দ্বারকা শিলা নিয়ে অনুসন্ধান
যত্র তিষ্ঠতি চক্রাঙ্কো দেবো দ্বারবতীভবঃ ।
তীর্থকোটি সহস্রাণি তত্র সন্নিহিতানি বৈ ।।
সম্বৎসরন্তু যৎ পাপং মনসা কর্মণাকৃতং ।
তৎসর্বং নশ্যতে পুংসাং সকৃচ্চক্রাঙ্ক দর্শনাৎ ।।
স্কন্দ পুরাণের এই শ্লকে বলা হয়েছে যে, “যে শিলায় দ্বারাবতীজাত চক্রচিহ্ন থাকে তা ‘দ্বারাবতী’ বা ‘দ্বারকাচক্র’ নামে খ্যাত। এই শিলা সহস্রকোটি তীর্থ সমন্বিত। দ্বারকাচক্রচিহ্নিত শিলা দর্শনে মানুষের সম্বৎসরকৃত মনোজাত ও কর্মজ পাপ নষ্ট হয়”। স্কন্দপুরাণ ছাড়াও ব্রহ্মপুরাণ ও গরুড়পুরাণেও দ্বারকা শিলার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে দ্বারাবতী বা দ্বারকা শিলাকে বিষ্ণুর প্রতিভু বা শিলারূপী বিষ্ণু বলে অভিহিত করা হয়েছে। মানুষের কাছে দ্বারকা শিলার পরিচিতি কম, বিষ্ণুরূপী শিলা হিসেবে সবাই শালগ্রাম শিলাকেই চেনেন। প্রকৃতপক্ষে, শালগ্রাম শিলার যেমন জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি রয়েছে দ্বারকা শিলার তা নেই আর সেই জন্য অনেকেই এই দুই শিলাকে একই শিলা বলে ভাবেন যদিও দুইটি শিলা সম্পূর্ণ ভাবে পৃথক হলেও একটি বিষয়ে দুইটি শিলার মিল রয়েছে তা হল উভয়েই জীবাশ্ম।
শালগ্রাম শিলা
আমরা জানি যে শালগ্রাম শিলা অ্যামোনাইট (Ammonite) এর জীবাশ্ম। অ্যামোনাইট মারা যাওয়ার পরে মৃত শরীর খোলক সমেত সমুদ্রের তলায় থিতিয়ে পড়ে। ক্রমশ পলি দিয়ে অ্যামোনাইটের খোলক ঢেকে যায়। এরপর শুরু হয় জীবাশ্ম হওয়ার পালা যার মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলে। অ্যামোনাইটের খোলক তৈরি হয়েছিল অ্যারাগোনাইট নামক একপ্রকার অস্থায়ী ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে। অস্থায়ী এই পদার্থ অনেক সময়ই জলে দ্রবীভূত হয়ে যায় বা গলে যায়। তখন চারপাশ থেকে খনিজ পদার্থ এই ফাঁকা জায়গায় ঢুকে পড়ে। অ্যামোনাইটের দেহ শক্ত হয়ে ওঠা পলির মধ্যে একটি ছাঁচ ছেড়ে রেখে যায় আর খনিজ ও পলি সেই ছাঁচের মধ্যে ঢুকে অবিকল মূল অ্যামোনাইটের দেহের মতো আকার নেয়।
অ্যামোনাইট
অনেক সময় অ্যামোনাইটের খোলকের ভেতরেও খনিজ ঢুকে যায় ও অ্যামোনাইটের দেহের মতোই আকার নিতে থাকে। সিলিকা (SiO2) বা বালি জাতীয় খনিজ সাধারণত এই কাজটি করে থাকে, যার মধ্যে অবশ্য আরও অনেক খনিজ পদার্থ থাকে। এই পদ্ধতিকে সিলিসিফিকেসন (Silicification) বলে। শালগ্রাম শিলার রঙ কালো, কারণ কালো শেল পাথরের মধ্যে এর সৃষ্টি হয়ে থাকে বিজারক পরিবেশে পলি অবক্ষেপণের ফলে। শালগ্রাম শিলার জীবাশ্মগুলি সাধারনত জুরাসিক (Jurassic) যুগের অর্থাৎ এদের বয়স প্রায় ২০ কোটি বছর।
দ্বারকা শিলা
শালগ্রাম শিলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ শিলা হলো দ্বারকা শিলা, যদিও শালগ্রাম শিলার মতো অতটা প্রচার পায়নি দ্বারকা শিলা। দেখা যাচ্ছে যে এর পরিচিতি সৌরাষ্ট্র (গুজরাট), বাংলা ও মহারাষ্ট্রের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
দ্বারকা শিলা
কর্ণাটকের মাধব সম্প্রদায় এটিকে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে। দ্বারকা শিলা মন্দির বা গৃহস্থালিতে শালগ্রাম শিলার মতো সচরাচর দেখা যায় না। এই পাথরগুলি সাদা রঙের (অন্য রঙেরও হয়ে থাকে), আকারে ছোটো এবং তাদের উপর আবছা চক্রের মতো চিহ্ন রয়েছে। শালগ্রাম শিলার তুলনায় দ্বারকা শিলা অনেক নবীন, এদেরকে প্রস্তর প্রবাল বলা হয়ে থাকে। প্রস্তর প্রবালের ফসিল ট্রায়াসিক যুগের মাঝামাঝি সময় থেকেই পাওয়া যায়, তাই বোঝা যায় না যে, এর আগে প্রস্তর প্রবালের অস্তিত্ব ছিল কিনা। কেউ-কেউ বলেন যে মধ্যজীবিয় উপকল্পের আগে এই ধরনের প্রবাল ছিল, কিন্তু তাদের শক্ত পাথরের মতো কঙ্কাল বানাবার ক্ষমতা ছিল না। আবার কোনো-কোনো পণ্ডিতের মত ভিন্ন, তাঁরা বলেন যে এই প্রস্তর প্রবালের আবির্ভাবই হয়েছিল সেই ট্রায়াসিক যুগে টেট্রাকোরালিয়া বলে আরেক ধরনের প্রবাল থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে। দ্বারকা শিলা বলে পূজিত শিলাগুলির তৈরি হয়েছে বেশি দিন হয়নি, এগুলির জন্ম হোলোসিন সময়ে, তাই এদেরকে হোলোসিন প্রবালও বলা হয়ে থাকে।
ভূতাত্ত্বিক সময় সারণীর একেবারে শেষ যুগ হলো কোয়ার্টারনারি (Quaternary) যুগ, যা আজও চলছে। এই যুগের দুই ভাগ– প্লাইস্টোসিন, (Pleistocene)যা প্রায় ২৬ লক্ষ বছর আগে শুরু হয়ে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে শেষ হয়ে গেছে, এবং হোলোসিন (Holocene) যা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে শুরু হয়ে এখনও বর্তমান রয়েছে।
প্রস্তর প্রবালগুলি দেহের চারপাশে কঠিন ক্যালসিয়াম কার্বনেটের (CaCO3) আবরণ তৈরি করে, যা একের পর এক স্তরে-স্তরে জমে এক উপনিবেশ বানিয়ে ফেলে, আর এই উপনিবেশগুলি বাড়তে-বাড়তে প্রাচীর বা দ্বীপের মতো হয়ে ওঠে। একটি প্রবাল বা পলিপ (Polyp) আরেকটি প্রবালের সঙ্গে জুড়ে গুচ্ছ টিউব বানায়, যাকে কোরালাইট (Corallite) বলে; আর অনেক কোরালাইট মিলে যে উপনিবেশটির ধাঁচা খাড়া করে, তাকে কোরালাম (Corallum) বলে। প্রথম কোরালাম-এর অংশ হচ্ছে ব্যাসাল প্লেট (Basal plate), যার মাধ্যমে এই উপনিবেশ সমুদ্রের তলায় আটকে থাকে। কোরালাইটের চক্রাকার গঠন বিষ্ণুর চক্রকে স্মরন করিয়ে দেয় আর তাই এই শিলাকে চক্রশিলাও বলা হয়ে থাকে। এক একটি প্রবালের গায়ে এমন অনেক চক্র তৈরি হয় তাই এদের সংখ্যা অনুযায়ী দ্বারকা শিলার বিভিন্ন নাম হয়ে থাকে। স্কন্দপুরাণের প্রভাস খণ্ডের অন্তর্গত দ্বারকা মাহাত্ম্য গ্রন্থে (৩৭তম অধ্যায়ে) প্রহলাদ দ্বারকা শিলার বর্ণনা করেছেন আর সেখানে চক্রের সংখ্যা অনুযায়ী নামের উল্লেখ করেছেন।
সেখানে একচক্র বিশিষ্ট দ্বারকা শিলার নাম সুদর্শন। দ্বারকা শিলা হোলোসিন যুগের হলেও শুধুমাত্র একচক্র বিশিষ্ট দ্বারকা শিলা আরও পুরনো সময়ের। একমাত্র এক চক্রবিশিষ্ট শিলা স্বতন্ত্র প্রবাল, যার মধ্যে একটি মাত্র চক্র থাকে। এদের বয়স অনেক বেশি। আজ থেকে প্রায় ৪৯ কোটি বছর আগে অর্ডোভিসিয়ান যুগে এদের উৎপত্তি আর চরম উন্নতি হয়েছিল সিলুরিয়ান-ডেভোনিয়ান যুগে। এই রকম একটি রুগোসার ছবি দিলাম যেখানে তার একটি চক্রের মতো শারীরিক ভাগটি সহজেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রুগোসার জীবাশ্মে একটি চক্র (সংগ্রহ ও ছবি: লেখক)
কয়লা বা জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া, শালগ্রাম শিলা ও দ্বারকা শিলার মতো এমন উদাহরণ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ যেখানে জীবাশ্ম মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এতোখানি প্রভাব ফেলেছে। প্রাচীনকালে, মানুষ প্রকৃতির উপাদান হিসেবে বিভিন্ন জিনিস দেখেছে, পাথর এবং জীবাশ্মও তার মধ্যে একটি। প্রবাল পাথরের গায়ে চক্র দেখে তাকে ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেনি আর তা স্বাভাবিক। তখন তাকে ব্যাখ্যা করতে ধর্ম, কিংবদন্তী, মহাকাব্যের ঘটনা, সাহিত্য (মঙ্গলকাব্যের প্রভাব) ইত্যাদি যোগ করতে হয়েছে। তার অনেকগুলিই আমাদের নজরে পড়ে আবার বহু উদাহরণ হারিয়ে গেছে। সেই দিক দিয়ে এগুলি সত্যিই অনন্য।
শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: পৃথিবীর সময়কাল
তথ্যসূত্রঃ
- বক্সী শুভেন্দুকুমার, পুরাজীববিদ্যা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৯
- ভট্টাচার্য দীপান, অথ ফসিল উবাচ, বইচই পাবলিকেশন
- Christian Barrs et al, The earliest rugose coral
- Desaia Bhawanisingh G., Ichnological analysis of the Pleistocene Dwarka Formation, Gulf of Kachchh: tracemaker behaviors and reworked traces
- Merriam C W, Middle Devonian Rugose Coral
- Pankaj Arpita and R L Jain, Quarternry Corals of Okha – An evidence of sea level changes and environment of deposition, Article in indian Journal of Marine Sciences, Vol 43(7), July 2014
- সর্বাধিকারী তিমির রঞ্জন, ভারতের শিলাস্তর ও ভূতত্ত্বীয় ইতিহাস, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৯
- তর্করত্ন পঞ্চানন, স্কন্দপুরাণ, কলিকাতা, নবভারত পাবলিশার্স
- ঠাকুর হরু (অশোককুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদিত), শিলাচক্রার্থবোধিনী, কলকাতা, সদেশ, ১৪২৬ সন
দ্বারকা শিলা সম্পর্কে অনেক কিছু অজানা তথ্য জানতে পারলাম। আরও তথ্য ও ছবি চাই। অনেক ধন্যবাদ।
An excellent write-up