সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বিবর্তন ও গ্রেগর যোহান মেন্ডেল

বিবর্তন ও গ্রেগর যোহান মেন্ডেল

জয়ন্ত দাস

আগস্ট ২০, ২০২২ ৬০৯ 0

২০ জুলাই, ২০২২ সালে মেন্ডেলের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী ছিল। তাঁর স্মরণে এই লেখা।

প্রাক-কথন

গ্রেগর যোহান মেন্ডেল। আধুনিক জিনশাস্ত্রের জনক। তাঁর বয়স দুশো বছর হল। আধুনিক জীবনবিজ্ঞানের ধারায় তাঁর গবেষণার গুরুত্ব বা অবদান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁর সেই আশ্চর্য কাজ ফিরে দেখার চেষ্টা করলাম।

বংশগতির মূলসূত্র লুকিয়ে আছে ডিএনএ-র গভীরে, এই বিষয়টি জানা গিয়েছে হালে, একশ বছরও পেরোয়নি। তার আগেও পারিবারিক সূত্রে মানুষ বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা বহিরঙ্গের ধর্ম কীভাবে পেয়ে থাকে, সে নিয়ে চিন্তাভাবনার অভাব ছিল না। পশ্চিমদেশে পিথাগোরাস যেমন ভেবেছিলেন, বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের পুরোটাই মানুষ পেয়ে থাকে বাবা, তথা শুক্রাণুর কাছ থেকে—মায়ের ভূমিকা সেখানে বিশেষ কিছু নেই। হ্যাঁ, ইনি জ্যামিতির উপপাদ্যের সেই পিথাগোরাসই বটেন। সেসময়ে তো অত স্পেশালাইজেশনের কড়াকড়ি ছিল না, অঙ্কের হিসেব সামলানোর ফাঁকে বংশগতি নিয়েও দুচারটে কথা কইলে কেউই সেটাকে খারাপ চোখে দেখতেন না। পরবর্তীতে অবশ্য অ্যারিস্টটল বলেন, না, বংশগতি শুধুই বাবার ব্যাপার নয়—মানুষ বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের অর্ধেক পায় বাবার কাছ থেকে, বাকি অর্ধেক মায়ের অবদান।

মেন্ডেল এইসব যা-ইচ্ছে-তাই বলার অবসান ঘটালেন, উত্তরাধিকার-সূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্যকে প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলেন। তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা প্রকাশের প্রায় দুই দশক পরে তিনি মারা যান ১৮৮৫ সালে। মৃত্যু-পরবর্তী শোকসংবাদে গবেষক মেন্ডেলের সামান্য উল্লেখটুকুও ছিল না। কোন বিজ্ঞানপত্রিকা বা বিজ্ঞানীদের কোন সংগঠন তাঁর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেননি। মঠ থেকে প্রকাশিত শোকবার্তায় শুধু বলা ছিল, নরম মনের মানুষটি বড্ড ফুল ভালোবাসতেন। এতখানিই অনাবিষ্কৃত ছিল তাঁর গবেষণা!

পর্ব ১

ভ্যান গগ তার জীবদ্দশায় নিজের আঁকা ৯০০ পেইন্টিং-এর মধ্যে একটিমাত্র পেইন্টিং বিক্রি করতে পেরেছিলেন বলে জনশ্রুতি। ১৮৯০ সালে তিনি ব্রাসেলসে ‘দি রেড ভাইনইয়ার্ড’ ছবিটি মাত্র ৪০০ বেলজিয়ান ফ্র্যাঙ্কে বিক্রি করেন। আসলে ভ্যান গগের আরও দু-একটি পেইন্টিং ও স্কেচ সামান্য মূল্যে তাঁর জীবদ্দশায় বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু তাতে মূল কথাটা পালটায় না। এখন সব চাইতে বেশি দামে বিক্রিত হয় এই শিল্পীর ছবি—মৃত্যুর পরে শিল্পীকে মানুষ পুনরাবিষ্কার করে।

ভ্যান গগের জীবদ্দশায় তাঁর ‘একমাত্র’ বিক্রিত ছবি ‘দ্য রেড ভাইনইয়ার্ড’।

১৮৬৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেগর যোহান মেন্ডেল ব্রুন সোসাইটি ফর ন্যাচারাল সায়েন্সের অধিবেশনে তাঁর গবেষণা পেশ করেন—‘উদ্ভিদ সংকরায়নের উপর পরীক্ষা’। পরের বছর সেটি সোসাইটির জার্নালে ছাপা হয়। (তথ্যসূত্র ১) ‘বাঃ, বেশ, খাসা’ বলে পিঠ চাপড়ানির বেশি কিছু সেই পেপারের ভাগ্যে জোটেনি। কেউ তার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। হয়তো ভ্যান গগের মতই মেন্ডেল তাঁর সময়ের চেয়ে খুব বেশি এগিয়ে ছিলেন। বংশগতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে ধারণা জনপ্রিয় ছিল, মেন্ডেলের কাজ ছিল সেই ধারণার বিপরীত। মেন্ডেল নাকি একবার বলেছিলেন, “আমার সময় আসবে।” তাঁর সময় সত্যিই এসেছিল, ভ্যান গগের মতো মেন্ডেলকেও পুনরাবিষ্কার করা হয়েছিল। ক্যাথলিক মঙ্ক মেন্ডেল হয়তো বলতেন, এই তাঁর পুনরুত্থান!

মেন্ডেলের অনাদৃত গবেষণাপত্র।

গ্রেগর যোহান মেন্ডেল

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ডারউইনের তত্ত্ব আর বংশগতি, এই দুটোকে বিজ্ঞানীরা কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। ফলে প্রায় ১৯৩০ সাল অবধি ডারউইনবাদ বিজ্ঞান হিসেবে পুরো প্রতিষ্ঠা পায়নি। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বলেছিল, কোনও জনগোষ্ঠীতে প্রতিটি সদস্যের কিছু নিজস্ব ও পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে। যে কোনও উপকারী বৈশিষ্ট্য সেই ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায় ও তা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। এটাই হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই প্রক্রিয়াটির ফলে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি তৈরি হতে পারে।

ডারউইনের প্রস্তাবের সমর্থনে অজস্র তথ্য থাকলেও একটি গুরুতর ত্রুটি ছিল। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে কীভাবে বৈশিষ্ট্যগুলি সঞ্চারিত হবে, সেই বিষয়ে ডারউইনের কোনও ব্যাখ্যা জানা ছিল না। সেই সময়ে উত্তরাধিকারের প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে, পিতামাতার বৈশিষ্ট্যগুলি বংশধরদের মধ্যে মিশ্রিত হয়। এমন হলে যে কোনও উপকারী বৈশিষ্ট্য কয়েক প্রজন্মের মধ্যে জনগোষ্ঠীর সকলের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে হারিয়ে যাবে।

ডারউইনের ‘অরিজিন’ বইটি প্রকাশের কয়েক বছরপরে ফ্লিমিং জেনকিন ডারউইনের তত্ত্বের এই গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিটি দেখান। জেনকিন-এর বলা একটি গল্পের মধ্যে তার যুক্তির সারমর্ম ধরা যায়। রবিনসন ক্রুশো-র আদলে এক জাহাজডুবির ফলে দ্বীপে নির্বাসন পাওয়া এক শ্বেতাঙ্গের কাহিনী বলেন জেনকিন।

“… ধরুন, কোনও সাদা মানুষ জাহাজডুবির ফলে একটি কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুসিত দ্বীপে গিয়ে উঠলেন … আমাদের জাহাজডুবির নায়ক সম্ভবত রাজা হয়ে উঠবেন, তিনি অস্তিত্বের জন্য লড়াইয়ে অনেক কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করবেন; তার অনেক স্ত্রী এবং সন্তান থাকবে, অন্যদিকে তার অনেক [কৃষ্ণাঙ্গ] প্রজার কোনোদিনই বিয়ে হবে না … আমাদের সাদা-চামড়ার গুণাবলি অবশ্যই তাকে অনেক বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে, তবুও তিনি কোনোভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার প্রজাদের বংশধরদের সাদা করার জন্য যথেষ্ট কিছু করতে পারবেন না …

প্রথম প্রজন্মে কয়েক ডজন বুদ্ধিমান তরুণ মুলাটো হবে, যারা কৃষ্ণাঙ্গদের গড় বুদ্ধির চাইতে তুলনায় অনেক বেশি উন্নত হবে। আমরা আশা করতে পারি কয়েকটি প্রজন্ম ধরে সিংহাসনে কম-বেশি হলদেটে গাত্রবর্ণের রাজা বসবে; তবে এমন কি বিশ্বাস করা সম্ভব যে, পুরো দ্বীপটি ধীরে ধীরে একটি সাদা, এমনকি একটি হলুদ জনগোষ্ঠীতে ভরে যাবে?

এখানে এমন একটি ঘটনা বলা হচ্ছে যেখানে একটি নতুন মনুষ্যগোষ্ঠী এসে যে কোনও সম্ভাব্য অবস্থানের চাইতে বেশি সুবিধা [শ্বেতবর্ণ মানুষের অন্তর্জাত গুণাবলী এই সুবিধা দেয় বলে জেনকিন মনে করেছেন —অনুবাদক] পেল। সেই সুবিধাগুলো এমন, যা নিজের সংরক্ষণের সম্ভাবনা বাড়ায়। তা সত্ত্বেও নতুন একটি ‘উন্নততর’ মনুষ্যগোষ্ঠী স্থায়ীভাবে সৃষ্টি করা গেল না। (তথ্যসূত্র ২)

আজকের দিনে ফ্লিমিং জেনকিনকে চূড়ান্ত বর্ণবাদী না বলে উপায় নেই। কিন্তু তার প্রশ্নটিকে ডারউইন উপেক্ষা করতে পারেননি। কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বা প্রকরণ সত্যিই বেঁচে থাকার সুবিধা দেয়, যেমন হরিণের লম্বা পা। এমন প্রকরণ যদি পরের প্রজন্মে সংরক্ষিত না থাকে, যদি অন্য প্রকরণের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে, তাহলে অভিযোজন কেমন করে ঘটবে? বিবর্তন কেমন করে সম্ভব হবে? যদি কোনও সুবিধাজনক প্রকরণ নতুন করে কোনও জীবগোষ্ঠীতে উদ্ভূত হয়, তা পরের প্রজন্মগুলোতে পুরনো (অসুবিধাজনক) প্রকরণের সঙ্গে ক্রমগত মিশে যেতে থাকলে কী করে জীবের মধ্যে নতুন গুণের উদ্ভব হতে পারে? সেক্ষেত্রে ডারউইনের গোটা তত্ত্বটাই ভেঙ্গে পড়ে।

পর্ব ২

মানুষ সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যযুক্ত পশু বা গাছের বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে বহু প্রজন্ম ধরে অনেক পরিবর্তন সাধন করেছে। এটা হল কৃত্রিম নির্বাচন। রেসের ঘোড়া যারা পালন করেন তাদের কাছে প্রতিটি ঘোড়ার বংশলতিকা থাকে। একজোড়া রেসের ঘোড়ার মিলন ঘটিয়ে বাচ্চা হবার আগে তাদের দুজনের বংশে রেস জেতা ঘোড়া কতজন ছিল, সেটা মিলিয়ে দেখা হয়। পাকা রেসুড়েরা বংশলতিকা দেখে ঘোড়া পেছনে বাজি ধরেন। এইভাবে রেসের ঘোড়ার গতিবেগ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেড়েছে। একই ভাবে, প্রকৃতির মধ্যে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে ফারাকগুলো একসাথে সঞ্চিত হয়ে বড় পরিবর্তন করতে পারে। বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল ফারাক বা প্রকরণগুলো (variance) প্রকৃতি দ্বারা সংরক্ষিত হয়, আর প্রতিকূল প্রকরণগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। এটাই হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। (তথ্যসূত্র ৩)

ডারউইনের তত্ত্ব জীবগোষ্ঠী বা জীবপ্রজাতির মধ্যে প্রকরণ থাকার ওপরে নির্ভরশীল। আর এখানেই জেনকিন-এর বক্তব্যের গুরুত্ব আছে। কোনও জনগোষ্ঠীতে শুরুতে প্রকরণ থাকলেও, যৌন জননের ফলে সেই প্রকরণ ক্রমশ কমে যাবে। তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কিসের ওপর ভিত্তি করে কাজ করবে? ডারউইনবাদের বিরুদ্ধে এই যুক্তিটি ‘সোয়াম্পিং আর্গুমেন্ট’ নামে খ্যাত। ‘সোয়াম্প’ (Swamp) মানে জলাজমি। জলাতে শুকনো কিছু রাখলে তা শুকনো থাকে না, জলে ভিজে যায়। তেমনই একটি প্রজাতিতে কোনও নতুন বৈশিষ্ট্য বা প্রকরণ উৎপন্ন হলেও তা বজায় থাকে না, সেই প্রজাতির পুরনো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিশে যায়। সোয়াম্পিং আর্গুমেন্টকে আমরা রং মেশানোর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। যদি হলুদ রঙের সঙ্গে নীল রং মেশানো হয় তাহলে পুরো হলুদ বা পুরো নীল কখনই আসবে না, আসবে সবুজ রং। বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলো যৌন জননের ফলে মিশে যাবে, আর তা থেকে আদি প্রকরণটি পাওয়া কখনই সম্ভব হবে না।

চার্লস ডারউইন

ডারউইন প্রজাতির মধ্যে প্রভেদ বা প্রকরণ সংরক্ষণের গুরুত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু কেমন করে প্রকরণ আসে, কেমন করে তা প্রজাতি ও জীবগোষ্ঠীতে সংরক্ষিত হয়, সে কথা তিনি বলতে পারেননি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি নিজস্ব ‘প্যানজেনেসিস’ তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন। (তথ্যসূত্র ৪) কেমন করে যথেষ্ট প্রকরণ তৈরি হতে পারে এই তত্ত্ব তার ব্যাখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু এই তত্ত্বের অন্য বড় সমস্যা ছিল। জীবের বেঁচে থাকার সময়ে তার অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকার-সূত্রে পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হয়, প্যানজেনেসিস তত্ত্ব এমন ধরে নিয়েছিল। সেটা ভুল ও বিবর্তনের অনেক ঘটনা তা ব্যাখ্যা করতে পারে না।

১৮৫৯ সালে, ডারউইনের ‘অরিজিন’ প্রকাশের মাত্র সাত বছর পরে, গ্রেগর যোহান মেন্ডেল পরীক্ষা করে দেখালেন, যৌন জননের ফলে প্রকরণগুলো মিলে-মিশে বিলীন হয়ে যায় না। (তথ্যসূত্র ৫) এই পরীক্ষার ফলাফল একটি অখ্যাত জার্নালে ছাপা হয়। মেন্ডেল তখনকার অনেক বিখ্যাত জীববিজ্ঞানীকে তাঁর গবেষণাপত্রটির কপি পাঠিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত ডারউইনকেও একটি কপি তিনি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডারউইন হয় তা পড়েননি, অথবা বিবর্তনতত্ত্বের ক্ষেত্রে তার প্রাসঙ্গিকতা বুঝে উঠতে পারেননি। (তথ্যসূত্র ৬,৭,৮)

মেন্ডেলের গবেষণার প্রকৃত তাৎপর্য তাঁর সমসাময়িক কোনও বিজ্ঞানীই বুঝে উঠতে পারেননি। ফলে বিজ্ঞানের জগত থেকে মেন্ডেল তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘হারিয়ে’ গিয়েছিলেন।

১৯০০ সাল নাগাদ এই পরীক্ষার ফলাফলের গুরুত্ব কিছু বিজ্ঞানীর নজরে আসে, এবং বর্তমানে এটি জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে বিখ্যাততম পরীক্ষাগুলোর একটি বলে বিবেচিত হয়। জীবের বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য কেমন করে পরের প্রজন্মে যায়, বৈশিষ্ট্যগুলি কেন একে অপরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায় না, সে সম্পর্কে কিছু সুনির্দিষ্ট ধারণা মেন্ডেলের গবেষণায় পাওয়া গিয়েছিল।

আমরা এখন জানি, জিন হল বংশগতির একক। মেন্ডেল অবশ্য জিন কথাটি ব্যবহার করেননি, তিনি বলেছিলেন ‘ফ্যাক্টর’। ‘ফ্যাক্টর’ বা ‘জিন’ জননকোষের মাধ্যমে বাহিত হয়, আর জীবের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদা করে বহন করে। ভ্রূণ সৃষ্টির সময় দুটি বিপরীত প্রকরণ (যেমন নীল চোখ ও বাদামি চোখ) বহন করা ‘ফ্যাক্টর’ একত্রিত হয়। ভ্রূণ পূর্ণাঙ্গ জীবে পরিণত হয়, তার জননকোষে ফ্যাক্টর-দুটি আলাদা হয়ে যায়। ফলে কোনও জনগোষ্ঠীতে নতুন প্রকরণের উদ্ভব হলে তা যৌন জননের মাধ্যমে হারিয়ে যায় না। এই কথাগুলি মেন্ডেলের পরীক্ষায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অন্য ভাষায় বললে, জেনকিন যে ‘সোয়াম্পিং আর্গুমেন্ট’ দিয়েছিলেন, তা সত্যি নয়।

পর্ব ৩

মেন্ডেল ছিলেন এক মঠবাসী খ্রিস্টান সন্ন্যাসী, এবং জেনেটিক্স বিজ্ঞানের গাণিতিক ভিত্তি তথা মেন্ডেলিজম-এর জনক। ১৮২২ সালে তাঁর জন্ম, তিনি ছিলেন ডারউইনের চাইতে ১৩ বছরের ছোট। মৃত্যু ১৮৮৪ সালে, ডারউইনের মৃত্যুর দু’বছর পরে। জার্মানভাষী সাইলেশিয়ার গ্রামাঞ্চলে সাধারণ অবস্থার এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যোহান মেন্ডেল। ছোটবেলায় পড়াশুনায় ভাল বলে স্থানীয় চার্চের এক পুরোহিত তাঁকে পড়াশুনা চালাতে সাহায্য করেন। তিনি  ইউনিভার্সিটিতে দু’বছরের জন্য পদার্থবিদ্যা এবং গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর তিনি মঠে (মনাস্ট্রি-তে) শিক্ষানবিশ সন্ন্যাসী হিসেবে যোগ দিলেন। মঠ থেকে তাঁকে মোরাভিয়ার রাজধানী ব্রুন-এ পাঠানো হয়, আর এখানেই প্রথম তিনি এক বৈচিত্র্যময় বৌদ্ধিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচিতি হন। মঠের প্রধান তাঁকে বিকল্প-শিক্ষক হিসেবে কাজের ব্যবস্থা করে দেন।  

শিক্ষক হিসেবে সফল হলেও তিনি শিক্ষক হবার জন্য দরকারি সার্টিফিকেট পাবার পরীক্ষায় ব্যর্থহন। তখন মঠ থেকে তাঁকে ভিয়েনায় পড়াশুনা করতে পাঠানো হয়। ভিয়েনাতে বিখ্যাত নানা বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় তাঁর। এখানেই তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ফ্রানজ উঙ্গারের অধীনে মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার শেখেন। উঙ্গার বিবর্তনের সমর্থক ছিলেন, তবে তখনও ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশিত হয়নি। শিক্ষা শেষে মেন্ডেল মঠে ফিরে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরের দীর্ঘ চোদ্দ বছর তাঁর এখানেই কাটে। এই বছরগুলিতে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাতেকলমে উদ্ভিদ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। অবশ্য এরপর তিনি ‘অ্যাবট’ পদে উন্নীত হন ও প্রশাসনিক দায়দায়িত্বে তাঁর বেশিরভাগ সময় চলে যায়। ফলে বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা অনেক কমে যায়। 

ভিয়েনা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মঠে আসার পরেই মেন্ডেল মঠের জমিতে পরীক্ষানিরীক্ষা করার দায়িত্ব পান। তিনি উদ্ভিদের সংকরায়ন (হাইব্রিডাইজেশন) এর একটি বড় পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করেন। দুটি পৃথক বৈশিষ্ট্যযুক্ত উদ্ভিদের পরাগ-সংযোগ ঘটিয়ে সংকর উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায়। সেই সংকর উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করতে চাইলেন তিনি। দেখতে চাইলেন, সংকর উদ্ভিদের বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলি বংশ-পরম্পরায় কীভাবে পরিবাহিত হয়। মঠের কর্মকর্তারা অবশ্য অকারণে এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উৎসাহী হননি, এর একটি অর্থনৈতিক দিক ছিল। মঠের আয়ের একটা বড় উৎস ছিল মেরিনো ভেড়ার পাল ও তার পশম বিক্রি। সেই সময় অস্ট্রেলিয়াথেকে ইউরোপে কম দামে পশম আমদানি হচ্ছিল ও মঠের পশম থেকে লাভ কমছিল। তাই সংকর প্রাণী ও উদ্ভিদের গুনাগুণ নিয়ে মঠ কর্তৃপক্ষের বিশেষ চিন্তা ছিল।

মেন্ডেল মটরগাছ (বিজ্ঞানসম্মত নাম Pisum sativum) নিয়ে তাঁর পরীক্ষা করেছিলেন। মঠের জমিতে সহজে এই গাছের চাষ করা যেত। তাছাড়া তাঁর পরীক্ষাতে একটি গাছের পরাগ নিয়ে অন্য একটি নির্দিষ্ট গাছের পুষ্প নিষেক করা দরকার ছিল, আর সেটা মটরগাছে করা সহজ। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ৩৪ ধরণের মটর গাছ পরীক্ষা করে সাতজোড়া বিপরীত-বৈশিষ্ট্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন। গাছটির উচ্চতা (বেঁটে বা লম্বা), বীজের বর্ণ (সবুজ বা হলুদ), বীজের খোসার চরিত্র (মসৃণ বা কোঁচকানো)—এরকম সাত জোড়া বৈশিষ্ট্য।

মটরগাছ—মেন্ডেলের মডেল

মেন্ডেল এইসব মটরগাছের মধ্যে যাতে কেবলমাত্র ‘বিশুদ্ধ গুণ’ থাকে তার জন্য কয়েক প্রজন্ম ধরে তাদের ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। একটি গাছের নিজের পরাগ দিয়ে সেই গাছের পুষ্প নিষেক করাকে বলে স্বপরাগ-সংযোগ। যদি কয়েক প্রজন্ম ধরে স্বপরাগ-সংযোগ হলে বেঁটে গাছের সব প্রজন্মই পরবর্তীকালে বেঁটে হয়, কোনও প্রজন্মের একটি গাছও লম্বা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে ঐ বিশেষ বেঁটে গাছটি বিশুদ্ধ বেঁটে গুণ সম্পন্ন।  তেমনই কয়েক প্রজন্ম ধরে স্বপরাগ-সংযোগ ঘটিয়ে বিশুদ্ধ লম্বা বীজ, বিশুদ্ধ হলুদ বীজ, বিশুদ্ধ সবুজ বীজ, বিশুদ্ধ মসৃণ বীজ, বা বিশুদ্ধ কোঁচকানো বীজ মটরগাছ শনাক্ত করা যায়।

  • এরপর মেন্ডেল বিপরীত চরিত্র-জুটির মধ্যে সংকরায়ন করেন। যেমন বেঁটে মটরগাছের সঙ্গে লম্বা গাছের সংকরায়ন করা হয়। বেঁটে গাছের সঙ্গে লম্বা গাছের সংরায়নের ফলে উদ্ভূত প্রথম সংকর প্রজন্মের সবগুলি মটরগাছই লম্বা হল, একটিও বেঁটে গাছ হল না। প্রথম সংকর প্রজন্মকে সংক্ষেপে বোঝানোর জন্য F1 বলে নামকরণের প্রথা আছে, একইভাবে দ্বিতীয় সংকর প্রজন্ম হল F2
  • আবার কোঁচকানো বীজের সঙ্গে মসৃণ বীজের সংকরায়নের ফলে উদ্ভূত প্রথম প্রজন্মের (F1) সবগুলি মটরগাছ মসৃণ বীজ হল।
  • বংশগতি বিজ্ঞানের ভাষায়, লম্বা গুণ আর মসৃণ বীজ বৈশিষ্ট্য হল প্রকট গুণ—প্রথম প্রজন্মের সমস্ত সদস্য প্রকট গুণই দেখায়।

তাহলে কি বেঁটে গুণ বা কোঁচকানো বীজ বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে গেল?

তা কিন্তু নয়। প্রথম সংকর প্রজন্মের (F1 ) গাছগুলোর মধ্যে মেন্ডেল আবার স্বপরাগ-সংযোগ ঘটালেন। তৈরি হল দ্বিতীয় সংকর প্রজন্ম F2

  • লম্বা-বেঁটে সংকর গাছের ক্ষেত্রে দেখা গেল দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মের কিছু বেঁটে গাছ জন্মাচ্ছে।
  •  মসৃণ বীজগাছ ও কোঁচকানো বীজ গাছের ক্ষেত্রেও দেখা গেল, প্রথম সংকর প্রজন্মে হারিয়ে-যাওয়া কোঁচকানো বীজ গুণ দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মের কিছু গাছে ফিরে এসেছে।
  • প্রথম সংকর প্রজন্মে বেঁটে বৈশিষ্ট্য বা কোঁচকানো বীজ বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে ছিল, বা প্রচ্ছন্ন ছিল। তাই মেন্ডেল এরকম বৈশিষ্ট্যের নাম দিলেন প্রচ্ছন্ন গুণ।
  • প্রথম সংকর প্রজন্মে কেবল একটি গুণ দেখা যায়, তা হল প্রকট গুণ। প্রচ্ছন্ন গুণ থাকে লুকিয়ে। দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মে প্রকট গুণ যেমন দেখা যায়, প্রছন্ন গুণও তেমন দেখা যায়।
  • দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মে একটি বেঁটে বা কোঁচকানো বীজ মটরগাছের জন্ম হলে তিনটি লম্বা (বা মসৃণ বীজ) মটরগাছের জন্ম হবে। অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন গুণ দেখা দিল বটে, কিন্তু প্রচ্ছন্ন গুণবিশিষ্ট গাছের চাইতে প্রকট গুণবিশিষ্ট গাছের সংখ্যা তিনগুণ। এরপর থেকে আমরা প্রকট গুণের উদাহরণ হিসেবে কেবল লম্বা গুণের কথা বলব, আর প্রচ্ছন্ন গুণের উদাহরণ হিসেবে কেবল বেঁটে গুণের কথা বলব। কিন্তু এদের নিয়ে আমরা এখানে যা বলব তা অন্য সমস্ত প্রকট-প্রচ্ছন্ন গুণযুগলের বা বৈশিষ্ট্য-যুগলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। 

দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মে যে বেঁটে গাছ পাওয়া গেল, তাদের স্বপরাগ-সংযোগ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে করলেও কোনও লম্বা গাছ পাওয়াই যাবে না। তারা বিশুদ্ধ বেঁটে গাছ। তাদের আগের পূর্বসূরী গাছ যে লম্বা ছিল, তার কোনোরকম ছাপ তাদের মধ্যে আর নেই। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মে যে প্রচ্ছন্ন গুণ ফিরে এল, সেই প্রচ্ছন্ন গুণ বিশুদ্ধ। তাদের আগের প্রজন্মের লম্বা গুণের কোনও ছাপ তাদের মধ্যে নেই। প্রকট গুণ এদের মধ্যে থেকে পুরো হারিয়ে গেছে।

দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মে লম্বা গাছগুলো ছিল সংখ্যায় বেশি। কিন্তু তাদের মধ্যে সবাই সমান নয়। একদল লম্বা গাছ বিশুদ্ধ লম্বা। অর্থাৎ তাদের স্বপরাগ-সংযোগ ঘটালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কেবল লম্বা গাছ পাওয়া যাবে। এদের প্রকট গুণ বিশুদ্ধ।

দ্বিতীয় সংকর প্রজন্মের চারটে গাছের মধ্যে একটা যদি বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন গুণ (বিশুদ্ধ বেঁটে) হয় তাহলে একটা গাছ বিশুদ্ধ প্রকট গুণ (বিশুদ্ধ লম্বা) হবে। বাকি দুটো গাছ কেমন হবে?  

আমরা জানি, তারা দেখতে প্রকট গুণ সম্পন্ন অর্থাৎ লম্বা হবে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের সঙ্গে বিশুদ্ধ লম্বা গাছের ফারাক বোঝা যাবে না। কিন্তু তাদের স্বপরাগ-সংযোগ ঘটালেই ফারাক দেখা যাবে।

তাদের পরের প্রজন্মে (F3) চারটি গাছের মধ্যে একটি বিশুদ্ধ বেঁটে (বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন গুণ), একটি বিশুদ্ধ লম্বা (বিশুদ্ধ প্রকট গুণ) এবং বাকি দুভাগ দেখতে লম্বা, কিন্তু তাদের পরের প্রজন্মে লম্বা ও বেঁটে দুরকম গাছ ৩ ভাগ ও ১ ভাগ অনুপাতে থাকবে। এরা হল একেবার এদের আগের (F1) প্রজন্মের মত। আপাতদৃষ্টিতে কেবল প্রকট গুণ দেখা গেলেও এদের ভেতরে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন দুই গুণই থাকে। গুণ বা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায় না, একে অপরের সঙ্গে মিশে মাঝামাঝি কিছু তৈরিও করে না।

এই অনুপাতটি মনে রাখা দরকার, কারণ মেন্ডেলের করা পরীক্ষাগুলিতে শুধু নয়, পরে বংশগতি সংক্রান্ত অজস্র বিষয়ে এই অনুপাতটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেমন মা-বাবার সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগ প্রচ্ছন্ন থাকলে তাদের সন্তানদের সেই মারাত্মক রোগ দেখা দেবার সম্ভাবনা কতটা, সেই সম্ভাবনা চিকিৎসক বলে দিতে পারেন। কিন্তু আপাতত শুধু এটুকুই বলে রাখা যাক, যদি একটি বিশুদ্ধ প্রকট গুণ (লম্বা) ও একটি বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন গুণ (বেঁটে) এর সংকর করা হয়, তাহলে প্রথম প্রজন্মে বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন গুণযুক্ত হবে একভাগ, বিশুদ্ধ প্রকট গুণযুক্ত হবে একভাগ, আর মিশ্র প্রকট গুণযুক্ত হবে দুভাগ। প্রথম প্রজন্মের (F1) এই অনুপাতটি ৩: ১ হিসেবে লেখা যায়, কারণ প্রকাশ পাওয়া গুণের বিচারে একটি প্রচ্ছন্ন গুণসম্পন্ন (বেঁটে) ও তিনটি প্রকট গুণসম্পন্ন। আবার এই অনুপাতটি ১: ২ : ১ হিসাবেও লিখিত হতে পারে। কারণ এই প্রজন্মের একভাগ বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন, দুইভাগ সংকর প্রকট ও একভাগ বিশুদ্ধ প্রকট ছিল। বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন গুণযুক্তদের নিজেদের মধ্যে যত প্রজন্ম ধরেই প্রজনন করা হোক না কেন কেবলই প্রচ্ছন্ন গুণযুক্ত জীব পাওয়া যাবে। আবার বিশুদ্ধ প্রকট গুণযুক্তদের নিজেদের মধ্যে যত প্রজন্ম ধরেই প্রজনন করা হোক না কেন কেবলই প্রকট গুণযুক্ত জীব পাওয়া যাবে। কিন্তু মিশ্র প্রকটদের আপাতদৃষ্টিতে বিশুদ্ধ প্রকট গুণযুক্তদের মত দেখালেও, তাদের নিজেদের মধ্যে নিষেক ঘটালে কেবল প্রকট গুণযুক্ত জীবের জন্ম হয় না।

পরীক্ষাটি মটর গাছের ওপর করা হয়েছিল। কিন্তু ‘একক সংকর জনন’-এর এই নিয়ম কলাগাছ ও হাতি, শামুক ও সিংহ—সকলের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। ‘একক সংকর জনন’ বলা হচ্ছে কেন? গাছের উচ্চতার এই একটি বৈশিষ্ট্যের প্রভেদ নিয়ে, অর্থাৎ একটিমাত্র গুণের বৈচিত্র্য নিয়ে সংকরায়ন করা হচ্ছে, তাই একক সংকর জনন। এটি মেন্ডেলের বড় আবিষ্কার ছিল। তাঁর আগে কেউ এভাবে পরীক্ষা করেননি। সংকরায়নের ফলে যে প্রজন্ম জন্মায় তাদের মধ্যে নানা গুণ কীভাবে থাকে তার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ কেউ করেননি। পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে যে গুণসমূহের উত্তরাধিকার বা বংশগতি সম্পর্কে কিছু বোঝা যেতে পারে এটাও কেউ বোঝেননি। 

পর্ব ৪

সেই সময়ে মেন্ডেল ছাড়া আরও অনেকে এই ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন।তবে মেন্ডেলের আগে সংকরায়নের ফলে যে প্রজন্ম জন্মায় তাদের মধ্যে নানা গুণ কীভাবে থাকে তার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ কেউ করেননি। পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে যে গুণসমূহের উত্তরাধিকার বা বংশগতি সম্পর্কে কিছু বোঝা যেতে পারে এটাও কেউ বোঝেননি। মেন্ডেল একটি পরীক্ষায় একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর সৌভাগ্যক্রমে গবেষণার জন্য তিনি মটরশুঁটির এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বেছে নিয়েছিলেন যেগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত বা নির্ভরশীল ছিল না। মটরশুঁটি গাছের উচ্চতা, মটরদানার রঙ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সুনির্দিষ্টভাবে স্থানান্তরিত হতো। তিনি গাছটির যে সাত জোড়া বৈশিষ্ট্যনিয়ে কাজ করেন, প্রতিটি বৈশিষ্ট্য থেকে কাজ তাঁকে একই ফলাফল দিয়েছিল। ফলে তিনি প্রাপ্ত ফল থেকে সাধারণ সিদ্ধান্ত টানতে পেরেছিলেন।

মেন্ডেলের এই পরীক্ষা-পদ্ধতি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গণিতশাস্ত্র প্রয়োগের প্রথম দিকের উদাহরণ। মেন্ডেল নিজে গণিত নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। তিনি যে পরীক্ষায় নিখুঁত ১: ২ : ১ অনুপাতটি সবসময় পেয়েছেন তা নয়। হয়তো তাঁর অন্তর্দৃষ্টিএই অনুপাতের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব গড়ে তোলে। একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যের (উচ্চতা) দুটি মাত্র প্রকরণ (লম্বা-বেঁটে) নিয়ে পরীক্ষার বিবরণ এখানে দেওয়া হল। কিন্তু একসঙ্গে একাধিক আলাদা বৈশিষ্ট্যের প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষা করা যায়, এবং পরবর্তী প্রজন্মে প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের প্রকট ও প্রচ্ছন্ন গুণের অনুপাত একই রকম হয়। সাতটি আলাদা বৈশিষ্ট্য (লম্বা-বেঁটে গাছ, বীজের রং হলুদ সবুজ, বীজের ত্বক মসৃণ অমসৃণ, এইরকম) নিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি বৈশিষ্ট্য অন্য সমস্ত বৈশিষ্ট্যের থেকে আলাদা ও স্বাধীনভাবে পরের প্রজন্মে সঞ্চারিত হবে। একে মেন্ডেল বললেন ‘ল অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাসর্টমেন্ট’, অর্থাৎ এক-একটি বৈশিষ্ট্য পরের প্রজন্মে স্বাধীনভাবে যায়।

১৯০০ সালে ডাচ উদ্ভিদবিদ এবং জিনতত্ত্ববিদ উগো ডি ভ্রিস (Hugo de Vries), জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং জেনেটিক বিশেষজ্ঞ কার্ল এরিক কোরেন্স (Carl Erich Correns), এবং অস্ট্রিয়ান উদ্ভিদবিজ্ঞানী এরিচ স্কেরম্যাক ভন সেয়েসেনেগ (Erich Tschermak von Seysenegg)—এই তিন বিজ্ঞানী স্বতন্ত্রভাবে মেন্ডেলের মতই সংকরায়ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন। ডি ভ্রিস এবং কোরেন্স দুজনেই নিজেদের পরীক্ষা করার পরে মেন্ডেল পড়েছিলেন। ডি ভ্রিস নিজে যে পরীক্ষা করেছিলেন তার সঙ্গে মেন্ডেলের পরীক্ষার ফলাফল পুরোপুরি মেলেনি। পরীক্ষার পরে ডি ভ্রিস পুনরায় মেন্ডেলের গবেষণাপত্র পড়েন আর নিজের পরীক্ষার তথ্যগুলোকে যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে বাছাই করে সাজাতে পারেন। কোরেন্স মেন্ডেলের পরীক্ষার অনুরূপ পরীক্ষা করার পরে গবেষণাপত্র লেখার সময়ে মেন্ডেলের গবেষণাপত্র পড়েন। স্কেরম্যাক অবশ্য নিজের পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার আগে মেন্ডেল পড়েননি, তবে তিনিও পরে মেন্ডেল পড়ে নিজের তথ্য থেকে সিদ্ধান্ত টানতে সক্ষম হন।

ডি ভ্রিস তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রে মেন্ডেলের কাজের উল্লেখ করেননি। সেটা ঠিক হয়নি। ১৯০০ সালে ডি ভ্রিস তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশের ঠিক পরেই কার্ল কোরেন্স ভ্রিসের বিরুদ্ধে একাডেমিক চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ করেছিলেন। কোরেন্স প্রায় ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, “অদ্ভুত কাকতালীয়ভাবে ডি ভ্রিস তাঁর গবেষণাপত্রে মেন্ডেলের শব্দভাণ্ডার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন”। (তথ্যসূত্র ৯) ডি ভ্রিস দ্রুতই তাঁর ভুল সংশোধন করেন।পরবর্তীকালে মিউটেশন তথা পরিব্যক্তি তত্ত্ব আবিষ্কার করে ডি ভ্রিস বিজ্ঞানের দরবারে অমর হয়ে ওঠেন।

১৯০০ সালের পরে ইংরেজ বিজ্ঞানী বেটসনের প্রচেষ্টায় মেন্ডেলের অবদান বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃতি পাবার দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়।

জেনেটিক্স ইত্যাদি আবিষ্কারের অনেক আগেই মেন্ডেল বংশগতির মূল সূত্রগুলি বুঝতে পারেন। আজ মেন্ডেলের সেই মটরশুঁটির সংকরায়ন পরীক্ষা ও তা থেকে বংশগতির নিয়ম আবিষ্কার স্কুলপাঠ্য বিষয়। কিন্তু মেন্ডেলের গবেষণা অনাদৃত হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। কেমন করে ৩৪ বছর ধরে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ‘হারিয়ে গেল’ আর কেমন করেই বা তাকে পুনরাবিষ্কার করা গেল, সে কাহিনী আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। (তথ্যসূত্র ১০)

আপাতত বলার কথা এই যে, ১৯০০ সালে বিজ্ঞানী উইলিয়াম বেটসন একদিন লন্ডনে ভাষণ দেবার পথে একটি গবেষণাপত্র ট্রেনে বসে পড়ছিলেন। সেই গবেষণাপত্রটি ছিল মেন্ডেলের ধারণার ওপরে ডি ভ্রিস-এর নিজস্ব সংযোজন। বেটসন এই গবেষণাপত্রটি পড়ে এতই চমৎকৃত হয়ে গেলেন যে তিনি লন্ডনে গিয়ে রয়াল হর্টিকালচারাল সোসাইটি-তে তাঁর বক্তৃতার বিষয়টাই পাল্টে ফেললেন। তিনি লেকচার হলে বললেন, “আমরা এখন একটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নতুন এক নীতির সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে আছি। আর এই নতুন নীতি যে আমাদের কতদূর এবং কোথায় নিয়ে যাবে সেটা এখনই বলা সম্ভব না।” (তথ্যসূত্র ১১) এইরকম প্রায়-অলৌকিক ভবিষ্যদ্বাণী বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিরল।

এর তিনমাস পরে বেটসনফ্রান্সিস গ্যালটনকে চিঠিতে লেখেন, “আমি বলছি যে আপনি মেন্ডেলের গবেষণাপত্রটি দেখুন। এটি বংশগতি ব্যাপারে সবথেকে উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র বলে আমার মনে হয়েছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হল আমরা এতদিন এটা ভুলে আছি।” [ভাবানুবাদ বর্তমান লেখকের]

মেন্ডেলের কাজ যাতে আবার লোকে ভুলে না যায় তার জন্য বেটসন উঠে-পড়ে লাগলেন। কেম্ব্রিজে নিজের হাতে তিনি মেন্ডেলের উদ্ভিদের সংকরায়ন পরীক্ষা পুনর্বার করে তার ফলাফল যাচাই করলেন। লন্ডনে ডি ভ্রিসের সঙ্গে তিনি দেখা করলেন, এবং তাঁর কাজের ধরণ বেটসনের সঠিক বলে মনে হল। এরপর তিনি মেন্ডেলের গবেষণার ফলাফল ও তার তাত্ত্বিক নিহিতার্থ ও গুরুত্ব নিয়ে এক প্রচারাভিযান শুরু করলেন। বেটসন ছিলেন ‘মেন্ডেলের বুলডগ’, বুলডগের মতই জেদি। অবশ্য ‘ডারউইনের বুলডগ’ বলে বিখ্যাত টমাস হেনরি হাক্সলির মতো পরিচিতি বেটসন পাননি।

কেমব্রিজে বেটসনের চারপাশে একদল কমবয়সী বিজ্ঞানী জড়ো হলেন। বেটসন দেখলেন, নতুন যে বিষয়টা সিয়ে উৎসাহ ও চর্চা শুরু হয়েছে তার একটা লাগসই নাম দেওয়া দরকার। চালু এবং সঠিক অর্থ বহন করবে এমন শব্দ খুঁজতে খুঁজতে ১৯০৫ সালে বেটসন নিজেই একটা শব্দ বানিয়ে নিলেন। শব্দটি হল জেনেটিক্স। আমরা জানি এর পরের ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই শব্দটি শুধু জীববিজ্ঞান নয় মানুষের সমাজভাবনার মধ্যে রাজত্ব করবে। জেনেটিক্স হল বংশগতি এবং তার ভিন্নতা নিয়ে চর্চা করার বিজ্ঞান। বেটসন শব্দটি নিয়েছিলেন গ্রিক genno থেকে, যার মানে জন্ম দেওয়া। একটা জিনিস লক্ষ্যনীয়। ‘জিন’ শব্দ বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে আসার আগেই এসেছেজেনেটিক্স শব্দটি। জিন হলপ্রাণের বংশগতির কার্যকরী মৌলিক একক।শুধু তাই নয়, জিন কথাটা জেনেটিক্স থেকে পৃথকভাবে ভাবা হয়েছে।

সম্ভবত বেটসন ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি উপলব্ধি করেছিলেন, জীববিজ্ঞানে এক সত্যিকারের ও অতি বিরল বিপ্লব ঘটছে। তিনি বুঝেছিলেন, একবার যদি বংশগতির নিয়মগুলো বোঝা যায় তাহলেপ্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। আর কোনো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান মানুষকে এতটা ক্ষমতা দেয়নি। আজ কৃত্রিম উপায়ে মারণ-ভাইরাস তৈরি করা সম্ভব, ব্যাকটেরিয়ার কোষে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের ইনসুলিন তৈরি করা সম্ভব। এমনকি কৃত্রিম উপায়ে মানুষ তৈরিও অসম্ভব নয়। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে চলে আসবে রেসের সব ঘোড়াকে হারানোর মতো জেনেটিক গুণসম্পন্ন কৃত্রিমভাবে জিনমিশ্রণে তৈরি ‘ডিজাইনার ঘোড়া’, সব থেকে বেশি দুধ দেবার জন্য ডিজাইনার গরু, এবং আইনস্টাইন বা জুকেরবার্গ বা রবীন্দ্রনাথ হবার মতো জেনেটিক গুণসম্পন্ন  ‘ডিজাইনার বেবি’!

তা আসুক বা না আসুক, মেন্ডেলের পরে ঘোরতর অবিশ্বাসীরও পুনরুত্থানে বিশ্বাস না করে উপায় রইল না।

তথ্যসূত্র

১) Experiments In Plant Hybridization (1865) Gregor Mendel. Read at the February 8th, and March 8th, 1865, meetings of the Brünn Natural History Society Mendel, Gregor. 1866. Versuche über Plflanzenhybriden. Verhandlungen des naturforschenden Vereines in Brünn, Bd. IV für das Jahr 1865, Abhandlungen, 3–47. http://www.esp.org/foundations/genetics/classical/gm-65.pdf

২) Jenkin, F. The Origin of Species. North British Review, June 1867, vol. 46. P. 277—318. http://darwin-online.org.uk/content/frameset?itemID=A24&viewtype=text&pageseq=1 থেকে ১৬ এপ্রিল ২০২১ সংগৃহীত। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের।

৩) Darwin and Genetics. Brian Charlesworth and Deborah Charlesworth. Genetics. November 1, 2009 vol. 183 no. 3 757-766;  https://www.genetics.org/content/183/3/757

৪) Yawen Zou. Charles Darwin’s Theory of Pangenesis. 2014. The Embryo Project Encyclopedia.  https://embryo.asu.edu/pages/charles-darwins-theory-pangenesis

৫) Portin P. The Significance of Mendel’s Work for the Theory of Evolution; Specifically Birth and Development of the Mendelian Paradigm of Genetics: a Review. Annales Botanici Fennici;2019;56: p 285 – 293

৬) Lorenzano P. What would have happened if Darwin had known Mendel (or Mendel’s work)? Hist Philos Life Sci. 2011;33(1):3-49. PMID: 21789954.

৭) Fairbanks, D.J. Mendel and Darwin: untangling a persistent enigma. Heredity 124, 263–273 (2020). https://doi.org/10.1038/s41437-019-0289-9,

৮) Galton D. Did Darwin read Mendel? QJM: An International Journal of Medicine, Volume 102, Issue 8, August 2009, Pages 587–589,  https://academic.oup.com/qjmed/article/102/8/587/1598792

৯) Mukherjee, S. The gene: an intimate history. Penguin Random House India. 2016. P 58-61

১০) Moore, Randy (2001). “The “Rediscovery” of Mendel’s Work”. Bioscene. 27 (2): 13–24.

১১) Bateson, W. (1900) “Hybridisation and Cross-Breeding as a Method of Scientific Investigation” J. RHS (1900) 24: 59 – 66, a report of a lecture given at the RHS Hybrid Conference in 1899

লেখক চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য-আন্দোলনের কর্মী, প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।