হিপোক্রেটিস এবং চরকের দুটি “oath” এবং “টর্চার ডক্টরস”: “Oath” থেকে “শপথ”-এ রূপান্তর
শুরুর কথা
স্টিভেন এইচ. মাইলস ২০২০ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ The Torture Doctors: Human Rights Crimes & Road to Justice-এ লিখছেন – “২০০৩ সালের বসন্তে ইরাকে আমেরিকার ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ কেন্দ্র আবু ঘ্রাইব থেকে লুকিয়ে পাচার করা অনেকগুলো ফটোগ্রাফের মধ্যে ছিল একটি ফটো ছিল বরফের ব্যাগে ভরা এক ক্ষতবিক্ষত বন্দীর ওপরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক সেনার ছবি। মন আদেল আল-জামাদি নামে এই ব্যক্তির মৃত্যু এর আগে রিপোর্টেড ছিল না। এ ঘটনার ফলে সাংবাদিকেরা আমেরিকান সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে এই বন্দীর মৃত্যু সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য। সরকার আংশিক এক সেট ডেথ সার্টিফিকেট প্রকাশ করে যাতে স্বাভাবিক মৃত্যু এবং লুকিয়ে রাখা মৃত্যুকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল, যেখানে বাস্তবে ঘটেছিল হত্যা করা এবং জেলের অ-নিরাপদ পরিস্থিতি। আল-জামাদির মৃত্যু হয়েছিল হিংস্র অত্যাচারের ফলে।” (পৃ: ১৪৯)
কারা দিল এই সার্টিফিকেট? বইয়ের শিরোনাম থেকে বোঝা যায় “টর্চার ডক্টরস”রা এগুলো সরবরাহ করেছে।
আমরা যারা ফুকোর Discipline and Punish বইটি পড়েছি তারা ঐ বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায়ে দেখেছি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দানের গ্রাফিক বর্ণনা। গা শিউড়ে ওঠা, দেহের প্রতিটি অনুভূতিকে অবশ করে দেওয়া সে বিবরণে আমরা জেনেছি দেহের ওপরে রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং দণ্ডনীতির কি ভয়াবহ পরিণামচিহ্ন এঁকে দেওয়া যেতে পারে – “দুটো অথবা তিনটে চেষ্টার পরে ঘাতক স্যামসন এবং যে চিমটে ব্যবহার করছিল দু’জনেই তাদের পকেট থেকে ছুরি বের করল এবং শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটির পায়ের জয়েন্টগুলো কাটার বদলে দুটো উরু কেটে দিল। চারটে ঘোড়া দুদিক থেকে টেনে উরুদুটো নিয়ে চলল, প্রথমে ডান উরুটি পরে বাম উরু … এরকম করে যখন চারটে অঙ্গ আলাদা হয়ে গেল তখন যে পুরোহিত স্বীকারোক্তি শোনে সে এল মানুষটির সাথে কথা বলার জন্য …” (পৃ: ৫)
এরকম বীভৎস, বিবমিষা উদ্রেককারী বর্ণনাকে অপ্রয়োজনে আরও বিস্তৃত করার কোন প্রয়োজন দেখছি না। এলেইন স্কারি তাঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ The Body in Pain-এ যন্ত্রণা এবং ব্যথা নির্দিষ্টভাবে কি করে বোঝাতে গিয়ে বলছেন, দৈহিক যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষাকে শুধু রোধ করে না, একে সক্রিয়ভাবে ধ্বংস করে “bringing about an immediate reversion to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makesbefore language is learned.” (p. 4)
আমাদের আশ্বস্ত হবার অন্য কারণ আছে। হার্ভার্ড এবং আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে cognitive neuroscience নিয়ে বিপুল উদ্যমে গবেষণা ও চর্চা চলছে। এ গবেষণার একটি অভিমুখ হল যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ হার্ডকোর টেররিস্ট তারা দৈহিক এবং মানসিক অত্যাচারের ঠিক কোন পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে (to the sounds and cries a human being makes before language is learned) তার ব্রেইন ম্যাপিং করা এবং মস্তিষ্কের অ্যানাটমিতে কিরকম বায়োকেমিকাল পরিবর্তন হয় সেগুলোকে পরিমাপ করা। দেহ-রাজনীতির এ অন্য এক অধ্যায়। মেডিসিন এর অন্তরঙ্গ সাথী হয়ে যায়।
কিন্তু রাষ্ট্র দেহ-শাস্তি-রাজনীতি-ক্ষমতা এই ন্যারেটিভকে বদলাতে চাইল, বদলে ফেললো সময়ের সাথে। সমগ্র ঘটনাই ঘটবে, কিন্তু অন্তরালে – “the disappearance of punishment as spectacle.” চমকপ্রদ ভাষায় ফুকো ব্যাখ্যা করেন – “অসহনীয় অনুভূতি ঝাঁকিয়ে দেওয়া কলাকৌশলের পরিবর্তে শাস্তি এখন হয়ে উঠল বন্দীর যেসব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার মিতব্যয়ী প্রকাশ।” (“From being an art of unbearable sensations punishment has become an economy of suspended rights.”)
এখানে ডাক্তারের ভূমিকা কি? একজন ডাক্তার রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে মৃত্যুর সমস্ত প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। একজন “agent of welfare” হিসেবে ডাক্তার দেখবে মৃত্যু প্রক্রিয়াটি যেন যন্ত্রণা ছাড়া শান্তিময় হয়ে ওঠে। কিন্তু নিয়তির বা মেডিসিনের বা রাষ্ট্রের এমনই পরিহাস চিকিৎসকের রাষ্ট্র–নির্ধারিত দায়িত্ব হচ্ছে একজন মানুষের জীবনকে মৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে পার করে দেওয়া।
দেহের ওপরে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খুব প্রকট হয়ে ওঠে মৃত্যুদণ্ড দেবার সময়, যেমন ফুকোর বর্ণনায় আমরা দেখলাম। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও এর খুব তীক্ষ্ণ, নির্মম এবং অভ্রান্ত চেহারা দেখা যাবে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ডের বিবর্তনের মাঝে। এর পূর্ণাঙ্গ চেহারা ধরা পড়ে স্টুয়ার্ট ব্যানারের The Death Penalty: An American History-তে।
১৯৭৬ অবধি আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত “death by firing squad” দিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে বিচারব্যবস্থা দেখলো এধরনের মৃত্যু “too bloody and uncontrolled”। একাধিক মানুষকে গুলি করার পরেও তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়নি। এ কেমনতরো কথা? গণতান্ত্রিক দেশে একজন “অপরাধীকে” মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে অথচ সে একবারে মারা যাচ্ছেনা। সমাজের চোখে খারাপ দেখানোর চাইতেও, আমার বিচারে, রাষ্ট্রের অভ্রান্ততা প্রশ্নের মুখে পড়ছে এরকম মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিতে এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
এরপরে এল ফাঁসী। কিন্তু এটাও “মনে করা হল আরও বেশি অমানবিক” (“came to be regarded as still more inhumane”)। তারপরে এলো নাৎসী হিটলারের মতো গ্যাস চেম্বারের মৃত্যু। কিন্তু ১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা রাজ্যে ডোনাল্ড হার্ডিং-এর মৃত্যু ঘটতে ১১ মিনিট সময় লেগেছিল। ১৯৭৬ থেকে আজ অব্দি ২ জন বন্দীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে, ৩ জনকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে এবং ১২ জনকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইলেক্ট্রিক শক (২৬০০ ভোল্ট) দিয়ে মারার পদ্ধতি চালু হল এবং এখানে এসে আবার একটি গোল বাধলো। ১৯৭৯-তে এক বন্দীকে ২৬০০ ভোল্টের শক পরপর দুবার দেবার পরেও ২০ মিনিট ধরে তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখ নিয়ে বেঁচে ছিল। রাষ্ট্রের অসম্পূর্ণতা, অকার্যকারিতা আরেকবার প্রমাণিত হল। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের রাজনীতি পূর্ণত প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও “মুক্তচিন্তার” রাষ্ট্র কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারছেনা। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের সাফল্যের ক্ষেত্রে এক বড়োসড়ো প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে একে হজম করা সম্ভব নয়। তখন ডাক পড়ে মেডিসিনের।
ফুকোর গবেষণার এক নতুন চিত্রনাট্য যেন দেখতে পাচ্ছি একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায়। গ্যাস চেম্বার পরবর্তী পদ্ধতি হল “lethal injection”। কি দিয়ে তৈরি এ ইঞ্জেকশন? ২৫০০-৫০০০ মাইক্রোগ্রাম সোডিয়াম থায়োপেন্টাল (জীবিত দেহে অপারেশনের সময়ে এর সর্বাধিক ডোজ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম), ৬০-১০০ মিলিগ্রাম pancurium বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সবকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ করে দেয় এবং এই ডোজ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। এরপরেও দেওয়া হয় ১২০-২৪০ মি. ইকুইভ্যালেন্ট পটাশিয়াম।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে মান্য পত্রিকা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর সম্পাদকীয়তে (জানুয়ারি ২৪, ২০০৮) মন্তব্য করা হল – “Officials liked the method”, কারণ মৃত্যু ঘটানোর জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলো অ্যানাস্থেসিয়াতে ব্যবহৃত হয়। আরেকটি বড়ো কারণও ছিল – “আমেরিকার সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী যে শাস্তি ‘নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক’ তাকে নিষিদ্ধ করেছে। কোর্টের কাছে Baze v. Rees মামলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হল মৃত্যুর ঘটানোর জন্য সোডিয়াম থায়োপেন্টাল, প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইডের ব্যবহার সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞাকে লঙ্ঘন করে কিনা।” (Gregory D. Curfman, Stephen Morrissey and Jeffrey M. Drazen, New England Journal of Medicine (NEJM), “Physicians and Execution”, পৃ: ৪০৩-৪০৪)
রাষ্ট্র-নির্ধারিত মৃত্যু, ব্যক্তি দেহের মৃত্যু, যাতে নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক না হয় সেজন্য রাষ্ট্র চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সাথী করে। রাষ্ট্রের কি গভীর মানবিক অনুভব!
NEJM-এর উদ্যোগে জানুয়ারি ১৪, ২০০৮ সালে একটি গোল টেবিল প্যানেল ডিসকাশন হয়েছিল – “Physicians and Execution — Highlights from a Discussion of Lethal Injection” শিরোনামে – একাধিক বিশেষজ্ঞকে নিয়ে। সে আলোচনায় আইনের পরিচিত অধ্যাপক এবং স্কলার ডেবোরা ডেনো খুব মিহি করে জানিয়েছিলে – “সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী কখনও বলেনি অথবা আবেদনকারী যুক্তি দিয়ে এমন তর্ক করেনি যে মৃত্যুদণ্ডকে ব্যথামুক্ত হতে হবে। প্রশ্ন হল মৃত্যুর সময়ে যন্ত্রণা অপ্রয়োজনীয় কিনা সেটা নয়, বরঞ্চ প্রশ্ন হল এক্ষেত্রে বিকল্পগুলো আছে কিনা।” এই জার্নালেই (মে ৯, ২০১৯) প্রকাশিত প্রবন্ধে (“Physician Participation in Lethal Injection”) ডেবোরা ডেনো জানিয়েছিলেন – “I believe that whatever moral or professional credibility the medical community fears it will lose by engaging in a discussion of physician involvement in lethal-injection executions is already imperiled by the increasingly apparent divergence between the community’s words and its actions.”
নির্মম নারকীয় পরিহাসের মতো শোনায় যখন ডেবোরা ডেনো পূর্বোক্ত প্যানেল ডিসকাশনে বলেন – “প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহার করা হয় যে বন্দীর মৃত্যু হচ্ছে তার মর্যাদা ত্বরান্বিত করার জন্য। কারণ প্যানকিউরোনিয়াম ব্যতিরেকে মৃত্যুর সময় ঝাঁকুনি বা অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়া হতে পারে যা যারা মৃত্যুদণ্ড স্বচক্ষে দেখতে আসে তাদের পক্ষে অস্বস্তিকর হতে পারে।”
এই জার্নালেই (মে ৯, ২০১৯) প্রকাশিত প্রবন্ধে (“Physician Participation in Lethal Injection”) ডেবোরা ডেনো জানিয়েছিলেন – “I believe that whatever moral or professional credibility the medical community fears it will lose by engaging in a discussion of physician involvement in lethal-injection executions is already imperiled by the increasingly apparent divergence between the community’s words and its actions.”
নিয়তির পরিহাস হল, যে মানুষটির আইনসিদ্ধ হত্যা (legalized killing) হচ্ছে তার “dignity” ত্বরান্বিত করার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ১০গুণ বেশি ডোজে দেওয়া হচ্ছে প্যানকিউরোনিয়াম!
একে যদি সভ্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না বলি, তাহলে আর কাকে বলা হবে?
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ এই প্যানেল ডিসকাশনের আগে এই জার্নালের অন্য সংখ্যায় অতুল গাওয়ান্ডের একটি প্রবন্ধের (পরে প্রবন্ধটির উল্লেখ রয়েছে) প্রতিক্রিয়ায় “Why Physicians Participate in Executions” শিরোনামে কয়েকটি চিঠি প্রকাশিত হয় (জুলাই ৬, ২০০৬)। একটি চিঠিতে রবার্ট জে ইয়েটস বলেন – “মৃত্যুদণ্ডের মানবিক পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে একটি oxymoron (বিরোধালঙ্কার)। ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে মেরে ফেলা সবসময়েই এক পাশবিক এবং হিংস্র প্রক্রিয়া। মৃত্যুদণ্ড হত্যাকে কমাতে পারে ইত্যাদি ধরনের যুক্তি এতটাই কলঙ্কজনক যে এমনকি মৃত্যুদণ্ডের সমর্থকেরাও এখন আর এ যুক্তি ব্যবহারের তাৎপর্য খুঁজে পায়না। ফলে, মৃত্যুদণ্ডের একমাত্র ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জায়গা হল প্রতিহিংসার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা।” (পৃ: ১০০)
অথচ রাষ্ট্রের তরফে সজোরে এবং সগর্বে প্রকাশ করা এ যুক্তিকে আমরা অস্বীকারও করতে পারবনা। কারণ আমরা অর্থাৎ সামাজিক মানুষ ও নাগরিক সমাজ ঐতিহাসিকভাবে এর পূর্ববর্তী স্তর অর্থাৎ রাষ্ট্রের তরফে দেহের ওপরে মৃত্যুদণ্ড কায়েম করার নৈতিক, আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার মেনে নিয়েছি। সাধারণভাবে সামাজিক মান্যতা পেয়েছে রাষ্ট্রের operating techniques, রাষ্ট্র উৎপাদিত জ্ঞান বা logos, রাষ্ট্রের বিভিন্ন sign ও signifier।
আমেরিকার মিসৌরিতে এমনকি হাসপাতালের ঘরেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে রাষ্ট্র উদ্ভাবিত কারণ হল – “সরকারি কর্তাব্যক্তিরা এই পদ্ধতি পছন্দ করেছিল। কারণ অ্যানেস্থেসিয়ায় ব্যবহৃত টেকনিকগুলো কাজে লাগানোর জন্য হত্যাকাণ্ডটি আতঙ্কজনক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রদর্শনী হবার পরিবর্তে অনেকটা স্বাভাবিক মেডিক্যাল কার্যপ্রণালীর মতো দেখাবে।” (অতুল গাওয়ান্ডে, “When Law and Ethics Collide – Why Physicians Participate in Executions”, NEJM, মার্চ ২৩, ২০০৬)) গাওয়ান্ডে তাঁর Betterঃ A Surgeon’s Notes on Performance (২০০৮) পুস্তকে মন্তব্য করেছেন – “Medicine is being made an instrument of punishment. The hand of comfort that more gently places the IV, more carefully times the bolus of potassium, is also the hand of death. We cannot escape this truth.” (পৃ: ১৫২)
আমরা স্মরণে রাখবো, যে সমস্ত ডাক্তারদের মদতে এবং প্রশ্রয়ে এরকম বীভৎসতম অত্যাচার ঘটে তাঁরা সবাই কিন্তু তাঁদের মেডিক্যাল শিক্ষার সময়ে “Oath” নিয়েছেন। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ (মে ১৩, ২০০৪) একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল “I Swear by Apollo” – On Taking Hippocratic Oath। এ প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয় – “যেমনটা সমস্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরাই জানেন, পেশা জগতের শপথের উচ্চারণে আমরা যে কয়েক মিনিট সময় ব্যয় করি সে কাজ সারা জীবন ধরে এর বিশ্বস্তভাবে একে বাস্তবায়িত করার চেয়ে অনেক বেশি সহজ। যেমনটা হিপোক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি, “জীবন সংক্ষিপ্ত, কাজ সুদীর্ঘ, সুযোগ ক্ষণস্থায়ী, অভিজ্ঞতা বিপদসংকুল এবং সংকট কষ্টকর,” কিন্তু মেডিসিনের উত্তরাধিকার আমাদের স্মরণ করায় যে আমরা এই মহান দায়িত্ব পালনে সক্ষম।”
সত্যিই কি তাই? দেখা যাক “ওথ” তথা “শপথ”-এর ইতিহাস।
Oath এবং শপথের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
চিত্র – ১ হিপোক্রেটিসের ওথের একটি পুরনো পার্চমেন্ট পেপার। সৌ: নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন
লুডভিগ এডেলস্টাইন ইউরোপের প্রাচীন মেডিসিনের মান্য গবেষক। তাঁর বহুল পঠিত গ্রন্থ Ancient Medicine (ed. Owsei Temkin and C. Lilian Temkin, 1987) হিপোক্রেটিয় “ওথ”-এর ক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে। এডেলস্টাইন তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই জানাচ্ছেন – “The Hipocratic Oath clearly falls into two parts.” (পৃ: ৭)
এই দুটি অংশ কি কি? তিনি বলছেন – প্রথম অংশ হচ্ছে যেখানে ছাত্রদের শিক্ষকের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি কর্তব্য এবং চিকিৎসার জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে ছাত্রদের বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয় কিছু নিয়মকানুনের কথা।
এই ওথ-এর এক জায়গায় রয়েছে – “কোন মানুষের অনুরোধ-উপরোধ আমাকে কোন ব্যক্তিকে বিষপ্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারবেনা; এবং কোন মানুষকে এ ব্যাপারে পরামর্শও দেব না। অধিকন্তু, গর্ভস্থ শিশুকে ধ্বংস করার জন্য আমি কোন গর্ভবতী নারীকে কোন ধরনের ওষুধ দেব না।”
“আরও বলার যে, আমি আমার শপথের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হব এবং আমার জ্ঞানকে দেবানুগতভাবে কাজে লাগাবো।” (Further, I will comport myself and use my knowledge in a godly manner.)
Poison বা বিষ দেবার অংশটি নিয়ে বিভিন্ন শতাব্দীতে, বিশেষত আধুনিক সময়ে, গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে – সে সময়কালের গ্রীসে কি আত্মহত্যা করা বিষপ্রয়োগে মেরে ফেলা একটি সাধারণ প্রাকটিস ছিল, নাহলে এ প্রসঙ্গ আসবে কেন? অ্যারিস্টোটল, প্লিনি, ট্যাসিটাস, অ্যাপুলিয়াস (Apuleius) এবং থিওফ্র্যাসটাসের মতো দার্শনিকদের রচনা উদ্ধৃত করে এডেলস্টাইন দেখিয়েছেন – “যদি অসুস্থ ব্যক্তি অনুভব করে যে তার যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে উঠেছে, যদি কোন সাহায্য পাবার সম্ভাবনা নেই, তাহলে আশা করা যায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের জীবনের ইতি টানত।” আমাদের এক্ষেত্রে ইউথ্যানাশিয়া নিয়ে তুমুল বিতর্কের কথা মনে আসবে নিশ্চয়ই।
পরবর্তী প্রশ্ন আসবে এই ওথের ভিত্তিভূমি হিসেবে কোন দার্শনিক অবস্থান কাজ করেছিল। এডেলস্টাইনের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা – “পিথাগোরীয় দর্শন, সেক্ষেত্রে, একমাত্র দার্শনিক গোঁড়ামি যা সম্ভবত হিপোক্রেটিসের ওথে প্রকাশিত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা করতে পারে।” (পৃ: ১৭) বলার কথা, এ প্রতিপাদ্য বর্তমান গবেষকেরা অনেকেই গ্রহণ করছেন না। এ নিয়ে পরে আলোচনা করেছি।
যাহোক, আমরা বর্তমানের ভারতবর্ষে ফিরি। ১৮৭ বছরের প্রাচীন ভারতের তথা এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজের – ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ – প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ২৩. ০২. ২২ তারিখে প্রথম ক্লাসের আগে “চরক শপথ” পাঠ করানো হয়েছে। হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকার খবর হয়েছে – “Calcutta Medical College students read out ‘Charak Shapath’ during induction (২৩.০২.২২)”। চিকিৎসকমহলের প্রায় সর্বস্তর থেকে এ বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানানোর ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাণ্ডবিয়া আই.এম.এ.-র প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন – “চরক শপথ ছাত্রদের ওপরে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে না এবং এটা ঐচ্ছিক হিসেবে থাকবে, একথা তিনি আই.এম.এ.-র প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছেন।” (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, “Charak Shapath optional, will not be forced: Mandaviya assures IMA”, ২২.০২.২২) যদিও একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল জানিয়েছে যে “চরক শপথ” গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হবে। একটি সার্কুলারে জানানো হয়েছে – “A modified Maharishi Charak Shapath is recommended when a candidate is introduced to medical education.” (ইন্ডিয়া টুডে, ১ এপ্রিল, ২০২২)
এতসবের কারণ কি? কয়েকদিন আগে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার যে সিদ্ধান্ত – এখন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত “হিপোক্রেটিক ওথ” আর নয়, একে প্রতিস্থাপিত করা হবে একেবারে নির্ভেজাল ভারতীয় “চরক শপথ” দিয়ে – এ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কি? কোন রাজনৈতিক dynamics কাজ করছে এর প্রেক্ষাপটে?
এতে একদিকে হয়তো আমাদের নিজস্বতার এক দৃঢ় বিজ্ঞাপন হবে, অন্যদিকে একটি জাতীয়তাবাদী মানসিকতার নবজাগরণ ঘটবে। কিন্তু মুশকিল হল “চরক শপথ” বলে যা বলা হচ্ছে সেটি কর্তিত এবং নবনির্মিত। তাহলে চরক শপথ কি? এবার এ বিষয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হব।
ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের যে শপথ নেওয়ানো হয়েছিল সে শপথটি এবং এর শেষ বাক্যটি নীচে দিলাম। লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে দ্বিজত্বের ধারণাকে বর্তমানের উপযোগী করে প্রসারিত করা হয়েছে। ইতিহাসের গতিপথে সবসময়েই রাষ্ট্র নিজের ক্ষমতাবলে নতুন শব্দার্থ নির্মাণ করে। রাষ্ট্র সবাইকে তার কাঠামোর মধ্যে আত্তীকৃত করতে চায়।
চিত্র – ২
এখানে তিনটি বিষয় বলতে হবে – (১) শব্দটি Charak নয়, সঠিক ইংরেজিতে Caraka, (২) দ্বিজ শব্দটিকে ইংরেজিতে সঠিকভাবে লিখলে Dvija হবে, Dwij নয়, এবং (৩) শব্দটি Shapath নয়, Shapatha (শপথ)। স্বল্প বা অর্ধশিক্ষিতের পাল্লায় পড়ে বেচারা চরক কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন বা কাটাবেন জানি না।
ইংরেজিতে “ওথ” শব্দটির বিভিন্ন অর্থ আছে, যেগুলো সময়ের সাথে বদলে গেছে। পরিবর্তনশীল শব্দার্থের জন্য এডেলস্টাইনের মতো প্রাচীন গ্রেকো-রোমান মেডিসিনের বরেণ্য গবেষক অনেকক্ষেত্রেই “ওথ”-এর পরিবর্তে “covenant” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্যাকরণগতভাবে “ওথ”-এর আমরা তিনটি প্রধান অর্থ পাচ্ছি – (১) “A solemn promise, often invoking a divine witness, regarding one’s future action or behaviour”, (২) “A sworn declaration, such as the promise to tell the truth, in a court of law”, এবং (৩) “A coarse or blasphemous word or phrase used to express anger or other strong emotion”। তাহলে মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণ, আইনি শপথ থেকে কুবাক্য বলা বা গালিগালাজ করা – সবকিছুই ওথ শব্দটি দিয়ে বোঝানো সম্ভব। আমরা সাধারণভাবে প্রথম অর্থটি আমাদের পেশাগত জগতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছি।
এখানে দেরিদাকে দিয়ে সহজ করে বুঝলে দেখা যাবে যে একটি শব্দের মধ্যেকার বিভিন্ন অর্থের মধ্যে ক্রমাগত টানাপড়েন চলে – দেরিদা একে differance বলেছেন। ক্ষমতাসম্পর্কের সাথে শব্দার্থের কোন অংশটিকে যুক্ত করা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে তার ওপরে নির্ভর করে কোন অর্থটি জনসমাজে গ্রাহ্যতা পাবে। বাকী অর্থগুলো থেকে যায়, সম্পূর্ণ মুছে যায়না – trace হিসেবে থেকে যায়। ক্ষমতাসম্পর্ক আবার নির্ধারিত/নির্মিত হয় রাজনৈতিক প্রয়োজন, রাষ্ট্রিক তাগিদ, অর্থনৈতিক শক্তি ইত্যাদি বহুবিধের সমন্বয়ে। আমরা ক্ষমতাসপম্পর্কের সাথে কোন কিছুর being (অস্তিত্বশালী) হয়ে ওঠা বারেবারেই দেখব। যেমন একটু আগে দেখলাম দ্বিজ শব্দটির অর্থ কিভাবে প্রসারিত করা হয়েছে।
মনিয়ের-উইলিয়ামসের সংস্কৃত–ইংরেজি অভিধান থেকে দেখা যাচ্ছে “শপথ” শব্দের প্রথম অর্থটিই রয়েছে (ঋগ্বেদ অনুসরণ করে) অভিশাপ দেওয়া বা বিষোদ্গার করা। দ্বিতীয় অর্থ ওথের অনুগামী।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছে শপথ শব্দটির চারটি অর্থ – (১) আক্রোশ, শাপ (যেমন ইংরেজিতেও দেখেছি), (২) মিথ্যানিরসন, (৩) দিব্যি এবং (৪) নির্ভৎর্সন, উপালম্ভন, এবং অমরকোষ অনুযায়ী শপথ। আমরা শেষ অর্থটি প্রধানত গ্রহণ করেছি।
আজ থেকে ৫০ বছরেরও বেশি আগে (১৯৭০ সালে) আই. এ. মেনন এবং এইচ. এফ. হেবারমানের প্রবন্ধ (“The medical students’ oath of ancient India”) প্রকাশিত হয় মেডিক্যাল হিস্টরি জার্নালে। প্রবন্ধকাররা জানান কেন হিপোক্রেটিসের তুলনায় চরকের “ওথ” বেশি গ্রহণযোগ্য – “এটা সহজেই বোধগম্য যে হিপোক্রেটিক ওথ প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা এবং প্রয়োগের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল – পিথাগোরীয় দর্শনের হাত ঘুরে। অপরদিকে, চরক সংহিতা হচ্ছে সাধারণভাবে বললে প্রাচীন ভারতীয় জীবনের ধারণা এবং প্রয়োগের মূর্তরূপ এবং হিপোক্রেটিসের ওথ যেমন বিদেশী মাটিতে একটি ছোট গোষ্ঠীর মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল সেরকমটা নয়।” অর্থাৎ, ভারত যে “বিশ্বগুরু” হয়ে ওঠার উপযুক্ত এ ধারণা সেসময় থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে ভিন্ন ঢংয়ে, ভিন্ন রূপে প্রচার পেতে শুরু করেছিল। জারিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।
এখানে একাধিক প্রসঙ্গ উঠে আসে। আমাদের মনযোগও আকর্ষণ করবে আশা করি।
প্রথম, একটি বিশেষ সময় এবং প্রেক্ষিতে রচিত মেডিক্যাল এথিক্স তথা ওথ আদৌ অন্য একটি সময়ে (একবিংশ শতাব্দীতে) transferrable কিনা।
দ্বিতীয়, আয়ুর্বেদের “চরক শপথ” বলে যা পরিচিত সে তো প্রাচীন ক্ল্যাসিকাল আয়ুর্বেদের কালে রচিত। বর্তমান সময়ে আয়ুর্বেদের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া বলে পরিচিত মিউলেনবেল্ড (G Jan Meulenbeld, ২০১৭ সালে প্রয়াত হয়েছেন) এবং অন্যান্য আয়ুর্বেদের বিশেষজ্ঞরা সংশয়াতীতভাবে দেখিয়েছেন ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার দশক পর্যন্ত আধুনিক মেডিসিন তথা মেডিক্যাল কলেজের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে আয়ুর্বেদের অভ্যন্তরীণ চরিত্রে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। একে এঁরা বলেছেন নব্য-আয়ুর্বেদ। মিউলেনবেল্ডের magnum opus হল ভারতীয় মেডিসিনের ইতিহাসের ওপরে ৫ খণ্ডে সম্পূর্ণ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পুস্তক History of Indian Medical Literature। মিউলেনবেল্ড বলছেন – “ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আয়ুর্বেদের নবজন্ম ভারতীয় মেডিসিনের একটি একীভূত মডেলের জন্ম দিল। এই মডেল আয়ুর্বেদের মধ্যেকার সেসব অসংলগ্নতা এবং প্রমাণের অসাধ্য ধারণগুলো ছিল সেগুলোকে আধুনিক মেডিসিনের অনুকরণে ছেঁটে ফেলা হল। ফিজিওলজি, প্যাথলজি এবং রোগের বর্গীকরণ সংক্রান্ত পুরনো ঐতিহ্যবাহী শব্দসমূহকে ধৈর্য ধরে নতুন করে ব্যাখ্যা করা হল যাতে পশ্চিমী মেডিসিন থেকে আহরিত মেডিক্যাল টার্মের সাথে এদের সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলা যায়”।
মিউলেনবেল্ডের পরবর্তী সংযোজন – “ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আয়ুর্বেদের নবজাগরণ – ঐতিহাসিকভাবে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা – আয়ুর্বেদের প্রবক্তা এবং অনুগামীদের অনুভব করালো যে এই বিজ্ঞানের এক নতুন রূপরেখা প্রয়োজন যা পশ্চিমী মেডিসিনের সাথে প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে কার্যোপযোগী হয়ে উঠবে … এসমস্ত পদ্ধতির ফলে এক নতুন ধরনের আয়ুর্বেদের উদ্ভব হল যাকে সবচেয়ে ভালোভাবে বলা যায় নব্য-আয়ুর্বেদ কিংবা নিও-আয়ুর্বেদ।” (১ম খণ্ড, ১৯৯৯, পৃ: ২)। এ প্রসঙ্গে আরেকটি লেখা দ্রষ্টব্য – কেনেথ জিস্ক, “New Age Ayurveda or What Happens to Indian Medicine When It Comes to America”।)
মিউলেনবেল্ড আরও বলছেন – “Indian medicine is thoroughly embedded in the culture of the subcontinent and cannot adequately be studied and understood without acquaintance with its history and ways of thought. Conversely, knowledge of medical concepts will certainly illuminate problems that would otherwise remain obscure. Medical treatises abound in material relevant to cultural history, and many nonmedical texts contain data pertaining to medicine, which demonstrates that medical science constitutes an integral part of the Indian civilization.” (পূর্বোক্ত, পৃ: ২) অর্থাৎ, ভারতীয় মেডিসিনের গবাক্ষ দিয়ে ভারতের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে ভালো করে বোঝা সম্ভব। উলটো দিক থেকে দেখলে, ভারতের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রোথিত আয়ুর্বেদ ভারতকে পূর্ণত বোঝার জন্য নিতান্ত জরুরি।
এই নতুন ধরনের আয়ুর্বেদ রাষ্ট্রের সহযোগিতায় কলেজ ও পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে। মেডিক্যাল কলেজের অনুসারী সিলেবাস তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে হাসপাতাল। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের History of Indian Medicine: Containing Notices, Biographical and Bibliographical, of the Ayurvedic Physicians and their Works on Medicine-এর (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৪) ২য় খণ্ডের পাঠ জরুরী। তাঁর প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম হল এরকম – First-year – physics, chemistry, biology and anatomy, dissection and practical training in scientific subjects. Second-year – anatomy, physiology, materia medica, pathology dissection, practical classes, and hospital duty. Third-year – medicine, surgery, midwifery, hygiene, clinical medicine and surgery, labour cases, hospital duty – medical and surgical, and operative surgery. Fourth-year – same as in the third year, medical jurisprudence and history of medicine। (২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬)
ড্যাগমার বেনার তাঁর “The Medical Ethics of Professionalized Ayurveda” (Asian Medicine, January 2005 1(1):185-203) প্রবন্ধে বলছেন – “এটা জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন যে চরকে যেসমস্ত রচনাংশ রয়েছে আয়ুর্বেদের টেক্সটের মেডিক্যাল প্র্যাক্টিসের নৈতিকতা নিয়ে সেগুলো একমাত্র বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অপরপক্ষে, যা আমরা পরে উদ্ধৃত করব, চরকের শপথ আয়ুর্বেদের অন্যত্র পাওয়া যায় এরকম সমস্ত নৈতিক অনুশাসনকে সারসংকলিত করেছে এবং এজন্য কিছু পরিমাণে আয়ুর্বেদীয় নৈতিকতার প্রতিনিধিত্বকারী, যদিও কোনভাবেই সেগুলোর সর্বাঙ্গীণ সারসংক্ষেপ নয়।”
নব্য-আয়ুর্বেদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, জিমারম্যান যেমন বলেছেন, কেবলমাত্র সাম্প্রতিক সময়ে “এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইউরোপীয় মেডিসিনের প্রভাবে আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসকেরা দেহের অভ্যন্তরের ফিজিওলজি সংক্রান্ত ঘটনাসমূহকে মানচিত্রের মতো হুবহু প্রকাশ করেছেন আধুনিক মেডিসিনের ধরনে … অ্যানাটমির যেসব চিত্র আঁকা হয়েছে সেগুলো ইংরেজি হ্যান্ডবুক থেকে পাওয়া চিত্র হয়ে উঠলো, শুধু ইংরেজি শিরোনামগুলো (captions) পরিবর্তন করা হল সংস্কৃত নাম দিয়ে – যাকে এক ধরনের পূর্ববর্তী যৌক্তিকতা (retrospective rationalization) বলা যেতে পারে।” (The Jungle and the Aroma of Meats, পৃ: ১৬৬)
এরকম কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
চিত্র – ৩
চিত্র – ৪
চিত্র – ৫
চিত্র- ৬
এখন স্বাভাবিক নিয়মে প্রশ্ন উঠবে – কোনটি আমরা গ্রহণ করব? নব্য-আয়ুর্বেদে নতুন রূপে এবং চরিত্রে প্রকাশিত প্রফেশনাল আয়ুর্বেদের বর্তমান রূপটিকে কিংবা ক্ল্যাসিকাল আয়ুর্বেদে বর্ণিত শিক্ষক-ছাত্র-রোগী সম্পর্কের ধরনটিকে? পুরনো ধরনটি দিয়ে নতুন ধরনকে আদৌ প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব বা উচিত কিংবা নৈতিক? শুধু তাই নয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল মেডিক্যাল জ্ঞানের জগতকে যেখানে জ্ঞানের নতুন নতুন উপচার, রোগীর অধিকার, লিঙ্গসাম্য ও প্রতিবন্ধীদের অধিকারের জোরালো দাবী, রাজনীতি-বাণিজ্য-কর্পোরেট পুঁজি-মেডিসিনের আন্তঃসম্পর্ক, স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ নিত্যনতুন জটিলতা এবং অন্যান্য বিষয় ক্রমাগত প্রভাবিত করে চলেছে সেখানে প্রায় ২৫০০ বছরের পুরনো একটি শিক্ষাকে আবার তুলে আনা কি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নতুন বিগ্রহ (icon) তৈরি করার চেষ্টা যখন প্রাচীনকে দিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানের অতিরাষ্ট্রিক বিজ্ঞাপন হবে? যেমনটা প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাতে নতুন করে সংযোজন করা হচ্ছে।
তৃতীয়, চরকের শপথ বলে যা বলা হচ্ছে তা আসলে প্রকৃত অর্থে শপথ নয়। চরক সংহিতা-র বিমানস্থানের ৮ম অধ্যায় “রোগভিষগজিতীয়ং”য়ে বর্ণিত (৮.৩ থেকে ১৪ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত) আয়ুর্বেদ কিভাবে পাঠ করা হবে, শিক্ষকের নির্বাচন এবং একজন ছাত্রের নতুন জ্ঞানে দীক্ষা নেওয়ার মতো বিষয়গুলো এসেছে। “Chapter eight, called rogabhivishagjitiya, deals with the study of ayurveda, the selection of a teacher, the method of studying, the method of teaching, and the initiation of a student (8.3-14)” (মিউলেনবেল্ড, পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৪)।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করার যে দৃঢ়বলের দ্বারা চরক সংহিতার যে সংস্কার এবং সংস্কার হবার পরের যে চেহারাকে আমরা মূল চরক সংহিতা বলে জানি সেখানে সংস্কারের পরে মোট ১২০টির মধ্যে ৪১টি অধ্যায় নেই। মিউলেনবেল্ড বলছেন – “Agnivesa’s treatise, as redacted by Caraka, found to be incomplete by one-third, was fully restored by Dridhabala (12.36cd–40ab).” (পূর্বোক্ত, পৃ: ৯১-৯২) চরক সংহিতা-র সিদ্ধিস্থান-এর শেষাংশে বলা হচ্ছে – “এই তন্ত্রের চিকিৎসাস্থানের শেষ সপ্তদশ (১৭) অধ্যায় এবং সিদ্ধি ও কল্পস্থান পাওয়া যায় নাই। দৃঢ়বল নামক এক ব্যক্তি … বহু পরিশ্রমে বহুতন্ত্র হইতে সংগ্রহ করিয়া ইহাতে চিকিৎসাস্থানের সপ্তদশ অধ্যায় এবং কল্প ও সিদ্ধিস্থান যোজনা করেন।” (চরক সংহিতা, অনু: সতীশচন্দ্র শর্মা, ১৯০৪, পৃ: ৮৮৪)
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলছেন – “বিলুপ্ত হবার প্রকৃত কারণ আমাদের জানানো হয়না। এমন কি হতে পারে যে ভারতীয় নীতিপ্রণেতাদের মেডিসিন সম্পর্কে (পড়ুন মেডিসিনের অভ্যন্তরীণ সেক্যুলারিটি) ঘৃণা – তাদের গোঁ যে মেডিসিনের প্র্যাক্টিস সীমাবদ্ধ থাকবে সাংস্কৃতিকভাবে সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের মধ্যে – এসবের কোন প্রভাব পড়ে থাকতে পারে এই জ্ঞানশাস্ত্রের অবহেলা এবং এর একটি বড়ো অংশের হারিয়ে যাবার মধ্যে? দৃঢ়বলের কাছ থেকে আমরা এ বিষয়ে কোন সদুত্তর পাইনা।” (Science and Society in Ancient India, 1977, পৃ: ৩০) দেবীপ্রসাদের গ্রন্থ থেকে আমরা এ তথ্যও জানতে পারি যে অজানা কারণে হঠাৎ করেই চরক সংহিতায় দ্রাবিড় এবং আন্ধ্রকদের ব্যাপারে ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। (পূর্বোক্ত, পৃ: ৩১)
এতগুলো স্তর মাথায় রেখে আমরা “চরক শপথ”-এর বিষয়টি বুঝবো। আগেই বলেছি, চরক সংহিতার বিমানস্থানের ৮ম অধ্যায় “রোগভিষগজিতীয়ং”য়ে বর্ণিত (৮.৩ থেকে ১৪ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত) অংশে প্রথমে বলা হয়েছে কারা চিকিৎসক হতে পারবেন সে বিষয় – “কারণ চিকিৎসকগণের মধ্যে বহুবিধ শাস্ত্র সমাজে প্রচলিত আছে।” (চরক সংহিতা, সম্পা: ব্রজেন্দ্রচন্দ্র নাগ, ২য় খণ্ড, পৃ: ১৩২) এ থেকে বোঝা যায় শুধু চরক সংহিতা নয়, আরও অনেক মেডিক্যাল টেক্সট সেসময়ের সমাজে প্রচলিত ছিল। ধীরে ধীরে চরক সংহিতা একমাত্র কর্তৃত্বকারী টেক্সট হয়ে উঠেছে। অধীত টেক্সটের কি কি গুণ থাকবে? “অল্পবুদ্ধি মধ্যবুদ্ধি ও বিপুলবুদ্ধি এই ত্রিবিধ শিষ্যের যাহা বুদ্ধিগম্য, যাহাতে পুনরুক্তি দোষ নাই, যাহা ঋষিপ্রণীত … যাহাতে কোন শব্দ প্রক্ষিপ্ত হয় নাই অর্থাৎ যাহাতে কোন আধুনিক লেখকের বিষয় সংযোজিত হয় নাই … এইরূপ শাস্ত্রই নির্মল সূর্যের ন্যায় তমোরাশি বিনষ্ট করিয়া সমুদয় প্রকাশ করিয়া থাকে।” (পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩২) এটুকু থেকে স্পষ্ট হয় যে টেক্সটের আধুনিক হওয়া চলবে না। ঐতিহ্যাশ্রয়ী, দৈবনির্ভর এবং ব্রাহ্মণ্য সমাজ অনুমোদিত একটি টেক্সটই অধ্যয়ন করতে হবে।
“শাস্ত্রপরীক্ষার পরে আচার্য পরীক্ষা করিবে।” কি সেই পরীক্ষা? “শাস্ত্রে সন্দেহশূণ্য, দৃষ্টকর্মা, কার্যদক্ষ, অনুকূলস্বভাব, শুদ্ধাচারী, সিদ্ধহস্ত” ইত্যাদি গুণ থাকতে হবে। “শাস্ত্রে সন্দেহশূণ্য” শব্দবন্ধ নজরে রাখতে হবে। অর্থাৎ কোন প্রশ্ন করা চলবে না। প্রশ্নাতীত আনুগত্য নিয়ে শিক্ষালাভ করতে হবে। অন্যত্র বলা হয়েছে যারা প্রশ্ন করে তাদেরকে বাতিল করতে হবে। সম্ভবত চার্বাকপন্থীদের লক্ষ্য করে এ কথাগুলো বলা হয়েছিল।
এরপরের অংশ শিষ্যপরীক্ষার পালা। শিক্ষার্থীদের কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে? “যে প্রশান্তস্বভাব, আর্যবংশীয়, অক্ষুদ্রকর্মা; যাহার চক্ষু মুখ ও নাসাবংশ সরল, জিহ্বা পাতলা রক্তবর্ণ ও নির্মল, দন্ত ও ওষ্ঠ অবিকৃত, যে মিন্মিনভাষী নহে, যে ধৈর্যবান, অনহংকৃত, মেধাবী, তর্কশক্তি ও স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন, উদারচেতা, আয়ুর্বেদবিদবংশজ অথবা আয়ুর্বেদোপজীবী … আচার্যের সমূহ আজ্ঞাবহ ও অনুরক্ত, এইরূপ গুণসম্পন্ন সেই শিষ্যই অধ্যাপনার উপযুক্ত।” (পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৪) অস্যার্থ, আর্যবংশীয় এবং বিশেষ শারীরিক গুণসম্পন্ন ছাত্র শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত। পরিত্যক্ত হল আর্য নয় যারা এবং যাদের শারীরিক অক্ষমতা রয়েছে। নারীর তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। আয়ুর্বেদে রয়েছে “unwaveringly male gaze”।
চরক সংহিতা-র পরে সংকলিত সুশ্রুত সংহিতা-য় ভিন্ন সুর শোনা যায় – “কেহ কেহ বলেন যে, কুললক্ষণসম্পন্ন শূদ্রকেও মন্ত্রভাগ পরিত্যাগপূর্বক (এরা মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারবেনা) দীক্ষিত করা যায়।” (সুশ্রুত সংহিতা, ২য় অধ্যায়, শিষ্যোপনীয়, শ্লোক ৩) এর সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করা এ প্রবন্ধের পরিধির বাইরে। একটি কারণ হতে পারে অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে কায়িক শ্রম এবং দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কুশলতা এদের জন্য এরকম একটি শিক্ষার সম্ভাবনা উন্মুক্ত করেছিল। আর শল্য চিকিৎসা প্রধানত হস্ত নির্ভর কর্ম। এটাও একটা কারণ হতে পারে। কারণ আমরা পরবর্তীতে দেখেছি যারা চরক-নির্ভর ব্রাহ্মণ্যবাদী স্কল্যাস্টিক মেডিসিনের চর্চা করেছে তারা রোগীদের দেহ স্পর্শ পর্যন্ত করত না। আর শল্য চিকিৎসা একটি গোষ্ঠী বা পারিবারিক craft হিসেবে নির্বাসিত হয়েছিল সবচেয়ে নীচুশ্রেণির মধ্যে।
সুশ্রুত সংহিতা-য় এর পরে বলা হয়েছে – “দ্বিজ, গুরু, দরিদ্র, মিত্র, প্রব্রজিত, শরণাগত, সাধু, অনাথ ও আগন্তুকদিগকে আপনার জ্ঞাতি-কুটুম্বের ন্যায় মনে করিয়া আপনার ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করিবে, তাহাতে মঙ্গল হইয়া থাকে।” কাদের চিকিৎসা করবে না? “ব্যাধ, শাকুনিক (যারা পাখীদের হত্যা করে), পতিত ও পাপকারীদের চিকিৎসা করিবে না। এইরূপে আচরণ করিলে বিদ্যা প্রকাশিত হয় এবং মিত্র, যশ, ধর্ম, অর্থ ও কাম লব্ধ হয়।”
এবার আবার চরকে ফিরি। বিমানস্থানের পূর্বোক্ত অধ্যায়ে দীক্ষাগ্রহণের পদ্ধতি হিসেবে “পূর্বদিকে নত বা উত্তরদিকে নত … চতুর্দিকে এক এক হস্ত পরিমিত (সমতল পবিত্রস্থানে) স্থণ্ডিল (যজ্ঞভূমি) করিয়া … আশীর্যুক্ত মন্ত্রদ্বারা ব্রাহ্মণ” ইত্যাদিকে অভিমন্ত্রিত করে দীক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
শিষ্যরা কেমন হবে? “ব্রহ্মচারী, শ্মশ্রুধারী, সত্যবাদী, অমাংসভোজী, পবিত্রভোজী” হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের কঠোর অনুশাসন এখানে স্বতঃই প্রতিভাত হচ্ছে। আচার্যের ক্ষেত্রে “রাজবিদ্বেষজনক, প্রাণহানিকর, অত্যন্ত অধর্মজনক এবং অনর্থক বাক্য ভিন্ন, আমার সকল বাক্যই প্রতিপালন করিবে। তুমি সমস্তই আমাকে অর্পণ করিবে, আমাকে প্রধান বলিয়া জানিবে … উঠিতে বসিতে সর্বদার জন্য সর্বাগ্রে গো-ব্রাহ্মণের তৎপরে সমুদয় প্রাণীর সুখ কামনা করিবে।” (চরক সংহিতা, সম্পা: ব্রজেন্দ্রচন্দ্র নাগ, ২য় খণ্ড, পৃ: ১৩৬) আমরা “অমাংসভোজী” শব্দটি খেয়াল রাখবো। বোঝা যায়, এক বিশেষ খাদ্যবিধির ও সংস্কৃতির মানুষ আয়ুর্বেদ পাঠের উপযুক্ত।
অথচ আশচর্যজনকভাবে চরক সংহিতা-র সূত্রস্থান-এ ২৭ অধ্যায়ে (“অনুপানবিধিমধ্যায়”) ৬১ থেকে ৮৭ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য রোগীর উপযোগী পথ্যের মাংসের তালিকায় রয়েছে (“অথ মাংসবর্গ” শিরোনামে) বিভিন্ন প্রাণীর মাংস যা বিভিন্ন ধরনের রোগীর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রয়োজন পড়ে। এবং এগুলোর বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখনকার সময়েও তালিকা দেখলে আয়ুর্বেদাচার্যদের ব্রাহ্মণ্যবাদের গণ্ডীর বাইরে অবস্থান এবং “সেক্যুলার” দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় – যদিও অনেক মৌলিক চিন্তাতেই আপোষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এঁরা।
যাহোক, কোন কোন প্রাণীর মাংস রোগীর পথ্য হিসেবে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিবেচিত হবে তার তালিকাটি এরকম – শৃমর, চমর, খড়গ, মহিষ, গবর, হস্তী, নঙ্কু এবং শূকর প্রভৃতিকে আনূপ পশু বলে। রুরু প্রভৃতি মৃগরাও আনূপ শব্দের বাচ্য। এই তালিকায় রয়েছে গো, গর্দভ, অশ্বতর, উষ্ট্র, ঘোটক, চিতাবাঘ, সিংহ, ভল্লুক, পেঁচা, ধুমীক অর্থাৎ ফিঙ্গা পাখী, কচ্ছপ, কর্কটক, মৎস্য, শিশুমার, তিমিঙ্গিস, শুক্তি ইত্যাদি। জাঙ্গল পশুদের নাম – পৃষৎ, শরভ, রাম, শ্বদংষ্টা, মৃগমাতৃকা, শশ, উরণ, কুরঙ্গ, গোকর্ণ, কোট্টকারক, চারুষ্ক, হরিণ, এণ, শম্বর, কালপুচ্ছক, ঋষ্য এবং ভরপোত। এর সাথে যুক্ত হবে ছাগ ও মেষ মাংস, ময়ূরের মাংস, কুক্কুট মাংস, গোসাপের মাংস (বলবর্ধনকারী), শজারুর মাংস, শশক মাংস, গোমাংস (“দেহের মাংসক্ষরে বিশেষ হিতকর” বলা হয়েছে), বরাহ ও শূকরের মাংস (স্নিগ্ধকারক বলা হয়েছে), মহিষের মাংস। সবশেষে বলা হচ্ছে – “শরীরপোষকের মধ্যে মাংসাপেক্ষা অন্য কোন খাদ্য শ্রেষ্ঠ নহে।”
বর্তমান ভারতবর্ষে এরকম “বিপজ্জনক” খাদ্যবিধিকে অনুমোদন দেওয়া প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে – যেখানে একইসাথে গরু, মহিষ, শূকর, ময়ূর, শজারু, ভল্লুকের মাংস ভক্ষণের বিধান দেওয়া আছে রোগীর এবং রোগের প্রয়োজন অনুযায়ী। একে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে, নির্বিষ, নিরামিশ এবং নিরীহ করে কেবলমাত্র ফার্মাকোলজির অংশটুকুকে গ্রহণ করে AYUSH-এর মধ্যে নিয়ে এসে একটি একমাত্রিক আয়ুর্বেদ তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যেকার বহুস্তরীয়, বহুত্ববাদী, বহু-অর্থবাহী চরিত্র বিলীন হয়ে বহুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির চিকিৎসা জগতের বাহক আয়ুর্বেদ (মিউলেনবেল্ড, জিমারম্যান এবং অন্যান্য স্কলাররা এমনটাই মনে করেন) পর্যবসিত হয়ে যাবে রাষ্ট্র অনুমোদিত নির্জীব, নিষ্প্রাণ একমাত্রিক একটি চিকিৎসাবিধিতে।
ব্রাহ্মণ-রাজা-রাজত্ব-গোসম্পদকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক সংস্কৃতি চিকিৎসাশাস্ত্র তার সাথে ক্রমাগত আপস করে চলেছে। দেবীপ্রসাদ বলেছেন, এরকম আপোস না করলে প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃত্বকারী সমাজে আয়ুর্বেদের মতো একটি সেক্যুলার চিকিৎসাব্যবস্থা টিকে থাকতে পারত না। কিন্তু এ ধরনের মেডিসিন চর্চার মধ্যে যে নৈতিকতার বনিয়াদ রচনা হয়, সহজেই অনুধাবন করা যায়, সেটা একান্তই বিশেষ সমাজ-সংস্কৃতি নির্ভর, সার্বজনীন নয়। একবিংশ শতকে একে transfer/translocate করা যায় না।
“রাজদ্বিষ্ট (যে রাজার কুপিত নজরে) বা রাজদ্বেষী এবং মহাজনদ্বিষ্ট বা মহাজনদ্বেষী ব্যক্তিগণকে ঔষধ প্রয়োগ করিবে না। যাহারা অত্যন্ত বিকৃতাচারী, দুষ্টস্বভাব, দুঃশীলাচারী, অপচারী, যাহারা অপবাদের প্রতিকার করে না, যাহারা মুমূর্ষু এবং যে সকল স্ত্রীলোকের স্বামী বা অধ্যক্ষ (মালিক) উপস্থিত নাই, এইরূপ লোকসকলকেও ঔষধ প্রয়োগ করিবে না।” (পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৭)
কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রসঙ্গ পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় – “আতুরকুলসম্বন্ধীয় বিষয় সকল বাহিরে প্রকাশ করিবে না। আতুরের আয়ুঃ হ্রাস হইয়াছে ইহা জানিতে পারিলেও, যেখানে বলিলে রোগী বা রোগীর অন্য কোন ব্যক্তির প্রাণহানিকর হইবে, সেখানে তাহা প্রকাশ করিবে না।” (পূর্বোক্ত, পৃ: ১৩৮)
এখানে হিপোক্রেটিক ওথের সাথে চরকের ধারণার পার্থক্য ঘটে যায়। ওথ-এ বলা হয়েছে – রোগী চাইলেও তাকে কোন ধরনের বিষ দেওয়া যাবে না। চরকে বলা হচ্ছে – “আতুরকুলসম্বন্ধীয় বিষয় সকল বাহিরে প্রকাশ করিবে না। আতুরের আয়ুঃ হ্রাস হইয়াছে ইহা জানিতে পারিলেও, যেখানে বলিলে রোগী বা রোগীর অন্য কোন ব্যক্তির প্রাণহানিকর হইবে, সেখানে তাহা প্রকাশ করিবে না।” দুটো বিষয়বস্তুর মধ্যে মূলগত ফারাক রয়েছে।
হিপোক্রেটিক ওথ এবং তার বিবর্তন
এই ওথ-এর একটি অংশে আছে – “1 will apply dietetic measures for the benefit of the sick according to my ability and judgment; 1 will keep them from harm and injustice.
1 will neither give a deadly drug to anybody if asked for it, nor will 1 make a suggestion to this effect. Similarly 1 will not give to a woman an abortive remedy. ln purity and holiness I will guard my life and my art.”
এ অংশটি নিয়ে বিপুল বিতর্ক চলেছে, প্রাণবন্ত আলোচনা চলেছে, অসংখ্য মতামত উঠে এসেছে। আবার নতুন করে সংশোধিত হয়েছে। যেমনটা হবার কথা গতিশীল চলমান বৌদ্ধিক জগতে (চরকের শপথের মতো যদি অপরিবর্তনীয় বা অভ্রান্ত না হয়)। এরপরে বিভিন্ন সংশোধনী হয়েছে। এরমধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ১৯৪৮ সালে ডিক্লেয়ারেশন অফ জেনেভা এবং ১৯৪৯ সালে ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ইন্টারন্যাশনাল কোড অফ মেডিক্যাল এথিক্স। মনে রাখতে হবে এর অব্যবহিত আগে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন “হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট” নিয়ে চিকিৎসকদের ভূমিকা শক্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সমগ্র বিশ্বের মানুষ এবং চিকিৎসকেরা চিকিৎসাপেশার নৈতিকতা নিয়ে প্রবলভাবে আলোড়িত। এর অভিঘাতে এই নতুন কোড অফ এথিক্সগুলো জন্ম নেয়। ভারতে এর বিশেষ কোন অভিঘাত সৃষ্টি হয়নি। ফলে তেমনভাবে প্রভাবও পড়েনি।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (২২-২৯ ডিসেম্বর, ২০০১) প্রকাশিত হয়েছিল “Medical oaths and declarations” শীর্ষক প্রবন্ধ। এখানে বলা হল – “The increasing complexity of healthcare arrangements and interagency collaboration, and the need to look at rationing resources, has forced the medical profession to reexamine its core values.” ২০০৪ সালে প্রকাশিত স্টিভেন এইচ. মাইলস-এর লেখা The Hippocratic Oath and the Ethics of Medicine-এ জোর দেওয়া হয়েছিল “মানসিক রোগী অথবা সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে রোগীদের কি অবস্থান হবে নৈতিকতার প্রশ্নে এ বিষয়ে কিছু জানা যায়না।” (পৃ: vii) সঙ্গে এটাও বলা হয়েছিল – “It comes from an ancient culture that, though ancestral to ours, was very different.” (p. v)
Different হবার স্বীকৃতি চরক শপথে নেই। আমরা একে সরিয়ে রেখেছি। রাষ্ট্র সমস্তকিছুকে সমসত্ত্ব করতে চায়।
এরকম পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় প্রকাশিত হল “Hippocratic Oath: Modern Version”। সমগ্র ভার্সনটি এরকম –
I swear to fulfill, to the best of my ability and judgment, this covenant:
I will respect the hard-won scientific gains of those physicians in whose steps I walk, and gladly share such knowledge as is mine with those who are to follow.
I will apply, for the benefit of the sick, all measures [that] are required, avoiding those twin traps of overtreatment and therapeutic nihilism.
I will remember that there is art to medicine as well as science, and that warmth, sympathy, and understanding may outweigh the surgeon’s knife or the chemist’s drug.
I will not be ashamed to say “I know not,” nor will I fail to call in my colleagues when the skills of another are needed for a patient’s recovery.
I will respect the privacy of my patients, for their problems are not disclosed to me that the world may know. Most especially must I tread with care in matters of life and death. If it is given me to save a life, all thanks. But it may also be within my power to take a life; this awesome responsibility must be faced with great humbleness and awareness of my own frailty. Above all, I must not play at God.
I will remember that I do not treat a fever chart, a cancerous growth, but a sick human being, whose illness may affect the person’s family and economic stability. My responsibility includes these related problems, if I am to care adequately for the sick.
I will prevent disease whenever I can, for prevention is preferable to cure.
I will remember that I remain a member of society, with special obligations to all my fellow human beings, those sound of mind and body as well as the infirm.
If I do not violate this oath, may I enjoy life and art, respected while I live and remembered with affection thereafter. May I always act so as to preserve the finest traditions of my calling and may I long experience the joy of healing those who seek my help.
—Written in 1964 by Louis Lasagna, Academic Dean of the School of Medicine at Tufts University, and used in many medical schools today.
২০০৬ সালের জেনেভা ডিক্ল্যায়েরেশনকে গ্রহণ করেছে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। এর সর্বশেষ রূপ এরকম –
Declaration of Geneva (WMA, 2006)
At the time of being admitted as a member of the medical profession:
I solemnly pledge to consecrate my life to the service of humanity;
I will give to my teachers the respect and gratitude that is their due;
I will practise my profession with conscience and dignity;
The health of my patient will be my first consideration;
I will respect the secrets that are confided in me, even after the patient has died;
I will maintain, by all the means in my power, the honour and the noble traditions of the medical profession;
My colleagues will be my sisters and brothers;
I will not permit considerations of age, disease or disability, creed, ethnic origin, gender, nationality, political affiliation, race, sexual orientation, social standing or any other factor to intervene between my duty and my patient;
I will maintain the utmost respect for human life;
I will not use my medical knowledge to violate human rights and civil liberties, even under threat;
I make these promises solemnly, freely and upon my honour.
শেষ কথা
ক্রমপরিবর্তনশীল চরিত্রই মেডিসিন, জ্ঞান, সমাজ এবং এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ মেডিক্যাল এথিক্সের জীয়নকাঠি। এভাবেই সমাজ ও জীবন এগোয়। পুরাতনের আরাধনার জন্য তাকে নতুন মোড়কে নির্মাণের পেছনে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্য কাজ করে। আমরা এই সময়ের সাক্ষী।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, প্রাচীন মেডিসিনের মান্য গবেষক পূর্বোদ্ধৃত এডেলস্টাইনের Ancient Medicine গ্রন্থে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে – হিপোক্রেটিসের ওথ পিথাগোরীয় দর্শনের উপজাত – আধুনিক গবেষকদের একটি শক্তিশালী অংশ ভুল প্রমাণ করেছেন বা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। স্টিভেন এইচ. মাইলস-এর পূর্বোক্ত পুস্তকে মাইলস বলছেন – “প্রাচীন গ্রীস সম্পর্কে অধিকাংশ স্কলারই হিপোক্রেটিয় ওথ যে পিথাগোরীয় দার্শনিকদের লেখা এ ব্যাপারে সন্দিহান।” (পৃ: ৩০) আমি একজনমাত্র গুরুত্বপূর্ণ গবেষকের গবেষণাপত্রের একটি অংশ উদ্ধৃত করছি – “Ludwig Edelstein’s influential but disputed hypothesis that the Oath belongs to a Pythagorean context fails to account satisfactorily for this feature of the Oath: the Oath’s concluding prayer and imprecation do not correspond to the aspirations shaped by a Pythagorean belief in the transmigration and reincarnation of the soul after death.” (H. Von Staden, “”In a pure and holy way:” Personal and professional conduct in the Hippocratic Oath”, Journal of the History of Medicine and Allied Sciences, 1996, 51(4): 404-437) আধুনিক চিকিৎসক এবং গবেষকেরা একে নাকচ বা অগ্রাহ্য করেননি।
আমরা কি চরকের ক্ষেত্রে এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে সক্ষম? না কি একটি কল্পিত, ছেদহীন, ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতবর্ষকে প্রতিষ্ঠা করার অতিরাষ্ট্রিক উদ্যোগকে প্রশ্নহীন আনুগত্যসহ মেনে নেব?
যদি ইউরোপ আমেরিকার অভিজ্ঞতায় দেখি তাহলে এই প্রশ্নহীন আনুগত্য গবেষকদের একটি বৃহদংশ মেনে নেননি। তাঁরা বারংবার রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের শিক্ষাক্রমে শিক্ষিত “টর্চার ডক্টরস” এবং system-কে প্রশ্ন করেছেন। স্টিভেন মাইলস ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর পুস্তক Oath Betrayedঃ America’s Torture Doctors থেকে জানতে পারি – “A 2004 posting of the “Interrogation Rules of Engagement” at the Abu Ghraib military prison stated that the following techniques required the approval of the commanding general: dietary and environmental manipulation, “sleep adjustment, isolation for longer than 30 days, presence of military working dogs . . . sensory deprivation, [and] stress positions.”
আমাদের এখানে যে ডিটেনশন সেন্টারগুলো তৈরি হয়েছিল ডি-ভোটারদের জন্য সেগুলোর অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ আমরা হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবনা। এবং সেখানে ডাক্তারদের ভূমিকা কি ছিল তাও অজানা থেকে যাবে। হিপক্রেটিসের ওথ নিয়ে প্রশিক্ষিত ইউরো-আমেরিকান ডাক্তাররা অন্তত প্রশ্ন তুলেছেন, তুলে যাচ্ছেন – বারংবার, বিরামহীনভাবে। “চরক শপথ”-এ সিঞ্চিত চিকিৎসকরা কি ভারতে এ প্রশ্ন তুলতে পারবেন?
চিত্র – ৭ A Detainee at the Abu Ghraib Prison in Baghdad, Iraq, Receiving Medical Attention. NEJM
চিত্র ৮ আবু ঘ্রাইবে মৃত ইরাকী বন্দীর দেহকে নিয়ে নারী মিলিটারির উল্লাস – Divne Comedy!)
চিকিৎসকেরা খুব স্পষ্টভাষায় উচ্চারণ করতে পারে এবং করা উচিত যে মেডিক্যাল এথিক্সের যে মান আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত হয়েছে (এ প্রবন্ধে শেষাংশে আলোচিত) তাকে রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা। কিন্তু চিকিৎসকেরা নিজেরা সরকারি নীতি এবং এর প্রয়োগকে সংস্কার করতে পারবে না। তবে সংঘবদ্ধভাবে একটি “pressure group” হিসেবে কাজ করতে পারে।