আইনস্টাইন, LIGO ও একটি মহাজাগতিক বার্তা
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫, রাত তখন ১১.৫০; হ্যানোভারে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিঊট অব গ্র্যাভিটেশনাল ফিজিক্সের একটি ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা এক পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো মার্কো ড্রাগো একটা ইমেল পেলেন। তাঁর ব্যক্তিগত মেলবক্সে নয়। যে প্রজেক্টে তিনি গবেষণারত সেই প্রকল্পের নির্ধারিত মেলবক্সে। মেলটি অবশ্য কোনো মানুষের পাঠানো নয়। মাত্র মিনিট তিনেক আগে LIGO অবজারভেটরির কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়েছে মেলটি। কিন্তু কেন? আর এই LIGO অবজারভেটরিটাই বা কী? জানার জন্য মেলটা খুলতে হবে।
সেদিন মেলটা খোলার সময় যদিও মার্কো ২য় প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন না কারণ সে উত্তরটা তাঁর ভালোই জানা ছিল। বস্তুত অতলান্তিকের অপর পারে অবস্থিত LIGO অবজারভেটরি থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণের জন্য হ্যানোভারের এই গবেষণাগারে তিরিশজন বিজ্ঞানীর যে দলটি গঠিত হয়েছে তার অন্যতম সদস্য তিনি। এরকম মেল তাঁর পাওয়ার কথা— তিনি মেলটি খুললেন অতিরিক্ত কৌতূহল ছাড়াই।
মেলটিতে ছিল দুটি লিঙ্ক। তিনি দুটিতেই একে একে ক্লিক করলেন এবং দেখলেন দুটিতেই রয়েছে প্রায় একইরকম দেখতে সংকেতের লেখচিত্র। ঠিক যে ধরনের লেখচিত্র পক্ষীবিশারদরা ব্যবহার করেন পাখীদের কাকলি বা গান ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করতে। কিন্তু মার্কো জানতেন যে এ কোনো পাখীর গানের লেখচিত্র নয়।
এই সংকেত দুটির একটি এসেছে আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের হ্যানফোর্ড LIGO অবজারভেটরি থেকে, অন্যটির উৎস সে দেশেরই লুইসিয়ানা রাজ্যের লিভিংস্টোন LIGO অবজারভেটরি। দুটি স্টেশনের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ২০০০ কিলোমিটার। এদিকে দুটি সংকেতের মধ্যে সময়ের পার্থক্য মাত্র সাত মিলিসেকেণ্ড। মার্কো এও লক্ষ্য করলেন যে সংকেত দু’টির লেখচিত্র প্রায় একরকম।
প্রায় দুহাজার কিমি দূরবর্তী দুটি স্টেশনে প্রায় একইসঙ্গে, প্রায় একইরকমের দুটি সংকেত ধরা পড়ার অর্থ হতে পারে দুটি।
দুটি সংকেতের লেখচিত্র, Observation of Gravitational Waves from a Binary Black Hole Merger by Abbot B.P. et al in Phys. Rev. Lett. 2016,116, 061102. থেকে। (অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত)
হয় কেউ যন্ত্র দু’টির কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য কোনো কৃত্রিম সংকেত যন্ত্রে দিয়েছে বা বলা উচিৎ অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, অথবা এ সত্যিই সেই সংকেত যার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছে LIGO ডিটেক্টরগুলি; যার আশায় প্রায় একশ বছর ধরে উদগ্রীব অপেক্ষায় বিজ্ঞানীকুল— এ কি তবে সেই?
২য় সম্ভাবনার কথা ভেবে যদি সেদিন মার্কোর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠেও থাকে তবু তিনি যথাকর্তব্য ভুলে যাননি। প্রথা মেনে তিনি হ্যানোভারে নিজের সহকর্মী আরেক ফেলো অ্যান্ড্রু লুন্ডেরগেন-কে ফোন করলেন। LIGO যেহেতু তখনও ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডেভেলপমেন্ট স্তরে রয়েছে সুতরাং যান্ত্রিক উপায়ে কৃত্রিম সংকেত যন্ত্রে দেবার উপায় নেই। অতএব খুব সম্ভাবনা যে এটা আসল সংকেত। মার্কো নিজের সহকর্মী অ্যান্ড্রুকে ঘটনাটা জানিয়ে দেখতে বললেন যে কোনো ঝুটো সংকেত এগুলো হতে পারে কিনা!
অ্যান্ড্রু কোনো কৃত্রিমতার সন্ধান পেলেন না। এদিকে সংকেত দু’টো এতই স্পষ্ট যে ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ সরানোর জন্য কোনো ফিল্টারও ব্যবহার করতে হচ্ছে না, সুতরাং এগুলো কৃত্রিম সংকেত হতেই পারে না। তবুও মার্কো ও অ্যান্ড্রু ফোন করলেন লিভিংস্টোন ও হ্যানফোর্ডের কন্ট্রোলরুমে। আমেরিকার তখন সকাল, লিভিংস্টোন স্টেশন থেকে কেউ উত্তর দিলেন। কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক ঘটনার কথা জানা গেল না। অবশেষে সংকেতদুট পাওয়ার প্রায় এক ঘন্টা পরে মার্কো LIGO-র কর্ণধার ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারদের সকলকে মেল করে জানতে চাইলেন কোনো ঝুটো সংকেতের উৎপত্তি হতে পারে এমন কোনো ঘটনার কথা কেউ জানেন কিনা! কোনো উত্তর এলো না।
কয়েকদিন পরে LIGO-র কর্ণধাররা একটা অফিশিয়াল রিপোর্ট দিয়ে জানালেন যে, কোনো কৃত্রিম সংকেত যন্ত্রে অনুপ্রবেশ করানো হয়নি। অতএব এর একটাই অর্থ হতে পারে যা কয়েকমাস পরে ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬-তে একটা সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হলো। ঐ সংকেত কোনো ঝুটো বা কৃত্রিম সংকেত নয় বরং এক মহাজাগতিক বার্তা যা এসেছে সুদূর মহাকাশ থেকে। ১৩০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্ব পরিবারের দুই বিশালাকার সদস্য নিজেদের মিলন সংবাদ প্রেরণ করেছিল মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। সেই বার্তাই আজ এসে কড়া নেড়েছে LIGO ডিটেক্টরের সেন্সরে। তার আগমনবার্তা বিজ্ঞানীদের কাছে প্রমাণ দিয়েছে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এক তত্ত্বের, প্রায় একশ বছর আগে যিনি অনুমান করেছিলেন এই বার্তাবাহক সংকেতটির উপস্থিতি, তিনি ভুল করেননি।
কিন্তু দাঁড়ান, ১৩০ কোটি বছর আগে পাঠানো বার্তা আর ১০০ বছর আগে তার আগমন প্রত্যাশা জাতীয় কথাগুলোকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প মনে করে নিবন্ধ পড়া বন্ধ করার আগে গোড়া থেকে একটু জেনে নেওয়া যাক সেইসব ঘটনাবলী যার অন্তিম ফলশ্রুতি আজকের এই ঘটনা।
১৯০৫ সালের ৫ই জুলাই ফ্রেঞ্চ আকাদেমী অব সায়েন্স এর জার্নাল ‘Comptes Rendus’-এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যার লেখক ছিলেন অঁরি পয়ঁক্যারে। সেখানে পঁয়ক্যারে প্রথম প্রস্তাব দেন যে মহাকর্ষ তরঙ্গের আকারে বা রূপে প্রবাহিত হয়। [Henri, P. “Sur la Dynamique de l’electron” Comptes Rendus de l’Academie des Sciences. 1905, 140, 1504–1508] এই তরঙ্গের তিনি নাম দেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা Gravitational wave। কিন্তু সেসময় কেউ এই প্রস্তাবে তেমন আমল দেননি।
প্রায় বছর দশেক বাদে ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন যখন নিজের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাধারণ রূপ দান করেন তখন তিনি এই তত্ত্বের মাধ্যমে মহাকর্ষের বিস্তারিত ব্যাখা করেন। এই তত্ত্বে নিউটনীয় তত্ত্বের মতো মহাকর্ষ দূর থেকে বিনা সংযোগে প্রভাববিস্তারকারী একটা বল নয়। বরং মহাকর্ষ এখানে স্থান-কালের বক্রতা, যেটি ভরের উপস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত এবং অবশ্যই কোনো বস্তুর শক্তি ও ভরবেগ দ্বারাও।
খুব সরল গাণিতিক রূপে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বটিকে লেখা যায়,
Gik = KTik যেখানে i, k = 0,1,2,3
এখানে i, k হলো মাত্রা যা প্রাথমিকভাবে চারটি হতে পারে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। বাঁদিকের G হলো, আইনস্টাইনের মেট্রিক টেনসর যা স্থান-কালের বক্রতাকে চিহ্নিত করে। ডানদিকের T হলো, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে উপস্থিত বস্তুর জন্য শক্তি ও ভরবেগের বন্টন সম্পর্কিত টেনসর। এটি হতে পারে একটি গ্যাসীয় স্রোত, একটা আলোকরশ্মি, বা যেকোনো কিছু যার ভরবেগ ও শক্তি আছে। K একটি ধ্রুবক যা নিউটনীয় মহাকর্ষ ধ্রুবকের সঙ্গে সমানুপাতি।
এই অসাধারণ অভেদটির সাহায্যে আইনস্টাইন স্থান-কালের জ্যামিতিকে (যা বহু বছর আগে পুরোপুরি গাণিতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বার্নার্ড রীম্যান বর্ণনা করেছিলেন) ভর ও শক্তির মতো বাস্তব রাশির সঙ্গে এক সুতোয় গেঁথে ফেললেন। যখন স্থান-কাল সমতল বা flat অর্থাৎ G অদৃশ্য তখন T ও শূন্য অর্থাৎ কোনো ভর বা শক্তি ঐ ক্ষেত্রে উপস্থিত নেই। মানে অভেদের বাঁদিক থেকে ডানদিকে বিচার করলে স্থান-কালের বক্রতা বস্তুকে প্রভাবিত করে। আবার যদি কোনো ক্ষেত্রে কোনো ভর বা শক্তি না থাকে অর্থাৎ T=0 হয় তাহলে G ও শূন্য অর্থাৎ স্থান-কাল সমতল। মানে অভেদের ডানদিক থেকে বাঁদিকে বিচার করলে বস্তু বা ভর স্থান-কালকে বক্রতা প্রদান করে।
সেই বিখ্যাত উক্তি, “Geometry tells matter how to move, and matter tells geometry how to bend.’’ (Misner C. W., Thorne, K. S., & Wheeler, J. A. Gravitation. San Francisco: W. H. Freeman, (1973).)
এভাবে মহাকর্ষকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখা করার পরেই আইনস্টাইন ঠিক পঁয়েক্যারের মতোই বলেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মতোই মহাকর্ষেরও তরঙ্গ আছে বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বলে একটা কিছু আছে। কিন্তু এর সৃষ্টি কীভাবে হতে পারে তা ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়লেন। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের মধ্যবর্তী কম্পনের (Oscillation of Dipole separation) কারণে যেভাবে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সেভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে আধানের সমতুল্য রাশি হলো ভর এবং ভর কেবল ধনাত্মক হতে পারে। ঋণাত্মক ভর বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই— বাস্তবেও নয়, গাণিতিক ভাবেও নয়।
ঋণাত্মক ভরের অনুপস্থিতি বা অসম্ভাব্যতার কারণে একদা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সমতুল্য রূপে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে প্রকাশ করার আশা আইনস্টাইন প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। ১৯১৬ সালে কার্ল সোয়ার্জচাইল্ডকে তিনি লিখেছেন,
“Since then [November 14] I have handled Newton’s case differently, of course, according to the final theory [the theory of General Relativity]. Thus, there are no gravitational waves analogous to light waves. This probably is also related to the one-sidedness of the sign of the scalar T, incidentally [this implies the nonexistence of a “gravitational dipole”
[Albert, E. The Collected Papers of Albert Einstein, Volume 8: The Berlin Years: Correspondence, 1914–1918 (English translation supplement, Translated by Ann M. Hentschel) Page 196]
“তারপর থেকে [নভেম্বর ১৪] আমি নিউটনের নজির ভিন্নভাবে মোকাবিলা করেছি, অবশ্যই, চূড়ান্ত তত্ত্ব [সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব] অনুসারে। সুতরাং, আলোক তরঙ্গের অনুরূপ কোনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নেই। এটি সম্ভবত স্কেলার T চিহ্নের সঙ্গে একতরফা ভাবে সম্পর্কিত, ঘটনাক্রমে এটি একটি ‘মহাকর্ষীয় ডাইপোল’ এর অস্তিত্বকে বোঝায়। [অনুবাদ সম্পাদকের]
এর পরেও আইনস্টাইন চেষ্টা ছাড়েননি— সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পূর্ণ করার পরে তিনি এর সমীকরণগুলি থেকে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বকীয় সমীকরণের সমতুল্য একটি সমীকরণ তৈরির প্রয়াস চালিয়ে যান। সাধারণ তত্ত্বের সমীকরণগুলির জটিলতার জন্য প্রচুর অনুমানের সাহায্য নিয়েও প্রথমে তিনি সফল হননি; পরে এক বন্ধুর পরামর্শে কোঅর্ডিনেট সিস্টেমটা পরিবর্তন করে তিনি সমীকরনের সমাধান পেলেন যা তিন ধরনের মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উপস্থিতির ঈঙ্গিত দেয়। হারমান ওয়েইল এগুলোর নাম দেন, অনুদৈর্ঘ্য— অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal-Longitudinal wave), তির্যক-অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Transverse-Longitudinal wave), এবং তির্যক-তির্যক তরঙ্গ (Transverse-Transverse wave) Hermann, W. Space, Time, Matter. Methuen & Co. Ltd. London 1922. Chapter 4 p. 376 Translated from German by Henry l. Brose]
কিন্তু কোঅর্ডিনেট সিস্টেম পরিবর্তন করে এ’ধরনের সমাধান বের করার পদ্ধতি বিজ্ঞানীমহলে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে, এমনকি আইনস্টাইন নিজেও সন্দিহান ছিলেন। শিগগিরই (১৯২২ সালেই) আর্থার এডিংটন একটি গবেষণাপত্রে আইনস্টাইনের ভুলটা ধরিয়ে দেন। [Stanley, E.A. The propagation of Gravitational waves. Proc. R. Soc. Lond. 1922, 102, 268–282.]
তিনি দেখান, প্রথম দুটো তরঙ্গের বেগ যা খুশি হতে পারে এবং সেই বেগ কোঅর্ডিনেট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং এ দুটো আদতে ঝুটো তরঙ্গ। এ দুটো আদতে সাধারণ সমতল স্থান-কাল যাকে একটি তরঙ্গায়িত কোঅর্ডিনেট সিস্টেমের মাধ্যমে তরঙ্গ আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। মজার ব্যাপার এডিংটন কিন্তু ঐ একই পেপারে দেখিয়েছিলেন যে তৃতীয় ধরনের তরঙ্গটি সব কোঅর্ডিনেট সিস্টেমে আলোর বেগে ভ্রমণ করে সুতরাং এর বাস্তব অস্তিত্ব অসম্ভব নয়, বস্তুত এডিংটনের পেপারে এর অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাই হয়নি। তবুও বিজ্ঞানীরা এবং এমনকি খোদ আইনস্টাইন পর্যন্ত এর অস্তিত্ব বিষয়ে সন্দিহান হয়ে রইলেন।
আইনস্টাইন
আর্থার এডিংটন
এরপর বেশ কিছু বছর এ নিয়ে আর কোনো কাজ হয়নি। ইতিমধ্যে ১৯৩৩ সালে আইনস্টাইন পাকাপাকিভাবে আমেরিকায় চলে এলেন। তারপরে ১৯৩৬ সালে তিনি নিজের ছাত্র নাথান রোজেনের সঙ্গে যৌথভাবে একটি পেপার লিখলেন “Are there any gravitational waves?” নামে যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বলে কিছু নেই। সেটি পাঠানো হয়েছিল ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে ছাপানোর জন্য, কিন্তু সেটি সেখানে ছাপা হয়নি। কেন হয়নি সেটা বেশ বড়সড় একটা গল্প। এখানে স্থানাভাবে আমরা তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া থেকে বিরত রইলাম।
এক দীর্ঘ নাটকীয় ঘটনাবলীর শেষে আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন যে, তিনি ভুল করেছেন এবং ঐ পেপারটিই Journal of Franklin Society-তে ছাপতে দেবার আগে অন্য এক ছাত্র লিওপোল্ড ইনফেল্ডের সাহায্যে (কারণ রোজেন তখন রাশিয়া চলে গেছেন) সেটির অনেকটা অংশ নতুন করে লিখলেন। ফলস্বরূপ মূল পেপারের সিদ্ধান্তই বদলে গেল। সংশোধিত পেপারটির শেষে আইনস্টাইন একটি ব্যাখামূলক নোট বা কৈফিয়ত লিখলেন,
“Note— The second part of this article was considerably altered by me after the departure to Russia of Mr. Rosen as we had misinterpreted the results of our formula. I want to thank my colleague Professor Robertson for their friendly help in clarifying the original error. I also thank Mr. Hoffmann your kind assistance in translation.”
[Albert, E.; Rosen, N. On gravitational waves. J. Frank. Inst. 1937, 223, 43–54]
“দ্রষ্টব্য— মিঃ রোজেন-এর রাশিয়া চলে যাওয়ার পরে এই নিবন্ধের দ্বিতীয় অংশটি আমার দ্বারা যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছিল কারণ আমরা আমাদের সূত্রের ফলাফলের ভুল ব্যাখ্যা করেছিলাম। আমি আমার সহকর্মী প্রফেসর রবার্টসনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সাহায্যের ফলে মূল ত্রুটিটি পরিষ্কার করার জন্য। অনুবাদে আপনার সদয় সহায়তার জন্য আমি মিঃ হফম্যানকে ধন্যবাদ জানাই।” [অনুবাদ সম্পাদকের]
এ ঘটনার পরে যদিও আইনস্টাইন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের (তির্যক-তির্যক তরঙ্গ) অস্তিত্ব বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে গেলেন কিন্তু তখনও অনেকেই সন্দিগ্ধ ছিলেন। খোদ রোজেন মনে করতেন এ তরঙ্গ কেবল গাণিতিক সত্য কিন্তু এর বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
এবারে তাহলে প্রশ্ন কী করে বোঝা যাবে যে এ তরঙ্গের বাস্তব অস্তিত্ব আছে কী নেই? একমাত্র উপায় যদি কোনো যন্ত্রে বা পরীক্ষায় এর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। কিন্তু সেটা খুব কঠিন— প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, অন্তত তখনকার প্রযুক্তি সাপেক্ষে। কেন? কারণ, তরঙ্গ বহন করে কোনো ক্ষেত্রের শক্তি, যেমন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বহন করে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি। সুতরাং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বহন করবে মহাকর্ষীয় শক্তি। কিন্তু গণিত বলছে, এ তরঙ্গ যদি থাকেও তাহলেও এর শক্তি খুবই কম। এতই কম যে তা কোনো পরীক্ষায় ধরার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। এর শক্তি কতটা কম? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক।
১৯৪৫ সালে অ্যালামগার্ডো মরুভূমিতে যে প্রথম পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ হয়েছিল তার থেকে উৎপন্ন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের (দৃশ্যমান আলোর কথাই শুধু ভাবলে) শক্তি এতই তীব্র ছিল যে দশ মাইল দূরের পর্যবেক্ষকদেরও চোখে বিশেষ চশমা পরে চোখ বন্ধ করে থাকতে হয়েছিল। সে তুলনায় কেমন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে ঐ বিস্ফোরণে? গণিত অনুসারে বিস্ফোরণ মুহূর্তে যদি সেই বোমার ঠিক নীচেও কেউ দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে উৎপন্ন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তার শরীরকে একটা পরমাণুর দৈর্ঘ্যের লক্ষভাগের একভাগ হয়তো প্রসারিত করতো।
অবশ্যই বোমা ফাটিয়ে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খোঁজার কথা কেউ ভাবেননি। কিন্তু মহাজাগতিক ঘটনাবলীর ফলে উৎপন্ন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার কথা ভাবা হয়েছিল। মুশকিল হলো, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি এতই কম যে সূর্যের মতো বিপুল ভরের মহাকর্ষীয় তরঙ্গও যন্ত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। একমাত্র কোনো বৃহৎ ভরের নক্ষত্র যদি নোভা বা সুপারনোভা হয়ে ফেটে পড়ে তবে তেমন বিস্ফোরণ (কোটি কোটি পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের সমতুল্য) থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হয়তো যন্ত্রে ধরা পড়তে পারে। একমাত্র মহাকাশ থেকেই আসতে পারে তেমন বার্তা। সুতরাং পৃথিবীবাসীকে প্রস্তুত হতে হবে তেমন বার্তা গ্রহণের জন্য। কিন্তু কেমন হবে সে বার্তাগ্রাহক যন্ত্র? সাধারণ টেলিস্কোপ বা রেডিও অ্যান্টেনা যাতে মহাকাশ থেকে ভেসে আসা দৃশ্য ও অদৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বার্তা গৃহীত হয় তেমন যন্ত্র এক্ষেত্রে অচল! তাহলে?
আইনস্টাইনের জীবৎকালে তেমন যন্ত্র তৈরির ব্যাপারে তেমন কোনো পরিকল্পনা হয়নি। ১৯৫৭ সালে চ্যাপেল হিল কনফারেন্সে বিজ্ঞানী ফাইনম্যান প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ কীভাবে করা যেতে পারে সে ব্যাপারে একটা ধারণা দেন। বিজ্ঞানী জোসেফ ওয়েবার শিগগিরিই সে ধারণাকে কার্যকরী প্রযুক্তিতে রূপান্তরের ব্যবস্থা করেন। ১৯৬০ সালে তেমন যন্ত্রের কারিগরী খুঁটিনাটি বিষয়ে একটি পেপারলেখার পাশাপাশি তিনি যন্ত্র বানাতেও শুরু করেন। ১৯৬৯ সাল নাগাদ তিনি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছেন এমন দাবীও করেন ।
[Weber, J. Detection and Generation of Gravitational Waves. Phys. Rev. 1960, 117, 306–313]
[Weber, J. Evidence for Discovery of Gravitational Radiation. Phys. Rev. Lett. 1969, 22, 1320–1324]
এরপরে তিনি এমন অনেক সংকেত পেয়েছেন বলেও জানালেন যেগুলির উৎস আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থল। [Weber, J. Anisotropy and Polarization in the Gravitational-Radiation Experiments. Phys. Rev. Lett. 1970, 25, 180–184]
দুঃখের বিষয় পরবর্তীকালে দেখা গেল, তাঁর প্রায় সব পর্যবেক্ষণই সন্দেহজনক এবং অতি উৎসাহের ফলে হওয়া ভুল।
ওয়েবারের উৎসাহ ও বৈজ্ঞানিক সততা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও এধরনের ব্যর্থতার ফলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব বিষয়ে লোকের মনে সন্দেহ জেগে উঠছিল এবং গবেষণায় উৎসাহ স্তিমিত হয়ে আসছিল। ঠিক এসময় ১৯৭৪ সালে রাসেল হালস এবং জোসেফ টেলর এমন একটা আবিষ্কার করলেন যে সকলের উৎসাহ আবার ফিরে এল।
(মূল গবেষণাপত্রটি যদিও ১৯৭৯ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, Taylor, J.H.; Fowler, L.A.; McCulloch, P.M. Overall measurements of relativistic effects in the binary pulsar PSR 1913 + 16. Nature 1979, 277, 437–440),
কেমন সে আবিষ্কার? তাঁরা দুজনে একটি বাইনারি পালসার (অর্থাৎ ঘূর্ণনরত নিউট্রন তারকা, যে তারকার অভ্যন্তরের সমস্ত পরমাণু মহাকর্ষের প্রভাবে নিউট্রন কণায় পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ তাদের শরীর পরমাণুর পরিবর্তে কেবল নিউট্রন দ্বারা গঠিত। এদের আলো নেই কিন্তু তীব্র চৌম্বকক্ষেত্র আছে। সেই চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে এরা রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করে এবং রেডিও অ্যান্টেনায় এদের অস্তিত্ব ধরা পড়ে) পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বাইনারি পালসার অর্থে দুটি নিউট্রন তারকা একে অপরের চারদিকে ঘুরছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলে এমন অবস্থায় এরা প্রচুর মহাকর্ষীয় শক্তি তরঙ্গাকারে বিকিরণ করবে। এই বিকিরিত শক্তি সরাসরি ধরা না গেলেও গাণিতিক উপায়ে বের করা যায় এর ফলে তারকাদুটির শক্তিক্ষয় কতটা হবে। এর ফলে তাদের পরস্পরের চারদিকে ঘূর্ণনকাল কমে আসবে বা সোজা কথায় তারা ধীরে ধীরে পরস্পরের নিকটবর্তী হবে। হালস ও টেলরের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেল সত্যিই তাই হচ্ছে। পর্যবেক্ষণের ফলাফল সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ঘোষিত ফলের সাথে নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে। (নিচের ছবি দেখুন)
ছবিতে ধনুকের মতো ওপর থেকে নিচের দিকে নুয়ে পড়া অবিচ্ছিন্ন রেখাটি হলো সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের গণনানুসারে অঙ্কিত আর ঐ রেখার ওপরে কালো বিন্দুগুলি হালস ও টেলরের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া ফল।
অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উপস্থিতির পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই আবিষ্কারের জন্য হালস ও টেলর ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন।
কিন্তু এখনো অবধি পাওয়া গেল শুধু পরোক্ষ প্রমাণ। তাহলে কি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কেবল গাণিতিক সম্ভাবনা আর পরোক্ষ প্রমাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এমন কোনো যন্ত্র বানানো কি সম্ভব যেখানে সত্যিই মহাজাগতিক বার্তারূপে ধরা পড়বে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ?
ফাইনম্যান কথিত ও ওয়েবার নির্মিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গ্রাহক অ্যান্টেনার প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর বা প্রায় সমসময়ে বিজ্ঞানীরা মন দিয়েছেন ডিটেক্টর ইন্টারফেরোমিটার নামক যন্ত্রের প্রতি। এই যন্ত্রের কর্মপদ্ধতি খুব সরল।
মুশকিল হলো স্থান-কালের কুঞ্চন এত কম যে যন্ত্রটি অত্যন্ত বড় না হলে অর্থাৎ পথদৈর্ঘ্যদুটি বিরাট না হলে স্থান-কালের এই কুঞ্চন ধরাই যাবে না। একদা পৃথিবীতে এত বড় ইন্টারফেরোমিটার বসানো প্রায় অসম্ভব ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্নরকম ইন্টারফেরোমিটার বিভিন্ন উপায়ে বসানো হয়েছে পৃথিবীতে; (GEO600, TAMA300 ও VIRGO-Very Improbable Radio Gravitational Observatory) এবং মহাকাশে (LISA- Laser Interferometer Space Antenna)। এদের বিস্তারিত ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি আরেকটি পূর্ণ নিবন্ধের দাবীদার বলে আমরা আপাতত সংক্ষেপে কেবল LIGO বা Laser Interferometer Gravitational wave Observatory প্রকল্প নিয়েই আলোচনা করবো।
এর সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে যখন পদার্থবিদ রেইনার ওয়েইস ও কিপ থর্ন ওয়াশিংটনে মিলিত হন মহাকাশবিদ্যা ও আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিষয়ে নাসার একটি সেমিনারে। সেখানেই দুজনে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বিষয়ে আলোচনার উপান্তে এ নিয়ে আরো গবেষণার কথা ভাবেন। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গ্রাহক সুবেদী ইন্টারফেরোমিটার যন্ত্র বানানোর জন্য তাঁদের প্রয়োজন ছিল একজন পরীক্ষণ বিশারদ পদার্থবিদ।
প্রথমে এ কাজের জন্য তাঁরা রাশিয়ান পদার্থবিদ ভ্লাদিমির ব্রাজিন্সকির কথা ভাবেন, কিন্তু সে’সময় আমেরিকা-রাশিয়া ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ কারণে তাঁকে পাওয়া গেল না। তখন তাঁরা গেলেন আরেক প্রখ্যাত পদার্থবিদ রোনাল্ড ড্রেভারের কাছে যিনি ইতিমধ্যেই সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ওপরে পরীক্ষামূলক গবেষণা “হিউজেস-ড্রেভার পরীক্ষা”-র জন্য বিজ্ঞানীমহলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
১৯৭৮ সালে থর্ন ড্রেভারকে ক্যালটেক-এ (California Institute of Technology) একটা কাজের অফার দিলেন এবং ১৯৮৩ সাল নাগাদ ড্রেভার ক্যালটেক-এ সর্বক্ষণের জন্য যুক্ত হলেন। সেখানে চল্লিশ মিটার বাহু দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি ইন্টারফেরোমিটার বানানো হলো কিন্তু প্রত্যাশিত সাফল্য এল না। যন্ত্রটিতে নয়েজ বা অন্যান্য গোলযোগ বেশি ধরা পড়ছিল। ড্রেভার যন্ত্রটিকে ত্রুটিহীন করার প্রয়াস চালিয়ে গেলেও অন্যদিকে ওয়েইস Massachusetts Institute of Technology-তে নিজের মতো একটি ইন্টারফেরোমিটার বানাতে চেষ্টা করছিলেন।
ইন্টারফেরোমিটারের বাহুর দৈর্ঘ্য বাড়ানোর বদলে তাঁরা আলোটিকে একজোড়া আয়নার মধ্যে বারংবার প্রতিফলিত করিয়ে পথদৈর্ঘ্যটা বাড়ানোর উপায় আবিষ্কার করলেন। ইতিমধ্যে ওয়েইসের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন বা NSF এই প্রকল্পের খরচ জোগাতে রাজী হলো। ১৯৮৩ সালে ক্যালটেক-এমআইটি যৌথ উদ্যোগে কাজও শুরু করলো। এই সময়েই প্রকল্পটির বর্তমান নামLIGO রাখা হলো। কিন্তু এসবের পরেও গবেষকদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের অভাবে প্রকল্পের কাজ থমকে রইল প্রায় ১৯৯২ অবধি। সেই বছর ড্রেভার হতাশ হয়ে প্রকল্প ত্যাগ করলেন।
১৯৯৪ সালে NSF উচ্চশক্তি পদার্থবিদ্যা নিয়ে কর্মরত ব্যারি ব্যারিশকে প্রকল্পের ডিরেক্টর রূপে নিয়োগ করলো। তিনি এ ধরনের বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব ও উদ্যোগে প্রকল্পটি নতুন গতি ও অর্থসাহায্য পেল।
ব্যারিশ LIGO প্রকল্পটিকে একটি ক্রমবিবর্তিত গবেষণাগারের আকারে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা করলেন। প্রাথমিক ধাপ বা initial LIGO (iLIGO) ছিল সমগ্র ধারণাটির পরীক্ষা ও মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরতে পারার সম্ভাব্যতা বিষয়ক কাজ। পরবর্তী ধাপে advanced LIGO (aLIGO) তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরতে পারার ব্যাপারে সবাই আশাবাদী ছিলেন। কারণ ওয়েইস ও ড্রেভারের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসরণ করে যন্ত্রটির আলোকপথের দৈর্ঘ্য প্রায় চার কিলোমিটার করে ফেলা সম্ভব হলো এবং সুবেদিতা বা sensitivity বহুগুণ বাড়ানো গেল।
১৯৯৪ ও ‘৯৫ সালে হ্যানফোর্ড এবং লিভিংস্টোনে দুটি যন্ত্রসহ গবেষণাগার বা পর্যবেক্ষণাগার বানানো শুরু হলো যা ১৯৯৭ সালে সম্পূর্ণ হলো। LIGO বা initial-LIGO স্তরের কাজ চললো ২০০২ থেকে ২০১০ অবধি, এরপর শুরু হলো advanced LIGO-র কাজ। এই পর্যায়ে দুটি পর্যবেক্ষণাগারের যন্ত্রেই সংকেত ধরা, নয়েজ বা বহিঃস্থ গোলযোগ অপসারণ, সুস্থিতি এবং সুবেদীতা ইত্যাদি বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু হলো।
পাঁচ বছর পরে ২০১৫-র ফেব্রুয়ারি থেকে LIGO পরীক্ষামূলক স্তরে কাজ শুরু করলো। সেপ্টেম্বরের মাঝের দিকে LIGO বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করলো তবে তখনও পরীক্ষামূলকভাবেই— কিন্তু আশ্চর্যভাবে তার কয়েকদিনের মধ্যেই সে পেল সেই মহাজাগতিক বার্তা যার কথা প্রথমেই বলেছি।
এ এক অদ্ভুত সমাপতন! বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর হয়নি যেখানে এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বহুবছর ধরে নির্মিত একটি যন্ত্র কাজ শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করলো। কিন্তু বার্তাটি কী ছিল? এটি যে একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ, তা আশা করি এতক্ষণে সকলে বুঝে গেছেন। কিন্তু কোথা থেকে এল এই তরঙ্গ? কোথায় এর উৎপত্তি?
১১ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ যেদিন বিজ্ঞানীরা সাংবাদিক সম্মেলন করে এ খবর বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছেন সেদিনই ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত পবেষণাপত্র “Observation of Gravitational Waves from a Binary Black Hole Merger”–এ সবিস্তারে জানানো হলো বৈজ্ঞানিক খুঁটিনাটি।
প্রায় একশ তিরিশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুটি কৃষ্ণগহবর পরস্পরের চারদিকে সর্পিলগতিতে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে পরস্পরের সঙ্গে মিলে গিয়ে সৃষ্টি করে একটি বৃহত্তর কৃষ্ণগহবর। আমাদের সূর্যের ভরের ৩৬ গুণ ও ২৯ গুণ ভারী সেই দুটি কৃষ্ণগহবরের মিলন মুহূর্তে যে বিপুল মহাকর্ষীয় শক্তি স্থান-কালের মসৃণ গাত্রে সৃষ্টি করেছিল ভয়াবহ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। সেই তরঙ্গই ১৩০ কোটি বছর ধরে আলোর বেগে মহাকাশে ভ্রমণ ও ক্রমাগত শক্তিক্ষয়ের উপান্তে অবশেষে তার অন্তিম চিহ্নটুকু রেখে গেছে LIGO ডিটেক্টরের সেন্সরে।
একবার কল্পনা করুন ১৩০ কোটি বছর আগে যখন এ তরঙ্গের যাত্রা শুরু হয়েছিল তখনও পৃথিবীতে বহুকোষী জীবের আবির্ভাব হয়নি। প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে যখন সে আমাদের ছায়াপথের সীমায় প্রবেশ করছে সেসময় হয়তো আধুনিক মানুষ অর্থাৎ এই আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবে আফ্রিকা ছেড়ে বেরোচ্ছেন। আর প্রায় একশ বছর আগে যখন সেই অসামান্য প্রজ্ঞাবান মানুষটি গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন এ’ধরনের তরঙ্গের অস্তিত্ব তখন হয়তো এ’তরঙ্গ পার করছে হেউডস নক্ষত্রপুঞ্জের সীমানা! কেউ কি তখন ভেবেছিলেন যে ঐ গণিতের যথার্থতার প্রমাণ রয়েছে একশ আলোকবর্ষ দূরত্বে?
মহাবিশ্বকে চেনা ও জানার এক নতুন দ্বার খুলে দেবার পুরষ্কার স্বরূপ ২০১৭ সালে ব্যারি ব্যারিশ, কিপ থর্ন ও রেইনার ওয়েইসকে নোবেল সম্মানে ভূষিত করা হলো। এতদিন অবধি মহাবিশ্বকে জানার জন্য বিজ্ঞানীদের একমাত্র অবলম্বন ছিল মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসা দৃশ্য ও অদৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। এবার তাঁদের হাতে এসে গেল এক নতুন উপায়। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সন্ধান ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এখন উন্মোচিত হবে মহাবিশ্বের নতুন রহস্য, পদার্থবিদ্যার নতুন দিগন্ত। কালে কালে সে যাত্রায় আদতে সামিল হবে সমগ্র মানবসভ্যতা।
শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: হ্যানফোর্ড ও লিভিংস্টোন এর LIGO গবেষণাগার দুটির ফটো।
তথ্যসূত্র
অধিকাংশই লেখার মধ্যেই প্রদত্ত। সাধারণ বিবরণী ও অতিরিক্ত তথ্যের জন্য দেখুন,
1) Harry Collins, ‘Gravity’s Kiss: The Detection Of Gravitational Waves, The MIT press (2017)
2) Harry Collins, ‘Gravity’s Shadow: The Search For Gravitational Wave’, The University of Chikago Press (2022)
3) Govert Schilling, Ripples in Space Time: Einstein, Gravitational wave and Future of Astronomy,’ Harvard University Press (2017)
4) Michele Maggiore, Gravitational Waves Vol -1 & 2, Oxford University Press (2008 & 2018)
5) S. Rowan and J. Hough, ‘The Detection of Gravitational Wave’
দারুণ রোমাঞ্চকর এবং তথ্যবহুল।