ইউরোপের ব্যালাড ও তার প্রকৃতি
ভাবতে অবাক লাগে গোটা একটা বই লেখা হলো (সিংগিং দ্য নিউজ অফ ডেথ: এক্সিকিউশন ব্যালাডস ইন ইউরোপ ১৫০০-১৯০০) ইউরোপের গত চার শতকের শিরচ্ছেদের ব্যালাড নিয়ে, আর এই গবেষণাপত্রটিকে একটা পূর্ণাঙ্গ বইয়ের রূপ দিতে উনা ম্যাকিলভেন্না সময় নিলেন দশটা বছর! ২০২২ সালের ৫ জুলাই বইটি ছাপা আকারে প্রকাশিত হয়। দু’টো পর্বের এই বইটির প্রথম অংশের বিষয়বস্তু হল ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে ইউরোপে সংগঠিত শিরচ্ছেদের সময়ে বা পরে রচিত ব্যালাডগুলিতে ঘটনার সত্যতা ও রচনার কাব্যিক অতিকথন নিয়ে। দ্বিতীয় অংশের বিষয় বিবিধ – সমাজ ও সংস্কৃতিতে (বিশেষত অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে) ভালো-মন্দের হিসেব, হত্যা ও নৃশংসতা সম্পর্কে লেখক ও পাঠক বা শ্রোতা-মনের প্রতিক্রিয়া এবং ব্যালাড যুগের অন্তকাল নিয়ে।১
আমরা ইউরোপের ব্যালাডের খুব সাধারণ দু’টো প্রশ্ন নিয়ে এখানে ভাবার চেষ্টা করবো, ব্যালাড কী এবং ইউরোপীয় ব্যালাডকে কিভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা যেতে পারে। ব্যালাড শব্দের কাছাকাছি বাংলা পরিভাষা হতে পারে ‘গীতিকা’। এটি এমন একটি সাহিত্যিক ধারা, যা ইউরোপের ইতিহাসে একসময় সবচেয়ে বেশি পঠিত, সংরক্ষিত এবং রচনার দিক দিয়ে সবচেয়ে ব্যাপৃত। এছাড়াও কোনও কোনও ব্যালাডের মধ্যে যেহেতু এক ধরনের রহস্য ও রোমাঞ্চের অনুষঙ্গ আছে সেই জন্য ইউরোপের লোকসংগীতের অন্যান্য ধারাগুলির তুলনায় এর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। একসময় ব্যালাড-গবেষকরা অনেকেই একে ইউরোপের সাহিত্যের ইতিহাসে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র সাহিত্যিক অভিব্যক্তি বলে মনে করতেন, যদিও উত্তর আমেরিকায় বহু ব্যালাডের সন্ধান পাওয়া যায় আর দক্ষিণ এশিয়ার ব্যালাড-এর কতটা বিস্তার হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দক্ষিণ এশিয়ার এক সময়ের গীতিকাগুলি এখানকার নিজস্ব গল্পকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল।
লোকসাহিত্যের গবেষক জন নাইলস্ মানুষের স্বভাব পর্যালোচনা করে তাকে ‘homo narrans’ বা ‘গল্প-বলা প্রাণী’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন তা প্রায় ২০ বছরের বেশি হয়ে গেল। যে কোন ব্যালাডের সার্বিক প্রচেষ্টাই হলো একটি গল্প বলা। একটা ব্যালাডকে বিশ্লেষণ করে তার ছন্দ, অন্ত্যমিল, সুর ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক পাওয়া যাবে, তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় একটা দুর্ধর্ষ গল্প। এই গল্প সবসময় যে মহাকাব্যের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হতে হবে এমন কিন্তু গৎবাঁধা নিয়ম নেই। বরং এর ব্যতিক্রম রয়েছে। স্লোভাকিয়ান ব্যালাড ধারাগত, ছন্দগত বা ভাবনাগত – সমস্ত ক্ষেত্রেই অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ, যদিও এই অঞ্চলের কোন নিজস্ব মহাকাব্য নেই।
‘ব্যালাড’ শব্দটি বর্তমানে ইংরেজি ও বাকি ইউরোপীয় ভাষায় যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, তা অতীত অর্থের সঙ্গে আর মেলে না। মধ্যযুগে ব্যবহৃত ল্যাটিন একটি ক্রিয়া ‘ballare’ শব্দটির (এর অর্থ হলো নাচ) থেকে ব্যালাড শব্দের উৎপত্তি। আসলে এক ধরনের গান সহযোগে নাচকেই প্রথমে ব্যালাড বলা হত।২ এই নাচ অর্থে ব্যালাড শব্দটি ব্যবহৃত হতো দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে। ট্রুবাদুর বা চারণকবিরা এই ধরনের সংগীত ও নৃত্যক্রিয়া করতেন বলে জানা যায়। চতুর্দশ শতকে এই চারণকবিরা নিজেরাই বাজনা বাজিয়ে, দুই বা তিন রকম স্বরে গান গাইতেন। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে যখন ছাপায় এই ধারার সাহিত্য বা সংগীত উপস্থাপনার প্রসার ঘটে তখন ব্যালাড শব্দটি কোনও বড়ো বা বর্ণনামূলক গান অর্থে ব্যবহৃত হতো। ১৭৬৫ সালে একটি সংগৃহীত রচনা প্রকাশ করতে গিয়ে থমাস পারসি এই ধারার নাম দিয়েছিলেন ‘ওল্ড হিরোয়িক ব্যালাডস’।৩ ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে ছাড়াও প্রাচীন কেল্টিক ব্যালাড সম্পর্কে বলা হতো, এটা আসলে এক ধরনের গান। এই কারণে পুরোনো স্কটিশ লোকসংগীতকে ব্যালাড বলেই উল্লেখ করা হতো। ইংল্যান্ডে ব্যালাড শব্দটির ব্যবহার শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই জার্মানিতে এই শব্দটির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ১৭৭১ সালে গুতে তার লেখায় রাইন নদীর পশ্চিমে অবস্থিত অ্যালসেশিয়ান অঞ্চলের লোকগীতির যে সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তাকে ‘জার্মান ব্যালাড’ নামে উল্লেখ করেন। ফোক ব্যালাড বা লোকগীতিকা শব্দটি বর্তমানে ইংরেজি ভাষায় বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাগুলিতে খুব অনায়াসে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু লোকগীতির চর্চাকারী বা এতে যুক্ত মানুষরা এই শব্দটি ব্যবহার করেন না বললেই চলে।
ব্যালাড ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে।৪ কারণ প্রতিটি ভাষার সাহিত্যের যে কোনও ধারাতেই একটি নির্দিষ্ট চলন ও ঐতিহাসিক পরম্পরা রয়েছে, ঠিক একইভাবে স্থানগত বা বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতাও রয়েছে। তবে মোটামুটি সব ধারাই ব্যালাডকে একটি ‘ন্যারেটিভ সং’ বা ‘গল্প বলা গান’ অর্থ করে। ঊনবিংশ শতকের সার্বিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত মনীষা ভোক খারাজুইচ (Vuk Stefanović Karadžić) একে অবশ্য ‘মেয়েদের গান’ বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ সেখানে মেয়েরাই এই গানের বাহক ছিলেন। অন্যদিকে হিস্পানিদের৫ অভিধানে দুটো শব্দ পাওয়া যায়; একটি হল ‘করিডো’ আর অপরটি হল ‘কেন্তো’। আজকের দিনেও করিডো বলতে যে যে বিষয়ের উপর ব্যালাড বোঝায়, সেগুলি হলো – ঐতিহাসিক ঘটনা, বীররসের গীতিকা, হত্যার ঘটনা ও হত্যাকারীর জীবনী, নারী-পুরুষের অজাচার, আত্মহত্যা ইত্যাদি। অন্যদিকে স্লোভেনিয়ার গায়করাও ব্যালাডকে ভিন্ন দুটি শব্দে উল্লেখ করেন, একটি এলিজি ও অপরটি প্রাচীন সংগীত অর্থে।
ব্যালাড ইউরোপে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে মোটামুটিভাবে অন্ত-মধ্যযুগ থেকে। তবে এর সূচনা কখন থেকে হয় তার নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। এরিখ সিম্যান তার লেখায় ব্যালাড-এর সূচনা সম্বন্ধে দুটো আলাদা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। এর প্রথমটি হলো, ইউরোপের মধ্যযুগের শেষ হতেই দেখা গেল বড়ো মহাকাব্যের দিন শেষ হয়ে আসছে। তাই এই বড়ো গল্পকে ছোটো ছোটো টুকরো করে তার একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুর দেওয়া কবিতা বা গীতিকা তৈরি হলো। এই গানগুলি নাচ বা নাটকের আবহে উপস্থাপিত করা হতো। সিম্যানের দ্বিতীয় ধারণা হলো, বহুদিন আগে থেকেই ছোটো ছোটো গান চারণকবিদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছিল। সামন্ততন্ত্রের পূর্ণতার কালে এই গানগুলিই মহাকাব্যের সঙ্গে জড়িয়ে বড় গান তৈরি করে। ব্যালাড সৃষ্টিতে এই উভয় ধারণারই সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রতিটি অঞ্চলে সাহিত্যের একটি নিজস্ব রীতি রয়েছে। যদি সামগ্রিকভাবে দেখা যায় তবে বলতে হবে ইউরোপে ব্যালাড যে মহাকাব্য থেকে এসেছিল এতে কোন ভুল নেই। এটা বোঝা যায় একই ব্যালাডের বিভিন্ন ভাষায় অস্তিত্ব লক্ষ করে। মারজেতকা কাওসিস এই বক্তব্যের স্বপক্ষে একটি উদাহরণ দিয়েছেন।৬ তিনি বলেছেন, জার্মানির একটি ব্যালাডকে (Die Geburt im Walde) স্লোভেনিয়ায় ‘Smrt matere na porodu’ নামে ডাকা হতো। এই একই ব্যালাড ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে প্রচলিত ছিল। এই সবগুলিই এসেছিল একটি প্রচলিত মহাকাব্য উলফডায়াট্রিচ্ থেকে। কাওসিস মনে করেছেন মহাকাব্যকে খণ্ডিত করে যে ব্যালাড তৈরি হয়েছিল, এটি তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ।
এখানে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে ব্যালাডের আবির্ভাব বা বহন করেছিলেন আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গায়ক সম্প্রদায়ের চারণকবিরা। এরা রাজানুগ্রহে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হন ও বিভিন্ন কেল্লায় বা ক্যাসলে গান গেয়ে বেড়াতেন। এই তত্ত্ব মেনে নিলে ব্যালাডের জন্ম হয় দ্বাদশ শতকের আশেপাশের সময় ফ্রান্সে অথবা ইংল্যান্ডে। তবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার লোকগানের গবেষকরা মনে করেন তাঁদের অঞ্চলে ব্যালাডের আগমন হয়েছিল ফ্রান্স থেকে, ত্রয়োদশ শতকের আগেই। এঁরা নিজেরাই গান গাইতেন ও সঙ্গে বাজনাও বাজাতেন। সিম্যানের মতে, জার্মানির ব্যালাড সম্পর্কে প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তা দ্বাদশ শতকের শুরুর দিকেই। অন্যদিকে ইভান গ্রাফেনওয়ার মনে করেন শ্লোভেনিয়ান ব্যালাডের সূচনা হয় একাদশ শতকের রোম্যান্টিক ব্যালাড থেকে। স্প্যানিশ রোমান্সের সূচনা হয় চতুর্দশ শতকে আর রাশিয়ায় বাইলিনের আবির্ভাব হয় ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে। ইউরোপীয় সাহিত্যে যাকে রোম্যান্টিক যুগ বলা হয় সেই সময় থেকেই ব্যালাডের ব্যাপক বিস্তার হতে থাকে। সেই সময়ের লেখা হয়তো আজ তেমনভাবে পাওয়া যায় না, তবে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে অন্য নানা সূত্র থেকে জানা যায়। জেমস ফ্রান্সিস ছোটোদের গল্প নিয়ে কয়েকটি খণ্ডে সংকলন প্রকাশ করেছিলেন যা ‘দ্য ইংলিশ অ্যান্ড স্কটিশ পপুলার ব্যালাডস’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে রবিনহুডের গল্প পঞ্চদশ শতকের মাঝের কোনও সময়ের একটি হাতে লেখা বই থেকে নেওয়া হয়েছিল। ডেনমার্কের প্রথম ছাপানো ব্যালাড পাওয়া যায় ১৫৯১ সালে। স্লোভেনিয়াতে হাতে লেখা ব্যালাডের প্রথম নিদর্শন রয়েছে ১৭৭৫ সালে ডিগমা জ্যাকোৎনিকের রচনার।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, ইউরোপের সাহিত্যের ইতিহাসে দেখতে পাই প্রথমে বড় কবিতা বা মহাকাব্যের যুগ, তারপর তা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসে এবং তারপর আসে গদ্যের যুগ। সাহিত্যের প্রবাহে এই পরম্পরা তৈরি হচ্ছে কেন? এর উত্তর হিসেবে যেটা বলা যায়, সামন্ততন্ত্রের পতনের পর যখন ইউরোপে নগরায়ন শুরু হয় তখন গ্রাম থেকে মানুষের নিয়মিত শহরে যাত্রা হতো (প্লেগ বা রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি বাদে), সঠিক বলতে এভাবেই শহর ক্রমশ স্ফীত হয়। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে গানের পৃষ্ঠপোষক ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকলে গানের ফর্মেরও পরিবর্তন হয়। প্রাচীন অতীতে অধিকাংশ বৃহৎ রচনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন ছোটো বা বড়ো শাসকরা। ফলে তাদের সাংস্কৃতিক চাহিদায় এই বীররসের বৃহৎ গানগুলি তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হতো। মধ্যযুগের ইউরোপে এক দল নতুন সামন্ত শাসকরা এই কবিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এগুলি তখন বিনোদনের উপকরণ ছিল। পৃষ্ঠপোষক ভেদে তাঁদের স্তুতিবন্দনায় কিছু পরিবর্তন করতে হত। ব্যালাড ছাপার আকারে তখনও প্রকাশ হতে শুরু হয়নি। ষোড়শ শতকের পর আমরা আর এই ধারাটির প্রবহমানতা বিশেষ দেখতে পাই না। তখন গান বা ব্যালাডগুলো যেন ক্রমশ নগরজীবনে ঢুকে আসছে আর তার গায়ে নাগরিক প্রলেপ লাগছে।৭ নগরের মূল পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠছেন সাধারণ গরিব মানুষ। একদিকে এরা দরিদ্র এবং অন্যদিকে এদের নিরক্ষর অবস্থান থেকে পরিবর্তন হচ্ছে নাগরিক চাহিদায়। নাগরিক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে ব্যালাড আর কেবল মৌখিক রইল না, কিন্তু ছাপা হতে লাগল সস্তা কাগজে (সাধারণ পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় থাকতে) আর প্রায় একই ধরনের সুর ও ছন্দের আকারে, যাতে নিরক্ষর মানুষ শুনে শুনে খানিকটা মনে রাখতে পারেন ও উপভোগ করতে পারেন। নগরায়নের পরবর্তী পর্যায়ে, যেখানে সাক্ষরতার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে এবার গদ্য প্রচলিত হতে থাকে। আসলে পদ্য ক্রমশ পুরোনো ধারার প্রকাশ হয়ে উঠছিল, তাই আর একটু জটিল বিষয় বলার জন্য গদ্যের প্রয়োজন হচ্ছিল আঞ্চলিক ভাষাগুলিতেই।
ইউরোপের ব্যালাডকে ভাষাগতভাবে চারভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এই চারটি ভাগের আলাদা কিছু নিদর্শন থাকলেও স্লোভেনিয়ান ব্যালাডের যে ধারা ও বিষয়বস্তু, তা মূলত ইউরোপীয় পশ্চিম ধারার সঙ্গে একেবারেই মিলে যায়। ইউরোপের সমস্ত অঞ্চলে ব্যালাড নিয়ে উৎসাহ থাকলেও গবেষণার গভীরতা সব জায়গায় সমান নয়। আর প্রতিটি স্থানের ব্যালাড নিয়ে সমমানের গবেষণা হয়নি বলে এর একটি সর্বজন সুবিদিত সংজ্ঞাও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সিগার হুস্তবেদ অন্য একভাবে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের পরিভাষা, বিভিন্ন সংজ্ঞা, শ্রেণিবিন্যাস এবং অন্যান্য সমস্যাগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।৮ বিশেষজ্ঞ ডেভিড বুচেনের বইটা পড়া শুরু করলে আপনি প্রথম লাইনেই ধাক্কা খাবেন, কারণ তিনি শুরু করছেন এইভাবে, ‘ব্যালাডস আর অকওয়ার্ড থিংস’! তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ব্যালাড কিন্তু প্রকৃত অর্থে ছাপা কোন লেখা নয়, মুখে মুখে প্রচলিত সাহিত্য। সাহিত্যিক ঐতিহ্য থেকে তৈরি হওয়া একধরণের কবিতা বা গানকেই তিনি ব্যালাড বলে উল্লেখ করছেন।৯
যদি রচনার বিষয়বস্তু বা অন্য কোন ধরনের মানদণ্ডে ব্যালাডের শ্রেণিবিন্যাস করার চেষ্টা হয় সেটা বেশ কঠিন। কারণ সময় ভেদে ও দেশ ভেদে এর চরিত্র বহু ধরনের। একটা তুলনামূলক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। জার্মানিতে যে ব্যালাডগুলি প্রচলিত তা অধিকাংশই ঐতিহাসিক বা বাস্তব ঘটনার নিরিখে রচিত হয়েছিল, অর্থাৎ এখানে মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই রচনাগুলি উঠে এসেছিল। অন্যদিকে স্পেন, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি বা ইতালির মত দেশে ব্যালাড ছিল মূলত ‘সামাজিক ভাষ্য’। আবার পোর্তুগালের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে মূলত মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত সংগীত হিসেবে ব্যালাড প্রসার লাভ করে। ফলে সহজেই বোঝা যায় ইউরোপের সমগ্র অঞ্চলে ব্যালাডের চরিত্র একরকম ছিল না।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা জিনিস খেয়াল রাখা জরুরি। ব্যালাড লেখা ও তা উপস্থাপনা করা – এই দুইয়ের ভিন্ন তল রয়েছে এবং এই দুটি ক্ষেত্রই এক সংস্কৃতি থেকে অপর সংস্কৃতিতে ভিন্নতর হয়। ব্যালাড গাওয়া যাকে ইংরেজিতে ব্যালাড্রি বলা হয়, আর সেই গান রচনা করা – দুটো আলাদা সময়ের বা ব্যক্তির কারণে এর ভেতর উদ্দেশ্যগত বা ভাবনাগত পার্থক্য দেখা যায়। কোন দেশে, যেমন স্লাভ ভাষাভুক্ত দেশগুলিতে ব্যালাড প্রায় সম্পূর্ণরূপেই মৌখিকভাবে রচিত হতো। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের মত দেশগুলিতে ব্যালাড লেখার একটি আলাদা ধারা ছিল বহু প্রাচীনকাল থেকে। এই লিখে রাখার ধারা সেই মধ্যযুগ থেকেই আমরা দেখতে পাই। এরিখ সিম্যান লক্ষ করেছেন যে ইউরোপের ব্যালাডগুলি একটি গল্পকে বলার বা লিখনের চেষ্টা করে। তাই ব্যালাড বলতে আসলে যে শব্দটা ব্যবহার করা যায়,তা হলো ‘গল্প বলা গান’।
এতদিনের পশ্চিম ইউরোপীয় ও স্লোভেনিয়ান ব্যালাড চর্চা ক্রমশ একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দাবি করছিল। সেই অভাব মেটানো সম্ভব হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। এই বছর জার্মানির ফাইবুর্গ-এ ব্যালাড বিশেষজ্ঞ ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর এথনোলজি অ্যান্ড ফোকলোর (SIEF)-এর যে ব্যালাড কমিশন (KfV) রয়েছে তাঁরা একত্রিত হন। এঁরা সর্বসম্মতিক্রমে যে সংজ্ঞা তৈরি করেন তা হলো, ‘আ ব্যালাড ইজ আ সং দ্যাট টেলস আ স্টোরি দ্যাট ইজ পয়েন্টেডলি ড্রামাটিক’। কেবল সংজ্ঞা নির্ধারণেই নয়, তাঁদের প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেজা জামের ১৯৭৪ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ব্যালাডের প্রথম একটি ক্যাটালগ তৈরি করেন। আপাতত এই সংজ্ঞাটি মান্য ও এদের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রচেষ্টায় মোট ছয়টি দেশের ব্যালাডের সংরক্ষণ, গবেষণা ও আগ্রহ সৃষ্টিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের নতুন ধারণা দেবে বলেই আশা রাখি।
পাদটীকা
১. Una McIlvenna, “Ballads of Death and Disaster: The Role of Song in Early Modern News Transmission” in J. Spinks, C. Zika (eds.), ‘Disaster, Death and the Emotions in the Shadow of the Apocalypse, 1400–1700’; London, 2016.
২. J. E. Housman, ‘British Popular Ballads’; London: Ayer Publishing, 1969, p. 15.
৩. Nick Groom, “Introduction” in Thomas Percy, ‘Reliques of Ancient English Poetry’, 3 vols; London, Routledge Press, 1996.
৪. বিভিন্ন ভাষায় ব্যালাডকে বর্তমানে যে নামে ডাকা হয় –
স্লোভেনিয়ান- pripovedna pesem
ফরাসি- chanson narrative
রাশিয়ান– byline
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান- vise
পোর্তুগিজ- romanceiro
জার্মান- Erzähllied
ক্রোয়েশিয়ান ও সার্বিয়ান- pričalica বা pripovjetka
ইউক্রানিয়ান- dume
স্প্যানিশ- ; romance বা romacero
৫. প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা মানুষদের সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। হিস্পানি বলা হয় তাদের, যারা নিজেরা এক সময়ের স্পেন থেকে অন্য দেশে গিয়ে এখনও স্প্যানিশ বলেন অথবা তাদের পূর্বপুরুষরা বলতেন। আর ল্যাটিনো বলা হয় ল্যাটিন আমেরিকানদের, অর্থাৎ মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানদের।
৬. Zmaga Kumer, ‘The Folk Ballad in Slovenia’, 1991; Marjetka Golež Kaučič, ‘The Slovenian Folk Ballad: A Genre Enigma’, 2007.
৭. রাধাকে নিয়ে পল্লী গীতিকা ও কলকাতার লোকসাহিত্যের পরিবর্তনের উপর উল্লেখযোগ্য একটি লেখা রয়েছে, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, “তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না – একটি দেবীর রূপান্তর”, ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’; কলকাতা: অনুষ্টুপ, ২০০৮, পৃ. ১১৫ – ১২৬।
৮. Sigurd Hustvedt, ‘Ballad Books and Ballad Men’; Harvard University Press, 1930, p. 4.
৯. David Buchan, ‘The Ballad and the Folk’; East Linton: Tuckwell Press, 1997, p. 1.
অসাধারণ একটি নিবন্ধ। অনেক নতুন জিনিস জানলাম। ইউরোপীয় ব্যালাডের সঙ্গে আমেরিকার ঐ জাতীয় লোকসাহিত্য বা লোকগীতি সম্পর্কে কোনো গবেষণা হয়েছে কিনা তা জানতেও ইচ্ছুক।
আর ইউরোপ এবং এশিয়ার বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার লোকগীতিসমূহের মধ্যে কোনো তুলনামূলক আলোচনা বা গবেষণা হয়েছে কিনা সেটা জানারও আগ্রহ রইল।
খুব ভালো লাগলো পড়ে।
খুব ভালো। আপনি নিশ্চয়ই বই করুন এই বিষয়ে৷