গোবিন্দ ভিটা- মহাস্থানগড়, বাংলাদেশ
মহাস্থানগড়ের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল হল গোবিন্দ ভিটা। পুণ্ড্রনগরের উত্তরদিকের সুরক্ষা প্রাচীরের বাহিরে জাহাজঘাটা থেকে কয়েকশো গজ দূরে এটি অবস্থিত। প্রত্নস্থলটির উত্তর কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া করতোয়ার একটি ধারা। করতোয়ার ধারাটি এখন শীর্ণকায়া হলেও একসময়ের বিশাল প্রমত্তা এই নদীর বুকে বণিকদের বাণিজ্যতরী বয়ে যেত দূরদেশে। গোবিন্দ ভিটার আরেকটি স্থানীয় নাম ‘গোবিন্দের দ্বীপ’, অর্থাৎ বিষ্ণুর দ্বীপ/আবাসস্থল। মূলত ভূপৃষ্ঠ থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু নদীতীরবর্তী স্থানকে বরেন্দ্র অঞ্চলে দ্বীপ নামে ডাকা হয়। এই গোবিন্দ ভিটা পুণ্ড্রের ধর্মেতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গৌরবের একটি বিরাট অধ্যায় ধারণ করে আছে।
করতোয়া নদী
পুণ্ড্রে বৌদ্ধধর্ম প্রবল প্রতাপের সঙ্গে প্রায় এক হাজার বছর টিকে ছিল। এই দীর্ঘ সময়কালে সমস্ত পুণ্ড্রে গড়ে উঠেছিল হাজারো বিহার, সংঘারাম, স্তুপ ও মন্দির। বৌদ্ধদের এত প্রসারের মাঝেও যে কয়জন ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী পুণ্ড্রে স্বমহিমায় পূজিত হতেন, তাঁদের মধ্যে বিষ্ণু, সূর্য, কার্তিকেয়, মনসা, শিব, নবগ্রহ, ব্রহ্মা, যম, বরুণ, মহিষমর্দিনী প্রধান। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন যথাক্রমে বিষ্ণু ও সূর্য। পুণ্ড্রের সৌর উপাসনার ধারা বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন ছিল ভারতবর্ষে, আদিত্যপুরাণ নামের বিশাল গ্রন্থও রচিত হয়েছিল এই সময়, যেটি কালের বিবর্তনে আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। অপরদিকে সারা পুণ্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলে যে পরিমাণে বিষ্ণুমূর্তি আজও পুরোনো পুকুর সংস্কারের সময়, বাড়ি তৈরির সময় ও প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে বেরিয়ে আসছে, সে সংখ্যার দিকে তাকালে রীতিমতো আশ্চর্য হতে হয়। এত বিপুল সংখ্যক বিষ্ণুমূর্তি প্রাপ্তি থেকে বুঝা যায়, এই অঞ্চলে তথা বাংলায় বিষ্ণুর উপাসনা কতটা প্রসারিত হয়েছিল। পুণ্ড্রে বুদ্ধের চেয়ে বিষ্ণু মূর্তি বেশি পাওয়া যায় এবং অনেক জায়গায় বুদ্ধের স্থান বিষ্ণু অধিকার করেছেন। বরেন্দ্রীর জয়পুরহাটের বেল আমলা গ্রাম থেকে শ্রদ্ধেয় রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য একটি পাথরখণ্ড আবিষ্কার করেন, যেটিতে অনেকগুলো মূর্তি খোদিত ছিল। মাঝখানের প্রধান মূর্তিটি চতুর্ভুজ বিষ্ণুর, যেটি মূলত তথাগত বুদ্ধের মূর্তির দুই হাতের সঙ্গে আরো দুটি হাত খোদিত করে চার হাত তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মূর্তিতে উপস্থিত অন্যান্য অনুষঙ্গ থেকে এটি চিনতে অসুবিধা হয়নি যে এটি বুদ্ধ মূর্তি।
নানা সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সমগ্র পুণ্ড্রবর্ধনে গুপ্তযুগ থেকে সেনযুগ পর্যন্ত সময়কালের অনেক বিষ্ণুমন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। গুপ্ত ও পাল আমলের অনেকগুলো তাম্রশাসন থেকে রাজানুগ্রহে বিষ্ণুমন্দির স্থাপনের জন্য ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করার কথা জানা যায়। শুশুনিয়া শিলালেখ থেকে চক্রস্বামী, বৈগ্রাম তাম্রশাসন থেকে গোবিন্দস্বামী এবং দামোদরপুরের ৪র্থ ও ৫ম তাম্রশাসন থেকে যথাক্রমে কোকামুখস্বামী ও শ্বেতবরাহস্বামী নামক বিষ্ণুর কথা জানা যায়। ধর্মপালদেবের খালিমপুর তাম্রশাসনে বিষ্ণুমন্দির স্থাপনা ও মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য কয়েকটি গ্রাম দানের কথা পাওয়া যায়। মাথরাই শিলালিপিতে বালগ্রাম ও শীয়ম্বপুরে মোট তিনটি বিষ্ণুবিগ্রহ স্থাপনের কথা লিপিবদ্ধ আছে। সোমপুর মহাবিহার [পাহাড়পুর] এর কেন্দ্রীয় মন্দিরের দেয়ালে পোড়ামাটির ফলকে কৃষ্ণলীলা উৎকীর্ণ রয়েছে। এরূপ বহু শিলালেখ ও তাম্রশাসন থেকে বিষ্ণু উপাসনার ব্যাপ্তি সম্পর্কে পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায়।
পুণ্ড্রবর্ধন
তন্ত্ররশ্মি গ্রন্থ বলছে, বিষ্ণুর অধিষ্ঠান যেখানে— প্রবল তন্ত্রের উপস্থিতি তো সেখানেই। তন্ত্রাচার্যগণ সাধনার সুবিধার্থে সমগ্র ভারতকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, প্রতিটি ভাগকে বলা হয় ‘ক্রান্তা’। প্রতিটি ক্রান্তার জন্য ৬৪টি করে তন্ত্র প্রণয়ন করেছেন তন্ত্রাচার্যগণ, মোট আছে ১৯২টি তন্ত্র। তিনটি ক্রান্তার নাম যথাক্রমে বিষ্ণুক্রান্তা, রথক্রান্তা ও অশ্বক্রান্তা বা গজক্রান্তা। সমগ্র বৃহৎ বঙ্গ, কামরূপ ও নেপাল— এই সুবিশাল অঞ্চল নিয়ে বিষ্ণুক্রান্তা। সুতরাং তন্ত্রের উৎকর্ষের কালেও সমগ্র পুণ্ড্রবর্ধনে বিষ্ণুর উপস্থিতি সুস্পষ্ট।
পুণ্ড্রবর্ধন
দশম শতকে রচিত ‘কবীন্দ্রবচন সমুচ্চয়’ গ্রন্থে রাধার অভিসারিকার যেন ইঙ্গিত পাওয়া যায়:
মার্গে পঙ্কিনি তয়োদাদ্ধতমসে নিঃশব্দ সঞ্চারকং।
গন্তব্যা দয়িতস্য মেহদ্য বসতিমুর্গ্ধেতি কৃত্বা মতিম্।
আজানুদ্ধৃত নূপুরা করতলেনাছাদ্য নেত্রে ভৃশং
কৃচ্ছ্বাল্লব্ধ পদস্থিতিঃ স্বভবনেপন্থানমভ্যস্যতি।।
এর অর্থ হল: ঘন অন্ধকার সমাচ্ছন্ন পঙ্কিল পথে নিঃশব্দ পদচারণায় অভিসারে যেতে হবে— এই মনে করে এক মুগ্ধা রমণী নূপুরকে জানু পর্যন্ত তুলে, নয়ন যুগল করতলের দ্বারা আচ্ছাদন করে অতি আয়াসে নিজ ঘরের মধ্যে পদচালনা অভ্যাস করছে।
একইভাবে প্রাচীন অনেকানেক সাহিত্য ও শাস্ত্র গ্রন্থে আমরা বৈষ্ণবধারার উল্লেখ পাই।
ফিরে আসি, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে। বৈগ্রাম তাম্রশাসনে উল্লিখিত গোবিন্দস্বামীর মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বৈগ্রামে রয়েছে। দিনাজপুরের কাহারোলের মাধবগাঁওয়ে দশম-একাদশ শতকের নবরথ গঠনশৈলীর একটি বিষ্ণু মন্দির সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমস্ত পুণ্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলে। মহাস্থানগড়ের গোবিন্দভিটা এমনই একটি প্রাচীন বিষ্ণুমন্দির ছিল, প্রাচীন গ্রন্থাদির আলোকে এমনটাই আমার মতামত। এ বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
করতোয়া মাহাত্ম্যে মহাদেব করতোয়া তীরস্থ তীর্থক্ষেত্রের বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা থেকে আমরা পুণ্ড্রে বিষ্ণুর অধিষ্ঠানের কথা পাই এভাবে:
মৎপুত্রোহপি গুহস্তত্র তিষ্ঠতোব হি সর্ব্বদা।
যত্রাস্তে ভগবান বিষ্ণুর্গরুড়াসন ঈশ্বরঃ।। ৭
অর্থাৎ সেই পৌণ্ড্রক্ষেত্রে আমার পুত্র গুহ [কার্তিকেয়] সর্বদাই বাস বিরাজমান। সে ক্ষেত্রে ভগবান বিষ্ণু গরুড়াসনে অবস্থান করেন। করতোয়া মাহাত্ম্যের আরো ভেতরে গেলে পাই:
স্কন্দগোবিন্দয়োর্মধ্যে ভূমিঃ সংস্কৃতবেদিকা।
বেদীমধ্যোত্তরে পার্শ্বে দেবী কালঞ্জরী স্থিতা।। ১৭
পুণ্ড্রের প্রসিদ্ধ স্কন্দ ও গোবিন্দ মন্দিরের মধ্যবর্তী ভূমিকে “বেদিকা” অর্থাৎ সিদ্ধপীঠ বলা হচ্ছে; যেটি বর্তমান স্কন্দের ধাপ ও গোবিন্দ ভিটার মধ্যবর্তী স্থান। করতোয়া মাহাত্ম্য অনুসারে এই বেদীকার চারপাশে রাজা পরশুরাম কর্তৃক পুনঃস্থাপিত সিদ্ধপীঠগুলো হল: কালঞ্জরী, কোটীশ্বরী, কোটীলিঙ্গ, বিজয়াচণ্ডী, ভূতিকেশ্বর ও ভূমিকেশ্বর। এছাড়া বেদিকার চারপাশে সূর্য, বিষ্ণু, বলভদ্র, কার্তিকেয় সদা বিরাজমান বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
করতোয়া মাহাত্ম্যে আরো বলা হয়েছে:
স্কন্দগোবিন্দয়োর্ম্মধ্যে সোমবারে কুহূতিথৌ।
প্রাতরুত্থায় যঃ স্নায়াৎ কুলকোটিং সমুদ্ধরেৎ।। ৩০
স্কন্দ গোবিন্দয়োর্ম্মধ্যে গুপ্তা বারাণসী পুরী।
তত্রারোহণ মাত্রেণ নরো নারায়ণো ভবেৎ।। ৫৭
অর্থাৎ, পুণ্ড্রনগরের স্কন্দ ও গোবিন্দ মন্দিরের মধ্যবর্তি স্থানে করতোয়া নদীতে পৌষনারায়ণী যোগে স্নান করলে অশেষ পুণ্য অর্জন হয়।
স্কন্দপুরাণেও আমরা এই বেদিকার উল্লেখ পাই। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, প্রসিদ্ধ শীলাদেবীর ঘাট এই বেদিকার সীমার মধ্যে অবস্থিত। বর্তমান শীলাদেবীর ঘাটটি করতোয়ার গতিপথ বদলের কারণে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছে এবং বর্তমান ঘাটটির অপর পাশে মহাস্থান শ্মশান। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা যায়, শীলাদেবীর প্রাচীন ঘাটটি পুণ্ড্রের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে বর্তমান জাহাজঘাটার নিকটে ছিল এবং পুণ্ড্রনগর থেকে আসা যাওয়ার জন্য ছিল দরজা। প্রাচীন ঘাট বলুন আর বর্তমান ঘাট বলুন, দুটি ঘাটই ‘বেদিকা’ অর্থাৎ স্কন্দের ধাপ ও গোবিন্দ ভিটার মধ্যবর্তী স্থানটিতে অবস্থিত। পুণ্ড্রনগরের সেই স্কন্দ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজো স্কন্দের ধাপে মাটির নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে। আর স্কন্দের ধাপ ও গোবিন্দ ভিটার মধ্যবর্তী শিলাদেবীর ঘাটে (শিলাদ্বীপ থেকে বিবর্তিত নাম} শত বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পৌষনারায়ণী মেলা আজো অনুষ্ঠিত হয়।
কলহনের রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য এর পৌত্র জয়াপীর (৭৭৯-৮১৩ সাধারণাব্দ) গঙ্গার ওপারে সৈন্যবাহিনী লুকিয়ে রেখে ছদ্মবেশে পুণ্ড্রনগরে আসেন। পুণ্ড্রের সৌন্দর্য, বিশেষ করে স্কন্দ ও গোবিন্দ মন্দির তাঁকে মুগ্ধ করে। স্কন্দের মন্দিরে সন্ধ্যারতির সময় সেবাদাসী কমলার নাচ দেখে জয়াপীর বিমোহিত হন এবং কমলার প্রেমে পড়েন। জয়াপীর এক রাতে একটি সিংহ মেরে পুণ্ড্রের রাজা জয়ন্তের সুনজরে আসেন। সিংহটি পুণ্ড্রনগরের বাসিন্দাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজা জয়ন্ত জয়াপীরের পরিচয় পেয়ে তাঁর কন্যা ললিতার সঙ্গে বিয়ে দেন। জয়াপীর নিজের বাহুবলে শ্বশুর জয়ন্তকে পঞ্চগৌড়েশ্বর করেন। কাশ্মীর ফিরে যাওয়ার সময়ে তিনি কমলাকেও রানী করে নিয়ে যান।
লঘুভারতে বলা হয়েছে, মানসিংহ কামরূপ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় পুণ্ড্রনগরে আসেন এবং অনেক লুপ্ত তীর্থ সনাক্ত করেন। এর মধ্যে স্কন্দ, গোবিন্দ মন্দির আর শিলাদ্বীপ উল্লেখ্য। প্রায় সবকটি তীর্থ ও মন্দিরকে তিনি অতি করুণ অবস্থায় দেখতে পান ও ব্যথিত হন।
এভাবে প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তিতে আজকের গোবিন্দ ভিটাকে সনাক্ত করতে অসুবিধা হয় না। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যায় যে, গোবিন্দ ভিটায় কয়েকটি নির্মাণ কালের নিদর্শন পাওয়া গেছে— সর্বশেষ নির্মাণকাল ছিল মুসলিম যুগের। অর্থাৎ এই স্থাপনাটি পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে অনেকবার। তাই উৎখননে এখানে গোবিন্দ মন্দিরের নিদর্শন না-ও পাওয়া যেতে পারে।
শ্রদ্ধেয় রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করার সময় গোবিন্দ ভিটা পর্যবেক্ষণ করেন। তখনো এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ করা হয়নি এবং জায়গাটি ‘গোবিন্দের দ্বীপ’ নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় গোবিন্দ ভিটার উত্তর পাশে, অর্থাৎ যে পাশ দিয়ে করতোয়ার ক্ষীণ ধারা বয়ে চলেছে, সেখানে নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছিল। তখন মাটি সরানোর ফলে পাথরের ভিত্তি-দেয়াল বেরিয়ে আসে। দেয়ালটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০ ফুট। সম্পূর্ণ দেয়ালটি প্রাচীন স্থাপনা, বিশেষত কোনো মন্দির থেকে সংগৃহীত নকশাকার পাথরখণ্ড দিয়ে নির্মিত ছিল। স্থানীয় লোকজন দেয়ালটিকে ‘পাথরঘাটা’ বলতো। পাথরখণ্ডে নানা রকম মূর্তি খোদিত ছিল, যেগুলো বিনষ্ট করা হয়েছিল পুনর্ব্যবহারের সময়। এই দেয়াল থেকে সামান্য দূরে ছিল শীলাদেবীর ঘাট। সে ঘাটেও পাথরের নকশাকার খণ্ড দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯২২ সালের প্রবল বন্যায় পাথরের দেয়াল ও ঘাট করতোয়ায় ভেসে যায়।
গোবিন্দ ভিটা প্রত্নস্থলে ১৯২৮–২৯ সালে কে. এন দীক্ষিত প্রথম খননকার্য পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে ড. নাজিমউদ্দীন আহমদ এখানে একটি গভীর খাদ খনন করেন।
কে. এন. দীক্ষিতের খননে পূর্ব ও পশ্চিমে পাশাপাশি অবস্থিত দুই সেট মন্দির এবং পরপর চারটি যুগের নিদর্শনসমূহ পাওয়া গিয়েছে।
(১) পশ্চিম পাশে রয়েছে পরবর্তী গুপ্তযুগে (৬ষ্ঠ – ৭ম শতক) নির্মিত বারান্দাযুক্ত একটি মন্দির যার ভিত্তিভূমি অত্যন্ত গভীর এবং অফসেট যুক্ত।
(২) পশ্চিম পাশেই প্রাথমিক পাল যুগে (৮ম – ৯ম শতক) প্রতিষ্ঠিত একটি বারান্দাযুক্ত মন্দির রয়েছে যার ভিত্তি স্তরে স্তরে উঁচু করে নির্মিত হয়েছিল।
(৩) পশ্চিম পাশের এই উঁচু ভিত্তিটি পরবর্তী পাল ও সেন যুগে এবং এমনকী মুসলমানদের সময়েও ব্যবহৃত হয়েছিল। মন্দিরের পাশে একটি চন্ডীদেবীর প্রস্তর প্রতিমা (১১ শতক) এবং একটি নৃত্যরত গণেশের প্রস্তর প্রতিমা (১১ শতক) পাওয়া গিয়েছে।
(৪) পশ্চিম পাশের মন্দিরের উপরে মুসলিম তথা সুলতানি যুগে (১৫ – ১৬ শতক) নির্মিত একটি ইটের প্ল্যাটফর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে।
গোবিন্দ ভিটার পূর্ব পাশের মন্দির অংশে সুস্পষ্ট চারটি যুগের সাংস্কৃতিক নিদর্শনসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে। যথা: (১) পরবর্তী গুপ্ত যুগে নির্মিত বর্গাকৃতির মন্দির যার মধ্যে প্রদক্ষিণপথ বেষ্টিত একটি আয়তাকার ডায়াস রয়েছে। (২) প্রাথমিক পাল যুগে নির্মিত একটি কমপ্লেক্স এবং বহুপার্শ্ব বিশিষ্ট প্রস্তর বেদি। (৩) পরবর্তী পাল যুগে নির্মিত কিছু ক্ষয়িষ্ণু দেওয়াল এবং একটি সম্ভাব্য অগ্নিশিলা। (৪) মুসলিম তথা সুলতানি যুগে নির্মিত একটি ভগ্ন মেঝের মধ্যে ১৮টি সুলতানী আমলের মুদ্রা ভর্তি একটি মাটির পাত্র।
গোবিন্দ ভিটা
উল্লেখ্য, প্রাথমিক পাল যুগেই দুটি মন্দির ঘিরে একটি সাধারণ বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া মন্দির সংলগ্ন নদীর তীরে এ যুগে নির্মিত পাথরের রক্ষা বাঁধ বা রক্ষা প্রাচীর এবং একটি পাথরের বাঁধানো ঘাট ছিল যা ১৯২২ সালের প্লাবনে ভেসে গিয়েছে।
গোবিন্দ ভিটায় ১৯৬০ সালের গভীর খাদ খননের ফলে আবিষ্কৃত হয় মৌর্যযুগের ছাপাঙ্কিত ও ঢালাই করা রৌপ্য মুদ্রা এবং উত্তরাঞ্চলীয় কালো চকচকে মৃৎপাত্র, অর্ধ-ডজন শূঙ্গযুগের (সাধারণ পূর্ব ২য়-১ম অব্দ) পোড়ামাটির ফলক, একটি খোদাইকৃত নীল পাথরের চাকতি-আকৃতির প্রসাধনী ট্রে (সাধারণাব্দ ১ম-২য় শতক), একটি কাদা মাটির তৈরি সিলমোহর ও পোড়ামাটির মস্তক (৪র্থ শতাব্দী), তিনটি বৃহৎ মাটির পাত্র বা ভাট (সাধারণাব্দ ৬-৭ শতক) যাতে শঙ্খখোসা, চুন এবং নরকঙ্কাল ছিল।
এখানে প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন আকৃতির ও ধরনের পোড়ামাটির দ্রব্য, স্বল্পমূল্যের পাথরের তৈরি গুটিকা ও বোতাম, কানবালা ও কুন্তল, নাকফুল ইত্যাদি। এ ছাড়া, পোড়ামাটির মূর্তি ও খেলনা এবং তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরি বলয় এবং সুরমা দণ্ডও পাওয়া গিয়েছে।
পুণ্ড্রনগরের সহস্র বছরের ইতিহাসে গোবিন্দ ভিটা সন্দেহাতীতভাবে একটি বিশাল অধ্যায় বুকে ধারণ করে আছে।
তথ্যসূত্র:
১. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পার্ল পাবলিকেশন্স, ২য় সংস্করণ, ২০১১
২. বৈষ্ণব পদাবলীর পরিচয়, সনাতন গোস্বামী, digitallibraryindia; JaiGyan ১৯৫৩
৩. তন্ত্ররশ্মি, শ্রীআশুতোষ চৌধুরী, যোগমায়া আশ্রম, লাবান, শিলং, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ, পিডিএফ
৪. পৌণ্ড্রবর্ধন ও করতোয়া- প্রাচীন বাঙ্গালার উজ্জ্বল চিত্র, শ্রীহরগোপাল দাসকুণ্ডু, সমর পাল (সম্পাদক), শোভা প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ, ২০১৬