সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

জাহাজ ভাসে সাগরজলে – পর্ব ৩

জাহাজ ভাসে সাগরজলে – পর্ব ৩

ভাস্কর দাস

ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫ ৮১ 0

[এই নিবন্ধের প্রথম দুটি পর্বে আমি ভারতবর্ষ আর তার মধ্যে বিশেষত বাংলার জাহাজের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখার চেষ্টা করেছি। বাংলার ছিল অন্তত তিন হাজার বছরের জাহাজ নির্মাণের এবং জাহাজ নির্ভর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ঐতিহ্য। শুধু বাণিজ্যপোত বা প্রমোদতরণী নয়, রণতরী বানানোর প্রকৌশলে বাংলার জাহাজশিল্প বিরাট উচ্চতায় অবস্থান করেছিল, চট্টগ্রামে কনস্টান্টিনোপল-এর রণতরীও নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বাংলার নিজস্ব নৌশিল্পের ক্ষয় শুরু হয়। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের মাঝামঝি অব্দি সময়টুকু জোয়ারভাটার দোদুল্যমানতায় কাটে। তারপর অবিশ্বাস্য দ্রততায় তা প্রায় বিলোপের দিকে যায়। ভারত দখলের আগে থেকেই ইংরেজরা নানা কূটপথে ভারতীয় নৌবাণিজ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল। তারপর তাদের উপর্যুপরি আঘাতে বাংলার জাহাজশিল্প বিলীন হয়ে গেল। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ১৮৪০ এর পর কোনো উল্লেখযোগ্য জাহাজ তৈরি হয়নি বাংলার কোনো বন্দরে।]         

এই পর্যন্ত পড়ে যে কোনো পাঠকের মনে এই প্রশ্ন আসবে, ‘তাহলে গত ২০২৩-এ খিদিরপুর ডকে অতি আধুনিক রণতরী ‘বিন্ধ্যগিরি’-র কমিশন হল, সেগুলো কারা বানালো?’ উত্তরটা অবশ্যই কলকাতার গর্ব Garden Reach Ship Builders & Engineers Ltd. দেশের মিনিরত্ন আখ্যায় ভূষিত এই কোম্পানি ১৯৮৪ থেকে দেশের জাহাজশিল্পের প্রসারে বিরাট ভূমিকা নিয়ে চলেছে। এর হোম পেজ আর তার রেফারেন্স-এ এদিক ওদিক সার্ফিং করলে প্রাপ্ত তথ্য এটাই জানাবে, যে ১৮৪০-এ বাংলার জাহাজশিল্পের এন্তেকাল শেষে সাইমন ডিগবির বিলাপ—

‘…Scarcely anything has struck me more forcibly than the manner in which the Mistress of the seas in the Western World has stricken to death the Mistress of the seas in the East.’

পশ্চিমের সমুদ্রবাণিজ্যের নিয়ন্তা মহারাণী যে তৎপরতায় পূর্বদেশের সমুদ্রবাণিজ্যের মধ্যমণিকে দংশন করে তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, তার তুলনা পাওয়া ভার।

একশো বছর পরে আবার নিদ্রা ভেঙ্গে আড়মোড়া ভেঙেছিল বাংলা তথা ভারতের জাহাজনির্মাণ শিল্প। লম্বা ঘুমের শেষে প্রথম কটি পদক্ষেপে খুব স্বাভাবিকভাবেই ছিল অবিন্যস্ত অসংলগ্ন চলনের আভাস। কারণ ততদিনে জাহাজ নির্মাণের কারিগরিবিদ্যায় পরম্পরাসঞ্জাত মেধা আর কুশলতার সম্পদ বিস্মৃতির সিন্দুকে বন্দী হয়ে গেছে। ‘টেকনোলজি’ লাঞ্ছিত ‘নলেজ’-ভিত্তির পরিসরে পৃথিবী ততদিনে একমাত্রিক ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এ নিজেকে পরিবর্তিত করে নেবার সাধনায় রত। আঞ্চলিকতার নিজস্বতা সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। বিশিষ্টতার চেয়ে গুরুত্ব বেশি ব্যবহারিক উপযোগিতার। ফলে উৎপাদিত পণ্যের চেহারা উত্তর আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে চিনের সাংহাই—সর্বত্র এক৷ মুল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ব্যাপ্তি সারা বিশ্ব। এইরকম আন্তর্জাতিকতার আবহে ভারতের জাহাজশিল্পের আধুনিক যুগের পত্তন শেঠ নরোত্তম মোরারজি আর শেঠ ভালচাঁদ হীরাচাঁদ দোসির ‘সিন্ধিয়া স্টীম ন্যাভিগেশন কোম্পানি’-র হাত ধরে শুরু হয়। সময়টা ১৯৪১ সাল।

বীজ বোনা হয়েছিল আরও আগে। সেই ১৯১৯-এ, যখন এঁরা দুজন লন্ডন গেলেন ক’খানা স্টীমার কিনতে। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে আর একটা ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন তাঁদের সঙ্গী ছিল। তাঁরা দেখতেন ভারতের পণ্য আর যাত্রী পরিবহনের সমস্ত জাহাজ তৈরি হচ্ছে ভারতে, কিন্তু পূর্ণ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা কথা শুরু করলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে ফেললেন, ভারতের নৌ-শিল্প সম্পর্কে একশো বছরের পুরনো মনোভাবে ব্রিটিশদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। জাহাজশিল্পে ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার প্রচেষ্টায় তাদের সক্রিয় বাধাদান চালু থাকল। ফলে নিজেদের জাহাজশিল্পের পত্তনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল দেশপ্রেমের গাঢ় আবেগ। তাই শত বাধার মুখে ১৯৪১-এর জুন মাসে বিশাখাপত্তনমে সিন্ধিয়া কোম্পানি-র জাহাজ কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন কোনো ব্রিটিশ রাজপুরুষ নয়, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি বাবু ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। আর ১৯৪৫-এ কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় শেঠ ভালচাঁদ বললেন—

‘It is the misfortune of the Indian Shipping that while it was not allowed to build ships in Indian yards during the War and while no facilities given to it even to build such ships as it has lost during the War, His Majesty’s Government, have given every facility to British shipping to make up the losses sustained by them during the War… Indian Shipowners were…not allowed to build ships in the Indian yard which was fully laid out for that purpose… British shipowners have been given actual subsidy… No such assistance has been given or even contemplated by the Government of this country’.

এটা ভারতীয় জাহাজশিল্পের নিতান্তই দুর্ভাগ্য যে যুদ্ধের সময় তাদের ভারতীয় বন্দরে কোনো জাহাজ তৈরি করতে দেওয়া হয়নি, বা সেই জাহাজও বানানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি যা যুদ্ধে খোয়া গিয়েছিল। বরঞ্চ ব্রিটিশ সরকার ইংরেজ কোম্পানিকে সেই ক্ষতি পূরণ করার সমস্ত সুযোগ ও সুবিধে দিয়েছে।…ভারতীয়রা ভারতের বুকেই জাহাজ তৈরির সুযোগ পায়নি…এমনকি ইংরেজদের এই কাজে যে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল, তা থেকেও বঞ্চিত ছিল ভারতীয়রা।

স্বাধীন ভারতের নবীন সরকারের পক্ষেও ভারতের বিকাশে জাহাজশিল্প কতটা কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে, তা বুঝতে প্রচুর সময় লেগেছিল। তাই ১৯৪৭-এর পর প্রায় দশ বছর সময় এই শিল্পের অনুশীলনের এক ও একমাত্র মঞ্চ হিসেবে আমরা পাই বিশাখাপত্তনম জাহাজ কারখানাকে। শেষে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষদিকে, ১৯৫৭-এ আরও কটি কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই সূত্রে পর্দার আড়াল থেকে সামনে আসে গার্ডেনরিচ-এর এক জাহাজ কারখানা। ১৮৮৪ থেকে সেই ছোটো কোম্পানিটি ছোটো জাহাজ ও স্টীমারের জন্য স্থানীয় চাহিদা পুরণ করত। মেরামতের কাজে তাদের সুনাম ছিল। ১৯১৩-তে সেটি ‘গার্ডেনরিচ ওয়ার্কসপস লিমিটেড’ নামে পঞ্জীকৃত হয়েছিল। ১৯৬০-এ ভারত সরকার এটি অধিগ্রহণ করে। শুরু হয় এর উত্থানের পর্ব। এক ছোটো কারখানা থেকে শুরু হয়ে আজ কলকাতায় প্রায় ১১২ একর জমির ওপর পাঁচটি ‘ইউনিট’ সমৃদ্ধ এক বিরাট ‘মিনিরত্ন’ উদ্যোগ।

অধিগ্রহণের এক বছরের মধ্যেই গার্ডেনরিচ সে সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে দেশের নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেয় প্রথম যুদ্ধজাহাজ আই.ইন.এস অজয়। সেই শুরু। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রথাগত থেকে অত্যাধুনিক, ছোটো ও বড়ো মিলিয়ে ৯৮টি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছে GRSE (Garden Reach Shipbuilders & Engineers). পরিবহণ ও টহলদারির কাজে ব্যবহারের জন্য সীমান্তরক্ষীবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া জলযানের সংখ্যা সাড়ে সাতশোর মতো। বাংলার মানুষের কর্মসংস্থানেও এই সংস্থার যথেষ্ট অবদান।

জলপথ পরিবহণ আর আঞ্চলিক নৌবাণিজ্যে প্রয়োজনীয় জলযান নির্মাণের জন্য কলকাতা আর তার আশপাশ অঞ্চলে প্রায় ৩০টি শিপইয়ার্ডে কাজ করেন অনেক মানুষ। আর তাদের শ্রমের ফসল সমৃদ্ধ করছে ভারতের জাহাজশিল্পকে। অনেকটা পথ পেরিয়ে, সরকার ভারতের মতো একটি সুদীর্ঘ তটরেখাসমৃদ্ধ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জাহাজশিল্পের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। তাই বিশ্ববাণিজ্যে দেশে তৈরি জাহাজের অংশীদারি এখনকার ০.০১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০২৫-এ ৫ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। পরিকল্পনার রূপায়নের দায়িত্ব  বাংলার ভাগে এসেছে বেশ কিছুটা।     

এইসব প্রশ্রয়ী ভাবনায় এই বঞ্চনার কালে যখন খানিকটা তুষ্টির অনুভব আরাম দিচ্ছিল মনটাকে, তখন একটা বেয়াড়া প্রশ্ন জলের গভীর থেকে উঠে আসা মাছের মতো আবার ঘাই মারল। এই যে আজকের বাংলায় জাহাজ উৎপাদনের যতটুকু বোলবোলা, তার বেশিটাই তো যুদ্ধজাহাজ। তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খার যোগাযোগ কোথায়? সে জাহাজ তো নিয়ে যায় না ঢাকার তৈরি সেই মসলিন, যা পরে পারস্যের রাজকুমারী যান অভিসারে। পেটি ভরে নিয়ে যায় না সুগন্ধি চা, যার পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সউদাম্পটনের সমুদ্রসৈকতে সূর্যাস্ত উপভোগ করেন কোনো অভিজাত রাজদম্পতি। কাঠের বাক্সে বিশেষ পদ্ধতিতে ভরে নেয় না মন মাতাল করা সুগন্ধি মশলা, যাতে তৈরি হয় কোনো সুলতানের নার্গিসি কোফতা। বদলে থাকে আগুনভরা বোমা, মিসাইল আর ডেপ্‌থ চার্জ, যার ব্যবহারে মানুষের একটাই প্রাপ্তি—সম্পদের বিনাশ, সভ্যতার ক্ষয়।      

আজকের এই কারখানাদের কোনো মন্ত্রবলে বাংলা থেকে তুলে ভারতের অন্য কোথাও যদি বসিয়ে দেওয়া হয়, নিয়োগ করা হয় স্থানীয় মানুষদের, তবে উৎপাদিত পণ্যে কি রকমফের ঘটবে? উত্তরটা নিশ্চিতভাবে ‘না’। কারণ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় উপাদানের তালিকা থেকে এখন অদৃশ্য হয়েছে ব্যক্তিগত দক্ষতা। নকশাদার খাট তৈরিতে মিস্ত্রীর হাতের বাটালির কাজের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য যেমন আজ অপ্রাসঙ্গিক, তেমনই অপ্রয়োজনীয় বংশপরম্পরায় অর্জিত সেই মেধা, যাকে মূলধন করে চট্টগ্রামের অশিক্ষিত কারিগর চকখড়ির নকশার কাঠামোয় বানিয়ে ফেলত সমুদ্রগামী বহিত্রবহর। অথবা একটি জাহাজে ৭০০ মানুষের মিছিল নিয়ে শ্রীলঙ্কায় হাজির হত বিজয় সিংহ। আর এটা ভাবতেই মনে হল, বাংলার জাহাজশিল্প, যার গায়ে একদিন লেগেছিল ষোলআনা বাঙ্গালিত্বের ডাকটিকিট, তার এন্তেকাল হয়ে গেছে ১৮৪০ এই। মধ্যমেধার বাঙালি শুধু ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে আজ যাকে বাংলার জাহাজশিল্প বলে শ্লাঘা অনুভব করে, তা আসলে বয়ে যাওয়া আড়াই হাজার বছরের পরম্পরার নির্যাসের বদহজমজনিত উদ্গারগন্ধে ভরপুর এক আবর্জনামাত্র।  

সহায়ক পাঠ

  • Indrajit Ray, Bengal Industries and the British Industrial Revolution (1757-1857). (Routledge, 2011)
  • Balthazar Solvyns, Boats of Bengal. Eighteenth Century Portraits. (Monohor, 2001)
  • আবদুল হক চৌধুরী, বন্দর শহর চট্টগ্রাম. (গতিধারা, ঢাকা, ২০০৯)
  • Rear Adm. G.K.Harish, VSM & Com. Prashant Singh, Shipbuilding, a larger National perspective. www.vifindia.org
জন্ম ১৯৫৯। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা। পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। লেখার জগতে বিলম্বিত প্রবেশ। লেখা প্রকাশিত 'দেশ', হরপ্পা, ভ্রমি ভ্রমণআড্ডা সহ নানা পত্রিকায় ও সংকলনে। প্রকাশিত বই 'টাইমলাইন আলাস্কা', 'এক চামচ বিদেশ', 'কোভিড-১৯, এক বিভ্রান্তির সন্ত্রাস'। ভ্রমণআড্ডা প্রদত্ত 'কলম' সম্মান লাভ ২০২২এ। ভ্রমণ, ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষভাবে অনুরাগী। ছবি তোলার নেশায় দেশে বিদেশে পাড়ি, তাতে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তি। দেশে ও বিদেশে একক ও দলগত প্রদর্শনী।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।