সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বৈষ্ণব ধর্মের গোড়ার কথা

বৈষ্ণব ধর্মের গোড়ার কথা

সুদীপ্ত পাল

এপ্রিল ২৯, ২০২৩ ৭৮৮ 1

হিন্দু দেবমণ্ডলীতে সবচেয়ে পুরোনো পাথুরে প্রমাণ অর্থাৎ পাথরে খোদাই করা নাম আছে যাঁর, তিনি হলেন বাসুদেব অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ। হিন্দু ধর্মের প্রধান সাহিত্যগুলি (মহাভারত, গীতা এবং রামায়ণ) কৃষ্ণ ও বিষ্ণুকে ঘিরেই এবং লোকসাহিত্যেও কৃষ্ণের জনপ্রিয়তা অনস্বীকার্য, তাই বৈষ্ণব ধর্মকে হিন্দু ধর্মের মুখ্য ধারা বললে ভুল হয়না। বৈদিক ও বৌদ্ধ ধর্মের স্তর পেরিয়ে যখন ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্থান হচ্ছে সেই সময়টার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত বাসুদেব ও বিষ্ণুর উত্থান। এই যুগসন্ধিক্ষণকালকে বোঝার জন্য বিশেষ ভাবে সহায়ক হল বিভিন্ন বৈষ্ণব শিলালেখ, প্রস্তরচিত্র ও মুদ্রা।

রাজস্থানের চিতোরের নিকটস্থ ঘোসুণ্ডি ও নগরী এই দুটি গ্ৰামে পাওয়া যায় ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়া শিলালিপি – তিন ভাগে বিভক্ত অবস্থায়। এটি দ্বিতীয় থেকে প্রথম খ্রিস্টপূর্ব শতকের। এতে সংকর্ষণ (বলরাম), বাসুদেব দুজনেরই নাম আছে, আর নারায়ণবাটিকা কথাটিও আছে। “পূজাশিলাপ্রাকারো নারায়ণবাটিকা” কথাটা একটা নারায়ণ মন্দিরেরই ইঙ্গিত দেয়, যেখানে আধুনিক মন্দিরের মতো প্রাকার ছিল। পূজাশিলাপ্রাকার শব্দটিকে দুভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। এক হল, পূজার জন্য তৈরি শিলানির্মিত প্রাকার। আবার পূজাশিলাকে ঘিরে তৈরি প্রাকার- এভাবেও ভাবা যায়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রথম অর্থটা ধরেছেন, ভাণ্ডারকর এবং জে সি ঘোষ দ্বিতীয়টা। দ্বিতীয় অর্থটাকে ধরে এগোলে একটা বিষয়ে কৌতূহলের উদ্রেক হয়- কেমন হত এই পূজাশিলা?

এই মন্দিরের পূজাশিলা অবশিষ্ট নেই, কিন্তু কিছু অনুমান করা যায়। এখন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের বাইরে বটগাছের নীচে গোল করে অনেক শিলা রাখা থাকে। এক থেকে তিন ফুট উচ্চতার, যাতে ঈশ্বরের রূপ বা নাগ খোদিত থাকে। এরকম শিলা হওয়া সম্ভব। দুই-তিন শতাব্দী পরে রাজস্থানের নগর গ্ৰামে বা মথুরার নিকটবর্তী সোঙ্খে মহিষমর্দিনীর যে ফলকগুলি পাওয়া গেছে সেরকমও হতে পারে, যদিও এগুলো পাথর নয়, পোড়ামাটির তৈরি। আবার শিবলিঙ্গ, গয়ার বিষ্ণুপদশিলা, বা শালগ্ৰামশিলার মতো বিমূর্ত শিলাও হওয়া সম্ভব। জে সি ঘোষের মতে এটি শালগ্ৰামশিলা, তবে সেযুগে এর প্রচলন ছিল কিনা স্পষ্ট জানা নেই।

ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়া শিলালিপিতে আছে রাজা সর্বতাতের অশ্বমেধ যজ্ঞর কথা। লেখাটির প্রথম পংক্তিতে রাজার যে পরিচয় দেয়া হয়েছে সেখান থেকেই অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তথ্য পাওয়া যায়। লেখাটা থেকে অনুমান করা যায় তিনি পিতৃক্রমে গজ বা গাজায়ন গোত্রের এবং তাঁর মা পারাশর গোত্রের। তাঁকে গাজায়ন এবং পারাশরীপুত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। গজের সঙ্গে ষ্ণায়ন প্রত্যয় যোগ করে গাজায়ন, যেমন দক্ষ থেকে দাক্ষায়ণ। পরাশর থেকে পারাশরী। পিতৃপরিচয়ের সঙ্গে মাতৃপরিচয়ও লিখিত আছে সেটা লক্ষণীয়। সেটা সেযুগে ভালোই প্রচলিত ছিল, যেমন সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী। একাধিক রানির সন্তানদের আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার জন্য মাতৃপরিচয়কে নামের অঙ্গরূপে ব্যবহার করা হত।

ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা পুরো কবিতাটি এরকম ছিল:

“(ভাগ)বতেন গাজায়নেন পারাশরীপুত্রেন সর্বতাতেন অশ্বমেধযাজিনা।

ভগব(দ্)ভ্যাম্ সংকর্ষণ-বাসুদেবভ্যাম্ অনিহতাভ্যাম্ সর্বেশ্বরাভ্যাম্ পূজাশিলাপ্রাকারো নারায়ণবাটিকা।।”

[পাঠভেদে নারায়ণবাটক]

বন্ধনীর অংশগুলো অনুমিত। তিনটে আলাদা আলাদা শিলালেখ যোগ করে লেখাটিকে দাঁড় করানো হয়েছে। কবিতাটির বাংলা অনুবাদ- “অশ্বমেধযজ্ঞকারী ভাগবত গাজায়ন পারাশরীপুত্র সর্বতাত দ্বারা (নির্মিত হয়েছে) নারায়ণবাটিকা (নামক) পূজাশিলাপ্রাকার, ভগবান সংকর্ষণ-বাসুদেব এই দুই অনিহত সর্বেশ্বরদের জন্য।”

সেই যুগে বাসুদেবের উপাসকরা নিজেদেরকে ভাগবত বলত। বৈষ্ণবের থেকে ভাগবত নামটারই চল বেশি ছিল। বৈষ্ণব নামটা ভাগবতের তুলনায় অর্বাচীন। এখানে রাজা নিজেকে ভাগবত বলেছেন। প্রায় সমসাময়িক আরও দুটি শিলালেখতে আরও দুজন ভাগবতের নাম পাওয়া যায়- হেলিওডোরাস ভাগবত আর গৌতমীপুত্র ভাগবত। দুটিই বিদিশাতে। এই তিনটি উদাহরণ থেকে বোঝা যায় ভাগবত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের বর্ণ বা গোত্রভিত্তিক পদবির চেয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের নামকে পদবি হিসেবে লেখা পছন্দ করত। সর্বতাত এখানে গোত্র ও মাতৃপরিচয়ের আগে নিজের ভাগবত পরিচয়কে রেখেছেন। এই ধরনের সম্প্রদায়ভিত্তিক পদবির প্রমাণ এর চেয়ে পুরোনো আছে কিনা সন্দেহ। নামের সঙ্গে শৈব, বৌদ্ধ, জৈন এরকম কোনও সম্প্রদায়সূচক শব্দ আগে কখনও দেখা যায়নি। সম্রাট অশোক বা কলিঙ্গরাজ খারবেল কেউই তাঁদের শিলালেখগুলিতে নিজের নামের সঙ্গে বৌদ্ধ বা জৈন যোগ করেননি। বংশপরিচয়ের উর্ধ্বে সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে রাখার উদাহরণ এই প্রথম। অর্থাৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধারণার একটা সূত্রপাত আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি।

বিষ্ণু, নারায়ণ আর বাসুদেব অতীতে স্বতন্ত্র ছিলেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যক -১০/১১তে এদের প্রথম একীভূত হতে দেখা যায়। সেটা সাহিত্যপ্রমাণ। নারায়ণ আর বাসুদেবের একীকরণের প্রথম পাথুরে প্রমাণ মেলে এই ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়ার শিলালিপিতে। এই লিপির আরেকটা বড় তাৎপর্য হল- এটি সংস্কৃতে লেখা প্রাচীনতম শিলালিপি বলে ধারণা করা হয়। এর চেয়ে পুরোনো যা কিছু আছে, মূলত অশোকের শিলালেখ আর কিছু সাতবাহনদের, সেগুলো সবই প্রাকৃত।

উত্তর ও মধ্য ভারতে বাসুদেব ও ভাগবত ধর্মের উপস্থিতি আমরা দেখলাম। কিন্তু এই ধর্মের ব্যাপকতা বোঝার জন্য আমাদের যেতে হবে আরও দক্ষিণে সাতবাহনদের রাজ্যে ও আরও উত্তরে আফগানিস্তান।

গোদাবরী আর কৃষ্ণা। পশ্চিমঘাটে এদের শুরু, বঙ্গোপসাগরে এদের সমাপ্তি। এই দুটি নদীর উৎসমুখ থেকে মোহনা অবধি পুরো অঞ্চল জুড়ে একসময়ে রাজত্ব করেছিল সাতবাহন রাজবংশ, প্রায় চার শতাব্দী জুড়ে। সাতবাহন সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ছিল সোপারা, চাউল, কল্যাণ ও ভারুচের মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। আর দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে ছিল কৃষ্ণা গোদাবরীর বদ্বীপ যাকে দাক্ষিণাত্যের শস্যভাণ্ড বলা হয়। পুরো সাম্রাজ্য জুড়েই ছিল বাণিজ্যপথ। সাতবাহন বাণিজ্যিক রপ্তানির ক্রেতা ছিল রোমানরা। বৃহত্তর রোমান বাণিজ্যপথ যা শুরু হত দূর ভূমধ্যসাগর থেকে সেই পথের উপরেই ছিল সাতবাহন রাজ্যের বন্দরগুলো।

কৃষ্ণা-গোদাবরীর নিম্ন অববাহিকার সমতল অংশে পাওয়া গেছে অমরাবতী আর নাগার্জুনকোণ্ডার মত বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার, এদের উৎসমুখে ছিল‌ নানাঘাট গিরিবর্ত্মের উপর নানাঘাট বৈষ্ণব গুহা, যেটি এই বাণিজ্যপথের যাত্রীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল ছিল। আবার বাণিজ্যপথের একদম পশ্চিমে আরব সাগরের উপর আছে কানহেরি বৌদ্ধ গুহা আর সোপারার বৌদ্ধ বিহারের অবশেষ।

বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও সাতবাহনরা ব্রাহ্মণ্যধর্মী ছিলেন। নানাঘাট বা নানেঘাট গুহার শিলালেখগুলি তৈরি করিয়েছিলেন সাতবাহন রাজা সাতকর্ণীর বিধবা পত্নী নয়নিকা। সেখানেই আমরা বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীর প্রাচীনতম কিছু খোদিত নামোল্লেখের দেখা পাই- ধর্ম, ইন্দ্র, সংকর্ষণ, বাসুদেব, এবং চারজন লোকপাল যাদের নাম বলা হয়েছে- যম, বরুণ, কুবের, বাসব। চারজন লোকপাল চারটি দিকের প্রতিপালন করেন। সংকর্ষণ-বাসুদেবকে চন্দ্রসূত বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

নানাঘাট শিলালেখতে সেযুগের যজ্ঞের দান-দক্ষিণার পরিমাণ, বিধবা রানির ব্রহ্মচর্যপালন ও মাসব্যাপী উপবাসব্রতপালনের বিবরণ আছে। মুদ্রার একক হিসেবে কার্ষাপণ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাকৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বশতকের এই শিলালেখগুলি হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম পাথরে লেখা ও টিকে থাকা নথিগুলির একটি।

নানাঘাট ও ঘোসুণ্ডির চেয়ে পুরোনো বাসুদেবের লিখিত পাথুরে প্রমাণ নেই কেন? কারণ ভারতে শিলালিপির ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে অশোকের সময়ে, তাই তার আগে শিলালেখ পাওয়া মুশকিল। মুদ্রায় লিপির ব্যবহার আর দেবদেবীদের উপস্থিতি ইন্দো-গ্রিকদের আগে আসেনি।

আফগানিস্তানের উত্তরপ্রান্তে আমু দরিয়া আর কোকচা নদীর সঙ্গমে ২৩০০ বছর পুরোনো এক ইন্দো-গ্রিক নগরীর ধ্বংসাবশেষ- আই খানুম। তাজিকিস্তান সীমান্তের কাছেই এই গ্রাম। আমু দরিয়া বেয়ে শ’খানেক কিলোমিটার নেমে গেলে তারমিজের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ, কাছেই অনেকগুলো খনি। বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত না হলেও, আই খানুমের ভৌগোলিক অবস্থান ঈর্ষণীয়। সেই গ্রিক নগরীতে ছিল দুর্গ, ছিল টাঁকশাল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে শহরটা ছিল গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজা আগাথোক্লেসের অধীনে। তাঁর অনেকগুলি মুদ্রা এখানে পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে ছয়টি রৌপ্যমুদ্রা, এই মুদ্রাগুলিতে আছেন সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেব। মুখ্যপিঠে সঙ্কর্ষণ, তাঁর হাতে ডান হাতে গদা, বামহাতে লাঙল। গৌণপিঠে বাসুদেব, তাঁর ডানহাতে শঙ্খ, বামহাতে চক্র। আট স্পোকযুক্ত চাকা- অনেকটা বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের মত, অথবা গ্রিক দেবী সাইবেল ও নাইকের সিংহচালিত রথের চাকার মত। এই দেবী ও রথের একটি চিত্রণ ওই আই খানুমেই পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলি ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। সমসাময়িক শিলালিপিগুলিতে সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের নাম আমরা দেখেছি, তবে তাঁদের কোনও প্রতিকৃতি সেখানে পাওয়া যায়নি। তাই এই মুদ্রাগুলিই সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের সবচেয়ে পুরোনো বা দ্বিতীয় প্রাচীনতম প্রাপ্ত প্রতিকৃতি। অন্যটি হল গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী টিকলা গুহার দেয়ালচিত্র।

মুদ্রাগুলিতে সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেবের নাম নেই। মুদ্রাগুলির মুখ্যপিঠে গ্রিক হরফে লেখা রাজার নাম- আগাথোক্লেস, আর লেখা “বাসিলেউস” অর্থাৎ রাজা। গৌণ পিঠেও রাজার নাম ব্রাহ্মী লিপিতে। মুদ্রায় নাম লেখা নেই, তবে হাতের আয়ুধগুলো থেকে স্পষ্ট এরা সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেব।

চিত্র-১: আগাথোক্লেসের মুদ্রায় সঙ্কর্ষণ ও বাসুদেব

ইন্দো-গ্রিকদের বাসুদেব-ভক্তির উদাহরণ এটাই একমাত্র নয়। এর চেয়েও বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ নিদর্শন আছে বিদিশায়। পাঞ্জাবের তক্ষশিলার গ্রিক রাজা অ্যান্টিঅ্যালকিদাসের গ্রিক দূত ছিলেন হেলিওডোরাস। ১১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তিনি মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় একটি গরুড়স্তম্ভ নির্মাণ করেন যেটি হেলিওডোরাস পিলার নামে পরিচিত।

পুরোনো মন্দিরের সামনে সাধারণত একটা ধ্বজাস্তম্ভ বা দীপস্তম্ভ বা গরুড়স্তম্ভ থাকত। এই স্তম্ভের সামনে একটা মন্দির ছিল বলে অনুমেয়, ইঁটের বা কাঠের মন্দির- তাই এর অবশেষ আর নেই। এই খাম্বাটির স্থানীয় নাম খাম্বাবা। এই নামেই লোকে দীর্ঘদিন একে চিনত। ভাগবত হেলিওডোরাস এটি নির্মাণ করান বাসুদেবকে নিবেদন করে। এতে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা সংস্কৃত ঘেঁষা প্রাকৃতে বাসুদেবের বন্দনা করা হয়েছে।

প্রাকৃত লেখটির কিয়দংশ –

“দেবদেবস বাসুদেবস গরুড়ধ্বজ অয়মকরিতো ইঅ হেলিওদোরেন ভাগবতেনদিয়স পুত্রেন তক্ষশীলকেনযোনদতেন অগতেন মহারাজস…”

চিত্র-২: হেলিওডোরাস পিলার

যাদবদের বিভিন্ন কুলের একটি ছিল বৃষ্ণি। এই বৃষ্ণি কুলেই জন্মেছিলেন বাসুদেব, সংকর্ষণ সহ পাঁচ বীর। এদের একত্রে বলা হয় বৃষ্ণি পঞ্চবীর। বাকি তিনজন হলেন – প্রদ্যুম্ন (বাসুদেব ও রুক্মিণীর পুত্র), শাম্ব (বাসুদেব ও জাম্ববতীর পুত্র), অনিরুদ্ধ (প্রদ্যুম্নর পুত্র)। প্রথম শতাব্দীর শক মহাক্ষত্রপ রাজুবুলার দ্বারা লিখিত মোরা কূপের শিলালিপিতে দেখা যায় এদের উল্লেখ “ভগবতাম্ বৃষ্ণিনাম্ পঞ্চবীরানাম্ প্রতিমা শৈলদেবগৃহে”। এটি মথুরার নিকটস্থ। এখানে অবশ্য পাঁচজনের নাম নেই। লক্ষণীয় যে ঘোসুণ্ডি শিলালেখর মতো এখানেও একটি পাথরের মন্দিরের কথা আছে – “শৈলদেবগৃহ”। এখানে তাঁদের প্রতিমাও ছিল। আর কী ছিল এই মন্দিরে? “অর্চদেশম্ শৈলম্ পঞ্চম্” অর্থাৎ অর্চনা করার জন্য পাঁচ রকমের শিলানির্মিত বস্তু। এগুলি কিন্তু প্রতিমা নয়। সম্ভবতঃ ঘোসুণ্ডি শিলালেখতে বর্ণিত “পূজাশিলা”র মতো কোনো বস্তু। শালগ্ৰামশিলাও হতে পারে। পাঁচজন বৃষ্ণিবীরের জন্য পাঁচটি শিলা। ঘোসুণ্ডি আর মোরা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ এক করলে বোঝা যায় প্রতিমার পাশাপাশি শিলাও ব্যবহার করা হত বৃষ্ণিবীরেদের পূজায়। তখনও বৈষ্ণব ধর্ম নাম হয়নি, ভাগবতধর্ম বলেই পরিচিত। তবু ঐ শিলা-উপাসনার মধ্যে আধুনিক বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে একটা মিল পাওয়া যায়।

কারা ছিল এই বৃষ্ণিবীরেরা? মহাভারতের চরিত্র। তবে তাদের আরও গভীর ইতিহাস আছে – শতপথ ব্রাহ্মণ ৩.১.১.৪ এ “বার্ষ্ণ্য” দেবতাদের যজনের উল্লেখ আছে, অর্থাৎ বৃষ্ণি কুলের মানুষ বা দেবতাদের উপাসনা সেই সময় থেকেই হত। শতপথ ব্রাহ্মণ সপ্তম থেকে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীর রচনা। শতপথ ব্রাহ্মণেই ১.১.১.১০এ বর্কু বার্ষ্ণ বলে একটি চরিত্র দেখা যায়। বৃষ্ণির সঙ্গে অপত্যার্থে ষ্ণ, ষ্ণ্য এবং ষ্ণেয় প্রত্যয় যোগ করে বার্ষ্ণ, বার্ষ্ণ্য, বার্ষ্ণেয়। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, বৃহদারণ্যক উপনিষদ, জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণেও বৃষ্ণি জাতির উল্লেখ আছে। গীতায় দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণ সম্বোধিত হচ্ছেন বার্ষ্ণেয় নামে। বার্ষ্ণেয় মানে বৃষ্ণিকুলজাত (বৃষ্ণি + ষ্ণেয় প্রত্যয়)। এখনও উত্তর ভারতে আগ্ৰা-মথুরা অঞ্চলে অনেক বৈশ্য কাস্টের সাব-কাস্ট বা পদবি হয় বার্ষ্ণেয়। তবে তাদের সঙ্গে বৃষ্ণিকুলের যোগাযোগের কোনো প্রমাণ নেই।

মথুরাতেই আরেকটি কূপের মধ্যে আরেকটি শিলালিপি পাওয়া গেছে যাকে বসু শিলালিপি বলা হয়। এটিতে শক মহাক্ষত্রপ রাজুবুলার পুত্র সোদাসের নাম পাওয়া যায়। এটিও প্রথম শতাব্দীর। এটিতে “ভগবতো বাসুদেবো মহাস্থান শৈলম তোরণম বেদিকা” লেখা আছে। অর্থাৎ একটি বাসুদেবের মন্দির যেখানে পাথরের তোরণ ছিল। মোরা আর বসু শিলালিপি দুটি থেকে বোঝা যায় আজ থেকে দু হাজার বছর আগেও মথুরাতে বাসুদেবের একাধিক মন্দিরের উপস্থিতি ছিল। আরেকটা জিনিস বোঝা যায় যে ইন্দো গ্ৰিকদের মতো শকরাও বাসুদেবের পরম ভক্ত ছিল। বিভিন্ন বিদেশি জাতির মধ্যে ভাগবত ধর্মের এই জনপ্রিয়তা খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়। আবার এই জাতিগুলির মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মও জনপ্রিয় ছিল। কঙ্কালী টিলার শিলালেখ থেকে বোঝা যায় সোদাস জৈনধর্মকেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।

বাসুদেব ও বৃষ্ণিদের অনেকগুলো লেখ্য প্রমাণ আমরা পেলাম – ঘোসুণ্ডি-হাথিবাড়া, নানাঘাট, হেলিওডোরাস, মোরা, বসু। এবার আমরা মূর্তিরূপের খোঁজ করব। এদের সবচেয়ে পুরোনো প্রতিকৃতিগুলো দ্বিমাত্রিক। এই ব্যাপারে তিনটি ভালো উদাহরণ হল- এক, গোয়ালিয়রের কাছেই টিকলা গুহাচিত্র যেখানে বাসুদেব ও সংকর্ষণের পাশে একানংশাকেও দেখা যায়। একানংশাই পরবর্তীকালের সুভদ্রা। এটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতাব্দীর। দুজন পুরুষের হাতে চক্র, গদা আর লাঙল। একানংশার হাতে ছত্র। দুই, আফগানিস্তানের গ্ৰিক রাজা আগাথোক্লিসের মুদ্রা যা আগে আলোচিত- খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর। তিন, পাকিস্তানের গিলগিট বালতিস্তানের চিলাস প্রস্তরচিত্র। এটি প্রথম শতাব্দীর। এখানে বৌদ্ধ প্রস্তরচিত্রই বেশি। আগেরগুলোয় ছবির সঙ্গে নাম ছিল না, এটায় আছে – “রাম(কৃ)ষ(ণ)”। অর্থাৎ বলরাম ও কৃষ্ণ। বন্ধনীর অংশগুলো অনুমিত। কিভাবে বোঝা গেল এরা তারাই? একজনের হাতে গদা ও চক্র আছে।

বাসুদেবের হাতের চক্র রাজচক্রবর্তী রাজার প্রতীক, কিছুটা বৌদ্ধ ধর্মচক্রের সঙ্গে তুলনীয়। দুটোই আট স্পোকযুক্ত চাকা। সংকর্ষণের লাঙল কৃষি ও উর্বরতার প্রতীক। বৃষ্ণিবীরেরা শৌর্যের প্রতীক হিসেবে পূজিত হতেন। ঘোসুণ্ডির চক্রবর্তী রাজা, সাতবাহন সম্রাটপত্নী, আফগানিস্তানের গ্ৰিক রাজা, মথুরার শক মহাক্ষত্রপ- অনেকটাই বিস্তৃত ছিল বৃষ্ণিবীরদের উপাসকের তালিকা। তাজিকিস্তান সীমান্ত থেকে অন্ধ্র অবধি তাঁদের উপাসনা ব্যাপ্ত ছিল।

তথ্যসূত্র:

১. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, “ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট”, আনন্দ, ২০১৩, পৃ. ১৩০-১৩৩।

২. Burgess, “Report on The Elura Cave Temples and The Brahmanical and Jaina Caves in Western India”, pp. 59-63; “Epigraphia Indica”, Vol XXII, 1933-34, (1938), pp. 202-204.

৩. Vinay Gupta, “Vrishnis in Ancient Literature and Art”, 2019.

৪. হেলিওডোরাস পিলারের সামনের সাইনবোর্ড।

৫. শিলালেখগুলির উইকি পেজ।

মন্তব্য তালিকা - “বৈষ্ণব ধর্মের গোড়ার কথা”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।