সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

কক্সবাজারের ইতিহাসের অনুসন্ধানে (প্রথম পর্ব)

কক্সবাজারের ইতিহাসের অনুসন্ধানে (প্রথম পর্ব)

কালাম আজাদ

জুন ১৫, ২০২২ ১৩৮০ 2

মানব সভ্যতা এগিয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।টিকে থাকার এ পর্বে মানুষ তার বিজয়গাথাকে লিখে রাখতে পারেনি। হয়তো তখন তাদের মস্তিষ্কে এই বোধ-ই জন্মায় নি। হাজার বছরের তীব্র লড়াই আর সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মানুষ যখন গুহাগাত্রে ছবির মাধ্যমে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে থাকে তখন থেকেই মানুষের ইতিহাস শুরু হয়।প্রাগিতিহাস।এই সময় থেকে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা হতে শুরু করে। এভাবেই ইতিহাসের যাত্রা শুরু বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। তারপর আগুন জ্বালিয়ে গাছের গুঁড়িতে বসে দাদুর মুখে গল্প শুনে শুনে ইতিহাসের একটি মৌখিক রূপ দাঁড়ায়। ইশারা-ইঙ্গিত এবং গুহাগাত্রে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় বসবাসকারী নৃগোষ্ঠী থেকে হিন্দু মুসলিম, বড়ুয়া, মগ-রাখাইন–পৃথিবীর সব নরগোষ্ঠীর আদি যাত্রাপথ এভাবেই শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, ফেনি, আকিয়াব, রোসাঙগিরি, মন্ডু, ইরাবতী, পেগু, নেহ স্লাই বা নীল নাফ, হলুদ ফুলের দেশ (রামু), বাঁকোলী বা পেঁওয়া, ‘পালংকি’ কক্সবাজার এই স্থান সমূহে বহু প্রাচীন কাল থেকেই রীতিমত একটি সভ্যতার পদযাত্রা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্ত জেলা কক্সবাজার। কক্সবাজার জেলার নাম দেশ-বিদেশে সুন্দর ভূ-প্রকৃতি, লোনাজল প্রসূত অর্থবিত্তের মিথস্ক্রিয়া, সর্বোপরি আন্তঃ-প্রাদেশিক সীমারেখা কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে।কক্সবাজারের প্রশাসনিক ইতিহাস ও নাম-মাহাত্ম পণ্ডিতি ভাষায় অতি-সাম্প্রতিক। জেলা হিসেবে এর অস্তিত্ব মাত্র তিন যুগ (১ মার্চ ১৯৮৪) আগের। কিন্তু দুইশ বছর আগেও কক্সবাজার নামক কোনো শব্দ বা বাক্যের অস্তিত্ব বিশ্বমানচিত্রে ছিল না। তবে ভিন্ন নামে তার ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস সুপ্রাচীন। কালে কালে রাজা বাদশাহের ক্ষমতার পালাবদল, আরাকানি ও মগ, বহিরাগত মোগল, পর্তুগীজ অতঃপর ব্রিটিশ করায়ত্ত হলুদাভ ফুলেল দেশ ‘পেঁওয়া’, ‘বাঁকোলী’ বা পালঙ্কী কীভাবে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স সাহেবের বাজারে পরিণত হয় তা সাংবাদিক সাহিত্যিক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ সিদ্দিকী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড, আবদুল করিম, ম্যাথেন জেইন, মুহম্মদ সিদ্দিক খান, মুহম্মদ নুরল হুদা, আবুল কাসেম, মুহম্মদ নুরুল ইসলাম, নুর আহমদ, ড. মালিক সোবহান প্রমুখ ইতিহাসবেত্তার দৌলতে জানা যায়। এভাবে বাঁকোলী বা পেঁওয়া ও পালংকীথেকে কক্সবাজার হয়ে এগিয়ে চলেছে এখানকার মানবসভ্যতা ও তার সংস্কৃতি। কিন্তু সভ্যতার ভিত্তিভূমি ও স্মারক হিসেবে তার সাহিত্য-সংস্কৃতির পূর্বাপর ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপট আড়ালে রয়ে গেছে অনন্তকাল।

ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাংলাদেশে ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার নামে স্থানিক ইতিহাস প্রণয়নের রীতি ছিল। তাতে প্রতিটি জেলার ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক ইতিহাস স্থান পেত। সে প্রক্রিয়া ব্রিটিশোত্তরকালে লুপ্ত হয়ে যায়। ফলে স্থানিক ইতিহাসও দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়। এভাবে রাষ্ট্রীয় গরজের অভাব, লোক-সাধারণের অজ্ঞতা ও প্রাগ্রসর সমাজের অনিহাহেতু এতদঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধূলিধূসর হয়ে আছে যুগে যুগে। তাই অনেকটা অনুমান ও কিছুটা দূরাগত উপকরণের উপর নির্ভর করে এখানকার ইতিহাস- ঐতিহ্য সন্ধান ভিন্ন গত্যন্তর নেই। তাই কক্সবাজারের ইতিহাসের অনুসন্ধান করলে একটু গভীরে যেতে হবে। ঘাঁটতে হবে ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাঙলার ইতিহাস।

ভারতবর্ষের ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন তাঁরা বঙ্গের সীমানা সমতটের ময়নামতি বা চট্টগ্রামের ফেনি পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। অনেকে চট্টগ্রামকে আরাকানের সঙ্গে বা আকিয়াব বন্দরের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। ইতিহাসের কাল হিসেবকরলেও আমরা তা বুঝতে পারি। চট্টগ্রাম স্বতন্ত্র একটি রাজ্য হিসেবে শাসিত হলেও মধ্যযুগে তা কখনো বঙ্গের শাসনে কখনও আরাকানের শাসনাধীন হয়ে পড়তো। মধ্যে মধ্যে স্থানীয় সামলীয় নৃপতি চট্টগ্রামে স্বাধীনভাবে তাদের নিজেদের শাসনভার চালালেও তা ধরে রাখতে পারতো না। এরপর এই বিস্তৃত পাহাড়ি ভূখণ্ডকে অপেক্ষাকৃত বর্বর বা মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য মনে করে শাসক ও ঐতিহাসিকেরা এড়িয়ে গেছেন। মগধ (বিহার) বার্মা, ত্রিপুরা, তিব্বত, চীন মঙ্গোলীয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষও প্রাথমিক ভূখণ্ড হিসেবে এ অঞ্চলকে বেছে নেয়। বঙ্গোপসাগরের তীরে দুই নৃগোষ্ঠীর মানুষের বাস, একগোষ্ঠী পিতৃতান্ত্রিক, আরেকগোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক। তাদের অনুসৃতধর্ম বিশ্বাসের স্তম্ভ -মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, নানান ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, প্রকৃতির সৃজনী শক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, লিঙ্গ পূজা, কুমারী পূজা, টোটেম’এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের রোগ, দুর্ঘটনা দুষ্ট শক্তি বা ভূত-প্রেত দ্বারা সংগঠিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি। অতঃপর মৌর্যযুগ থেকে আর্যরা (ব্রাহ্মণ) বাংলায় অনুপ্রবেশ করে, ইরাবতীর তীর ধরে বার্মা হয়ে আরাকান রাজ্যে তারা নিজেদের বসবাসযোগ্য ভূমি খুঁজে নেয়। গুপ্তযুগে আরো অনেক মানুষ এ অঞ্চলেআসতে থাকে। ক্রমে তারা আরও দক্ষিণপূর্বে পাহাড়ি অঞ্চল বঙ্গোপসাগরের তীরে চলে আসে। ভারতবর্ষ, বার্মা, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের ও আরাকানের প্রান্তীয় অঞ্চলের নাম ছিল রামু।অপেক্ষাকৃত স্বাধীন জীবনযাপন ও সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে অনেক প্রাচীন মানুষ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের মধ্য দিয়ে পরবর্তী সময়ে বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসে তাদেরকে বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম ধারক রূপে দেখা হলেওআরাকানের জাতিসত্তার সঙ্গে কেউ কেউ এদের মিলিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেক ঐতিহাসিক তাদেরকে আলাদা জাতিসত্তা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আমরা শেষোক্ত ঐতিহাসিকদের বর্ণনাকে গ্রহণ করে এ সভ্যতার নির্মাণ, সৃষ্টিশীলতা ও বিকাশের কালকে দেখবো।

‘সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা দেখেছি আধুনিকতার নামে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ- ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য সব কিছু আত্মসাৎ করে নতুন করে আবারও তারা মানুষের মনের জগতে সাম্রাজ্যবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে। এটাকে সাম্রাজ্যবাদ শোষণের যুগ না বলে তারা বলছে আধুনিক যুগ।’

এই পটভূমিতে চট্টগ্রাম ও আরাকান সম্পর্ক হিসেব করতে গেলে আরো একটু গভীরে যেতে হবে।ঐতিহাসিকভাবে এ আরাকান প্রথম ছিল বাংলার চন্দ্ররাজবংশের অধীনে করদ রাজ্য এবং উজালি কিংবা বৈশালী ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। আরাকান রাজবংশসমূহে শুরু থেকেই ভারত ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রকট প্রভাব লক্ষ্য করার মতো। তবে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই আরব বণিকরা আরাকানে তাদের বাণিজ্য নোঙর করে। আর ৭৮৮ সাধারণ অব্দ থেকে তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি বসতি স্থাপন শুরু করে। আর এই দিকে খ্রিস্টিয় দশম শতক থেকে মধ্য বার্মার লোকেরা আরাকানে যাতায়াত শুরু করে। রাখাইন ছিল বার্মা পিউনগর রাষ্ট্রের এক অধিবাসী গোষ্ঠী। তারাই প্রথমে মধ্য বার্মা থেকে আরাকান পর্বতমালা অতিক্রম করে আরাকানে আসে এবং লেমব্রো নদীর উপত্যকায় বসতি গড়ে তোলে। এ দিকে পরবর্তীকালে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলা ও আরাকান দখল প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু হয় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। মোদ্দাকথা পারসিক, মোগল, পর্তুগীজ, ডাচ,ইংরেজ,এবং বার্মা বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক খেলার ঘুঁটি হিসেবে বার্মার আরাকান এবং পূর্ব বাংলার চট্টগ্রামকে ব্যবহার করে।

বাংলার সুলতান বারবাক শাহ’র মৃত্যুর পর ১৩৪০ সাধারণ অব্দেতারই অস্ত্রবাহক ফখরুদ্দিন, ফখরুদ্দিন মুহম্মদ শাহ নাম ধারণ করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ত্রিপুরাকে পরাজিত করে নোয়াখালীর পথে অগ্রসর হয়ে আরাকানিদের নিকট থেকে চট্টগ্রাম দখল করে নেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে গৌড় পর্যন্তএকটি রাজপথ নির্মাণেরও পরিকল্পনা করেন। এ দিকে ‘ফখরুদ্দিন মুহম্মদ শাহ’র দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আরাকানরাজ মেংদি ১৩৫৩ সাধারণ অব্দে চকরিয়ার মাতামুহুরির তীর পর্যন্ত পুনরায় চট্টগ্রাম অধিকার করেন। পরে ১৪০৬ সাধারণ অব্দে বার্মার রাজা মেংশো আই আরাকান রাজা নরমিখকে পরাজিত করে এ অঞ্চল দখল করলে নরমিখ বাংলার রাজধানী গৌড়ে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াসশাহী রাজবংশ গৌড় থেকে বাংলা শাসন করতেন। চট্টগ্রাম ফের গৌড়ের অধীনে চলে গেলেও ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম থেকে চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব লাভের জন্য গৌড়ের সুলতান, ত্রিপুরারাজ ও আরাকানরাজের মধ্যে ত্রি-দলীয় সংঘর্ষ শুরু হয়। বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর রাজা নরমিখের পরবর্তী আরাকান রাজ ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করেন।

১৪৪০সাধারণ অব্দেআরাকানের যুবরাজ নরমিখলা গৌড়ীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় সোলাইমান শাহ নাম ধারণ করে ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস আমাদের আরও সাক্ষ্য দেয় যে, সুলতান হোসেন শাহ-এর রাজত্বকালে ১৫১৭সাধারণ অব্দেচট্টগ্রামে পর্তুগীজদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। বাণিজ্য অপেক্ষা জলদস্যুতাই ছিল তাদের প্রধান বৃত্তি ও পেশা। অধিকাংশ আরাকান রাজা তাদের জলদস্যুতা কঠোর হাতে দমন করলেও সুলতান গিয়াসউদ্দিন আফগান সর্দার শেরশাহের আক্রমণে ভীত হয়ে পর্তুগীজদের সাহায্য কামনা করলে, তার রাজত্বের শেষ ভাগে সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে (১৫৩৭সাধারণ অব্দে)চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ ও বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার লাভ করার সুবাদেপর্তুগীজরা চট্টগ্রাম শাসন করতে থাকে। পরে বাংলার সুলতানেরা ফের চট্টগ্রাম দখল করেন। ১৫৩৮ সাধারণ অব্দে আফগান সর্দার শেরশাহ কর্তৃক বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মোহাম্মদ শাহের পরাজয়ের সুযোগে আরাকানরাজ চট্টগ্রাম দখলে নেন। ১৫৩৮ সাধারণ অব্দ থেকে ১৫৭৬ সাধারণ অব্দ পর্যন্ত মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম গৌড়ের অধীনে আসলেও ১৫৭৬ সাধারণ অব্দে আফগান কররানী বংশের শেষ সুলতান দাউদ কররানীকে পরাজিত করে মুঘল সম্রাট আকবরের জাঁদরেল মুঘল সেনাপতি খান জাহানের মধ্য-বাংলায় পদ্মার তীর বিজয়ের পর থেকে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে নবাব শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্টগ্রাম অধিকৃত হওয়া পর্যন্ত (১৬৬৬ সাধারণ অব্দে) চট্টগ্রামের বৃহদাংশ (উত্তর-পশ্চিম এলাকার সামান্য অংশ ছাড়া) আরাকানের অধীনে চলে যায়। এ সময়ে চট্টগ্রাম বেশকিছুদিন আরাকান রাজের অধীনেই থাকে, যদিও ত্রিপুরার রাজা এবং মুঘল সুবেদারেরা মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম অধিকারের চেষ্টা করেন। তবে ১৫৮২ সাধারণ অব্দে সিকান্দর শাহের আমলে গোটা চট্টগ্রামই আরাকানের অধীনে চলে যায়। সেই থেকে প্রায় এক শত বছর থেমে থেমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা (আজকের কুমিল্লা) থেকে শুরু করে মংডু-আকিয়াব পর্যন্ত আরাকানের অন্তর্ভূক্ত ছিল। চকরিয়া থেকে বাঁকখালী নদীর তীরের রামু পর্যন্ত এলাকায় রম্ভ (রামু) নামে একটি আলাদা অঙ্গরাজ্য ছিল। আদম শাহ নামে এক সামন্ত রাজা আরাকান রাজার অধীনে থেকে রামু অঞ্চল শাসন করতেন বলে ত্রিপুরার ইতিহাস ‘রাজমালা’তে পাওয়া যায়। যদিও ১৬৬৬সাধারণ অব্দপর্যন্ত রামু, হলদিয়া পালং, রত্মাপালং, উখিয়ার ঘাট ও চকরিয়ার কিছু অংশ ছাড়া কক্সবাজার অঞ্চলে কোনো জনবসতি গড়ে উঠেনি।

স্বাধীন রাজ্য আরাকানে দু’শ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে ১৬৩৫ সাধারণ অব্দের পর। সেখান থেকেই শুরু আরাকানিদের ভাগ্য বিপর্যয়ের পালা। ১৬৬১ সাধারণ অব্দে আরাকানের রাজা চন্দ্র থান্দুধর্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মুঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করেন এবং শাহ সুজার পক্ষাবলম্বনকারী মুসলিমদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালান। শাহ সুজার এই পরিণতি সারা ভারতের মুসলিম বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দেয় এবং দলে দলে মুসলিমেরা ভারত থেকে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে আরাকানে আসতে থাকে। শাহ সুজাকে আরাকানী মগ রাজা কর্তৃক হত্যার পর ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে সম্রাট ঔরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার নবাব শায়েস্তা খানকে দায়িত্ব দেন। ১৬৬৬সাধারণ অব্দের ২৭ জানুয়ারি বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের সুযোগ্য সেনাপতি-পুত্র বুজর্গ উমেদ খান মুঘল নৌ-বাহিনীর সহায়তায় চট্টগ্রাম দখল করে নেন। কর্ণফুলি নদী পার হয়ে মুঘল সৈন্যরা আরাকানি দুর্গসমূহের দখল নেয়। শাহ সুজার সাথে আসা অনেক মুসলিম সৈন্যও আরাকানিদের কাছে বন্দী ছিল। তারাও এই সুযোগে আরাকানিদের তাড়া করে। তাড়া খেয়ে আরাকানিরা রামু দুর্গে আশ্রয় নেয়। বুজর্গ উমেদ খান তার সেনাপতি মীর মতুর্জাকে রামু অধিকারের জন্য প্রেরণ করেন। ‘আলমগীরনামা’য় বলা হয়েছে- “রামুর পথ অত্যন্ত দুর্গম ও উঁচু-নিচু হওয়ায় ১২ দিনে অতি কষ্টে পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করে মীর মর্তুজা রামু দুর্গ অবরোধ করেন এবং চট্টগ্রামেসার্বভৌমত্বের অধিকারী শেষ আরাকানরাজ চন্দ্র থান্দুধর্মা থোধম্মা (Thudaimma)-এর ভাই রামুর গভর্নর রাউলিকে পরাজিত করে রামু জয় করেন এবং আরাকানি সৈন্যদের তাড়িয়ে হত্যা করে মুসলিম বন্দীদের উদ্ধার করেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর নবাব শায়েস্তা খানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাকে আরাকানি মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারের কবল থেকে মুক্ত করা। আরকানি মগ আর ফিরিঙ্গীদের১০ অত্যাচারবাংলার সামাজিক জীবনকে করে তোলে ভীতসন্ত্রস্ত। বাংলার দক্ষিণ সীমান্তে আরাকান রাজ্য বা মগদের দেশে পর্তুগীজ ও অন্যান্য ফিরিঙ্গী জলদস্যুরা উপনিবেশ স্থাপন করে। এসব জলদস্যুরা গোয়া, সিংহল (শ্রীলংকা), কোচিন, মালাক্কা প্রভৃতি দেশ থেকে পালিয়ে এসে লুটতরাজ চালাতো। জলপথে পর্তুগীজ-ফিরিঙ্গী আর মগদের দস্যুবৃত্তির উৎপাতে সমুদ্র তীর ও অনেক নদীর দু-পাশে বাঙালি অধিবাসীরা অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হয়। সাম রাজা ও দিল্লির সম্রাট এদের সহজে দমন করতে পারেননি। এরা ছোট ছোট নৌকায় হঠাৎ বাণিজ্য-জাহাজ ঘিরে ফেলে লুণ্ঠন কিংবা হাটবাজার, উৎসব, সভা বা বিবাহভোজে উপস্থিত হয়ে অত্যাচার চালাতো।১১ এমন কোনো অপকর্মনেই যে তারা করেনি। নামে খ্রিস্টান হলেও, তাদের মত মানবিক ধর্ম রহিত জঘন্য পিশাচ প্রকৃতির লোক সচরাচর দেখা যেত না। খুন-জখম, লুটতরাজ ইত্যাদির ব্যাপারে তাদের সমকক্ষ কেউ ছিল না। আরাকানের রাজারা তাদের আশ্রয় দিতেন নিজেদের স্বার্থে। মুঘলদের ভয়ে সব সময় তাঁরা সন্ত্রস্ত থাকতেন এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ আশংকা করে এই ফিরিঙ্গী দস্যুদের নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই পর্তুগীজ দস্যুরা মগদের প্রশ্রয় ও উস্কানি পেয়ে রীতিমতো যথেচ্ছাচার করতে শুরু করেছিল বলে ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়ের তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেন। এই ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা বাংলার উপকূলের জলপথে যখন তখন লুঠতরাজ এবং অত্যাচার চালাতো এবং তাদের অত্যাচার-নিপীড়নে দক্ষিণবঙ্গের অনেক জনবহুল গ্রাম লোকালয় শূন্য অরণ্যে পরিণত হয়।১২

দিল্লির সম্রাটের আদেশক্রমে নবাব শায়েস্তা খান ফিরিঙ্গী ও মগ জলদস্যুদের অত্যাচারকঠোর হাতে দমন করেন। চট্টগ্রামে আরাকানিদের আধিপত্য ধ্বংস করে মোগল সৈন্যরা চট্টগ্রাম অধিকার করে সম্রাট ঔরঙ্গজেব আলমগীরের আদেশে চট্টগ্রামের নাম দেন ইসলামাবাদ।১৩ ওই দিন থেকে চট্টগ্রাম স্থায়ীভাবে মুঘল সাম্রাজ্য ভুক্ত বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীকালে ১৭৬০ সাধারণ অব্দেবাংলার নবাব মীর কাশিমের এক রাজকীয় ফরমান বলে বাংলার মেদিনীপুর, বর্ধমান এবং চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম শাসনের দলিল দস্তাবেজে দেখা যায় রামু পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্ব বজায়ে ছিল। কিন্তু তারা জানতো না যে, চট্টগ্রামের সীমা নাফ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৭৯০সাধারণ অব্দেকোম্পানি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়ে নাফ নদীর সীমানা পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্ব বিস্তৃত করে। আরাকান রাজ্যের মতোই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রামুকে এ অঞ্চলের প্রশাসনিক সদর দপ্তর হিসেবে বিবেচনা করে ১৭৯৬ সাধারণ অব্দেরামুকে একটি পুর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক থানার মর্যাদা প্রদান করে। আরাকানি মগদের দস্যুবৃত্তি রোধ করতে এই থানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

চট্টগ্রাম ১৬৬৬ সাধারণ অব্দের পরেমোগল বাহিনীর আয়ত্ত্বাধীন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই চট্টগ্রামেরই অধীন নাফ নদী বার্মা ও বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটে হওয়ায় কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফ-বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমা বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে আসছে। নাফ নদীপথ আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে বার্মা ও বাংলাদেশকে পৃথককারী লাইন হিসেবে কাজ করে এবং দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূমি অধিকারের মধ্যে বৈধ কর্তৃত্ব স্থাপন করে। ১৯৩৭ সালে যখন এই বিশাল কলোনি বা উপনিবেশ ব্রিটিশ শাসনাধীন বার্মা ও ব্রিটিশ ভারতে বিভক্ত হয়, তখন এই সীমা আধা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। এটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক হয় যখন ব্রিটিশরা ভারত বা পাকিস্তান (১৯৪৭) এবং বার্মা (১৯৪৮) ছেড়ে চলে যায়।

আর এ দিকে ১৬৬৬ সাধারণ অব্দেমুঘল কর্তৃক চট্টগ্রাম অধিকারের পর আরাকান রাজ্য সংকুচিত হয়ে একটিছোট্ট অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে তখন দেখা দিয়েছিল বিদ্রোহ, হত্যা, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।১৪ ১৭৩১ থেকে ১৭৮৪ সাধারণ অব্দের মধ্যে আরাকান রাজ্যকে ১৩ জন রাজা শাসন করেন এবং এ রাজাদের গড় শাসনকাল দুই বছরের বেশি ছিল না।১৫

সামন্ত প্রভুদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আভারাজ বোধাফায়ার (১৭৮২-১৮১৯) নির্দেশে ওই দেশের সেনাপতি মহাবালা ১৭৮৪ সনের ৩১ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আরাকানে আক্রমণ চালিয়ে আরাকান দখলে নেন। আরাকান রাজসভার সভাপতি হারি আরাকানরাজ থামাদাকে অপসারণ করতে আলাপায়া রাজবংশের সম্প্রসারণবাদী রাজা বোধাফায়াকে আমন্ত্রণ জানান। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে যদি ইংরেজ কিংবা ফরাসিরা আরাকান অধিকার করে ফেলে তাহলে বার্মার জন্য হুমকি হতে পারে-এই আশংকায় তিনি হারির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আরাকান করায়ত্ত্ব করে আরাকানকে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করেন। এই দখল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাড়ে চার হাজার বছরের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আরাকানের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় রাজতান্ত্রিক শাসন-শোষণ ও সম্প্রদায়গত অমানবিক নির্যাতন। এই সময় অসংখ্য আরাকানি নিহত হয়।“এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেদের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে আরাকান রাজ্যের মগ-মুসলিম জনগোষ্ঠীরা নাফ নদী১৬ অতিক্রম করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রদেশ পূর্ব বাংলায় (আজকের বাংলাদেশ) কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রবেশ করে।”১৭

আরাকানের ক্ষমতা দখলের পর সম্প্রসারণবাদী রাজা বোধাফায়া দিগ্বিজয়ে উৎসাহিত হন। তিনি চীন ও ভারত দখলের মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর যুদ্ধংদেহি মনোভাবের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৭৮৬ সাধারণ অব্দে বার্মার দক্ষিণ পশ্চিম প্রতিবেশী শ্যামরাজ্য (থাইল্যান্ড) দখলের প্রচেষ্টায়। এরই প্রেক্ষিতে তিনি থাইল্যান্ড আক্রমণে চল্লিশ হাজার সৈন্য ও চল্লিশ হাজার মুদ্রা চেয়ে ঈ-থানদির উপর আদেশ জারি করেন। দারিদ্রের নিম্নতম অবস্থানে নিপতিত আরাকানের জনগণের পক্ষে এর শতাংশ ভাগ পূরণ করা সম্ভব ছিল না। ঈ-থানদি অর্ধেক পূরণের আশ্বাস দেন। কিন্তু বোধাফায়া রাগান্বিত হয়ে ঈ-থানদির এক ছেলেকে হত্যা করে পুরো দাবি আদায় না হলে পরিবারের সবাইকে অনুরূপভাবে হত্যা করা হবে– এই মর্মে হুমকি দেন। সম্প্রসারণবাদী বোধাফায়ার হুমকিতে ভীত হয়ে থানদি কয়েক হাজার অনুচর নিয়ে পালিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারভাঙ (হারবাং) এবং মুসিরগিরির গভীর পার্বত্য অঞ্চলে উপস্থিত হন।১৮ শুরু হয় আরাকানিদের মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রাম। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, যার অনুপ্রেরণা ও আমন্ত্রণে বোধাফায়া আরাকান দখল করলেন, তারই নেতৃত্বে এক বছরের মধ্যে শুরু হয় আরাকানের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। আর এই গণযুদ্ধের দেওয়াল লিখন হিসেবে জন্ম নিলো ঐতিহাসিক শহর কক্সবাজার। বস্তুত কক্সবাজার শহর বঙ্গোপসাগরের পাড়ে হারিয়ে যাওয়া এই সভ্যতার স্মৃতি বহন করছে বলে ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ খ্যাত লেখক প্রফেসর এন. এম. হাবিব উল্লাহ মনে করেন।১৯ এন. এম. হাবিব উল্লাহ’র তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় ব্রিটিশ কর্মকর্তা ফ্রান্সিস বুখনিনের স্মৃতিকথা ‘চট্টগ্রাম এবং ত্রিপুরার ভ্রমণ বৃত্তান্তে’। যে ভ্রমণ কাহিনি পরে ‘দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুখানন (১৭৯৮), কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘তার ভ্রমণ’ নামে সম্পাদনা করেন নেদারল্যান্ডের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ভেলাম ভান সেন্দেল। ফ্রান্সিস বুখানন২০ আমাদের জানান দিয়েছেন যে- জেলা পালংবারো পালংয়ের একটি, যা ১৭৯৪ সাধারণ অব্দে বার্মিজদের আগ্রাসনে বিবর্ণ হয়ে পড়ে, এবং তখন থেকেই এই এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে পড়তে থাকে।২১

যুদ্ধে ঈ-থান দি পরাজিত হলে ফের শুরু হয় জাতিগত শোষণ এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। জাতিগত বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় উন্মাদনায় পরিচালিত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিহিংসার রূপ যে কি ভয়াবহ হতে পারে তা তার শিকার মানবগোষ্ঠী মাত্রই জানে। আরাকান থেকে প্রত্যাগত আরাকানি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে নিয়োগ করে। এ সময় হিরাম কক্স পেগুর রাজধানী আভায় ব্রিটিশদেরআবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৭৯৮ সাধারণ অব্দের ১২ই জুন হিরাম কক্স আভা (বর্তমানে মান্দালয়) থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় বাংলার গভর্নরের সাথে যোগাযোগ করে তিনি আরাকানি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব পেয়ে ১৭৯৯ সাধারণ অব্দের জানুয়ারি মাসে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেন। অবশ্য এর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিরা রামুতে অফিসস্থাপন করেছিলেন। হিরাম কক্সও রামুতেই তার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। তিনি মগ (রাখাইন), মুসলিম, হিন্দু এবং বড়ুয়া সম্প্রদায়সহ আরাকানি উদ্বাস্তুদের এক বিরাট অংশকে ২১ ডিগ্রি ২৭মিনিট এবং ৯৭ ডিগ্রি ৫৯ মিনিট দ্রাঘিমাংশের মধ্যবর্তী এলাকায় বাঁকখালী নদীর তীরে (মহেশখালী, রামু, বারো পালং২২) জমি বন্দোবস্তদেন। এ ছাড়াও রাউজান, পটিয়ার রামদিয়া, চকরিয়ার হারবাং প্রভৃতি অঞ্চলে উদ্বাস্তুদের অনুরূপ বসতি দেওয়া হয়।২৩

আরাকানি শরণার্থীদের পুনর্বাসন করার পর ইংরেজ অফিসার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স ১৭৯৯সাধারণ অব্দেবাঁকখালী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনাস্থ সমতলভূমিতে একটি বাজার স্থাপন করেন। বাজারটি কক্স সাহেবের বাজার নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সমুদ্র উপকূলীয় পাহাড়ি এলাকা হিসেবে এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল। হিরাম কক্স এ অঞ্চলে দায়িত্ব নিয়ে আসার পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ছয় মাস যেতে না যেতেইহিরাম কক্সমারা যান। হিরাম কক্স মারা যাওয়ার পর ঢাকার রেজিস্ট্রার মি. কার হিরাম কক্সের স্থলাভিষিক্ত হন। ক্যাপ্টেন কক্সের মৃত্যুর পর শরণার্থীদের তদারকি করার জন্য পাঠানো ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি ঢাকার রেজিস্ট্রার মি. কারও বাজারের নাম কক্স সাহেবের বাজার হিসেবে রেখে দেন। পরবর্তীকালে বাজারটি কক্স সাহেবের বাজার থেকে কক্সবাজার’-এ রূপ লাভ করে ও মি. কার-এর তদারকিতে রামু হতে উখিয়ার ঘাট পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়।২৪

১৭৯৭ সাধারণ অব্দ থেকে বর্মীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকার দাবি করেন এবং এ দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় চট্টগ্রাম সীমান্তে বর্মী বাহিনী নাশকতা চালায় এবং ১৮২৩ সাধারণ অব্দে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের অধিকার নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ সময় উভয় পক্ষের পরস্পর বিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। সে যুদ্ধ চলাকালে আরাকানিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের এলাকা দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনী আরাকান আক্রমণ করেছিল। এরপর থেকে উখিয়া, টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত নিয়ে অনেক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।২৫ প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৮২৪ এ, এর পরে, ১৮৫২ সাধারণ অব্দে দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং ১৮৫৫ সাধারণ অব্দে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধও হয়েছে বাংলার সীমান্ত ও আধিপত্য নিয়ে। ১৮২৪ সাধারণ অব্দে সংঘটিত প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধও রামু থানার (বর্তমানে উখিয়া থানার) রত্মাপালং সীমান্ত দিয়েই শুরু হয়, যা ইতিহাসে ‘রামু ব্যাটেল’ নামে পরিচিত।২৬

কক্সবাজার এলাকার একাধিক নাম ছিল বলে জানা যায়। এসব নামের মধ্যে ছিল পালংকি বা ফলিংকি বা ফলংজি, পাওয়া বা পোঁওয়, পালোয়ানছি ও বাঙ্গোলী, অংশেং থা স্রো। তবে পোওয়া নামটি বেশ প্রাচীন বলে অনেকেই মনে করেন। ১৭৮৪ সালের পর আরাকান থেকে পালিয়ে আসা রাখাইনদের দেওয়া নামই হচ্ছে প্যাঁওয়া। সে সুবাদে কক্সবাজারকে পেঁওয়া বলা হতো বলে গবেষকদের ধারণা। প্যাঁওয়াকে স্থানীয় লোকজন বিকৃত করে প্যানোয়া’ বা ‘পানোয়া’ বা ‘পেনওয়া’ বলে থাকেন। কক্সবাজার অন্যতম উপজেলা রামুর প্রাচীন নাম ‘পেঁওয়া প্রে’। বার্মিজ শব্দ ‘পেঁওয়াপ্রের’ বাংলা অর্থ ‘হলুদ ফুলের দেশ বা রাজ্য। বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন কাঁচা বাজারে এক প্রকার শাক বিক্রি হয়, যাকে স্থানীয়ভাবে কলাপাতা শাক বলা হয়। এই কলাপাতা শাক দেখতে হলুদ ফুলের মতো। কক্সবাজার, রামু সহ জেলার পাহাড়ি এলাকায় এরকম অজস্র কলাপাতা শাক জন্মায় এবং এসব গাছে হলুদ ফুলের মত সাদা বা অন্যান্য বিভিন্ন রঙের ফুল দেখা যায়। বার্মিজ ভাষাভাষী রাখাইনরা এসব ফুল দেখে পুরো এলাকাকে ‘পেঁওয়া প্রে’ নামে আখ্যায়িত করে। প্রাচীন কালে বার্মিজ ভাষাভাষী রাখাইনদের বসবাস রামুতে বেশি ছিল বলে শুধু রামুকেই ‘পেঁওয়া প্রে’ বলে মনে করা হয়।

কক্সবাজারের বার্মিজ নাম হচ্ছে ‘ফালংকি বা ফলংজি’।বার্মিজ শব্দ ‘ফলং’ অর্থ অফিসার বা সাহেব। এভাবে “ফলং জি’ শব্দের অর্থ দাঁড়াল সাহেব বাজার। স্থানীয় মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ‘কক্স’ সাহেব প্রতিষ্ঠিত বাজারকে ‘কক্সবাজার’ নামে আখ্যায়িত করলেও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন এই বাজারকে তাদের ভাষায় ‘ফলং জি’ নামে আখ্যায়িত করে এবং ফলংজি নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। এই ‘ফলংজি’ শব্দের পূর্বে যদি ‘কক্স’ শব্দটি যুক্ত করে কক্স ফলংজি’ বলা হতো তাহলে নাম সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হতো। কক্স ফলংজি’ অর্থ কক্স সাহেবের বাজার। পরবর্তীতে এই ফলংজি শব্দটি “ফলংজি’ হয়ে কালের বিবর্তনে পালংকিতে এসে দাঁড়িয়েছে’।২৭

দোহাই

১.বঙ্গোপসাগর এবং নাফ নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম মোহনা-বেষ্টিত আরাকান-ইয়োমা নামের দীর্ঘ পর্বতশৃঙ্গ আরাকান তথা আজকের রাখাইন স্টেটকে মিয়ানমারের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করেছে।

২. মনির ইউসুফ, বঙ্গোপসাগরীয় সভ্যতা : বৈদিক যুগ থেকে মৌর্য যুগ, ২১ আগস্ট ২০২০, রাইজিং কক্স।

৩. অধ্যাপক শাহেদ আলী, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান, দ্বিতীয় প্রকাশ-জানুয়ারি ১৯৯৭, ঢাকা: বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. পৃ. ২৬।

৪. ১৫৭৬ সাধারণ অব্দের জুলাই মাসে সম্রাট আকবরের সেনাপতি খান জাহান মধ্যবাংলায় পদ্মার তীরে দাউদের বাহিনীর মোকাবেলা করেন। আফগানরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। তাদের সেরা সেনানায়কেরা যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন এবং দাউদের ঘোড়া বর্ষণসিক্ত কাদামাটিতে আটকে গেলে তিনি জীবিত অবস্থায় ধরা পড়েন। এবার মোগলরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নির্মম হয়। দাউদকে তার মাথার বোঝা থেকে অব্যাহতি দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ খান জাহান সাবেক রাজার শিরচ্ছেদ করেন এবং তার দেহ টাঙ্গায় ঝুলিয়ে রাখেন; মাথাটি পুরস্কারহিসেবে সম্রাট আকবরের কাছে পাঠানো হয়। দাউদ কররানীর মৃত্যুদণ্ডের ফলে বাংলায় স্বাধীন মুসলিম শাসনের অবসান ও মুঘল শাসনের সূচনা হয়। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- রিচার্ড এম. ইটন, ‘ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ (১২০৪-১৭৬০)’, হাসান শরীফ অনুদিত, জুন ২০০৮, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ. ১৮১-১৮২)

৫. ড, আবদুল করিম, চট্টগ্রামে ইসলাম, ১৯৮১, চট্টগ্রাম: ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, পৃ. ৬৩।

৬.রামুকে আরাকানিরা ‘প্যানোয়া’ বলে জানতো। আর এ ‘প্যানোয়া’-ই কক্সবাজারের আদি নাম। ক্যাপ্টেন কক্সও রামুতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস করেন।

৭. রামুর শাসনকর্তা আদম শাহ আরাকান রাজের সাথে বিরোধের কারণে রামু থেকে ত্রিপুরা রাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৫৭১ সাধারণ অব্দে আরাকান রাজ যুদ্ধে জয় লাভ করে ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের কাছে প্রস্তাব পাঠান যে, আদম শাহকে ফেরত পাঠালে ত্রিপুরারাজের সঙ্গে সম্প্রীতি স্থাপিত হবে। মহারাজ অমর মাণিক্য এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। অমর মাণিক্য স্বয়ং যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। আরাকান বাহিনী ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর পর্যন্ত দখল করে নেয়। রামুর শাসনকর্তা আদম শাহের ভাগ্যে কি ঘটেছিল রাজমালা কিংবা অন্য কোথাও উল্লেখ নেই। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আবুল কাশেম, রামুর ইতিহাস, ১৯৯৪, কক্সবাজার: কক্সবাজার ফাউন্ডেশন, পৃ: ৩৪-৩৮)।

৮. সুলতান আহমদ ভূঁইয়া, বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা, আগস্ট ১৯৭১, ঢাকা: পাকিস্তান একাডেমি, পূ, ২৪২।

৯. মগ শব্দটি নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে, বিশেষত বাঙালি ও রাখাইন (মগ) সমাজে। আরাকানের মগেরা পর্তুগীজ জলদস্যুদের সঙ্গে একত্রে বেড়াত এবং ডাকাতি করতো। মগেরা আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও আরাকানের সমস্ত অধিবাসী জলদস্যু ছিল না এবং তারা মগও নয়। তবে স্বাধীন আরাকানের রাজা মিনবিন (জেবুক শাহ) দিল্লির শাসকদের হুমকি এড়াতে আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরে গেঁথে থাকা পর্তুগীজ জলদস্যুদের চট্টগ্রাম বাণিজ্যের সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে স্বদেশীবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগদের নিয়ে আরাকান রাজার নৌ-বাহিনী গড়ে তোলেন। মিনবিনের মুসলিম সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে মগদের নিয়ে আরাকান নৌ-বাহিনী গঠন করার পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে আরাকানের স্থল বাহিনী ছিল একচ্ছত্রভাবে মুসলিম প্রধান। তদুপরি পর্তুগীজ জলদস্যুদের আরাকানের মুসলমানেরা ঘৃণার চোখে দেখতো। তাই মগ প্রজাদের নিয়ে গঠিত হয় আরাকান নৌ-বাহিনী। কিন্তু মগ প্রজাদের নিয়ে গঠিত আরাকানের নৌ-বাহিনী নৌ-যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেনি, বরঞ্চ পর্তুগীজ প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ঐতিহ্য হিসেবে পায় জলদস্যুবৃত্তি। এদের দস্যুতা ছিল বর্বরতম ও বীভৎস। মেঘনা নদীর মোহনা থেকে শুরু করে মগ দস্যুরা উজানের দিকে চলে যেত। গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে, গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে বহু গ্রামবাসীকে বন্দী করে ফেলত এবং বন্দীদের একটি অংশকে আরাকানে পাঠিয়ে দিত।আরাকান রাজ এ সকল বন্দীদের কৃষি কাজে নিয়োগ করতেন। ১৫৩০ থেকে ১৬৬৬ সাধারণ অব্দে নবাব শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্টগ্রাম অধিকৃত হওয়া পর্যন্ত পর্তুগীজ জলদস্যুদের এই নৃশংসতম অত্যাচার বলবৎ থাকে। চট্টগ্রাম থেকে মগ জলদস্যুরা শায়েস্তা খানের হাতে পরাজিত হওয়ার পর আরাকানের সামুদ্রিক উপকূলে জড়ো হয় এবং তখন দস্যুবৃত্তি অলাভজনক হয়ে পড়ায় মগ দস্যুরা ঘৃণার বশে বৌদ্ধদেরকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে থাকে। অনেককালের দস্যুবৃত্তিতে অভ্যস্ত মগ দস্যুদের পাশবিকতায় আরাকানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। ১৬৭০ সাধারণ অব্দে আরাকানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায় মগ জলদস্যুরা। মুসলিমেরা দাঙ্গায় লিপ্ত মগ দস্যুদের হত্যা করে। এতে মগদস্যুদের জ্বালায় অতিষ্ঠ সাধারণ মগ বৌদ্ধও মুসলমানদের সহায়তা হয়। পরে মুসলিমদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেলে সেই আধিপত্যকে কেন্দ্র করে আরাকানের মুসলিমদের অস্থিরতা ও অরাজকতার সুযোগ নেয় মগ জলদস্যুরা। এই দস্যুরা স্বদেশী বৌদ্ধদের কাছেও ছিল ঘৃণার পাত্র। তাই রাখাইনেরা মগ শব্দটি কোনোভাবেই গ্রহণ করতে রাজী নয়।

১০.‘ফিরিঙ্গি’ শব্দটি ফারসি ফরঙ্গীথেকে জাত। মুসলমান আমলে যে কোনো ইউরোপবাসী শ্বেতাঙ্গকে ফিরিঙ্গী বলা হতো। ইংরেজ যুগের প্রথম দিকে সাহেবেরা সাধারণত হিন্দুদেরকে জেন্টু এবং মুসলমানদের মুর বলতেন। ‘জেন্টু’ শব্দটি পর্তুগীজ এবহঃরড় থেকে এসেছে এবং তার থেকেই ইঙ্গ-ভারতীয় শ্ল্যাঙ-জেন্টু শব্দের উৎপত্তি। আর মুসলমানদের জন্য উচ্চারিত মুর শব্দটি গড়ৎড়ং থেকে moors. অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংরেজদের লেখা গ্রন্থে Gentioও moors শব্দের ছড়াছড়ি দেখা যায়। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় হিন্দু ও মুসলমান।

১১. প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, বাঙালী, মার্চ ১৯৬৯, কলিকাতা: রূপা অ্যাণ্ড কোম্পানী, পৃ, ৮২।

১২. বিনয় ঘোষ, ‘বাদশাহী আমল’ (ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়ের ভ্রমণ বৃত্তান্তের বাংলা অনুবাদ), বৈশাখ ১৩৮৫, কলকাতা : অরঙ্গা প্রকাশনী, ৬৮-৬৯। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্র Map of the Sundarbund and Baliagot Passages-এর মধ্যে দেখা যায়, বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বার্ণিয়েরের এই বিবরণের সঙ্গে রেনেলের মানচিত্রের এই উল্লেখ আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য গঙ্গার ধারা পরিবর্তনের জন্যও প্রাচীন ভাগীরথীর তীরবর্তী অনেক জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়।

১৩. আবদুল করিম, চট্টগ্রামে ইসলাম, ১৯৮১, চট্টগ্রাম: ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, পৃ. ৬৩।

১৪. এখানে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা এই শব্দ দু’টির মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। মাক্স ওয়েবার ক্ষমতাকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে- এমন এক সম্ভাব্যতা যেখানে কোনো নায়ক একটি সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে এমন এক অবস্থানে থাকেন, যাতে এই সম্ভাব্যতার ভিত্তি নির্বিশেষে প্রতিরোধ সত্ত্বেও তিনি তার নিজের ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রতীকের প্রকাশ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওয়েবার যাকে ‘এই সম্ভাব্য অবস্থানের’ ভিত্তি হিসেবে বুঝেছেন অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বলেছেন, তার উপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

১৫. সাদাত উল্লাহ খান, ‘আরাকান’, ‘বাংলাপিডিয়া-১ম খণ্ড’, দ্বিতীয় সংস্করণ-জুন ২০১১, ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, পৃ.২৫৮।

১৬. নাফ বাংলাদেশের তথা কক্সবাজারের সবচেয়ে দক্ষিণ-পূর্বের সীমান্ত নদী। বাংলাদেশ ও বার্মাকে পৃথক করা এই নদীর তীরে বাংলাদেশের অংশে গড়ে উঠেছে সীমান্ত উপজেলা, নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ এবং টেকনাফ স্থলবন্দর। অন্যদিকে বার্মার অংশে গড়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর মংডু ও মংডু টাউনশীপ। আন্তর্জাতিক নদী নাফ, আরাকান ইউমা রেঞ্জ থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রচ খালে প্রবেশ করেছে। তুমব্রচ এলাকায় নদীর এক পাশে বাংলাদেশের তুমব্রচ উত্তর ও আরেক পাশে আরাকান প্রদেশের মংডু টাউনশীপের তুমব্রচ দক্ষিণ। বর্তমান মিয়ানমার তুমব্রচ দক্ষিণকে টাউনশীপে উন্নীত করে বার্মার সীমান্তরক্ষীদের হেডকোয়ার্টার করে। নাফ নদী একটু গড়িয়ে পশ্চিমে এগিয়ে বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তের টেকিবনিয়া গ্রামে, টেকিবনিয়া নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার গড়িয়ে বাংলাদেশ ও বার্মাকে দু-পাশে রেখে এঁকেবেঁকে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপের বদর মোকাম মোহনায় বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।

১৭. ড. রতন লাল চক্রবর্তী, ‘বাংলাদেশ-বার্মা সম্পর্ক’, জুলাই ১৯৮৪, ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ: ১১।

১৮. ড.রতন লাল চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ:- ১০৭।

১৯. এন. এম. হাবিব উল্লাহ, ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’, এপ্রিল ১৯৯৫, ঢাকা : বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি, পৃ: ২৮।

২০. ফ্রান্সিস বুখানন দক্ষিণ ভারত, বিহার, নেপাল ও বার্মায় ব্যাপক ভ্রমণের তাৎপর্যপূর্ণ বিবরণ ভারতবর্ষের জন্য রেখে গেছেন। ১৭৯৫ থেকে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এসব ভ্রমণ করেন এবং এসব ভ্রমণের প্রতিবেদন আজ ইতিহাসের ক্লাসিক হিসেবে পরিগণিত। তাছাড়া তিনি যেখানে ভ্রমণ করেছেন সেখানে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই তার ভ্রমণকে ব্রিটিশ সম্প্রসারণের রেকর্ড বলা হয়।

২১. ভেলাম ভান সেন্দেল সম্পাদিত ‘দক্ষিণপূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুখানন (১৭৯৮), কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে তার ভ্রমণ’ (সালাহউদ্দীন আয়ুব অনুদিত), আগস্ট ১৯৯৪, ঢাকা: ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ: ৮১।

২২. এক সময় এই পালং এলাকাকে ৩৬০ পালংয়ের দেশ বলা হতো। এ অধ্যায়ে উল্লিখিত বারো পালং এর মধ্যে রয়েছে- রত্মাপলং, ধেছুয়া পালং, ওয়ালাপালং, রঙ্খা পালং, রাজা পালং (যেটাকে ফ্রান্সিস বুখানন জেলা পালং বলে উল্লেখ করেছেন)হলদিয়া পালং, উমপ্রি পালং, হিজলিয়া পালং, পাগলির পালং, দারিয়ারদিঘি পালং, ধোয়া পালং, মরিচ্যা পালং এর নাম পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে অনেক নামের শেষে ‘পালং’ শব্দটি লুপ্ত হয়ে গেছে।

২৩. ড.রতন লাল চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৭।

২৪.১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি লেফটেনেন্ট টমাস ব্ৰকহাম রামু হতে উখিয়ার ঘাট ও নাফ নদীর তীর হতে ত্রিশ মাইল দূরত্ব রেখে একটি রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করেন গভর্নরের কাছে। (Magistrate to the Governor General, P C, February10, 1774). ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সও এই সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব করেন।এ রাস্তা বারো পালং-এর মধ্যে দিয়ে রামু নদী পর্যন্ত প্রসারিত থাকবে এবং সেখান থেকে এই রাস্তাদক্ষিণাঞ্চলকে দুটি নির্দিষ্ট অংশে ভাগ করবে। ক্যাপ্টেন কক্স এই রাস্তার দু’পাশে উদ্বাস্তুদের বসতি দেওয়ার সুপারিশ করেন। এই ব্যবস্থার ফলে কেন্দ্রের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে, যা সামরিক ও বেসামরিক উভয় দিক হতেই গুরুত্বপূর্ণ। কক্স আরাকানি উদ্বাস্তুদের উপনিবেশের নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য রাস্তাটি নির্মাণের উপর সবিশেষে গুরুত্বারোপ করেন। (Proceedings of the Vice President, 1 March 1779)। এই রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাবটি বোর্ড অব রেভিনিউ সমর্থন করে। (Collector of Chittagong to the Board of Revenue, 21 August 1799)। পুনর্বাসন কাজে ক্যাপ্টেন কক্সের প্রথম কাজ ছিল রাস্তানির্মাণ কাজে উদ্বাস্তুদের নিয়োগ এবং চাষাবাদে উৎসাহী আরাকানী রায়তদের পতিত জঙ্গলাকীর্ণ ভূমি সংস্কারের কাজে লাগানো। রামু হতে উখিয়ার ঘাট পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে উদ্বাস্তুদের ব্যবহারের জন্য বোর্ড অব রেভিনিউ ঢাকার কালেক্টরকে ৩৫০০ খানা কোদাল প্রেরণ করার নির্দেশ দেন। তাছাড়া ক্যাপ্টেন কক্স বাঁকখালী বা রামু নদীর তীরে মাহেরকুলে (বর্তমানে যেখানে রামু সেনানিবাস অবস্থিত) তিনি সেনা বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করারও সুপারিশ করেন। অবশ্য এর আগে ফ্রান্সিস বুখাননও ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানী উদ্বাস্তুদের নিজস্ব কর্মচারী দ্বারা অর্থাৎ আরাকানীদের দ্বারা পরিচালিত করা প্রয়োজনএবং সম্ভব হলে উদ্বাস্তুদের একটি ভিন্ন জেলা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে বারোপালং ও নাফ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই জেলা গঠনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

২৫. ড. আরশাদ উল্লাহ, ‘বার্মার নেতৃত্বে ছিল আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিমরা’, অমিত চৌধুরী সম্পাদিত মূল্যায়ন (মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গা সংখ্যা), ডিসেম্বর ২০১৭, পৃ: ৫১।

২৬. কালাম আজাদ, মুক্তিযুদ্ধে আরাকানে বাঙালি শরণার্থী, ফেব্রুয়ারি ২০২১, চট্টগ্রাম : তৃতীয় চোখ, পৃ: ২৩।

২৭. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : কক্সবাজার, জুন ২০১৪, ঢাকা : বাংলা একাডেমি, পৃ: ২৪।

ঢাকা কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর। এল. এল. বি. অধ্যয়ন করেন। গবেষণা করছেন ‘বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১-২০০০)’ শীর্ষক বিষয়ে।সাংবাদিকতা, লেখালেখি নেশা ও পেশা। বামধারার যুব সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী। ২০০৫ সাল থেকে কবিতা, ছোটগল্পের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ এবং ইতিহাস বিষয়ক লেখালেখি করে আসছেন। ইতিমধ্যে তার প্রকাশিত গবেষণাধর্মী বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ভাষা আন্দোলনে কক্সবাজার (২০১৫), রাজাকারনামা (২০১৬), বাংলাদেশের যুব আন্দোলন (২০১৭), কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু (২০২০), কক্সবাজারের সংগীত ও নাট্যচর্চার ইতিবৃত্ত (২০২১), মুক্তিযুদ্ধে আরাকানে বাঙালি শরণার্থী (২০২১), শহীদ সাবের: জীবন ও সাহিত্যকর্ম (২০২১)।

মন্তব্য তালিকা - “কক্সবাজারের ইতিহাসের অনুসন্ধানে (প্রথম পর্ব)”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।