয়াম’-এ তাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আর ১৯০৫এ ট্রাফালগারের যুদ্ধে চট্টগ্রামের সরের জাহাজ ব্যবহারের ইতিহাস সকলেরই জানা।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর হালিশহরের কাজি আব্দুল বারিক ও ফটিকছড়ী নিবাসী শশীবাবু যৌথ মালিকানায় ‘চট্টেশ্বরী’ নামের এক সরের জাহাজ তৈরি করান। কিন্তু কোম্পানির স্টীমশিপ ততদিনে সমুদ্রবাণিজ্যের দখল নিয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব হয়নি চট্টেশ্বরীর পক্ষে। বন্দরের পাওনা মেটাতে না পারায় নিলাম হয়ে যায় চট্টল বন্দরের শেষ সরের জাহাজ। তারপর আর কোনো সরের জাহাজ তৈরি হয়নি চট্টগ্রামে।

‘বাংলার নৌবাণিজ্যের ইতিহাস’ নামে এক অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির রচয়িতা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল মোনায়েম—লিখছেন আবদুল হক চৌধুরী। সেখানে ৩০টি সরের জাহাজের নাম ও তাদের মালিকের নামের একটা তালিকা পাচ্ছি আমরা। এবং অনেকটা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি হিন্দু মালিক নিত্যানন্দ কুণ্ডু তাঁর জাহাজের নাম দিচ্ছেন ‘জানে আলম’ বা ‘ফতুহুলবারী’। অন্যদিকে আবদুল মালুম-এর জাহাজের নাম ভদ্রকালী, এয়াকুব আলি দোভাষের জাহাজ দুর্গা, সীতা। স্বভাবিকভাবেই চৌধুরী সাহেবের সিদ্ধান্ত—

‘তখন এ দেশের হিন্দু-মুসলমান আদিবাসিগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক আবিলতার ভেদবুদ্ধি … ছিল না।’

সরের জাহাজের পালে ঠেলমারা হাওয়ায় ভেসে যতদিন কাল কাটিয়েছে চট্টগ্রাম, ততদিন হিন্দু মুসলমান একে অন্যের অস্তিত্বকে মান্যতা দিয়েছে সসম্মানে। কিন্তু কোম্পানির স্টীমশিপ যেমন চট্টেশ্বরীকে ডুবিয়েছিল, কালক্রমে ব্রিটিশের ভেদবুদ্ধির অস্ত্রে সলিলসমাধি হয়েছে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির।

সপ্তগ্রাম, হুগলী বা কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলার যে নৌশিল্প, তাতে সমৃদ্ধির উচ্ছ্বাস কিছু দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হলেও দিনের শেষে আঁধার নেমে আসার চক্রাকার আবর্তনের অনিবার্যতা এখানেও মিথ্যে হয়নি। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বাংলার নিজস্ব নৌশিল্পের ক্ষয় শুরু হয় এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা বিলোপের কাছাকাছি পৌঁছয়। নেভার আগে প্রদীপের বুক একবার জ্বলে ওঠে বটে, কিন্তু নিভে যাওয়াই ছিল ভবিতব্য—সে অনিবার্য পরিণামেই আত্মসমর্পণ ঘটে বাঙ্গালির জাহাজশিল্পের। 

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ

অর্থনীতিবিদ ইন্দ্রজিত রায় এই সময়কে তিনটি নির্দিষ্ট পর্বে ভাগ করে তার চরিত্র নিরূপণ ও কারণ অনুসন্ধান করেছেন।

  • সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ১৭৬০ সাল অবধি এর প্রথম পর্ব।
  • দ্বিতীয় পর্ব, যার বিস্তৃতি ১৭৬০ থেকে ১৮১৩ অবধি, সেখানে ব্রিটিশ পুঁজির বিনিয়োগের দৌলতে একটা স্বল্পকালীন পুনরুজ্জীবন আসে।
  • আর শেষে ১৮১৪ থেকে ১৮৫০ পর্ব যখন দ্রুত বিলোপের পথে চলে যায় এই শিল্প। 

প্রথম পর্ব:

সপ্তদশ শতকের প্রথম পর্বে বাংলার ভরপুর নৌবাণিজ্য চলত দূর প্রাচ্যের দেশ, চিন এমনকি জাপানের সঙ্গেও। এই শতকের মধ্যভাগ থেকে ইউরোপীয় শক্তি এই বাণিজ্যে প্রবেশ করে। শতাব্দীর শুরুতেই পর্তুগিজরা থাবা বসিয়েছিল বটে, কিন্তু স্বল্প পরিমাণের কারণে তা বাংলার বাণিজ্য আধিপত্যে টোল ফেলতে পারেনি। তবে প্রথমে ওলন্দাজ, পরে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা এখানে বানিজ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা অনুমান করে ক্রমশ তাদের উপস্থিতি বাড়াতে থাকে। ক্রমে ব্যবসায়ী ইংরেজ আরাকান, পেগু, সুমাত্রা, ফিলিপিন্স ও মালয় উপদ্বীপের থেকে বাঙালি ব্যবসায়িদের সম্পূর্ণ উৎখাত করে এবং এটা ঘটে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। বাংলার নিজস্ব বাণিজ্য ও ওই সব দেশের সঙ্গে যাওয়াআসার সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।

এখন এই বাণিজ্যে বিদেশীরা, বিশেষত ব্রিটিশরা বাংলায় তৈরি জাহাজ ব্যবহার করলে স্থানীয় শিল্পের এত স্বাস্থ্যহানি হত না। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তারা ভাবল নিজেদের সমৃদ্ধির কথা। তাতে স্বাভাবিকভাবে মনে এল, শুধু বানিজ্যপসরা কেন, বাণিজ্যপোতটিও যদি নিজস্ব হয়, মন্দ কি? অন্যের জমিতে বসে অন্যের উৎপাদন নিয়ে মধ্যস্বত্তভোগীর ভূমিকায় যে অবতীর্ণ হয়, তার বিবেক থাকে না। ইংরেজেরও ছিল না। তাই বাংলার জাহাজ ব্যবহার তারা তো করলই না, উল্টে ১৬৫১ সালের British Navigation Act-এর সাহায্য নিয়ে তাতে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। কী ছিল সে আইনে? 

“For the increase of the Shipping, and the Encouragement of the navigation of the Nation …. no Goods or Commodities whatsoever of the Growth, Production, or Manufacture of Asia, Africa or America … shall be Imported or brought into this Commonwealth of England, or into Ireland … in any Ship or Ships, Vessel or Vessels whatsoever, but only in such as do truly and without fraud belong to the People of this commonwealth….”. (Quoted in Schmidt 1974: 344-45)।

১৬৯৬ তে আরেক প্রস্থ এগিয়ে এর সঙ্গে জোড়া হল আর এক আইন যাতে বলা হল জাহাজের মালিকরা এক লিখিত শপথবাক্যে স্বাক্ষর করবেন, যাতে লেখা থাকবে যে জাহাজের মালিকানায়

‘no foreigner, directly or indirectly hath any Share, or Part, or Interest therein’ (Quoted in Crowther 1973: 91).

এর ফলে বাংলায় তৈরি সব জাহাজ ইংরেজের খাতায় নথিভুক্তির সুযোগ হারাল। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলার আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহৃত বাণিজ্য বহরটি বাংলার জাহাজের পরিবর্তে ইংল্যান্ড-এর থেমস-এর পারে তৈরি জাহাজ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল। ব্যতিক্রম হিসেবে রয়ে গেল নুন আর রেশমের জাহাজ, যার কারণ প্রযুক্তিগত।

এইভাবে ব্রিটিশ শাসন উন্নত কারিগরি দিয়ে নয়, উন্নত কূটনীতির প্রয়োগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করল।

দ্বিতীয় পর্বঃ

প্রতিস্থাপনের এই সিদ্ধান্তে, ১৭৬০-এর আশপাশ সময়ে কিন্তু ইংরেজদের ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’-র অবস্থা দেখা দিল। আসলে বাংলার বাণিজ্যের বহরটা তাদের পরিমাপের মধ্যে ছিল না। মাঠে নেমে তারা দেখল, সবটা সামলানোর পুঁজি ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’-র নেই, তারা হাঁ-এর থেকে বড় মাপের খাবারে কামড় দিয়ে ফেলেছে। এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর কথায়—

‘That from the increased demand in Europe and America for Indian commodities, the produce and manufacture of British India have far beyond what the capital of East India Company, applicable to its investment, is capable of exporting.

এই সুযোগে অন্য দেশের জাহাজ নাক গলিয়ে ফেলল এই বানিজ্যের পরিসরে। [হিসেব বলছে ১৭৯৯-১৮০০ তে এই কারণে ইংরেজরা যে বাণিজ্যের সুযোগ হাতছাড়া করে, আর্থিক বিচারে তার পরিমান ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার।(Henchman).] জাত বেনিয়া ইংরেজ বেওসার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়—তারা পথ খুঁজতে লাগল উদ্ধারের। ব্রিটিশ পুঁজি, কারিগরি ও ইংরেজ ‘আন্ত্রেপ্রেনর’-এর উদ্যোগে দুটি জাহাজ তারা বানিয়ে ফেলল বাংলায়। ১৭৬৯-এ ‘আমাজন’ (১৩৮ টন) ও ১৭৭০এ ‘মিনার্ভা’ (১৮০ টন)। বানাল, এবং বুঝে গেল নিজেদের কব্জায় রাখা উৎপাদন দিয়ে পরিবহণের প্রয়োজনীয় জলযানের দাবির এক শতাংশও মেটান যাবে না।   

ইতিমধ্যে ১৭৮০ তে হায়দার আলি শুরু করেছেন দ্বিতীয় অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধ। তার পোড়া মাটি নীতির কারণে কর্ণাটকে দেখা দিল মন্বন্তর। সেখানে যুদ্ধরত ইংরেজ সেনাবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহের দায় ইংরেজদের, দায়িত্ব বাংলার। সিলেটের কালেক্টর লিন্ডসের নেতৃত্বে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জাহাজ তৈরির তৎপরতা শুরু হল। ৪০০ টনের একটি বড় জাহাজ আর ২০টি ছোট জাহাজ চাল নিয়ে পাড়ি দিল মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একবার ভেসেই সমস্ত জাহাজের ভেঙ্গে পড়ার জোগাড়—নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী, খারাপ কারিগরি আর সর্বোপরি অতি দ্রুত কাজ শেষ করার উদগ্র বাসনার অন্য পরিণতি হবার কথা নয়, হয়ওনি। এবার জাহাজ নির্মাণের সমস্ত প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত হল কলকাতায়। সেখানে কর্নেল হেনরি ওয়াটসন ১৭৮০তে এক লক্ষ পাউন্ড খরচ করে ওয়াটগঞ্জে একটি ‘wet-and-dry dock’ বানিয়ে ফেলেছেন। (মজার কথা, ১৭৭২ সালে পরিকল্পনা করা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে সময় লেগেছিল ৮ বছর, কারণ স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে জমিবিবাদ যার নিস্পত্তি হয়েছিল আদালতের হস্তক্ষেপে৷ (সিঙ্গুরের প্রথম সংস্করণ ?) ১৭৮১তে সেখানে তৈরি হল ৪৮৩ টনের জাহাজ Nonsuch আর ১৭৮৮তে ৩৭০ টনের জাহাজ Surprise. তাদের মান সম্বন্ধে সে সময়ের এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য;

“The ship [Nonsuch] is a proof not only of good workmanship, but of the durability of her materials; as she is still [1800] reckoned in the first class of the company ships …”।

এর সাফল্যে উৎসাহিত হয় ব্রিটিশ পুঁজি। পরবর্তী কয়েক বছরের একটা তালিকার দিকে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাব কতগুলো সংস্থা কত জাহাজ তৈরি করেছিল—

Company name  ShipYear of Production
G. Gillet & CoHindoostan (700 tons)1788
 Ann Eliza (197 tons)1789
 Speke (450 tons)1789
 Reliance (469 tons) 1790
 Il Netuno (76 tons)1791
 Bangalore (206 tons)1792
 Heiress (340 tons)  1792
 Peggy (517 tons)    1793
 Lutchmy (402 tons)1794
 Gabriel (815 tons)1794
G. Foreman & Co (later J. Gilmore & Co in 1800)Aurora (572 tons)         1789
 Earl of Morington (770 tons)1798
 Arran (350 tons) 1800
 Morrington (770 tons) 1800

এ ছাড়া আরও কিছু কোম্পানি মিলে কলকাতা ও তার আশেপাশে আঠেরো শতকের শেষ দুই দশকে মোট জাহাজ তৈরি করে ফেলল ৩৫টি, যাদের সম্মিলিত ওজন ১০ হাজার টনেরও বেশি। পরের মাত্র তিন বছরে বাংলার বন্দরে তৈরি হল আরও ২১ট জাহাজ, ৯৩টি স্টিমার জাতীয় জলযান। সম্মিলিত অর্থমূল্য ৫ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। এর সুবাদে কলকাতা, সালকিয়া, হাওড়া, ওয়াটগঞ্জ, খিদিরপুর প্রভৃতি অঞ্চলে পত্তন হল অনেক ‘ডক’-এর। তাদের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে এক বিরাট সংখ্যক কর্মী ও আধিকারিক নিযুক্ত হলেন কাজে। সঙ্গে জাহাজ নির্মাণে যুক্ত মানুষদের যোগ করা হলে দেখা যাচ্ছে পূর্ণ সময়ের কর্মী নিয়োগের সংখ্যা ৪৫০০ থেকে ৫০০০। বিশেষ সময়ে, যেমন ১৮০১-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০০০০ এর আশেপাশে।  

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় হুগলী জেলার কোন্নগরের ডক ও জাহাজ তৈরির কথার। শ্রী সুধীর কুমার মিত্র তাঁর ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ বইটিতে লিখছেন—

‘কোন্নগর একটি প্রাচীন স্থান। পূর্বে সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণের জন্য এই স্থান সবিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। উনবিংশ শতাব্দীতেও কোন্নগরের ডকে জাহাজ নির্মিত হইত দেখিতে পাওয়া যায়। ডাক্টার ক্রফোর্ড লিখিয়াছেন “Early in the 19th century there was a dock at Konnogar where ships were built” (Hooghly Medical Gazetteer.)

এই তথ্যের সমর্থন মেলে ঐতিহাসিক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘হুগলী জেলার পুরাকীর্তি’ গ্রন্থেও। ঠিক কারা কি কারণে এই স্থানটিকে উপযুক্ত মনে করে এই শিল্পের পত্তন করেন এখানে, কবেই বা তাতে দাঁড়ি পড়ে, তার খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। 

ডকের পত্তন ও জাহাজ তৈরিকে ঘিরে অনুসারী শিল্পের ঢল নামল এই অঞ্চলে। কাঠের যোগান দিতে উত্তবাংলার ও উত্তরবিহারের বিস্তীর্ণ জঙ্গল, অযোধ্যার অরণ্যের গাছ কাটা আর নিয়ে আসার এক বিস্তারিত ব্যবস্থা আর ব্যবসা রমরমিয়ে চলতে লাগল। লোহা, তামা, পিতল ও কাঁসার ব্যবসা যা আগেই বাংলায় যথেষ্ট সম্পন্ন ছিল, তারা আরও একটু স্বাস্থ্যবান হল, দড়ি, পাল, মাস্তুল ইত্যাদির উৎপাদনে কর্মসংস্থান হল বহু মানুষের।

১৮০০ সাল থেকে বাংলার জাহাজ পেল আন্তর্জাতিক বাজার। এই বছরে ৭টি জাহাজ বিক্রি হল ইংল্যান্ড-এর কাছে। পর্তুগাল, আমেরিকা আর আরবদেশ প্রত্যেকে একটি করে জাহাজ কিনল। পরবর্তী কয়েক বছর মোট জাহাজের শতকরা পঁচিশ ভাগই পেয়েছিল বিদেশী ক্রেতা। সেই ১৮০২ সালে Lambert লিখলেন—

‘this noble and useful art has been ever since [1781] persued with so much vigour, that Bengal …. now supplied not only shipping for her own commerce, but for the sale to foreigners;’

অনেক জাহাজ তৈরি হল। প্রশংসাও বড় কম জুটল না! ব্রিটিশ সংসদের সিলেক্ট কমিটির কাছে পেশ করা এক প্রতিবেদনে লেখা হল—

‘that for durability, and also for repairs, and durability of those repairs, you should prefer an India-built ship and Indian repair, to a British one?. Most certainly.’

কিন্তু ইংরেজ বাণিজ্যে দেশীয় জাহাজ? সে তো কবেই বারণ হয়ে আছে। সেই যে British Navigation Act, তার কি হবে? Act থাকলে Amendment আছে। ১৭৯০তে শুরু করে বেশ কিছু সংশোধনীর মই বেয়ে ১৭৯৪এ এল সংশোধিত Navigation Act৷ বলা হল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত জাহাজের নথিভুক্ত হবে ব্রিটিশ নিবন্ধনিতে। অচিরেই প্রচুর জাহাজ তালিকাভুক্ত হয়ে গেল ব্রিটিশ বাণিজ্যে অংশ নেবার জন্যে। ১৮০১ এ কলকাতা বন্দর থেকে লন্ডন বন্দর অভিমুখি চাল বহন করা বিশাল সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াল ২৫, যাদের সম্মিলিত ওজন ২২,৭৬৭ টন। ১৮০৭ সালে কলকাতা বন্দরে আসা যাওয়া করা জাহাজের সংখ্যা বেড়ে হল ৭৭৩।

এই ব্যবসায়ে না জেনে বড়সড় ইন্ধন যোগালেন যে মানুষটি, তাঁর নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ অব্দি বার বার নৌযুদ্ধে জড়ালেন ইংল্যান্ড-এর সঙ্গে। এক ১৮০৩ এই ইংরেজদের জাহাজ ধ্বংস করলেন ১৭৩,৯০০ টন। শুধু যুদ্ধজাহাজ নয়, বহু বানিজ্যপোতও ছিল এই তালিকায়। ফলে বহির্বাণিজ্যে ভারত তথা বাংলার জাহাজকে আরও বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ল ইংরেজদের। আপন স্বার্থেই বাংলার জাহাজশিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় যাকে আমরা পেলাম, তার নাম ব্রিটিশ রাজশক্তি। বাংলা আপ্লুত হল। ইতিহাসের দেবতা কিন্তু অলক্ষ্যে মুচকি হাসলেন। 

তৃতীয় পর্বঃ 

যুদ্ধের এই পর্বে ইংল্যান্ড-এর জাহাজশিল্পের কী দশা? দশা বৃহস্পতির। তার নমুনা রয়েছে ব্রিটিশ নিবন্ধনিতে নথিভুক্ত জাহাজের সংখ্যায়। সেখানে সংখ্যাটি ১৭৯২-এ যখন ৬০৯, তখন ১৮০৩ বেড়ে হল ২,২৮৬ আর ১৮১১তে ৪,০২০। ফলে যুদ্ধে প্রচুর জাহাজ ধ্বংস হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধশেষে যুদ্ধ পূর্ববর্তী সংখ্যার তুলনায় ইংরেজ নৌসাম্রাজ্যে জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল ২১ শতাংশ। এই উদ্বৃত্ত নৌশক্তিকে লাভজনক উপায়ে ব্যবহার করার উপায় বার করতে তৎপর হল ইংরেজ রাজশক্তি। সহজতম মনে হল বাংলার বিরাট বানিজ্যবহরকে আবার প্রতিস্থাপন করা নিজেদের জাহাজ দিয়ে। আবার হাতিয়ার হল আইনের পরিবর্তন। হাজার হোক সভ্য দেশ, বেআইনি কিছু করা তার কি সাজে? ফলে, প্রথম যে আইন পাশ হল ১৮১৩ সালে তাতে বলা হল—

‘It shall not be lawful for any Ship or Vessel; the registered measurement whereof shall be less than Three hundred and Fifty Tons … to clear out from any port in the United Kingdom … Company’s charter….’.

কলমের এক খোঁচায় আইনকে আইনের পথে চলতে দিয়ে বাংলার জাহাজের ৪০ শতাংশকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া গেল বিশ্ববানিজ্যের পরিসর থেকে, কারণ বাংলার জাহাজের এই অংশটুকু ৩৫০ টনের কম ওজনের জলযান দিয়ে তৈরি। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য থেকে তাদের নির্বাসন হল পূর্বসমুদ্রের দূরপ্রাচ্য ও চিনের সীমায়িত গণ্ডির মধ্যে।

দ্বিতীয় আইনের প্রথমাংশ বলল ব্রিটিশ রেজিস্টারে নথিভুক্ত হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের জাহাজ কলকাতা ও লন্ডন থেকে আমেরিকা ও ইউরোপের অন্য অংশে ব্রিটিশ (ব্রিটেনে নির্মিত জাহাজ) জাহাজের সমান সুবিধে পাবে না। ফলে ভারতীয় তথা বাংলার জাহাজ ব্যবহারে খরচ বাড়ল—ব্যবসায়ীরা মুখ ফেরাল।

আইনের দ্বিতীয় অংশ আরও মারাত্মক। এশিয়া বা ইংরেজের অ-এশিয় উপনিবেশে জন্মান নাবিক, লস্কর বা জাহাজের অন্য কর্মচারী ব্রিটিশ নাবিকের স্বীকৃতি পাবে না। ফলে শুধু তাদের দ্বারা চালিত কোনো জাহাজ অ-ইংরেজ জাহাজের শ্রেণীভুক্ত বলে বিবেচিত হবে। লন্ডন বন্দরে তাদের প্রবেশাধিকার থাকবে না। আর দেশের লাটসাহেবের বিশেষ অনুমতি বলে লন্ডনে আসতে পারলেও, ফেরার সময় জাহাজভরা ইংরেজ নাবিক বয়ে নিয়ে যাবার দায় পড়ল তাদের ঘাড়ে। বানিজ্যের সরল সমীকরণে কলকাতা লন্ডন পথে বাংলার জাহাজের পাড়ি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। আগে কলকাতা থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজ যেত চিন, সেখান থেকে চা নিয়ে পৌঁছত লন্ডন আর সেখানকার পণ্য নিয়ে কলকাতা ফিরত। লন্ডনের রাস্তা বন্ধ হওয়ায় চিনে যাওয়া জাহাজকে খালি ফিরতে হল কলকাতায়, কারণ চিন থেকে বয়ে আনা কোনো পণ্যে লাভজনক ব্যবসা চালানো সেকালে অসম্ভব ছিল। চিন বানিজ্য শেষ হতে বাংলায় তৈরি জাহাজ অলস বসে পড়ল কলকাতা আর বম্বের বন্দরে। তাদের দুয়ো দিয়ে ‘Made in England’ জাহাজেরা ঢেউ তুলল বন্দরের বুকে।

Phipps সাহেবের লেখা তথ্য জানাচ্ছে কলকাতার বন্দর থেকে ১৮১৪ সালে যখন যাত্রা করেছে ২৬টি জাহাজ, ১৮১৫ তে তা কমে দাঁড়াল ১৯-এ, ১৮২১এ ১২ আর তারপর ক্বচিৎ কখনো কোনো জাহাজ সাগরপাড়ি দিল। জাহাজনির্মাণ প্রসঙ্গে তাঁর নথি বলছে—

‘Since the last mentioned period [1801 – 21], shipbuilding has greatly declined in Bengal; …. from 1827 to 1839 both inclusive, being only five ships, 1340 tons; no ship was on the stock at Calcutta, at the later end of 1839.”

১৮৪০ এর পর কোনো উল্লেখযোগ্য জাহাজ তৈরি হল না বাংলার কোনো বন্দরে। জাহাজনির্মাণ থেকে জাহাজ সারাই-এর ব্যবসায় এই শিল্প কিছুদিন টিকে থাকার চেষ্টা চালাল। শেষে রনক্লান্ত সৈনিকের মতো অস্ত্র ফেলে দিয়ে শত্রুর অসির আঘাতে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সময় স্মৃতির চাদরে ঢেকে তাকে কবরস্থ করল। সে কবরের এপিটাফে সাইমন ডিগবি লিখলেন—

‘…scarcely anything has struck me more forcibly than the manner in which the Mistress of the seas in the Western World has stricken to death the Mistress of the seas in the East.’

তথ্যসুত্র

  • Indrajit Ray., Bengal Industries and the British Industrial Revolution (1757-1857). (Routledge, 2011).
  • Balthazar Solvyns, Boats of Bengal. Eighteenth Century Portraits. (Monohor, 2001).
  • আবদুল হক চৌধুরী, বন্দর শহর চট্টগ্রাম। (গতিধারা, ২০০৯) ৷
  • সুধীর কুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, দ্বিতীয় খণ্ড৷ (দে’জ সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৩)৷

প্রথম পর্বের লিংক

জন্ম ১৯৫৯। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা। পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। লেখার জগতে বিলম্বিত প্রবেশ। লেখা প্রকাশিত 'দেশ', হরপ্পা, ভ্রমি ভ্রমণআড্ডা সহ নানা পত্রিকায় ও সংকলনে। প্রকাশিত বই 'টাইমলাইন আলাস্কা', 'এক চামচ বিদেশ', 'কোভিড-১৯, এক বিভ্রান্তির সন্ত্রাস'। ভ্রমণআড্ডা প্রদত্ত 'কলম' সম্মান লাভ ২০২২এ। ভ্রমণ, ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষভাবে অনুরাগী। ছবি তোলার নেশায় দেশে বিদেশে পাড়ি, তাতে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তি। দেশে ও বিদেশে একক ও দলগত প্রদর্শনী।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।