গন্ডোয়ানার জঙ্গলের দুই গাছের খোঁজে
রঞ্জনদার কাছে একবার একটা পাথর নিয়ে গিয়েছিলাম, যেটাকে দেখে আমার ফসিল মনে হয়েছিল। পাথর হলেও অনেকটা গাছের কাণ্ডের মতো দেখতে। মনে হয়েছিল যে প্রস্তরীভূত গাছ (Petrified Wood) হয়তো হবে, কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে দাদা বলল যে, ওটা কোন ফসিলই নয়, সাধারণ পাথর। অনেক পাথরের বাইরের দিকটা বিভিন্ন কারণে এবড়ো খেবড়ো হয়ে যায়; আর তখন দেখলে মনে হয় যে, পাথরে পরিণত হওয়া গাছের কাণ্ড বুঝি। ওই পাথরটাও দেখতে অনেকটা সেই রকমই ছিল, কিন্তু জানতে পারলাম যে ওটা প্রস্তরীভূত গাছ নয়। আমার মনটা খারাপ দেখে রঞ্জনদা সান্তনা দিয়ে বলল, “ভাবিস না রে, কয়েকদিন পরেই আমি রাণীগঞ্জের কাছে ট্রান্সফার হয়ে আসছি। দেখা যাক, তোকে একটা গাছের ফসিল হয়তো জোগাড় করে দেওয়া যাবে।” তাও ভালো!
কথায় কথায় রঞ্জনদার পরিচয়টাই দিতে ভুলে গেছি। রঞ্জনদার সঙ্গে আলাপ ‘বিজ্ঞান মঞ্চের’ এক দিদির মাধ্যমে। আমার তখন ছাত্রকাল। সংগ্রহের নেশা আমার চিরকাল, আর বিভিন্ন পাথর এর মধ্যে ভীষণ মন কাড়ত। আস্তে আস্তে পাথরের সঙ্গে দু’ একটা ফসিলও জোগাড় করে ফেলেছি। এমনই পাথর সংগ্রহ করি আর সেটাকে চিহ্নিত করতে বইপত্র পড়ি, কখনও বুঝতে পারি আবার বেশির ভাগ সময় পারি না। তখনই দেবদূতের মতো রঞ্জনদাকে পেয়ে গেলাম। রঞ্জনদা আমার বাড়ির কাছেই ভাটপাড়ায় থাকেন, ভূতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে মিনারেল এক্সপ্লোরেশন কর্পোরেশনে ভূতাত্ত্বিকের চাকরি করেন। কিছুদিন পরেই রঞ্জনদা বদলি হয়ে চলে এলো রানিগঞ্জের কাছে, নারায়ণকুড়ি নামের একটা জায়গায়। এবার আমার সুযোগ এল কাছ থেকে ভূতাত্ত্বিকদের কাজকর্ম দেখা। ওঁরা তখন একটা নতুন অঞ্চলে অনুসন্ধান করছেন, শুনলাম তাঁবুতে থেকে জন-মনিষ্যি শূন্য এলাকায় প্রতিদিন খোঁজ চালাতে হচ্ছে। আমার তো শুনে দুঃসাহসিক অভিযানের মতো লাগলো। তাই আমিও কিছুদিন ওখানে গিয়ে এই কাজকর্ম একটু দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। অনবরত ঘ্যান ঘ্যান থামাতে দাদা একদিন আমাকে ওখানে ডেকেই পাঠাল।
রাণীগঞ্জ থেকে নারায়ণকুড়ি হয়ে মিনারেল এক্সপ্লোরেশন কর্পোরেশনের ক্যাম্পে কীভাবে পৌঁছেছিলাম তার বর্ণনা এখানে অবাঞ্ছিত, তবে পৌঁছেই আমাদের মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। দামোদর নদের ধারে একসারি ক্যাম্বিসের ক্যাম্প, বেশ সাফসুতরো আশপাশ। আমি আর বিজ্ঞান মঞ্চের এক বন্ধু গিয়েছিলাম। আমাদের জন্যে একটা তাঁবু দাদা ঠিক করে রেখেছিল। পরের দিন ছিল আমাদের ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান দেখবার দিন। ভোর ভোর দাদার সঙ্গে জীপে করে ফিল্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার কথা। একে তো উত্তেজনায় ঘুম আসছে না আবার তার সঙ্গে ভয়ঙ্কর মশার দৌরাত্ম্য, তার ওপরে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বন্ধুর প্রচণ্ড নাসিকা গর্জন! কোনরকমে সকালের দিকে একটু ঘুম এলেও সাত সকালে উঠে তৈরি হয়ে নিতে হল যাতে আমাদের জন্যে সবার না দেরী হয়ে যায়। জলখাবার খেয়েই রঞ্জনদার সঙ্গে আমরা দু’জন একটা জীপে করে বেরলাম যেখানে অনুসন্ধান হচ্ছে সেখানকার উদ্দেশ্যে। খুব একটা দূরে ছিল না সেই জায়গা, ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে ঢাকা পাথুরে মাঠ। যতদূর চোখ যায় মাটিটা যেন লাফাতে লাফাতে মিশে গেছে দিগন্তের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে এক একটা বড় গাছ। বিশাল একটা ড্রিল মেশিন ঘর্ ঘর্ শব্দ করে মাটি কেটে ঢুকে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে পরে ওই ড্রিল মেশিনের কাটা পাথর (core) একটা লম্বা বাক্সে খোপ করা সরু সরু চ্যানেলে রাখা হচ্ছে। সেই বাক্সটাকে লগবক্স বলে, সেই বাক্সে তারপরে গভীরতা অনুযায়ী বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে বোঝা যায় যে কতখানি নীচ থেকে পাওয়া গেল ইত্যাদি। আমরা এইরকম বেশ কয়েকটা সাইট ঘুরে দেখলাম। সেখানেই আমি পেলাম আমার প্রথম উদ্ভিদ ফসিল।
চিত্র-১. লগবক্সে ড্রিল করে পাওয়া ‘কোর’ গভীরতা অনুযায়ী সাজানো রয়েছে (চিত্রঋণ- ইন্টারনেট)
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই নারায়ণকুড়ি নামের জায়গাটার একটা আলাদা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩৪ সালে উইলিয়াম কার (William Carr)-এর সঙ্গে প্রথম ভারতীয়-ইউরোপীয় সমান মালিকাধীন একটি কোম্পানি চালু করেন, এর নাম ছিল কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি (Carr, Tagore and Company)। দ্বারকানাথ ঠাকুর আগেই কয়লাখনি কিনে কয়লার ব্যবসায় নেমেছিলেন। কয়লা রপ্তানির উদ্দেশ্যে জলপথ ব্যবহার হত আর এই কাজের জন্যে বেছে নেওয়া হয় নারায়ণকুড়িকে। নারায়ণকুড়ি গ্রামে কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি একটি জেটি বানায় দামোদরের পাড়ে। বড় বড় নৌকা, স্টিমার এসে ভিড়ত সেই জেটিতে। শোনা যায়, জেটি বানাবার আগে হাতির সাহায্যে কয়লা ওঠানো হত নৌকায়। সেই পুরনো জাহাজঘাটার অংশ এখনও দেখা যায় ওই গ্রামে।
চিত্র ২. নারায়ণকুড়িতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের কোম্পানির প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির জেটি (চিত্রঋণ- টেলিগ্রাফ পত্রিকা)
‘নারায়ণকুড়ি ৭’ নামের একটা সাইট থেকে পাওয়া একটি পাথর দেখাল দাদা। প্রায় ইঞ্চি তিনেক ব্যাসের মোটা মোমবাতির মতো পাথরটা ড্রিল করে বের করে আনা হয়েছে। ড্রিল করে বের করা এই লম্বা ড্রিল কোরের ওপরে দু’টি পাতার ছাপ, যেন মনে হচ্ছে পাথরের ওপরে তুলি দিয়ে হাল্কা করে দু’টি পাতা এঁকে দিয়েছে কোন অজানা শিল্পী। পাতা দু’টি আলাদা আলাদা দু’টি গাছের কিন্তু তারা এককালে পাশাপাশি থাকতো গাছ-গাছালিতে ঢাকা এক প্রাগৈতিহাসিক অরণ্যতে।
সে আজকের কথা নয়। এই হিমালয়, বঙ্গোপসাগর, গঙ্গা নদী – এইসব কিচ্ছুটি ছিল না তখন। পৃথিবীর ওপরে মহাদেশগুলোর আকৃতি তখন আলাদা। আজ থেকে প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগে ভারত, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অ্যান্টার্কটিকা সব একসঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে থাকতো। এই সুবিশাল স্থলভূমির নাম গন্ডোয়ানা। আমাদের ধারণার মহাদেশের চাইতে অনেক অনেক বড় এই ধরণের স্থলভূমিকে অতি-মহাদেশ (supercontinent) বলে। এই গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশ প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগে তৈরি হয় আর প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে ভেঙ্গে যায়। এই গন্ডোয়ানা নামের সঙ্গে ভারতবাসী হিসেবে আমাদের এক অনুভূতি জড়িয়ে আছে। এডুয়ার্ড স্যুস (Eduard Suess) নামের এক অস্ট্রিয়ান ভৌগোলিক এই ‘গন্ডোয়ানা’ নামটি দেন। গন্ডোয়ানা নামটির উৎপত্তি ভারতের এক আদিম অধিবাসী ‘গোণ্ড’ জাতি থেকে। এই জাতি আমাদের দেশের এক আদিম অধিবাসী যারা মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বসবাস করে। গ্লসোপ্টেরিস নামটি আবার এডুয়ার্ড স্যুসের নিজস্ব আবিষ্কার নয়। তিনি এই নামটি পান হেনরি বেনেডিক্ট মেডলিকট (Henry Benedict Medlicott) নামে এক আইরিশ ভূতাত্ত্বিকের লেখায়। ভারতবর্ষের ভূতত্ত্ব নিয়ে মেডলিকট অনেক কাজ করেন আর তিনি প্রথম গন্ডোয়ানাল্যান্ড বলে মহাদেশের উল্লেখ করেন তাঁর লেখায়। স্যুস সেখান থেকে ওই নামটি ধার করে ব্যবহার করেন। আমাদের ভারতবর্ষের অনেকটা অংশ সেই আদিম অতি-মহাদেশের অংশ ছিল আবার অনেকটা পরে সৃষ্টি হয়েছে। এই অতি-মহাদেশ অনেক কিছুই দেখেছে, যে ক্যামব্রিয়ান (Cambrian) যুগে এর সৃষ্টি তখন তো বড় বড় জীব সেভাবে আসেনি কিন্তু প্রাণের একটা জোয়ার এসে গিয়েছিল। অজস্র ধরণের জীব তৈরি হচ্ছে, উদ্ভিদের গঠন ক্রমশ জটিল হতে শুরু করেছে। এইরকম ভাবে চলতে চলতে এই অতি-মহাদেশ যখন ভেঙ্গে পড়ল তখন অতিকায় ডাইনোসরদের রাজত্ব। আজ অবশ্য আমরা ফসিলের এই দুটি গাছের বিষয়ে আলোচনা করব যেগুলি আমাদের দেশে ফসিল হিসেবে অনেক পাওয়া যায়। আমরা তাদের সম্বন্ধে অল্প জানব আর তাদের চিনতে শিখব।
চিত্র ৩. শিল্পীর চোখে গন্ডোয়ানার জঙ্গল (চিত্রঋণ- ইন্টারনেট)
গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের অধিকাংশ জায়গাই দখল করে ছিল বিরাট বিরাট গাছের দল। এই গাছের অবশিষ্ট আমরা এখন পাই বহু অঞ্চলে কয়লা হিসেবে। কয়লাও এক ধরণের ফসিল। রানিগঞ্জের এই কয়লাস্তর মোটামুটি পারমিয়ান (Permian) যুগে তৈরি হয়েছে, যার বিস্তার মোটামুটি ৩০ থেকে ২৫ কোটি বছরের মধ্যে আর এই সময়েই পৃথিবীর আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছিল পাথরে ছাপ ফেলে যাওয়া এই দুই গাছ। ফসিলে দুটি আলাদা আলাদা গাছের ছাপ দেখলেও আদতে এই দুটি একই গোষ্ঠীর (Order) গাছ, যাকে গ্লসোপ্টেরিডেলস (Glossopteridales) বলে।
চিত্র ৪. গ্লসোপ্টেরিস ও গঙ্গামোপ্টেরিস মোটামুটি এইরকমই দেখতে ছিল (চিত্রঋণ- ইন্টারনেট)
গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের কালকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে; একটি হল ‘নিম্ন গন্ডোয়ানা’ যা কিনা কার্বনিফেরাস যুগ (প্রায় ৩৬ কোটি – ৩০ কোটি বছর) থেকে পারমিয়ান যুগ (প্রায় ৩০ কোটি – ২৫ কোটি বছর) অবধি বিস্তৃত ছিল, আর এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলির মধ্যে একটি হল গ্লসোপ্টেরিস। গাছটিকে একটি বৃহদাকৃতি ফার্ন (fern) গাছ বলা যেতে পারে যার পরাগ হত, বীজ হত। এই গাছ এখন পরিপূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ওই সময়ে ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। এখন জলা বা ভিজে, স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ফার্ন দেখে থাকি আর সেগুলো দেখতে অনেক ছোট হয়। তখন কিন্তু এই গাছগুলি ছোট ছোট লতা থেকে প্রকাণ্ড আকারের বৃক্ষের মতোও হত। আমরা এখন কল্পনাতেও আনতে পারব না যে কী বিশাল ফার্ন জাতীয় গাছ হত ওই সময়ে! পৃথিবীর অনেক জায়গার কয়লার উৎপত্তি এই ফার্ন বা pteropsida জাতীয় গাছ থেকে। আগেই বলেছি যে, এই গ্লসোপ্টেরিস গাছের বিকাশ হয়েছিল পারমিয়ান যুগে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করে থাকেন পারমিয়ান যুগের আগের কার্বনিফেরাস যুগের অবসানের পরে অজস্র হিমবাহ গলতে থাকে আর সেই হিমবাহ গলা জল গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে রূপান্তরিত করে দেয় কাদা ভরা জলা জায়গায়। পারমিয়ান যুগের প্রথমে বাড়তে থাকা সমুদ্রের জলে অনেক স্থান ডুবে যায়। তারপর যখন সমুদ্রের জল নেমে যায় তখন এইসব জায়গাগুলি জলাভূমিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবহাওয়াও হয়ে উঠতে থাকে উষ্ণ। সব মিলিয়ে ফার্ন জাতীয় গাছের বৃদ্ধির পক্ষে একেবারে আদর্শ অবস্থা। তাই ওই সময়ে যে উদ্ভিদ জগত বিকশিত হতে আরম্ভ করে তার মধ্যে ফার্ন অগ্রগণ্য আর তার মধ্যে আবার কিছু জায়গায় গ্লসোপ্টেরিস ছিল একদম প্রথমে। এখনকার সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছের মতোই গ্লসোপ্টেরিস সমুদ্রের ধারে জলা জায়গায় জন্মাত আর তাই এদের সরাসরি বাতাস গ্রহণ করার জন্যে শ্বাসমূল তৈরি হয়েছিল। ভারতে কয়েকটি নদী অববাহিকায় গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের পাললিক শিলায় গ্লসোপ্টেরিস গাছের ফসিল পাওয়া যায় আর তার মধ্যে দামোদর নদ খুব উল্লেখযোগ্য। রাণীগঞ্জ, তালচের, বরাকর, পাঞ্চেৎ ইত্যাদি অঞ্চলে পাথরের গায়ে পাওয়া যায় গ্লসোপ্টেরিসের ফসিল। আমার এই ফসিলটাও রাণীগঞ্জ অঞ্চল থেকেই পাওয়া। এছাড়া গোদাবরী ও মহানদী নদীর অববাহিকাতেও গ্লসোপ্টেরিসের ফসিল পাওয়া গেছে। ভারত ছাড়া একই ধরণের গ্লসোপ্টেরিস গাছের ফসিল পাওয়া গেছে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকাতে আর সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এই জায়গাগুলি যে গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের অংশ হিসেবে একসঙ্গে ছিল সেই সময়ে।
চিত্র ৫. সংগ্রহের ফসিল
ওপরের চিত্রতে সাদা বিন্দু দিয়ে দুটি গাছের পাতাকে আলাদা করে দেখিয়েছি। আপনার ডান দিকের পাতাটির মাঝে মধ্য শিরা রয়েছে। সেটি আদর্শ গ্লসোপ্টেরিসের উদাহরণ। বাম দিকের পাতাটির মধ্যে কোন মধ্যশিরা নেই। এর নাম গঙ্গামোপ্টেরিস (Gangamopteris)। গঙ্গামোপ্টেরিস পাতার আকৃতি অনেকটা জিভের মতো। দুটি গাছই গ্লসোপ্টেরিডাসিয়ে গোষ্ঠীভুক্ত।
চিত্র ৬. গ্লসোপ্টেরিস ও গঙ্গামোপ্টেরিস
গঙ্গামোপ্টেরিস চিনতে পারার সহজ নিয়ম হল যে এর পাতার মধ্যে মধ্য শিরা থাকে না। গ্লসোপ্টেরিসের মতোই গঙ্গামোপ্টেরিসও গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের অংশ হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, মাগাদাস্কার, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা প্রভৃতি জায়গাতে পাওয়া গেছে। গঙ্গামোপ্টেরিসের ফসিল বলতে সবচেয়ে বেশী পাতার ছাপই পাওয়া যায়। কখনও কখনও অনেক বড় ফসিল হলে পাতার সঙ্গে গাছের সরু ডালেরও ছাপ পাওয়া যায়।
চিত্র ৭. A ও B হল গঙ্গামোপ্টেরিসের একটা পাতার ছাপ যা ফসিল হয়ে গিয়েছে। C হল গঙ্গামোপ্টেরিসের পাতা সহ গাছের একটা ডাল (চিত্রঋণ- ইন্টারনেট)
আমার ফসিলটা রানীগঞ্জের কাছে পেলেও ওই জায়গায় গ্লসোপ্টেরিসের ফসিল তুলনামূলক ভাবে বেশি লভ্য। আবার ওড়িশার তালচেরের আশেপাশে গঙ্গামোপ্টেরিস বেশি পাওয়া যায়। কার্বনিফেরাস যুগের শেষ থেকে এদের উৎপত্তি আর পারমিয়ান যুগে এই গঙ্গামোপ্টেরিস গাছের চরম বিকাশ হয়। এই ফসিল প্রচুর মাত্রায় পাওয়া যায় ওড়িশার ইব নদের ধারে। ইব নদ মহানদীর একটি উপনদ। এটি ছত্তিশগড় থেকে বেরিয়ে ওড়িশার ঝাড়সুগুড়া ও সুন্দরগড় জেলার মধ্য দিয়ে গিয়ে শেষে রাজ্যের হিরকুদ বাঁধে গিয়ে মহানদীতে মিলিত হয়েছে। পাথর আর তার গঠন দেখে অনুমান করা হয় যে আজকের ইব নদের অববাহিকা অঞ্চলে পারমিয়ান যুগে একটি বিরাট অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ ছিল এবং সেই হ্রদের চারপাশে অনেকটা অঞ্চল জুড়ে যে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছিল তার মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ছিল গঙ্গামোপ্টেরিস গাছ। ওড়িশার ঝাড়সুগুড়া জেলার দু’টি শহর হল বেলপাহাড় আর বৃজরাজনগর। এই দু’টি শহরের মাঝে বেশ কয়েকটি কয়লাখনি আছে আর এইসব খনিতে গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের গাছের অবশেষই কয়লা হয়ে জমে আছে। এই অঞ্চলে লাজকুরা, জুরাবাগা ও নুল্লা গ্রামগুলির আশেপাশে চার পাঁচটা জায়গায় পারমিয়ান যুগের শিলাস্তর ওপরে এসে উন্মুক্ত হয়ে গেছে আর এখানে খুঁজলে এখনও গঙ্গামোপ্টেরিসের ফসিল পাওয়া যায়, যার ওপরে গাছের ছাপ পরিষ্কার বোঝা যায়।
লেখার আগের কৈফিয়ত দিচ্ছি একেবারে শেষে। এই লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে, গন্ডোয়ানা অতি-মহাদেশের উদ্ভিদকুল সম্বন্ধে অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ উপস্থাপন করা বা সেই সময়ের দুই বৃক্ষ গ্লসোপ্টেরিস ও গঙ্গামোপ্টেরিস সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দেওয়া। আমার লেখা ফসিল উৎসাহী মানুষদের আর ফসিল শিকারিদের উদ্দেশ্যে, যারা নিজের উদ্যমে ফসিল সংগ্রহ করেন। তাদের বোঝার জন্যে ও এই গুরুত্বপূর্ণ শখটিকে জনপ্রিয় করবার কারণেই এই নিবেদন।
তথ্যপঞ্জী:
১. Leafy branches of Gangamopteris from the Gzhelian–Johana A. Fernández, Silvia N. Césari.
২. First Report of Genus Gangamopteris From Gondwana Sediments Of Ib-River Coalfield, Orissa, India – Kamal Jeet Singh & Shreerup Goswami
৩. Plant Fossils And Gondwana Flora (eGyankosh)
৪. Glossopteris flora: A review – S. Goswami
৫. পুরাজীববিদ্যা – শুভেন্দু কুমার বক্সী
৬. The Telegraph: 02.08.21
৭. Bengali Entrepreneurs And Western Technology In The Nineteenth Century: A Social Perspective – Suvobrata Sarkar
খুব ভালো লাগল তথ্য ও বিশ্লেষণ ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
Ami gach niye kaz kori vison upokrito holam oto prachin kale kemon gach chilo se bisoy janlam
আপনার কাজে লেগেছে শুনে খুশী হলাম
গুরুত্ত্বপূর্ণ আলোচনা। খুব কঠিন বিষয়কে সহজ সরল ভাবে প্রকাশ করে সাধারণ মানুষদেরও আগ্রহ সৃষ্টি করবে এই প্রতিবেদন
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
তথ্যে সমৃদ্ধ হবার সাথে সুখী হবার অবকাশ পেলাম। গোন্ড জাতি সন্মন্ধেও জানার ইছ্ছা রইলো। মধ্যপ্রদেশের প্রাচীন গুহাচিত্র কি এদেরই পরিজনদের আঁকা?
তথ্যে সমৃদ্ধ হবার সাথে সুখী হবার অবকাশ পেলাম। গোন্ড জাতি সন্মন্ধেও জানার ইছ্ছা রইলো। মধ্যপ্রদেশের প্রাচীন গুহাচিত্র কি এদেরই পরিজনদের আঁকা?
Gond উপজাতিদের একটা বিশেষ ছবি আঁকার style আছে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগের rock art যখন আঁকা হয় তখন Gond এর অস্তিত্ব ছিল না
খুব ভালো লাগলো লেখাটি।
অনেক ধন্যবাদ
খুব ভালো লাগলো লেখাটি। একসময় ফসিল খুঁজতাম। ছোট বেলা যেমন করে গুপ্তধন খোঁজা হয় তেমনি করে। কিছই পাইনি, বা পেলেও হয়ত বুঝতে পারিনি, কারন কিছুই জানতাম না। আজ থেকে ৫৭ বৎসর আগে বরাপানী লেকের কাছে পাহাড়ের পাথরের ভেতরে পেয়েছিলাম লাল ফুলের ছাপ। ফসিল তো বটেই কিন্তু কবেকার ফসিল তা কোনদিন জানা হয় নি। বাড়ি বদলাতে বদলাতে সে সব আর নেই।
মেঘালয়ে অনেক ফসিল পাওয়া যায়। আমি ও 1999 এ posted ছিলাম মেঘালয়ে। কিছু সংগ্রহ করেছিলাম
Gond উপজাতিদের একটা বিশেষ ছবি আঁকার style আছে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগের rock art যখন আঁকা হয় তখন Gond এর অস্তিত্ব ছিল না
অনেক উপকৃত হলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ ।🙏
অসম্ভব গোছানো পরিপূর্ণ একটি নিবন্ধ। আমার মত প্রত্ন উদ্ভিদবিদ্যা তে একেবারে নভিস ব্যাক্তির পক্ষে অত্যন্ত আকর্ষক ও শিক্ষণীয় পোস্ট ।
অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।