মাতাল দাঁতাল
‘হর্ষের হর্ষ উবে গেল’। লিখেছিলেন রবিকীর্তি। বাদামি চালুক্য বংশের প্রবল পরাক্রমশালী শাসক দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তি। কর্ণাটকের আইহোলের মেগুতি পাহাড়ের ওপর এক জৈন মন্দির আছে। সেই মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা এক লেখতে, যে লেখর পোশাকি নাম ‘আইহোলে লেখ’।
হর্ষ কে? তাঁর হর্ষ উবে গিয়েছিল কেন? এমন হেঁয়ালি কেন রচনা করেছিলেন রবিকীর্তি? এইসব প্রশ্ন নিশ্চই আসছে আপনাদের মনে। দোষের কিছু নেই। আমারও এসেছিল। পরে বইপত্র ঘেঁটে বুঝেছিলাম যে হেঁয়ালি রচনা করেননি রবিকীর্তি। রসিকতা করেছিলেন। বিদ্রুপ করেছিলেন থানেশ্বরের (প্রাচীন নাম স্থানিশ্বর) পুষ্যভূতি বংশের চতুর্থ প্রজন্মের রাজা প্রবলপ্রতাপান্বিত হর্ষবর্ধনকে। বাপরে বাপ! কী সাহস! হর্ষবর্ধনকে নিয়ে রসিকতা! কেন এহেন রসিকতা করেছিলেন রবিকীর্তি হর্ষবর্ধনকে নিয়ে? সাহস পেয়েছিলেন কী করে? হুম, তাহলে তো একটু কষ্ট করে জানতে হবে আইহোলে লেখর প্রেক্ষাপট।
আইহোলে লেখ নিয়ে কথা বলবো; দ্বিতীয় পুলকেশী, হর্ষবর্ধন এবং রবিকীর্তিকে নিয়ে কথা বলবো আর আইহোলে নিয়ে কিছ বলবো না— তা কী হয়? এ যেন রামায়ণ, রাম, রাবণ, বাল্মীকি নিয়ে আলোচনা হবে কিন্তু অযোধ্যা নিয়ে আলোচনা হবে না। তা কী সম্ভব? বিশেষ করে এই যুগে যখন অযোধ্যাই মুখ্য আর বাকি সব কিছু গৌণ। অতএব আসুন, হয়ে যাক আইহোলে নিয়ে দু-চার কথা।
কর্ণাটকের বাগালকোট জেলায় আছে এই আইহোলে। বাদামি চালুক্যদের রাজধানী বাদামি থেকে আইহোলের দূরত্ত্ব কমবেশি ৩৫ কিলোমিটার। প্রাচীন নাম ছিল আয়্যাভোলে এবং আর্যপুরা। যারা ভারতের মন্দির স্থাপত্যশৈলীর বিবর্তন নিয়ে জানতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য অবশ্যগন্তব্য এই আইহোলে। কারণ আইহোলে ছিল ভারতের মন্দির স্থাপত্যশৈলী বিকাশের ধাত্রীগৃহ। সাধারণ অব্দের পাঁচ শতক থেকে বারো শতকের মধ্যে আইহোলেতে তৈরি হয়েছিল শতাধিক মন্দির যেগুলি পরবর্তীকালে পুরো ভারতের মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে কাজ করেছিল। আইহোলে’র মন্দিরগুলি তৈরি করার সময় করা হয়েছিল নানান রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রসায়নের গবেষণাগারে যেমন তিন-চার রকমের জিনিস মিশিয়ে একটা নতুন জিনিস বানানো হয়; তেমনই আইহোলে’র মন্দিরগুলি তৈরি হয়েছিল কখনও নগর নকশা মেনে আবার কখনও কখনও দ্রাবিড়-বিমান নকশা মেনে। স্বকীয় কারুকাজ সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল গুপ্তদের এবং কদম্বদের তৈরি মন্দিরের কারুকাজও। আদতে, আইহোলে ছিল একটা ল্যাবরেটরি— মন্দির স্থাপত্যশৈলীর।
দুর্গ মন্দির, আইহোলে
আইহোলে গিয়েছেন আপনি? না গিয়ে থাকলে, একবার ঘুরে আসতে পারেন। একসঙ্গে ঘুরে নিতে পারেন আইহোলে, বাদামি এবং পাট্টাদাকাল— এই তিনটে জায়গা। দেখতে পাবেন খুব সুন্দর সুন্দর অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির। চোখের আরাম হবে। এই সব মন্দির দেখার জন্য যে মন্দির স্থাপত্যশৈলীর ওপর পণ্ডিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। রেজালার রেসিপি না জানলে রেজালার স্বাদ নেওয়া যাবে না, এমন দিব্যি’তো কেউ দেয়নি।
তবে হ্যাঁ, আইহোলের রস ঠিকঠাক ভাবে আস্বাদন করতে চাইলে, একটা জিনিস আপনার কাছে থাকলে ভালো হয়। মন’এর দু’টো ডানা— যাতে আপনার কল্পনা, পাখা মেলে উড়তে পারে। তা যদি থাকে, দুর্গ মন্দিরের বারান্দায় বসে দু’চোখের পাতা এক করলেই আপনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন যে মালপ্রভা নদীর তীরে বসে রয়েছেন আপনি। আপনার চারপাশে তৈরি হয়ে চলেছে মন্দিরের পর মন্দির। মিস্ত্রিরা কাটছে পাথর, সেগুলি ঠিকঠাকভাবে সাজানো হচ্ছে স্থপতিদের তত্ত্বাবধানে, ভাস্কররা তার ওপর ফুটিয়ে তুলছে সূক্ষ ভাস্কর্য। আর সব কিছুর উপর কড়া নজর রাখছেন সূত্রধর (প্রধান স্থপতি)। বেলা একটু পড়লে, যখন সূর্যের রোদ একটু নরম হয়ে যাবে, চলে যেতে পারেন মেগুতি পাহাড়ে। মেগুতি পাহাড়ের ওপর জৈন মন্দিরের ছাদ থেকে বিকেলের কনে দেখা আলোয় দেখতে পাবেন যে, গায়ে সোনালী রং মেখে নিচের সমতলে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মন্দির। এই মন্দিরগুলো কিন্তু এইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে; শুধু আপনি কবে আসবেন তার প্রতীক্ষায়।
মল্লিকার্জুন মন্দির, আইহোলে
মেগুতি পাহাড়ের ওপর এই জৈন মন্দিরটি দেখতে তেমন কিছু আহামরি নয়। তাও, ভারতের ইতিহাসচর্চার দিক থেকে এই মন্দিরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রাচীন ভারতের যে অল্প কয়েকটি প্রাচীন মন্দিরের বয়স ঠিকঠাক ভাবে নির্ণয় করা গিয়েছে, তার মধ্যে একটি হল এই মেগুতি পাহাড়ের জৈন মন্দির। এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ৬৩৬ সাধারণ অব্দে। কী করে জানা গেল? আইহোলে লেখ থেকে। আইহোলে লেখ লেখা হয়েছিল এই মন্দিরেই। আর সেই আইহোলে লেখতেই রবিকীর্তি লিখেছিলেন ‘হর্ষের হর্ষ উবে গেল’।
গৌরচন্দ্রিকা অনেক হল, এইবার আসল কথায় আসা যাক।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় পুরো উত্তর ভারতে একাধিপত্য স্থাপন করে নিয়েছিলেন হর্ষবর্ধন। থানেশ্বরের সঙ্গে, বিধবা বোন রাজ্যশ্রী’র বকলমে কনৌজের মৌখরীদের শাসনভারও নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কনৌজ হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় রাজধানী। সুদূর পূর্বে অভিযান চালিয়ে পুন্ড্রর যুদ্ধে হারিয়েছিলেন গৌড়ের শশাঙ্ককে, দাদা রাজ্যবর্ধনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। শশাঙ্ককে গৌড়ের রাজ্যপাট থেকে পুরোপুরি উৎখাত না করতে পারলেও, দখল করে নিয়েছিলেন তাঁর রাজ্যের বেশ খানিকটা অংশ। গৌড় অভিযানের পথে অধিকার করে নিয়েছিলেন প্রয়াগ, অযোধ্যা, শ্রাবস্তী, মগধ এবং আরও অনেকগুলো ছোটো ছোটো রাজ্য। পশ্চিমে সৌরাষ্ট্রর মৈত্রক’রা পালিয়ে গিয়েছিলেন রাজধানী বল্লভী থেকে তাঁর ভয়ে। কাশ্মীরের রাজা আর তাঁদের পঞ্জাবের সামন্ত শাসকরা মেনে নিয়েছিলেন হর্ষবর্ধনের অধীনতা। সিন্ধ এবং উড়িষ্যাও হয়ে গিয়েছিল তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কাশ্মীর থেকে আরব সাগর, আরব সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর, পুরো উত্তর ভারত তখন চলে এসেছিল হর্ষবর্ধনের অধীনে।
হর্ষবর্ধন যখন পুরো উত্তর ভারত নিজের কবজায় নিয়ে আসছিলেন, তখন দাক্ষিণাত্যে উঠে এসেছিলেন সেই যুগের আর এক মহারথী— বাদামি চালুক্যদের দ্বিতীয় পুলকেশী। কাকা মঙ্গলেসা’কে হঠিয়ে বসেছিলেন বাদামি চালুক্য সিংহাসনে। রাজ্যপাট চালাতে শুরু করেছিলেন বাদামির অগস্ত্য হ্রদের তিন দিকের পাহাড়ের মাথায় দাদু প্রথম পুলকেশীর গড়া দুর্গপ্রাসাদ থেকে। বিদ্রোহী আপ্পায়িকাকে দমন করেছিলেন ভীমরথী নদীর ধারে যুদ্ধে হারিয়ে। আপ্পায়িকার বন্ধু গোবিন্দ মেনে নিয়েছিলেন বশ্যতা। বনবাস থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন কদম্বদের। দক্ষিণ কর্ণাটকের আলুপা’রা, মাইশোর’এর গঙ্গা’রা এবং উত্তর কোঙ্কন-এর মৌর্য’রা যাদের রাজধানী ছিল পুরী (আজকের এলিফ্যান্টা) দিতে শুরু করে দিয়েছিল ‘নজরানা’। গঙ্গা রাজা ‘দুর্বিনীত’কে কন্যাদান করে দ্বিতীয় পুলকেশীকে বানিয়ে নিয়েছিলেন নিজের জামাই। তখনও অবশ্য জয় করা হয়ে ওঠেনি দক্ষিণ ভারতের বাকি অঞ্চলগুলো— পূর্বদিকের কৃষ্ণ-গোদাবরী অববাহিকা এবং দক্ষিণের তামিলনাড়ু আর কেরল। সময় বের করে উঠতে পারেননি বলে। ভাবনা-চিন্তা করছিলেন ভাই যুবরাজ বিষ্ণুবর্ধনের হাতে রাজ্যপাট সঁপে বেরোবেন দিগ্বিজয় করতে।
এই সময়, অনেকটা অযাচিতভাবেই, দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্যবিস্তার হয়ে গেল। তবে পূর্বে বা দক্ষিণে নয়, উত্তরে। কোনো রকম লড়াই-দাঙ্গা ছাড়াই। হয়েছিল কী, হর্ষবর্ধন আর দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্যের মধ্যে ছিল তিনটে ছোটো ছোটো রাজ্য, বলা যেতে পারে ‘বাফার স্টেট’— মালব্য, লতা (আজকের দক্ষিণ গুজরাট) এবং গুজ্জর (আজকের মধ্য/উত্তর গুজরাট)। এই রাজ্যগুলির তখন ‘জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ’ অবস্থা— একদিকে হর্ষবর্ধন আর অন্যদিকে দ্বিতীয় পুলকেশী। তা এঁরা ঠিক করলেন যে, সমূলে উৎখাত হওয়ার আগে, কারো সামন্ত রাজা হয়ে যাওয়া ভালো। সেই মত, এঁরা গিয়ে নাম লেখালেন দ্বিতীয় পুলকেশী’র দলে। ‘বাফার স্টেট’গুলো হয়ে গেল ‘ক্লায়েন্ট স্টেট— বাদামি চালুক্য’দের। দ্বিতীয় পুলকেশী’র রাজ্যের উত্তর সীমা একলাফে তাপ্তি এবং নর্মদা নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেল মাহি নদী পর্যন্ত, হর্ষবর্ধনের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার দূরত্বে।
লতা, মালব্য এবং গুর্জর; এঁরা কেন হর্ষবর্ধনের ছাতার তলায় না গিয়ে দ্বিতীয় পুলকেশী’র ছত্রছায়ায় গিয়েছিলেন, তার কারণ সুনিশ্চিতভাবে জানা নেই। এই রাজ্যগুলো থেকে বাদামির দূরত্ব ছিল কনৌজের থেকে বেশি। তাই হয়তো এঁরা ভেবেছিলেন যে দ্বিতীয় পুলকেশীর অধীনে এঁরা বেশি স্বাধীন থাকবেন। হতে পারে এটাই ছিল কারণ। মালব্য’র একটা অবশ্য সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। মালব্য’র সঙ্গে হর্ষবর্ধনের ছিল পুরনো ‘দুশমনি’। মালব্য’র আক্রমণেই নিহত হয়েছিলেন রাজ্যবর্ধন, হর্ষবর্ধনের বোন রাজ্যশ্রীর স্বামী মৌখরীদের রাজা।
সাধারণ অব্দের সাত শতকের প্রথমভাগে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্র
তবে কারণ যাই হোক না কেন, লতা, মালব্য এবং গুর্জরদের এইভাবে দ্বিতীয় পুলকেশীর দলে যোগ দেওয়াটা একদমই ভালো ভাবে নেননি হর্ষবর্ধন। ‘দুয়ারে সরকার’ সবারই ভালো লাগে, কিন্তু সরকার যদি প্রতিপক্ষের হয় তাহলে কারোরই ভালো লাগে না— কী এই যুগে, কী সেই যুগে। হর্ষবর্ধনেরও লাগেনি। তাই, তিনি ঠিক করলেন যে নর্মদা পেরিয়ে দ্বিতীয় পুলকেশী’কে একটু ‘শিক্ষা’ দিয়ে আসবেন। এতে রথ দেখাও হবে, কলা বেচাও হবে। দাক্ষিণাত্য বিজয় করলে তাঁর দিগ্বিজয় সম্পন্ন হয়ে যাবে। তিনি হয়ে যাবেন ‘চক্রবর্তী’। আবার দ্বিতীয় পুলকেশীর বাড়বাড়ন্তেরও হবে অঙ্কুরে বিনাশ। দ্বিতীয় পুলকেশীকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে বাঘের গুহায় হাত ঢোকালে কী হয়।
কিন্তু এরপরের ঘটনাগুলো ঠিক তেমনভাবে ঘটল না যেভাবে হর্ষবর্ধন চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় পুলকেশীকে ‘শিক্ষা’ দিতে গিয়ে, তিনি নিজেই গেলেন খুব বিচ্ছিরি ভাবে ফেঁসে। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে হর্ষবর্ধনের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল দ্বিতীয় পুলকেশীর সৈন্যবাহিনীর মাতাল হাতিদের।
আগের লাইন’টা পড়ে আপনি নিশ্চই চোখ কচলাচ্ছেন। ভাবছেন ‘দাঁতাল’ পড়তে গিয়ে ‘মাতাল’ পড়লেন কিনা? কিন্তু চোখ কচলে দেখলেন যে ‘মাতাল’ই লেখা আছে। এবার ভাবছেন যে এই গল্প’টা সপ্তাহান্তের গল্প বলে লেখক আগের সন্ধ্যের প্রভাবে দাঁতালকে মাতাল লিখে ফেলেছে। আপনার অনুমান যৌক্তিক হলেও ভ্ৰান্ত। কারণ, সত্যি সত্যিই দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষবর্ধনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিলেন মাতাল দাঁতালদের।
প্রাচীন ভারতে, যুদ্ধে হাতি ব্যবহারের প্রথা বহু পুরোনো। হর্ষবর্ধন বা দ্বিতীয় পুলকেশীর অনেক আগে থেকেই ছিল এর চল। মগধের সাম্রাজ্য বিস্তারে, বিম্বিসারের প্রধান ভরসা ছিল হাতিবাহিনী। নন্দদের ছিল প্রায় তিন হাজার হাতি। মৌর্য এবং গুপ্তদের ছিল আলাদা হাতিবাহিনী। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বাহিনীতে ছিল প্রায় ন’হাজার হাতি। এমনকী হর্ষবর্ধনেরও ছিল বিশাল হাতি বাহিনী। হর্ষবর্ধনের সেই হাতি বাহিনী এবং প্রিয় হাতি দর্পশত-এর জন্য, জীবনীকার বাণভট্ট খরচ করেছিলেন হর্ষচরিত্র’র বেশ কয়েকটা পাতা।
লড়াইয়ের ময়দানে এই হাতি নির্ভরতার কারণ ছিল যে, বিপক্ষের সৈন্যদলকে তাড়াতাড়ি খেদিয়ে দিতে হাতির সমকক্ষ কিছু ছিল না। হাতি এক ঝটকায় উড়িয়ে দিত বিপক্ষের একাধিক পদাতিক এবং ঘোড়সওয়ারকে। বিপক্ষের ঘোড়া পিছু হঠে যেত ভয় পেয়ে। হাতি তৈরি করত ‘মনস্তস্ত্বিক চাপ’। তাই সব রাজাদের হাতেই হাতি থাকতো। যুদ্ধ পরিকল্পনায় হাতি তখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে যুদ্ধে হাতির উপযোগিতা কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, তা নিয়ে রীতিমতো চিন্তা-ভাবনা করতেন সেইযুগের সমরবিশেষজ্ঞরা। গবেষণাধর্মী লেখাও হয়েছিল অল্পবিস্তর। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র বইতে বিস্তারিত ভাবে লিখেছিলেন বিভিন্ন প্রকারে হাতি, হাতির বংশবৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধে হাতির ব্যবহার নিয়ে। বৌদ্ধ গ্রন্থ দীর্ঘনিকায়তে তো পরিষ্কারভাবে বলেই দেওয়া হয়েছিল যে রাজহাতি’কে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে সে সবরকম অস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে পারে, নিজের পিঠের সওয়ারিকে রক্ষা করতে পারে, যেখানে যেতে বলা হবে সেখানেই যেতে পারে আর বিপক্ষের পদাতিক, ঘোড়সওয়ার এবং স্বজাতীয়’দের নিকেশ করতে পারে। হাতি’কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হত যাতে তারা নিজেদের শুঁড়, দাঁত, মাথা, পা, কান, এমনকী পরিস্থিতি দাবি করলে, লেজ দিয়েও লড়াই করতে পারে। লড়াইয়ের ময়দানে জান কবুল করে দেবে হাতিরা, এটাই ছিল প্রত্যাশিত।
যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির কার্যকারিতা বাড়াতে সবাই মাথা ঘামালেও, এই বিষয়ে বাদামি চালুক্যরা ছিলেন কয়েক কাঠি সরেস। যুদ্ধে হাতিদের বিধ্বংসী ভূমিকাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা, মাদক ব্যবহার করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে হাতির দল এবং হাতির পিঠে সওয়ার যোদ্ধাদের পরিমিত পরিমানে মাদক সেবন করানো ছিল বাদামি চালুক্যদের এক রণকৌশল। আর নেশার বস্তু একবার পেট’এ পড়লে, দু’পেয়ে বলুন বা চার’পেয়ে, সবাই যে অমিতবিক্রমশালী হয়ে ওঠে, এই নিয়ে আশা করি আপনি দ্বিমত পোষণ করেন না। এখানেই দ্বিতীয় পুলকেশী টেক্কা দিয়ে গিয়েছিলেন হর্ষবর্ধনকে।
আগেই বলেছি হর্ষবর্ধনেরও বিশাল হাতি বাহিনী ছিল। কিন্তু তাঁর দাঁতালরা ছিল সাত্ত্বিক। তাই দ্বিতীয় পুলকেশীর পাঁড় মাতাল দাঁতালদের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারেনি হর্ষবর্ধনের হস্তী বাহিনী। যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন র্হর্ষবর্ধন। নর্মদা অতিক্রমের স্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল দুঃস্বপ্ন। মেনে নিতে হয়েছিল লতা, মালব্য এবং গুর্জর’এর ওপর দ্বিতীয় পুলকেশী’র অধিকার। তাঁর প্রচুর দাঁতাল নিয়ে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশী ভবিষ্যতে মাতাল বানাবেন বলে।
আইহোলে লেখ
আর, হর্ষবর্ধনের এই নাজেহাল হাল নিয়ে, দ্বিতীয় পুলকেশীর সুরসিক সভাকবি রবিকীর্তি কৌতুক করে আইহোলে লেখ’তে লিখেছিলেন— ‘হর্ষের হর্ষ উবে গেল’।
পাদটীকা:
- আইহোলে লেখ পাওয়া গিয়েছে আইহোলের মেগুতি পাহাড়ের জৈন মন্দিরে। এই লেখটি লিখেছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তি, ৬৩৬ সাধারণ অব্দে, যখন দ্বিতীয় পুলকেশী (৬১০-৬৪২ সাধারণ অব্দ) ছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে। হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দ্বিতীয় পুলকেশীর যুদ্ধ সম্পর্কে এই লেখর ২৩ নম্বর শ্লোকে লেখা আছে “Harsha, whose lotus–feet were arrayed with the rays of the jewels of the diadems of hosts of feudatories prosperous with unmeasured might, through Him had his mirth melted away by fear, having become loathsome with his rows of lordly elephants fallen in battle”।
- মূলত প্রশস্তিমূলক লেখ হলেও, আইহোলে লেখ থেকে দ্বিতীয় পুলকেশী, সমকালীন অন্যান্য রাজা/রাজত্বদের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং বাদামি চালুক্য রাজবংশ সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সেই কারণে ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার দিকে থেকে আইহোলে লেখর গুরুত্ব অপরিসীম। আইহোলে লেখর সবচেয়ে গুরুত্যপূর্ণ দিক হল যে, এই লেখতে এর সময়কালের উল্লেখ আছে যা পরবর্তীকালে নির্ণীত হয়েছে ৬৩৬ সাধারণ অব্দ বলে। তার ভিত্তিতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সময়ানুক্রম ঠিক করা সম্ভব হয়েছে। এই লিপিতে দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকাল প্রসঙ্গে, মহাভারতের সময়কালেরও উল্লেখ আছে (যদিও তা কতটা সঠিক তাই নিয়ে ঐতিহাসিকরা সন্দিহান)। দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকাল প্রসঙ্গে, এই লিপির ৩৩ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে –“(Now) when thirty and three thousand and five years besides, joined with seven hundred years, have passed since the Bharata war”।
- হর্ষবর্ধনের জীবন এবং রাজত্বকাল সম্পর্কে আমরা তথ্য পাই মূলত দুটো সূত্র থেকে – তাঁর জীবনীকার বাণভট্টের লেখা হর্ষচরিত্র এবং চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখা ভ্রমণ বিবরণী (হিউয়েন সাং ভারতে ছিলেন ৬৩০ সাধারণ অব্দ থেকে ৬৪৪ সাধারণ অব্দ পর্যন্ত)।
- হর্ষচরিত্রে দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে হর্ষবর্ধনের পরাজয়ের কোনো উল্লেখ নেই। এর সম্ভাব্য কারণ দু’টো। এক নম্বর সম্ভাব্য কারণ হল যে, বাণভট্ট নিজের পৃষ্ঠপোষকের হারের কথা লিপিবদ্ধ করেননি। দুই নম্বর সম্ভাব্য কারণ হল, বাণভট্টের লেখা মূলত হর্ষবর্ধনের জন্মকাল (৫৯০ সাধারণ অব্দ) থেকে তাঁর সিংহাসনলাভ (৬০৬ সাধারণ অব্দ) এবং শশাঙ্কর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ হয়েছিল সেই সময়ের বেশ কয়েক বছর পরে, তাই হয়তো হর্ষচরিত্রে তার উল্লেখ নেই।
- হিউয়েন সাং-এর লেখাতেও হর্ষবর্ধনের পরাজয়ের সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু তাঁর লেখা থেকে দ্বিতীয় পুলকেশীর প্রতিপত্তি এবং তাঁকে নিজের অধীনে আনতে হর্ষবর্ধনের অপারগতার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। হিউয়েন সাং-এর বিবরণী অনুযায়ী পুরো ভারত ভ্রমণ করতে করতে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে যে জায়গার নাম ছিল ‘Mo-ho-la-ch’a’ (মহারাষ্ট্র)। এখানকার অধিবাসীরা ছিলেন সৎ কিন্তু নির্মম। এদের মধ্যে ছিল ‘a band of champions’, যাঁরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে, নিজেরা এবং নিজেদের হাতিদের মাদক সেবন করিয়ে নামতেন, হয়ে উঠতেন অপ্রতিরোধ্য। তাই এদের রাজা ‘Pu-lo-ki-she (দ্বিতীয় পুলকেশী) ‘treat his neigbours with contempt’। হিউয়েন সাং আরও লিখেছিলেন যে, সেই সময় (৬৩০ সাধারণ অব্দ) হর্ষবর্ধন তাঁর ‘five Indies’ থেকে সবচেয়ে সুযোগ্য সেনানায়কদের অধীনে সৈন্য সমাবেশ করিয়ে এবং সেই সেনাবাহিনীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েও দ্বিতীয় পুলকেশীর যোদ্ধাদের কাবু করতে পারেননি এবং দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষবর্ধনকে একদমই সমীহ করতেন না। প্রসঙ্গত, ভারতভ্রমণসূত্রে হিউয়েন সাং পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চিপুরম এবং বাদামি চালুক্যদের রাজধানী বাদামিতেও গিয়েছিলেন।
- দ্বিতীয় পুলকেশীর এই মাতাল হাতি বাহিনীর কথা হয়তো হর্ষবর্ধনের জানা ছিল। কিন্তু হাতিদের কী খাওয়ালে এবং কতটা খাওয়ালে তারা কার্যকরী থাকবে এবং বিধ্বংসী হয়ে ওঠে, সেইটা সম্ভবত ছিল বাদামি চালুক্যদের ‘trade secret’। এর ফল শুধু হর্ষবর্ধনকেই নয়, পল্লবসহ এবং বাদামি চালুক্যদের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজশক্তিকেও ভুগতে হয়েছিল।
- হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দ্বিতীয় পুলকেশীর যুদ্ধ ঠিক কবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিক কে.ভি.রমেশ এবং ঐতিহাসিক কে.এ.নীলকান্ত শাস্ত্রী, ৬১২-৬১৩ সাধারণ অব্দে লেখা দ্বিতীয় পুলকেশীর হায়দ্রাবাদ লেখর ভিত্তিতে মত পোষণ করেন যে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দ্বিতীয় পুলকেশীর যুদ্ধ হয়েছিল ৬১২ সাধারণ অব্দে বা তার আগে। পক্ষান্তরে, ঐতিহাসিক শ্রীনাদ.এল.বাপত এবং প্রদীপ.এস.সোহানি বিজাপুর-মুম্বাই দানপত্রের ভিত্তিতে, যার তারিখ ছিল ৪ এপ্রিল, ৬১৯ সাধারণ অব্দ, মনে করেন যে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দ্বিতীয় পুলকেশীর যুদ্ধ হয়েছিল ৬১৮ সাধারণ অব্দের নভেম্বর মাস থেকে ৬১৯ সাধারণ অব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে।
- দ্বিতীয় পুলকেশীর অন্যন্য উল্লেখযোগ্য সামরিক অভিযানগুলো যেমন, পূর্ব দাক্ষিণাত্য, দক্ষিণ কোশল, কলিঙ্গ আক্রমণ; বিষ্ণুকুন্দিন, পল্লব এবং পাণ্ড্য’দের সঙ্গে যুদ্ধ ইত্যাদি হয়েছিল হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের পর। পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় পুলকেশীর সঙ্গে যুদ্ধই ছিল হর্ষবর্ধনের শেষ বড়ো যুদ্ধ। এরপর প্রায় ৩০-৩৫ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন কোনো বড়সড় যুদ্ধ ছাড়াই।
তথ্যসূত্র:
- John Keay; India A History: From the Earliest Civilisation to the Boom of the Twenty-First Century by; Harper Collins; 2010
- by K.A.Nilkanta Sastry; The Illustrated History of South India – From Prehistoric Times to the Fall of Vijaynagar; Oxford University Press; 2009
- Romila Thapar; The Penguin History of Early India, From Origins to AD 1300 (Kindle Edition)
- Lalit Chugh; Karnataka’s Rich Heritage, Art and Architecture, From Prehistoric Times to Hoysala Period; Notionpress.com; 2016
- George Michelle; The Hindu Temple, An Introduction to Its Meaning and Forms; The University of Chicago Press; 1988
- https://www.ancient.eu/article/1241/elephants-in-ancient-indian-warfare/
- https://cbkwgl.wordpress.com/2015/01/19/chalukya-pulakesis-aihole-inscription/
- https://www.thehindu.com/news/national/%E2%80%98Pulakeshin%E2%80%99s-victory-over-Harsha-was-in-618-AD%E2%80%99/article14255348.ece
যথারীতি দারুণ লাগল। একটা সময় সত্যিই হাতী বাহিনী ভারতে যুদ্ধের নির্ণায়ক ছিল।
তবে মাতাল হস্তীবাহিনী থাকা সত্ত্বেও পুলকেশী পল্লবরাজ নরসিংহবর্মণের কাছে কেন হেরে গেলেন সে গল্পও শুনতে চাইব।
খুব ভালো লাগলো।সরস আলোচনা।অনেক কিছু জানলাম।
এতদিন জানতাম হর্ষ যুদ্ধে শশাঙ্ককে নাকি পরাজিত করতে পারেন নি।
ভুলটা শুধরানো গেল।