সম্পাদকীয়
তাহাদের কথা
সেটা ১৮১৭ সালের কথা। স্কটল্যান্ডে বসে বসেই জেমস মিল লিখে ফেললেন তাঁর নিজের ভাবনার রসে জারিত তিন খণ্ডে ভারতের ইতিহাস ‘দ্য হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’। মুখবন্ধে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি ভারতে কখনও আসেন নি, ভারতের কোনও ভাষা সম্পর্কে তাঁর প্রাথমিক জ্ঞান নেই এবং তাঁর মতে ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য এসব অপরিহার্যও নয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এহেন লেখকের ভারতের ইতিহাসের ত্রিযুগী বিভাগের ভাবনার প্রভাব থেকে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। সেই কারণেই আজ যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর অমৃত মহোত্সবের আয়োজন চলছে, তখন বোধ হয় আরও বেশি করে ভাবনার প্রয়োজন আছে, কাদের ইতিহাস আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যাঁরা স্বাধীনতার অমৃতের স্বাদ পেয়ে ধন্য হলেন, না স্বাধীনতার ঊষাকালের মহামন্থন থেকে উঠে আসা হলাহল পান করে যাঁরা আজও নীলকণ্ঠ।
মহাকালের রথের চাকা যখন অন্ধবেগে ছুটে চলে, তখন সেই রথচক্রে পিষ্ট মানুষদের রক্তাক্ত ইতিহাস একদিন হারিয়ে যায়, সর্বসমক্ষে রয়ে যায় শুধু রথের আরোহীদের সুন্দরকাণ্ড। ভারতের স্বাধীনতার আগে আর পরে সেই মানুষদের সংগ্রামের কথা আমরা শোনাচ্ছি ‘ইতিহাস আড্ডা’র এই আন্তর্জালিক মঞ্চে ‘স্বাধীনতার ৭৫’ শীর্ষকের নিচে, শুনিয়ে যাব এক বছর ধরে। আমরা নিশ্চিত, কালের রথের রশি টানার হাতগুলো একদিন বদলে যাবে, আর সেই আগামী দিনের প্রত্যাশায় নথিবদ্ধ করে চলেছি ‘তাহাদের কথা’।
ইতিহাস তো আজকের চোখ দিয়ে অতীতকে দেখা, তাই সেই দেখার চোখ যখন বদলায়, ইতিহাস ভাবনাও বদলে যায়। ছোট ছোট ফাটল বড় হয়ে দেখা দেয়, বড় বড় সাঁকো যায় হারিয়ে। ‘ইতিহাস আড্ডা’র মঞ্চে আমরা দেখার আদলটাকে ভাঙ্গতেও চাই, আবার ভেঙে নতুন করে গড়তেও চাই। আজকের মতো কালকেও এই পোর্টালে সেই ভাঙা-গড়ার খেলা হবে অক্ষরের সমাবেশে। যাঁরা ভাবছেন ইতিহাসকে পাল্টিয়ে দিয়ে, নিজেদের মতো করে ঘর সাজিয়ে গুছিয়ে নেবেন, তাঁদের সেই খেলার জবাব হবে আমাদের এই খেলা।
লাল জামা গায়ে রাজার বদলে নীল জামা গায়ে রাজা এসে যখন সিংহাসনে বসে, তখন পাঠ্য পুস্তকের পাতা যায় বদলে, কাঁচা মনের গলাধঃকরণের জন্য লেখা হয় নতুন কাহিনি আর অন্ধকারের আড়ালে ঢাকা থেকে যায় সাম্রাজ্যের বাকি ইতিহাস। ‘ইতিহাস আড্ডা’য় আমাদের যাত্রা সেই না বলা ইতিহাসের সন্ধানে। আসুন, আমরা সবাই মিলে খুঁজে আনি স্বাধীনতার সংগ্রামের সেই নামহারা মানুষদের কান্নাহাসির হারিয়ে যাওয়া অ্যালবামগুলো।
‘ইতিহাস আড্ডা’র আত্মজনদের সবার আসন্ন শারদ উত্সবের দিনগুলি আনন্দময় হয়ে উঠুক, এই কামনার সঙ্গে এবারকার মতো সমাপ্ত হোক কীবোর্ডের নড়াচড়ার পালা।