দেবী
বিদিশার প্রাসাদোপম শ্রেষ্ঠীগৃহে গতকাল থেকে সাজো সাজো রব উঠেছে। বিশেষ করে অতিথিশালার বহিরাঙ্গন থেকে অলিন্দ, শয্যাগৃহ থেকে স্নানঘর… সর্বত্রই ব্যস্ত পরিচারক ও পরিচারিকাবৃন্দ। কোথাও যেন এতটুকু মালিন্য না থাকে, সেই সঙ্গেই উৎসব-সাজেও যেন না থাকে ঘাটতি। পুষ্পসজ্জা, গন্ধদ্রব্য, নানা প্রকার আরামদায়ক আসন, সৌখিনতম বস্ত্রাদি, বিভিন্ন অনুলেপনের প্রাচুর্যে চারপাশ পূর্ণ। আয়োজন করা হয়েছে নানাপ্রকার পানীয় ও সুস্বাদু খাদ্যেরও। বিশেষ করে এই অতিথির আমিষ খাদ্যপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। প্রস্তুতির এই আড়ম্বরের কারণও যথাযথ। পাটলিপুত্র থেকে উজ্জয়িনী যাবার পথে এই বিদিশার শ্রেষ্ঠীগৃহে বিশ্রাম-বিরতি নেবেন স্বয়ং মৌর্য রাজপুত্র অশোক, যিনি কিনা একইসঙ্গে উজ্জয়িনী প্রদেশের শাসনকর্তাও। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুমেয়। তাই এই আপ্যায়ন-প্রস্তুতির মূল দায়িত্বভার শ্রেষ্ঠী দিয়েছেন নিজ কন্যাকে। তবে কিনা, প্রাচুর্যের মধ্যে বড়ো হলেও, কন্যাটির নিজের সাজসজ্জার প্রতি আকর্ষণ নেই তেমন। শুভ্রবস্ত্র ও দুকুল, মুক্তার অল্প কিছু অলংকার আর চন্দনগন্ধ… এতেই সে খুশি। শান্তস্বভাবের কন্যাটি আজ একটু সন্ত্রস্ত। কারণও আছে। রাজকুমার অশোকের নিষ্ঠুরতা, ক্রোধপ্রবনতা ও অসহিষ্ণু মনোভাবের নানা কাহিনী এই বিদিশা পর্যন্ত ব্যাপ্ত যে!
গৃহসজ্জা সমাপ্ত। এখন অপেক্ষা। নির্জন কক্ষের আরামদায়ক আসনে একা বসে বসে কোন এক সুদূর অতীতের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছিলেন দেবী। হ্যাঁ, শ্রেষ্ঠী-কন্যার নাম দেবী। ভাবছিলেন নিজ আরাধ্য পরম সৌগতর উপদেশের কথা, শান্তি আর অহিংসার যে বার্তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে, সেই কথা। কিন্তু তা সফল হলো কি? সেই তো চারিদিকে যুদ্ধ আর হিংসার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব। তথাগতর জীবদ্দশাতেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের জাতিবংশ। কোসলরাজ প্রসেনজিতের পুত্র বিড়ুতূহ শেষ করে দিয়েছিলেন তাদের অপরিসীম নৃশংসতায়। সামান্য যে কয়জন আত্মরক্ষার্থে পলায়নসক্ষম হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তার নিজের পূর্বপুরুষ। এই কথাটা স্মরণে এলে একদিকে যেমন দেবীর রোমে রোমে হর্ষ জাগে, সেই মহাপুরুষের বংশের রক্তধারা নিজ শরীরে বহনের মহান ও বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হিসাবে, তেমনই যে পূর্বপুরুষ জাতিকে ঐ সঙ্কটের মধ্যে ফেলে রেখে পলায়ন করেছিলেন, তাঁর কথা মনে করে সে লজ্জিতও হয়। আর তারপর ধ্বংসের মুখে পড়লো তাদের অর্থাৎ শাক্যদের মতো অন্য গণরাজ্যগুলিও। তথাগতের জীবদ্দশাতেই আরম্ভ হয়েছিল সেই মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি। হর্যঙ্ক বংশের অজাতশত্রু লিচ্ছবী গণরাজ্যের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শক্তিজোটের বিরুদ্ধে শুরু করেছিলেন যে যুদ্ধ, যা একযুগেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল, তার ভয়াবহতা, বিশ্বাসঘাতকতার প্রদর্শন যেন স্তব্ধ করে দিয়েছিল মানুষকে। এখানেও, যে তথাগত দেবীর ঈশ্বর, তাঁর একটি আচরণ তাঁর মনে প্রশ্ন তোলে। তিনি শুনেছেন অজাতশত্রু নিজ মন্ত্রীকে বুদ্ধের কাছে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে কিভাবে জেতা যায় সেই বিষয়ে উপদেশ নিতে। বুদ্ধ সরাসরি সেই কথার উত্তর দেননি। আনন্দকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রীকে শুনিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বৃজিদের দেওয়া তাঁর সাতটি উপদেশ। আর এই সাতটির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল গণরাজ্যের পতনের সেই মারণবান। সেটি হল, যতদিন তাদের মধ্যে সিদ্ধান্তের ঐক্য থাকবে, ততদিন তারা অপরাজেয়। ঐ পথ ধরেই এসেছিল সর্বনাশ। শক্তিজোটের বিরুদ্ধে কিছুতেই সফল হতে না পেরে, মন্ত্রী কাজে লাগিয়েছিলেন কিছু বিশ্বস্ত লোককে। তারা, বহু আয়াসে যদিও, সৃষ্টি করতে সফল হয়েছিল পারস্পরিক সন্দেহ। শুরু হয়েছিল দল ভাঙার রাজনীতি। আর অন্যদিকে অজাতশত্রুর বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণ তো চলছিলই একনাগাড়ে! শেষ পর্যন্ত পতন ঘটেছিল শক্তিজোটের। শক্তিজোট তথা গণরাজ্যের সভাপতি চেটক, সম্পর্কে ছিলেন মহাবীরের মাতুল, আত্মহত্যা করেছিলেন। এইরকম ঘটনায় এমনকি বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন মহান দার্শনিকগণও। কশ্যপ বলেছিলেন ‘পাপ পুণ্য নেয়-অন্যায়ের সাধারণ ধারণা মিথ্যা’। অজিত কেসকম্বলি বলেছিলেন, ‘যা দেখা যাচ্ছে শ্মশান ভিন্ন মানুষের আর কোন গতি নেই। দেহান্তে পণ্ডিত মূর্খের একই পরিণাম।’ সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত বলেছিলেন ‘ঔচিত্য অনৌচিত্য দিয়ে কিছু বিচার করা সাধ্যাতীত।’ আর মংখলিপুত্ত গোসাল উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রলাপের মধ্যে তিনি উচ্চারণ করে চলেছিলেন অজাতশত্রু ব্যবহৃত দুটি ভয়ানক অস্ত্র, মহাশিলাকন্টক ও রথমুসল-এর নাম। বলেছিলেন ‘যুদ্ধই হচ্ছে সেই শেষ ঝটিকাবাহী মহামেঘ যা মানবতার সকল আশাকেই ধুলিস্যাৎ করবে।’ ওই উন্মাদ অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে। তারপরেও ঘটে গেছে কত না যুদ্ধ। মহাপদ্মনন্দ তো দ্বিতীয় পরশুরাম নামে খ্যাত হয়েছিলেন ক্ষত্রিয় রাজাদের ক্রমাগত যুদ্ধে হারিয়েই। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিকে বিদেশী গ্রীকদের সঙ্গে যুদ্ধ লেগেই ছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে। আজও কুমার আসছেন বিদ্রোহ দমনে, যা যুদ্ধেরই নামান্তর।
আকস্মিক কোলাহল আর ভেরিবাদনের আওয়াজে ঘোর কাটে দেবীর। চঞ্চল হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ান তিনি। এক সখী তার হাতে ধরিয়ে দেয় বরণডালা। মান্য অতিথিকে প্রদীপ দেখিয়ে, চন্দন ও মাল্যে বিভূষিত করে অতিথিশালার অন্দরে আপ্যায়ন করে নিয়ে আসেন দেবী। মনে মনে একটু সন্ত্রস্তই, তবু সেই মনোভাব গোপন করে যথাসাধ্য নিখুঁত ভাবে অতিথি আপ্যায়নে নিজেকে নিয়োজিত করলেন তিনি। পুরষ্কার পেতেও দেরী হল না। রাজপুত্রটি বড়োই পছন্দ করে ফেললেন তাকে। কিন্তু সরাসরি বিবাহ সম্ভব নয় কারণ রাজনীতি বড়ো বিষম বস্তু। যা হল সেটাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলা যায়। শ্রেষ্ঠীর অমত হল না। রাজশক্তি আর বণিকগোষ্ঠীর মেলবন্ধন তো বাস্তবেই আদর্শ সম্পর্ক। একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল, এই সত্য আরো অন্তত পাঁচশো বছর আগে থেকে কারুর অজানা তো নয়! দেবীরও মন বললো, এ একটা অন্যতর সুযোগ। অহিংসার আদর্শে যদি পরিবর্তিত করা যায় কুমারকে, তবে সে তো হবে তথাগতেরই জয়। সুতরাং তিনিও রাজী হলেন।
তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব কিন্তু ভোলেননি কুমার। সেই কাজেও সাফল্য এল। আর এরপরেই শুরু হলো পাটলিপুত্রের সিংহাসন সংক্রান্ত জটিলতা। রোগশয্যায় শায়িত বিন্দুসার চাইলেন জ্যেষ্ঠ পুত্র সুসীম পরবর্তী সম্রাটের পদে আসীন হোক। মন্ত্রী রাধাগুপ্তের নেতৃত্বাধীন বিরোধী গোষ্ঠী বেছে নিলেন অশোককে। এই দ্বৈরথ জন্ম দিলো এক দীর্ঘ রক্তাক্ত ঘটনাপ্রবাহের — যার পরিণতিতে সুসীম সহ অন্য সব ভ্রাতাদেরও (সহোদর এক ভ্রাতা বাদে) হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হলেন অশোক।
দেবী রইলেন পিতৃগৃহেই। কোল আলো করা পুত্র মহেন্দ্রর মাতা তিনি। অশোকের কাছ থেকে কখনও কোনো অসম্মানজনক ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর কোনো দিশাও দেখতে পাননি তিনি বিগত বছরগুলিতে। বরং হিংসার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। এই তো সেদিনের কথা, অশোকের ব্যবহারে অতিষ্ঠ তাঁর নয় উপপত্নী একটি অশোকবৃক্ষের মূলোৎপাটন করে গাছটির ডালপালা খণ্ডবিখণ্ড করে দিয়েছিল। এইটুকু রূপক-প্রতিবাদও সহ্য করেননি সম্রাট। হতভাগিনীদের জীবন্ত পুড়ে মরতে হয়েছে। সম্রাটের চোখে যারা “পাপীতাপী”, তাদের জন্য সম্রাট তৈরি করিয়েছেন “নরক”। সেখানকার অত্যাচারের স্বরূপ এমনি যা আসল নরককে হার মানায়। এইসব শুনতে শুনতে দেবী ক্লান্ত, অবসন্ন। ইতিমধ্যে তিনি জন্ম দিয়েছেন এক কন্যাসন্তানের, নাম রেখেছেন সংঘমিত্রা। ক্রমশ তিনি যেন বুঝেছেন পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদ ও সেখানকার সিংহাসনে আসীন ব্যক্তিটিকে পরিবর্তন করায় তাঁর শুভ আয়াস তো সাফল্যের দিকে এতটুকু অগ্রসর হচ্ছেই না বরং পিছু হটছে। আরো এক অনাগত আশংকায় কেঁপে উঠছে তাঁর মাতৃহৃদয়। যদি তাঁর সন্তানদের চরিত্রেও এই কালিমা ছায়া ফেলে! এথেকে বাঁচার শেষ রাস্তা একটাই। আর তাই করলেন তিনি। সন্তানদের তখনই পাঠালেন না পাটলিপুত্রে। বৌদ্ধ শিক্ষার শান্তির বাতাবরণে বড়ো হতে থাকলো মহেন্দ্র। কিছুদিনের মধ্যেই প্রবজ্যা নিল সে। সংঘমিত্রার বিবাহ হল এক ধর্মপ্রাণ যুবকের সঙ্গে, একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেবার কয়েক বছরের মধ্যে সেও প্রবেশ করল সংঘে। যদিও কিছুটা বড়ো হবার পরে তাদের তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পিসন্নিধানে। তবে এর মধ্যেই তাদের মনে তথাগতের অহিংসা ধর্মের স্থায়ী চিহ্ন গড়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি।
এদিকে ততদিনে ঘটে গেছে কলিঙ্গ যুদ্ধ। অশোকের সব হিংসাত্মক কাজের মধ্যেও শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এটির কপালেই। কিন্তু এই পথেই এসেছে দেবীর ইপ্সিত পরিবর্তন। যুদ্ধের ভয়াবহতার অভিঘাতে এতদিনে যেন সম্বিত ফিরেছে সম্রাটের। মনে পড়েছে সেই স্নিগ্ধ মুখনিঃসৃত অহিংসার বার্তাগুলি। আর প্রতিবার সেসবের বিচ্যুতির সংবাদে মলিন মুখখানিও। কতখানি বেদনা যে দেবী পেয়েছিলেন, তাও হৃদয়ঙ্গম হয়েছে তাঁর। সবকিছুর ফলশ্রুতিতে যেন জন্ম নিয়েছে এক নতুন মানুষ, ধর্মাশোক।
আরো কিছু সময় পরে প্রথমে মহেন্দ্র তথাগতের শান্তির বার্তা নিয়ে সিংহলে গেছিলেন, সঙ্গে সংঘমিত্রার পুত্র… সেও ততদিনে প্রবজ্যা নিয়েছে। তার কিছু পরে বোধিবৃক্ষের শাখা নিয়ে একই উদ্দেশ্যে সিংহল গেলেন সংঘমিত্রা। ভারতের তো বটেই, বোধহয় পৃথিবীর প্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা তাঁরই প্রাপ্য।
নেপথ্যচারিনী দেবীর জীবনের এই শেষতম স্বার্থকতা তিনি কি জেনে যেতে পেরেছিলেন? ইতিহাস এই প্রশ্নে নীরব।
গ্রহণ-সূত্র
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, জেনারেল পাবলিশার্স এন্ড প্রিন্টার্স লিমিটেড, ১৯৯৫.
Allen, Charles, Asoka: The Search for India’s lost Emperor, Little, Brown Book Group, 2012.
সংক্ষিপ্ত। সুন্দর।
তথ্যবহুল লেখা,সমৃদ্ধ হলাম।
তথ্যবহুল লেখা।