অথ ‘ধানের খেতে বেগুন’ বা ‘হাঁসজারু’-ঘটিত কথা
ইদানীং ঔপনিবেশিক গবেষণার সহায়তায় ইউরোপীয় শাসনের সময়ে কীভাবে ‘মূল কেন্দ্র’-এর (metropole) স্বার্থে উপনিবেশগুলিকে শোষণ করা হয়েছে সেই বিবরণ, বিশ্লেষণের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসকরা কীভাবে নিজেদের প্রয়োজনে উপনিবেশগুলির সাবেক চেহারাকে ভেঙ্গেচুরে নতুন রূপ দিয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এমনকি ইতিহাস-চিন্তাতেও পরিব্যক্তি ঘটিয়েছে তার বয়ান তৈরি হয়েছে।[1] আমরা জানতে পারছি যে Rationalist historiography-র প্রভাবে কীভাবে পুরাণেতিহাসের অবলুপ্তি ঘটে আর ইতিহাসের এক নতুন ভাষ্যের জন্ম হয়। তবে একদম হাল আমলের কিছু গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব একমুখী ছিল না। একদিকে যেমন বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস রচনা ও চর্চার ধরন বদলাচ্ছিল, তেমনি উপনিবেশের সংস্পর্শে এসে মূল কেন্দ্রের সময় ভাবনাও অবিকৃত থাকে নি। একেই সাম্প্রতিক সময়ে এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ‘Clash of Chronologies’ বলেছেন।[2] আমরা সেই ‘শোধনবাদী’ ইতিহাস চর্চা (Revisionist historiography)-র অনুসরণে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে এদেশের ইতিহাস রচনায় কী পরিবর্তন ঘটেছে তার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের ইতিহাস ভাবনায় কী পরিবর্তন এলো তার কয়েকটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করবো। কারণ, ইতিহাস শুধু যে কেবল অতীতের বিবরণ তাই নয়, তার নিজের গায়েও ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিচিহ্ন লেগে থাকে, সে নিজেও সময়ের সাথে বদলাতে থাকে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রবন্ধে আক্ষেপের সাথে বলেছিলেন,‘সাহেবরা যদি পাখি মারতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষদচরিত ও গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশে উদয়নাচার্য্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শম্যান স্টুয়ার্ট প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি, সে কেবল সাধ পূরণ মাত্র’।[3]
এর কিছু পরে বাংলার আর এক অন্যতম মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে [4] এদেশের ইতিহাস রচনা সম্পর্কে এমনই কিছু প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন:
‘ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং পড়িয়া মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র। কোথা হইতে কারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলেয়, ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, এক দল যদি বা যায় আরেকদল কোথা হইতে উঠিয়া পড়ে – পাঠান, মোগল, পর্তুগিজ, ফরাসী ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই দুঃস্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্নদৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে ভারতবর্ষকে দেখা হয় না। ভারতবাসী কোথায়, এ সকল ইতিহাস তাহার কোনো উত্তর দেয় না।’
অর্থাৎ তাঁরও অভিমত হল ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস নেই। কেন নেই? তার উত্তরে তিনি বলছেন,
‘ইতিহাস সকল দেশে সমান হইবেই, এ কুসংস্কার বর্জন না করিলেই নয়। যে ব্যক্তি রথচাইল্ডের জীবনী পড়িয়া পাকিয়া গেছে সে খৃস্টের জীবনীর বেলায় তাঁহার হিসাবের খাতাপত্র ও আপিসের ডায়েরি তলব করিতে পারে; যদি সংগ্রহ না করিতে পারে, তবে তাহার অবজ্ঞা জন্মিবে এবং সে বলিবে যাহার এক পয়সার সংগতি ছিল না তাহার আবার জীবনী কিসের? তেমনি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় দপ্তর হইতে তাহার রাজবংশমালা ও জয়পরাজয়ের কাগজপত্র না পাইলে যাঁহারা হতাশ্বাস হইয়া পড়েন এবং বলেন, যেখানে পলিটিক্স নাই সেখানে আবার হিস্ট্রি কিসের, তাঁহারা ধানের খেতে বেগুন খুঁজিতে যান এবং না পাইলে মনের ক্ষোভে ধানকে শস্যের মধ্যেই গণ্য করেন না। সকল খেতের আবাদ এক নহে, ইহা জানিয়া যে ব্যক্তি যথাস্থানে উপযুক্ত শস্যের প্রত্যাশা করে সেই প্রাজ্ঞ।’
এই দুটি নাতিদীর্ঘ উদ্ধৃতি দেবার উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথ বিজাতীয় ‘বালপাঠ্য’ বা স্কুলপাঠ্য ইতিহাস সম্পর্কে খড়্গহস্ত ছিলেন। এই বিজাতীয় ইতিহাসবোধ প্রতিষ্ঠিত হবার আগে দেশজ ইতিহাসবোধের পরিচয় কেমন ছিল?
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে দেশজ ইতিহাস চিন্তার ক্রমান্বয় পরিবর্তন:
ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তনের সময় থেকে ইতিহাসবোধের ক্রমান্বয় পরিবর্তন কীভাবে ঘটল তার সম্বন্ধে ধারণা পাওয়ার জন্য ওই সময়ে ইতিহাস কেমন করে লেখা হত সেটা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। ১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরি রামরাম বসুকে দিয়ে লেখালেন রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র। ১৮০৫ সালে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম’ আর ১৮০৮ সালে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার লিখলেন রাজাবলী।[5] প্রথম দু’টি চরিত সাহিত্যের আদলে লেখা, ফলে তাতে ঐতিহাসিক চরিত্রের সময়কার ঘটনা লেখা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার পৌরাণিক সময়ভাবনার সাথে সঙ্গতি রেখে একটি বিরাট সময়ের ‘পুরাণেতিহাস’ লিখেছেন।
মৃত্যুঞ্জয় লিখছেন:
“পিতৃকল্পাদি ত্রিংশত কল্পের মধ্যে ঘটীযন্ত্রের ন্যায় কালচক্রের ভ্রমণবশতো কল্প যাইতেছে একৈক কল্পতে চতুর্দ্দশ মনু হয় তাহাতে শ্বেতবরাহ কল্পের মধ্যে বৈবস্বত নামে সপ্তম মনু যাইতেছে। ইহার পরিমাণ ৪৩২০০০। ইহার মধ্যে ১৭২৬ পর্যন্ত গত ৪৯০৫ বৎসর। বাকি ৪২৭০৯৫। প্রথম ৩০৪৪ বৎসর ধরে প্রচলিত ছিল যুধিষ্ঠির রাজার শক। এই দুই শক গত”।[6]
ধাঁধার মত শোনাচ্ছে? পৌরাণিক সময়ভাবনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বয়ান পাওয়া যায় মনুর ধর্মশাস্ত্রে। সংক্ষেপে সেটা এই রকম: ১৮ বার চোখের পলক = ১ কাষ্ঠ (‘second’); ৩০ কাষ্ঠ = ১ কাল (‘minute’); ৩০ kal = ১ মুহূর্ত (‘hour’); ৩০ মুহূর্ত = ১ অহোরাত্র (day & night); ৩৬০ অহোরাত্র = ১ বৎসর (human year). মানুষের ১ বৎসর আবার দেবতাদের ১ দিন; উত্তরায়ণ দিন আর দক্ষিণায়ন রাত্রি। যুগের মোট সময়ঃ
কৃত যুগ
৪০০০+৪০০+৪০০*৩৬০= ১৭২৮০০০ বৎসর
ত্রেতা যুগ
৩০০০+৩০০+৩০০*৩৬০= ১২৯৬০০০ বৎসর
দ্বাপর যুগ
২০০০+২০০+২০০*৩৬০= ৮৬৪০০০ বৎসর
কলি যুগ
১০০০+১০০+১০০*৩৬০= ৪৩২০০০ বৎসর [7]`
পৌরাণিক সময়কাল কল্প, মনু, যুগ ও বৎসরে বিভক্ত। মৃত্যুঞ্জয় যে সময়ের ইতিহাস লিখেছেন সেটা সপ্তম বা বৈবস্বত মনুর অন্তর্গত ১১২ তম যুগ যার সূত্রপাত হয়েছিল মহাভারত যুদ্ধের পরে। যুধিষ্ঠির ছিলেন প্রথম রাজা। এরপর আরও ২৮ জন ক্ষত্রিয় রাজা ১৮১২ বৎসর রাজত্ব করবার পর এলো শূদ্র বংশীয় মহানন্দ এবং আরও ১৪ জন রাজা যাঁরা সব মিলিয়ে ৫০০ বৎসর ধরে রাজত্ব করবেন। এরপর বৌদ্ধ রাজাদের পালা। মধ্যবর্তী বেশ কয়েকটি বংশের শাসনকাল শেষে এলো চৌহান রাজপুত জাতি যার অবসানে শুরু হল মুসলমানদের রাজত্ব। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের নিজের সময় অর্থাৎ ১৭২৬ শকাব্দে দ্বিতীয় শাহ আলমের শাসনকালে এসে বিবরণ সমাপ্ত হয়েছে।[8] অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরের শাসনকাল থেকে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম পর্যন্ত ঐতিহাসিক ধারাবিবরণীতে কোন ছেদ পড়ে নি। পরবর্তীকালে পৌরাণিক বিবরণ আর ঐতিহাসিক বিবরণের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে তার কোন ইঙ্গিত বিদ্যালংকারের রচনায় দেখতে পাওয়া যায় না। এই পৌরাণিক সময় ভাবনায় দেখা যাচ্ছে যে সময়ের সাথে সাথে যত পাপ, অমঙ্গল পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছে ততই মানুষের আয়ু কমেছে, যুগের সময়কাল সংকুচিত হয়ে গেছে। তাই একে ইতিহাসের ‘ক্ষয়বাদী’ (degenerationist) দৃষ্টিভঙ্গী বলা যেতে পারে। পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গী ‘প্রগতিবাদী’ (developmental বা progressive view of history) দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সুস্পষ্ট তফাৎ রয়েছে।
শুধু যে সময়ভাবনায় তফাত ছিল তাই নয়, ইতিহাসের কার্যকারণ সম্পর্কও ভিন্ন ছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের বক্তব্য হল:
- পৃথিবীর প্রতিপালক শাসনকর্তারা পরমেশ্বর প্রেরিত
- রাজা ধর্মপালনার্থে রাজত্ব করেন
- যদি কোন কারণে অধর্ম হয়ে থাকে তবেই রাজ্যনাশ হয়।
দু-একটা উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক। যেমন মৃত্যুঞ্জয় মনে করেন পৃথ্বীরাজ শিহাবউদ্দিন ঘুরির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন অধর্ম ও ঈশ্বরেচ্ছার কারণে। প্রথমত পৃথ্বীরাজ ছিলেন পিতৃহন্তারক (যদিও তার কোন প্রমাণ নেই)। পিতৃহত্যার কারণে অখ্যাতি হওয়ায় সামন্তেরা সবাই কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর যখন শিহাবউদ্দিনের আক্রমণ সমুপস্থিত তখন পৃথ্বীরাজ একটি যজ্ঞ আয়োজন করেন কিন্তু ঈশ্বর বিরূপ থাকায় যজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় নি। যজ্ঞের পুরোহিতেরা জানালেন যে ঘুরির বিজয় অবশ্যম্ভাবী কারণ সেটাই ঈশ্বর আদিষ্ট। সেই কারণেই পৃথ্বীরাজ যুদ্ধে শৈথিল্য দেখান, পরাজিত ও বন্দী হন। আবার সিরাজের পরাজয়ের পিছনে দায়ী ছিল তাঁর নারীলোলুপতা ইত্যাদি পাপ। এই কারণেই তিনি ঈশ্বরের কোপে পড়েন এবং ইংরেজের কাছে পরাজিত হন। অন্যদিকে ‘নবাব জাফরালি খাঁ পুনর্বার দুই বৎসর সুবেদারী করিয়া সিরাজদৌল্লার সঙ্গে নিমখারামীর ফল গলৎকুষ্ঠ রোগে অতিশয় ব্যামোহ পাইয়া মরিলেন।’[9] সিরাজের নারীলোলুপতা আর মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে একই রকমের দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং রাজাবলীর ইতিহাসবোধ সম্পূর্ণরূপে প্রাক-ঔপনিবেশিক এবং পুরাণেতিহাসের আদর্শ নির্ভর। বর্তমানে যে ধরনের ইতিহাস চর্চার সাথে আমরা অভ্যস্ত তার সাথে রাজাবলীর তফাৎ খুবই স্পষ্ট।
নতুন এক ইতিহাস বোধের উন্মেষ: স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে সাক্ষ্য
ইংরেজি শিক্ষা, বিশেষ করে ইউরোপের ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতির চর্চা শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে চালু হতেই ইতিহাসের গল্প বলার পুরনো ছক ভেঙ্গে এক নতুন ছক তৈরি হতে শুরু করে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রকরণ অবলম্বন করে ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়ে যায় যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন স্কুলপাঠ্য বইয়ে দেখতে পাওয়া যায়। ১৮৫৭-৫৮ নাগাদ অনেকগুলি স্কুলপাঠ্য বাংলা ইতিহাসের বই প্রকাশিত হয়। সম্ভবত এগুলি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য পাঠ্য ছিল। এদের মধ্যে কয়েকটি হলঃ-
- কৃষ্ণচন্দ্র রায়, ভারতবর্ষের ইতিহাসঃ ইংরেজদিগের অধিকারকাল
- কান্তিচন্দ্র রাড়ি, ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
- রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস (বঙ্কিম যাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন)
এছাড়া খুবই জনপ্রিয় ছিল তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস। পাশাপাশি চলত নীলমণি বসাকের ভারতবর্ষের ইতিহাস।[10]
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের ইতিহাস চেতনার সাথে এই স্কুলপাঠ্য বইগুলির তুলনা করলেই তফাৎ স্পষ্ট হবে। যেমন ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠাকে ঈশ্বরেচ্ছা না বলে কৃষ্ণচন্দ্র রায় সম্পূর্ণ নীতিবর্জিত ক্ষমতার লড়াই হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন। মৃত্যুঞ্জয় যেখানে সিরাজের পতনের পিছনে নৈতিক অধঃপতনকে দায়ী করেছেন সেখানে কৃষ্ণচন্দ্রের অভিমত হল একজন সার্বভৌম রাজার পক্ষে নিজের রাজ্যে বিনা অনুমতিতে দুর্গ নির্মাণকে মেনে নেওয়া কখনই সম্ভব নয়। তাই দুর্গ ভেঙ্গে সিরাজ অন্যায় কিছু করেন নি। তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইতে সময়ের কালানুক্রমিক বিবর্তন বোঝাতে গিয়ে লিখছেন: ‘ভারতবর্ষ ক্রমান্বয়ে হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টানদিগের অধিকৃত হইয়াছে, এবং তদনুসারে এদেশের ইতিবৃত্ত হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টান এই তিন রাজত্বকালে বিভক্ত’।[11]
বিদ্যালংকারের সময়ভাবনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর চার যুগের ক্রমান্বয় চক্রাবর্তন উল্লিখিত হবে না কোনদিন। ১৮১৭ সালে তিন খণ্ডে জেমস মিলের A History of British India- তে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তিন যুগে ভাগ করার যে ধারা চালু হয়েছিল তারিণীচরণের লেখায় তার হুবহু অনুসরণ লক্ষ্য করা গেল। তফাৎ খালি এটুকুই নয় – বিদ্যালংকার যেখানে যুধিষ্ঠির থেকে নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ৫১ জন ক্ষত্রিয় রাজার ধারাবাহিক শাসনের কথা বলেছেন সেখানে ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান আত্মস্থ করে তারিণীচরণ লিখছেন, ‘ইউরোপীয় পুরাবিদেরা বিবিধ যুক্তি দ্বারা প্রতিপন্ন করিয়াছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খৃষ্টীয় শকারম্ভের চতুর্দ্দশ শতাব্দীর পূর্ব্বে ঘটিয়াছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর বহুকাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত এরূপ অপরিজ্ঞেয়,অসম্বন্ধ ও গোলযোগে আবৃত যে তাহা হইতে কোনরূপ বিবরণ সংকলন করা দুঃসাধ্য।’[12]
আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাস ভাবনার (যাকে আমরা Rationalist Historiography বলে চিহ্নিত করেছি) প্রভাবে ইতিহাস চিন্তায় যে পরিবর্তন এলো তা অনেকটা এই রকম:
মৃত্যুঞ্জয় যেভাবে কলিযুগের প্রারম্ভে যুধিষ্ঠির থেকে এক ধারাবাহিক রাজবৃত্তের কল্পনা করেছিলেন, উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণাদির অভাবে (যা Rationalist Historiography-র অবদান) তার অনেকটাই বাতিল হয়ে গেল।
আগে যা ছিল একেবারেই রাজারাজড়ার ইতিহাস, এখন সেখানে ক্রমে এক অখণ্ড জাতির ইতিহাস খোঁজা শুরু হল।
রাজত্ব পরিবর্তন আগে যেখানে ঈশ্বরের অঙ্গুলিহেলনে ঘটতো, এখন সেটাই হয়ে দাঁড়ালো সমগ্র জাতির উৎকর্ষ বা অপকর্ষের ফল।
পৌরাণিক ভূগোল ভাবনা (সপ্তদ্বীপা পৃথিবী, জম্বুদ্বীপ ইত্যাদির ধারণাও) বাতিল হয়ে গেল। আমরা এক নতুন বিশ্ব ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলাম যার মেজাজ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
ঔপনিবেশিক শাসকের লেখা ইতিহাস, প্রাচ্যবিদ্যার অবদান ও ফলাফল – কয়েকটি উজ্জ্বল উদ্ধার
আজকে স্বাধীন, সার্বভৌম ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দুটি অন্যতম প্রতীক হল ১. ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকার মধ্যে ‘চক্র’বা অশোকচক্র ২. অশোকস্তম্ভ। ভারতীয় রাজা/সম্রাটদের মধ্যে অশোকই প্রথম প্রায় সারা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন (সারা উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর লেখমালা তারই সাক্ষর)। অশোকচক্র বা অশোকস্তম্ভ এমন ভাবে আমাদের স্বত্তায় মিশে গেছে যে আমরা যেন এদের অস্তিত্বকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিয়েছি। অথচ বেশি আগের কথা নয়, চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলক দিল্লির নিকটবর্তী টোপরা গ্রামে শিকার করতে গিয়ে একটা ৪২ ফুট উঁচু পাথরের থাম দেখে চমৎকৃত হয়ে তাকে তুলে এনে নবনির্মিত ফিরোজ শা কোটলায় প্রতিষ্ঠা করলেন তখন কোন পণ্ডিতই এর ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করতে পারেন নি। লোকশ্রুতি হল, এগুলি ‘ভীমের লাঠি’ যা দিয়ে মহাভারতের ভীম হাঁটাহাঁটি করতেন! ফিরোজ শাহ বহু পণ্ডিতকে লাগিয়েও এই স্তম্ভের গায়ে উৎকীর্ণ লিপির পাঠোদ্ধার করাতে পারেন নি। তাহলে মধ্যবর্তী সময়ে কি এমন হল যে অশোকস্তম্ভ, অশোকের রাজাদর্শ স্বাধীন ভারতের মর্মবস্তু হয়ে উঠল ?! এ এক ডিটেকটিভ কাহিনীর মতই রোমাঞ্চকর গল্প যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিক শাসন, প্রাচ্যবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণা। এই আবিষ্কারের যোগফল হল পুরাণেতিহাসের অতিকথা (myth)-নির্ভর বিশাল সময়-ভাবনা খারিজ হয়ে যাওয়া, তার পরিবর্তে ‘ছোট সময়’এর প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া, এর পাশাপাশি rationalist historiography-র পদ্ধতি প্রকরণ, অর্থাৎ সাক্ষীসাবুদ নির্ভর ইতিহাস লেখার পদ্ধতি একমাত্র গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা। (যার কথা আমরা একটু আগে তারিণীচরণের লেখায় পেয়েছি)।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার যে পুরাণ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে তাঁর রাজাবলী লিখেছিলেন সেই পুরাণে (যেমন বিষ্ণু পুরাণ, মৎস্য পুরাণ বা বায়ু এবং ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ) মৌর্য বংশতালিকায় একজন আশোকবর্ধনের কথা পাওয়া গেলেও তাঁর কীর্তির কোন বিবরণ তাতে পাওয়া যায় না। তাহলে বিস্মৃতির অতল থেকে অশোক বা দেবনামপিয় পিয়দসসি অশোককে উদ্ধার করা সম্ভব হল কীভাবে?
ফিরোজ তুঘলক প্রতিষ্ঠিত ‘মিনারা এ জরি’বা ‘ফিরোজ কা লঠ’ এর মতই এলাহাবাদ দুর্গের মধ্যেও ছিল এক বিস্ময়কর স্তম্ভ। সপ্তদশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী উইলিয়াম ফিঞ্চ তাঁর বিবরণে সেই স্তম্ভের কথা বর্ণনা দিয়েছিলেন। আজ যেখানে লৌরিয়া নন্দনগড়ের অশোকস্তম্ভ রয়েছে, ১৬৭০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জন মার্শাল তাঁর বিবরণে তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুসারে এটি ছিল ‘ভীমের লাঠি’(জন মার্শাল লিখেছিলেন ‘Brinkalattee’)! ১৭৬৯ সালে জেসুইট কাপুচিন মিশনের সদস্য পাদ্রি দেল্লা তোম্বা নিকটবর্তী এলাকায় অনুরূপ থাম দেখার কথা লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু এই বিবরণগুলিতে কোথাও অশোকের নামগন্ধ ছিল না।
এমনই এক সন্ধিক্ষণে কলকাতায় নবগঠিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে ভারতে এলেন বহু ভাষাবিদ স্যার উইলিয়াম জোনস। কলকাতায় আসার প্রাক্কালে জোনস ভারতে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির আদলে একটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে মনস্থির করেন। ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি (Asiatik (c) Society) প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুপ্রীম কোর্টের গ্রান্ড জুরির ঘরে আয়োজিত অধিবেশনগুলিতে উইলিয়াম জোনস আর ওয়ারেন হেস্টিংসকে ঘিরে একদল শখের পুরাবিদ (antiquarian) তরুণের সমাবেশ ঘটতে থাকে। মাসিক অধিবেশনগুলিতে যে গবেষণাপত্র/প্রতিবেদনগুলি পড়া হত সেগুলি Asiatik Researches (পরে নাম বদলে Asiatic Researches) জার্নালে প্রকাশিত হতে শুরু করে।
উইলিয়াম জোনস খুব তাড়াতাড়ি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে ভারতে প্রাক-সুলতানি শাসনপর্বের ইতিহাস রচনার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল সুনির্দিষ্ট কালপঞ্জির (chronology) অভাব। এই সমস্যা সমাধানকল্পে তাঁর পরামর্শ ছিল Synchronology-র অনুসরণ। Synchronology কি? যদি সাল জানা কোনও ঘটনার সাথে তারিখ না জানা ঘটনার সম্পর্ক স্থাপন করা যায় তাহলে তারিখহীন ঘটনার সময় সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। এই কাজে জোনসের ধ্রুপদী ভাষার (গ্রিক, ল্যাটিন, আরবি, ফার্সি ইত্যাদি) জ্ঞান খুব কাজে লাগলো। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ বর্ণিত হয়েছে আররিয়ানের Anabasis, টলেমির Geographia, কার্টিয়াস কুইন্টাস রুফাসের Historiae Alexandrie Magni-র মত বইতে। এই বইগুলির গ্রিক ও ল্যাটিন সংস্করণগুলি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা শুরু হল যাতে আলেকজান্ডারের সময়কালে (যার তারিখ আমাদের জানা) ভারতের ইতিহাসের তথ্য (যার তারিখ জানা নেই) মিলিয়ে দেখা যায়। এই বিবরণগুলিতে একজন সিসিকোট্টাসের পরিচয় পাওয়া যায় (সম্ভবত তিনিই চন্দ্রগুপ্ত যদিও সিসিকোট্টাস বা শশিগুপ্ত আর চন্দ্রগুপ্তের নামের সমাপতন জোনসের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল)। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের অধিকার বর্তায় সেলুকস ‘নিকাটররে’র হাতে। ততদিনে ভারতে জাঁকিয়ে বসেছেন একজন আন্ড্রোকট্টাস যার সাথে সেলুকসের সংঘর্ষ হয়েছিল। পরে সেলুকসের দূত মেগাস্থিনিস স্যান্ড্রোকপ্টাসের রাজধানী পালিমবোথরায় বেশ কিছু দিন কাটিয়ে যান, যার বিবরণ রয়েছে Indica-য়। জোনসের কৃতিত্ব হল এই এন্ড্রোকট্টাস বা স্যন্ড্রোকট্টাসের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তকে শনাক্ত করা। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে তারিখের অভাব ঘুচতে শুরু করল। এর পাশাপাশি মেগাস্থিনিস-বর্ণিত পালিমবোথরাকেও তিনি শনাক্ত করতে সমর্থ হলেন। ভারতের মানচিত্র রচনায় পথিকৃৎ জেমস রেনেল জানতে আগ্রহী ছিলেন যে পালিমবোথরা আর পাটনার নিকটবর্তী Patelpoot-her এক এবং অভিন্ন জায়গা কিনা? মেগাস্থিনিস জানিয়েছিলেন পালিমবোথরা ছিল এরান্নোবোয়াস নদীর তীরে অবস্থিত। ততদিনে সংস্কৃত সাহিত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠা জোনস দেখালেন যে এরান্নোবোয়াস হল হিরণ্যবাহু বা সোন নদীর গ্রিক অপভ্রংশ। এইভাবে মৌর্যদের বিখ্যাত রাজধানী পাটলিপুত্রের শনাক্তকরণ সম্ভব হল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের দ্বারা সেই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ অবশ্য আবিষ্কার করা সম্ভব হবে বিংশ শতাব্দীতে এসে। যাইহোক, অশোককে খুঁজে পাওয়ার আর একটু দেরি ছিল।
জোনসের মৃত্যুর পর এশিয়াটিক সোসাইটির দায়িত্ব পেলেন সংস্কৃতজ্ঞ হোরেস হেম্যান উইলসন। তিনি রাজতরঙ্গিনীর অনুবাদ করেন। সেখানে তিনি পেলেন অশোক নামে এক রাজাকে যিনি শ্রীনগরের পত্তন করেছিলেন। তবে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হবার জন্য রাজতরঙ্গিনীর রচয়িতা এই রাজার উপর বেশ খাপ্পা ছিলেন। অন্যদিকে এলাকার ক্ষেত্র-সমীক্ষা করতে গিয়ে হ্যামিল্টন-বুকানন বুদ্ধগয়ার খোঁজ পেলেন যা ঘটনাচক্রে ততদিনে হিন্দু মন্দিরে পর্যবসিত হয়েছে। এই বৌদ্ধ ক্ষেত্রটিকে সাজিয়ে তুলতে এই অশোকের বড়ো ভূমিকা ছিল যদিও তখনও তা বিশেষ জানা ছিল না। প্রায় একই সময়ে দক্ষিণ ভারতে কর্তব্যরত এক শখের পুরাবিদ ইংরেজ কলিন ম্যাকেঞ্জি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কাভেল্লি ভেঙ্কট বোরিয়ার সাহায্যে পাণ্ডুলিপি আর পুরাবস্তুর সন্ধান করতে করতে দ্বাদশ শতকে জৈন পণ্ডিত আচার্য হেমচন্দ্রের লেখা পরিশিষ্টপর্ব-এর পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করলেন। পরিশিষ্টপর্বে চন্দ্রগুপ্তের জীবনের প্রথম ও শেষদিকের ঘটনার বর্ণনা ছিল। কলিন ম্যাকেঞ্জিই ১৭৯৭ সালে অমরাবতী থেকে প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে তার কিছুটা কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন (যা এখন কলকাতার জাদুঘরে আমরা দেখতে পাই)।
ইতিমধ্যে আরেক ব্রিটিশ উপনিবেশ শ্রীলঙ্কাতে আলেকজান্ডার জনস্টন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাজপক্ষের সাহায্যে সে দেশের প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশ-এর পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন, যার ইংরেজি অনুবাদ ১৮৩৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে জর্জ টার্নৌর (George Turnour) কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির অর্থানুকূল্যে টীকা সমেত আরও নির্ভরযোগ্য সংকলন প্রকাশ করেন। সেই গ্রন্থে জম্বুদ্বীপের শাসক অশোকের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার কথা বিশদে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া এই বই থেকে আর একটি নির্ভরযোগ্য কালপঞ্জির হদিশ পাওয়া গেল। অশোকের বর্ণনা প্রসঙ্গে সেখানে বলা হয়েছে তিনি গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের ২১৮ বছর বাদে সিংহাসনে আরোহণ করেন। খ্রিস্টের জন্ম থেকে যেমন খ্রিস্টাব্দের শুরু তেমনি বুদ্ধের পরিনির্বাণকে ০ ধরে আর এক শক/অব্দের ধারণা পাওয়া যায় যা একটি নির্ভরযোগ্য তারিখ (যদিও ইদানীংকালে সেই তারিখ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে)। এর পাশাপাশি টার্নৌরের মতই নেপালের রেসিডেন্ট ব্রায়ান হাউটন (Brian Houghton) পাটনের থেকে বৌদ্ধ পুঁথির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেলেন যার সাথেও এমন এক রাজার যোগ ছিল।
সবশেষে আসা যাক জেমস প্রিন্সেপের কথায়। প্রিন্সেপ কলকাতার টাঁকশালে পরীক্ষকের (Assay Master) এর চাকরি নিয়ে আসেন ১৮১৯ সালে। পরে কোম্পানি বেনারসে দ্বিতীয় টাঁকশাল খুললে তাঁকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে তিনি কলকাতায় ফেরেন ১৮৩০ সালে। হোরেস হ্যেম্যান উইলসন অক্সফোর্ডে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে গেলে টাঁকশালের চাকরির পাশাপাশি প্রিন্সেপ এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদকের দায়িত্ব সামলাতে শুরু করেন। প্রিন্সেপ জোনসের মত বহুভাষাবিদ ছিলেন না, না তিনি উইলসনের মত সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু টাঁকশালে মুদ্রা পরীক্ষার কাজ করতে গিয়ে তাঁকে প্রচুর প্রাচীন মুদ্রা ঘাঁটতে হয়েছিল যার মধ্যে কিছু মুদ্রাতে প্রাক-ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী হরফে এক-দুটো শব্দ উৎকীর্ণ থাকত। এগুলিকে নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে তাঁর এতটাই ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল যে ১৮৩৪ সালেই তিনি ব্রাহ্মী লিপির ২৯ টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ৫ টি স্বরবর্ণকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই অক্ষরজ্ঞানকে এবার প্রিন্সেপ সেই ‘ফিরোজ কা লঠ’ এ উৎকীর্ণ লিপি পাঠোদ্ধারে ব্যবহার করলেন। এক লহমায় এতদিনের অন্ধকার ভেদ করে দেবনামপিয় পিয়দসসি অশোক নামে এক ভুলে যাওয়া রাজার কথা প্রকাশ পেল যিনি পশুহত্যা নিবারণ, রাজ্যে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, নৈতিক পরাকাষ্ঠা হিসাবে ‘ধর্ম’ প্রচারের মত বহু কাজের কথা সেই লেখতে জানিয়ে গেছিলেন। তাঁর আবিষ্কারের ফলাফল প্রিন্সেপ ১৮৩৭ সালের ৭ই জুন এশিয়াটিক সোসাইটির অধিবেশনে প্রকাশ করেন। এই দিনটি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এরপর শুরু হল এতদিন ধরে যত লেখমালা আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলিকে পাঠোদ্ধারের কাজ যার মধ্যে দিয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস কে এক দৃঢ় কালপঞ্জির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হল।
এই সংক্ষিপ্ত বিবরণের মধ্যে দিয়ে আমরা যেদিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলাম তা হল প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্য, বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, লেখমালার সাক্ষ্য ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রাচ্যবিদ (Orientalist) -দের হাত ধরে এমন এক ধরনের ইতিহাস চর্চা শুরু হল যার সাথে রাজাবলীর ইতিহাস একেবারেই মেলে না। পুরাণের যুগযুগান্তের যে সময়-ভাবনা তার থেকে এই রাজবংশের নির্দিষ্ট রাজত্বকালের ছোট সময় একেবারে আলাদা।
ইউরোপের সময়চিন্তায় বিপ্লব:
ঔপনিবেশিক শাসন, প্রাচ্যবিদ্যা, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার, লেখমালার সাক্ষ্য যেমন এক লহমায় যুগযুগান্ত পরিব্যাপ্ত লক্ষ কোটি বছরব্যাপী বিস্তৃত বিপুল সময়চিন্তাকে ছোট করে দিল, ইউরোপের সময়ভাবনাও কিন্তু অবিকৃত থাকল না। সে এক অন্য উলট পুরাণের গল্প! একে ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত্ববিদ থমাস ট্রটমান বলেছেন ‘revolution in ethnological times’ যা কোনও অংশে কম চমকপ্রদ ছিল না। ভারতে যেমন ‘বৎসর, যুগ, মনু, কল্পের’ ছকে এক বিপুল সময়ের ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, ইউরোপে তার বিপ্রতীপে বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের (Genesis) ছকে একটি অত্যন্ত ছোট সময়ের খোপে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঠেসেঠুসে ঢুকিয়ে রেখেছিল। এক ঝলকে বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে ঝালিয়ে নেওয়া যাক। জগতের স্রষ্টা ঈশ্বর বা ইয়োভা (Yahweh) কীভাবে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে বাইবেলের Book of Genesis বা Pentateuch-অংশে, ইহুদিরা যাকে Torah বলে থাকে। সৃষ্টিতত্ত্বে রয়েছে দু’টি পরস্পর সম্পর্কিত গল্প। প্রথম কাহিনীতে রয়েছে কীভাবে ইয়োভা মোট ছয়দিন ধরে জগৎসংসার, গাছপালা, জীবজন্তু এবং মানুষ তৈরি করলেন, তার কথা। দ্বিতীয়টি হল, স্বর্গোদ্যানে প্রথম মানুষ বা এডাম (অথবা আদম)-এর গল্প। ইয়োভা ধুলোমাটি থেকে এডামকে সৃষ্টি করলেন এবং স্বর্গদ্যানে সমস্ত জীবজন্তুর উপর তার কর্তৃত্বের এজাহার করলেন। সঙ্গিনী হিসাবে ইভকে সৃষ্টি করলেন। কিন্তু একদিন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ায় এডাম এবং ইভ স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হলেন। আদমের নবম প্রজন্ম নাগাদ পৃথিবী পাপে ভরে ওঠায় ইয়োভা পৃথিবীকে পাপমুক্ত করতে এক প্রলয়ঙ্কর বন্যায় ধরাতল ভাসিয়ে দেবার পরিকল্পনা করলেন। একমাত্র সাত্ত্বিক নোয়া ও তাঁর পরিবারকে বাঁচাতে ঈশ্বর তাঁকে এক বিশাল জলযান (Noah’s Ark) তৈরির পরামর্শ দিলেন। সেই পরামর্শ মেনে বন্যার সময় নোয়া, তাঁর তিন ছেলে – শেম, হাম ও জাফেট আর তাদের স্ত্রীরা – সর্বমোট আটজন মানুষ, যত রকমের পশুপাখি তাদের নমুনা সমেত সেই জাহাজে চড়ে বসলেন। ৪০ দিন (মতান্তরে ১৫০ দিন) সেই জাহাজে কাটিয়ে বন্যার জল নেমে গেলে নোয়া আর তাঁর পরিবার আবার ডাঙ্গায় এসে উঠলেন। এই নোয়া আর তাঁর তিন সন্তান-সন্ততিদের থেকেই পৃথিবীর সব রকমের মানুষের উৎপত্তি।
বাইবেলের এই ‘সৃষ্টিকাহিনী’-কে ভিত্তি করে ১৬৫০ সালে প্রকাশিত হয় আর্চবিশপ জেমস উসারের Annals of the Old Testament from the beginning of the World. এই বইতে হিসেব কষে দেখান হয়েছিল ৪০০৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের ২৩ অক্টোবর সকাল ৯ টায় পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে (জুলিয়েন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী)। আর সেই জগৎপ্লাবী বন্যা ঘটেছিল ২৩৪৯ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে।[14] না, থমাস উসারের গণনা নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা খালি বুঝবার চেষ্টা করছি ইউরোপে বাইবেলের (এবং অবশ্যই ইহুদি এবং ইসলাম ধর্ম – যাদের সম্মিলিত ভাবে Judeo-Christian tradition বলা হয়ে থাকে) অনুপ্রেরণায় কেমন ধরণের সময় ভাবনা প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত উসারের এই কালপঞ্জি খুবই মর্যাদা পেয়েছে। এমনকি আইজাক নিউটনের মত বিজ্ঞানীও এই ‘ছোট সময়’ কে প্রমাণ করবার জন্য বহু হিসাবনিকেশ করেছিলেন।
‘ছোট সময়’-কে চ্যালেঞ্জ জানালো ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ১৭৮৮ তে প্রকাশিত হয় জেমস হাটনের Theory of the Earth. এই বইতে তিনি সুনির্দিষ্ট একটি দিনে পৃথিবী সৃষ্টি হবার ধারণাকে নাকচ করে এক অনির্দেশ্য সময়ের দিকে ইঙ্গিত করলেন।[15] আর ১৮৩০-৩৩ তিন খণ্ডে প্রকাশিত হল চার্লস লায়ালের Principles of Geology (একে ভূতত্ত্ব বিদ্যার জনক বলা হয়)। এই বইগুলো থেকে এক ‘গভীর বা অতলান্ত সময়’-এর ধারণা গড়ে উঠল। তবে পঞ্চদশ শতক থেকে ভূপর্যটক ও ঔপনিবেশিক শক্তি যত নতুন নতুন দেশ, মানুষ, ভাষা আবিষ্কার করতে শুরু করল ততই এই ইউরোপ কেন্দ্রিক খ্রিস্টীয় বিশ্বসৃষ্টির ছকে পৃথিবীর ইতিহাস ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে উঠছিল। অষ্টাদশ শতকে ভলতেয়ারের মত জ্ঞানদীপ্তির উজ্জ্বল প্রতিনিধিরা চার্চপোষিত এই ‘ছোট সময়ের’ইতিহাসের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডের ডেভন অঞ্চলে ব্রিক্সহ্যাম গুহায় খননকার্যের সময় বিলুপ্ত প্রাণী যেমন টিচোরিন গণ্ডার (tichorine rhinoceros), গুহা ভালুক, গুহা হায়নার জীবাশ্মের সাথে মানুষের তৈরি পুরা-প্রস্তর যুগের অস্ত্রের উপস্থিতি পাওয়া গেল, তখন ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ এসোসিয়েশনের অধিবেশনের ইংলন্ডের রাজার উপস্থিতিতেই চার্লস লায়াল মেনে নিলেন যে জেনেসিসের ‘ছোট সময়’ দিয়ে আর প্রাচীন ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। একেই থমাস ট্রটমান ‘revolution in ethnological times’ বলেছেন।[16] ‘ছোট সময়’—এর ধারণাকে কেউ যেন ছুঁড়ে ফেলে দিল। ইউরোপ এগিয়ে চললো এক অতলান্ত প্রাগৈতিহাসিক সময়ের দিকে, যার প্রকৃতি আবার পৌরাণিক ‘বড় সময়’-এর সাথে মেলে!
উইলিয়াম জোনসের ‘উলট পুরাণ’:
সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণগুলির মধ্য থেকে জোনস কীভাবে স্যান্ড্রোকোট্টস বা মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে শনাক্ত করেছিলেন, কীভাবে synchronology-র পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জি নিরূপণের কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সেকথা আমরা আগে আলোচনা করেছি। কিন্তু কীসের অনুপ্রেরণায় বা তাড়নায় উইলিয়াম জোনস এই কাজে হাত দিয়েছিলেন? অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে যখন বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব আর ‘ছোট সময়’-এর ধারণা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ল, তখন অনেক বিশ্বাসী মানুষ জেনেসিসের বর্ণনাকে সঠিক প্রমাণ করতে আদা জল খেয়ে লেগে পড়লেন। কিন্তু মুখের কথায় তো হবে না – প্রমাণ চাই (কারণ যুক্তিবাদ শিখিয়েছিল এমনকি ‘বিশ্বাসকেও তথ্যপ্রমাণের মজবুত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নইলে সেটা বাতিলের খাতায় নাম লেখাবে)। জোনস সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে জেনেসিসের প্রমাণ খুঁজতে শুরু করলেন!
উইলিয়াম জোনস একটি বিশিষ্ট ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে (২৬৫-৩৩৯) সেসারিয়ার ইউসেবিয়াস (Eusebius of Caesaria) একটি বিশ্ব ইতিহাস লিখে ফেলেন, যার নাম দিয়েছিলেন Chronological Canon.[17] তিনিই ছিলেন Synchronology পদ্ধতির উদ্ভাবক। এই বইতে যেমন তিনি দেখালেন যে রোমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গ্রিসে সপ্তম অলিম্পিয়াডের প্রথম বর্ষে। এইভাবে গ্রিস ও রোমের ইতিহাসের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেন। যিশু জন্মেছিলেন রোম প্রতিষ্ঠার ৭৫৩ বছর বাদে। জেরুসালেমে দ্বিতীয় মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পারস্যের সম্রাট দারিয়ুসের দ্বিতীয় রাজ্য বর্ষে। এইভাবে চাল্ডিয়া, আসিরিয়া, পারসিক, গ্রিক, রোমান এবং সর্বোপরি বাইবেলে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনাকে সাজিয়ে তিনি একটি বিশ্বজনীন কালপঞ্জি নির্মাণের গোড়াপত্তন করেন। উইলিয়াম জোনসের গবেষণা যেন সেই ইউসেবিয়াসের তুলনামূলক সময়সারণি আর বিবরণের উত্তরসুরি। আরেকজন গবেষক, যাঁর গবেষণা জোনসের চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তিনি হলেন জ্যাকব ব্রায়ান্ট। জ্যাকব তাঁর Analysis of ancient mythology বইতে দেখানোর চেষ্টা করছিলেন যে গ্রিক, রোমান আর মিশরীয়রা সবাই নোয়ার পুত্র হামের সন্তান।[18] তাঁর অনুসরণে জোনস দেখাতে চাইলেন গ্রীক, রোমান, মিশরীয় এবং ভারতীয়রা সবাই হামের সন্তান!
জেনেসিস-এ বর্ণিত প্রলয়ঙ্কর বন্যার সমর্থন জোনস খুঁজে পেলেন পুরাণের মধ্যে! পুরাণে বর্ণিত দশ অবতারের মধ্যে প্রথম তিন অবতার – মৎস্য, কূর্ম আর বরাহের কাহিনীতে এক ভয়ঙ্কর বন্যার বর্ণনা রয়েছে। বস্তুত মৎস্য পুরাণে দেখা যায় যে পৃথ্বী যখন বন্যায় নিমজ্জিত তখন মনু ও সপ্ত ঋষি (আটজন মানুষ) জীবজন্তু সমেত এক জাহাজে চড়ে বসেছেন যাকে টেনে নিয়ে চলেছে মৎস্য অবতার। ঘটনাচক্রে (বা আকস্মিক সমাপতনে) জেনেসিস বর্ণিত বন্যায় নোয়ার সাথে জাহাজে ছিল শেম, হাম জাফেট এবং তাদের স্ত্রীরা, যাদের সম্মিলিত সংখ্যাও আট! জোনসকে আর পায় কে?! তিনি এই মনুর মধ্যে নোয়াকে খুঁজে পেলেন। এইভাবে এগোতে এগোতে তিনি কৃত যুগে নরসিংহ অবতারের মধ্যে নিমরড, দ্বাপর যুগে রামের মধ্যে বাইবেলে বর্ণিত Raamah-কে শনাক্ত করলেন। জোনসের সেই Mosaic ethnolog- র কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু গ্রিক, রোমান, মিশরীয় আর ভারতীয়রা যে হামের সন্তান সেটা প্রমাণ করবার জন্য তিনি যে এই মানুষদের ভাষার মধ্যে আত্মীয়তার সম্বন্ধ খুঁজে বের করলেন যার ভিত্তিতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ধারণা মান্যতা পেয়েছে। উইলিয়াম জোনস যে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের (comparative philology) জনক তা স্কুলের ছাত্রও জানে কিন্তু আমরা ভুলে গেছি যে জোনস আসলে জেনেসিসের বর্ণনাকে সঠিক প্রমাণ করতে আদা জল খেয়ে লেগেছিলেন। বলা যায় যে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস রচনায় ভাষাগত যোগাযোগ, একটি সুনির্দিষ্ট কালপঞ্জির প্রতিষ্ঠা, চন্দ্রগুপ্তকে খুঁজে বের করা, এ সবই ছিল ভলতেয়ারদের মুখের মতো জবাব দেবার প্রচেষ্টা। কিন্তু শেষে পুরাণের অস্ত্রে খ্রিস্টীয় ধ্যানধারণাকে প্রমাণ করতে গিয়ে পুরাণের ইতিহাস ভাবনাটাই বাতিল হয়ে গেল, আর তার কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের পুরাণেতিহাসের সাথে সাথে জেনেসিসের সৃষ্টিতত্ত্বও বানের জলেই ভেসে গেল! একেই বলে ‘ঘোর কলি।
সাধে বলে: ‘হাঁস ছিল, সজারুও (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না’
তথ্যসূত্র:
১) পার্থ চট্টোপাধ্যায়,‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ ঐ, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০০। পৃ. ১৩১-১৭০; Ranajit Guha, Dominance without Hegemony; History & Power in Colonial India. Harvard University Press, 1997. pp. 152-214 দ্রষ্টব্য। আমরা এই দুটি বই, দুই প্রাবন্ধিকের লেখাই অনুসরণ করেছি।
২) Thomas R. Trautmann, The Clash of Chronologies: Ancient India in the Modern World. Yoda Press, Second Impression, 2018. Kindle version-এর কারণে পৃষ্ঠা সংখ্যা দেওয়া সম্ভব হল না।
৩) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল কর্তৃক সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, প্রথম প্রকাশ ১৩৬১, অষ্টম মুদ্রণ। পৃ। ৩৩০-৩৩২. প্রবন্ধটি বস্তুত শ্রীরাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রণীত প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস বইটির পুস্তক সমালোচনা যা বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্কিম বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ ভাদ্র, ১৩০৯. উইকি সংকলন downloaded 7/29/20.
৫) পার্থ চট্টোপাধ্যায়,‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’; Ranajit Guha, Dominance without Hegemony; History & Power in Colonial India. Harvard University Press, 1997. pp. 177.
৬) প্রাগুক্ত,পৃ. ১৩৩
৭) Thomas Trautmann, Clash of Chronologies
৮) পার্থ চট্টোপাধ্যায়,‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’পৃ. ১৩৫
৯) পার্থ চট্টোপাধ্যায়,‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’পৃ. ১৪০
১০) প্রাগুক্ত
১১) প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫১.
১২) প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫২.
১৩) এই সমগ্র আলোচনাই Charles Allen, Ashoka; The Search for India’s Lost Emperor. London, 2012. থেকে নেওয়া।
১৪) ‘James Ussher’, Wikipedia
১৫) Stephen Jay Gould, Time’s Arrow, Times Cycle; Myth & Metaphor in the Discovery of Geological Time. Harvard University Press, 1987.
১৬) Thomas R. Trautmann, Clash of Chronologies.
১৭) ‘Eusebius’ in Wikipedia
১৮) ‘Jacob Bryant’ in Wikipedia
Splendid. Excellent depiction of our historical studies in colonial India. Author has shown his commendable knowledge on this aspect.
অসাধারণ একটি প্রবন্ধ। লেখককে ধন্যবাদ জানাই।
অনবদ্য আলোচনা। অনেক নতুন কিছু জানলাম ও শিখলাম।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা। তবে ইতিহাস রচনার মোটিভেশনের অনুমানগুলো অনেকটাই বিশ্বাস করার মতো।
চমৎকার লেখা। তবে বাংলা র ইতিহাস নিয়ে বিশেষ কিছু বলা হয় নি।
1200 খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় কোনো মুসলমান ছিল না। 1800 খ্রিষ্টাব্দের পর Conversion হয় নি। তাহলে বাঙালির 65% মুসলমান কেন এর ভাল উত্তর নেই।
কোন শতাব্দীতে কিভাবে transition হয়েছে তার কোনো প্রামাণ্য model নেই।
বাঙলায় মুসলমান একেবারে ই ১২০০শতাব্দীর পূর্বে ছিল না এর তথ্য পাওয়া যায় না এটা মানা যায় না এনিয়ে অনেক গবেষণা ও হয়েছে,আর বাঙলা নিয়ে বলা হয়নি কোথায় রাজাবলি র কথা উল্লেখ আছে,বিশদে রাজাবলি পাঠ করলে বোঝার অত্যুক্তি হবে না।
অসাধারণ আলোচনা, খুব সুন্দর স্যার, আবারও এক পুরাতন কে নতুনের আঙ্গিকে আলোচনা যা সবসময় আপনার থেকে পাওয়া যায়।
খুব ভাল লেখা।
তবে কৃত যুগ বলে যেটা উল্লিখিত সেটা কি সত্য যুগ? টাইপো?
ইতিহাসের এক্সিডেন্টএ আব্রাহামিক ধর্মগুলির মাইথোলজি ছিল কম দিনের কল্পনা, আর ভারতীয় মাইথোলজি ছিল বেশি দিনের কল্পনা। এক সভ্যতার সময়চিন্তা অন্য সভ্যতার সময়চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে হয়ত। বিজিত হলেও, উনবিংশ শতকে ভারতীয় চিন্তার প্রভাব পাশ্চাত্য চিন্তাকে বদলে ফেলতেও পারে হয়ত।