সহস্র কলঙ্কিনী ও গিরিরাজ ম্যাক্সওয়েল
সাড়ে ছ’ মিনিট
১৯৬১ সাল। ইউএসএ-র পাসাডেনা শহরের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে তখন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে সদ্য স্নাতক হয়েছেন রিচার্ড মরিস গোল্ডস্টাইন (Richard Morris Goldstein) (১৯২৭-২০২৪)। পিএইচডি-র জন্য এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। তাঁর গাইড অধ্যাপক হার্ডি মার্টেল (Hardy Martel) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছো কিছু?’ দ্বিধাহীন চিত্তে গোল্ডস্টাইনের জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ স্যার, শুক্র পৃষ্ঠ থেকে রেডিও ওয়েভ প্রতিফলন সংগ্রহের কথা ভেবেছি’।
‘অ্যাঁ, এ ছেলে বলে কী?’ খানিকটা চমকেই উঠেন হার্ডি, ‘শুক্র পৃষ্ঠ থেকে রেডিও ওয়েভের প্রতিফলন সংগ্রহ করবে?’ বিষয়টা যে এক্কেবারে আধুনিক ও অত্যন্ত দুরূহ কাজ তা বিলক্ষণ বোঝেন হার্ডি। পৃথিবী পৃষ্ঠের কোনো এক স্থান থেকে রেডিও ওয়েভ নিক্ষেপ করে, সেই রেডিও ওয়েভের প্রতিফলন সংগ্রহ করে, কোনো পাহাড়ের দূরত্ব বা সমুদ্রের গভীরতা মাপা যায় নিশ্চয়। কিন্তু তাই বলে ঘূর্ণায়মান গ্রহকে তাক করে রেডিও ওয়েভ নিক্ষেপ করা! সেই রেডিও ওয়েভের আবার প্রতিফলন সংগ্রহ করা! এখান থেকে শুক্র গ্রহকে তো এইটুকু দেখায়। তাকে লক্ষ করে রেডিও ওয়েভ ছোঁড়া হয়তো যাবে, কিন্তু তার প্রতিফলন সংগ্রহ করা মোটেও সম্ভবপর নয়। এই তো কিছুদিন আগে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির লিঙ্কন ল্যাবরেটরির গবেষকরা ঠিক এই রকমই একটা পরীক্ষা করেছিলেন। তাতে আশে পাশের কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই ধরা পড়েনি তাঁদের সংগ্রাহক যন্ত্রে। আর এই ছেলে বলে কিনা শুক্র পৃষ্ঠ থেকে রেডিও ওয়েভের প্রতিফলন সংগ্রহ করবে? বিরক্ত হার্ডি বলে ওঠেন, ‘ওসব হাবিজাবি না বকে অন্য কোনো বিষয় পছন্দ করো’। কিন্তু গোল্ডস্টাইন নাছোড় – ‘স্যার, একবার চেষ্টা করেই দেখি না। যদি কিছু পাওয়া যায়’। গোল্ডস্টাইনের কথায় এবার বেজায় চটেছেন মার্টেল। রুষ্ট মার্টেল এবার সাফ জানিয়ে দেন, ‘তোমার ইচ্ছা হলে তুমি পরীক্ষা করতে পারো, কিন্তু মনে রেখো – নো ইকো, নো থিসিস (No Echo, No Thesis)। প্রতিফলন যদি ধরতে না পারো, তাহলে তোমার গবেষণা খারিজ করে দেবো আমি’।
চিত্র-১
ক্যারিয়ার খতমের এ হেন হুমকি শুনেও কিন্তু বেজায় খুশি গোল্ডস্টাইন। স্যার তাঁর পরিকল্পনা অনুমোদন তো করেছেন! এর থেকে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে? পারবেন, ঠিক পারবেন তিনি। শুক্র পৃষ্ঠ থেকে রেডিও ওয়েভের প্রতিফলন সংগ্রহ করতে পারবেন। স্যারের অনুমতি পেয়ে, গোল্ডস্টাইন চলে গেলেন পাসাডেনা শহরের ২০০ কিমি পশ্চিমে মোহাবে (Mojave) মরুভূমির মাঝে গড়ে ওঠা গোল্ডস্টোন ডিপ স্পেস কমিউনিকেশনস্ কমপ্লেক্সে। নাসা ও ক্যালটেকের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠা এই কমপ্লেক্সে পৌঁছায় না সভ্য জগতের কোনো শব্দ। সেখানে শুধু আছড়ে পড়ে মহাকাশের নির্বাক তরঙ্গ।
১০ মার্চ ১৯৬১, নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে শুক্র গ্রহ তখন পৃথিবীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। গোল্ডস্টোন কমপ্লেক্সের রেডারকে শুক্র মুখে তাক করা হল। যথাসম্ভব নিশানা ঠিক রেখে শুক্রের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হল রেডিও তরঙ্গ। মহাকাশের বুক চিরে সে তরঙ্গ ধেয়ে চলল শুক্র গ্রহের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে তরঙ্গ আছড়ে পড়ল শুক্র পৃষ্ঠে। সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরতি পথে এবার সে ছুটে চলল পৃথিবীর দিকে। তরঙ্গ ছোঁড়ার সাড়ে ছ’ মিনিটের মাথায় গোল্ডস্টোন কমপ্লেক্সের সংগ্রাহক যন্ত্রে ধরা পড়ল সেই প্রতিফলিত তরঙ্গ। উল্লাসে ফেটে পড়লেন গোল্ডস্টাইন ও তাঁর সহকর্মীরা। পেরেছেন, তাঁরা পেরেছেন শুক্র পৃষ্ঠ থেকে রেডিও প্রতিফলন সংগ্রহ করতে পেরেছেন। কিন্তু এখনই জনসমক্ষে এই সাফল্যের খবর তুলে ধরতে চান না তাঁরা। আগে এই ফলাফল নিয়ে নিশ্চিত হতে চান সতর্ক গোল্ডস্টাইন। ফলাফল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরপর বেশ ক’দিন ধরে চলল শুক্রের উদ্দেশ্যে রেডিও তরঙ্গ নিক্ষেপণ আর তার প্রতিফলন সংগ্রহের পরীক্ষা। প্রতিবারই সফল ভাবে শুক্র পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ সংগ্রহ করতে সক্ষম হন গোল্ডস্টাইন। ১৬ মার্চ টেলেক্স মারফৎ ক্যালটেক-এ পাঠানো হল সুখবর- “Have been obtaining real time radar reflected signals from Venus from march 10 …” । ১০ মে ১৯৬১ পর্যন্ত, টানা তিন মাস, প্রায় প্রতিদিন একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করে চললেন তাঁরা। আর প্রতিবারই সাফল্যের সাথে সংগ্রহ করে চললেন শুক্র পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত রেডিও তরঙ্গ। বলা বাহুল্য, সেই ফলাফলের ভিত্তিতেই গোল্ডস্টাইন লিখে ফেললেন তাঁর যুগান্তকারী থিসিস পেপার ‘রেডার এক্সপ্লোরেশান অফ ভেনাস’ (Radar Exploration of Venus)। যুগান্তকারী এই কর্ম পদ্ধতির জন্যই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘রেডার ইন্টারফেরোমেট্রির জনক’ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন তিনি।
মেঘের ’পরে মেঘ
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল গোল্ডস্টাইনের এই পরীক্ষা। গোল্ডস্টাইনের পরীক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে গেলে, আরও প্রায় ৩০-৩৫ বছর পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের। সেটা ১৯২৪ সাল, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ারকিস মানমন্দিরের (Yerkes Observatory) অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফারের পদে তখন সদ্য যোগ দিয়েছেন পদার্থবিদ ফ্রাঙ্ক এলমোর রস (Frank Elmore Ross) (১৮৭৪-১৯৬০)। ইয়ারকিস মানমন্দিরে বসানো রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রতিসারক টেলিস্কোপ। ৬০ ফুট লম্বা এই টেলিস্কোপের মাথায় লাগান আছে ৪০ ইঞ্চি ব্যাসের ইয়া বড়ো এক লেন্স। মহাকাশের রহস্যভেদ করতে সে এক অমোঘ যন্ত্র। মানমন্দিরে যোগদানের পরদিন থেকেই মহাকাশের দিকে সেই টেলিস্কোপ তাক করে একের পর এক চমকপ্রদ সব ফটো তুলতে থাকেন রস। সেই সমস্ত চিত্র বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে পেশ করতে থাকেন নতুন নতুন সব তথ্য।
টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা নতুন কোনো ঘটনা নয়। গ্যালিলেওর আমল থেকেই টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণ মানের সেই সব টেলিস্কোপ দিয়েই চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতি সম্পর্কে কত কিছুই না আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম গ্রহ, শুক্র সম্পর্কে নতুন কোনো কথা শোনাতে পারেননি তাঁদের কেউই। অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের গায়ে নজরে পড়ার মতো কিছু কলঙ্ক বা দাগ বা রঙের ছোপ, যাহোক একটা কিছু সহজেই লক্ষ করা যায়। কিন্তু শুক্রের গায়ে তেমন কোনো দাগ দেখতে পাওয়া যায় না। টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেও গোটা গ্রহটাকে একই রকমের ঘোলাটে সাদা রঙের দেখতে লাগে। ইয়ারকিস মানমন্দিরের টেলিস্কোপ দিয়ে ছবি তুলে এহেন শুক্রের সম্পর্কে কিন্তু বেশ কিছু নতুন এক কথা শোনালেন ফ্রাঙ্ক রস। ১৯২৭ সালে ইনফ্রারেড ও আল্ট্রাভায়লেট রশ্মির সাহায্যে শুক্র গ্রহের একাধিক ছবি তোলেন রস। বছর ভর সেই ফটো বিশ্লেষণ করার পর ১৯২৮ সালে তিনি জানালেন, শুক্র গ্রহের আকাশ সর্বদাই ঘন মেঘে আবৃত থাকে। মেঘ বলতে জলীয় বাষ্পের মেঘ নয়। শুক্রের আকাশে মেঘের মূল উপাদান হল কার্বন ডাই অক্সাইড, সাথে কিছু সালফিউরিক অ্যাসিড বাষ্প। বায়ুমণ্ডলের এই ঘন মেঘের স্তর ভেদ করে, শুক্র পৃষ্ঠে সূর্যালোক পৌঁছে যায় ঠিকই, কিন্তু শুক্র পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ার পর সেই আলো আর মেঘের স্তর ভেদ করে বাইরে বেরতে পারে না। এই গ্রিন হাউস এফেক্টের ফলে শুক্রর আবহাওয়া হয়ে উঠে অত্যন্ত গরম। বলা প্রয়োজন, সূর্যের নিকটবর্তী বুধ গ্রহের গড় তাপমাত্রা ৩৩৩০ সেন্টিগ্রেড, সেখানে বুধের তুলনায় সূর্য থেকে দূরে থেকেও শুক্র গ্রহের গড় তাপমাত্রা ৪৬৪০ সেন্টিগ্রেড। শুক্রই হলো সৌর মণ্ডলের উষ্ণতম গ্রহ। গ্রিন হাউস এফেক্টের ফলে শুক্র পৃষ্ঠ থেকে কোনো আলো মহাকাশে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে, যত শক্তিশালী টেলিস্কোপই ব্যবহার করা হোক না কেন, শুক্রের মূল ভূমির কোনো ছবি পৃথিবী থেকে কোনো দিনই দেখা যাবে না। টেলিস্কোপ দিয়ে শুক্র গ্রহের যে ছবিটা আমরা দেখে থাকি তা আসলে শুক্রের আকাশে সদা বিরাজমান মেঘের বাইরের দিকের স্তরটা। আর শুক্রের আকাশে চিরস্থায়ী এই মেঘের স্তরের জন্যই এই গ্রহকে সর্বদা সাদাটে দেখায়।
রসের এই সিদ্ধান্তও ছিল যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত। কারণ, রসের এই সিদ্ধান্তই বিজ্ঞানীদের নতুন ভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন টেলিস্কোপ দিয়ে শুক্র পৃষ্ঠের রহস্য ভেদ করা যাবে না। আর ঠিক তখনই শুক্র পৃষ্ঠের রেডিও প্রতিফলনের বিষয়টা সামনে আসে। মেঘের স্তর ভেদে করে অনায়েসে শুক্র পৃষ্ঠে পৌঁছতে সক্ষম রেডিও তরঙ্গ। শুক্র পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হওয়ার পর ফের মেঘের স্তর ভেদ করে সেই তরঙ্গ দিব্যি বেরিয়েও আসতে পারে। ঠিক এই কারণেই নিজের গবেষণার বিষয় হিসেবে শুক্র পৃষ্ঠের রেডিও প্রতিফলন বিষয়টা বেছে নিয়েছিলেন গোল্ডস্টাইন। আর সফল ভাবে সেই প্রতিফলিত রেডিও ওয়েভ সংগ্রহও করেছিলেন তিনি। গোল্ডস্টাইন সংগৃহীত সেই তথ্য নিয়ে চলল বছর ভর বিচার বিশ্লেষণ। তাঁর সংগৃহীত রেডিও চিত্রে প্রাথমিক ভাবে পাঁচটা কালো অঞ্চল ধরা পড়েছে। রেডিও ইমেজিং তত্ত্ব অনুসারে এই কালো দাগগুলো উচ্চভূমিকে নির্দেশ করছে। ১৯৬৪ সালে সেই চিত্র দেখে সবাই নিশ্চিত হলেন, এই দাগগুলো আদতে শুক্র পৃষ্ঠে অবস্থিত কোনো পাহাড় বা উচ্চভূমি। প্রাথমিক ভাবে এই পাঁচটা অঞ্চলকে গ্রিক বর্ণ আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা ও এপসিলন নামে অভিহিত করলেন গোল্ডস্টাইন। পরবর্তীকালে, এই পাঁচ অঞ্চলের মধ্যে প্রথম দুটো অঞ্চল যথাক্রমে আলফা রিজিও (Alpha Regio) ও বিটা রিজিও (Beta Regio) নামে পরিচিত হয়। ল্যাটিন ভাষায় ‘রিজিও’ শব্দের অর্থ অঞ্চল। আলফা রিজিওকে দেখতে খানিকটা বৃত্তের মতো। আলফা রিজিওর গড় ব্যাস প্রায় ২৫ কিমি মতো। আলফা রিজিওর উচ্চতা প্রায় ৭৫০ মিটার। অপরদিকে, খানিকটা আয়তক্ষেত্রের মতো দেখতে বিটা রিজিও। বিটা রিজিওর দৈর্ঘ্য ৭৫ কিমি, প্রস্থ ২০ কিমি এবং উচ্চতা প্রায় ২ কিমি মতো।
গিরিরাজ
গোল্ডস্টাইনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউএসএ-র অন্যান্য মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রগুলোতেও রেডিও প্রতিফলনের ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের পোয়ের্তো রিকো দ্বীপের অ্যারেসিবো (Arecibo) শহরের দক্ষিণ প্রান্তে স্থাপন করা হয় তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপ। ১৯৬৪ সালে অ্যারেসিবো মানমন্দিরে রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে গবেষণা করতে আসেন নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা আরেক স্নাতক রেমন্ড এফ. জুরগেন্স (Raymond F. Jurgens) (১৯৩৭-২০২০)। ১৯৬৭ সালে, গোল্ডস্টাইনের মতোই, শুক্র গ্রহের উদ্দেশ্যে রেডিও তরঙ্গ নিক্ষেপের পরীক্ষা শুরু করেন জুরগেন্স। বছর ভর চলা পরীক্ষায়, সাফল্যের সাথেই শুক্র পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত রেডিও তরঙ্গ সংগ্রহ করেন জুরগেন্স। পরীক্ষার সামগ্রিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে গোল্ডস্টাইনের মতো তিনিও শুক্রের রেডিও চিত্রে চারটে কালো দাগ চিহ্নিত করেন। এখন একথা নিশ্চিত যে এই কালো দাগগুলো হল শুক্র পৃষ্ঠের উচ্চভূমি কিম্বা পাহাড়। ১৯৭০ সালে শুক্র পৃষ্ঠের সেই চার উচ্চভূমিকে গাওস, হার্জ, ফ্যারাডে এবং ম্যাক্সওয়েল নাম দিয়ে চিহ্নিত করেন জুরগেন্স।
চিত্র-২
জার্মান গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ কার্ল ফ্রেডরিখ গাওস, জার্মান পদার্থবিদ হেনরিখ রুডলফ হার্জ, ইংরেজ পদার্থবিদ ও রসায়নবিদ মাইকেল ফ্যারাডে এবং স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল-এর স্মরণে শুক্র পৃষ্ঠের সেই চার নাম চয়ন করেছিলেন জুরগেন্স। কিছুদিন পর, জুরগেন্স-এর হিসাবে অবশ্য কিছু গোলমাল ধরা পড়ে। আরও বিচার বিশ্লেষণ করার পর অন্যান্য গবেষণাগারের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, জুরগেন্স আদতে গোল্ডস্টাইনের চিহ্নিত করা অঞ্চলগুলোই ফের চিহ্নিত করে ফেলেছেন। তাঁরা বললেন জুরগেন্স-এর চিহ্নিত করা গাওস ও হার্জ অঞ্চল দুটো প্রকারান্তরে গোল্ডস্টাইন চিহ্নিত বিটা রিজিওর অন্তর্গত। আর ফ্যারাডে অঞ্চলটা গোল্ডস্টাইনের আলফা রিজিওর অন্তর্গত। একমাত্র ম্যাক্সওয়েল অঞ্চলটাই জুরগেন্স-এর নতুন আবিষ্কার।
জুরগেন্স আবিষ্কৃত ম্যাক্সওয়েল অঞ্চলটা আসলে ৮০০ কিমি লম্বা সুউচ্চ এক পর্বত শ্রেণি। সেই সূত্রে শুক্র পৃষ্ঠের এই পাহাড়ের নাম রাখা হয় ম্যাক্সওয়েল মন্টেস (Maxwell Montes)। মন্টেস কথাটার অর্থ হল পর্বত শ্রেণি। পরবর্তীকালের গবেষণায় ধরা পড়ে, শুক্র গ্রহের গড় পৃষ্ঠতল থেকে ম্যাক্সওয়েল পর্বত শ্রেণির উচ্চতম শৃঙ্গের উচ্চতা প্রায় ১০,৯৪৩ মিটার, যা কিনা আমাদের মাউন্ট এভারেস্টের (৮,৮৪৯ মি) থেকেও ২ কিমি অধিক উঁচু। শুক্রের উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত ম্যাক্সওয়েল মন্টেসের উচ্চতম এই শৃঙ্গের নাম রাখা হল স্কাদি মন্স (Skadi Mons)। মন্স মানে পাহাড় বা শৃঙ্গ। আর স্কাদি হলেন স্ক্যানডিনেভিয়া অঞ্চলের নর্স (Norse) জাতির পাহাড় ও শীতের দেবী। নর্স জাতির দেবীর নামে শুক্র গ্রহের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম রাখা হয় স্কাদি মন্স।
কলঙ্কিনী
১৯৭৩ সালের ২১-৩০ আগস্ট। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে বসেছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের (International Astronomical Union, IAU) ১৫তম সাধারণ সভা। এতদিন পর্যন্ত মহাকাশের বিভিন্ন বস্তু বা স্থানের নামকরণের দায়িত্ব ছিল এই ইউনিয়নের উপর। কিন্তু ইউনিয়নের এই ১৫তম সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, এবার থেকে মহাবিশ্বের যাবতীয় নতুন অঞ্চলের নামকরণের দ্বায়িত্ব থাকবে ‘দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর প্ল্যানেটারি সিস্টেম নমেনক্লেচার’-এর (The Working Group for Planetary System Nomenclature, WGPSN) উপর। এই ওয়ার্কিং গ্রুপের অধীনে আবার গঠন করা হল পাঁচটা পৃথক টাস্ক গ্রুপ (Task group)। চাঁদ, মঙ্গল, বুধ, শুক্র ও বহির্সৌরজগৎ – এই পাঁচটা অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামকরণের দায়িত্ব থাকবে এই পাঁচটি টাস্ক গ্রুপের উপর। ১৯৮৪ সালে এই পাঁচটি গ্রুপের সাথে আরও একটি নতুন টাস্ক গ্রুপকে যুক্ত করা হয়। মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র গ্রহাণু (asteroids), ধূমকেতু অথবা ক্ষুদ্র বস্তু সমূহের নামকরণের দায়িত্ব বর্তায় এই ষষ্ঠ টাস্ক গ্রুপের উপর। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের (IAU) সিদ্ধান্ত মোতাবেক, পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো ব্যক্তি নতুন কোনো মহাজাগতিক বস্তুর নামকরণ বা নাম চয়ন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে নামকরণের প্রাথমিক প্রস্তাব পাঠাতে হবে নির্দিষ্ট টাস্ক গ্রুপের কাছে। সব দিক বিবেচনা করে টাস্ক গ্রুপ সেই নাম সুপারিশ করে পাঠাবে ওয়ার্কিং গ্রুপের কাছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ সেই নামকরণের প্রস্তাব রাখবে ইউনিয়নের সাধারণ সভায়। সাধারণ সভা সেই নাম অনুমোদন করলে, তবেই সেই মহাজাগতিক বস্তু বা অঞ্চলকে সরকারি ভাবে নতুন নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হবে।
১৪-১৮ জুলাই ১৯৭৫, মস্কো শহরে বসে ওয়ার্কিং গ্রুপের (WGPSN) দ্বিতীয় অধিবেশন। এই দ্বিতীয় অধিবেশনে শুক্র পৃষ্ঠ নামকরণের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নেন গ্রুপের সদস্যরা। প্রাচীনকাল থেকেই শুক্র গ্রহের সাথে নারী বা প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। সেই ধারা বজায় রেখে, এই অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, শুক্র গ্রহের সমস্ত কলঙ্ক (বা গর্ত), পাহাড়, খাদ, সমতলাদি কেবলমাত্র নারীদের নামেই নামকরণ করা হবে। সমস্ত সদস্যরা স্বাগত জানায় এই প্রস্তাবকে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় গোল্ডস্টাইন ও জুরগেনস্কে নিয়ে। শুক্র পৃষ্ঠের দুটো মালভূমি ও একটা পাহাড়ের নামকরণ যে ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন তাঁরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের আঙিনায় – আলফা রিজিও, বিটা রিজিও এবং ম্যাক্সওয়েল মন্টেস তখন বহুল ব্যবহৃত নাম। এই নামগুলো আবার কোনো নারীর নামও নয়। আলফা, বিটা গ্রিক বর্ণের নাম। সেটা না হয় ক্লীবলিঙ্গ হিসেবে মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল? ম্যাক্সওয়েল তো আদ্যন্ত পুরুষের নাম? সমগ্র নারী সাম্রাজ্যের মাঝে একা পুরুষ মানুষ হিসেবে ম্যাক্সওয়েলের নাম কি করে মেনে নেওয়া যায়? কী করণীয় তাহলে? ম্যাক্সওয়েল মন্টেস নামটা বদলে ফেলা হবে? এই প্রসঙ্গে ওয়ার্কিং গ্রুপ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ইতিমধ্যে শুক্র পৃষ্ঠের যে সব অঞ্চলের নামকরণ করা হয়ে গেছে, সেই সব অঞ্চলের নামের আর কোনো পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। এর পর যে সব অঞ্চলের নামকরণ করা হবে, সেই সমস্ত অঞ্চল কেবলমাত্র নারীদের নাম দিয়েই চিহ্নিত করতে হবে। ১৯৭৯ সালে ওয়ার্কিং গ্রুপের এই সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দেয় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের (IAU) সাধারণ সভা। ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক শুক্র পৃষ্ঠের আলফা রিজিও, বিটা রিজিও ও ম্যাক্সওয়েল মন্টেস নাম তিনটে বহাল থেকে যায় শেষ পর্যন্ত।
’৭৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সাধারণ সভায় নেওয়া সেই সিদ্ধান্তের পর থেকে, শুক্র পৃষ্ঠে সমস্ত কলঙ্ক (গর্ত), পাহাড়, সমতল, খাদকে কেবল মাত্র নারী বা দেবীদের নাম দিয়ে চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কোন্ কোন্ নারীর নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে শুক্র কলঙ্ককে? শুক্র পৃষ্ঠের নারীদের নামের সেই তালিকায় রয়েছেন- আগাথা ক্রিস্টি, আনা ফ্রাঙ্ক, ক্লিওপেট্রা, গ্রেটা গার্বো, জয় অ্যাডামসন, পার্ল এস. বাক, মাদাম তুঁসো, রাজিয়া সুলতানা, হেলেন কেলার সমেত পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত মহিলারাই। তালিকায় রয়েছেন অভিনেত্রী, ইতিহাসবিদ, গণিতজ্ঞ, গায়িকা, চিকিৎসক, চিত্রকর, নৃত্যশিল্পী, মহাকাশচারী, লেখিকা, সাংবাদিক সমেত হরেক পেশায় নিযুক্ত নারীর নাম। খ্যাতনামা এই সমস্ত মহিলাদের পাশাপাশি শুক্রপৃষ্ঠে স্থান পেয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাধারণ বা আম-নারীদের নাম বা ডাকনামও। যেমন শুক্র পৃষ্ঠে স্থান পেয়েছে – অ্যাডজোবা (ঘানা), এমিলিয়া (সুইডেন), চিচিক (সাইবেরিয়া), জাকিয়া (আরব), রানি (ভারত) ইত্যাদি সাধারণ নারীর নামও। এই সমস্ত নারীরা ছাড়াও শুক্র পৃষ্ঠে স্থান পেয়েছেন বিভিন্ন দেশের দেবীদের নামও। স্ক্যানডিনেভিয়ার পাহাড় ও শীতের দেবী স্কাদির নাম তো আগেই জেনেছি আমরা। স্কাদি ছাড়াও শুক্র পৃষ্ঠে স্থান পেয়েছেন – ব্রাজিলের সূর্য কন্যা আবে ম্যাঙ্গো, জাপানের প্রেমের দেবী বেনটেন, ব্যাবিলনীয় দেবী জালটু, গ্রিসের আকাশের দেবী হীরা, রোমান চন্দ্র দেবী ডায়ানা, ভারতীয় দেবী দুর্গা সমেত বিভিন্ন দেশের দেবীর নাম। আর এই সহস্র দেবী আর নারীর মাঝে রয়ে গেছেন মাত্র একজন পুরুষ- ম্যাক্সওয়েল। ঘটনাক্রমে তিনিই আবার হলেন শুক্রের সর্বোচ্চ অংশ। তিনিই হলেন শুক্রেশ্বর। সহস্র কলঙ্কিনী পরিবৃত হয়ে প্রেমের আবাসভূমি শুক্র গ্রহে বিরাজ করছেন একমাত্র পুরুষ – গিরিরাজ ম্যাক্সওয়েল।
চিত্র পরিচিতি
১. চিত্র-১ মোহাবে মরুভূমির মাঝে গোল্ডস্টোন ডিপ স্পেস কমিউনিকেশনস্ কমপ্লেক্স
২. চিত্র-২ স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যক্সওয়েল
সহায়ক গ্রন্থ, নিবন্ধ ও সাইট
১. Richard M. Goldstein, ‘Radar Exploration of Venus’; Pasadena, California: California Institute of Technology, PhD thesis, 1962.
২. ‘XVIIth General Assembly of The International Astronomical Union (Proceeding)’; Montreal, Canada, 1979.
৩. Richard O. Fimmel, ‘Pioneering Venus: A Planet Unveiled’; Washington DC: NASA, US Government Printing Office, 1995.
৪. Andrew J. Butrica, ‘To See the Unseen: A History of Planetary Radar Astronomy’; Washington, DC: National Aeronautics and Space Administration, 1996.
৫. David Leverington, ‘New Cosmic Horizons: Space Astronomy from the V2 to the Hubble Space Telescope’; Cambridge: Cambridge University Press, 2000.
৬. Tenielle Gaither and Rosalyn Hayward, “Planetary Nomenclature: A Brief History and Overview” in ‘Lunar and Planetary Information Bulletin, January 2018, Issue 151’ [url: https://www.lpi.usra.edu/publications/newsletters/lpib/new/planetarynomenclature/].
৭. G. van Biesbroeck, ‘Frank Elmore’ in ‘Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society, Vol. 2, December 1961’.
৮. S.B. Nicholson, “Frank Elmore Ross’” in ‘Publications of the Astronomical Society of the Pacific, Vol. 73, No. 432’; 1961, pp. 182-184.
৯. Steve Fentress, “Yerkes Observatory: Home of Largest Refracting Telescope” in ‘Space.com, October 28, 2019’ [url: https://www.space.com/26858-yerkes-observatory.html].
১০. ‘Gazetteer of Planetary Nomenclature’; The U.S. Geological Survey [url: https://planetarynames.wr.usgs.gov/].
অসাধারণ লেখা। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত একটা বিষয়ে জানলাম এবং লেখার গুণে আরও জানার ইচ্ছা বেড়ে গেল।
এমন লেখা আরও চাই।