সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

হুগলী জেলা ও আধুনিক বাংলা ছাপা অক্ষরের বিকাশ

হুগলী জেলা ও আধুনিক বাংলা ছাপা অক্ষরের বিকাশ

অতীন চক্রবর্ত্তী

মে ১, ২০২১ ৮৬২ 0

“মোদের গরব, মোদের আশা,

আ মরি বাংলা ভাষা।

তোমার কোলে, তোমার বোলে,

কতই শান্তি ভালবাসা।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে ১৯১৩ সালে বাঙালি এবং বাংলা ভাষার প্রতি গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই গানটি রচনা করেছিলেন অতুল প্রসাদ সেন। তিনি হয়তো কখনো কল্পনাও করেননি তার রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি দেশ প্রথমে ভাষা আন্দোলন ও তারপর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যাবে। ভাষাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হওয়া ও পরে স্বাধীনতা পাওয়ার দৃষ্টান্ত মানব সভ্যতার ইতিহাসে কমই আছে। বাঙালিরা এর অন্যতম পথিকৃৎ। হবে নাই বা কেন? মাতৃভাষার চেয়ে সুমধুর আর কি হতে পারে? তবে যাইহোক, বাংলা ভাষার আজকের যে রূপ আমরা দেখতে পাই তার বহুলাংশই আধুনিক কালে সৃষ্টি। বিদেশি সাহেব ও দেশীয় পণ্ডিতের কখনো সচেতন, কখনো অতিসচেতন, আবার কখনো অসচেতন কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই আজকের বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।

অনেকে মনে করেন বাংলার লেখার শুরু কলকাতায়। আসলে কিন্তু এর জন্ম ও শৈশব কেটেছে হুগলীতে। হুগলী জেলার একাধিক ব্যক্তি বিদেশি সাহেবদের সঙ্গে মিলে সরল আধুনিক বাংলা ভাষার নির্মাণ ও বিকাশ করেছেন। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড সাহেব রচিত, ‘A Gramer of the Bengal Language’ বইটি হুগলীর ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়। এটাই ছিল প্রথম মুদ্রিত পুস্তক যেখানে বাংলা হরফ ব্যাবহার করা হয়। সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন, “১৭৭৮ সালে হুগলীতে বাংলা হরফের জন্ম হয় এবং সেই সময় হইতেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের উন্নতির শুরু।”

এরপর ১৭৯৭ সালে জন মিলার নামক এক ইংরেজ ভদ্রলোক, ‘The Tutor, Or, A New English & Bengalee Work, Well Adapted to Teach the Natives English. In Three Parts বা ‘সিক্ষ্যা গুরূ’ নামক একটি বই রচনা করেন, যেখানে বাংলা হরফ ব্যাবহার করা হয়।

বাংলা মুদ্রাক্ষর আবিষ্কার হলেও সেগুলিকে ইংরেজ সাহেবরা মূলত ব্যাকরণ ও শব্দকোষ হিসাবে ব্যাবহার করতেন। এদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ছিল তার ব্যবহার। ফলে এই সময় বাংলা অক্ষর ও ব্যাকরণে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এরপর ঊনবিংশ শতকে কলকাতা থেকে শ্রীরামপুরে পালিয়ে এলেন একদল খ্রিস্টান মিশনারি। সঙ্গবদ্ধ হয়ে তারা শ্রীরামপুর মিশন প্রেস গঠন করেন। ছোট্ট একটি ভাড়াবাড়িতে কাজ শুরু, সেখান থেকে এশিয়ার বৃহত্তম ছাপাখানা তৈরি হয়। বাংলা ভাষা, হরফ, লিপি, সাহিত্যের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে শ্রীরামপুর। এর জন্য প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিলেন একজন ইংরেজ সাহেব, উইলিয়াম কেরী। ১৮০০ সালের মার্চে মতীয়ের রচিত ‘মঙ্গল সমাচার’-এর প্রথম পাতাটি মুদ্রিত হয় যা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রূপে আগস্ট মাসে প্রকাশ পায়। তারপর ১৮০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘ধর্মপুস্তক’ নামে নিউ টেস্টামেন্ট-এর বাংলা অনুবাদ মুদ্রিত হয়। সুধীর কুমার মিত্রের মতে, বাংলা সাহিত্যে এটাই ছিল প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা ভাষার গদ্য।

১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে উইলিয়াম কেরীকে সেখানকার বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেই কেরী সাহেব একদল পণ্ডিতকে সংগঠিত করলেন, যারা একের পর এক রচনা করেন সরল বাংলা ভাষার গদ্যপুস্তিকা। ১৮০১ সালে কেরী সাহেবের মুন্সি চুঁচুড়ার বাসিন্দা রামরাম বসু রচনা করলেন ‘রাজা প্রতাপাদিত্যচরিত্র’, এটি ছিল একক ভাবে রচিত প্রথম পূর্নাঙ্গ আধুনিক বাংলা অক্ষরে পুস্তক। এরপর ১৮০২ সালে তিনি লিপিমালা ও ১৮১২ সালে ‘খৃষ্টবিবরণামৃতম্’ রচনা করেন।

উইলিয়াম কেরী ১৮০১ সালে ‘বেঙ্গলি গ্রামার’ (প্রথম সংস্করণ) রচনা করেন। খ্রিস্টিয় শিক্ষা বাদ দিলে এটাই ছিল তাঁর লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণের পুস্তক। তাছাড়া কথোপকথন (১৮০১), বেঙ্গলি গ্রামার; দ্বিতীয় সংস্করণ (১৮০৫), ইতিহাসমালা (১৮১২) প্রভৃতি রচনা করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ১৮০২ সালে ‘বত্রিশ সিংহাসন’ রচনা করেন। এছাড়া দায়রত্নাবলী (১৮০৫), হিতোপদেশ (১৮০৮), রাজাবলী (১৮০৮), বেদান্ত চন্দ্রিকা (১৮১৭) প্রভৃতি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত ‘রাজাবলী’ বাংলা ভাষায় প্রথম ইতিহাসের পুস্তকের সম্মান লাভ করে।

এছাড়া গোলোকনাথ শর্মা – হিতোপদেশ (১৮০২), তারিণীচরণ মিশ্র – ঈশপ ফেবলসের অনুবাদ (১৮০৩), রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় – মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৮), চণ্ডীচরণ মুন্সী – তোতা ইতিহাস (১৮০৫), রামকিশোর তর্কচূড়ামণি – হিতোপদেশ (১৮০৮), হরপ্রসাদ রায় – পুরুষপরীক্ষা (১৮১৫), কাশীনাথ তর্ক পঞ্চানন – পদার্থতত্ত্ব কৌমুদী (১৮২১), আত্মতত্ত্বকৌমুদী (১৮২২) প্রভৃতি রচনা আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে জন্ম দান করে। উক্ত রচনাগুলির মধ্যে অধিকাংশই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়েছে।

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ‘দিগ্দর্শন’ নামে বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত বাংলা ভাষায় প্রথম মাসিক পত্রিকা শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস থেকে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এর ঠিক পরে ঐ বছরেই ২৩ মে মার্শম্যানেরই সম্পাদনায় মিশন থেকে প্রকাশ লাভ করে বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র (সাপ্তাহিক) ‘সমাচার দর্পণ’। তবে মার্শম্যান সাহেব নামেমাত্র সম্পাদক ছিলেন, বাঙালি পণ্ডিতরাই আসলে সমাচারদর্পণ সম্পাদনা করতেন।

বাঙ্গালা গদ্য সাহিত্যের উদ্বোধনের সময় হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে আর একজন মনীষীর আবির্ভাব হয়েছিল; তিনি রাজা রামমোহন রায়। বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশে এবং প্রকৃত গদ্য সাহিত্যের প্রবর্তক হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে রামমোহন রায়ের যাবতীয় বাংলা পুস্তক রচিত হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ ও ভাষ্য রচনা করেছিলেন। রামমোহন রায়ের লিখিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্তসার (১৮১৫), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৭), সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ (১৮১৯), কবিতাকারের সহিত বিচার (১৮১৯), পথ্যপ্রদান (১৮২৩)। এছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩)। তিনি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সম্বাদ কৌমুদী’ সম্পাদন করেন। পরবর্তীকালে তিনি একাধিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।

প্রায় দুইশত বছর আগে একজন ইংরেজ সাহেব, তাঁর মুন্সি এবং একাধিক পণ্ডিত মানুষ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ছাপানো রূপের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। পুরাতন বাংলা সাহিত্য যেমন, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, বাংলার রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি উদ্ধার করে সেখান থেকে আধুনিক বাংলা হরফ, লিপি, ভাষা, বাক্য গঠনের মতন ভীষণ কঠিন কাজগুলি উইলিয়াম কেরী ও তাঁর সঙ্গীরা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরবর্তী বাংলা ব্যাকরণগুলি রচনা করতে অনেকাংশে সুবিধা হয়েছিল।

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে আধুনিক বাংলা ভাষার এই বিবর্তন প্রসঙ্গে সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন, “রামরাম বসু, উইলিয়ম কেরী, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়ের মধ্য দিয়া যে সর্বাঙ্গীনতা বঙ্গভাষা অনুভব করিতেছিল তাহা বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারের মধ্য দিয়া চরিতার্থ হয়।”

গ্রন্থপঞ্জি:

১) সুধীর কুমার মিত্র, ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’, প্রথম খণ্ড, মিত্রানী প্রকাশন, ১৯৬০

২) সুধীর কুমার মিত্র, ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’, দ্বিতীয় খণ্ড, মিত্রানী প্রকাশন, ১৯৬২

৩) সুধীর কুমার মিত্র, ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’, শিশির পাব্লিশিং হাউস, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ

৪) বসন্ত কুমার বসু, ‘শ্রীরামপুর মহকুমার ইতিহাস’, ১৯০২

৫) ‘শ্রীরামপুর পরিচিতি’, শ্রীরামপুর পৌরসভা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ

৬) শ্রীকৃষ্ণগোপাল পাকড়াশী, ‘তিন শতকের রিষরা ও তৎকালীন সমাজ চিত্র’, স্মৃতি প্রেস, ১৩৮২ বঙ্গাব্দ

৭) শ্রীমুনীবেন্দ্র রায়, ‘হুগলী কাহিনী’, ১৩১০ বঙ্গাব্দ

৮) অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, ৪র্থ খণ্ড, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৭৩

৯) অমলেশ ত্রিপাঠি, ‘ইতালীর রেনেসাঁস বাঙালির সংস্কৃতি’, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৪

১০) সমর কুমার মল্লিক, ‘আধুনিক ভারতের দেড়শো বছর (১৭০৭-১৮৫৭)’, ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৯৮৯

১১) বিজিত ঘোষ, ‘উইলিয়াম কেরী’, গ্রন্থতীর্থ, ২০১৯

১২) প্রমথনাথ বিশী, ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ

১৩) শিবনাথ শাস্ত্রী, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা. লি, ১৯০৪

১৪) সুকুমার সেন, ‘বাংলা সাহিত্যে গদ্য’, রঞ্জন প্রকাশালয়, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ

১৫) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘বাঙালিরা তখন গদ্যে কথা বলে, গদ্য লিখতে জানে না’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১১

১৬) আবু সাঈদ, ‘বাংলা গদ্যের আদি লেখক রামরাম বসু’, বঙ্গদর্শন, ২০১৭

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।