সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ডোরবেল ও ইগ নোবেল Research that makes people laugh and then think

ডোরবেল ও ইগ নোবেল Research that makes people laugh and then think

সহস্রলোচন শর্মা

জুন ১৬, ২০২১ ৬০১ 0
(হ্যারি জিনট লিপকিন জন্ম শতবর্ষ স্মরণে)

।। ১ ।।

শীতের রাতের নীরবতা খান খান করে সহসাই বেজে উঠল বাড়ির সদর দরজার ডোরবেলটা। ঘুমের জড়তা নিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসেন খান সাহেব। ঘুম ভেঙ্গে যায় তাঁর স্ত্রীরও। একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতেতাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন তাঁর স্ত্রী। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের বোতাম টিপে দেখেন ৩.০৪। এই মাঝ রাতে আবার কে এলো? তবে কি জরুরী কোনও খবর আছে তাঁর জন্য? ব্ল্যাঙ্কেটটা চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামলেন খান সাহেব। দোতলা থেকে একতলায় নামতে নামতে দারোয়ানের নাম ধরে ডাকতে থাকেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গায়ে কম্বল জড়িয়ে হাজির হয় মাঙ্কিক্যাপ পরা মোটা গোঁফওলা দারোয়ান। 

-দেখো তো, কে বেল বাজালো।  

আগন্তুক অভ্যাগতের সন্ধানে বাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরোলো দারোয়ান। ছোট্ট একটা উঠোন পেরিয়েই পেল্লায় লোহার দরজা। তিন চার খানা তালা লাগানো তাতে। সব ক’টা তালা খুলে বাইরে বেরোয় দারোয়ান। না, কেউ তো নেই এখানে। ফাঁকা শুনশান রাস্তা। কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। দারোয়ান ফিরে এসে জানালো, কেউ নেই সাব।

-নেই মানে? বেলটা কি তবে ভূতে বাজালো? মেজাজ হারিয়ে খেঁকিয়ে উঠেন খান সাব। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দারোয়ান।

-যাও, ভালো করে চারিধারটা দেখে এসো আরেকবার। বাধ্য ছাত্রর মতো বড় গেটটা ফাঁক করে ফের বাইরে বেরোয় দারোয়ান। এদিক ওদিক দু’এক চক্কর লাগিয়ে ফিরে আসে সে।

-কেউ নেই সাব। চ্যাংড়া ছেলে ছোকরার কাজ হবে হয়তো।

-ঠিক আছে তালা দিয়ে শুয়ে পড়ো তুমি, ধীর ও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন খান সাহেব। ছেলে ছোকরারা রাত ৩টের সময় এসে বেল বাজিয়ে যাবে? তাঁদেরও তো বাড়ি ঘর আছে না কি? দিনের বেলা হলে না হয় ভাবা যেত যে এটা কোনও ছেলে ছোকরার কাজ। রাত ৩টের সময় তাঁরা পাড়া বেড়াতে বেরোবে? নীরবে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দোতলার সিঁড়ি ভাঙ্গতে থাকেন খান সাহেব। ঘরে ঢুকে উদ্বিগ্ন স্ত্রীকে বলেন, না কেউ নয়, শুয়ে পড়ো।

শুয়ে শুয়ে ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু ভাবতে থাকেন খান সাহেব। তাঁর মুলুক আর এই মুলুক দুই প্রতিবেশী দেশ। আজ প্রায় দু’বছর হলো তাঁর দেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে এই দেশে এসেছেন তিনি। রাষ্ট্রদূতের পদমর্যাদা তাঁর। তাঁর গায়ে এতটুকু আঁচড় পড়লে দুই দেশের সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাঁকে হেনস্তা করার জন্য চরম ভোগান ভুগতে হবে দু’দেশকেই। সেই তাঁর বাড়িতেই কিনা রাত ৩টের সময় এমনই এমনই বেজে উঠল ডোরবেলটা? এটা মোটেও কোনও আশেপাশের ছেলে ছোকরার কাজ নয়। এতো সাহস তাদের নেই যে রাত ৩টের সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হাইকমিশনারের সাথে তারাচ্যাংড়ামো মারবে। ব্যাপারটা পাড়াগত নয় মোটেও। ব্যাপারটা দেশগত। কারণ, কিছুদিন আগেই কারা যেন তাঁর কিশোর ছেলেকে ভয় দেখিয়ে গেছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে তিন চারটে লোক তাঁর ছেলেকে ঘিরে ধরে যাচ্ছেতাই রকমের ভয় দেখায়। তারা বলে, কিরে চিকনা, সিগারেট যাবি? মাল খাবি? হারাX,শালা এ দেশে বসে এ দেশের দাড়ি উপড়াবি? মেরে হাত পা ভেঙ্গে দেশে পাঠিয়ে দেবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্কুল থেকে ফিরে মাকে সব কথা জানায় ছেলে। খবর পেয়ে থানায় গিয়ে ডায়েরি করেন খান সাহেব। বাড়ি ফিরে ছেলেকে পাশে বসিয়ে বলেন, ওরা শুধু ভয়ই দেখাবে তোকে, তোর গায়ে হাত দিতে পারবে না। ওরা জানে তুই কে। তোর গায়ে হাত পড়লে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তাই ওরা শুধু ভয়ই দেখাবে তোকে। আর ওরা চায় তুই যেন ভয়ে ভয়ে থাকিস এদেশে। তুই যদি ওদের ভয় পেতে শুরু করিস তাহলে ওরা আরও ভয় দেখাবে তোকে। তুই নিজের মতো স্কুলে যাবি, নিজের মতো আসবি। তোর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না ওরা। ভয় পাস না মোটেও, বলে ছেলের মাথায় হাত চালিয়ে চুলটা এলোমেলো করে ঘেঁটে দিয়ে ব্যাপারটাকে হাল্কা করে দেওয়ার চেষ্টা করেন খান সাহেব। 

ছোটবেলা থেকেই কূটনৈতিক আভিজাত্যের মধ্যে বড় হয়েছে খান সাহেবের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই আধুনিক আদব কায়দাতে অভ্যস্ত সে। তাই বাবার কথাগুলো বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তার। পরদিন থেকে নিয়মিত স্কুল যেতে শুরু করে সেও। যদিও তারপর থেকে কেউ আর কোনও দিনও বিরক্ত করেনি তাকে।

কিন্তু খান সাহেব ভাবছেন অন্য কথা। প্রতিবেশী দেশের হাইকমিশনারের সাথে এ কেমন ব্যবহার? ক্রমাগত বিরক্ত করা হচ্ছে তাঁকে। মানসিক চাপ তৈরি করা হচ্ছে তাঁর উপর। তিনি বিলক্ষণ জানেন, চাপের মধ্যেই কাজ করতে হয় রাষ্ট্রদূতদের। কিন্তু বিষয়টা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে না এবার? ঘটনাগুলোকে চুপচাপ এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন তিনি। এই বিষয়ে তাঁর দেশের বিদেশ সচিবের সাথে কথা বলবেন তিনি একবার। তাঁর দেশের বিদেশ মন্ত্রকে ঘটনাগুলো জানানো প্রয়োজন এবার। বিদেশ মন্ত্রক কি বলে সেটা জানা প্রয়োজন তাঁর।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে খান সাহেবের। সকাল ৭টার মোবাইল এলার্মে ঘুম ভাঙ্গে তাঁর। রাত্রে ভালো ঘুম না হওয়ায় মাথাটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে। আরও কিছুক্ষণ তাই বিছানায় গড়িমসি করে শুয়েই রইলেন তিনি। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে আজ সকাল সাড়ে দশটায় তো মেরিল্যান্ড হসপিটালে ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে তাঁর। বেশ কয়েক মাস হলো কোমরটা নিয়ে বড্ড ভুগছেন তিনি। আজ তাই ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার কথা। সেই মতো অ্যাপয়েন্টমেন্টও করা হয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে ব্রেকফাস্ট করে বেরোবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি।

বাড়ির বড় গেটের সামনেই অপেক্ষা করছিল খান সাহেবের গাড়ি। খান সাহেব গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট করলেন ড্রাইভার। খান সাহেবের গাড়ি স্টার্ট নেওয়া মাত্রই, স্টার্ট নিল খান সাহেবের গাড়ির পিছনে থাকা আরেকটা গাড়ি। পিছনের গাড়িটা খান সাহেবের গাড়ির পিছন পিছন চলতে শুরু করল। খান সাহেবের গাড়ি থেকে বোধহয় এক হাত দূরত্ব রেখে চলতে থাকে পিছনের গাড়িটা। দূরত্ব আর একটু কম হলেই বা আচমকা ব্রেক মারলেই ধাক্কা লেগে যেতে পারে গাড়িটার সাথে। বিষয়টা লক্ষ্য করে ড্রাইভার বলে উঠেন, পিছনের গাড়িটাকে দেখুন স্যার, ইচ্ছা করে আমাদের গাড়ির পিছন পিছন চলেছে।

তুমি সাইড দিয়ে দাও না, বলে উঠেন খান সাহেব।

ডানদিকে কত জায়গা দেখুন স্যার। তবু গাড়িটা আমাদের পিছন পিছন চলেছে। আসলে ফলো করছে স্যর আমাদের।

কিছুটা এগিয়েই বড় রাস্তার মুখে পড়ল খান সাহেবের গাড়ি। বড় রাস্তায় উঠে বাঁদিকে মোড় নিল খান সাহেবের গাড়ি। সেই টার্নিঙের মুখেই পিছনের গাড়িটা স্পিড বাড়িয়ে খান সাহেবের গাড়ি ঘেঁষে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল। ‘দেখলেন স্যর, দেখলেন’ বলে উঠেন ড্রাইভার, ‘কি রকমের রাফ ড্রাইভিং করল দেখলেন’। খান সাহেব চুপ করে থাকেন। তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনাই বিচ্ছিন্ন বা কাকতালীয় নয়। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন সব ঘটনাগুলো আসলে এক সুতোয় গাঁথা। তাঁকে চাপে রাখতে, তাঁকে ভয় দেখাতেই এই সব কাণ্ড কারখানার আয়োজন করা হয়েছে।

‘স্যার দেখেছেন, ওই গাড়িটা আমাদের পথ আটকে কি রকম ভাবে আস্তে আস্তে যাচ্ছে। এসব ইচ্ছা করে করছে স্যর, কিছুতেই রাস্তা দিচ্ছে না’। খান সাহেব দেখলেন কালো কাঁচে ঢাকা পিছনের গাড়িটাই সামনে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছে সামনের গাড়িটা। পাশ কাটাবার পথও দিচ্ছে না। খান সাহেব বুঝতে পারছেন সব। তাই মুখে কিছু বলছেন না। কিছুক্ষণ এই ভাবে চলার পর, হঠাৎই স্পিড বাড়িয়ে সামনের ফ্লাইওভারে উঠে গেল গাড়িটা। খান সাহেবের গাড়ি ফ্লাইওভারের নীচে দিয়ে গিয়ে বাঁদিকে মোড় নিল। একটু এগোতেই বাঁ হাতে পড়ল মেরিল্যান্ড হসপিটাল।

হসপিটালের মূল তোরণ পাড় করে বড় কোলাপ্সিবল গেটের কাছে থামল খান সাহেবের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে দু’পা এগোতেই দু’টো লোক নজরে পড়ে তাঁর। কালো ট্রাউসার, কালো কোট, কালো টুপি, চোখে কালো সানগ্লাস পড়া লোক দু’টো যেন তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ছোটো ছোটো করা চুল ছাঁটা লোক দু’টোর চেহারাও কেমন যেন ষণ্ডা মার্কা। অনেকটা ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের মতো দেখতে তাঁদের। হতে পারে কেউ হয়তো দেহরক্ষী নিয়ে এসেছেন এখানে। কিন্তু খান সাহেবের মন বলছে, এই লোক দু’টো তাঁর জন্যই এখানে অপেক্ষা করছে। যা হোক, সেই সব চিন্তা মন থেকে সরিয়ে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হেঁটে হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি। ডান দিকে ইনকোয়ারি কাউন্টারের গিয়ে নিজের এপয়েনমেন্টের কথা জানালেন। হেল্পডেস্কে বসে থাকা ছিপছিপে তরুণী তাঁকে ৩ নম্বর ঘরের সামনে অপেক্ষা করতে বললেন। মেয়েটা তাঁকে আরও বলে, একজন পেশেন্ট ভিতরে আছেন। উনি বেরোলে আপনি ঢুকবেন।

৩ নম্বর ঘরের সামনে রাখা অনেকগুলো ফাঁকা চেয়ারের একটাতে গিয়ে বসলেন খান সাহেব। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখেন ষণ্ডা মার্কা লোক দু’টো ইনকোয়ারি কাউন্টারের কিছু জিজ্ঞাসা করছেন। তাঁদের মধ্যে একটা লোক তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন। পাশে রাখা ফাঁকা চেয়ারগুলোর একটাতে এসে বসল লোকটা। খান সাহেব বেশ বুঝতে পারছেন, নজর রাখা হচ্ছে তাঁর উপর। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কার সাথে দেখা করছেন সব কিছুর উপরই নজরদারি চলছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতের উপর নজর রাখা নতুন কোনও ঘটনা নয়। আবহমান কাল থেকেই সব দেশের সরকারই বিদেশি রাষ্ট্রদূতের উপর নজরদারি করে থাকেন। রাষ্ট্রদূত কার কার সাথে দেখা করছেন, কোথায় কখন যাচ্ছেন তার সব হিসাবই রাখেতে হয় সরকারকে। তাঁদের মুলুকেও এই নজরদারির প্রথা চালু আছে। তবে সেই সমস্ত কর্মকাণ্ড হয় অত্যন্ত গোপনে। কেউ টেরও পায় না যে তাঁর উপরে নজরদারি করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তো প্রকাশ্যে নজরদারি করা হচ্ছে। তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। অর্থাৎ তাঁকে বলা হচ্ছে, দেখো আমরা তোমাকে অনুসরণ করছি। এটা নিছক নজরদারি নয়। তাঁকে ভয় দেখাতেই ইচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো হচ্ছে ঘটনাগুলোকে। আর ভয়টা তো তাঁকে দেখানো হচ্ছে না, ভয়টা দেখানো হচ্ছে তাঁর দেশের সরকারকে। তাঁর দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এমনিতেই বছর ভর দু’দেশের সীমান্তে উত্তেজনা বজায় থাকে। মাঝে মাঝে গুলি-গোলাও চলে। সেই পরিস্থিতি জেরেই তাঁর উপরে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই কূটনীতিরও তো একটা সীমা থাকা উচিত। এ ভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে যখন তখন তাঁকে, তাঁর পরিবারের সদস্যদের উত্যক্ত করাটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। নাহ্‌, তাঁর দেশের বিদেশ মন্ত্রকে জানাতেই হচ্ছে গোটা ব্যাপারটা। এই ব্যাপারে বিদেশ মন্ত্রক কি প্রতিক্রিয়া জানায় তা জানা প্রয়োজন তাঁর।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে সেই ষণ্ডা মার্কা লোক দু’টোকে আর দেখতে পেলেন না খান সাহেব। সোজা গাড়িতে না গিয়ে হাসপাতালের একটু নিরিবিলি বাগানের দিকে চলে গেলেন খান সাহেব। গাড়ির ড্রাইভারের সামনে ফোন করতে চান না তিনি। ফাঁকা এই অঞ্চল থেকে ফোন করলেন তাঁর দেশের বিদেশ সচিবকে।

‘বলুন জনাব’, ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো পুরুষ কণ্ঠ। খান সাহেব একে একে বলতে শুরু করলেন কি ভাবে তাঁকে, তাঁর পরিবারকে ভয় দেখিয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মাঝ রাতে ডোরবেল বাজিয়ে কিভাবে তাঁর ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো হচ্ছে। তিনি জানতে চান কি করা উচিৎ এখন তাঁর?

খান সাহেবকে বলা হলো, আপনি ওই দেশের ‘মিনিস্ট্রি অব ফরেন এফেয়ার্স’এ কমপ্লেইন লজ করুন। আর আমরা এদিকে দেখছি টিটের জবাব কী ভাবে ট্যাট দিয়ে দেওয়া যায়।

* * *

সত্য ঘটনার উপর আধারিত কল্পনাশ্রয়ী এই কাহিনীর দুই প্রতিবেশী দেশ হলো ভারত ও পাকিস্তান। কূটনীতির জেরে দু’দেশের হাইকমিশনারই প্রায় একই ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করা হয়েছে তাঁদের। এমন ভাবে বিরক্ত করা হয়েছে যে সরাসরি দোষারোপও করা যাবে না কাউকে। শুধু শুধু ফলো করা হয়েছে পরিবারের সদস্যদের। যাঁরা ফলো করছেন তাঁরা কোনও ক্ষতি করছেন না, কিন্তু হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে আমরা সব লক্ষ্য রাখছি কিন্তু। মাঝ রাতে ডোরবেল বাজিয়ে উত্যক্ত করা হয়েছে। কোনও দিন আবার মাঝ রাতে মোবাইলে মিসকলড আসে। মাঝ রাতে ল্যাণ্ড লাইনে ফোন করে বিরক্ত করা হয়েছে দু’দেশের হাইকমিশনারকেই। হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে রাষ্ট্রদূতের কার্যালয়ের কর্মচারীদেরও। কার্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীরা জানান প্রায়ই তাঁদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইলেকট্রিক অফিসে খবর দিলেও কাজ হয় ঢিমে গতিতে। বিকল করে রাখা হয় ফোনের ল্যাণ্ড লাইন। বিভিন্ন ভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয় কার্যালয়ের কর্মচারীদেরও।

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার জেরে সম্প্রতি নতুন এই কূটনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে দুই দেশ। এক দেশ অন্য দেশের হাইকমিশনারকে উত্যক্ত করতে থাকেন। কে আগে কার রাষ্ট্রদূতকে উত্যক্ত করেছেন শত চেষ্টা করলেও তা কোনও দিনও জানা যাবে না। রাষ্ট্রদূতদের বিরক্ত করা ঘটনাটা সামনে আসে ২০১৮ সালে। চাপ সৃষ্টির এই খেলায় তিতি বিরক্ত হয়ে উঠেন নিউ দিল্লীতে অবস্থিত পাকিস্তানি হাইকমিশনার। ১৩ মার্চ ২০১৮ সালে ভারতের ‘মিনিস্ট্রি অব ফরেন এফেয়ার্স’এ এক গুচ্ছ অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। কিছুদিন পরে এক বিবৃতিতে পদস্থ এক ভারতীয় আধিকারিক জানান, পাকিস্তানি গোয়েন্দা দপ্তর আইএসআই ক্রমাগত নজরদারি চালাচ্ছেন ভারতীয় কর্মচারীদের উপর। পাকিস্তানে অবস্থিত ভারতের পদস্থ কর্মীদের বাড়িতে মাঝরাতে কারা ডোরবেল বাজিয়ে পালিয়ে যান। অর্থাৎ দু’দেশের রাষ্ট্রদূত বা পদস্থ কর্মচারীরা ডোরবেলের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় দু’দেশের এই কূটনৈতিক প্রতিহিংসা ডোরবেল নামে খ্যাত। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, দু’দেশের মধ্যে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি কথা বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু তাঁদের এই মিষ্টি কথা আদতে যে মিছরির ছুরি তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি পোড় খাওয়া কূটনীতিবিদদের। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল বক্রহাসি হেসে মনে মনে বোধহয় ধন্য ধন্য করেছেন এমন বিচিত্র কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা জেনে।

।। ২ ।।

মানুষের মনের গভীরে কত যে বিচিত্র রকমের খেয়াল বাসা বেঁধে থাকে তার হদিশ হয়তো বা সে নিজেও রাখে না। কিন্তু আমরা যখন সেই সব অদ্ভুত খেয়ালের কথা যখন জানতে পারি, তখন ‘হাসবো না কাঁদবো’র মতো দশা হয় আমাদের। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন ঠিক কি বলতে চাইছি আমি। ধরুন, ‘ভরপেট খেয়ে রোগা হওয়ার উপায়’ নিয়ে ভেবে চলেছেন কেউ। না, না, শুধু ভেবেই ক্ষান্ত হন নি তিনি। তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে লিখে ফেলেছেন আস্ত একটা গবেষণাপত্র। আবার ধরুন ‘ডার্ক বাল্ব’এর কথা। ডার্ক বাল্বের বিষয় বস্তুর কথা শুনলে আবারও হতবম্ভ হতে হবে আপনাকে। আমরা সবাই জানি, বৈদ্যুতিক বাল্ব বা বাতি থেকে আলো বিকীর্ণ হয়। তাহলে এমন একটা বাল্ব নির্মাণ করা নিশ্চয় সম্ভব, যে বাল্ব আলো বিকিরণের বদলে আলো শোষণ করবে। সেই বাল্ব জ্বালানো মাত্রই ঘরে নেমে আসবে অন্ধকার।

কি মনে হচ্ছে? এগুলো সব পাগলের প্রলাপ? আজ্ঞে না, এগুলো ঘোর বাস্তব। ওই যে বললাম, মানুষের বিচিত্র সব খেয়াল। না জানি কোন পাগলের ইশারায় জন সমক্ষের অন্তরালে, এমনই হরেক বিষয়বস্তু নিয়ে একনিষ্ঠ চিত্তে গবেষণা করে চলেছেন কত শত গবেষক। তাঁদের সেই প্রতিপাদ্যগুলো আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো পাগলামো পর্যায়েই পড়ে। অথচ বিচিত্র সেই সব প্রতিপাদ্যগুলোই কিন্তু গোগ্রাসে গিলতেন ইসরায়েলের পদার্থবিদ হ্যারি জিনট লিপকিন (১৯২১-২০১৫)। সেই সমস্ত প্রতিপাদ্যগুলো পড়ে ভারি মজা পেতেন তিনি। তিনি ভাবতেন, বিজ্ঞান মানে সব সময় খুব সিরিয়াস কিছু হতে হবে, তা কেন? এই তো, বিজ্ঞানের কত মজাদার বিষয়ের উপর গবেষণা ছড়িয়ে আছে চারিধারে। এই গবেষণাপত্রগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে মানুষের বিচিত্র সব চিন্তা ভাবনার হদিশ, তেমনই এই গবেষণাপত্রগুলোর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে হাসি আর মজার খোরাকও। তিনি তাই মনে করতেন সেই সমস্ত উদ্ভট গবেষণাপত্রগুলোও প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু কে করবে সেই সমস্ত হাবিজাবি অর্থহীন গবেষণাপত্র প্রকাশ? বিজ্ঞান জগতে এমন পত্রিকা প্রচুর রয়েছে যেখানে মূলধারার গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়ে থাকে। কিন্তু যে সমস্ত গবেষকরা উদ্ভট একটা প্রতিপাদ্য প্রমাণ করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের গবেষণাপত্রগুলো কে প্রকাশ করবে?

একদিন কথাচ্ছলে, বিষয়টা নিয়ে তিনি আলোচনা করছিলেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডা. আলেক্সান্দার কনের সাথে। উদ্ভট ও মজাদার গবেষণাপত্র প্রকাশ করা নিয়ে লিপকিনের বিচিত্র প্রস্তাব কিন্তু মনে ধরল ডা. কনের। রাজি, বিচিত্র ও মজাদার গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য নতুন একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে রাজি আছেন ডা. কন। তাহলে আর দেরি কেন? ১৯৫৫ সালে দুই বন্ধুর উদ্যোগে, ইসরায়েলের নেস জিয়োনা (Ness Ziona) শহর থেকে প্রকাশিত হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে কোনও শাখার উপর আধারিত উদ্ভট ও মজাদার গবেষণাপত্র সম্বলিত পত্রিকা ‘জার্নাল অব ইররিপ্রোডিউসেবল রেসাল্টস্‌’ (Journal of Irreproducible Results, JIR)। এটাই হলো বিজ্ঞানের প্রথম প্যারডি (parody) পত্রিকা। প্রতি দু’মাস অন্তর (বছরে ৬টা সংখ্যা) প্রকাশিত এই পত্রিকায় ঠাঁই পেল বিজ্ঞানের যাবতীয় কৌতুকপূর্ণ, ব্যঙ্গাত্মক, শ্লেষাত্মক রচনা সমূহ, যে রচনাগুলো এতোদিন পর্যন্ত ব্রাত্য ছিল বিজ্ঞানের মূলধারার পত্রিকার কাছে।

পাঁচের দশকের শেষের দিকে কর্মসূত্রে ইউএসএতে পাড়ি জমাতে হয় লিপকিনকে। সেই সূত্রে ইসরায়েল থেকে ইউএসএতে স্থানান্তরিত হলো পত্রিকার সদরদপ্তরও। আরও কিছু কাল পরে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি নেন লিপকিন। ১৯৯০ সালে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিতের স্নাতক, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ মার্ক আব্রাহামস্‌ (Marc Abrahams)। পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পরই, লিপকিনের মতাদর্শের যোগ্য উত্তরসূরি মার্ক ভাবলেন, শুধু রচনা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হবো কেন? ব্যতিক্রমী এই সব গবেষকদের উপযুক্ত পুরস্কারে সম্মানিত করা হবে নাই বা কেন? সেই মতো, ১৯৯১ সাল থেকে প্রায় তাঁর একক উদ্যোগে চালু হয় ‘ইগ নোবেল’ (Ig Nobel) পুরস্কার। ইংরাজি অভিধানে ‘ইগ’ কথাটার কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। নোবেল পুরস্কারের বিপরীতার্থে, ব্যঙ্গার্থে নোবেলের আগে ‘ইগ’ কথাটা যুক্ত করা হয়েছে। JIR পত্রিকার মূল ভাবনার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে, ঠিক করা হলো ইগ নোবেল পুরস্কার তাঁদেরই দেওয়া হবে যাঁদের গবেষণা বা কর্মকাণ্ডের মধ্যে হাসি, ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপের খোরাক থাকবে, অথচ সেই গবেষণার মধ্যে কিছু ভাবনার উপকরণও থাকবে। তাঁদের ট্যাগ লাইনে ইগ নোবেল কমিটি তাই লিখলো Research that makes people laugh and then think। তাঁরা ঠিক করলেন প্রতি বছর মোট ১০টা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা সেরা গবেষণাকে ইগ নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হবে। তবে কোন ১০টা বিষয়ের উপর পুরস্কার দেওয়া হবে তা নির্দিষ্ট করা হলো না। প্রয়োজন পড়লে ইগ নোবেলের তালিকায় যুক্ত হতে পারে নতুন কোনও বিষয়ও। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্থনীতি, জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য, শান্তি প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও পুষ্টিবিজ্ঞান (Nutrition), মনোবিজ্ঞান (Psychology), অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিজ্ঞান (Anatomy), ধাত্রীবিদ্যা (Obstetrics), জনস্বাস্থ্য (Public health), পশু চিকিৎসা (Veterinary), পুরাতত্ত্ব (Archaeology), ধ্বনি বিজ্ঞান(Acoustics), আবহাওয়া বিজ্ঞান (Meteorology), পরিচালনবিদ্যা (Management), ক্রেতা বিজ্ঞান (Consumer engineering) প্রভৃতি হরেক বিষয়ের উপর আধারিত গবেষণাকে ইগ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়ে থাকে। কেমন হতে পারে সেই গবেষণা, যার জেরে ইগ নোবেল পুরস্কার লাভ করে থাকেন কোনও গবেষক? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৯৩ সালে অর্থনীতিতে ইগ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন রবীন্দ্রনাথ বাত্রা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ইউএসএ নাগরিকের লেখা একাধিক বই কিন্তু ‘বেস্ট সেলার’এর তকমা ছিনিয়ে নিয়েছে। তাঁর লেখা ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন অব ১৯৯০’ ও ‘সার্ভাইভিং দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন অব ১৯৯০’ বই দু’টোও ছিল ‘বেস্ট সেলার’। আর ঠিক এই বই দুটোর জন্যই তাঁকে ইগ নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। কেন, বুঝলেন না? ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ চলাকালীন গ্রেট ডিপ্রেশনের উপর বই লিখে বেস্ট সেলার হিসেবে ‘গ্রেট ইনকাম’ করে ফেলেছেন তিনি। এর থেকে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে?দারিদ্রের উপর বই লিখে ধনী হওয়া যাকে বলে। আছে না বিষয়টার মধ্যে একটা টুইস্ট?

তাহলে সম্মান কোথায়? ইগ নোবেল প্রাপকদের তো শেষমেশ ব্যঙ্গই করা হলো। এতো অপমান! হ্যাঁ, তা বটে। কারও গবেষণাকে হাস্যস্পদ করে প্রচার করা তো অপমানেরই সামিল। আর ঠিক সেই কারণেই অনেকেই ক্ষুব্ধ ইগ নোবেল পুরস্কারের উপর। সেই কারণে পুরস্কার নিতেই আসেন না অনেক প্রাপক। যেচে যেচে মঞ্চে উঠে কেন অপমানিত হতে যাবেন তাঁরা? আবার বেশ কিছু পুরস্কার প্রাপক কিন্তু বিষয়টাকে মজার ছলে নিয়ে দিব্যি মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ইগ নোবেল পুরস্কারের স্রষ্টা মার্ক আব্রাহামসের ভাষায়, ‘Some people covet it, others flee from it. Some see it as a hallmark of civilization, others as a scuff mark. Some laugh with it, others laugh at it. Many praise it, a few condemn it, others are just mystified. And many people are madly in love with it. It is the Ig Nobel Prize.’

হ্যাঁ একথা সত্য, অজস্র সমালোচনার পাশাপাশি ইগ নোবেল নিয়ে উন্মাদনাও রয়েছে যথেষ্ট। আর সেই উন্মাদনার সাথে তাল মিলিয়ে মঞ্চে উঠে রসিকতা করতে পিছপা হন না পুরস্কার প্রাপকরাও। তাঁদের সেই রসিকতায় হাবুডুবু খাওয়া দর্শকরা কাগজের উড়োজাহাজ বানিয়ে ভাসিয়ে দেন মঞ্চ লক্ষ্য করে। সেও এক উপভোগ্য দৃশ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে কাগজের উড়োজাহাজ উড়ে আসছে মঞ্চ লক্ষ্য করে। সেই মজার দৃশ্যই শেষ পর্যন্ত ট্রাডিশন হয়ে দাঁড়ায় ইগ নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানের। প্রতি বছর অনুষ্ঠানের দিন ঝাঁকে ঝাঁকে কাগজের উড়োজাহাজ উড়ে আসে মঞ্চের দিকে। অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ জুড়ে পড়ে থাকে অজস্র কাগজের উড়োজাহাজ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যশালী স্যান্ডার্স থিয়েটারে প্রতি বছর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। উড়োজাহাজাকীর্ণ ঐতিহ্যশালী সেই মঞ্চকে পরিষ্কার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে ঝাড়ু হাতে অবতীর্ণ হন বিখ্যাত পদার্থবিদ রয় জে গ্লবার (১৯২৫-২০১৮)। প্রতি বছর নিয়ম করে মঞ্চ পরিষ্কার করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন তিনি। বিরল এই কাজের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতাকে সম্মান জানাতে তাঁকে ‘কিপার

ইগ নোবেল মঞ্চ পরিস্কার করছেন রয় জে গ্লোবার

অব দ্য ব্রুম’ (Keeper of the Broom) বা ‘ঝাড়ুর রক্ষক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। ২০০৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে (আসল) নোবেল পুরস্কার জেতেন গ্লবার। স্টকহোম শহরে নোবেল পুরস্কার গ্রহণে ব্যস্ত থাকায় সেই বছর ইগ নোবেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের অফিশিয়াল ঝাড়ুদারের ভূমিকা পালন করতে পারেন নি তিনি। মজার বিষয় হলো, নোবেল পুরস্কার জিতলেও ইগ নোবেল ঘনিষ্ঠ এই মজাদার মানুষটি কিন্তু ইগ নোবেল পুরস্কার জিততে পারেন নি কোনদিনও! তবে আছেন, এমন একজন আছেন যিনি নোবেল ও ইগ নোবেল দুটো পুরস্কারই জিতেছেন। রাশিয়া জাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ আন্দ্রেই গেইম (Andre Geim) হলেন এই পর্যন্ত (২০২০) একমাত্র ব্যক্তি যিনি পদার্থ বিজ্ঞানে ইগ নোবেল (২০০০) ও নোবেল (২০১০) উভয় পুরস্কারই জিতেছেন দু’টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার জন্য। শুরুতেই বলছিলাম না, কত বিচিত্র রকমের বিষয় নিয়ে গবেষণা করে থাকেন একজন মানুষ তা জানতে পারলে আশ্চর্য হতে হয় আমাদের। তাঁর সেই গবেষণাগুলোর মধ্যে একটা হয়তো নিছকই উদ্ভট খামখেয়ালিপনা, আবার অন্যটা হয়তো খুবই ভাবগম্ভীর ব্যাপারস্যাপার। মানুষের এই বিচিত্র প্রকৃতির তরতাজা উদাহরণ হলেন আন্দ্রেই গেইম। আর ঠিক এই কথাটাই তো সবার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন লিপকিন।

১৯৯৪ সাল, লিপকিনের সাধের ‘জার্নাল অব ইররিপ্রোডিউসেবল রেসাল্টস্‌’এর মালিকানা তথা প্রকাশনা সংস্থার বদল ঘটে। পত্রিকা ছাপানো ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নতুন ম্যানেজমেন্টের সাথে বিরোধ বাঁধে সম্পাদক মার্ক আব্রাহামসের। প্রতিবাদে মার্ক সহ এক ঝাঁক কর্মচারী পদত্যাগ করেন পত্রিকা থেকে। লিপকিনের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ মার্ক কিন্তু এই পত্রিকার গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট ভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। এই পত্রিকা তাঁর জীবন। তিনি হলেন ইগ নোবেল পুরস্কারের স্রষ্টা। পত্রিকার সেই জগতকে ছেড়ে কি করে শ্বাস নেবেন তিনি? তিনি তাই ঠিক করলেন, একই ধাঁচের নতুন আরেকটা পত্রিকা প্রকাশ করবেন তিনিও। রাতারাতি সিদ্ধান্ত নেন পদত্যাগী কর্মচারীরাও। আছেন, তাঁরাও আছেন মার্কের নতুন পত্রিকার সাথেই। মার্চ ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হলো বিজ্ঞানের দ্বিতীয় প্যারডি পত্রিকা অ্যানালস্‌ অব ইমপ্রোবাবেল রিসার্চ (Annals of Improbable Research, AIR)। ১৯৯৪ সাল থেকে এই পত্রিকার তত্ত্বাবধানেই জারি রইল ইগ নোবেল পুরস্কার প্রদানের প্রথা। ইগ নোবেল প্রদানের কোনও অধিকার নেই AIR পত্রিকার- এই মর্মে আদালতের দ্বারস্থ হলেন JIR পত্রিকার পরিচালন গোষ্ঠী। মার্কের নতুন পত্রিকার পক্ষেই অবশ্য রায় দান করেন আদালত। ফলে ১৯৯৪ সাল থেকে AIR পত্রিকার তরফ থেকে প্রদান করা হতে লাগলো ইগ নোবেল পুরস্কার।

প্রতি বছর শরৎকালের (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের) কোনও এক বৃহস্পতিবার ইগ নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রাপকদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন আসল নোবেল জয়ী কোনও এক অতিথি। বুঝুন কাণ্ড, আসল নোবেল জয়ী পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন নকল নোবেল জয়ীর হাতে। ব্যঙ্গের যেন শেষ নেই ইগ নোবেলে। সাধেই কি আর লোকে ক্ষুব্ধ ইগ নোবেলের উপর। তা সে যে যতই রাগ করুন না কেন, ইগ নোবেল কমিটি কিন্তু নির্বিকার। স্বভাবসিদ্ধ ঐতিহ্য বজায় রেখে তাঁরা কিন্তু মজার ছলে বিদ্রুপ করে চলেছেনই। তাঁদের বিদ্রুপের বর্শামুখ থেকে রেহাই পান নি আচ্ছা আচ্ছা পদস্থ লোকজন, কর্পোরেট সংস্থা কিম্বা সরকারী দপ্তর। এমনকি বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রীপ্রেসিডেন্টকে নিয়েও বিদ্রুপ করতে পিছপা হননি তাঁরা। শুনলে অবাক হবেন, ১৯৯৮ সালে যৌথ ভাবে শান্তিতে ইগ নোবেল প্রদান করা হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে। কেন? পারমানবিক বোমা পরীক্ষার জন্য। ১৯৯৮ সালের মে মাসে রাজস্থানের পোখরানে পারমানবিক বোমা পরীক্ষা করে ভারত। জবাবে, ১৫ দিনের মধ্যে চাঘাই অঞ্চলে পারমানবিক বোমা পরীক্ষা করে পাকিস্তানও। তাঁদের এই ‘aggressively peaceful explosions of atomic bombs’এর জন্য শান্তিতে ইগ নোবেল প্রদান করা হয় তাঁদের। না, শুধু ভারত বা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকেই ইগ নোবেল পুরস্কারে (অ)সম্মানিত করা হয় নি। ইগ নোবেলের (অ)সম্মানের তালিকায় আছেন ব্রাজিল, মেক্সিকো, ফ্রান্স, বেলারুশ, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের প্রধানমন্ত্রীরাও। আছেন ইউকের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, আছেন ইউএসএর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তাঁদের বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়েছে নামী দামী কর্পোরেট সংস্থাগুলোকেও। সেই তালিকার মধ্যে রয়েছে মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ফোকসওয়াগন (Volkswagen), পেপসিকোলা কোম্পানি অব ফিলিপিন্স, ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা মার্ক (Merck), আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি সমেত আরও অনেক সংস্থা। তাঁদের বিদ্রুপ থেকে বাদ পড়েনি দ্য ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স, ইতালির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকস্‌, ব্যাঙ্কক মেট্রোপলিটান পুলিশ, ব্রিটিশ রয়েল নেভি, ভ্যাটিকান সিটির প্রশাসনের মতো সরকারী দপ্তরও। বিদ্রুপের ছলেই এক ভ্রষ্টাচারকে উন্মোচন করে থাকে ইগ নোবেল। ইগ নোবেল প্রাপকদের এক একটা কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক এক অজানা বিস্ময়। তেমনই এক বিস্ময় নিয়ে বিশ্বের সামনে তাঁরা হাজির করেছেন লাল বিহারিকে। কে এই লাল বিহারি? কেন বিস্ময় তৈরি হয়েছে তাঁকে ঘিরে? এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক লাল বিহারি বৃত্তান্ত।

১৯৭৬ সালে ব্যবসার স্বার্থে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণের আবেদন করেন উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলার বাসিন্দা লাল বিহারি। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, তাঁকে ঋণ দেওয়া যাবে না। কারণ হিসেবে তাঁরা জানান, তাঁদের কাছে রাখা নথিতে দেখা যাচ্ছে লালবিহারি মৃত। মৃত ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। লাল বিহারি জানান, তিনি মৃত হবেন কি করে? তিনি তো তাঁদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানান তাঁর পরিচয় জানা তাঁদের কাজ নয়। তাঁদের কাছে প্রমাণ আছে লাল বিহারি মৃত। বিপন্ন লাল বিহারি বিভিন্ন সরকারি অফিসে দৌড়াদৌড়ি করে জিগেস করেন, আমি স্বয়ং যখন আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তখন আমাকে মৃত ঘোষণা করা হলো কেন? সে নয় একটা ভুল হতে পারে। এখন তো আমাকে জীবিত বলে ঘোষণা করা হোক, যাতে আমি সরকারী সুযোগ সুবিধা পাই। মানুষ মারা গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করার ক্ষমতা থাকলেও, মরা মানুষকে জীবিত ঘোষণা করার কোনও আইন না থাকায় কোনও সুরাহা হয় না লাল বিহারির। লাল বিহারির এই বিপত্তির খবর প্রকাশিত হয় এক দৈনিক পত্রিকায়। সেই সূত্রেই সামনে আসে লাল বিহারির ঘটনা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লাল বিহারির মতো আরও অন্তত শত খানেকেরও বেশি এমন মানুষ আছেন উত্তরপ্রদেশে, সরকারি কাগজে যাঁরা মৃত, অথচ তাঁরা দিব্যি জীবিত রয়েছেন তখনও। এই সমস্ত ‘মৃত’ মানুষেরা এককাট্টা হতে থাকেন লাল বিহারির নেতৃত্বে। সরকারি অপদার্থতাকে ব্যঙ্গ করতে নিজের নামের শেষে ‘মৃতক’ উপাধি যুক্ত করেন লাল বিহারি। সেই থেকে ‘লাল বিহারি মৃতক’ নামে অধিক পরিচিত হয়ে উঠেন তিনি। এই সমস্ত ‘মৃত’ ব্যক্তিরা ‘মৃতক সঙ্ঘ’ নামে একটা দল গঠন করেন। নিজেদের জীবিত প্রমাণ করতে, ১৯৮৯ সালে আমেঠি লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে মৃতক সঙ্ঘের প্রার্থী হিসেবে লাল বিহারি মৃতককে প্রার্থী করা হয়। তাতেও সরকারি ভাবে ‘জীবিত’ স্বীকৃতি জোটে না মৃতকের। অবশেষে ১৯৯৪ সালে সরকারের তরফ থেকে তাঁকে জীবিত ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে লাল বিহারির এই ব্যতিক্রমী আন্দোলনের স্বীকৃতিতে এবং প্রশাসনের অপদার্থতাকে উন্মোচন করতে ২০০৩ সালে শান্তিতে ইগ নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় লাল বিহারিকে। প্রসঙ্গত, এই বছরেই (২০২১) মুক্তি পেয়েছে সতীশ কৌশিক পরিচালিত লাল বিহারির বায়োপিক ‘কাগজ’। ফিল্মে লাল বিহারির চরিত্রে অভিনয় করেছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি। শেষ খবর অনুযায়ী, চুক্তি ভঙ্গের কারণে পরিচালক সতীশ কৌশিকের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করেছেন লাল বিহারি মৃতক। মৃতকের অভিযোগ, ফিল্মের নাম ‘ম্যায় জিন্দা হুঁ’ রাখার কথা ছিল। কিন্তু মৃতককে না জানিয়ে ফিল্মের নাম রাখা হয়েছে ‘কাগজ’। সতীশ নিজে ফিল্মের প্রযোজনা করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায় সেই ফিল্মের প্রযোজনা করেছেন অভিনেতা সলমন খান। এছাড়াও ফিল্মে তাঁকে ব্যাণ্ড (তাসা) বাদক হিসেবে দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তিনি কোনও দিনও ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন না।

সবই তো হলো, কিন্তু গল্প শুরুর ডোরবেল কূটনীতির সাথে ইগ নোবেলের সম্পর্কটা কি? মার্চ ২০১৮ সালে ভারতের ‘মিনিস্ট্রি অব ফরেন এফেয়ার্স’এ ডোরবেল ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন পাকিস্তানি হাইকমিশনার। এরপরই সমস্ত বিশ্বের নজরে পড়ে ডোরবেল কূটনীতি। উভয় দেশের হাইকমিশনারের বাড়িতে প্রায়ই মাঝরাতে বেজে উঠেছে ডোরবেল। কেউ ডোরবেল বাজিয়েই ধাঁ। রাস্তা শুনশান, কেউ নেই চারিধারে। চাঁদা বা অন্য কোনও কারণে পাড়ার ছেলেদের সাথে মনোমালিন্যের জেরে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে হয়তো আমাদের অনেকেই। তাই বলে মাঝরাতে হাইকমিশনারের বাড়িতে ডোরবেল বাজানো! কূটনীতি নিয়ে এহেন শিশু সুলভ আচরণের সংবাদে দারুণ মজা পেয়েছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের কূটনীতি বিশারদরা। না হেসে উপায় কি আছে তাঁদের। আর এই মজাদার অথচ সিরিয়াস বিষয়কে সামনে তুলে ধরাই তো ইগ নোবেলের কাজ। তাই বিরল সেই কূটনীতির স্বীকৃতিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ২০২০ সালের শান্তিতে ইগ নোবেল সম্মানে(!) ভূষিত করা হয়। তবে অতিমারির জেরে গত বছরের পুরো ইগ নোবেল অনুষ্ঠানটাই অনলাইনে আয়োজন করতে হয়েছিল। এবারও অনলাইনেই প্রদান করা হবে ইগ নোবেল পুরস্কার। এখন জানতে উৎসাহ বোধ করছেন কি, কে হবেন এবারের ইগ নোবেল বিজেতা? জানতে ইচ্ছা করছে কি, কেমন মজা হয়ে থাকে ইগ নোবেল প্রদান অনুষ্ঠানে? কোনও চিন্তা নেই, এইবার আপনিও সরাসরি যোগ দিতে পারবেন অনলাইন ইগ নোবেল অনুষ্ঠানে। ইগ নোবেলের সাইটে যোগাযোগ করুন আর আপনার ইমেল অ্যাড্রেস নথিভুক্ত করে রাখুন। ২০২১ সালে ৩১ তম ইগ নোবেল প্রদান করা হবে ৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার, ইউএসএ সময়ে সন্ধ্যা ৬টায়। কী,ইগ নোবেলের মজা নিতে সেদিনের অনলাইন অনুষ্ঠানে হাজির থাকছেন তো তাহলে?  

গ্রন্থপঞ্জী :

মার্ক আব্রাহামসের লেখা কয়েকটা বই ছাড়া ইগ নোবেল নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও গ্রন্থ চোখে পড়েনি আমার। ওয়েবসাইট বা ইউটিউবে ‘ইগ নোবেল’ সার্চ করলে অনেকগুলো সাইট পাওয়া যাবে। সেই সমস্ত সাইটগুলোই এই রচনার আকর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যে ইগ নোবেলের নিজস্ব improbable.com থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। কয়েকটা দৈনিক পত্রিকার অনলাইন আর্কাইভ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।