সম্পাদকীয়
স্বপ্ন আর সংগ্রাম ছুঁয়ে থাক ইতিহাসচর্চাকে
নভেম্বর মাস বিপ্লবের মাস। ১৯১৭ র পর থেকে যখন রুশ ক্যালেন্ডারে বদল হল, তখন এগারো দিন এগিয়ে এসে অক্টোবর বিপ্লব নামে কথিত রুশ বিপ্লব নতুন নাম পরিচয় পেল। তার নাম হল নভেম্বর বিপ্লব।
নভেম্বর বিপ্লব এমন এক বিশ্বব্যাপী প্রেরণা ছিল, যে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে গড়ে উঠল কমিউনিস্ট পার্টি। কোথাও তারা সাফল্যের সঙ্গে অনেকটা এগিয়ে গেল, আবার কোথাও শাসক শ্রেণি তাকে রুখে দিতে পারল।
কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিকতার কথা বলেন। কিন্তু এই আন্তর্জাতিকতা দেশকালের বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। রুশ বিপ্লবের অনতি পরেই যেমন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানাল নতুন করে আবার প্রতিষ্ঠিত হল, যার প্রচলিত নাম হল কমিন্টার্ন, তেমনি এই কমিন্টার্নের রুশ/ ইউরো কেন্দ্রিকতা নিয়েও উঠল প্রশ্ন। অনেকে কমিন্টার্নের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিতে গিয়ে দেশের নিজস্ব বাস্তবতাকে বুঝতে ভুল করলেন। এরকম ই এক ভুল থেকে ভারতে ১৯৪২ এ কমিউনিস্টরা ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দূরে থাকলেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই এর সঙ্গে দেশের উপনিবেশ বিরোধী লড়াইকে মেলানোর ক্ষেত্রে বড়সড় ভুল থেকে গেল এবং তার বিরাট মূল্য দিতে হল।
আবার অন্যদিকে চিনে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত কমিন্টার্নের অনেক নির্দেশ মানলেন না। কৃষি ও কৃষক কে বিপ্লবের কেন্দ্রীয় অবস্থানে নিয়ে এসে মার্কসবাদ লেনিনবাদকে এশীয় তথা চিনের নিজস্ব বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন। এই সৃজনশীলতা ১৯৪৯ এর চিন বিপ্লবের মূল চাবিকাঠি ছিল।
আজ রুশ বিপ্লবের একশো পাঁচ বছর পরে তাকে ফিরে দেখতে গিয়ে তার বিপুল অর্জনগুলিকে যেমন আমাদের ফিরে দেখতে হয়, তেমনি এই প্রশ্নের মুখেও দাঁড়াতে হয় কেন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেল। এটা তো ঠিক সেটা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভাঙে নি। কোনও মিলিটারি ক্যু হয় নি। ভেতর থেকেই ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে। কোনও রক্তপাত ছাড়াই সোভিয়েত রাশিয়ার যবনিকা পতন হয়েছে। আর তার প্রধান কারণ হিসেবে থেকেছে গণতন্ত্রের প্রশ্নটি।
বিশ শতকী সমাজতন্ত্র পেরিয়ে একুশের সমস্ত সমাজতন্ত্র নির্মাণের স্বপ্নের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রশ্নটি তাই বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। পরিবেশের প্রশ্নটি এসে গেছে অতি বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে।
ইতিহাস তখনি সবচেয়ে সরব ও সংবেদনশীল ভাষায় কথা বলে যখন আমাদের রোজকার পথচলা, সংকট, সংগ্রাম ও স্বপ্নের সঙ্গে তা যুক্ত হয়ে যায়। এই অর্থেই ইতিহাস পাঠ ও রচনাকর্ম শুধু পেশাদার ইতিহাসবেত্তাদের কাজ নয়। জনগণের দায় ও দায়িত্ব। আমাদের ইতিহাসচর্চার নানামুখী প্রয়াস আমাদের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে ছুঁয়ে থাকুক।