বাইবেলের এক পুঁথি আর কেরলের খ্রিষ্টধর্মের দীর্ঘ যাত্রার কাহিনি
‘পেশিটা’ হল সিরিয়াক বাইবেল। মূলগতভাবে আরামাইক ভাষায় লেখা। পৃথিবীর অধিকাংশ খ্রিষ্টানই গ্ৰীক বাইবেলের অনুবাদ পাঠ করে, কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের যে শাখাগুলো সিরিয়া বা আসিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত তারা পেশিটা বা সিরিয়াক বাইবেলের অনুবাদ পাঠ করে। এই শাখাগুলির বেশিরভাগই কেরলে আর মধ্যপ্রাচ্যে আছে। শাখাগুলি হল কেরলের সিরো-মালাবার ক্যাথলিক, জেকোবাইট সিরিয়ান অর্থোডক্স, মলঙ্কর অর্থোডক্স, মার থোমা ইত্যাদি আর মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ান অর্থোডক্স আর আসিরিয়ান চার্চ অফ ইস্ট। পেশিটা গ্ৰীক বাইবেলের থেকে কিছুটা আলাদা। এটি যীশুর মাতৃভাষা আরামাইকে লেখা। কারো কারো মতে এটি গ্ৰীক বাইবেলের থেকে কিছুটা পুরনো- যদিও সেটা নিয়ে সংশয় আছে- গ্ৰীক বাইবেলকেই সবচেয়ে পুরনো বাইবেল বলে ধরা হয়।
আমরা পেশিটার ৮০০-৯০০ বছর পুরনো এক পুঁথির গল্প শুনব- এই পুঁথির একটা ইতিহাস আছে। এটি কেরলে খ্রিষ্টান ধর্মের ইতিহাস এবং তাদের সঙ্গে পর্তুগিজ ক্যাথলিকদের লড়াইয়ের সাক্ষী।
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ বণিক ভাস্কো ডা গামা ভারতে প্রথম পা রাখেন- কেরলের কালিকটে। পর্তুগিজরা লক্ষ করে এক হাজার বছর আগে থেকে কেরলে একটা স্থানীয় মালায়ালি খ্রিষ্টান সম্প্রদায় আছে। এরা নিজেদের নাসরানি বলত- এখনও বলে।
পুরনো হিব্রু, আরামাইক ও আরবি ভাষায় খ্রিষ্টানদের নাসরানিই বলা হত। খ্রিষ্ট বা খ্রিষ্টান শব্দটা গ্ৰীক-রোমান মূলের। নাজ়ারেথ থেকে নাসরানি বা নাজ়রিন। যাই হোক, পর্তুগিজরা দেখল এদেরকে নিজেদের প্রয়োজনে লাগানো যায়, কিন্তু একটা সমস্যা! পর্তুগিজরা রোমান ক্যাথলিক, আর কেরলের খ্রিষ্টানরা ছিল ইস্ট সিরিয়ান খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। ইস্ট সিরিয়ান খ্রিষ্টধর্মকে নেস্টরিয়ান চার্চ, পারসিক চার্চ, বা চার্চ অফ দ্য ইস্ট ও বলা হয়। তাদের উপাসনাপদ্ধতি ছিল ইস্ট সিরিয়াক লিটার্জি। পর্তুগিজদের উপাসনা পদ্ধতি ছিল লাতিন লিটার্জি। তাদের বাইবেলও আলাদা। কেরলের খ্রিষ্টানরা বিশপ আনাতো ইরান-ইরাক-সিরিয়া অঞ্চল থেকে, রোমের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ তাদের ছিল না।
দূর অতীতের কেরলে খ্রিষ্টধর্ম:
কেরলে এই ইস্ট সিরিয়ান খ্রিষ্টধর্ম কীভাবে এল? বাদবাকি ভারতে খ্রিষ্টধর্মের প্রসার শুরু হয় ভাস্কো দা গামা আসার পরে, ১৪৯৮ সাল থেকে। মুঘল যুগ শুরু হবার কয়েক দশক আগে যখন দিল্লিতে লোদি বংশ আর দাক্ষিণাত্যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আধিপত্য- সেই সময়ে। কিন্তু ভাস্কো দা গামার প্রায় এক সহস্রাব্দ আগে থেকে কেরলে খ্রিষ্টান ধর্ম ছিল। কীভাবে এর বিস্তার শুরু হয়? লোককথা অনুযায়ী যীশুর বারো জন শিষ্যের একজন- সেন্ট থমাস- যীশুর মৃত্যুর এক-দুই দশকের মধ্যে কেরলে এসে ৫২ অব্দে কোডুঙ্গালুরে ভারতের প্রথম চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
সেন্ট থমাস ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা সেই নিয়ে কিছু সংশয় আছে, তিনি কেরলে এসেছেন কিনা জোর দিয়ে বলা যায় না, তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের বিভিন্ন পারসিক ও রোমান লেখায় তাঁকে ভারতীয় খ্রিষ্টান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
যে ঘটনাটির ঐতিহাসিক প্রমাণ সবচেয়ে জোরদার হল ক্নাই থোমা নামক বণিকনেতার নেতৃত্বে ৭২টি বণিক পরিবারের মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে আসা এবং কের বংশীয় শাসক অর্থাৎ কেরমন পেরুমলের কাছ থেকে কয়েকটি গ্ৰামের অধিকার পাওয়া।
কেরমন পেরুমল কোনো একজন মানুষ নয়, এটি একটি উপাধি। কেরমন পেরুমলের দেয়া একটি তাম্রশাসনে এই দানের উল্লেখ আছে। এই ধরনের ভূমিদান (grant) মূলত ব্রাহ্মণরাই পেত অগ্ৰহার ব্যবস্থার মাধ্যমে। মূল তাম্রশাসনটি হারিয়ে গেছে; তবে এর কিছু অনুবাদ টিকে আছে। এই ৭২টি পরিবার এখনো টিকে আছে। এরা নিজেদের ক্নানায়া বলে। ক্নানায়া পরিবারগুলো নিজেদের মধ্যে অন্তর্বিবাহের মাধ্যমেই বিয়ে করে, অন্য কেরল খ্রিষ্টানদের সাধারণত বিয়ে করে না। মূলত উচ্চবর্ণের, বিশেষ করে নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের সামাজিক প্রথাগুলো এরা মেনে চলে। এই তাম্রশাসনটি অবশ্যই নবম শতকের আগের। ক্নানায়ারা এটিকে ৩৪৫ অব্দের বলে দাবি করে, তবে অনেকের মতে এটি আরেকটু অর্বাচীন। ক্নানায়া মানে হল বাইবেলে বর্ণিত Canaanite জাতি।
“কোল্লম সিরিয়ান কপার প্লেটস”- অনুলিপি
আরেকটি দানপত্র যা এখনও টিকে আছে সেটির নাম হল “কোল্লম সিরিয়ান কপার প্লেটস”, আনুমানিক ৮৫০ অব্দের। কেরমন পেরুমল স্থানু রবি এই তাম্রশাসনের মাধ্যমে ভূমিদান করেন গির্জা নির্মাণের জন্য। দানের গ্ৰহীতা ছিলেন কোল্লম শহরের প্রতিষ্ঠাতা মার সাপির ইসো। এখানে দুটি বণিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করার উল্লেখ আছে। এই তাম্রশাসন মার সাপিরকে আরও অনেক বিশেষ অধিকার এবং সুবিধা প্রদান করে। তার মধ্যে ছিল একটি দাঁড়িপাল্লা ও কয়েকটি বাটখারা রক্ষা করার অধিকার, যেটা তখনকার বাণিজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর ছিল বেশ কিছু শূদ্র পরিবারকে ঐ জমিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করার ক্ষমতাপ্রদান। এছাড়া গির্জার জমি থেকে আসা সবরকম আয়কে আয়কর প্রদান থেকে রেহাই দেয়া হয়। এটা অনেকটা ব্রাহ্মণদের প্রদত্ত অগ্ৰহারের জমির মত। এখনকার sez (special economic zone) এর সঙ্গেও কিছুটা তুলনা করা যায়। এই তাম্রশাসনে অতীতের ক্নাই থোমাকে দেওয়া দানপত্রটিরও উল্লেখ আছে।
সাক্ষী হিসেবে যারা এই প্লেটে সই করেছিল তাদের সই আছে তিনটি হরফে। কুফিক আরব লিপিতে ১১টি, পহ্লবী পারসিক লিপিতে ১০টি, হিব্রুতে ৫টি স্বাক্ষর। স্বাক্ষরকারীরা সম্ভবত মুসলিম আরব, নেস্টরিয়ান খ্রিষ্টান, পারসিক ইহুদি উৎসের ছিল। এর থেকে বোঝা যায় কেরল নবম শতকে রীতিমত একটা বহুজাতিক বাণিজ্য ও বসতের স্থান ছিল।
ক্নানায়া ব্যতীত অন্য কেরল খ্রিষ্টানরা দাবি করে ক্নানায়াদের অনেক আগেই সেন্ট থমাস ধর্মপ্রচার করতে এসেছিলেন। অনেকে মনে করে বিভিন্ন ইহুদীজাতিভুক্ত খ্রিষ্টান বণিকরা ফিলিস্তিনের দিক থেকে কেরলে এসে বসত গড়ে, মোটামুটি তৃতীয় শতক থেকে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের মিশ্রণের ফলে কেরলের নাসরানিদের সৃষ্টি হয়। ক্নানায়া বণিকরা এই বৃহত্তর নাসরানি গোষ্ঠীর একটি অংশ মাত্র।
কাডুথুরুথির সেন্ট মেরিজ় ক্নানায়া চার্চে গ্ৰানাইটের নাসরানি স্তম্ভ, ১৫৯৬ অব্দ। উল্টোনো পদ্ম আর দুদিকে হাতি
কেরলে ষোড়শ শতকের আগের গির্জা বিশেষ অবশিষ্ট নেই, তবে আদিমধ্যযুগের অনেক খ্রিষ্টান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল উল্লিখিত তাম্রশাসনটি আর ইরানীয় পহ্লবী লিপি খোদাই করা বেশ কিছু পাথরের ক্রস। এগুলো অষ্টম থেকে দশম শতকের- বেশ কয়েকটি গির্জায় রক্ষিত আছে।
পারসিক ক্রস, কদমত্তোম চার্চ, এরনাকুলম। আর্চগুলিতে পহ্লবী লিপি
আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রত্নসম্পদ হল বেশ কিছু ওপেন এয়ার ক্রস- উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে (সাধারণত গির্জার পশ্চিম দিকে) স্থাপিত পাথরের ক্রস। অনেকটা হিন্দু মন্দিরের সামনে রাখা দীপস্তম্ভের মত। এগুলিকে নাসরানি স্তম্ভও বলা হয়। এগুলির কয়েকটি বেশ পুরোনো, কিছু অর্বাচীন। হিন্দু এবং খ্রিষ্টান দুরকম সংস্কৃতির মিশ্রণ এগুলির মধ্যে দেখা যায়। স্তম্ভের নিচে উল্টোনো পদ্মফুল (হিন্দু প্রভাব), পদ্মের দুদিকে প্রহরী হাতি (হিন্দু প্রভাব), ক্রসের উল্লম্ব ও আনুভূমিক দণ্ডগুলোর সংযোগস্থলে ষোলো স্পোকযুক্ত চক্র (হিন্দু প্রভাব), ময়ূর (হিন্দু প্রভাব), মাছ (যীশুর প্রতীক)- এগুলো লক্ষণীয়। উল্টোনো পদ্ম, হাতি, চক্র- এগুলো অবশ্য আদিতে বৌদ্ধ শিল্পরীতি ছিল যা পরে হিন্দুরা গ্ৰহণ করে। এই ক্রসগুলির চারিদিকে ভক্তরা পরিক্রমণ করে- সেটাও অনেকটাই ভারতীয় ধর্মাচার।
নাসরানি স্তম্ভ, মার্থা মরিয়ম চার্চ, কুরবিলঙ্গড। উল্টোনো পদ্ম আর ক্রসের হাতগুলোর সংযোগস্থলে ষোলো স্পোকযুক্ত চক্র।
খ্রিষ্টান ধর্মের বিভিন্ন শাখা:
ষোড়শ শতকে পর্তুগিজ আর কেরলের খ্রিষ্টানদের মধ্যে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, সেটাকে বোঝার জন্য খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার কথা জানা প্রয়োজন। খ্রিষ্টান ধর্মের পাঁচটি প্রধান শাখা-
১. ইস্ট সিরিয়ান খ্রিষ্টধর্ম (বা চার্চ অব দ্য ইস্ট বা নেস্টরিয়ান চার্চ): এরা ৪৩১ অব্দে রোমান চার্চ থেকে আলাদা হয়। অতীতের বিস্তার পারস্য, মধ্য এশিয়া ও লেভান্টে। এখন সীমিত ইরাকে।
২. ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্স: এরা ৪৫১ সালে রোমান চার্চ থেকে আলাদা হয়। এর ৬টি উপশাখা- কপটিক অর্থোডক্স (মিশর), ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স (ইথিওপিয়া), এরিট্রিয়ান অর্থোডক্স (এরিট্রিয়া), আর্মেনিয়ান অর্থোডক্স (আর্মেনিয়া), সিরিয়ান অর্থোডক্স (মধ্যপ্রাচ্য ও কেরল), মলঙ্কর অর্থোডক্স (কেরল)।
৩. ইস্টার্ন অর্থোডক্স: এরা ১০৫৪ সালে রোমান চার্চ থেকে আলাদা হয়। এটি গ্ৰীস, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপে বেশি প্রচলিত। লেভান্তের আরবদেশগুলোতে অল্প উপস্থিতি আছে।
৪. রোমান ক্যাথলিক চার্চ: এটি প্রায় বিশ্বব্যাপী চার্চ যা রোমের পোপের অধীনে।
৫. প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ: এরা ষোড়শ শতকে রোমান চার্চ থেকে আলাদা হয়।
প্রথম তিনটি বিভাজন হয় তুরস্কে তবে এই ঘটনাগুলোর প্রভাব কেরলের খ্রিষ্টানদের ইতিহাসে দেখা যায়।
এবার কেরলের শাখাগুলো এক নজরে:
ক. মলঙ্কর অর্থোডক্স: এটি ২ নং শাখার একটি উপশাখা, তবে ১ নং এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
খ. জেকোবাইট সিরিয়ান অর্থোডক্স: এটি ২ নং শাখার অন্তর্ভুক্ত সিরিয়ান অর্থোডক্স উপশাখার একটি অংশ, তবে ১ নং এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
গ. সিরো মালাবার ক্যাথলিক: এদের ইতিহাস বেশ জটিল, যেটা বিশদে আলোচনা হবে এই লেখায়।
ঘ. রোমান ক্যাথলিক।
ঙ. মার থোমা প্রোটেস্ট্যান্ট: এটি ৫ নং শাখার একটি উপশাখা, তবে এদের ইতিহাস ১,২,৪ নং শাখার সঙ্গে যুক্ত।
প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগে কেরলের খ্রিষ্টানধর্ম ছিল মূলত ১ নং অর্থাৎ ইস্ট সিরিয়ান (বা নেস্টরিয়ান) শাখার, এবং পারস্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সপ্তম শতকে ইরান প্রায় সম্পূর্ণ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার পর ইরাকে, বিশেষ করে বাগদাদে নেস্টরিয়ানরা নিজেদের টিকিয়ে রাখে এবং সেখান থেকেই কেরলে বিশপরা আসত পরবর্তীকালে।
ষোড়শ শতকের টানাপোড়েন:
ছলে বলে কৌশলে বিশেষ করে অস্ত্রবলে ও অর্থবলে পর্তুগিজরা রোমান ক্যাথলিক চার্চের দিকে টানার চেষ্টা করল কেরলের খ্রিষ্টানদের। পর্তুগিজরা এদের গ্ৰন্থাগার পুড়িয়ে দিল, এছাড়া ইরাক থেকে বিশপরা আসত গোয়ার বন্দর হয়ে- আর সেখানেও পর্তুগিজরা বাধা সৃষ্টি করে। একাধিক বিবাদ হয় ষোড়শ শতক জুড়ে।
শেষ অবধি একটা বড় অংশকে পর্তুগিজরা ক্যাথলিক ধর্মের দিকে টানতে পারলেও ঐ অংশটা পুরোনো ইস্ট সিরিয়াক উপাসনা পদ্ধতিই চালু রাখে, পেশিটাকেই বাইবেল হিসেবে রাখে, তবে রোমান ক্যাথলিক পোপের সাথে তারা কমিউনিয়নে আবদ্ধ হয়। এই নূতন সম্প্রদায়ের নাম হল “সিরো-মালাবার ক্যাথলিক”। এরা ক্যাথলিকের আওতায় এল, কিন্তু নাম থেকে সিরিয়া শব্দটা বাদ দিল না, আর লাতিন উপাসনাপদ্ধতিও গ্রহণ করল না। অন্য অংশ বাগদাদ ও সিরিয়ার সঙ্গে নূতন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তবে ইস্ট সিরিয়ান বা নেস্টরিয়ান চার্চের সঙ্গে নূতন করে যোগাযোগ হয় না, বরং সিরিয়ান অর্থোডক্স চার্চ তাদের বিশপদের কেরলে পাঠাতে রাজি হয়। অতএব যে অংশটি ক্যাথলিক হল না, তারা জেকোবাইট সিরিয়ান অর্থোডক্স ধর্ম অনুসরণ করতে থাকে এবং সেখান থেকে মলঙ্কর অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের জন্ম হয়।
এই প্রসঙ্গে আবার মনে করিয়ে দিই- ইস্ট সিরিয়ান খ্রিষ্টধর্ম এবং সিরিয়ান অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্ম আলাদা, যদিও দুটিই সিরিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তারা ৪৩১ ও ৪৫১ সালে যথাক্রমে রোমান চার্চ থেকে আলাদা হয়। বিভিন্ন মতপার্থক্য থাকলেও এই দুই দলের উপাসনাপদ্ধতিতে মিল আছে। প্রথম দল ইস্ট সিরিয়াক লিটার্জি আর দ্বিতীয় দল ওয়েস্ট সিরিয়াক লিটার্জি ব্যবহার করে উপাসনা করে। দুই দলেরই উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ‘কুরবানা’। এটি একটি আরামাইক শব্দ যার অর্থ হল ‘অর্পণ’। বাংলায় এটিকে আমরা কোরবানি বলি। কেরলে সিরো মালাবার ক্যাথলিকরা ইস্ট সিরিয়াক আর মলঙ্কর অর্থোডক্সরা ওয়েস্ট সিরিয়াক উপাসনাপদ্ধতি ব্যবহার করে, এবং দুই দলই কুরবানা করে।
আরও পরে ১০৫৪ সালে রোমান চার্চ আবার আরো দু টুকরো হয়ে ইস্টার্ন অর্থোডক্স (কন্স্টান্টিলোপোল কেন্দ্রিক) ও ক্যাথলিক চার্চ (রোম কেন্দ্রিক) তৈরি হয়, এবং আরো পাঁচশ বছর পর ক্যাথলিক চার্চ ভেঙে প্রোটেস্টান্ট চার্চ তৈরি হয়। পর্তুগিজরা ছিল রোমান ক্যাথলিক।
এই নেস্টরিয়ান বা ইস্ট সিরিয়ান চার্চ একসময় বৃহত্তর ইরান ও মধ্যএশিয়ায় জরথুষ্ট্রীয় ও বৌদ্ধধর্মের সমান জনপ্রিয় ছিল। ইরানের সাসানীয় সম্রাটরা জরথুষ্ট্রীয় হলেও খ্রিষ্টানদের প্রতি সহনশীল ছিল, আর নেস্টরিয়ান চার্চকে রাষ্ট্রীয় চার্চ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। শেষ সাসানীয় সম্রাট আরব খিলাফতের আক্রমণের পর যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন তাঁর মৃত্যুর পর শেষকৃত্য করেন এক নেস্টরিয়ান বিশপ।
ইসলামের জন্মের পর নেস্টরিয়ান খ্রিষ্টান ধর্মের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং মূলত কেরলে এবং বিক্ষিপ্তভাবে মধ্যপ্রাচ্যে এরা টিকে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের অংশটা পঞ্চদশ শতক থেকে আসিরিয়ান চার্চ নাম ব্যবহার করে। সাধারণত আসিরিয়া বলতে উত্তর ইরাক এবং পূর্ব সিরিয়াকে বোঝায়। আসিরিয়া, সিরিয়া দুটো শব্দ একই উৎস থেকে এসেছে। বিংশ শতকে প্রথমে অটোমান তুর্কদের হাতে এবং পরে ইরাকের হাতে আসিরীয় খ্রিষ্টানদের বড়সড় গণহত্যা হয়- প্রথমটি আসিরিয়ান জেনোসাইড বা সেফো নামে পরিচিত যাতে সংগঠিত ভাবে ২৫০,০০০ আসিরীয় খ্রিষ্টানকে, অর্থাৎ ওদের প্রায় অর্ধেক মানুষকে হত্যা করা হয়। কেরলে আসিরীয় খ্রিষ্টধর্মের পরম্পরা আজও টিকে আছে ইস্ট সিরিয়াক লিটার্জির মধ্যে।
ডেভিড বা নবী দাউদ (বুকানন বাইবেলের একটি ছবি)
যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেরলে ফিরে আসি। পর্তুগিজরা গ্ৰন্থাগার ধ্বংস করেছিল বলেছি। এটি কোচির কাছাকাছি অঙ্গমালির একটি গির্জার গ্ৰন্থাগার। তবে এই ধ্বংসলীলা থেকে সম্ভবত একটি আট-নয়শো বছর পুরোনো সিরিয়াক বাইবেল বেঁচে যায়। সেটি স্থানীয় খ্রিষ্টানরা দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখে পর্তুগিজদের ভয়ে। এটি একজন ইংরেজ মিশনারি – তাঁর নাম বুকানন- তিনি খুঁজে পান অঙ্গমালি গির্জাতেই ১৮০৬ সালে। মলঙ্কর অর্থোডক্স চার্চের প্রধান মার থোমার সঙ্গে তাঁর ভাল বন্ধুত্ব হয়, এবং বুকানন এটি আরামাইক থেকে মালায়লমে অনুবাদ করার আগ্ৰহ দেখান। মার থোমা তাঁকে এই বিরল বইটি উপহার দেন বইটির সুরক্ষা এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তাছাড়া পর্তুগিজদের ভয় ঐ অঞ্চলে ১৮২০ অবধি ছিল, আর এক দশক আগে টিপু সুলতানের আক্রমণে কেরলের অনেক গির্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতএব বইটির সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল। ইংরেজদের সঙ্গে পর্তুগিজদের বিরোধ ছিল, তাই তাদের ভরসা করা গিয়েছিল।
বুকানন কথা রাখেন এবং তাঁর উদ্যোগে এটি সংরক্ষিত ও অনূদিত হয়। এখন এই বইটি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আছে, এবং ওদের ডিজিটাল আর্কাইভে দেখতে পারেন। এই বইটি এখন বুকানন বাইবেল নামে পরিচিত।
বুকানন ছিলেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উপাধ্যক্ষ। তিনি একজন ধর্মপ্রচারক এবং হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন। জগন্নাথের রথযাত্রায় শিশুবলি হত- এই ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য তাঁর লেখায় পাওয়া যায়।
ডানদিকে গ্ৰীক ও বাম দিকে আর্মেনিয় লিপি (বুকানন বাইবেলের একটি ছবি)
বুকানন বাইবেলের ইতিহাস:
ভারতের সঙ্গে আরামাইক ভাষা ও লিপির যোগ অনেক পুরোনো। অশোকের কান্দাহার দ্বিভাষিক শিলালিপির একটি ভাষা ছিল আরামাইক। সিরিয়াক আর আরামাইক একই ভাষা। আসলে সিরিয়াক হল আরামাইকের একটি উপভাষা- আর ধর্মীয় কাজে আরামাইকের উপভাষাগুলির মধ্যে সিরিয়াকই বেশী ব্যবহার হয়।
এবার এই আরামাইক বাইবেলের নয়শো বছর পুরোনো ইতিহাস দেখা যাক। তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বে তুর আবদিন অঞ্চলের এডেসা শহর- আধুনিক নাম উর্ফা- এটি সিরিয়া সীমান্তের কাছেই। এখানেই সিরিয়াক লিপিতে এই পুঁথিটি তৈরি করা হয় দ্বাদশ শতকে। অনেকে মনে করে বইটি পর্তুগিজদের আসার আগেই এবং গ্ৰন্থাগার পোড়ানোর আগেই কেরলে ছিল। আবার অনেকে মনে করে এই বইটি সিরিয়ার দিক থেকে কেরলে আনা হয় যখন নূতন করে যোগাযোগ শুরু হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। যেটাই হোক না কেন, এটা সত্যি যে বইটি দ্বাদশ শতকের, এবং দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
বাইবেলের পুঁথি খণ্ডে খণ্ডে তৈরি করা হত, কারণ পুরো বই টানাটানি করা কঠিন এবং বইটা নষ্ট হলে পুরোটাই নষ্ট হবে। একটা খণ্ড নষ্ট হলে সেই ভয় থাকে না। মনে রাখতে হবে নয়শো বছর আগে মুড়ি মুড়কির মত বই প্রকাশ হত না। পুঁথি ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। খণ্ড খণ্ড নয়, এই বইটি ছিল পূর্ণাঙ্গ বাইবেল (pandex) যা সপ্তদশ শতকের আগে বিরল। আর এত পুরোনো সিরিয়াক বাইবেলের পুঁথি এখনো অবধি মাত্র চারটি পাওয়া গেছে।
আর বিশেষ মূল্যবান সম্পদ হল এই বইয়ের ছবিগুলো। রেনেসাঁ-পূর্ব যুগের মধ্যপ্রাচ্যের চিত্রশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর এটি। যেহেতু এই ধরনের বাইবেলের পুঁথি হাজার কি, দেড় হাজার বছর ধরে বিভিন্ন গির্জায় বা মঠে ব্যবহার হত, তাই অনেক সময় এই ধরনের চিত্রগুলির উপর overpainting হত, নূতন করে রঙ লাগিয়ে। এটিতে কিন্তু মোটামুটি সেই যুগের রঙই অক্ষত আছে বলে অনুমিত হয়। ছবিগুলো জেরুজালেমের চিত্রশৈলীর, তবে কিছু লাতিন প্রভাব আছে।
রুথ- ইনি ডেভিড বা দাউদের প্রপিতামহী (বুকানন বাইবেলের একটি ছবি)
আরও দুটো মজার তথ্য দিই- এক, ঐ যুগে এই ধরনের বড় বইয়ের কপি যখন বানানো হত, বইতে প্রত্যেকটা শব্দ গুণে দেয়া হত যাতে মূল পুঁথির সঙ্গে তুলনা করে বোঝা যায় কপি ঠিকমত হল কিনা! কীরকম পরিশ্রম ও ধৈর্যের কাজ ভাবুন! দুই, এই বইয়ের কিছু পাতার মার্জিনে আরবি, গ্ৰীক ও আর্মেনিয় ভাষায় টুকটাক লেখা দেখা যায়, যার থেকে বোঝা যায় কত আলাদা আলাদা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বইটার হাতবদল হয়েছে। এরকম একটা পুঁথি সেই যুগে একটা অমূল্য সম্পদ ছিল, যার ফলে একাধিকবার হাতবদল হয়েছিল।
এই বইয়ের মাধ্যমে সিরিয়া-আসিরিয়া এবং সেখানকার খ্রিষ্টধর্মের একটুকরো স্মৃতি ভারতবর্ষে টিকে ছিল। এখনও টিকে আছে এর মালায়লম অনুবাদগুলোর মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কেরলের হাজার হাজার বছরের বাণিজ্যিক যোগ- যা খ্রিষ্টজন্মের এক হাজার বছর আগেও ছিল- তারও প্রতিভূ এই বইটি।
তথ্যসূত্র:
১. https://cudl.lib.cam.ac.uk/view/MS-OO-00001-00001/633
২. https://specialcollections-blog.lib.cam.ac.uk/?p=20848
৩. https://en.m.wikipedia.org/wiki/India_(East_Syriac_ecclesiastical_province)
৫. https://mosc.in/the_church/hisrory/before-1653
৬. https://mosc.in/the_church/hisrory/640-2
৭. https://en.wikipedia.org/wiki/Thomas_of_Cana_copper_plates
৮. https://en.wikipedia.org/wiki/Quilon_Syrian_copper_plates
অত্যন্ত ভাল লেখা। অনেকদিন পর এমন একটা লেখা পেলাম যার বিস্তার বহুদূর।
এতদিন ধারণা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরাই কেবল বহুত্ববাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এসেছে। খ্রিস্টধর্মেও যে এমন চরিত্র আছে তার প্রমাণ এই লেখাটি। সাথে ইউরোপের সাথে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যের হদিস মেলে।
এই লেখাটা পড়ে আগ্রহী হয়ে বুকাননের বইটা খানিকটা উল্টে পাল্টে দেখলাম, খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আশাকরি সুদীপ্ত বাবু এই লেখাটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। খুব ভাল লেখা।
অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলাম এই প্রবন্ধটি পড়ে।
অত্যন্ত ভালো লেখা। অনেক অজানা তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ লেখককে।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, কারন এই বিষয়ে প্রায় কিছুই জানতাম না। সমৃদ্ধ হলাম।