একটি দিন
স্থান – উয়ারী-বটেশ্বর, বাংলাদেশ
কাল – আজ থেকে সোয়া দুই হাজার বছর পুর্বে।
নাগরিক জীবন ক্রমশ হয়ে উঠেছে পাপসঙ্কুল। ধনী নগরবাসীর ইন্দ্রিয়াসক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে; অপর দিকে গরীব মানুষ দুই বেলার খাদ্যের জন্য সারাদিন পরিশ্রম করে দু’মুঠ খুদকুঁড়া সংগ্রহ করতে পারে না।
আমার দুর্ভাগ্যের বর্ণনা করি। পূর্বজীবনে ছিলাম এক বণিক। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রাচীন জনপদ সৌনাগড়াতে বেসাতি করতাম। ছিল মূল্যবান পাথরের ব্যবসা। স্বর্ণকাররা আমার থেকে পাথর কিনে অলঙ্কার তৈরি করত।
সৌনাগড়া এক প্রাচীন বন্দর ও দুর্গ-নগরী। নগরীর চারিদিকে আছে চুন-সুরকি নির্মিত সোজা সড়ক। মূল সড়কগুলির পাশে পার্শ্ব-রাস্তা। সড়কের পাশে বিপণিগুলিতে বিলাসী নাগরিকের ভিড় লেগেই থাকে। আমার বিপণির সামনে পোড়ামাটির ফলকে বিপণির নাম লেখা ছিল – ‘রত্নমালা’। মাতার নাম রত্নমালা। এখন আর সে বিপণি নেই, বন্ধ হয়ে গেছে। আমার কারিগরেরা অন্য দোকানে আশ্রয় নিয়েছে।
এই নদী-বন্দর থেকে বড় বড় নৌকায় বিভিন্ন বিলাসদ্রব্য দেশের নানা জায়গায় যায়। নদীতে তাই দেখা যায় ডিঙ্গি, ভেলা, মালবাহী নৌকা, ময়ূরপঙ্খী। এমনকি এই সব নৌকা সমুদ্র দিয়ে চলে যায় দূর চম্পা ও কাম্বোজ দেশে। নৌকায় থাকে মূল্যবান পাথরের অলংকার, রূপা ও অন্যান্য ধাতুর গহনা। থাকে লোহার কুঠার, কোদাল ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্য, কাচের পুঁতির অলঙ্কার, পোড়ামাটি ও পাথরের শিল্পবস্তু, লাল বা কালো মসৃণ মৃৎপাত্র।
নগরে আছে বৌদ্ধবিহার, পাশে বৌদ্ধকুণ্ড। নগরবাসীর আবাসস্থলগুলি পার্শ্ব-রাস্তাগুলির পাশে গড়ে উঠেছে, অধিকাংশই ছোট ছোট মাটি ও ইটের গৃহ। তবে আমার ইষ্টক নির্মিত দ্বিতল হর্ম্য ছিল মূল সড়কের পাশে। বাড়িতে ছিল চতুর্দোলা। গৃহে ছিল মাতৃদেবী, স্ত্রী, সুখ ও শান্তি।
কিন্তু অদৃষ্ট মন্দ। এক ছলনাময়ী রূপসীর খপ্পরে পড়ে সব গেল। সেই চতুরার মোহে সকল সম্পদ নষ্ট করলাম। মদিরায় আসক্ত হয়ে স্বাস্থ্য গেল। মাতৃদেবী সেই শোকে আত্মহত্যা করলেন। আর সেই দিন রাতে আমি সংসার ত্যাগ করলাম।
আশ্রয় পেলাম এই মহাবিহারে। হয়ত এ’ও তথাগতের বাসনা। এই বিহারের তিনদিকে আছে প্রাচীর। মধ্যে সু-উচ্চ স্তূপ। সেথায় আছে ভগবান তথাগতের কেশ। চত্বরের পাশে আছে তথাগতের প্রস্তরমূর্তি। পিছনে ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রাচীরের গায়ে অজস্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ। এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠগুলিতে নেই কোন বিলাস সামগ্রী। ইট বাঁধানো শয্যায় মাদুর বিছিয়ে নিদ্রা যায় বিগতজন্মের বিলাসী বজ্রসেন। শান্তি খুঁজে পাই এই ক্ষুদ্র উপকরণহীন প্রকোষ্ঠে। একদিন আমার শরীর ছিল মাংসল, মেদবহুল। আজ আমি ক্ষীণ, কৃশ। ভুলে গেছি গত জন্মের বজ্রসেনকে। সত্যিই কি ভুলেছি তাকে? তবে কেন এখনও নিদ্রাহীন রাতে চেতনে-অবচেতনে আসে সেই রূপসী ছলনাময়ী?
সন্ধ্যার আগমনে প্রকোষ্ঠগুলিতে পীতবর্ণ বস্ত্র পরিহিত শ্রমণরা দীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রাত্রির আহার্য সামান্য দুটি তণ্ডুল ও ফলমূল। বিগত জন্ম থেকে এনেছি এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রত্নখচিত বুদ্ধ মূর্তি। আহার শেষে এবার আমি ভগবান তথাগতকে আরাধনা করব।
শাক্যমুনি বলে গেছেন, ‘বৈরভাব কেবল অবৈরভাব দ্বারা শান্ত হয়। ইহা মানুষের ধর্ম।’
আজ আমার আর কোন বৈরভাব নেই।
সত্যি কী দূর করতে পেরেছি সকল বৈরিতা, মোহ, লোভ, লালসা ও রিরংসা? এখনও যে রাতে স্বপ্নে দেখি সেই মদালসা রমণীকে! এখনও যে তাকে কামনা করি, তার জন্য অস্থির হই!
নমো তস্স ভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্স।
হে শাক্যসিংহ বুদ্ধ, আমাকে তোমার পায়ে স্থান দাও। হে বুদ্ধ, আমার প্রতি প্রসন্ন হও।
মৌর্য যুগে বাংলায় গড়ে উঠেছিল কতিপয় নগর, তাতে ছিল বৌদ্ধ মন্দির, বিহার ইত্যাদি। বাংলার প্রাচীনতম লিপি পাওয়া গিয়েছে মহাস্থানগড়ে। এটি বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া শহর থেকে ১৩ কি.মি. দূরে শিবগঞ্জে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। গবেষকরা মনে করেন সে সময়ে মহাস্থানগড় মৌর্য সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
আবার প্রায় ওই একই সময়ে বর্তমানে বাংলাদেশের নরসিংদীতে উয়ারী-বটেশ্বর দুই গ্রাম নিয়ে তৈরি হয়েছিল এক নগর। পূর্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদের খাতের পাশে অবস্থিত ছিল সেই নগর। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মাটির নিচে প্রাপ্ত এই দুর্গ-নগরী সৌনাগড়া প্রায় আড়াই হাজার বছর থেকে আঠারশ বছরের পুরনো। টলেমি তার বই ‘জিওগ্রাফিয়া’তে সৌনাগড়ার উল্লেখ করেছিলেন।
২০০০ সালে বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে উয়ারীতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, রোলেটেড মৃৎপাত্র, নব্ড মৃৎপাত্র প্রভৃতির কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়। ঐ পরীক্ষায় উয়ারীর বসতিকে ৪৫০ সাধারণ পূর্বাব্দের বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে পেরেক, লৌহমল, লৌহ গলানোর ফলে অতি ক্ষুদ্র বল, মরিচাপড়া লৌহবস্তু প্রভৃতি। প্রাপ্ত পোড়ামাটি থেকে ধারণা করা যায় যে, এখানে উচ্চ তাপমাত্রায় লোহা গলানোর প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহার ছিল। উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থানে প্রাপ্ত মৃৎপাত্র এখানে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইঙ্গিত বহন করে।
তথ্যসূত্র-
1. Abu Imam, et.al., ‘Religious and Auspicious Symbols Depicted on Artifacts of Wari-Bateshwar Pratnatattva,’ Journal of the Department of Archaeology, 12, (2006):1-12
2. Jahan, S.H., Archaeology of Wari-Bateshwar, Ancient Asia, 2, (2010): 135–146. DOI:http://doi.org/10.5334/aa.10210
তথ্যসূত্র ২-এ উল্লেখ আছে – A bronze votive stupa and remains of old bricks and fragmentary walls testifying the existence of a ruined Buddhist monastery at Ashrafpur (Zakaria, 1984: 414) are further indications that a prosperous urban centre capable of patronising a Buddhist monastery flourished in this area.
বাংলাতে একদা বুদ্ধধর্ম প্রসারিত হয়েছিল। এখন যেই অংশ বাংলাদেশ সেই অঞ্চলের অনেক জায়গায় এই ধর্ম প্রসারিত হয়। পশ্চিম বঙ্গ এর দক্ষিণাঞ্চলে ও বৌদ্ধ মঠের সন্ধান পাওয়া গেছে।
লেখাটি খুব ভাল ও তথ্য নির্ভর।
ধন্যবাদ নেবেন।
খুব ভালো তথ্য নির্ভর লেখা .
অনেক ধন্যবাদ।
ইতিহাসের ছায়ায় সুন্দর খণ্ডকাহিনি ৷
অন্য স্বাদে ইতিহাসে। অনবদ্য।
অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার বর্ণনা। বিস্তৃত লেখার আশা করছি।
খুব ছোট থেকেই বিভিন্ন কারণে বদ্ধমূল ধারণা
একটা অন্যরকম সভ্যতার উন্মেষ আমাদের অন্চলে ছিল। পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধানে এটা
প্রমাণিত। আপনার তথ্য সমৃদ্ধ রচনাটি ও এক ইংগিত দেয়। আর ও এই ধরণের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা লব্ধ লেখার প্রয়োজন আছে।
ধন্যবাদ নেবেন। এই ধরনের আরও লেখা দিতে চেষ্টা করব।
এই বাংলার বুকেই রাজত্ত করতেন আগ্রামেস, সিন্ধু ছাড়াও ভারতের আরেক সভ্যতা, নাম উয়ারী-বটেশ্বর, Odd Bangla
এই লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন I যে দুই শিক্ষক বাবা ছেলে এই ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগনকে অবগত করেছিলেন (শ্রদ্ধেয় হানিফ পাঠান এবং হাবিবুল্লা পাঠান) বিস্তারিত জানবার জন্য তাঁদের সাথে আমরা ৫ জনের একটি ছাত্র দল সাক্ষাৎ করেছিলাম ১৯৭৪ সালে I তখনো কোন খনন কাজ হয়নি বলে আমরা অহম রাজার গড়, পরিখা, এবং উনাদের কিছু সংগ্রহ দেখতে পেয়েছিলাম I এসবের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিলো panch-mark coin, যেগুলো কুশান যুগের বলে মনে করা হয় I যে লেখাটার উল্লেখ উপরে করেছি, সেটা সবাই পড়ে দেখতে পারেন I google korlei পাবেন I
অনেক ধন্যবাদ নেবেন। লেখা জোগাড় করে নেব।
Panch mark নয়, punch mark হবে I
অনেক ধন্যবাদ।