দারাশুকোর ধর্মমত
একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও আমরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কথা শুনে থাকি। এ যেন আদিম পৃথিবীর উত্তরাধিকার। মানুষের শিক্ষা ও সভ্যতার পথে ইতিহাসের প্রশ্নচিহ্ন। আজ থেকে চারশত বছর আগে এক পরমতসহিষ্ণু ভারতীয় রাজপুত্র নিজের মুক্তচিন্তার জন্য তৎকালীন অসহিষ্ণুতার বলি হয়েছিলেন। তিনি শাহজাদা সুলতান মুহম্মদ দারাশুকো। পিতামহ সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেয়া নাম। শাহজাহান ও মমতাজমহলের এই জ্যেষ্ঠপুত্রটি আর দশজন মধ্যযুগীয় শাহজাদার মতো একদমই ছিলেন না। যে হাতে তরবারি শোভা পাবার কথা, সে হাতে থাকতো লেখনী। রাজনীতির কূটচালের পরিবর্তে তিনি মগ্ন থাকতেন সাধুসঙ্গে, অতীন্দ্রিয়বাদী আলোচনায়। সুফি মতবাদ আর বেদান্ত দর্শন চর্চায় দিন কাটতো তাঁর। ধর্মীয় সহাবস্থানের সূত্রটির অনুসন্ধানে জীবনব্যাপী বহু প্রচেষ্টায় নিরত ছিলেন তিনি। সেই খোঁজের ফলাফল রয়েছে তাঁর রচিত কয়েকটি গ্রন্থে।
ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো লিখেছেন, “দারা অসাধারণ মেধাবী ও মনীষাসম্পন্ন ছিলেন এবং জ্ঞানচর্চায় তাঁহার ঐকান্তিক আগ্রহ ও অসীম উৎসাহ ছিল। খেলাধুলা, কবুতরবাজী, শিকার কিংবা বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আয়েশ ও শরাব তাঁহার মনের উপর স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই; লেখাপড়ার নেশা ও তত্ত্বজ্ঞানের তৃষ্ণা বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়িয়া চলিয়াছিল।” …এই লেখাপড়ার নেশা ও তত্ত্বজ্ঞানচর্চার তৃষ্ণা তাঁকে আন্তঃধর্মীয় গ্রন্থপাঠ ও দর্শনের অনুসন্ধানে আগ্রহী করে তুলেছিল। কৈশোর থেকে শুরু করে তাঁর ৪৩ বছরের ক্ষুদ্র জীবনের অধিকাংশই ব্যয়িত হয়েছিল ধর্ম জিজ্ঞাসায়। একে তিনি তাঁর জীবন জিজ্ঞাসায় পরিণত করেছিলেন। মধ্যকালীন ভারতেতিহাসের রাজবৃত্তের মধ্যে এমন ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা ভাবনা এক মহামতি আকবর বাদে আর দেখা যায় না। এক্ষেত্রে দারাশুকো তাঁর প্রপিতামহের সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। মানবিক প্রজ্ঞার দিকে, রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক দিক থেকে নয়। আকবরের ‘সুলহ-ই-কুল’ (Peace with all) নামক ধর্ম সমন্বয় প্রচেষ্টার মননশীল উত্তরসাধক তাঁর প্রপৌত্র দারাশুকো।
দারাশুকো ও সুফি সন্ত মিয়াঁমীর
দারা তত্ত্বজ্ঞানী সাধু সন্তদের ভিড়ে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি লাহোরের সুফি সন্ত মিয়াঁমীরের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। মিয়াঁমীরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা দারা ও তাঁর বড়বোন জাহানারাকে কাদেরিয়া সুফি মতবাদে বিশ্বাসী করে তুলেছিল। লাহোরের মিয়াঁমীর, কাশ্মীরের মোল্লা শাহ বদক্’শী, দক্ষিণ ভারতের সাধু সারমাদ, উত্তর ভারতের যোগী বাবালাল সহ অগণিত সাধুসন্ত, ফকির-দরবেশ, যোগী-সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে আসা দারা বহু ভণ্ডসাধুকেও বিশ্বাস করতেন। সাধু-সন্ত, ফকির-দরবেশের প্রতি দারার ভক্তি ও আস্থার কথা তৎকালীন সময়ে অনেকেরই জানা ছিল। তিনি সাধু-সন্তের খোঁজ করতেন। আবার অলৌকিকত্বের উপরে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাঁকে ঠকাত। তুকতাক, ম্যাজিক করে অনেক ভণ্ড সাধু সেজে তাঁর কাছ থেকে দু’পয়সা আদায় করতো। সরল বিশ্বাসে দারা এসব মেনে নিতেন। এসব সত্ত্বেও এই মুঘল রাজকুমার বেশ কয়েকজন প্রকৃত সাধু-সন্তের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। মিয়াঁমীর, মোল্লা শাহ বদক্’শী, মুহম্মদ লিসানুল্লা, সারমাদ ও বাবালাল বৈরাগী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এঁদের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক পুণ্যপ্রভা আলোকিত করেছিল দারার জীবনবোধকে। সাধুসঙ্গ ও নানান গ্রন্থপাঠ তাঁকে এক চিন্তাশীল, ভাবপ্রবণ অতীন্দ্রিয়বাদী মানুষ করে তুলেছিল। বাইরের রাজকীয়তা তাঁর অন্তরের ফকিরত্বকে ঢেকে দিতে পারেনি। তাই দারাশুকো সম্রাট হতে গিয়ে সন্ন্যাসীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। পার্থিব ময়ূর সিংহাসনের হাতছানিকে একপ্রকার উপেক্ষা করে তিনি বেদান্ত ও সুফি দর্শনের অন্বেষণে জীবন ব্যয় করেছিলেন।
দারা জন্মসূত্রে মুসলমান ছিলেন। কাদেরিয়াপন্থী সুফি ইসলামের অনুগামী। তাঁর রচিত গ্রন্থে অন্য সুফি মতবাদের থেকে কেন তিনি কাদেরিয়া সিলসিলাকে অধিক শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এহেন দারাকে আওরঙ্গজেবের আদেশে ইসলাম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিচার্য বিষয়। দারা জীবনে কখনোই ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেননি। তিনি অন্য ধর্মমতকে ইসলামের সমমর্যাদায় স্থান দিতেন। হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যেকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলতেন। সব মতের সাধকদের সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। পরধর্মসহিষ্ণুতা যদি ধর্মদ্রোহ হয়ে থাকে তবে আওরঙ্গজেব এবং তার অনুগৃহীত আলিমদের কাছে দারাশুকো অবশ্যই একজন ধর্মদ্রোহী কাফের। সুচতুর আলমগীর নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরতরে সরিয়ে দিতে ধর্মীয় অনুভূতিকেই হাতিয়ার করেছিলেন। কারণ মানবীয় প্রজ্ঞা ও সদগুণাবলী সম্পন্ন দারাকে হত্যা করার জন্য ধর্মের চেয়ে অমোঘ অস্ত্র আর কিছুই হতে পারতো না।
সাধু সমাগমে দারাশুকো
দারা নিয়মিত নামাজ (দৈনিক প্রার্থনা) ও রোজা (উপবাস ব্রত) রাখতেন না। মনে করতেন আধ্যাত্মিকতাকে পরিপূর্ণভাবে নিজের দৈনন্দিন জীবনে তিনি আত্মস্থ করে নিয়েছেন, তাই ধর্মের বহিরঙ্গের আচরণীয় দিকগুলো তাঁর ক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয় নয়। যারা এখনো সেই স্তরে পৌঁছাতে পারেনি, তাদের জন্যে এসব বাঁধাধরা নিয়মকানুন। দারা প্রকৃত বৈদান্তিকের মতো বলেছেন – যে সাধক সাধনার উচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছেন, তার জন্য বাহ্যিক পূজার্চনা অপ্রয়োজনীয়। দারা নিজ হাতের অঙ্গুরীয়তে আরবিয় ”আল্লাহ্” শব্দের পরিবর্তে দেবনাগরী অক্ষরে ”প্রভু” শব্দটি খোদিত করেছিলেন। তাঁর কাছে ‘প্রভু’, ‘ঈশ্বর’ এসব ‘আল্লাহ্’ শব্দেরই সমার্থক ছিল। তাঁর কাছে একই হলেও অন্যদের কাছে তা একদমই এক নয়। ধর্মধ্বজীদের দৃষ্টিতে তাই দারা ধর্মচ্যুত হয়েছিলেন।
দারা ও আওরঙ্গজেব পরোক্ষভাবে পরস্পরের প্রতি বাছা বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করতেন। তারা জন্ম থেকেই একে অপরের থেকে শুধুমাত্র ভিন্ন নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ ছিলেন। দারা বলতেন ভাই আওরঙ্গজেব নামাজী বকধার্মিক; আওরঙ্গজেব বলতেন কাফের শাহজাদা দরবারী মোসাহেব, মতলববাজ পাগল। পিতা শাহজাহানের অতিরিক্ত স্নেহে তাঁর মাথা বিগড়ে গিয়েছে। দারার জীবননাট্যের সমাপ্তিতে আওরঙ্গজেবের নিদারুণ অভিঘাত ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘটনা। দারার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সহোদরের এতোটাই অপ্রিয় ছিল যে; শিরচ্ছেদের পরে হতভাগ্য শাহজাদার ধড় দিল্লির হুমায়ুন মকবরায় আর মাথা তাজমহলের কোনো চিহ্নবিহীন স্থানে সমাধিস্থ করা হয়। এটা শুধুমাত্র কোনো সাধারণ ভাতৃবিরোধ ছিল না; এ ছিল তাদের মধ্যের জীবনদর্শনের বা মতাদর্শের বিরোধ। দারার রক্তাক্ত পরিণতির পেছনে তাঁর উদার ধর্মবোধ গভীরভাবে দায়ী। কী সেই ধর্মবোধ; কী ছিল দারার ধর্মমত? এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে দারার রচিত মুখ্য একটি গ্রন্থে। যার নাম- ‘মজমুয়া-অল্-বহারিন’ বা দুই সাগরের সঙ্গম (সম্মিলন)।
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “ইসলামীয় তত্ত্বজ্ঞানে বিশেষরূপে প্রবীণ হইবার পরে, তিনি (দারা) খ্রিষ্টান, য়িহুদী ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতে থাকেন। হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠে এবং হিন্দু তত্ত্বজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ফলে ইঁহার মনে হিন্দু দর্শনের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মে। হিন্দু আধ্যাত্মিকতা মূলে যে এক, এই উপলব্ধি তাঁহার হয়।”
দারা ফার্সি ভাষায় সুফি সাধকদের একটি জীবনীগ্রন্থ (সফিনাৎ-উল-আউলিয়া) রচনা করেন। সুফি দর্শন ও সাধনা বিষয়ক আরো তিনটি গ্রন্থ ও একটি পুস্তিকা রচনা করার পর ৪২ বছর বয়সে (১৬৫৬ খ্রিঃ) ‘মজমুয়া-অল্-বহারিন’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এর অর্থ ‘দুই মহাসমুদ্রের সম্মিলন’; গ্রন্থের এই নামকরণের মাধ্যমে দারার ভাবপ্রবণ কবিমন ও উদার সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। ‘সফিনাৎ-উল-আউলিয়া’ দারার প্রথম জীবনের রচনা। এতে তাঁর আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়া মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তুলনায় ‘মজমুয়া-অল্-বহারিন’ তাঁর পরিণত বয়সের রচনা। এই গ্রন্থ পড়ে দারার জীবনবাণীর সন্ধান পাওয়া যায়। এটিই তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। ক্ষুদ্র এই গ্রন্থের মধ্যে বহু অমূল্য কথা লেখা রয়েছে। এই গ্রন্থের সবথেকে মূল্যবান অংশ হলো এর ভূমিকাটি। উদার হৃদয় শাহজাদার সাহসী মানবিকতার দলিল রূপে এই গ্রন্থ বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। দুই সাগর; হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম। এঁদের মধ্যেকার সারবস্তু ও দুইয়ের সমন্বয়ের সূত্র এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। নিজেদের পৃথক সত্তা ধরে রেখেও কীভাবে দুইয়ের মধ্যে সঙ্গম বা সম্মিলন ঘটতে পারে এতে সেই দিশা নির্দেশ করা হয়েছে। পথ আলাদা হলেও দুইয়ের মূল উদ্দেশ্য যে এক, গন্তব্যও যে এক; তাই দুই সাগরের মিলনে কোনো বাধা নেই, বরং পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদানের মাধ্যমে উভয়ের উদ্দেশ্য সার্থক করার পথ সুগম হবে -এটাই ‘মজমুয়া-অল্-বহারিন’ এর প্রতিপাদ্য।
দুই ধর্মের সার সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে দারা ভারতীয় হিন্দু সাধক ও দার্শনিকদের সম্বন্ধে বলেছেন, “এই ধর্মের (অর্থাৎ হিন্দুধর্মের) তাত্ত্বিক ও সিদ্ধগণ, যাঁহারা ধর্মসাধনায়, ঈশ্বরের উপলব্ধি, তত্ত্বজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক দৃষ্টির ক্ষেত্রে উচ্চতম সিদ্ধিতে পৌঁছিয়াছিলেন, তাঁহাদের সঙ্গে বহুবার এবং সুদীর্ঘ কাল ধরিয়া আলোচনার ফলে, তাঁহারা যে-পথে সত্যের সন্ধান ও সত্যের উপলব্ধি করিয়াছেন, তাহাতে তিনি ভাষা বা শব্দগত পার্থক্য ছাড়া আর কোনো পার্থক্য দেখিতে পান না।” একথা সেকালে চিন্তা করা বা বলা খুব সহজসাধ্য ছিল না। সেক্ষেত্রে ধর্মসমন্বয়ক দারার এই উদ্যোগ সত্যই প্রশংসনীয়।
‘মজমুয়া-অল্-বহারিন’ গ্রন্থে আমরা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ক রূপে দারাশুকোকে দেখতে পাই। যিনি কয়েকশত বছর ধরে সংঘাতপ্রবণ দুটি পক্ষকে এক অভিন্ন সামঞ্জস্যের সূত্রে বাঁধতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। দারা ইসলামী তত্ত্বজ্ঞান ও হিন্দু দার্শনিক তত্ত্বের তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য নির্মাণের যে প্রয়াস করেছেন; তা ফলবতী হলে এই উপমহাদেশের দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অনাস্থা ও অবিশ্বাসের ক্ষেত্র এতোটা ব্যাপক হতে পারতো না। পরস্পরকে বোঝার এবং একে-অন্যের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের সুস্থ একটি মাধ্যম থাকা খুবই জরুরী। দুই সাগরের সম্মিলনের যে আশা দারা দেখেছিলেন তা নিয়ে আমাদের ভাববার অবকাশ প্রচুর।
দারা যেমন সুফি ইসলামীয় দর্শন নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তেমনি পঞ্চাশটি উপনিষদের ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এই এক সময় তিনি গীতারও অনুবাদ সম্পন্ন করেন। দিল্লির নিগমবোধ মঞ্জিলে বসে করা দারার উপনিষদের অনুবাদই প্রথম ইউরোপীয় জগতে প্রবেশ করে প্রশংসা লাভ করে। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ‘শোপেনহাওয়ার’ এই অনুবাদিত উপনিষদ গ্রন্থমালার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ‘স্বামী বিবেকানন্দের’ বহু পূর্বে দারাশুকো প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে ইউরোপে পৌঁছাতে পরোক্ষে অবদান রেখে গিয়েছেন। প্রথম জীবনে সুফিবাদী দারা শেষ জীবনে বেদান্তবাদী হয়ে উঠেছিলেন। সুফিবাদ ও বেদান্তের মূল ভাবনাকে তিনি অদ্ভুত সাবলীল ভাবে নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছিলেন। দারা মোল্লা শাহ বদক্’শীর সাথে সারমাদ ও বাবালাল বৈরাগীকেও গুরু বলে গ্রহণ করেছিলেন। তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য তিনি ভ্রামরী বৃত্তি অবলম্বন করতেন। ধর্ম, জাতি, ভাষার বাধাকে উপেক্ষা করে সবার মধ্য থেকে সারবস্তুটিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অক্লান্তচিত্ত ছিলেন। সর্বক্ষেত্রে সমভাব অধ্যয়ন করে মানুষের অভেদত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। মনের সবকটি জানালাকে তিনি খুলে রেখেছিলেন। কূপমণ্ডূকতা তাঁকে কখনো গ্রাস করতে পারেনি। তাই বলা যায়, সুফিবাদী ও বেদান্তবাদী দারাশুকোর ধর্মমত ছিলো- মানবতাবাদ, সমন্বয়বাদ ও সাম্যভাব।
দুই সাগরের সম্মিলনে আশাবাদী এক শাহজাদা
আজ ভাবতে অবাক লাগে যে, মধ্যযুগের সংকীর্ণ পরিবেশে দারার মতো এমন একজন মুক্তমনা মানুষ, এমন ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাবিদ ছিলেন! তিনি পারতেন রাজকীয় ভোগ বিলাস আর সিংহাসন অধিকারের চিন্তায় লিপ্ত থাকতে। কিন্তু তা না করে সম্পূর্ণ বিপরীত পথকে বেছে নিয়ে তত্ত্বজ্ঞানচর্চা ও সমন্বয়বাদী চিন্তায় মগ্ন হয়ে থেকেছেন। তাঁর সমকালীন মানুষেরা তাঁকে বুঝতে পারেনি। এই আধুনিককালের আমরাও কী তাঁকে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছি? – এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের অন্বেষণ করে যেতে হবে, যতদিন না সেই উত্তর মেলে। ততদিন পর্যন্ত কোনো অনামা সমাধিস্থল থেকে এক ভারতীয় রাজপুত্র আমাদের দিকে অনেক আশা নিয়ে চেয়ে থাকবেন।
তথ্যসূত্র:
১. শাহজাদা দারাশুকো – কালিকারঞ্জন কানুনগো
২. কুমার দারার বেদান্তচর্চা – যদুনাথ সরকার
৩. সাংস্কৃতিকী (চতুর্থ খণ্ড) – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
৪. দারাশুকো: জীবন ও সাধনা – অমিয়কুমার মজুমদার
৫. শাহজাদা দারাশুকো – শানজিদ অর্ণব।
শ্যামল গংগোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখা শাহাজাদা দারা শুকো বই খানিতে দারাশুকো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
পড়ে ভালো লাগলো