সেবা ও পরিসংখ্যান — ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের অজানা দিক
১৮২০ সাল, এদেশে বিদ্যাসাগর জন্মালেন। সেই বছরেই ব্রিটেনে এক সম্ভ্রান্ত, সম্পত্তিবান পরিবারে জন্মাল একটি মেয়ে। সেই মেয়ে বড় হয়ে হল এক নার্স। উঁচু ঘর থেকে আসা প্রথম সেবিকা। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার জন্মেছেন এরও ৪১ বছর পরে।
এদেশেই হোক আর বিলেতে, তখন ডাক্তারি একেবারেই পুরুষের পেশা। আর নার্সিং? পেশা হিসেবে মেয়েদেরই বটে, কিন্তু হীনপেশা ব’লে ভারি বদনাম। এমন সময় জন্ম-নেওয়া ইংল্যান্ডের এক উঁচুঘরের মেয়ে তার ১৭ বছর বয়সে হঠাৎ একের পর এক ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেতে থাকল। ঈশ্বরের আদেশ অবশ্য অনেকেই সে সময়ে পেত, আর লোকে সেটা মেনেও নিত, আজকালকার মত মনোবিদের কাছে পাঠাত না। কিন্তু ফ্লোরেন্সের কাছে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ ছিল অদ্ভুত। ফ্লোরেন্সকে নার্স হতে হবে!
ঐ সময়ে নার্স মানেই মাতাল, দুশ্চরিত্রা, সহজলভ্যা, ছোট ঘরের মেয়ে। অন্তত উঁচুঘরের লোকেরা পেশাটাকে তেমনভাবেই দেখত। কিন্তু ফ্লোরেন্স, মানে ঐ ১৭ বছরের মেয়েটি, যাকে আমরা পরে চিনব ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নামে, নার্স বা সেবিকা নামের ঠিক ঐ অপযশগুলো ঘোচাবার কাজটাই করতে নেমেছিলেন।
ছোটবেলায় ফ্লোরেন্স ইতালিয়, গ্রিক, ল্যাটিন ইত্যাদি ক্লাসিকাল সাহিত্য পড়েছিলেন। আবার ইতিহাস ও দর্শনের পাঠও নিয়েছিলেন। তখনকার উঁচুঘরের ইংরেজদের মধ্যে এরকম শিক্ষা চালু ছিল, তবে মেয়েদের মধ্যে তেমন চালু ছিল না — ফ্লোরেন্সের পরিবার উদারমনা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। তবে একটা কথা বলা দরকার, ফ্লোরেন্স অঙ্কটাও ভালোমতো শিখেছিলেন।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আজও খুব বিখ্যাত নাম। কিন্তু সেটা মূলত নার্সিং পেশাকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, “লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প” হিসেবে। হঠাৎ তাঁর অঙ্ক কষায় পারদর্শিতা নিয়ে কথা বলছি কেন? বলছি, কারণ এই লেখাটি সেবাব্রতী ফ্লোরেন্সকে নিয়ে নয়। এই লেখা পুরুষতান্ত্রিক ডাক্তারি পেশার চালু ছককে ঝাঁকুনি দেওয়া এক নারীর কথা; পুরনো ধাঁচের খামখেয়ালি চিকিৎসাব্যবস্থা তছনছ করার ও নতুন করে গড়ে তোলার কারিগর ফ্লোরেন্সর কথা, এই ফ্লোরেন্সকে আমরা অনেকেই চিনি না।
ফ্লোরেন্সের নার্সিং-এর গল্প একটু আধটু আমরা সবাই জানি। ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাড়ির বড়দের বাধ্য মেয়েটি হয়ে ছিলেন, নার্সিং-এর কাজে নেমে পড়েননি। তারপরে ঈশ্বরের স্বপ্নাদেশকে কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজে নামলেন। যদিও প্রথমজীবনে তাঁর নার্সিং শেখা ও করার কাজটি সহজ হয়নি। তাঁর নার্স জীবনের বিখ্যাত জায়গাটি হল ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র। তখন ফ্লোরেন্স ত্রিশের কোঠায়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে একপক্ষে ছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন ও তখনকার অটোমান (তুরস্ক) সাম্রাজ্য, আর অন্যপক্ষে ছিল রাশিয়া। হাজার হাজার সৈন্য সেখানে কলেরা আর ম্যালেরিয়ায় মারা পড়ছিল।
১৮৫৪ সালে ফ্লোরেন্স তুরস্কের স্কুতারি শহরে (বর্তমানে ইস্তাম্বুল নগরের একটি অংশ) একটা হাসপাতালে কাজ শুরু করলেন। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো নোংরা, বিছানাপত্র ময়লা, খাবার পচা, আর ময়লা জমে ড্রেন বন্ধ থাকায় ভুরভুর করছে দুর্গন্ধ। এখানে আহত সৈন্যরা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হত। খুব শিগগিরই ফ্লোরেন্স বুঝলেন, আঘাতগুলোর জন্য তারা মরে না, মরে হাসপাতালে এই ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য।
সুতরাং নাইটিঙ্গেলের প্রথম কাজ হল রোগীদের জন্য ঠিকঠাক খাবার, পরিষ্কার বিছানা আর জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করা, ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা, আর জানলা খুলে বাইরের নির্মল বাতাস যাতে ওয়ার্ডের ঢোকে তার চেষ্টা করা। এক সপ্তাহে তিনি ২১৫-টি ঠেলাগাড়ি ভর্তি ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করলেন। নর্দমাগুলোকে পরিষ্কার করতে উনিশবার জল দিয়ে ধোয়াতে হয়েছিল, ফ্লোরেন্স কিন্তু তাতেও গঙ্গারামের মতো ঘায়েল হননি। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরয়নি, কিন্তু হাসপাতাল চত্বর থেকে দুটি ঘোড়া, একটি গরু আর চারটি কুকুরের মৃতদেহ উদ্ধার করে কবর দেওয়া হয়েছিল।
আগে থেকে ওখানে যেসব ডাক্তার ও পরিচালকেরা ছিলেন, তারা এতে খুব অপমানিত বোধ করেন। হাসপাতালে নার্সিং করতে এসেছেন, নার্সিং করুন, খামোকা এত্তা জঞ্জাল সাফ করার কী দরকার? ওরা এতদিন ধরে আছেন, দরকার থাকলে কি আর ঐ কাজটা তাঁরা ফ্লোরেন্সের জন্য ফেলে রাখতেন? এটা হাসপাতাল, তায় মিলিটারি হাসপাতাল, সেখানে এইসব গন্ধ-নিয়ে-নাকউঁচু শৌখিন টাইপ ভদ্রমহিলাদের ঢোকার কী দরকার? যথাসাধ্য বাধা তারা দিয়েছিলেন, কিন্তু উপর মহলে ফ্লোরেন্সের যোগাযোগ ছিল, আর তিনি ছিলেন বাড়াবাড়ি রকমের স্থিরপ্রতিজ্ঞ। ফলে নিজের মতো করে হাসপাতালের ভোল বদলানোর কাজটা তিনি করেই ফেললেন। তারপর শুরু হল আসল কাজ।
তিনি বসলেন কাগজ কলম নিয়ে। আজকের দিন হলে হয়ত একটা স্প্রেডশিট রাখতেন, কাজটা সহজ হত। ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সৈন্যদের মধ্যে শতকরা ৪৩ ভাগ স্বর্গলাভ করেছে। ফ্লোরেন্স বুঝলেন, তাদের সম্মুখসমর ছিল মূলত জঞ্জালের সঙ্গে এবং জঞ্জাল সাফ করার পরে দেখা গেল, ঐ বছরের জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সৈন্যদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২ ভাগ মারা গেছে। উনিশবার নর্দমা ধোয়া নেহাতই শুচিবায়ুগ্রস্ততা, এমন বলার উপায় রইল না।
১৮৫৬ সালে ফ্লোরেন্স দেশে ফিরলেন। দেশে তিনি বীরের সম্মান ও প্রশংসা পেলেন। কিন্তু সেই প্রশংসা ছিল মূলত এক সেবাব্রতীর অক্লান্ত সেবার প্রশংসা। টাইমস সংবাদপত্রের ভাষায় “তাঁর করুণাঘন উপস্থিতি এমনকি দুরারোগ্য রোগীর মনেও আরামের সঞ্চার করত … তাঁকে দেখে রোগীদের মন কৃতজ্ঞতা আর আশায় ভরে উঠত।” এসব অবশ্যই খুব ভাল ব্যাপার, কিন্তু হাসপাতাল আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ফেরানোর যে কাজটা ফ্লোরেন্স করেছিলেন সে সবের তেমন উল্লেখ না করে সেবাব্রতীর এই একমুখী চিত্রটা দৃষ্টিকে কিছুটা অন্যদিকে সরিয়ে দেয়।
ক্রিমিয়ার হাসপাতালে মৃত্যুহার কমানোর সঙ্গে ফ্লোরেন্সের হাসপাতালের সাধারণ উন্নতির যোগসূত্র কিন্তু তারপরেও বড়কর্তারা বিশেষ মানতে চাইতেন না। আর্মির উচ্চতম ডাক্তার বললেন, হয়ত ঐ হাসপাতালে তখন যারা ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের আঘাত কম গুরুতর ছিল, কিংবা তখন আবহাওয়া ভাল ছিল, বা অন্য কোনও ব্যাপার ছিল যেটা বোঝা যায়নি। আপত্তিগুলো কিন্তু কোনোটাই ফেলে দেবার মতো নয়। কারণ তখন চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত উপায়গুলোর সাহায্যে এই প্রশ্নের ফায়সালা করা মুশকিল ছিল। তখনও পর্যন্ত ডাক্তারিতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ নিয়ে বিশেষ কেউ ভাবতে রাজি ছিলেন না।
এবং এখানেই আসে অঙ্কের প্রশ্ন। ফ্লোরেন্স ছোটবেলায় অঙ্কটা ভালই শিখেছিলেন, এবং তাঁর বাবা অন্তত এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে তৎকালীন ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদেরা ছিলেন। অন্যদিকে, হাসপাতালে বসে ফ্লোরেন্স কেবল সেবাই করেননি, তিনি সেখানকার নানা পরিসংখ্যান সযত্নে সাজিয়ে রেখেছিলেন। স্কুতারি হাসপাতাল পরিষ্কার করার আগে যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হত আর যেসব রোগী কোনও কারণে তাঁদের মিলিটারি ক্যাম্পেই থেকে যেত, তাঁদের মৃত্যুহারের পরিসংখ্যান তাঁর সংগ্রহে ছিল। তিনি দেখালেন, ক্যাম্পে থাকা সৈন্যদের মৃত্যুহার (শতকরা ২.৭) হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সৈন্যদের মৃত্যুহারের (শতকরা ৪২.৭) চাইতে অনেক কম। এই পরিসংখ্যান দেখলে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে পরিষ্কার করার আগে স্কুতারি হাসপাতাল আরোগ্যসদনের চাইতে যমের দক্ষিণ দুয়ারের বেশি কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এই একটামাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে সব কিছু প্রমাণ হয় না, আর ফ্লোরেন্স সেই চেষ্টাও করেননি।
তাঁর চেষ্টায় পুরো মিলিটারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য একটা রয়্যাল কমিশন তৈরি হয়। সেখানে তিনি কয়েকশ’ পাতার রিপোর্ট জমা দেন। তাতে শুকনো পরিসংখ্যান ছিল, তবে রাজনীতিবিদদের ধৈর্য ও নতুন জিনিস বোঝার ইচ্ছে বোধহয় সর্বকালে ও সর্বদেশেই কম। ফ্লোরেন্স সেটা জানতেন, সুতরাং তিনি অঙ্কের পাশাপাশি বেশ সুন্দর করে চার্ট এঁকে দিলেন।
চিত্র ১) পূর্বদিকের সৈন্যবাহিনীতে মৃত্যুর কারণসমূহের চিত্র
অঙ্কের ধাক্কায় বা বলা ভাল পরিসংখ্যান শাস্ত্রের প্রয়োগের ধাক্কায়, রাজনীতিবিদ ও মিলিটারি কর্তাদের টনক নড়ল। ফৌজি হাসপাতালগুলোতে এক বিপ্লবই এসে গেল যেন। রয়্যাল কমিশনের রিপোর্টের সূত্র ধরে একটি আর্মি মেডিক্যাল স্কুল তৈরি হল, আর তৈরি হল পরিসংখ্যান জোগাড় ও বিশ্লেষণের ধারা। চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহৃত নানা পদ্ধতির মধ্যে থেকে একটিকে পরিসংখ্যানের সাহায্যে নিশ্চিতভাবে শ্রেয়তর প্রমাণ করা যায়, সেটা মেনে নেবার দিন শুরু হল।
সৈন্যদলের বাইরেও চিকিৎসায় পরিসংখ্যানের প্রয়োগেও ফ্লোরেন্স পথিকৃৎ। সেই সময় নার্সদের ট্রেনিং দেওয়াকে সময়ের অপচয় মনে করা হত। অবশ্য তার কারণ যেটা দেখানো হত সেটা শুনলে আপনারও মনে হবে, সত্যিই তো! টেনিং পাওয়া নার্সদের যত্নে যেসব রোগী থাকত তাদের মৃত্যুহার সত্যিই ট্রেনিং না-পাওয়া নার্সদের যত্নে থাকা রোগীদের চেয়ে বেশি ছিল! ফ্লোরেন্সই প্রথম তার কারণটা দেখালেন। তিনি দেখালেন, ট্রেনিং পাওয়া নার্সদের কাছে যায় বেশি অসুস্থ রোগী, আর ট্রেনিং না-পাওয়াদের কাছে যায় কম অসুস্থ রোগী—তাই এমন ফল। সমানভাবে অসুস্থ দু’দল রোগীর একদলকে ট্রেনিং পাওয়া আর অন্যদলকে ট্রেনিং না-পাওয়া নার্সদের তত্ত্বাবধানে রাখলেন ফ্লোরেন্স। দেখা গেল ট্রেনিং পাওয়া নার্সদের হাতে থাকলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমে।
আরেকটা কাজ করে ফ্লোরেন্স ধাত্রীবিদ্যায় বেশ আলোড়ন ফেলেছিলেন। তিনি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখান, ইংল্যান্ডে বাড়িতে বাচ্চা জন্মানো হাসপাতালে জন্মানোর চাইতে বেশি নিরাপদ। এর কারণ বোধহয় এই যে সেই সময়ে বাড়িতে যতটা পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকত, বেশির ভাগ হাসপাতাল ততটা পরিচ্ছন্ন থাকত না। মনে রাখতে হবে, এর কয়েক বছর আগে কলকাতায় ফিভার কমিটির কাছে প্রতিবেদন রেখেছেন ডাক্তার মধুসূদন গুপ্ত (১৮৩৭ সাল), এবং সেখানে তিনি হিন্দু ধাত্রী ও পরিচারিকা সহ একটি প্রসূতি হাসপাতাল তৈরির সুপারিশ করছেন। খুব সম্ভব, সেই সময় এদেশে বাড়িতে প্রসবকালীন ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের চাইতে খারাপ ছিল, এবং সেই খারাপ অবস্থার কথা মধুসূদন ঐ প্রতিবেদনে বলেছেন। কলকাতার মত জায়গায় ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে কেবলমাত্র সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষেরাই হাসপাতালে প্রসব করাতে যাবেন, আর তাঁদের বাড়িতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সম্ভব ছিল না, এমনও হতে পারে।
ফ্লোরেন্স পরে গবেষণা করে দেখান, শান্তির সময়েও ব্রিটিশ সৈন্যদের মৃত্যুর হার অন্যদের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ। এটার জন্য তিনি সেনাব্যারাকের খারাপ স্বাস্থ্যবিধিকে দায়ী করেন। হিসেব করে তিনি দেখান সেনাবাহিনীতে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য কীভাবে অপচয় করা হয়। গোটা ব্রিটিশ আর্মিতে স্বাস্থ্যবিধি-অভাবজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা নির্ণয় করেন ফ্লোরেন্স। তাঁর ভাষায়, জীবনের এমন নিরর্থক অপচয় “১১০০ জন যুবককে প্রতি বছর স্যালিসবেরি প্লেইন-এ নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে মারার চাইতে আলাদা নয়।”
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল তাঁর জীবদ্দশায় দেশে ও বিদেশে অজস্র স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরামর্শদাতা ছিলেন। তিনি আমেরিকান স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সম্মানসূচক সদস্য হন এবং রানী ভিক্টোরিয়া নাইটিংগেলকে তার কাজের জন্য রয়্যাল রেড ক্রস প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি রাজা সপ্তম এডোয়ার্ডের কাছে ‘অর্ডার অফ মেরিট’ পান—তিনি ছিলেন এই সম্মানের প্রথম মহিলা প্রাপক।
কিন্তু তাঁকে আমরা একজন মানবদরদী মহান নারী ও সেবিকা হিসেবেই চিনেছি। তিনি যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরিসংখ্যান প্রয়োগের অন্যতম পথিকৃৎ, আর তাঁর সময়ে পুরুষ-প্রধান চিকিৎসা জগতে এমনটা হওয়া খুব কঠিন ছিল, এই কথাটা প্রায়ই হারিয়ে যায়। আজকে যে প্রমাণ নির্ভর চিকিৎসা পরিসংখ্যানের প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তার পেছনে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের অবদান কারও চেয়ে কম নয়।
১৮৬০ সালে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে অবস্থিত নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল এবং নার্সদের জন্য হোম খোলা হল, প্রথম ব্যাচে ছিলেন ১০ জন শিক্ষার্থী। এর অর্থ এসেছিল ‘নাইটিঙ্গেল ফান্ড’ থেকে। ক্রিমিয়াতে থাকার সময়ে নাইটিঙ্গেল এই ফান্ডটি তৈরি শুরু করেন। জনসাধারণের দানে ৫০,০০০ পাউন্ড এই তহবিলে জমা পড়ে। তখনকার দিনে সেটা ছিল বিরাট অংকের টাকা। নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল-এর দুটি নীতি ছিল। প্রথমত, নার্সদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ থাকা উচিত, এবং সেই উদ্দেশ্যে কিছু হাসপাতাল বিশেষভাবে সংগঠিত করা দরকার। দ্বিতীয়ত, নার্সদের নৈতিক উন্নতি এবং শৃঙ্খলা গঠনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া দরকার। এই স্কুল তৈরির মাধ্যমে নাইটিঙ্গেল নার্সিংকে তার অসম্মানজনক অতীত থেকে জনমানসে একটি দায়িত্বশীল এবং সম্মানজনক পেশায় রূপান্তরিত করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
ক্রিমিয়ার সেবাব্রতীজীবনে পাওয়া কিছু অসুস্থতার কারণে নাইটিঙ্গেল তার জীবনের একটা বড় সময় জুড়ে শয্যাশায়ী ছিলেন, ও সেবার কাজ প্রত্যক্ষভাবে চালাতে পারেননি। কিন্তু এই অসুস্থতা তাঁকে থামাতে পারেনি। তিনি ২০০টি বই, প্রতিবেদন এবং পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। এই প্রকাশনার মধ্যে একটি ছিল ‘নোটস অন নার্সিং’ (১৮৬০) শিরোনামের একটি বই। এটি নার্সদের শিক্ষার জন্য প্রথম পাঠ্যপুস্তক; এটি অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
চিত্র ২) ক্রিমিয়ান মনুমেন্ট
নাইটিঙ্গেল ১৯১০ সালে মারা যান, তখন তাঁর বয়স ৯০ বছর। তিনি সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যের জন্য যে অবদান রেখেছিলেন তার সম্মানে ১৯১৫ সালে লন্ডনের ওয়াটারলু প্লেসে ক্রিমিয়ান মনুমেন্ট তৈরি করা হয়।
চিত্র পরিচিতি
কভার ফটো: ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল (চিত্রঋণঃ Wikimedia Commons)
১) নাইটিঙ্গেলের ব্যবহৃত চার্ট। রয়্যাল কমিশনের সামনে তিনি শুকনো পরিসংখ্যানের পাশাপাশি এইসব ব্যবহার করে রাজনীতিবিদ আর সেনানায়কদের তাঁর কথাগুলো বুঝিয়েছিলেন। (চিত্রঋণঃWikimedia Commons)
২) লন্ডনের ওয়াটারলু প্লেসে ক্রিমিয়ান মনুমেন্ট (চিত্রঋণঃ Man vyi, Public domain, via Wikimedia Commons)
তথ্যসূত্র
১) Porter, Roy. The Cambridge illustrated history of medicine (New York: Cambridge University Press, 1996), 226
২) Simon Singh & Edzard Ernst. Trick or Treatment? Corgi Books, 2008
৩) I B Cohen, Florence Nightingale, Scientific American 250 (March 1984), 128-137.
৪) S Stinnett, Women in Statistics : Sesquicennial Activities, The American Statistician 44 (2) (1990), 74 -80.
৫) ডা. শঙ্করকুমার নাথ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গোড়ার কথা ও পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০১৪
অসাধারণ লেখা এবং আমার কাছে অজানা তথ্য। একটাই কথা কেবল বলতে হয়। এমন আরও চাই।
Khub bhalo lekha. Somriddho holam. Aagei udbuddha chhilam abar punornobikoron holo.