আফ্রিকার বৃহত্তম জনবহুল দেশ নাইজেরিয়ার অতীতের কিছু কথা – ১
কিছু প্রাথমিক কথা
আমাদের ছোটবেলা (১৯৬০-৬৫) ইতিহাসে পড়ানো হত “অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ কাহাকে বলে?” আমরা মুখস্থ করতাম,”আফ্রিকাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়।” পরীক্ষার খাতায় উক্তিটির ব্যাখ্যায় লিখতে হত – “এই মহাদেশ সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছু জানিত না। লিভিংষ্টোন এবং অন্যান্যদের দুঃসাহসিক অভিযানের ফলে এই মহাদেশের কথা মানুষ প্রথম জানিতে পারে।এই মহাদেশ সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছু জানিত না, কারণ এই অঞ্চলে ছিল ভয়ঙ্কর জন্তু-ভর্তি গভীর অরণ্য, দুর্গম পর্বত, খরস্রোতা নদী, মরুভূমি, অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু আর আদিম হিংস্র অধিবাসীরা বসবাস করিত। ফলে সভ্য লোক সেখানে যাইতে পারিত না। তাই উহাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়।”
এই ২০২২-এ এসে এই সব কথা পড়লে হাসি পায় বটে কিন্তু, ১৯৬০-৬৫তে, স্কুলের ইতিহাস বইতে ব্যাকরণগতভাবে বর্তমানকাল বোঝাতে “অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়” কথাটি লেখা হত। অতীতকাল বোঝাতে “বলা হইত” লেখা থাকতো না। যদিও তখন সেটা অতীতকালের কথা ছিল না। কারণ তখনও অনেক ভারতীয়ই আফ্রিকাতে বসবাস করেন, ব্যবসা করেন, চাকরি করেন এবং বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। স্বয়ং গান্ধীজীও তো অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে আফ্রিকাতেই গিয়েছিলেন। তবু আমাদের পড়ানো হত ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ বলা হয়।
আমাদের পাঠ্য ইতিহাস ছিল মূলত নানা রাজা, সম্রাট আর যুদ্ধের ইতিহাস। বড়ো বড়ো রাজা-সম্রাট আর তাঁদের যুদ্ধের কথা না থাকলেই সেই দেশ বা মহাদেশও আর ইতিহাসের বইতে ঠাঁই পেত না। তবে ব্যতিক্রমও ছিল। আমাদের পড়ানো হত হরপ্পা সভ্যতার কথা। যদিও সেখানে কোন রাজা বা যুদ্ধের কথা নেই। তবু হরপ্পা সভ্যতাকে মহান সভ্যতা বলেই পড়ানো হত। সেটা সেই সভ্যতাটির সমাজের মানুষদের শিল্পকর্ম, অর্থনৈতিক কর্মের নিরিখেই পাঠ্যবইতে স্থান পেয়েছিল। মাটি খুঁড়ে সেই অতীতের শহর আর শহরের নাগরিকদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা জেনেই আমরা জানলাম ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা শুরু হয়েছিল অতি প্রাচীনকালে।
আফ্রিকাতে কিন্তু রাজা-মহারাজা, সম্রাটের কথা যেমন জানা যায়নি তেমনই মাটি খুঁড়ে হরপ্পা সভ্যতার মত অতীতের কথাও তখনও জানা যায়নি। তাই মহাদেশটি তার অজানা অতীতকে নিয়েই পেয়েছিল তথাকথিত ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ তকমা।
কেন আফ্রিকার অতীত আমরা জানি না?
ইতিহাসের উপাদান প্রমাণ-সাপেক্ষ। আফ্রিকানদের কোন লিখিত প্রাচীন কাহিনি নেই। মৌখিক লোককথারও ঐতিহাসিক মূল্য প্রায় কিছুই নেই। তবে অনেক সময় লোককথা-গাথার ভৌগোলিক বর্ণনার সূত্র-সন্ধান করেও পরবর্তীকালে মাটি খোঁড়া হতে পারে। তা না হলে কোথায় খুঁড়তে হবে তা কে কেমন করে জানবে? সেভাবে ইতিহাস জানা যেতেই পারে। আরেকটি অন্য উপায় হল আচমকা কোন প্রত্ন-সামগ্রী খুঁজে পাওয়া। তারপরে শুরু হবে খোঁড়াখুঁড়ি। কিন্তু এই ধরনের খনন কাজে দরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল, তার সাথে বিপুল অর্থবলেরও প্রয়োজন হয়। যেহেতু প্রত্ন-খনন থেকে সরকারের বা কোন ব্যবসায়ীর অর্থনৈতিক লাভের সম্ভাবনা নেই, তাই সরকারী এমন কাজে জনগণের দেওয়া করের অর্থ বিনিয়োগে উৎসাহ খুব কমই থাকে। আবার অর্থ বিনিয়োগ না থাকলে খনন কাজ হবার সম্ভাবনা নেই। প্রত্ন-খনন না হলে তা নিয়ে পঠনপাঠনও থাকবে না। ফলে কাজের জন্য দক্ষ লোকও থাকবে না; একটি বিষচক্র পরিস্থিতি।
আফ্রিকার নাইজেরিয়ার যে তিনটি সংস্কৃতির বা সভ্যতার কথা লিখতে বসেছি সেই পরস্পর সম্পর্কিত তিনটির কথা জানা গেছে কিছুটা আচমকাই এবং তারপর থেকেই আফ্রিকাতে প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার চর্চা শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের সুবিধা থাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের অভাব কিছুটা হলেও মিটেছে। ফলে বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশে একাধিক প্রাচীন সভ্যতার খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে। আলোচনায় থাকা নাইজেরিয়ার প্রত্নক্ষেত্রগুলোতেও গোড়াতে কাজ শুরু হয় বিদেশি কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উৎসাহে। এখন নাইজেরিয়ার সরকারী উৎসাহও আসছে, কিছুটা জাতীয়তাবাদের হাত ধরে।
আপাতত এই আলোচনা সীমিত থাকছে কেবল নাইজেরিয়ার তিনটি সংস্কৃতি-সভ্যতার কথায়। বেছে নেওয়া এই তিনটি প্রত্ন-এলাকার হাত ধরে আমরা নাইজেরিয়ার একটি অংশের ইতিহাস, কয়েক হাজার বৎসর অতীত থেকে বর্তমান কাল অবধি, জানতে পারছি। কালানুযায়ী নাইজেরিয়ার এই তিনটি প্রত্নক্ষেত্র হল নক সংস্কৃতি, ইলে-ইফে সভ্যতা, ও বেনিন সাম্রাজ্য। প্রথম পর্বে থাকছে নক সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা।
চিত্র – ১ নক সংস্কৃতিঃ সৌজন্যেঃ উইকি কমন্সঃ ল্যুভর মিউজিয়াম
নক সংস্কৃতি
উত্তর নাইজেরিয়ার কাদুনা জেলার নক সংস্কৃতি নিয়ে ভালোভাবে গবেষণা শুরু হয়েছে ২০০৫ সালে। একদম প্রথমে নক সংস্কৃতির কালসীমা ভাবা হয়েছিল ১৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ৫০০ সাধারণাব্দ। আনুমানিক দুই হাজার বৎসরের আয়ুষ্কাল। পরে নক সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন প্রত্ন ক্ষেত্রের (সামুন ডুকিয়া ও তারুগা প্রত্নক্ষেত্র) কার্বন ডেটিং ও থার্মোল্যুমিসেন্স পরীক্ষা করে জানা গেছে সময়সীমা হবে ২৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ৫০০ সাধারণাব্দ, অর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার বৎসর। সাড়ে তিন হাজার বৎসর জীবনকাল একটি সংস্কৃতির জন্য যথেষ্ট দীর্ঘই বলতে হবে। তবু তার সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা ছিল না। এই নক সংস্কৃতির বড় ধাঁধা হল এই সংস্কৃতির জন্মদাতারা স্থানীয় না বাইরে থেকে এসেছিল? এ নিয়ে সুনিশ্চিত কোন ধারনা কিন্তু এখনও নেই।
চিত্র – ২ নক সংস্কৃতিঃ সৌজন্যেঃ Nigerian Soul
নক সংস্কৃতির নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য
অসাধারণ শিল্প-নৈপুণ্যে, এক নিজস্ব ঘরানায় তৈরি পোড়ামাটির মুখাবয়ব। এই মুখাবয়বগুলো মানব সভ্যতার শিল্পকলার এক বিশেষ নিদর্শন। তবে নক সংস্কৃতি অন্য কোন সংস্কৃতি বা সভ্যতার মত ধাপে ধাপে প্রস্তর-নব্যপ্রস্তর-তাম্র-ব্রোঞ্জ-লৌহ যুগ দেখেনি। এখানে নব্যপ্রস্তর থেকে-টোরাকোটা দিয়ে শুরু করে এক লাফে লোহার ব্যবহার উত্তরণ ঘটেছিল।
নক সংস্কৃতির আবিষ্কার
১৯২৮, অংশীদারি মালিকানায় একটি টিন খনিতে কাজ করানোর সময়, ডেন্ট ইয়ং নামে একজন, ভূমিতলের ২৪ ফুট নীচে থেকে পান একটি পোড়া মাটির মুখাবয়ব। ইয়ং সেটা জমা দেন মাইনিং বিভাগের সংগ্রহালয়ে। সেই সময় নক সংস্কৃতির ইতিহাস দুরে থাক, তার অস্তিত্বই কারও জানা ছিল না।
১৯৪৩, নক গ্রামে টিন খনিরই কাজ করার সময় মাটির নীচে আরও বেশ কয়েকটি পোড়ামাটির মুখাবয়ব পাওয়া যায়। ঐ কোম্পানির একজন স্থানীয় কেরানী, ঐরকম একটি পোড়ামাটির মুখাবয়ব নিজের খেতে লাঠির মাথায় লাগিয়ে রাখেন কাকতাড়ুয়া হিসাবে। কাকতাড়ুয়া হিসাবে সেটি বেশ ভালই কাজ করেছিল এক বৎসর ধরে।
১৯৪৪, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বার্নাড ফ্যাগের নজরে পড়ে সেই মাঠে রাখা কাকতাড়ুয়াটি। প্রত্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ফ্যাগ বুঝলেন এটি অতিপ্রাচীন এবং এর পেছনে কোন ইতিহাস থাকার কথা। আগ্রহী হয়ে, খোঁজ-খবর করে, টিন কোম্পানির সংগ্রহালয়ে ১৫ বৎসর আগে ইয়ং-এর জমা দেওয়া মুখাবয়বটির সাথে কাকতাড়ুয়াটিকে মিলিয়ে দেখেন। দেখার পর ফ্যাগ অনুমান করলেন, দুটোই মুখাবয়ব একই সংস্কৃতির। কিন্তু কোন সংস্কৃতির, বা কত প্রাচীন, তা নিয়ে কোন ধারণাই নেই তখন। ফ্যাগ এবার ইয়ং-এর সাথে কথা বলে জানালেন মাইনিং-এর সময় এসব প্রায়ই বের হয়। সবই প্রায় ভাঙ্গা, বা তুলতে গিয়ে ভেঙ্গে যায়, নতুবা ভেঙ্গে ফেলে দেওয়া হয় আস্তাকুঁড়ে। এ থেকে অনুমান করা সহজ হল যে এই মুখাবয়বগুলো হঠাৎ করে বাইরে থেকে আসা নয়, এগুলো এখানেই তৈরি হত।
চিত্র – ৩ নক সংস্কৃতি সৌজন্যেঃ Nigerian Soul
প্রত্ন অনুসন্ধানের ইতিহাস
১৯৬০, কাকতাড়ুয়া পাবার ঘটনার আরও সতের বৎসর পরে, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়। ফ্যাগ নিজেই প্রত্ন-অনুসন্ধানে নেমে ১৯৬১ সালের মধ্যে সংগ্রহ করেন প্রচুর প্রত্ন-নিদর্শন। ফ্যাগের অনুসন্ধানেই জানা গেল নকরা লোহার ব্যবহারও শুরু করেছিল।
১৯৭৭, বার্নাড ফ্যাগের লেখা প্রথম বই প্রকাশ পেল। ফ্যাগই প্রথম “নক সংস্কৃতি” নামাকরণ করেন নক গ্রামের নামে।
প্রত্ন-খননের কাজ শুরু হয় তারুগার তাকুশুরা গ্রামে। প্রথমে অবশ্যই পরীক্ষামূলক খাত খুঁড়ে কাজের শুরু। তাতেই পাওয়া যায় গলানো লোহার গাদ। লোহার চুল্লীতে হাওয়া দেবার জন্য পাইপ, কাঠকয়লা। এছাড়া পাওয়া গেল পোড়ামাটির পুতুলাকৃতি মূর্তি, আর তার ভাঙ্গা টুকরো, গিরিমাটি, কোয়ার্টজ পাথরের কুড়াল। বেশি খোঁড়াখুঁড়ি না করে ম্যাগনেটোমিটার দিয়ে জরিপ করে পাওয়া গেল আরও ২০টি চুল্লীর সন্ধান। তার সাথে পড়ে থাকা লোহার গাদ ও টুকরোটাকরা লোহা। এখানেই পোড়ামাটির বাসনও পাওয়া গেল। কানা সহ অগভীর বাটি, কানা ছাড়া গোলাকার পানপাত্র। কিন্তু যেহেতু এক জায়গায় অতগুলো লোহার চুল্লী ছিল, তাই প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হল এটা ছিল লৌহযুগীয় সংস্কৃতি।
এর পরে বার্নাড ফ্যাগের মেয়ে অ্যাঞ্জেলা ফ্যাগ রেকহ্যাম ও নাইজেরীয় প্রত্নবিদ যোশেফ জেমকুর যুগ্মভাবে এই অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁদের করা প্রথম কার্বন ডেটিং ও থার্মোল্যুমিসেন্স পরীক্ষা বলে এই সংস্কৃতি ৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। এর পরে আলাদা পরীক্ষায় এই সংস্কৃতির প্রাচীনতম কাল জানা গেল ৮০০ থেকে ২০০ সাধারণ পূর্বাব্দ। সেটা অবশ্যই এই লোহার ব্যবহার কালের কথা।
১৯৮৯, জার্মান প্রত্নবিদদের কাজ শুরু হল। লৌহযুগের সংস্কৃতির নমুনা পাবার পরে আবার সব চুপচাপ ছিল। একটি জার্মান দল কাজ করছিল চাদ বেসিন এলাকায়। মানব সভ্যতার উৎস ও ক্রমবিকাশ নিয়ে। সেই সূত্রে তাঁরা এই চাদ বেসিন এলাকার মানব বসতি, সংস্কৃতি — এই সবের প্রভাব কতদূর অবধি বিস্তৃত সেই খোঁজ করতে থাকেন। সেই খোঁজ তাঁদের নিয়ে আসে নাইজেরিয়ার এই এলাকায়। এবার পরপর বের হতে থাকে নক সাংস্কৃতিক এলাকাগুলো।
২০০৯, শুরু হয় আরেকপ্রস্থ প্রত্ন-খনন কাজ। এই কাজে আসেন জার্মান প্রত্নবিদ ব্রুনিং আর রূপ। তাদের লক্ষ্য ছিল নক সংস্কৃতির সমাজ ব্যবস্থা অনুধাবন করা। এই পর্যায়ে এসেই প্রথম জানা গেল গেল ৮০০ সাধারণ পূর্বাব্দের লৌহযুগের সংস্কৃতির নয়, এই নক সংস্কৃতি শুরু দ্বিতীয় সহস্র পূর্বাব্দে। আর জানা গেল এখানে মাটির বাসন বানাতে জানার আগে থেকেই লোকের বসবাস শুরু হয়েছিল এবং গোটা এলাকা ছিল যথেষ্ট ঘনবসতি এলাকা। জনঘনত্বে চাদ বেসিনের পরেই নক এলাকার নাম আসবে। লোহার উৎপাদন প্রকৃত পক্ষে শুরু হয়েছিল ৮০০-৭০০ পূর্বাব্দ থেকে। লোহা উৎপাদনের পরেও টেরাকোটা মুখাবয়ব উৎপাদন চলেছিল আরও চার’শো বছর ধরে। আর ৪০০ পূর্বাব্দে টেরাকোটা মুখাবয়ব তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে।
চিত্র – ৪ নক সংস্কৃতি: সৌজন্যেঃ Kimble
নক সংস্কৃতির বিখ্যাত পোড়ামাটির কাজ
নক সংস্কৃতির নামডাক মূলত তাদের পোড়ামাটির মুখাবয়ব তৈরি নিয়ে। ভেতরে ফাঁপা মুখাবয়বগুলো সাধারণত হত জীবন্ত মানুষের মাথার সম আয়তনের। তবে পূর্ণদৈর্ঘ্যের মানুষ পাওয়া যায় খুব কম। টেরাকোটা মুখাবয়বগুলো ছাঁচে ঢালাই করা নয়, প্রত্যেকটি আলাদা করে হাতে বানানো। ১১ ইঞ্চি থেকে তিন ফুট মাপের এগুলোর বিশেষত্ব হল শরীরের তুলনায় মাথা-মুখের আকার অনেকটাই বড়। যদিও অনুমান করা হয় প্রতিটি মুখের সাথে গোটা শরীরও বানানো হয়েছিল, তবে তেমন গোটা শরীর খুবই কম পাওয়া গেছে। যে কয়েকটা পাওয়া গেছে তার থেকে অনুমান নক মানুষদের মধ্যে পায়ের গোদ রোগ ছিল। নিজস্ব ঘরনার অনন্য সুন্দর শিল্প শৈলীতে বানানো এই মুখাবয়বগুলো যে কেন বানানো হয়েছিল তা নিয়েও কোন স্পষ্ট ধারনা তৈরি হয়নি এখনও। তবে এই টেরাকোটা মুখাবয়ব বানাবার শৈলী থেকে অনুমান করা হয় এই শিল্পশৈলীর উৎস কাঠের মূর্তি বানানোর থেকে। তারই সাথে এটাও নিশ্চিত এমন শিল্পশৈলীর দক্ষতা গড়ে উঠতে লাগবে লম্বা সময়। কাজেই নকদের ইতিহাস বহু বহু প্রাচীন হবার সম্ভাবনাই বেশি।
নকদের তৈরি এই অনন্য সাধারণ শিল্পের নাম ও চাহিদা তখন গোটা বিশ্ব জুড়ে। এই অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত মুখাবয়বগুলো খুব তাড়াতাড়ি ইয়োরোপ আর আমেরিকার সংগ্রহালয়, বিশ্ববিদ্যালয় আর ব্যক্তি সংগ্রাহকদের মধ্যে প্রবল চাহিদা তৈরি করে। ফলে স্থানীয় লোকেরা দলে দলে মাটি খুঁড়ে না ভাঙ্গা শিল্পকর্ম খোঁজা শুরু করল। এই টেরোকোটা মুখাবয়বগুলোর চাহিদা বেশি থাকায় বাজারদরও বাড়তেই লাগলো। ফলে চোরাই চালানের স্বর্গরাজ্য হয়ে গেল এই এলাকা। হাজার হাজার লোক লাগিয়ে খোঁড়া হচ্ছে, তোলা হচ্ছে আর পাচার হয়ে যাচ্ছে। কথিত, একসময় চোরাই চালানের প্রধান দুই ব্যবসায়ীর কাছে কাজ করত দুই হাজার লোক। প্রতিদিন দুই হাজার লোক মাটি খুঁড়ছে, আর তুলছে, টোরাকোটা মুখাবয়ব। এই চোরা চালান কিন্তু ঠেকাবার উপায় নেই। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তবে এটাও ঠিক, মাটির নীচে পড়ে পড়ে নষ্ট হবার বদলে, ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহে থাকলে এগুলো ভালো থাকবে। অনেক লোক দেখতে পাবে। আলোচনা হবে। গবেষণা হবে। সমস্যা হল এগুলো প্রত্ন-অনুসন্ধানের নিয়ম মেনে সংগ্রহ হয়নি। ফলে কোথায় পাওয়া গেল, কোন কালস্তরে, বা কোন এলাকায়, সেখানে আর কী ছিল, সেইসব তথ্য চিরকালের মত হারিয়ে গেল।
এপর্যন্ত ১৬৩টি নক সংস্কৃতির প্রত্নক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে। তার মধ্যে ৪৯টি প্রত্নক্ষেত্রে প্রত্নবিদদের কিছু কাজ করার মত অবস্থায় থাকলেও বাকি সবগুলোতেই প্রত্নবিদরা খবর পাবার আগেই সব প্রত্ন-সামগ্রী লুঠ হয়ে গেছে। বাকিগুলোতে লুঠ হলেও কিছুটা করে নমুনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যেসব এলাকায় লোহার চুল্লী ছিল সেইসব জায়গায় লুট হয়নি। কারণ সেই সব জায়গায় লুট করার মত টেরোকোটা শিল্প প্রায় কিছুই ছিল না। তবে বিজ্ঞানীরা এটাও মানেন চোরা কারবারিদের দৌলতেই প্রায় সব নক প্রত্নক্ষেত্রগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে। নতুবা মাটির উপরে নক সংস্কৃতির কোন চিহ্ন কোথাও ছিল না যে অনুমান করে খনন কাজ শুরু করা যাবে।
এক একটি নক সংস্কৃতির বসতি এলাকার আয়তন কতটা ছিল সেটা বলা খুব কঠিন। কারণ সেভাবে গুছিয়ে কোথাও খনন কাজ চালানো হয়নি। অন্য প্রত্ন এলাকায় যেমন ঢিবি দেখে এলাকার আয়তন অনুমান করা হয়, নক সংস্কৃতির বেলা সেটা সম্ভব ছিল না। কারণ সবটাই সমতলভূমি। কেবল সেই বিস্তৃত সমতলভূমির নিচে কিছু ছিল বা আছে সেটা বোঝা যায় লুটেরাদের খোঁড়া গর্ত দেখে। হাজার হাজার লুটেরা বৎসরের পর বৎসর খুঁড়ে চলেছে। ফলে তাদের খোঁড়া জায়গা দেখেই বোঝা যায় তারা কিছু পেয়েছিল কিনা। তাই দেখে বসতির আয়তন অনুমান করা। সেই ধরনের অনুমান থেকে বলা হয় এক একটি নক সংস্কৃতির বসতি দুই থেকে চার হেক্টরের মধ্যে ছিল।
চিত্র – ৫ নক সংস্কৃতি, সৌজন্যেঃ Nigerian Soul
প্রত্ন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যাবলী
নক প্র্রত্ন এলাকার মাটিতে অম্লত্ব বেশি থাকায় কোন মানুষ বা জন্তুর হাড় টিকে নেই। তাই সেই মানুষদের দেখতে কেমন ছিল সেটা জানার কোন উপায় নেই। তবে তাদের তৈরি টোরাকোটা মুখাবয়ব দেখে তাদের দেখতে কেমন সে ধারণা কিছুটা করা সম্ভব।
দেখা গেল নক সংস্কৃতি লোকেরা পাথরের ব্যবহারে খুব একটা সড়গড় ছিল না। তবে একটি ঘর পাওয়া গেল যার অংশ বিশেষের ভিত গ্রানাইট পাথর কুঁদে তৈরি করা হয়েছিল। পাওয়া গেল একটা বেড়া যা বিচ্ছিন্ন খাড়া পাথরের টুকরো দাঁড় করিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও এগুলোকে কবর বলে অনুমান করা হয়।
পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। তবে বৈচিত্র্য প্রায় নেই। বিশেষ করে কিছু কাটার জন্য দরকারি ধারালো পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যায়নি। বরং সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে শান পাথর। নানা আকারের। কিসে শান দিত? সম্ভবত পাথরের কুড়ালে। পাথরের কুড়াল আর বল্লমের ফলাই ছিল ঐ এলাকায় পাওয়া পাথরের হাতিয়ার। পাথরের কুড়াল ছিল নানা আকারের। তবে সব চেয়ে বড় পাওয়া গেছে ২০০ মিলিমিটার। কিছু গোল পাথরের বল পাওয়া গেছে। অনুমান হাতুড়ি হিসাবে ব্যবহার করা হত। খুব কম হলেও পাওয়া গেছে পাথরের পুঁতিও।
মাটির বাসনের ভাঙ্গা টুকরো পাওয়া গেছে অঢেল। এর থেকে নক সংস্কৃতির কালস্তর বের করার চেষ্টা চলছে। আপাতত চারটি স্তর ধরা হয়েছে-
স্তর-১, ২৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ
এই স্তরে মাটির বাসন নেই। তবে জনবসতি ছিল। ফলে বলা যায় এখন থেকে পাঁচ হাজার বৎসর আগে যারা এখানে বসবাস করত তারা সম্ভবত মাটির বাসন বানাতে জানত না।
স্তর-২, ১৫০০-৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ
এই স্তরের খুব বেশি প্রত্নক্ষেত্র নেই। আর পাওয়া বাসনের টুকরোও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। দেখা গেল বাসনের গায়ে কাজ করা আছে। আর আঁচড়কাটা সেই কাজ, সূক্ষ্ম কাজ।
স্তর-৩, ৯০০-৩০০ সাধারণ পূর্বাব্দ
এই স্তরের প্রচুর প্রত্নক্ষেত্র পাওয়া গেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবশ্যই লোহার গাদ। বাসনের বেলা দেখা গেল অলঙ্করণের কাজ এখন কেবল গলার কাছে। দুটো আনুভূমিক রেখা এঁকে মাঝখানের জায়গায় উঁচু করে বা খোদাই করে বানানো, তার মধ্যে করা হয়েছে ঢেউ খেলানো বা কাটাকুটি দাগের নক্সা। এই পর্যায়ে কানার আকার ঢাল এসবের বৈচিত্র্য ছিল অনেক।
স্তর-৪, ৩০০ থেকে ১ম সাধারণ পূর্বাব্দ
এই স্তরে প্রত্নক্ষেত্র খুব কম। তারই সাথে বাসনের পরিমাণও খুব কম। বাসনের কানার গড়নে অনেক বেশি পরিবর্তন দেখা গেল, সাথে বৈচিত্র্যও। আগের স্তরের শুধু গলার কাছের নক্সার বদলে একেবারে প্রথম স্তরের মত সারা গায়ের নক্সা ফিরে এসেছিল এই পর্যায়ে।
কৃষিকাজ
নক সংস্কৃতির লোক কৃষিকাজ করত। এবং সেই কৃষিকাজ ছিল তাদেরই নিজস্ব উদ্ভাবন। নকদের খাদ্যশস্য ছিল প্রধানত বাজরা আর ছোলা। শস্যদানা ভাঙ্গার পাথর প্রচুর থাকায় অনুমান করা যেতে পারে তারা বাজরা, ছোলা এই সব গুঁড়ো করে রান্না করত। কিছুটা শুষ্ক আবহাওয়া হলেও ফলের গাছ না থাকার কোন কারণ নেই। তবে সেগুলোর কোন অবশিষ্ট না পাওয়ায় ফলের সঠিক পরিচিতি নিয়ে কিছু বলা কঠিন। নক কৃষকরা একই জমিতে বাজরা ও ছোলার শস্য যেমন লাগাত তারই সাথে ফলের গাছও লাগাত, এমনটা অনুমান করা হয়। সম্ভবত ফলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাষ হত বাজরা, ছোলার। খাদ্যশস্য সংরক্ষণও তারা করত। সংরক্ষণে কাজে লাগাত বড়ো বড়ো মাটির পাত্র।
তারা কোন প্রাণীর মাংস খেত বলা কঠিন, কারণ নক সংস্কৃতি এলাকার মাটিতে অম্লের ভাগ বেশি হওয়ায় কোন হাড় টিকে নেই। তবে তারা যে মধু খেত প্রচুর পরিমাণে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
হাড় না থাকায় নক সংস্কৃতি কোন এলাকায় মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়নি, ফলে কোন কবরও সরাসরি কবর হিসাবে চিহ্নিত করা যায়নি।
নকদের বাড়িঘর
এমন কোন কিছু পাওয়া যায়নি যাকে সরাসরি বাড়ি বা বাড়ির ভিত বলা যাবে। তবে মাটিতে কাঠি বা সরু ডালের ছাপ দেখে অনুমান করা হয়, তাদের বাড়ির বেড়া তৈরি হত গাছের সরু ডালের উপর মাটির প্রলেপ দিয়ে। কোথায় ঘর ছিল সেটা অনুমান করা হয়েছে গৃহস্থালির উপকরণের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
লোহা
নক সংস্কৃতির লোকেরা লোহার ব্যবহার শুরু করেছিল আনুমানিক ১ হাজার সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ। আকরিক লোহা থেকে ব্যবহারযোগ্য লোহা নিষ্কাশন করা থেকে ব্যবহারিক প্রয়োগ কৌশল, সবই ছিল নক সংস্কৃতির লোকেদের নিজস্ব উদ্ভাবন। আর সব রকম পরীক্ষানিরীক্ষার অন্তে ৫৫০ সাধারণ পূর্বাব্দে লোহার নিয়মিত ব্যবহার শুরু করে দেয় তারা।
চিত্র – ৬ নক সংস্কৃতি, সৌজন্যেঃ Nigerian Soul
নক সমাজ ব্যবস্থা
সাধারণত আমরা জানি সমাজ গঠিত হয় ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত গোষ্ঠীকে নিয়ে। এবং বিভক্ত সম্প্রদায়গুলো পরে কোন শক্তিশালী নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজ্য বা রাষ্ট্র গঠন করে। তবে এইরকম একটা সমাজের সাংগাঠনিক রূপের বিশ্লেষণের উৎপত্তি মূলত ইয়োরোপীয় চিন্তাধারা থেকে হলেও তা এশিয়াতেও যথোপযুক্ত মনে হতেই পারে।
কিন্তু আফ্রিকাতেও কি সেরকমই ছিল?
আফ্রিকাতেও কি এইভাবেই আদিম মানব বসতিগুলো সংগঠিত ছিল? এই একই ছকে? বলা কঠিন। কারণ প্রকৃতপক্ষে তেমন কোন গভীর অনুসন্ধান চালানোই হয়নি। জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে বিজ্ঞানী ব্রুনিং ও রূপ এই ফাঁক ভরাবার চেষ্টা করেন। তাঁদের চাদ বেসিন ও নক’দের ঘিরে একটি গবেষণায় এই দিকটা যাচাই করে দেখা হয়। দেখা যায়, সমাজ গঠনের সূত্রপাত খানিক ভিন্নই ছিল।
আফ্রিকাতে সমাজের মুল বিভেদ ধর্ম বা ভাষার ভিত্তিতে নয়, ছিল পরিবারের ভিত্তিতে। এখানে পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের নিয়ে গঠিত হয় সমাজের প্রথম একক। পরিবারের সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে বসতির এলাকা। ফলে বসতিগুলো হয় অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট। বসতিগুলোর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বাণিজ্য চলে পাথরের হাতিয়ারের লেনদেন বা বিশেষ পাথরের লেনদেনের মাধ্যমে। পরিবার ভিত্তিক বসতিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষও হতো। ফলে তাদের প্রত্যেকের থাকত পৃথক প্রতিরক্ষা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। চাদ বেসিনে এই পরিবার ভিত্তিক সমাজ পরে বৃহত্তর সমাজে বিবর্তিত হয়। দেখা দেয় গোষ্ঠীপতিদের। ফলে এলাকা দখল ও আধিপত্য বিস্তারের পর্ব শুরু হয়। ছোট ছোট পরিবার ভিত্তিক সমাজ লোপ পায়। নকদের স্বতন্ত্র পরিবার ভিত্তিক সমাজের থেকে পরবর্তী গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটেনি। ফলে শিল্পে সংস্কৃতিতে তারা সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এক সময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত সেই বিলুপ্তি ঘটে গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজেরই চাপে।অনেক নক বসতিই দেখা গেছে স্বল্পকালীন বসতির এলাকা। এর থেকে অনুমান করা হয় নকদের মধ্যে অনেকেই সীমিত ভাবে যাযাবর গোছের ছিল। তারা বাসস্থান বদলাতো কিছুকাল পরে পরে। তার কারণ হতে পারে যে সেখানে ফসল ভালো হত না, বা মাটির জিনিষ বানাবার উপযুক্ত মাটি শেষ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু নকদের এই দীর্ঘকাল এতগুলো লোকের এক এলাকায় বসবাস, ও একই সংস্কৃতি বাহক হিসাবে তাদের মধ্যে একটা একাত্মতার বন্ধন অবশ্যই ছিল। আপাতত অনুমান, সেই বন্ধন ছিল তাদের ঐ টোরাকোটা মুখাবয়ব তৈরি ঘিরে। বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে যেটুকু তথ্য জোগাড় করা গেছে তাতে মোটামুটি অনুমান করা হয় যে এই মুখাবয়ব আর পূর্ণদৈহিক মূর্তিগুলো ঘিরে তাদের নানা ধর্মাচরণ ছিল। যার মধ্যে ছিল এগুলো কবর দেওয়া, এবং এগুলো বিশেষ স্থানে রেখে অর্চনা করা। যেহেতু এই প্রথা বেশি দেখা গেছে তাদের পরিত্যক্ত বসতিতে, তাই অনুমান করা হয়, এগুলোর সাথে মূলত জড়িত ছিল তাদের পূর্বজদের স্মরণ করা।
চিত্র – ৭ নক সংস্কৃতি, সৌজন্যেঃ Nigerian Soul
লৌহযুগে শ্রমদক্ষতার নব বিন্যাসের চাপে নকদের পরিবার ভিত্তিক প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙ্গন
সাধারণ পূর্বাব্দের প্রথম সহস্রাব্দে পরিবার ভিত্তিক চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থায় বদল ঘটতে শুরু করে। তখন পারিবারিক পরিচিতি ভিত্তিক বিন্যাসের বদলে শুরু হয় দক্ষতা ভিত্তিক সামাজিক শ্রেণী বিন্যাস। সম্ভবত আকরিক লোহা নিষ্কাশন ও ব্যবহারের যে প্রায়োগিক দক্ষতা দরকার ছিল তা সীমিত থেকে গিয়েছিল কিছু লোকের মধ্যে। অথবা কয়েকটি পরিবারের মধ্যে অধিগত বিশেষ দক্ষতা হিসাবে। অনুমান করা যায় এই দক্ষতা পরিবারগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। ফলে এই দক্ষতা বিনিময়ে পারিবারিক বাধাও তৈরি হয়েছিল।
ইতিমধ্যে লৌহযুগে বিনিময় ব্যবস্থার ধরনও বদলাতে শুরু করে। আগেকার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ভাঙ্গতে শুরু করে। ফলে যাদের লোহা ব্যবহারের জ্ঞান নেই তারা একসময় স্থান ও সমাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
প্রাচীন নক সমাজের ভিত ছিল পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের নিয়ে গড়া এক একটি বসতি। এবং সেই পরিবার গুলো সামগ্রিক ভাবে নক সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল কোন একটি বিশেষ ধর্মাচরণে। যদিও সেই ধর্মাচরণ সর্বজনীন সামাজিক ধর্মাচরণ ছিল না, তবু ঐটুকুই হয়ত ছিল তাদের সামাজিক বন্ধনের প্রধান যোগসূত্র। পরবর্তী কালে লৌহযুগে এসে তাদের অর্থনৈতিক কর্মধারা বদলে যেতেই পরিবার ভিত্তিক বসতি ভাঙ্গতে শুরু করে। সাথে লোপ পায় চিরাচরিত ধর্মাচরণ। তারই সাথে লোপ পায় মাটির মুখাবয়ব তৈরির কাজ। মুখাবয়ব তৈরিতে দক্ষ লোকেরা কাজের সন্ধানে পথে নামতে বাধ্য হয়। এই সমাজ ত্যাগীদের কিছু লোক হয়ত চলে যায় তখনকার জমজমাট ইফে শহরে, কাজের সন্ধানে।
ইফে শহর ও নক শিল্পী
ইফে শহরেও হয়ত নক ধর্মাচারণের প্রথা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট লোক ছিল না। ফলেনতুন এলাকার সংখ্যাগুরু ইয়োরুবাদের মধ্যে সংখ্যালঘু নকেরা মিশে গেলে নকদের পারিবারিক ধর্মাচরণ লোপ পাবারই কথা। তাছাড়া ইফের মাটি আর নকদের দেশের মাটিও ভিন্ন হবেই। ফলে মুখাবয়ব নির্মাতারা এখানেও কর্মহীন। এই দক্ষ অথচ কর্মহীন নকদের নিয়েই এবার ইফে শহরে তৈরি হতে শুরু করল মুখাবয়ব। যা পরে তৈরি হতে থাকে তামা দিয়ে। ধাতুরমুখাবয়ব তৈরি হবে সেখানকার রাজার ইচ্ছায়। আগেকার মত প্রতি পরিবারের মুখাবয়ব তৈরি হবার নয়। কেবল রাজপরিবারের মুখাবয়ব তৈরি হবে। কারণ ধাতুর দ্রব্যমূল্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
ইফে ও বেনিনের তামা-ব্রোঞ্জের শিল্পে নক সংস্কৃতির সরাসরি প্রভাব দেখা না গেলেও ভাবাই যায়, এই নক শিল্পীদের মাধ্যমেই হয়ত ইফে শহরের শিল্পকর্মের গোড়াপত্তন হয়েছিল। এমন ধারণার পেছনে তেমন জোরালো প্রমাণ না থাকলেও নক সংস্কৃতির শিল্পধারার বিলুপ্তি পরেই ইফে এলাকায় অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যে ভরা মুখাবয়ব শিল্পের উত্থান এমন একটি সম্ভাবনার ভাবনা উস্কে দেয় বৈকি। সময়রেখার দিকে তাকালেও দেখা যাবে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা আছে। নকদের লোহা গলানো শুরু হয় ৮০০-৭০০ পূর্ব শতকে। যেখানেই লোহা গলানোর চুল্লি ছিল সেখানে মাটির তৈরি মুখাবয়ব খুব কম অথবা একেবারেই নেই। ৪০০ পূর্ব শতক থেকে নকদের লোহার কাজ পুরো মাত্রায় চালু হয়। আর ঠিক এই সময় থেকেই মাটির মুখাবয়ব তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। তার দেড়শ বৎসর আগেই, ৫৫০ পূর্ব শতকে, ইফে শহরের উত্থান শুরু হয়। তারপরেই কেবল সেখানে মুখাবয়ব তৈরি শুরু হয়।
আবার এটাও জানা গেছে যে পরে ইফে শহরের শিল্পীরাই চলে যায় বেনিন শহরে। বজায় রাখে তাদের শৈল্পিক ধারাটি।
তথ্যসূচী-
NOK CULTURE:-
1. An Outline of recent studies on the Nigerian NOK Culture: By Peter Breuning&Nicole Rupp. Published by Journal of African Archaeology. Dec 2016
2. NOK Culture: National Geographic
3. NOK Culture: by Mark Carwright, March 2019, published by World History
Enclyopaedia
4. NOK Culture: C Elliot, published by History today in May 1967
5. NOK Culture: The MET. MET Museum. Hollyburn Time line of Art History, by The Departments of Arts of Africa, Oceania, and the Americas. The Metropolitan Museum of Art. On Oct. 2000
6. NOK Culture: University of Stanley Museum of Art. Iowa.
আফ্রিকার ইতিহাস – প্রত্নচর্চা নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য । কিন্তু কয়েকটা তথ্য ভুল আছে। আফ্রিকার প্রত্ন- ইতিহাস চর্চা ২০০৫ সালের নাইজেরিয়ার সভ্যতার আবিষ্কার দিয়ে শুরু হয় নি। পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্ন জীববিদ্যা নিয়ে কাজকর্মের কথা তো ধরছিই না, মিশর, মরক্কোকেও নয়। কিন্তু আফ্রিকার প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে কাজ হয়েছে গত শতাব্দী থেকেই। কেম্ব্রিজে আফ্রিকান আরকিওলজি পড়ানো হয় বহুকাল ধরেই, তেমনি ইন্সটিউট অফ আরকিওলজি, ইউ সি এলেও। এবিষয়ে পশ্চিম আফ্রিকায় বিশেষত মালিতে প্রফেসর কেভিন ম্যাকডোনালডের কাজ দেখা যেতে পারে।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। আপনার মত কেউ লেখাটি পড়েছে জানলে বেশ গর্ববোধ হয়।
আমার তথ্যগত ত্রুটি ধরে বলে দেবার জন্যও থাকলো অনেক ধন্যবাদ।
আমি এমনিতে সাধারন ভাবে জানি আফ্রিকার ইতিহাস নিয়ে অনেক আগে থেকেই চর্চা হচ্ছে। আফ্রিকার তালিকা থেকে মিশরকে বাদ রেখেই বলছি।
আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম এই নাইজেরিয়ার নক সংস্কৃতিরটি নিয়ে ভালো ভাবে বা গভীর ভাবে কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৫ থেকে। এমনিতে কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মি. ফ্যাগ তো অকারনে বা বেড়াতে আসেন নি, তিনি কোন গবেষণার সাথে যুক্ত থেকেই এসেছিলেন।
তবে আপনার দেখেমন্তব্য পড়ে বুঝলাম আার লেখায় আমার ধারনটা পরিস্কার ভাবে বোঝানো যায় নি। সেটা অবশ্যই আমার অক্ষমতা। তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপনার কাছে আর সব পাঠকের কাছেও।
পরের পর্বে এই ভুল ঠিক করে দেবার চেষ্টা করব।
আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস সম্মন্ধে আমাদের ধারণা প্রায় নেই বললেই চলে। এই প্রথম আপনি জানালেন লেখার মাধ্যমে।
খুব ই আগ্রহ উদ্দীপক লেখা। এত সুন্দর টেরাকোটা কাজ প্রায় নিখুঁত ই বলা যায়।
আপনার এনালিসিস এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও সবসময়ই থাকে। ছবি গুলো দেখে বোঝা ই যাচ্ছে এগুলির কদর ছিল।
পুরো সভ্যতার ক্রম বিকাশের রূপরেখা পাওয়া গেলে হয়ত বোঝা যাবে তাদের বর্তমান কালের অবস্থান।
খুব ভালো লাগলো। পরের খন্ড এর জন্যে অপেক্ষা করছি।
ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমাদের দেশে আফ্রিকার অতীত নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয়ই না। আর নাইজেরিয়ার এই সংস্কৃতির তো আদৌ কোন আলোচনাই নেই। অথচ কি অসাধারন শিল্পকর্ম এগুলোর। তাদের এই শিল্পসৃষ্টির দক্ষতা একেবারে অতুলনীয় ছিল। এগুলো এখনো গোটা দুনিয়ায়, অবশ্যই পশ্চিমি দুনিয়ায় প্রবল ভাবে জনপ্রিয়।
নক সংস্কৃতির বিষয়ে আর প্রায় কিছুই জানা যায় না। এটাই যা দুঃখের। তারা হারিয়ে গেছে। তবে আমার অনুমান হয়ত তাদের একাংশ ইলে ইফে রাজ্যে চলে গিয়েছিল। আমার ধারনা মাত্র। কোন প্রমান নেই।