দেবলগড়-আনুলিয়া অঞ্চলের প্রত্নচর্চা ও তার সম্ভাবনা
(বইয়ের নাম: দেবলগড়-আনুলিয়া প্রত্নক্ষেত্র: হারানো এক রাজধানীর সন্ধানে; লেখক: ড. বিশ্বজিৎ রায়; প্রকাশক: বিয়ন্ড হরাইজন পাবলিকেশন; প্রকাশ সাল: ২০২১)
(১)
‘মনে অহরহ ইচ্ছা জাগিতেছে যে, স্বহস্তে কোদাল ধরিয়া সমস্ত উচ্চভূমি খুঁড়িয়া সমান করিয়া দিই। প্রাচীন পুকুরগুলিকে প্রাচীন কটাহের মত ধরিয়া তুলি এবং উল্টাইয়া ফেলিয়া দিই, দেখি তাহাদের অভ্যন্তরে কী আছে। কিন্তু দুর্বৃত্ত উদর দুই বেলা যথাসময়ে চোঁ চোঁ করিয়া জানাইয়া দেয় যে রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি তাহা না জানিলেও পৃথিবীর বিশেষ ক্ষতি হইবে না। তথাপি “নেশা যারে ধরে তারে পাগল করে”। প্রত্নতত্ত্বের নেশাগ্রস্ত হতভাগ্যগণ আমার কথার সত্যতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিবেন।’ উক্তিটি কার জানেন? তাঁর নাম নলিনীকান্ত ভট্টশালী।
খুব হালকা মেজাজে বলা যায়, বাঙালি জাতি আর কোন কোন দিকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে জানা নেই, তবে একটি বিষয়ে তার খ্যাতি অসীম, আর তা হলো কৌতূহল! নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির প্রতিটি বিষয়ের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ রয়েছে। আর সেই কৌতূহল কারও কারও জীবনের পুরোটা জুড়েই এমন ছড়িয়ে থাকে তার প্রকৃত উদাহরণ উপরের এই উক্তির মালিক।
ইতিহাস-আগ্রহী বাঙালিকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় বাংলার প্রথম প্রত্নতত্ত্ববিদ কে, তবে অধিকাংশের কাছে পরিচিত নাম হবে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কারণ সেই স্কুল-বেলা থেকে আমরা এই নামটির সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। আর এই নামটা বলায় যদিও তেমন ভুল কিছু নেই। কারণ তাঁর মতো আবিষ্কারের কৃতিত্ব আজ পর্যন্ত খুব কম বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদের কপালে জুটেছে। যদিও সামান্য ৪৫ বছরের জীবনে (১৮৮৫ – ১৯৩০) খ্যাতি ও অপমান – এই দুইয়ের মধ্যে দিয়েই তাঁকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির ত্রয়ী – শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রমাপ্রসাদ চন্দ – তাঁরা সকলেই তাঁর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন।
প্রায় একই সময়ের আর একজন কৌতূহল-প্রিয় মানুষ ছিলেন বসন্তরঞ্জন রায়। তাঁর জীবনটাও ছিল বেশ অদ্ভুত। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও তিনি পরবর্তী জীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন! কিভাবে? সেই এক, অদম্য কৌতূহল। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন বহু পুথি আর তাদের মধ্যেই তিনি একদিন আবিষ্কার করে ফেলেন কালপর্যায়ের নিরিখে আদি বাংলাভাষার আজ পর্যন্ত পাওয়া দ্বিতীয় নিদর্শন, বড়ুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন! বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তার সারাজীবনের সারস্বত চর্চা ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধিৎসার পুরস্কার স্বরূপ ‘বিদ্বদ্বল্লভ’ উপাধি দেন। যাই হোক, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট নলিনীকান্ত ভট্টশালীর জীবনের কৌতূহলের কথা ও তার ফলাফল সম্পর্কে আরও কিছুটা বিস্তার করা যেতে পারে। সময়টা ইংরেজি সাল ১৯১২ থেকে ১৪-এর মধ্যে। তিনি সদ্য এম. এ. পাশ করে বালুরঘাট স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে কর্মজীবন শুরু করেছেন। কিন্তু তাঁর এই কাজে মন বসে না। মাটির তলায় অতীতের যে অপার ঐশ্বর্য জমা রয়েছে সে সব নিয়ে তিনি অসম্ভব কৌতূহল বোধ করেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সুযোগও এসে গেল কাকতালীয়ভাবে। সদ্য ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু চালাবার লোক নেই। সেই শূন্যস্থান পূরণের সুযোগ লুফে নিলেন নলিনীকান্ত। হয়তো এতদিন এই সুযোগটারই অপেক্ষাতে ছিলেন। সেই থেকে শুরু, এমনকি ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তটিতেও তিনি জাদুঘরে কর্মরত ছিলেন।
এই বছর নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মৃত্যুর ৭৫ বছর পূর্ণ হল। তবে এই লেখায় তাঁকে স্মরণ করার একটি আলাদা ও বিশেষ কারণ রয়েছে। নলিনীকান্তর জন্ম হয় বর্তমান ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলে। তিনি তাঁর প্রত্নতত্ত্বচর্চার প্রায় শুরুর জীবন থেকেই বলে এসেছেন বিক্রমপুরের রামপাল অঞ্চলের মাটির তলায় রয়েছে বাংলার প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ। সমগ্র রামপাল, বজ্রযোগিনী, নাটেশ্বর অঞ্চলে তখন উৎখননের মতো আর্থিক সামর্থ্য এমনকি আগ্রহী চর্চা, কোনটাই ছিল না। কিন্তু তার বক্তব্যের একশ বছর পর আজ আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি এখানে বৃহৎ জনবসতি, সম্ভবত প্রাচীন বাংলার রাজধানীর অবস্থান ছিল। ড. ভট্টশালী তার জীবদ্দশাতে বহু পুরস্কার পেলেও নিজের এই ধারণাটি যে সত্যি, সেই কৃতিত্বে তাকে পুরস্কৃত করা সম্ভব হয়নি।
(২)
‘প্রত্ন’ অর্থ পুরাতন ও ‘তত্ত্ব’ শব্দে বোঝায় জ্ঞান। প্রত্নতত্ত্বের সহজ অর্থ হলো পুরাতন সম্পর্কে জ্ঞান। এই পুরাতন বিষয়ে জ্ঞান ঠিক কত আগের সময়ের তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। যেমন প্রয়োজন তেমন সময়েরই হতে পারে। আমাদের সাধারণ ধারণা থেকে মানব সভ্যতার সময়কালকে দুটো ভাগ করা হয়ে থাকে – একটি, যে সময় মানুষ লিখতে জানতেন না বা লিখে থাকলেও সেই সময়ের লেখাগুলি আমাদের পক্ষে পড়া সম্ভব হয়নি। অপরটি, মানুষের নিজের বর্তমান সম্পর্কে লিখে যাওয়ার সময়। গোল বাঁধে এই আড়াআড়ি বিভাজনে। ধরুন, একই সময়ে দুটো আলাদা জাতির মধ্যে একটি লিখে গিয়েছে কিন্তু অপরের নিজের কিছু লেখা নেই। ইতিহাসের বিচারে সামান্য কিছু বছর আগের ঘটে যাওয়া সাঁওতাল বিদ্রোহের কথাই যেমন ধরতে পারেন। এই নিয়ে সাহেবদের বা বাবুদের লেখা থাকলেও সাঁওতালদের লিখিত কোন বর্ণনা আছে বলে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ প্রত্নতত্ত্ব কেবল না-লেখা সময়ের জন্য জরুরি নয়, লিখতে জানা সময়ের ইতিহাস জানতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
এইতো গেল একটি দিক। কিন্তু এর সঙ্গে আরও দুটো কথা জড়িয়ে আছে। যেমন, লিখিত উপাদান নিয়ে ইতিহাসবিদরা অতীতের যে চিত্রকল্প তৈরি করেন সেসব লেখাও যে খুব নৈর্ব্যক্তিক বা বস্তুনিষ্ঠ এমন কিন্তু নয়। খানিকটা ধারণা ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয়, আর অতীতের এমন বহু জনপদ রয়েছে যা সমৃদ্ধ হলেও সেখান থেকে বিশেষ একটা লিখিত উপাদান পাওয়া যায়নি বা লিখিত উপাদানে তার তেমন স্পষ্ট উল্লেখ নেই। দেবলগড়-আনুলিয়া তেমনি একটি প্রত্নক্ষেত্র। কোন একটি প্রত্নক্ষেত্র সম্পর্কে বুঝতে গেলে বা সেই ক্ষেত্রের ওপর লেখাপত্র পড়ার জন্য প্রত্নতত্ত্বের ফলিত প্রয়োগ যেমন জানতে হয় সেই সঙ্গে সামান্য কিছু তত্ত্বকথা মনে রাখলে তা আমাদের সাধারণের মনের প্রশ্নগুলিকে সহজে উত্তর দিতে পারে। যেমন ধরুন, কার্বন ডেটিং না করিয়ে কী করে কোন প্রত্নবস্তুর সময়কাল নির্ণয় করা যায় অথবা সমস্ত প্রত্নক্ষেত্রের প্রাচীন নির্মাণগুলি উঁচু ঢিবির আকার নেয় কেন – এইরকম।
প্রত্নতত্ত্ব একজন প্রত্নবিদ ও পাঠক, উভয়ের কাছেই যেমন আকর্ষক তেমনই জটিল একটি বিষয়। একজন প্রত্নবিদের কাছে আকর্ষক কেন, সে তো সহজেই বোঝা যায়, অতীতের প্রতি কৌতূহল ও সেই সঙ্গে আবিষ্কারের নেশার কারণে। কিন্তু জটিলতা কোথায়? নানান দিকে। চাইলেই তো আর আমি-আপনি মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতা উন্মুক্ত করতে পারি না। এই কাজের কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, প্রথমে কোন সঠিক স্থান অনুসন্ধান (এক্সপ্লোরেশন) প্রয়োজন। এখানে ‘সঠিক’ বলা হলো কেন? ভেবে দেখুন, কোন অঞ্চলে যদি বহুদিন থেকে জনবসতি থাকে তবে সেই অঞ্চলে মাটি খুঁড়লে জনবসতির ব্যবহার্য জিনিসপত্র তো পাওয়া যাবেই। তাহলে তাঁদের সবচেয়ে আকর্ষিত করে কোন বিষয়? যখন কোন একটি অঞ্চলে বর্তমান জনবসতির অপেক্ষায় অতীত নিদর্শন অনেক উন্নত জীবনধারণের পরিচয় দেয়, সেই আবিষ্কার অত্যন্ত আগ্রহ তৈরি করে। আমাদের সকলের মনে যে ধারণাটি বদ্ধমূল তা হলো, মানবসভ্যতা ক্রমোন্নতিশীল। তাই অতীতের কোন পর্যায়ে উন্নতির এই ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন দেখা দিলে তা সাধারণ মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। ধরুন বর্তমান কোন পল্লীর মাটি খুঁড়ে এক বিশাল শহর আবিষ্কৃত হল, তাহলে আপনি যে অবাক হবেন তা খুব স্বাভাবিক। আনুলিয়া-দেবলগড় তেমনি একটি প্রত্নক্ষেত্র। এখানকার মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে অতীতের এক বিশাল নগর স্থাপত্য।
এক্সপ্লোরেশন বা অনুসন্ধানের পর্যায়ে শেষ করে আমরা যখন নিশ্চিন্ত হলাম একটি অঞ্চলে উৎখনন করার প্রয়োজন রয়েছে, তার পরের ধাপটি হবে এক্সক্যাভেশন বা উৎখনন। এই কাজটি অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে হয় এবং প্রত্নতত্ত্বের পাঠ না পাওয়া মানুষের পক্ষে কাজটি পরিচালনা করা উচিত নয়। আপনি কীভাবে মাটি খুঁড়বেন ও কতটা খুঁড়বেন তার কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে। এই খোঁড়াখুঁড়ি প্রধানত দু’রকমভাবে হয়, (আরও অনেক ধরন রয়েছে যদিও) একটি ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল, অপরটি লম্বভাবে। ধরুন, একটি টেনিস কোর্ট সমতল করতে গিয়ে আপনি যেভাবে কোদাল চালিয়ে যাবেন সেইভাবে যদি কোন প্রত্নক্ষেত্রের মাটির নির্দিষ্ট স্তর অনুযায়ী খুঁড়তে থাকেন তবে তাকে সমান্তরাল উৎখনন বলা যেতে পারে। আর ওই কোর্টে নেট ঝোলানোর জন্য যখন খুঁটি পুঁততে হবে, আর তার জন্য শাবল দিয়ে যে গর্ত করবেন, তাকে আমরা উলম্ব উৎখনন (ভার্টিক্যাল এক্সক্যাভেশন) বলতে পারি।
এই হল নিয়ম মেনে কাজের কথা। কিন্তু আমাদের পোড়া দেশে কোন কাজটা নিয়ম মেনে ঠিক ঠিক পদ্ধতি অনুযায়ী হয় শুনি! আনুলিয়া-দেবলগড়ে এখনও সরকারি উদ্যোগে নিয়ম মেনে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয়নি। অর্থাৎ ড. বিশ্বজিৎ রায়ের এই গ্রন্থটিকে আমরা এক্সপ্লোরেশন বা অনুসন্ধান পর্বের আলোচনা বলে ধরতে পারি। তবে ওই যে বলা হয়েছিল, অদম্য কৌতূহল! সামান্য যেটুকু অঞ্চল নানান কাজে খনন করা হয়েছে বা কৃষিজমিতে চাষের প্রয়োজনে খুঁড়তে গিয়ে মাটির তলা থেকে অপরিকল্পিত উৎখননের ফলে যা উঠে এসেছে বা সাধারণের কাছে অবহেলায় রয়ে যাওয়া মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী নিয়ে লেখক ও স্থানীয়রা যৌথভাবে ‘দেবগ্রাম দেবল রাজা ও লোকসংস্কৃতি সংঘের’ উদ্যোগে একটি সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন ২০১৭ সালে। আর ২০২১ সালে এই বইটি প্রকাশের মাধ্যমে এই অঞ্চলে করা ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের বর্ণনা ও প্রাপ্ত সম্পদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই এরপর উৎখননের কাজটি ব্যাপকভাবে শুরু করা প্রয়োজন, কারণ এখান থেকে পাওয়া উপাদানে গুপ্ত আমল থেকে শুরু করে সুলতানি যুগের সময়কালীন প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময়ের নাগরিক জীবনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে পাঠক যদি মনে করেন উৎখননই প্রত্ন-গবেষণার সবথেকে কঠিন পর্যায় তবে খানিকটা ভুল হয়ে যাবে। গৌরব সিনহা ‘প্রত্নতত্ত্বের প্রাথমিক পাঠ’-এ মনে করিয়ে দিয়েছেন- ‘সাধারণভাবে মনে করা হয় যে প্রত্নক্ষেত্রে এক সপ্তাহের কাজের পর তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহ প্রয়োজন হয় পুরাবস্তুগুলিকে পরিষ্কার করে তালিকাভুক্ত করে তাকে সংরক্ষণ করার জন্য।’ (পৃ. ৬৭)
(৩)
কোন একটি বইয়ের আলোচনায় সেই বইটির বিষয়বস্তু সেখানে যতটা অক্ষর দখল করে, ঠিক ততটাই বলার যে সেই বইটির আলাদা গুরুত্ব কী। ড. বিশ্বজিৎ রায়ের ‘দেবলগড়-আনুলিয়া প্রত্নক্ষেত্র: হারানো রাজধানীর সন্ধানে’- গ্রন্থটির নামে ও পর্ব নির্ধারণে দুটি স্পষ্ট ভাগ রয়েছে। একটি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক ও অপরটি রাজধানীর সন্ধান সম্পর্কিত। প্রত্ন বিষয়ে যে প্রথাগত পদ্ধতির আলোচনা হল যেমন, প্রথম পর্যায়ে অনুসন্ধান, দ্বিতীয় পর্যায়ে উৎখনন, তৃতীয় পর্যায়ে অনুসন্ধান এবং উৎখননের ফলে প্রাপ্ত পুরাবস্তুর নথিবদ্ধকরণ বা ডকুমেন্টেশন, চতুর্থ পর্যায়ে সংরক্ষণ (প্রিজারভেশন) এবং শেষে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ (ইন্টারপ্রিটেশন অ্যান্ড অ্যানালিসিস) ইত্যাদি, যদি প্রথাগত এই পদ্ধতির নিরিখে দেখা যায়, তবে এটা ঠিক যে আনুলিয়া-দেবলগড় প্রত্নস্থলে এখনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎখননের কাজ শুরু হয়নি। ফলত এই বইটির বিষয়বস্তুকে আমরা নিয়মমতো অনুসন্ধান বা এক্সপ্লোরেশন পর্যায়ের ব্যাখ্যা বলে বিবেচনা করেছিলাম। কিন্তু এই দেশে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজের প্রতিকূলতা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বাস্তবচিত্রটি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হলে বইটির অবদান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। কারণ লেখক সেই সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে একদিকে যেমন অনুসন্ধান পর্যায়ের চর্চাকে এখানে সাধারণের জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন, সেই সঙ্গে খুবই সহজ সরল ভাষায় এই অঞ্চলের অবস্থান, অনুসন্ধানের পর্যায়, স্থানীয় মানুষদের সচেতন করার প্রক্রিয়া, অনুসন্ধান বা জরিপজাত ফলাফল, স্বাভাবিক উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু ও তা থেকে নিঃসৃত ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন।
এই অনুসন্ধানের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ও আধুনিকতম যে মেথডলজিটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হল জিও-আর্কিওলজি বা ভূপ্রত্নতত্ত্ব। প্রত্নতত্ত্ব চর্চার বাইরের পাঠকদের কাছে শব্দটি খানিকটা অপরিচিত মনে হতে পারে, তাই এর সম্বন্ধে সহজ করে বলে রাখার, ভূবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন যে পাঠ, যেমন – ভূগোল, জিওলজি, জিওফিজিক্স ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের চর্চার পদ্ধতিগুলিকে একত্র করে ভূপ্রত্নতত্ত্ব বিষয়টি তৈরি হয়েছে। এর ফলে অনুসন্ধানের কাজটি অনেকবেশি যন্ত্র-নির্ভর ও নিখুঁত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বর্তমানের ভূ-প্রত্নবিদ্যা এক সময়ের মার্টিমার হুইলারদের প্রদর্শিত পথ (‘আরকিওলজি ফ্রম দ্য আর্থ’, ১৯৫৪) থেকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আধুনিকতর ও সুনিপুণ পর্যবেক্ষণ এবং ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে।
(৪)
বইটির দ্বিতীয় একটি পর্ব রয়েছে। এই অংশটিতে প্রশ্ন দু’টো এবং লেখক এই দু’টো প্রশ্নের উত্তরকে মেলাতে চেয়েছেন। প্রথম প্রশ্নটি হল, লক্ষ্মণ সেন যে বিজয়পুর রাজধানী অঞ্চলে বখতিয়ার খলজির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়, তার সঠিক অবস্থান কোথায়। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল, বর্তমান দেবলগড়ে প্রাপ্ত এত বড়ো একটি নগরের ধ্বংসাবশেষ, অতীতে কেন গড়ে তোলা হয়েছিল। ড. রায় যে সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছেন, তা প্রতিষ্ঠিত করতে দুটো পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, বিভিন্ন সেকেন্ডারি সোর্স অর্থাৎ পরবর্তী রচনায় উল্লিখিত সেন বংশের রাজধানী বিজয়গড় আসলে নবদ্বীপে অবস্থিত, এই ধারণাটিকে নানানভাবে বিচার করে দেখেছেন ও তার অসারতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে। এই ক্ষেত্রে নবদ্বীপের উৎখননের ইতিহাসকে খুব বেশি আলোচনা না করে বরং আধুনিক এরিয়াল ফটোগ্রাফির মাধ্যমে ওই অঞ্চলের প্রত্ন-সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখেছেন। দ্বিতীয় যে যুক্তি বইটিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তা হলো সেন-রাজধানী হিসেবে বর্তমান দেবলগড়কে চিহ্নিত করার পেছনের বাস্তবতা। বঙ্গাল অঞ্চলের সমৃদ্ধশালী এলাকার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেবলগড় ও আনুলিয়ার নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানী হোক বা না হোক, এখানে যে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল তা নৌবন্দর আবিষ্কারের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই ধারণাকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে এখন প্রয়োজন সরকারি আয়োজনে প্রথামাফিক উৎখননের কাজ শুরু করা ও প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর যথাযথ বিশ্লেষণ।
(৫)
একটি বইয়ের সার্বিক গুরুত্ব কেবল তার সিদ্ধান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিশেষত প্রত্নতত্ত্ব সংক্রান্ত বইয়ে তো নয়ই। কারণ যত বেশি কার্যকরী উৎখনন চলতে থাকে, প্রত্নবিদদের ধারণা স্বাভাবিকভাবেই তত পরিশীলিত হতে থাকে। এই বইটির মেজাজ মূলত আনুলিয়া ও দেবলগড়ের মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস সাধারণ পাঠকের কাছে সহজভাবে উপস্থাপিত করা। লেখক খুব আন্তরিক শব্দে তাঁর পাঠককে এই অঞ্চলটি ভ্রমণ করিয়েছেন। ভাষার ক্ষেত্রে কোন অস্পষ্টতা নেই, তবে আর একটু প্রথামাফিক গদ্য-রীতির আবহে পাঠকের পাঠ-গতিকে দ্রুত করা যেতে পারতো। সুমন গোস্বামী এই গ্রন্থের বিন্যাস সহ প্রুফ সংশোধনের কাজটি করেছেন। এই দুটো কাজেই এবং ফন্ট নির্বাচনেও আর একটু সময় দেওয়ার সুযোগ ছিল। আশা করব আগামী মুদ্রণে রয়ে যাওয়া সামান্য ত্রুটিগুলি থেকে বইটি মুক্তি পাবে। গ্রন্থটির কভার, বাইন্ডিং, কাগজ, ছাপা ইত্যাদির নিরিখে বিনিময়মূল্য অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষত বইয়ের শেষ ফর্মায় রঙিন ছবিগুলির জন্য যে মানের কাগজ ও ছাপার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ।
কারও মনে প্রশ্ন হতে পারে, এই আলোচনার শুরুতে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সম্বন্ধে এত বিস্তারিত উল্লেখের উদ্দেশ্য কী ছিল। শেষে এই প্রসঙ্গটা একটু খোলসা না করলেই নয়। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের একবিংশ কৃষ্ণনগর অধিবেশনের ইতিহাস শাখায় সভাপতির অভিভাষণ দেন তিনি। পরবর্তীকালে এই ভাষণটির শেষাংশ লিখিত আকারে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকার ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায়। এই বক্তব্যটির শিরোনাম ছিল ‘নদীয়ার ইতিহাসের কয়েকটি সমস্যা’। তিনি সেখানে প্রথম যে প্রশ্নটি আলোচনা করেন তা হলো ‘নদীয়াতে কি কখনও সেনরাজগণের রাজধানী ছিল?’; নলিনীকান্ত ভট্টশালী এই বক্তব্যে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় প্রতিটি ধারণাকে নস্যাৎ করেন এবং এখানে রাজধানীর অবস্থানের ক্ষেত্রে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন। আজ থেকে ৮৩ বছর আগে তোলা এই প্রশ্নটির সমাধানের তাগিদে ড. বিশ্বজিৎ রায়ের পরবর্তী গবেষণাতে তথ্য-প্রমাণ সহ আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যাবে, এতে কোন দ্বিধা নেই।
খুব ভালো লেখা তবে বইয়ের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আরেকটু আলোচনা হলে মন ভরত