বাংলায় চোল আক্রমণ ও একটি ব্রোঞ্জের প্রতিমা
অন্ত মধ্যযুগ থেকে যে ভূভাগ বাঙ্গালা বা বাংলা নামে পরিচিত, আদি মধ্যযুগ থেকেই সেই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির ক্রমশ একটি রাজ্যতন্ত্রের অধীনে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সাধারণাব্দের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী কোনও সময় রচিত আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে (৫৩.৬৮৭) উল্লিখিত ‘গৌড়তন্ত্র’১ সম্ভবত এই পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। আদি মধ্যযুগে বাংলা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণাব্দের অষ্টম শতকে কাশ্মীরের শাসক ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় এবং একাদশ শতকে তামিল ভূমির শাসক রাজেন্দ্র চোলের সেনার আক্রমণে। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও উত্স থেকে আদি মধ্যযুগের এই দুই বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও আক্রমণের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে প্রায় কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি।
চোল শাসক প্রথম রাজেন্দ্র চোলের (রাজত্বকাল আনুমানিক ১০১৪-১০৪৪ সাধারণাব্দ) সেনাবাহিনীর ১০২১ থেকে ১০২৩ সাধারণাব্দ পর্যন্ত, দু’ বছর ধরে উত্তর দিকে সামরিক অভিযান, বিশেষত বাংলায় অভিযান, নিঃসন্দেহে আদি মধ্যযুগের ইতিহাসের একটি উল্লেখনীয় ঘটনা। আনুমানিক ১০২২ সাধারণাব্দ নাগাদ প্রথম রাজেন্দ্র চোলের সেনা বাংলা আক্রমণ ও ব্যাপক লুণ্ঠন করে ফিরে যায়। প্রথম রাজেন্দ্র চোলের তিরুমালাই শিলালেখে এই সামরিক অভিযান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিরুমালাই শিলালেখ তাঁর রাজত্বকালের ত্রয়োদশ বর্ষে (১০২৫ সাধারণাব্দ) উৎকীর্ণ। তামিল ও গ্রন্থ লিপি সমন্বিত তামিল ভাষায় রচিত এই প্রশস্তি থেকে প্রথম রাজেন্দ্র চোলের বাংলা আক্রমণ সম্পর্কে জানা যায়।২ ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবিষ্কৃত তিরুবালঙ্গাড়ু তাম্রশাসন দ্বিভাষিক, তামিল ও সংস্কৃতে লিখিত। এই লেখটির তামিল অংশ প্রথম রাজেন্দ্র চোলের রাজত্বকালের ষষ্ঠ বর্ষে (১০১৮ সাধারণাব্দ) রচিত এবং সংস্কৃত অংশ এর প্রায় এক দশক পরে সংযোজিত বলে অনুমান করা হয়। তিরুবালঙ্গাড়ু তাম্রশাসনের সংস্কৃত অংশে (১১৬-১১৭ শ্লোক ও ১১৯ শ্লোক) প্রথম রাজেন্দ্র চোলের সেনাপতির বাংলা আক্রমণের উল্লেখ রয়েছে।৩ এই দুই লেখে উল্লিখিত বিবরণ অনুযায়ী, প্রথম রাজেন্দ্র চোলের সেনা দণ্ডভুক্তির শাসক কাম্বোজবংশীয় ধর্মপাল, দক্ষিণ রাঢ়ের শূরবংশীয় শাসক রণশূর, বঙ্গালের (বা বঙ্গ) (এবং সমতটের) চন্দ্রবংশীয় শাসক গোবিন্দচন্দ্র (রাজত্বকাল আনুমানিক ১০২০-১০৪৫ সাধারণাব্দ) এবং সর্বোপরি উত্তর রাঢ় (এবং বরেন্দ্রভূমির) পালবংশীয় শাসক প্রথম মহীপালের (রাজত্বকাল আনুমানিক ৯৮৮-১০৩৮ সাধারণাব্দ) সেনাকে পরাস্ত করেছিল। ‘অবিরাম-বর্ষাবারি-সিক্ত’ বঙ্গালের শাসক গোবিন্দচন্দ্র হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন, এবং পরাজিত হয়ে হাতির পিঠ থেকে নেমে পালিয়ে যান। রাজেন্দ্র চোলের সেনাপতি প্রথম মহীপালকে পরাজিত করে তাঁর দুর্মদ রণহস্তি, নারীগণ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে দেশে ফিরে যান।৪
প্রথম রাজেন্দ্র চোলের সেনার বাংলা আক্রমণ সম্পর্কে আধুনিক ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের চোল লেখমালা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ – “চোলরাজের সভাকবি এই অভিযানের যে বর্ণনা দিয়াছেন, তাহাতে অনুমিত হয়, গঙ্গাজল সংগ্রহ করা ছাড়া ইহার আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। তামিল ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করেন যে, এই অভিযানে আর কোনও স্থায়ী ফল লাভ জয় নাই। চোল প্রশস্তিতে বাংলায় চোলরাজ্যের প্রভুত্ব বা প্রতিষ্ঠার কোন উল্লেখ নাই; কেবল বলা হইয়াছে, চোল সেনাপতি বাংলার পরাজিত রাজন্যবর্গকে মস্তকে গঙ্গাজল বহন করিয়া আনিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। ইহা সত্য হইলে বলিতে হইবে যে, পৃথিবীতে অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের জন্য যত উত্পীড়ন ও অত্যাচার হইয়াছে, চোলরাজের বঙ্গদেশ আক্রমণ তাহার এক চরম দৃষ্টান্ত। বিনাযুদ্ধে বাংলার রাজগণ যে চোল রাজাকে গঙ্গাজল দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন, ইহা চোল প্রশস্তিকার বলেন নাই, এবং ইহা স্বভাবতই বিশ্বাস করা কঠিন। সুতরাং ইহার জন্য অনর্থক সহস্র সহস্র লোক হত্যা করা ধর্মের নামে গুরুতর অধর্ম বলিয়াই মনে হয়। অপর পক্ষে দিগ্বিজয়ী রাজেন্দ্র চোল যে কেবল গঙ্গাজলের জন্যই সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন, বঙ্গদেশ জয় করা তাঁহার মোটেই উদ্দেশ্য ছিল না, ইহাও বিশ্বাস করা কঠিন। হয়ত এই চেষ্টা সফল হয় নাই বলিয়াই চোলরাজের সভাকবি পরাজয় ও ব্যর্থতার কলঙ্ক গঙ্গাজল দিয়া ধুইয়া ফেলিতে প্রয়াস পাইয়াছেন।”৫
বাংলা অভিযানের সময় রাজেন্দ্র চোলের সেনা এখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিল।৬ এখনও পর্যন্ত কেবল মাত্র একটি লুন্ঠিত ব্রোঞ্জের ঊর্ধ্বমুখ বৃষভের উপর নৃত্যরত দশভুজ শিবের প্রতিমা ছাড়া বাংলা থেকে চোল সেনাদের লুন্ঠিত সম্পদ সম্পর্কে প্রায় কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি।
আদি মধ্যযুগের দক্ষিণ ভারতে উপাসিত অপস্মার পুরুষের উপর তাণ্ডব নৃত্যরত চতুর্ভুজ নটরাজ শিবের প্রতিমার পরিবর্তে বাংলায়, বিশেষত, বঙ্গ ও সমতট অঞ্চলে, বৃষভের উপর তাণ্ডব নৃত্যরত অষ্টভুজ, দশভুজ বা দ্বাদশভুজ ঊর্ধ্বলিঙ্গ শিবের প্রতিমা উপাসিত হতো। শিবের এই রূপকে নর্তেশ্বর, নটেশ্বর বা নটেশ নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত নবীনগর উপজেলার নাটঘর গ্রামের একটি মন্দিরে এই কালপর্বে নির্মিত একটি বৃষভের উপর নৃত্যরত দ্বাদশভুজ নর্তেশ্বর শিবের প্রতিমা আজও পূজিত হয়।৭ বাংলাদেশের বর্তমান কুমিল্লা জেলার ভারেল্লা থেকে প্রাপ্ত একটি ভগ্ন নৃত্যরত দ্বাদশভুজ শিবের প্রতিমার পাদপীঠের লেখ অনুযায়ী এই প্রতিমা বঙ্গ ও সমতটের চন্দ্রবংশীয় শাসক লড়হচন্দ্রের (রাজত্বকাল আনুমানিক ১০০০-১০২০ সাধারণাব্দ) রাজত্বকালের অষ্টাদশ বর্ষে অভিষিক্ত নর্তেশ্বরের প্রতিমা বলে বর্ণিত।৮ লড়হচন্দ্রের পুত্র গোবিন্দচন্দ্রের ময়নামতী তাম্রশাসনে তাঁর শিবভট্টারকমুদ্দিশ্য নর্তেশ্বর ভট্টারকের উদ্দেশে ভূমিদানের উল্লেখ পাওয়া যায়।৯ ‘দেব্যামত’ নামের একটি প্রাচীন শৈব প্রতিষ্ঠাতন্ত্র গ্রন্থে দশভুজ নট্টেশ্বর শিবের প্রতিমার যে বর্ণনা রয়েছে, বাংলার নর্তেশ্বর শিবের প্রতিমার রূপকল্প তারই অনুরূপ। বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলায় এই রূপকল্প অনুসারী নর্তেশ্বর শিবের ঢালাই করা ধাতব প্রতিমা নির্মাণের রীতি যে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, তার প্রমাণ বিদ্যমান।১০
আদি মধ্যযুগের ভারতীয় শাসকদের মধ্যে বিজয়ের স্মারক হিসাবে পরাজিত শাসকদের স্থাপিত মন্দির থেকে বিগ্রহ লুণ্ঠন করে নিজের রাজ্যের মন্দিরে এনে স্থাপন করার রীতি বহুল প্রচলিত ছিল, অন্ত মধ্যযুগেও এই রীতির প্রচলন ছিল।১১ বাংলা থেকে চোল সেনাদের লুণ্ঠন করে নিয়ে আসার পর দশভুজ নর্তেশ্বর শিবের প্রতিমাটি বর্তমান তামিলনাড়ুর কুড্ডালুর জেলার মেলাক্কাদাম্বুর গ্রামের অমৃতঘটেশ্বর মন্দিরে স্থাপন করা হয় এবং আজও প্রতিমাটি এই মন্দিরেই বিদ্যমান। এই প্রতিমার পাদপীঠে পার্শ্বদেবতা হিসাবে গণেশ, স্কন্দ ও অন্যান্য শিবের গণদের প্রতিমা দেখতে পাওয়া যায়।১২ তামিলনাড়ুর মন্দিরে অবস্থিত নর্তেশ্বর শিবের এই প্রতিমাটি প্রথম রাজেন্দ্র চোলের সেনাদের বাংলা আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ঘটনাকে কখনওই বিস্মৃত হতে দেবে না।
পাদটীকা:
১. P.L. Vaidya, ed. “Mahāyānasūtrasaṁgraha, Part II”; Darbhanga: The Mithila Institute of Post-Graduate Studies and Research in Sanskrit Learning, 1964, p. 498.
২. E. Hultzsch, “Tirumalai Rock Inscription of Rajendra-Chola I” in E. Hultzsch and Sten Konow ed., “Epigraphia Indica, Vol. IX-1907-1908”; Calcutta: Office of the Superintendent of Government Printing, India, 1908, pp. 229-233.
৩. H. Krishna Sastri, “The Tiruvalangadu Copper-Plates of the Sixth Year of Rajendra-Chola I” in “South Indian Inscriptions, Vol. III, Part III”; Madras: The Superintendent, Government Press, pp. 424-425.
৪. R.C. Majumdar, “History of Ancient Bengal”; Calcutta: G. Bhardwaj & Co., 1971, pp. 132-134.
৫. রমেশচন্দ্র মজুমদার, “বাংলা দেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড [প্রাচীন যুগ]”; কলিকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, পরিবর্তিত চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৬৬, পৃ. ৬৩।
৬. নীতিশ সেনগুপ্ত, “বঙ্গভূমি ও বাঙালির ইতিহাস”; কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০০৮, পৃ. ৪৪।
৭. Nalini Kanta Bhattasali, “Iconography of Buddhist and Brahmanical Sculptures in the Dacca Museum”; Dacca: Dacca Museum Committee, 1929, pp. 110-111.
৮. ibid, pp. 114-115.
৯. শম্ভুনাথ কুণ্ডু, “বঙ্গে বৌদ্ধধর্ম: লেখমালার আলোকে”, গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “ইতিহাস অনুসন্ধান ১৬”; কলকাতা: ফার্মা কেএলএম, পৃ. ১৩৬।
১০. Anna Ślączka, “Dancing Śiva Images from Bengal” in Mokammal H. Bhuiyan ed. “South Asian Heritage: Essays in Memory of M. Harunur Rashid”;Dhaka: Bangla Academy, 2015, pp. 125-155.
১১. Richard M. Eaton, “India in the Persianate Age 1000-1765”; London: Allen Lane, an imprint of Penguin Books, 2019, pp. 28-29.
১২. C. Sivaramamurti, “Nataraja in Art, Thought and Literature”; New Delhi: National Museum. p. 304.
তথ্যসূত্র:
১. A.C. Banerji, “Chola Invasion of Bengal” in “Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, No. 4 (October, 1935)”; London: The Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, pp. 655-666.
২. K.A. Nilakanta Sastri, “The Coḷas”; Madras: University of Madras, 2nd edition, 1955, pp. 206-209.
৩. S. Krishnaswami Aiyangar, “The Chola Invasion of Bengal” in “Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, No. 1 (January, 1937)”; London: The Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland, pp. 79-90.
তথ্যপূর্ণ লেখা। তবে লেখার ধরন সাবলীল নয়। মনে হচ্ছে যেন কপি পেস্ট করা হয়েছে। তবে তথ্যটি লিখতে গিয়ে লেখক যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন।
একজন প্রযুক্তিবিদ হয়ে ইতিহাসের প্রতি তার আগ্রহ দেখে সমীহ হয়।
ধন্যবাদ নেবেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বিষয়টি এমন যে ভুল লেখার সম্ভাবনা প্রচুর। সাবধান হতে গিয়ে ভাষার সাবলীলতার দিকে নজর দেওয়া যায়নি। ত্রুটি স্বীকার করছি।
ধর্মপাল, রণশূর এঁরা সম্ভবত মহীপালদেবের অনুগত ছিলেন। চোল আক্রমণ প্রাচীন নগরী তাম্রলিপ্তের ধ্বংসকে তরাণ্বিত করেছিল। বঙ্গোপসাগরে চোল আধিপত্যের জন্য তাম্রলিপ্তকে ধ্বংস করাটা জরুরী ছিল।