বাংলার ছাত্র আন্দোলনের প্রথম এক শতক (১৮১৭-১৯১৯)
ভূমিকা:
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতি অন্যতম চর্চিত বিষয়। সমাজের একটা অংশের মানুষ, ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে কট্টর বিরোধী। তাদের মতে ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকাটা অপ্রয়োজনীয়। সরকার বা প্রশাসনের উচিত ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আর একাংশের মানুষ ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতিকে ছাত্রদের অধিকারস্বরূপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিকে শুধু অধিকার হিসাবে দেখলে তা নিতান্তই ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় হবে। অপরদিকে ছাত্র আন্দোলন নিষ্প্রোয়জন বা ছাত্রদের রাজনীতির বাইরে রাখার তত্বটাও কোনওভাবে গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না। এই দুটি অংশের বাইরে আর একটি অংশ আছে, যে অংশটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে থেকে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনকে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে আর প্রাসঙ্গিক হিসাবে দেখেন না। কারণ হিসাবে, ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলনের ধারার পরিবর্তনকে দায়ী করার চেষ্টা করেন।
বাস্তবিক বিষয় হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের ধারারও পরিবর্তন হয়েছে এবং তা প্রমাণ করেছে যে ছাত্ররাই সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। ছাত্র রাজনীতি বা তাদের আন্দোলনকে শুধুমাত্র ছাত্র সংসদ নির্বাচন বা নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দলের গণসংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গীতে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। কারন ইতিহাসে একথা প্রমাণিত, শিক্ষা ও শিক্ষা বিষয়ক দাবি পূরণের লক্ষে এগিয়ে যাওয়া, কিংবা জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উত্তরণ ও দায়বদ্ধতায় ছাত্র সমাজ সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পরাধীন ভারতে সমাজ পরিবর্তনের ভাবনারও প্রকাশ ঘটতে দেখা গিয়েছে ছাত্রদের মধ্যে। আর সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বাংলা’র ছাত্র সমাজ। সেই দিক থেকে বাংলার ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। যা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলার ছাত্র আন্দোলনের এই ইতিহাসকে দুটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় ছিল সংস্কারমূলক আন্দোলন এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল গণসংগ্রামমূলক আন্দোলন। উনবিংশ শতকের ছাত্র আন্দোলনের ধারায় এই দুটি পর্যায়ই স্পষ্ট। এই দুই ধারাই ছাত্র আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ায় ভারতবর্ষের ছাত্র আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম হয়। এই সময় দাঁড়িয়ে বাংলাতেই ছাত্ররা সর্বপ্রথম সংগঠন গড়ার চিন্তা ভাবনা নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধীতায় সামিল হয়েছিল। শুধুমাত্র তাই নয় বাংলাই ভারতবর্ষের ছাত্র-যুব আন্দোলনকে নেতৃত্ব দান করেছিল। বাংলা ছিল ভারতবর্ষের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। যদিও ঔপনিবেশিক আমলে ছাত্র আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য বা অপূর্ণতাকে দূর করতে বা ব্রিটিশ অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে বাংলার ছাত্র আন্দোলনর সূত্রপাত হয়নি। বাংলার ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত ধর্মীয় সমাজ সংস্কারের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তা ক্রমশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। তবে ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় একদিকে যেমন, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবেশ ও বিস্তার ঘটতে শুরু করল, ঠিক তেমনই ধর্মীয় সমাজ সংস্কার সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নবজাগরণের সূচনা হল। স্বাভাবিকভাবেই এই দুইয়ের প্রভাব এসে পড়ল ছাত্রদের মধ্যে। বিভিন্ন মণীষী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে বা তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ছাত্র সমাজ। ধর্মীয় সমাজ সংস্কারের জন্য নিজেদের যুক্ত করল, তবে পৃথক পৃথক পন্থায়।
এই সময়পর্বে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের হাত ধরে ধর্মীয় সমাজ সংস্কার শুরু হয়। এরা চেয়েছিলেন হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলিকে সরিয়ে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে এবং তা হিন্দুধর্মের মধ্যে থেকেই করতে। শুধু তাই নয় তাঁদের অনেকে হিন্দুধর্মকে.আরও সহজ সরল করে উপস্থাপন করতে ধর্মীয় সংগঠনও গড়ে তোলেন। যেমন আর্য্যসমাজ, ব্রাহ্মসমাজ, প্রার্থনা সমাজ ইত্যাদি। এই সমস্ত সংগঠনগুলিতে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভিড় বাড়লেও সংগঠনগুলিতে বিপুল অংশের ছাত্রদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে এই সমস্ত মনীষীদের দ্বার সমাজে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই, বহু বিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই, গঙ্গায় কন্যা সন্তান দানের বিরুদ্ধে লড়াই, বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য লড়াই, মূর্তি পূজা, জাতিভেদ, বর্ণভেদ সহ অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এবং তাঁরাও এইগুলিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে এই সমস্ত সংগঠনের ছত্রছায়ায় নয়।
ঊনবিংশ শতকের সূচনা পর্বে আধুনিক শিক্ষার প্রভাব ও ছাত্র আন্দোলন:
ঊনবিংশ শতকের সূচনা পর্বে দাঁড়িয়ে ইংরেজ শাসকদের মনে হয় তাঁদের কাজের সুবিধার জন্য কিছু স্বল্প শিক্ষিত ইংরেজী জানা লোকের প্রয়োজন। এই কারণে ১৮১৭ সালে কলকাতায় প্রথম হিন্দু কলেজ স্থাপন করে। এরপর তারা আস্তে আস্তে আরও স্কুল, কলেজ স্থাপন করে তার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ১৮২৬-২৭ সালে হিন্দু কলেজের শিক্ষক হয়ে আসেন ১৭ বছর বয়সী হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তাঁর বিজ্ঞান মনষ্কতা ও যুক্তি-মুক্তির তত্ত্ব ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করে। সামাজিক সংস্কার থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রসার ও প্রয়োজনীয়তা, যুক্তি দিয়ে বিচার করে যে কোনও বিষয়ে সংশয়ে পৌঁছানোর পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী ভাবনা, বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং লড়াই সম্পর্কে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকেন। তার ফলে খুব অল্প সময়েই তাঁর বাড়িতে ছাত্রদের আনাগোনা ও অবাধ বিচরণ শুরু হয়। তৈরি হয় আকাদেমি এশোসিয়েশন বা ইয়ং বেঙ্গল। এই সংগঠনের ছাত্রদের মধ্যে হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষ লক্ষ করা যায়। এবং তারা বিভিন্ন ভাবে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেন। এই ইয়ং বেঙ্গলের হাত ধরে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই থেকে বিধবা বিবাহের মত সামাজিক সংস্কার নিয়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই, গোমাংস ভক্ষণ, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের শব ব্যবচ্ছেদের মত ঘটনাও ঘটে।
এগুলি নিজেরা করার পাশাপাশি শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তারা পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে উদ্যোগী হয় এবং পার্থেনান বলে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। কিন্ত একটি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পরই হিন্দু সমাজপতিদের চাপে তা বন্ধ করে দিতে হয়। এসবের পাশাপাশি জাতীয়তবাদী চিন্তারও অঙ্কুরদগম হতে শুরু করে। তার প্রমাণ হিসাবে বলা যেতে পারে ১৮৩১ সালে ফরাসী বুরবো রাজতন্ত্রের পতন ঘটলে হিন্দু কলেজের একদল ছাত্র কলকাতায় মনুমেন্টের উপর থেকে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে দিয়ে ফরাসী প্রজাতন্ত্রের সাম্য- মৈত্রি ও প্রগতির পতাকা তুলে দেয়। হিন্দু কলেজকে অনেকে তাই ব্রিটিশ বিরোধীতার আঁতুরঘর বলে ব্যাখ্যা করে। অল্প বয়সেই ডিরোজিওয়র মৃত্যু হওয়ার পর ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন গতি হারায় এবং তা কার্যত অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে পড়ে।
এর পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে ইয়ংবেঙ্গলের অনুকরণেই বেশ কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠে। যেমন, সমদর্শী, দেশহিতৈষী, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আশোসিয়েশন প্রভৃতি। প্রতিটি সংগঠনই একজন বা দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সহাচার্যে গড়ে উঠে। তাঁদের মৃত্যুর পর বা মতানৈক্যর ফলে অল্প সময়েই এগুলি ভেঙে পড়ে। তবে এগুলি যে ছাত্রদের সংগঠিত হতে সাহায্য করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সিপাহি বিদ্রোহ ও তৎপরবর্তী সময় অবধি শিক্ষিত চেতনা সমৃদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে এই চিত্রই ধরা পরে।
সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তীতে নতুন করে ছাত্রদের সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস ও আন্দোলন:
সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৮৬০-৬২র সময় থেকে একাংশের ছাত্র-যুবদের মধ্যে যখন ইংরেজ অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটছে, তখন আর এক অংশের ছাত্র-যুবদের মধ্যে বিদেশি চাল-চলন ও মদ্যপান আসক্তির বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এই আসক্তি ও তার প্রভাব এতটাই বাড়তে থাকে যে, চেতনার উন্মেষ অপেক্ষা বিদেশি বাবু সাজার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর ফলে সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা স্পষ্ট লক্ষিত হয়। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একদল ছাত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষক প্যারিচরণ সরকারের নেতৃত্বে ‘মদ্যপান বিরোধী’ আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। সমাজের বৃহৎ অংশকে নাড়া দেয় এই অন্দোলন। ছাত্রদের মধ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে আবারও আগ্রহ তৈরি হতে শুরু করে। কিন্তু সে অর্থে কোনও সংগঠন না থাকায় তা সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে আনন্দমোহন বসু লন্ডন থেকে দেশে ফিরে কলকাতায় কিছু ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ছাত্র সমিতি গঠন করেন। নাম দেন ‘স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’। এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণকুমার মিত্র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘১৮৭৫-তে আনন্দমোহন বসু বিলেত থেকে দেশে ফেরার পর কলকাতায় কিছু ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। আনন্দমোহন বসু তাঁদের বললেন, বোম্বেতে তিনি একটি ছাত্র সমিতি ও তার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। কলকাতাতেও এই ধরণের কিছু করা উচিত।’ অন্যদিকে ঠিক এর কিছু দিনের মধ্যেই ভারতীয় রাজনীতিতে ও ছাত্র রাজনীতিতে আর একজন ব্যক্তির আবির্ভাব হয়, তিনি হলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে তিনি মেট্রোপলিটন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। আর সেখানেই ছাত্রদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রথমে ছাত্র আন্দোলন ও পরে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত রূপে নির্ভর করবে দেশের তরুণদের মধ্যে নির্ভেজাল, সুস্থ ও যুক্তি যুক্ত মনোভাব সৃষ্টির উপরে। যা নিয়ে তারা জনসেবা মূলক কাজে অংশগ্রহণ করবে। প্রথমে তাদের মধ্যে এই বাসনার বীজ উপ্ত করতে হবে।’ তাঁর অন্তর্নিহিত এই মনোভাবই তাঁকে ছাত্র সংগঠন গড়ার কাজে সাহায্য করেছিল। তারই ফলস্বরূপ দীর্ঘ এক বছরের প্রয়াসে ছাত্রদের সংগঠিত করে ১৮৭৬ সালের ২৬ জুলাই ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন মূলত, ছাত্র, যুব, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গণ ভাবনায় আলোকপাত করার পাশাপাশি শিক্ষিত বাঙালি প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তিদের মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এই সংগঠন নির্দিষ্ট কয়েকটি আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আদর্শগুলি ছিল, “১) দেশের মধ্যে জনমত গঠনের জন্য একটি শক্তিশালী সমিতি গঠন, ২) দেশের সর্বস্তরের পোষিত একটি মত যা রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণকেঐক্যবদ্ধ করা, ৩) হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন এবং ৪) বড়বড় গণ আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের জনসাধারণকে টেনে আনা।”
সংগঠন গড়ে তোলার এক বছরের মধ্যেই তাদের সামনে এক বৃহত্তর আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সেই সময় ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বয়স সীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ করে দেওয়া হয়। ভারত সচিব মার্কুইস অব সেলিশবেরীর আদেশেই এই কাজ হয়। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এই ব্যাপারে একটি জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৮৭৭ সালের ২৪ মার্চ কলকাতা টাউন হলে একটি বৃহৎ জনসভা করে। এই জনসভা থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে দুটি দাবি জানায়, ১) আইসিএস পরীক্ষার বয়স সীমা বাড়িয়ে যা ছিল তাই করতে হবে, ২) ইংল্যান্ডে ও ভারতে একই সময়ে পরীক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের রূপ দিতে বাংলা ছাড়িয়ে গোটা দেশজুড়ে প্রচার, কর্মসূচি শুরু হয়। আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিসর দিতে ছাত্র সমাজেরপাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও যুক্ত করে নেওয়া হয়। তৈরি করা হয় একটি দাবি সনদ এবং লালমোহন ঘোষকে প্রতিনিধি করে সেই দাবি সনদ পাঠানো হয় হাউস অব কমন্সে। দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে দাবি আদায় হয়।
অন্যদিকে এই সময়কালেই ব্রাহ্মসমাজ সংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর কিছু তরুণ অনুগামী ও ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ১৮৭৮ সালে ‘সমদর্শী গোষ্ঠী’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের আদর্শ ছিল, ১) স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নেওয়া, ২) সর্ব-ধর্ম সমান এই তত্ত্বকে মেনে নেওয়া, ৩) সংগঠনের কর্মীরা ও সংগঠন ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা বা অর্জনের কাজে আগ্রহী হবে না, ৪) দেশের ও জনগণের মঙ্গলের স্বার্থে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে তারা দ্বিধা বোধ করবে না। অর্থাৎ সমাজ সংস্কারের মধ্যে দিয়ে জাতীয় চেতনা বোধের উন্নতি ঘটানোই ছিল এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য।
এই সময় আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে, তা হল ইলবার্ট বিল বির্তক। এই বিলের মাধ্যমে ভারতীয় অপরাধীদের পাশাপাশি ভারতে বসবাসকারী অপরাধী ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচারের অধিকার দেওয়া হয় ভারতীয় জুডিদের উপর, যা এতদিন শুধু মাত্র শেতাঙ্গ বিচারকরাই করতে পারত। ১৮৮৩ সালে এই বিলের খসড়া প্রকাশ্যে আসা মাত্র ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিল। তারা এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। গঠন করল ‘ইউরোপীয় আত্মরক্ষা সমিতি’। অন্যদিকে এই বিলের পক্ষে আন্দোলন শুরু করল ভারতীয়রা। এই আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররাই। মুখ্য ভূমিকা পালন করে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। এই আন্দোলন করতে গিয়ে আইন অমান্য ও আদালত অবমাননার দায়ে গ্রেফতার হন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে বাংলার ছাত্র সমাজ উত্তাল হয়ে ওঠে। কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সভা, মিছিল, ধর্মঘট সংগঠিত করে। এইভাবেই ইলবার্ট বিল বির্তক ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায় এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের প্রচেষ্টা ও আন্দোলন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এমনকি পরবর্তীতে জাতীয় কংগ্রেসের সাংগঠনিক কার্যক্রম রূপায়ণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলার ছাত্র সমাজ।
জাতীয় কংগ্রেস গড়ে ওঠা ও বাংলার ছাত্র সমাজ:
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষত জাতীয় কংগ্রেস গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে মূলতঃ সভা সমিতির যুগ বা এজ অফ অ্যাসোসিয়েশন বলে চিহ্নিত করা হয়। এই সময় বাংলার ছাত্র আন্দোলনের সুস্পষ্ট কোনো লক্ষ্য বা সংগঠন ছিল না বললেই চলে। এর অন্যতম কারণ, পরাধীনতার শৃঙ্খল ও দেশীয় সামাজিক ব্যবস্থার আচার ও কুসংস্কার সমূহ এবং বিভিন্ন ধর্মে বর্ণ ভেদাভেদ যা তাদের স্বাধীন চিন্তাকে ব্যাহত করে। যদিও এই সময়কালেই অর্থাৎ ইলবার্ট বিল আন্দোলনের ঠিক অব্যবহিতে পরে ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এবং সেন্ট্রাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের বেশিরভাগ প্রতিনিধি ছিল ছাত্র এবং যুব সম্প্রদায়ের। সব থেকে মজার বিষয় হল এই সম্মেলনে শুধু বাংলার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন না মিরাট ম্যানারস এলাহাবাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলি কার্যকর করতে জাতীয়তাবাদী ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে।
এদিকে ঠিক তার পরেই ১৮৮৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। কলকাতায় এই অধিবেশনকে কেন্দ্র করে বাংলার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয়। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা প্রত্যেকে কংগ্রেসের কর্মী হওয়ায় তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অধিবেশন সম্পর্কে বাড়তি আগ্রহ ছিল। কিন্তু তার মধ্যে লক্ষণীয় বিষয় হল, রক্ষণশীলদের সংগঠন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরাও এই অধিবেশনকে কেন্দ্র করে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অধিবেশনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো প্রবীণ থেকে যুবক, মধ্যবিত্ত থেকে অভিজাত জমিদার শ্রেণী সবাই আকৃষ্ট হন এবং একই মঞ্চে উপস্থিত হন।
কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে বিদেশি শাসনের স্বেচ্ছাচার, অর্থনৈতিক দুর্দশা, জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও কংগ্রেসের আপোষমূলক নীতি – এই চারটি কারণেই ভারতের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় ও ছাত্রদের মধ্যে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়। শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় মনে করে বিদেশী শাসনই তাদের দারিদ্র ও অধঃপতনের একমাত্র কারণ। এদিকে ঠিক এই সময় মহারাষ্ট্রে কৃষক বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছাত্র-যুব সরাসরি বিদ্রোহে অংশগ্রহণ না করলেও এই বিদ্রোহের প্রভাব তাদের মধ্যে পড়ে। এই বিদ্রোহী মনোভাবের প্রতীক রূপেই বালগঙ্গাধর তিলক বিক্ষুব্ধ যুব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলার চেষ্টা/ প্রেক্ষিত:
তিলকের বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে বাংলার যুব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষ ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফেরেন এবং বরোদাতে কাজে যুক্ত হন। সেখানে থাকতে থাকতেই তিনি মহারাষ্ট্রে বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে সেখান থেকেই তিনি বাংলায় একটি বিপ্লবী দল গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি তাঁর সঙ্গী হিসেবে পান বর্ধমানের চান্না গ্রামের যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথমে ভেবেছিলেন ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করতে গেলে রীতিমত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন বাংলায় বিপ্লববাদের প্রবর্তক।
যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন বরোদায় কাটানোর পর ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দের পরামর্শে বাংলায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে তিনি প্রথমে যোগাযোগ করেন প্রমথ মিত্রের সঙ্গে। এদিকে ইতিমধ্যে বাংলাতেও একদল নেতা ছিলেন, যাঁরা কংগ্রেসের আপোস নীতিতে বিরক্ত হয়ে মহারাষ্ট্রের বৈপ্লবিক স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লবের পথ অবলম্বনের জন্য আলাপ-আলোচনা আরম্ভ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রমথ মিত্র। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রমথ মিত্র ও যতীন্দ্রনাথের যৌথ প্রচেষ্টায় বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির প্রথম সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম করণ হয় অনুশীলন সমিতি। সর্বসম্মতিক্রমে প্রমথ মিত্র এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সংগঠনের জন্য শরীরচর্চা এবং সেই সম্বন্ধীয় শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার জন্য তিনি আপার সার্কুলার রোড ও সুকিয়া স্ট্রিটের সংযোগস্থলে স্থাপন করেন একটি আখড়া। সেখানেই তিনি প্রথম লাঠি, তলোয়ার, ঘোড়ায় চড়া, কুস্তি প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
প্রতিষ্টিত হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই অনুশীলন সমিতি ছাত্র-যুব দের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর বিভিন্ন স্থানে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। শাখার সভ্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এদিকে কলকাতাতে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর পূর্ববঙ্গে তার প্রসার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি হতে শুরু করে। গ্রাম স্কুল-কলেজে সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। এভাবেই ধীরে ধীরে পাটনা, কাশি, দিল্লি, গুয়াহাটি প্রভৃতি স্থানে অনুশীলন সমিতির শাখা বিস্তার লাভ করে। সমিতির দ্বারা পরিচালিত অসংখ্য আখড়ায় শরীর চর্চার পাশাপাশি মানসিক উন্নতির জন্য নানারূপ জ্ঞান বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হয়। বিশেষ করে মহাপুরুষদের জীবনচরিত, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার কাহিনী, রাশিয়ার নিহিলিস্ট রহস্য, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস ও তার মূলমন্ত্র, ইতালির গ্যারিবল্ডি, ম্যাজিনি, ক্যাভুরের জীবনচরিত, দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা এই সমিতির সদস্যদের মধ্যে দেখা যায়। এছাড়াও এই সমিতি একটি জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলে। এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল আগুন বন্যা মহামারী প্রভৃতি দুর্ঘটনা ঘটলে জনগণকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। সমিতির এই অভূতপূর্ব বিস্তার দেখে ঋষি অরবিন্দ ঘোষ বলেছিলেন, “বাংলার ছাত্র-যুবরাই পারবে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে সামনে রেখে বিপ্লবী আন্দোলনকে আরো জোরালো ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে।”
এই ভাবেই একসময় গোটা বাংলা জুড়ে অনুশীলন সমিতি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে ছিল। সেই সময়কার সরকারি রিপোর্ট থেকে এই সমিতির বিশেষ প্রভাবের কথা জানা যায়। উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে এই অনুশীলন সমিতির থেকে আরও দুটি বড় সংগঠন সৃষ্টি হয়। একটি হল যুগান্তর সমিতি ও অপরটি হল উত্তরবঙ্গ সমিতি। এছাড়া এরকম আরো অনেক ছোট ছোট গুপ্ত সমিতি তৈরি হয় ছাত্র-যুবদের নেতৃত্বে। ছাত্র-যুবরাই হয়ে ওঠে এই গুপ্ত সমিতিগুলির মূল চালিকাশক্তি। তার অন্যতম প্রমাণ সেই সময় সরকারের শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টরের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, “মাধ্যমিক স্কুল গুলির বর্তমান অবস্থা নিঃসন্দেহে প্রদেশের অগ্রগতি ব্যাহত করেছে। বর্তমানে এই সাধারন অরাজক অবস্থার মধ্যে স্কুলগুলির দুর্দশার চিত্রটি কোন ভাবে উপেক্ষার বিষয় নয়। সাধারণত কলকাতা ও ঢাকার অন্ধকার অলিগলিগুলিকেই রাজদ্রোহ ও অপরাধমূলক ক্রিয়া-কলাপের উৎপত্তিস্থল বলে বর্ণনা করা হয়। কারণ এই অলি-গলিতে বসেই অরাজকতামূলক ষড়যন্ত্রের পান্ডারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দের মাঝ থেকে তাদের অনুচর সংগ্রহ করে। এই ধারনা আংশিকভাবে সত্য হলেও, উচ্চ ইংরেজি স্কুলগুলিই হল মূল ক্ষেত্র। যে সমস্ত স্কুলগুলিতে শিক্ষকগণ সামান্য বেতনের জন্য বিক্ষুব্ধ, ঘরগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন, আলোবাতাসহীন এবং অসংখ্য ছাত্রের ভিরে ভারাক্রান্ত, শিক্ষা পদ্ধতি হলো পরীক্ষায় পাসের উদ্দেশ্যে পড়া মুখস্ত করার জন্য ছাত্রদের উপর প্রবল চাপ দেওয়া সেই স্কুলগুলি আসল ক্ষেত্র যেখানে বিক্ষোভ ও উন্মত্ততার বীজ বপন করা হয়ে থাকে।”
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ধারার আন্দোলনগুলি কোনদিনই ছাত্র আন্দোলন রূপে স্বীকৃতি পায়নি। তার মূল কারণ, ছাত্র- যুব সম্প্রদায় এই সময়ে তাদের নিজেদের শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি দাওয়া বা কর্মসংস্থান সংক্রান্ত দাবি-দাওয়ার পরিবর্তে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে বেশি আগ্রহী ছিল। (এমনিতেও ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষানীতিতে তাদের আস্থাও তেমন ছিলনা।) তাছাড়াও পৃথকভাবে শুধুমাত্র তাদের উদ্যোগে পরিচালিত আন্দোলন যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করতে পারে এ ধারণাও মানুষের মধ্যে ছিল না। তাই ছাত্রদের দেশাত্মবোধ এবং ব্রিটিশ সরকার বিরোধী ক্রিয়া-কলাপ সাধারণভাবে উপনিবেশ বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের তকমা পেলেও, এগুলিকে কোনদিনই ছাত্রদের আন্দোলন বলে পরিচিতি দেওয়া হয়নি। অথচ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে শুধু সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদই নয়, স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন এবং গান্ধীজি পরিচালিত গণ আন্দোলনের ছাত্র-যুবদের অংশগ্রহণ ছিল সক্রিয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত।
বঙ্গভঙ্গ-স্বদেশী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা:
উনবিংশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের একদম প্রথমার্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, স্বাধীনতার চেতনা এবং জাতীয়তাবাদ বিংশ শতকে ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। এ দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় ও জনগণের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংঘাত প্রকাশ্য চেহারা নিচ্ছে। শিক্ষার কিছুটা বিস্তারের ফলে আন্দোলনের শক্তিও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ভারতীয় সমাজে নতুন দুটি শ্রেণী প্রকাশ পায়, আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী ও ভারতীয় শিল্পপতি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাছাড়াও ব্রিটিশ শাসনে নিপীড়িত অগণিত কৃষক জনসাধারণ। সব মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের এক উত্তাল চেহারায় এই সময় পর্বে ধরা পড়ে। আর এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়া তুলতে ছাত্রসমাজ ও শিক্ষিত সম্প্রদায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই সংগ্রামী জাতীয়তাবাদকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হন লর্ড কার্জন। প্রয়োগ করেন তাঁর দমনমূলক বিভেদ নীতি। এর পিছনে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। সেগুলি হলো, ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করা এবং ব্রিটিশ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারতবর্ষকে একচেটিয়া বাজারে পরিণত করা। আর এর জন্য কার্জন প্রথম শুরু করেন দমনমূলক স্বেচ্ছাচারী শাসন। এর জন্য শাসন কাঠামো এবং আইনি ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন ঘটান তিনি।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার গভর্নর ফ্রেজার কার্জনের নির্দেশমতো বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাব আনেন। কিন্তু তাতে গোটা দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে বিভাজনের বেদনা অনুভূত হয় যা জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করে ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার করে। বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতারা জনসাধারণের এই ক্ষোভকে ব্যবহার করে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে গণ আন্দোলনের রূপ দিতে তৎপর হোন। ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই আন্দোলন চরম আকার নেয়। এর ব্যাপকতা দেখে কার্জন বলেন, “বাঙালিরা ভাবে যে তারা একটি জাতি। তারা স্বপ্ন দেখে, একদিন ইংরেজরা ভারত থেকে বিতাড়িত হবে। আর তখন কলকাতার লাট প্রাসাদে এসে বসবেন কোন একজন বাঙালিবাবু। সুতরাং কলকাতার মানুষ অবশ্যই বিরোধিতা করবে বঙ্গভঙ্গের। এখন যদি আমরা দুর্বলতা দেখিয়ে তাদের চিৎকারে সামনে পিছু হটে যাই তবে আমরা আর কোনোদিনই বাংলাকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে বা বাগে আনতে পারব না।”
সমস্ত প্রতিবাদ আন্দোলনকে উপেক্ষা করেই ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে জুলাই তৎকালীন ভারত সচিব ঘোষণা করেন, “বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এর কোন রদবদল হবে না। আগামী ১৬ ই অক্টোবর থেকে বঙ্গবিভাগ কার্যকর হবেই এবং উত্তরবঙ্গের ৬ জেলাকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে।”
প্রাথমিকভাবে সরকারের ধারণা ছিল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন তেমন কোনো ব্যাপক আকার নেবে না। কিন্তু অচিরেই এই বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করে। তৎকালীন জাতীয়তাবাদী নেতারা একত্রিত হয়ে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করেন। আন্দোলনের পথ হিসেবে বেছে নেয়া হয়, বিদেশি দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলা। আর এই আন্দোলনকে সফল করতে নেতৃত্ব প্রথম আহ্বান জানান বাংলার ছাত্রজীবনকে। তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে স্কুল কলেজের ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ে এই আন্দোলনে। ক্রমে এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। আর যার প্রাণশক্তি হয়ে ওঠে ছাত্ররা। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক নবযুগের সূচনা হয়।
আন্দোলনের রূপরেখা মত ছাত্ররা ব্রিটিশ পণ্য বয়কটকে দারুন ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার ও বিদেশিদের বয়কট করার ক্ষেত্রে ছাত্ররা ক্রমশ সংগঠিত হয়। কলকাতার ইডেন হোস্টেল প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ পণ্য বয়কট ও লর্ড কার্জনের কুশপুত্তলিকা দাহ করার মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনে বাংলার ছাত্র সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ সূচিত হয়। এরপর রিপন কলেজের এক সমাবেশে ছাত্ররা বয়কটকে পবিত্র শপথ হিসেবে গ্রহণ করে। ছাত্রদের মুখে মুখে ফেরে, সংযুক্ত বাংলা ও বন্দেমাতরম ধ্বনি। ছাত্ররা সভা সমিতির মাধ্যমে বয়কট আন্দোলনকে এক জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত করে। বিলাতী মদ, বস্ত্র, চিনি, লবণ ও অন্যান্য বিদেশি দ্রব্যের দোকানের সামনে পিকেটিং-এর কাজ শুরু করে। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কাছে ‘আত্মোন্নতি সমিতি’র উদ্যোগে ছাত্র ভান্ডার নামে একটি দোকান খোলা হয়। ছাত্রদের ভাবাবেগ এতটাই প্রবল ছিল যে, স্কুল বা কলেজের ছাত্রের পক্ষে ক্লাসের লেকচার রুমে বিদেশি তৈরি কাপড় পড়ে যাওয়া বিপদজনক হয়ে উঠেছিল। একবার রিপন কলেজের এক ছাত্র বিদেশি জামা পড়ে যাওয়ায় তার জামা টেনে ছিড়ে ফেলেছিল অন্যান্য ছাত্ররা। এর পাশাপাশি ইংরেজদের শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করার জন্য সরকারি স্কুল কলেজ বয়কটের ডাক দেয় বাংলার ছাত্র সমাজ। তারা ব্যাপক সাড়া পায়। এমনকি বিদেশি কাগজে তৈরি কোন খাতা পরীক্ষার জন্য দেওয়া হলে ছাত্ররা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।
ছাত্রদের এই আন্দোলনের ব্যাপকতা সরকারকে নড়িয়ে দেয়। আর তাই ছাত্রদেরকে দমন করার জন্য তৎকালীন শিক্ষাসচিব কার্লাইল একটি সার্কুলার জারি করেন। সার্কুলারে বলা হয়, “যে ছাত্র বয়কট ও স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেবে সরকারি স্কুল কলেজ থেকে বিতারিত হবে। বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া চলবে না। স্বদেশী গান গাওয়া চলবে না। স্কুলে কলেজের ছাত্ররা সরকারি কাজ করলে সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হবে।” কিন্তু এরপরেও সার্কুলারকে অগ্রাহ্য করে ১৯০৫এর ৪ নভেম্বর হাজার হাজার ছাত্র কলেজ স্কোয়ারের সমবেত হয় এবং সভা অনুষ্ঠিত করে। সভা থেকে সার্কুলারকে ধিক্কার জানানো হয়। গড়ে তোলা হয় এন্টি সার্কুলার সোসাইটি। এটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রথম গণসংগঠন। কলকাতার বাইরে ঢাকা-ময়মনসিংহ, বরিশাল, নোয়াখালী, বাঁকুড়া সহ উত্তরবঙ্গে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল এই সংগঠনের। সংগঠনের মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়, জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলা, ব্রিটিশ পণ্য বয়কট, স্বদেশি দ্রব্য বিক্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করা এবং তাতে প্রত্যেক জেলা ছাত্র দের সামিল করা। ক্রমে বাংলার সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই সংগঠন।
ছাত্রদের আন্দোলনের ঢেউ যখন বাংলার ঘরে ঘরে গিয়ে পড়তে থাকলো তখন ইংরেজ সরকার ব্যাপক দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে। আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের বিনা বিচারে আটক করার জন্য ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রবর্তন করা হয়। ‘রাজদ্রোহমূলক জনসভা আইন’ প্রবর্তিত হয় ওই সময়। এরপর ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ও প্রেস আইন প্রবর্তিত হয়।
এইসময় রুশ-জাপান যুদ্ধে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তি রাশিয়া, ক্ষুদ্র দেশ জাপানের কাছে পরাজিত হয়। জাপানের এই জয় বাংলা ছাত্র-যুবকদের মনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সি এফ এন্ড্রুজ তাঁর ‘The Renaissance in India’ গ্রন্থে ছাত্রদের উদ্যোগ প্রসঙ্গে বিবরণ দিতে গিয়ে এক যুবকের সম্পর্কে একটি ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, “রুশ জাপান যুদ্ধ থেকে যুবকটি নতুন নতুন বিষয় জানতে থাকে। দূরপ্রাচ্য থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন জয়ের সংবাদ জানতে থাকে। অবশেষে সে একদিন খবর পায় যে শুসিনা প্রণালীতে গোটা রুশ নৌবহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই রাতে সে ঘুমোতে পারিনি। তার দেশমাতা যেন বাস্তব মূর্তি ধারণ করে তার কাছে এসেছিল। তার মনে হয়েছিল- যেন তার দেশমাতা বিষন্ন বদনে কাঙালিনী রূপে তার সামনে এসেছে। তিনি যেন তার থেকে সন্তানের ভক্তি দাবি করছেন। সে যেন সেই মায়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার ডাক শুনতে পেল।”
এদিকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে শ্রীঅরবিন্দের লেখা প্রবন্ধ, ‘Politics for Indians’ বন্দেমাতোরম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়. যুগান্তর পত্রিকাতেও তার কিছু অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এর পরেই ১৬ ই আগস্ট অরবিন্দের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তাকে গ্রেফতারও করা হয়, পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। এই মামলায় বিপিনচন্দ্র পালকে একজন সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুরোধে এবং নিজে ন্যাশনালিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে আদালতে তিনি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন। এর ফলস্বরূপ তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায় আনা হয় এবং তাকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলার রায় দানের দিন ১০ সেপ্টেম্বর আদালত চত্বরে জনসাধারণের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আদালত থেকে জনসাধারণকে সরানোর জন্য পুলিশ লাঠিচার্জও করে। আদালতের মধ্যেই উচ্চঃস্বরে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া হয়। তাতেই কিংসফোর্ড রেগে গিয়ে নির্দেশ দেন যে তরুণ বন্দেমাতরম শ্লোগান দিচ্ছে তাকে গ্রেফতার করতে। এরপর ১৪ বছর বয়সী বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র এবং মানিকতলা গুপ্ত সমিতির সদস্য সুশীল সেনকে ধরে জেরা করতে যায় পুলিশ। তখন সুশীল সেন সার্জেন্ট হুই-এর মুখে আঘাত করে। এরপর সুশীল সেনকে ধরা হয় এবং কিংসফোর্ড তাকে ১৫ বার বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সুশীল সেন প্রতিটি বেত্রাঘাতের পর বন্দেমাতরম ধ্বনি দেয়। সমগ্র দেশ সহ কলকাতায় এই ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। সেই সময়কার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সুশীল সেনের প্রশংসা করে পূর্ণ ঘটনার বিবরণ প্রকাশ করে। সুশীল সেনকে সম্মান জানিয়ে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল ১১ ই সেপ্টেম্বর বন্ধ থাকে। এদিকে এরপর সুশীল সেনকে বেত্রাঘাত করার জন্য বিপ্লবীদের মনে কিংসফোর্ডের প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা জন্ম নেয়। যুগান্তর গোষ্ঠী নেতারা একটি গোপন আদালতের মাধ্যমে কিংসফোর্ডের বিচারের ব্যবস্থা করে। সেই বিচারে কিংসফোর্ডকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় বিপ্লবীরা। সরকার কিংসফোর্ডের এই বিপদের কথা বুঝতে পেরে তাঁকে মোজাফফরপুর এ বদলি করে দেয়। কিন্তু যুগান্তর গোষ্ঠীর নেতারা কিংসফোর্ডকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বোমা তৈরির দায়িত্ব পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বোম্বাই ভিক্টোরিয়া টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন-এর ছাত্র তথা মানিকতলা গুপ্ত সমিতির সদস্য উল্লাসকর দত্তর উপরে। এই বোমা তৈরিতে উল্লাসকরকে সাহায্য করেছিল মেদিনীপুর গুপ্ত সমিতির অন্যতম সদস্য, বিদেশ থেকে বিস্ফোরক তৈরি ও তার ব্যবহার শিখে আসা হেমচন্দ্র। দুজনে মিলে যে বম্বটি তৈরি করে সেটি ছিল লাইফ বম্ব। এই বম্ব-এর পরীক্ষা করতে ১৯০৮ সালের জানুয়ারি মাসে উল্লাসকরের সঙ্গে দীঘারিয়া পাহাড়ে যান প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ সরকার, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, নলিনীকান্ত গুপ্ত। পরীক্ষার সময়ে প্রাণ হারাতে হয় প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তীকে। তবে বোমা তৈরিতে সফল হওয়ায় বাকি আরো বিস্ফোরক তৈরির ব্যবস্থা করতে থাকে বিপ্লবীরা। তাদের তৈরি বোমা দিয়ে কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য বারীন্দ্রকুমার ঘোষ দুজন তরুণ বিপ্লবীর উপর দায়িত্ব নেন। এই দুজন হলেন ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী। তারা দুজনে মিলে ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনটি রিভলভার ও একটি ডিনামাইট বোমা নিয়ে কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে মোজাফফরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এরপর ৩০ এপ্রিল কিংসফোর্ডের বাড়ির সামনে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু দুজন মহিলার মৃত্যু হয়। পরের দিন দুজন বিপ্লবীই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। প্রফুল্ল চাকী নিজের রিভালবার দিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মঘাতী হয়। আর বিচারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়।
উল্লাসকর দত্ত
এরপরেও গুপ্ত সমিতির সদস্যরা চরমপন্থার পথ ছাড়েননি। তবে এই পথ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কেনা এবং মামলা চালানোর জন্য যে ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন হয়, তার জন্য সমিতির সদস্যরা ডাকাতি ও লুণ্ঠনের কাজ শুরু করে। ১৯০৮-১৯১৫ পর্যন্ত বিপ্লবীরা বহু ডাকাতি ও লুণ্ঠন চালায়। শুধু তাই নয় বিপ্লবীদের কাজে বাধাদানকারী পুলিশ, গোয়েন্দা ও পুলিশ-গোয়েন্দাদের সাহায্যকারী ব্যক্তিদের গুপ্তহত্যা সংগঠিত করে।
এদিকে ১৯০৪-এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ শক্তি তাতে জড়িয়ে পড়ে। বিপ্লবীরা এই সময়কে বিপ্লব ঘটানোর সুবর্ণ সুযোগ বলে মনে করে এবং দেশজুড়ে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা বিভিন্নভাবে এই সশস্ত্র বিপ্লবের স্বার্থে বৈদেশিক সাহায্য লাভের চেষ্টা করতে থাকে। তবে বিপ্লবীদের নতুন করে অস্ত্রশস্ত্রের প্রস্তুতি সম্পর্কে পুলিশ নজর রাখতে শুরু করে। শুধু তাই নয় বিপ্লবীরা কিভাবে কোথা থেকে এ সমস্ত জোগাড় করার চেষ্টা করছে তারও তথ্য তলাশ করতে শুরু করে সরকারের পুলিশ। পুলিশের এই গুপ্তচরবৃত্তির কথা স্পষ্ট হয় এই সময়ের সিডিশন কমিটির রিপোর্ট। এখানে বলা হয় পুলিশ যে সকল তথ্য সংগ্রহ করেছে তাতে করে দেখা যায় যে, “রডা কোম্পানি বিদেশ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করে এদেশে ব্যবসা করত। এ সময় বিদেশ থেকে মশার নামে এক ধরনের পিস্তল আসে। এই পিস্তলের গুলি কোম্পানির কাস্টম অফিসারের থেকে কোম্পানির গুদামঘরে যাওয়ার সময়, ওই কোম্পানির এক বাঙালি কর্মচারী (বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী) দ্বারা দশটি বাক্স কোম্পানির গুদামে না গিয়ে সেগুলি যুগান্তর সমিতি বিপ্লবীদের হাতে চলে যায় এবং বাংলাদেশের ৯টি বিভিন্ন বিপ্লবী সমিতির মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই বিলি হওয়া পিস্তলগুলি ব্যবহার করে শুধুমাত্র ১৯১৪-তেই ৫০ টিরও বেশী ডাকাতি ও গুপ্ত হত্যা সংগঠিত হয়।” এই সমস্ত ডাকাতি ও গুপ্তহত্যা বাংলা সরকারকে অচল করে তোলে; এরপর সরকার বাংলা তথা গোটা ভারত থেকে প্রায় ১০ ছাত্র-যুব কে বিনা বিচারে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বাংলার বিপ্লবী।
এরপর ভারতবর্ষের জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর মতো অহিংস ব্যক্তির আগমনে গোটা দেশজুড়ে যখন অহিংস আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করছে তখনও ছাত্ররা শুধুমাত্র অহিংস আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে তারা আরও নানাভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। তারা বুঝিয়ে দিয়েছে অহিংস বা সহিংস যে পথেই হোক আসলে তারা চায় বিট্রিশ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, পূর্ণ স্বাধীনতা। তাই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, আন্দোলনে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা এবং বিদেশি অত্যাচারী শাসকের আইন ভাঙা ছাত্রদের ধর্ম। তবে এরপর থেকে ছাত্র আন্দোলন যত এগিয়েছে ততই তার রূপ এবং ধারা পরিবর্তন করেছে।
তথ্য সূত্র
১) গৌতম চট্টোপাধ্যায়-স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ছাত্র সমাজ, মণীশ গ্রন্থালয় প্রা.লি, ১৯৯০
২) হীরেন দাশগুপ্ত ও হরিনারায়ণ অধিকারী-ভারতীয় উপমহাদেশের ছাত্র আন্দোলন, র্র্যাডিক্যাল ইম্প্রেসন, কলকাতা, ২০০৮
৩) সুপ্রকাশ রায়- ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম,র্র্যাডিক্যাল ইম্প্রেসন, কলকাতা, ২০০৯
৪) নলিনী মোহন দাশগুপ্ত- রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের স্মৃতি কথা, পঃবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৮৮৯
৫) বরুণ দে (সম্পাদনা)-মুক্তি সংগ্রামে বাঙলার ছাত্র সমাজ, পঃবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ২০০৮
৬) সুশোভন সরকার- বাংলার রেনেসাঁস, দীপায়ন, কলকাতা, ২০১১
৭) শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ,কলকাতা, ১৯০৩
৮) Susobhan C Sarkar- Derozio and Young Bengal-in A.C Gupta(ed), studies in Bengal Reconnaissance, Jadavpur,1958
৯)Asish Lahiri-Radhanath Sikdar: An a typical Derozian- beyond the peak, Boichitro, Kolkata,2010
১০) Sivnath sastri- History of Brahmo samaj, publishers-R. Chatterjee, Kolkata, 1911
১১) S D Couet- Life and letters of Raja Rammohon Roy,2nd ed., Kolkata, 1918
১২) Nishit Ranjan Roy- India and her people: Bengal, Sangam books, Kolkata, 1979
১৩) NN Ghosh- Krishnodas Pal a study, Kolkata, 1887
১৪) Nitish Sengupta- History of the bengali speaking people, Ubs, 2001
বিশিষ্ট ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নির্মল নাগ বেশ কিছুদিন আগে প্রকাশিত ‘নিহত নায়ক’ বইটিতে যুক্তি প্রমাণ সহ প্রফুল্ল চাকিকে যে হত্যা করা হয়েছিল সেটি তুলে ধরেছেন। আর উল্লাসকর দত্তের বদলে পুলিনবিহারী দাসের ছবি ছাপা হয়েছে।অবিলম্বে সংশোধন প্রয়োজন।
কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। ছবিটা আমাদের ভুলে গেছে। পাল্টে দেওয়া হয়েছে। আর লেখক বইটার অনুসন্ধান করছেন। আবারও ধন্যবাদ জানাই।