চণ্ডী লাহিড়ী: এক সংগ্রামী কার্টুনিস্টের জীবন
সবে তখন বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রের দফতরে চাকরিতে গেছেন। নিয়মিত কার্টুন ছাপা হচ্ছে কাগজে। বরানগরের একটা অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ এল। গুণীজন সংবর্ধনা। গাড়ি করে সভায় নিয়ে গেলেন আয়োজকরা। তাঁর সঙ্গেই সংবর্ধনা পাবেন অভিনেতা বিকাশ রায়, ফুটবলার শৈলেন মান্না, সাঁতারু আরতি সাহা প্রমুখ বিখ্যাত মানুষেরাও। যথারীতি ফুল-মানপত্র ইত্যাদি প্রদানের পর ভাষণ শুরু হল অনুষ্ঠানের সভাপতি যুগান্তর প্রত্রিকার সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের। সে ভাষণ আর থামে না। বিকাশ রায় আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, “বাড়ি ফেরার ইচ্ছে আছে? তা হলে চলুন আমার সঙ্গে। নইলে অনেক রাতে পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে।” তিনি তো অবাক। উদ্যোক্তাদেরই তো গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা। হাসলেন বিকাশ রায়, “আপনি সবে গুণীজন হয়েছেন। নতুন এ লাইনে। এরা অনুষ্ঠানের আগে গাড়ি করে নিয়ে আসে। ফেরার দায়িত্ব কেউ নেয় না।” হতভম্ব তিনি সেদিন বিকাশ রায়ের গাড়িতে চুপি চুপি অনুষ্ঠান থেকে কাটলেন। এর পর দেখা হলেই বিকাশ রায় তাঁকে ‘কাঁচা গুণী’ বলে ডাকতেন।
আর একটা ঘটনা। তখন বিবাহিত। থাকেন পাইকপাড়ার ফ্ল্যাটে। একদিন এক জীর্ণবসন শীর্ণকায় ব্যক্তি এলেন তাঁর কাছে, সঙ্গে ততোধিক কৃশ রুগ্ন এক বালক। এসেই পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি, আপনি গুনিন। একটু মন্ত্র পড়ে হাত রাখুন আমার ছেলের মাথায়। ছেলেটা বেঁচে যাবে। জানা গেল, বামাখ্যাপা সাধন সংঘ নামে গঞ্জিকাসেবীদের এক আড্ডায় লোকটি শুনেছেন, যে শিল্পী এত ভালো কার্টুন আঁকেন— মন্ত্রী, রাজ্যপাল, পুলিশ কাউকে রেয়াত করেন না, এত মানুষ আনন্দ পান, তাঁর হাত নিশ্চয়ই ঈশ্বরের হাত, ঈশ্বর স্বয়ং সেই হাতে ভর করে আছেন। তাঁর গুরুদেব বলেছেন ওই হাত যদি একবার তিনি ছেলের মাথায় ছুঁইয়ে দেন নির্ঘাত তার রোগমুক্তি হবে। লোকটিকে অনেক বকে-বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হল। যদিও অচিরেই ছেলেটি মারা গেল সেখানে।
নিজের জীবনের স্মৃতিচারণায় ঘটনা দুটির উল্লেখ করে রসিক কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী লিখেছেন, “গুণীজন হতে পারিনি। গুণীনও হইনি, হতে চেয়েছিলাম কার্টুনিস্ট, হয়েছিলামও কার্টুনিস্ট। নবদ্বীপের মতো অতি ক্ষুদ্র এক শহরে জন্মে, পেডিগ্রি বর্জিত দারিদ্র্যসম্বল বালক আমি, অজানা অচেনা মহানগরীতে যেটুকু অর্জন করেছি এবং যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাতে অনায়াসে বলতে পারি, ধন্যোহং কৃতকৃতেহং। আমি ধন্য। আমি কৃতকৃতার্থ।” কার্টুনিস্ট হিসেবে তিনি যে কৃতকৃতার্থ, এ কথা বাঙালিকে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ প্রায় ছয় দশক ধরে তাঁর নিজস্ব স্টাইলের অসামান্য ব্যঙ্গচিত্রগুলি বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছিল বলা যায়। এমনকি অনেকে তাঁকে ‘বাংলার আর কে লক্ষ্মণ’ আখ্যাও দিয়েছিলেন।
জন্ম ১৯৩১-এর ১৫ মার্চ। নবদ্বীপের বুড়োশিবতলায় মামার বাড়িতে। পিতৃপুরুষের আদি বাড়ি ছিল পূর্ব-বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী থানার চক-বামনগড়িয়া গ্রামে। চণ্ডী লাহিড়ীর বাবা মোহিনীমোহন সেখান থেকে নদিয়া জেলার কালীগঞ্জ থানার মাটিয়ারি গ্রামে চলে এসেছিলেন। মাটিয়ারিতে নৃসিংহপ্রসাদ সেনের জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন। সেখানে সপরিবারে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। অনেক পরে কৃষ্ণনগরে বাড়ি বানিয়ে সেখানে থিতু হয়েছিলেন।
মোহিনীমোহনের চার ছেলে, তিন মেয়ে। দ্বিতীয় সন্তান চণ্ডী। ছেলেদের মধ্যে সকলের বড়ো। প্রথম সন্তান বড়ো মেয়ে গীতা। চণ্ডীর পরের ভাইয়েরা হলেন যথাক্রমে দেবব্রত, তুলসী ও গৌরীশঙ্কর। অন্যান্য বোনেদের নাম অসীমা ও পূর্ণিমা। মাটিয়ারিতে এত বড়ো সংসারে সচ্ছলতা খুব বেশি ছিল না। দরিদ্র পরিবারে ও গ্রামীণ পরিবেশে বড়ো হলেও মোহিনীমোহনের পুত্র-কন্যারা সকলেই হয়ে উঠেছিলেন কমবেশি নানা বিদ্যায় পারদর্শী। এঁদের মধ্যে চণ্ডী লাহিড়ী, দেবব্রত লাহিড়ী ও তুলসী লাহিড়ীর নাম উল্লেখযোগ্য। দেবব্রত লাহিড়ী সুগায়ক, সুচিত্রকর ও লেখক। আকাশবাণীর শিল্পী ছিলেন। প্রযুক্তিবিদ্যা ও বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র বাদনে তুলসী লাহিড়ীর অনায়াস দক্ষতা মুগ্ধ করার মতো। চন্ডী লাহিড়ীর নিজস্ব ‘ফিল্ম অ্যানিমেশন ইন্ডিয়া’ নামক সংস্থার তৈরি সব অ্যানিমেশন ছবির মিউজিক ডিরেক্টর ও ক্যামেরাম্যান ছিলেন তুলসী লাহিড়ী। এই সংস্থার তৈরি ছবিগুলো হল ‘সবচেয়ে বড়ো ডিম’, ‘পুনর্মুষিক ভব’, ‘দি ম্যাচ বক্স’, ‘আন্ডার দি ব্লু মুন’ ইত্যাদি। শেষোক্ত ছবিটি নির্মিত হয়েছিল তখনকার একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল সরকারি ‘দূরদর্শন’-এর ন্যাশনাল নেটওয়ার্কের জন্যে। এছাড়া অনেকগুলো বাংলা সিনেমার অ্যানিমেটেড টাইটেল কার্ড বানিয়েছিলেন তাঁরা। যেমন, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘পাকা দেখা’, ‘লাট্টু’, ‘চারমূর্তি’, ‘মৌচাক’ ইত্যাদি। ‘হংসরাজ’ ছবির গানের সঙ্গে অনবদ্য কার্টুনের সঙ্গতও তাঁদের করা। বলা বাহুল্য, সমস্ত ছবির কার্টুন আর্টিস্ট এবং পরিচালক ছিলেন চণ্ডী লাহিড়ী।
চণ্ডী লাহিড়ীর জীবনের প্রথম দশ বছর মাটিয়ারি গ্রামেই কেটেছিল। মাটিয়ারির রামপদ সেন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ। শৈশবের এই গ্রাম-জীবনের স্মৃতি তিনি আজীবন বহন করেছেন। বৃদ্ধ বয়সে তা নিয়ে লিখেছেন রম্য গদ্যের বই ‘বাহারী শৈশব’। গ্রামীণ বালকের দুরন্তপনায় জঙ্গলে আতা গাছে উঠে ডাল ভেঙে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতটি ভেঙে গিয়েছিল। সেকালের গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় তাঁদের পরিবার-ঘনিষ্ঠ দর্জি গনি শেখ নিজস্ব টোটকা-বিদ্যায় হাতটি বেঁধে দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে হাতের অবস্থা এমন হয়ে ওঠে যে সেটি কেটে বাদ দিতে হয়। অতীতের এই দুঃখবহ ঘটনা জিজ্ঞাসুদের কাছে বারংবার বিবৃত করতে করতে হয়তো বিড়ম্বিত হতেন। তাই এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীকালে এক মিথ তৈরি করেছিলেন। বিপ্লবীদের বোমার ব্যাগ বইতে গিয়ে বিস্ফোরণে হাতটি খোয়া যায়, এমনটাই বলতেন। তবে এই একটি হাত না-থাকাটা কখনও তাঁকে হীনম্মন্য করে তোলেনি। চণ্ডী লাহিড়ীর চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো গুণ ছিল সর্বদা সদর্থক থাকা। তাই এই বিষয়ে কথা উঠলে সহর্ষে বলতেন তিনি, তলোয়ারের একটি দিকেই ধার থাকে। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট কুট্টির একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়। এক সাংবাদিককে মজা করে বলেছিলেন একবার, “চণ্ডী ব্রিলিয়ান্ট। সে এক হাতে কী কাজ করে! ওর দুটো হাত থাকলে আমার আর আনন্দবাজারে চাকরি করা হত না।”
১৯৪২ সাল নাগাদ মাটিয়ারি থেকে নবদ্বীপে এসে ভর্তি হন নবদ্বীপ হিন্দু স্কুলে। তার আগে মা মারা যান। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু আর তাঁর মায়ের মৃত্যু একই দিনে। মাতৃহারা বালক চণ্ডী স্কুলের কাছে মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। গতে-বাঁধা ভালো ছেলে ছিলেন না। মামারা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব। বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভ বিগ্রহ ও তার মন্দির। সেসবের পাশ কাটিয়ে বালকোচিত কৌতূহলে নবদ্বীপের নানা জাতের নানা পেশার মানুষের মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে বেড়াতেন। মানুষ দেখার অভিজ্ঞতার ঝুলি তাঁর সেই সময় থেকেই ভরে উঠতে শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে সমাজ-নিরীক্ষার একটা মনও তৈরি হয়ে উঠছিল। দেশভাগের ফলে নবদ্বীপে আগত উদ্বাস্তু মানুষদের জন্যে লঙ্গরখানা চালানো, তার অর্থসংগ্রহ, কলেরা মহামারীতে অসুস্থ মানুষের পাশে থেকে কাজ করা ইত্যাদি নানা ধরনের উদ্যোগে জড়িয়ে গিয়েছেন। স্কুলের নীচু ক্লাসেই মনে স্বদেশি ভাবনা ঠাঁই গেড়েছিল। একটু বড়ো হয়ে, বছর পনেরো বয়সে সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক পার্টির সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠলেন। তাঁদের নেতা ছিলেন নবদ্বীপের বিশিষ্ট আইনজীবী সুবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। নবদ্বীপ থেকে প্রকাশিত বর্তমান নিবন্ধ-লেখকের সম্পাদিত ‘সময়’ নামে পত্রিকায় একবার একটি চিঠিতে চণ্ডী লাহিড়ী লিখেছিলেন, ছোটোবেলায় তাঁর মানসিক গড়নটি গড়ে দিয়েছিলেন নবদ্বীপের দুই বিশিষ্ট মানুষ, অধ্যাপক সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় এবং আইনজীবী সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই চিঠিতে আরও লিখেছিলেন তিনি— “যতদূর মনে পড়ছে নবদ্বীপ বাসকালে আমি কোনো কার্টুনই আঁকিনি।” কিন্তু তাঁর অন্য লেখাতে পাই, নবদ্বীপে তিনি ‘বান্ধব’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তাতে কলকাতার বিখ্যাত ছোটোদের পত্রিকার অনুকরণে অলংকরণ করেছেন। ছবি আঁকার অভ্যেস, এমনকি কার্টুন আঁকার চেষ্টাও যে তাঁর ছোটো থেকেই ছিল, তাঁর একাধিক লেখাতে তারও উল্লেখ আছে। স্কুল-কলেজে পড়াকালীন সেকালের প্রসিদ্ধ কার্টুনিস্ট পিসিয়েল (প্রফুল্লচন্দ্র সরকার) তথা কাফী খাঁ ও শৈল চক্রবর্তীর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কার্টুন কাঁচি দিয়ে কেটে রেখে তা নকল করার চেষ্টা করতেন। একবার তো কলেজের ব্ল্যাকবোর্ডে ছবি অথবা কার্টুন এঁকে অধ্যাপক ধীরেন মুখোপাধ্যায়ের ক্লাসে সস্নেহ বকুনিও খেয়েছিলেন।
১৯৪৮-এ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হলেন। কলেজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অবশ্য স্কুলের সময় থেকেই। কারণ, ১৯৪২ সালে জাপানি বোমার আতঙ্কে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজটি নবদ্বীপ ও সিউড়িতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে স্থানান্তরিত হয়েছিল। নবদ্বীপে প্রথমদিকে কলেজের ক্লাস বসত নবদ্বীপ হিন্দু স্কুলে। সকালের দিকে। সেই সূত্রে চণ্ডী লাহিড়ী নিজগুণে সেখানকার অধ্যাপকদের অনেকের স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন। স্কুল ছাত্র অবস্থাতেই একবার কলেজের জন্যে ট্রেনে কৌটো নিয়ে অর্থসংগ্রহ করতে গিয়ে টিকিট-পরীক্ষকের হাতে ধরা পড়ে কাটোয়া স্টেশনে রাত্রিবাস করতে হয়েছিল। দারিদ্র্যের কারণে বিদ্যাসাগর কলেজের কেন্দ্রীয় প্রিন্সিপাল (কলকাতা এবং দুই মফসসল শহরের দুটি শাখার) অধ্যাপক জে কে চৌধুরী তাঁর কলেজে পড়ার ফি মকুব করে দিয়েছিলেন। নবদ্বীপ শাখার প্রিন্সিপাল অশোক মুখোপাধ্যায়েরও সুনজরে ছিলেন। কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন যদিও কলেজগুলোতে এখনকার মতো রাজনৈতিক দলাদলির প্রভাব ছিল না। কলেজের প্রথম পত্রিকা-সম্পাদকও তিনি। তাঁর নিজের কথায়, সেখানেই তাঁর লেখালেখি তথা সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি। এই কলেজ থেকে ১৯৫০-এ আইএ এবং ১৯৫২-তে বিএ পাশ করেন। অনেক পরে বাংলায় এমএ করেছিলেন। ১৯৫৯-এ। কলকাতায় চাকরি করার সময়।
বিএ পরীক্ষার ফলপ্রকাশের আগেই বড়োমামা বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্যের চেষ্টায় কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটের এক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটেছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হাঁফিয়ে উঠলেন সেখানে। গ্রামের একঘেয়ে নিশ্চল জীবন। মাথাভর্তি নানা উদ্ভাবনী চিন্তা এবং প্রকৃতই উড়নচণ্ডী টগবগে যুবক চণ্ডী লাহিড়ীর তা বেশিদিন ভালো লাগার কথা নয়। অচিরেই চাকরি ছেড়ে পালিয়ে এলেন কলকাতায়। তাঁর এই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তে আহত হয়েছিলেন বাবা মোহিনীমোহন। কারণ, দরিদ্র পরিবারের এক-হাত সম্বল প্রতিবন্ধী জ্যেষ্ঠপুত্রকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল তাঁর। চণ্ডীর শিক্ষকতার চাকরিপ্রাপ্তিতে তাই নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই চাকরি ছেড়ে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় তাঁর কলকাতায় চলে যাওয়াতে তিনি এতই আঘাত পেয়েছিলেন যে চণ্ডীকে মৌখিক ভাবে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন। তিনি নিজে তো বটেই, সমস্ত ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কেউ যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। চণ্ডী লাহিড়ীর বিয়ের সময় সেই অভিমান ভঙ্গ হয়েছিল। ততদিনে চণ্ডী অবশ্য বিখ্যাত ব্যক্তি। আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় তাঁর ‘তির্যক’ নামে পকেট-কার্টুন দেখে মজে গিয়েছে বাঙালি। এর পর আশির দশকের শেষে দূরদর্শনের সর্বভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত চণ্ডী লাহিড়ীর অ্যানিমেশন ফিল্ম ‘আন্ডার দি ব্লু মুন’ দেখে এবং সে-সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি পড়ে ছেলের কৃতিত্বে ও গৌরবে গরীয়ান মোহিনীমোহন উচ্ছ্বসিত স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তাঁকে।
১৯৫২ সালে চণ্ডী লাহিড়ী কলকাতায় পালিয়ে এসে উঠেছিলেন এক বন্ধুর মেসে। ছোট্ট সিঙ্গল-বেড রুমে কোনও মতে মেঝেতে ঠাঁই হল। আঠারো টাকার মাস-মাইনের একটা সাংবাদিকতার চাকরি জুটল ‘দৈনিক লোকসেবক’ পত্রিকায়। সেই সুবাদে মেঝে থেকে বেডে উত্তরণ ঘটলেও বেড ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা দিতেও হিমসিম অবস্থা। বাধ্য হয়ে পত্র-পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশনের কাজ শুরু করলেন। আঁকার অভ্যাস তো ছিলই। কলকাতায় এসে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের কয়েকজন কৃতি ছাত্রকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে ছবি আঁকার আরও কিছু খুঁটিনাটি এবং জলরঙের কাজ শিখেছিলেন। প্রতিটি অলংকরণের জন্যে পেতেন দেড় টাকা। তাতেও কুলোত না। পয়সা বাঁচাতে শ্যামবাজারের মেসবাড়ি থেকে এন্টালির লোকসেবক অফিসে পায়ে হেঁটে যেতেন। এই সময় ট্রামভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতায় আন্দোলন শুরু হল। সেই নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক কার্টুন আঁকলেন লোকসেবক-এর পাতায়। ক্রমে আত্মবিশ্বাস বাড়ল। নিয়মিত কার্টুন আঁকা শুরু করলেন। তাঁর কথায়— “নদিয়ার লোক হওয়ায় রসবোধ তীব্র ছিল। অতএব যা ছিল আমার রক্তেই ছিল। চেষ্টা করে আমি শিল্পী হইনি। হয়ে গেছি আপন নিয়মে।”
সাংবাদিকতা সূত্রে সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হতে থাকে। লোকসেবক ছিল সরকার-বিরোধী কাগজ। ফলে সরকার পক্ষ তথা রাজনীতিকদের অবিমৃশ্যকারিতা, দুর্নীতি ইত্যাদি তাঁর চোখ খুলে দিল। লোকসেবক-এ রাতের বেলা ডিউটি, দিনের বেলা কলকাতার পথে পথে ঘুরে মানুষের জীবন, তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই দেখেন। স্কেচ আঁকেন। কার্টুনের বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেন। চলে যান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ অথবা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। বিশেষ করে নৃতত্ত্ব বা অ্যানথ্রোপলজি এবং বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণকাহিনি। কার্টুনিস্ট হিসেবে তিনি যে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তার একটা কারণ, চিত্রবিদ্যার সঙ্গে বৈদগ্ধ্যকে সার্থক ভাবে মেলাতে পেরেছিলেন তিনি। এদিক থেকে পরোক্ষ শিক্ষাগুরু মেনেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিসিয়েল অর্থাৎ প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ীকে। গগন ঠাকুর, পিসিয়েল ও চণ্ডী লাহিড়ী — এঁরা তিন জনেই বাংলার কার্টুনকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।
দৈনিক লোকসেবক-এ থাকাকালীন নানা বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অনেক প্রবন্ধও লিখেছেন। গবেষণামূলক প্রবন্ধ। আনন্দগোপাল সেনগুপ্তের ‘সমকালীন’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ইত্যাদিতে সেসব ছাপা হয়েছে। তাঁর ‘বিদেশীদের চোখে বাংলা’ বইটি তারই ফলশ্রুতি। বইটির বিষয়বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব তাঁর ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা ও ভাবনার বিশিষ্টতার দিক নির্দেশ করে।
দৈনিক লোকসেবক-এ চণ্ডী লাহিড়ীর মাসিক বেতন আঠারো টাকা থেকে বেড়ে দশ বছরে ছাব্বিশ টাকায় পৌঁছেছিল। তাও মাঝে মাঝে বকেয়া থেকে যেত। ১৯৬১-তে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি পত্রিকা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ ‘থার্ড আই ভিউ’ এবং ‘সিন আসকিউ’ শিরোনামে পকেট-কার্টুন আঁকতে শুরু করেন। বাড়তি কিছু রোজগার এল। সেই সঙ্গে খ্যাতিও বাড়ল। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ তাঁর আঁকা কার্টুন আকৃষ্ট করেছিল আনন্দবাজার-এর মালিক অশোককুমার সরকারকে। বছরখানেক পরে তাঁর নির্দেশে তখনকার ডাকসাইটে সাংবাদিক তথা আনন্দবাজার-এর বার্তা সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষ তাঁকে আনন্দবাজার পত্রিকায় ডেকে নিলেন। লোকসেবক-এর দফতরে এক মাঝরাতে হঠাৎ ফোন, আমি সন্তোষ ঘোষ বলছি আনন্দবাজার থেকে। আপনার আনন্দবাজার-এ চাকরি হয়েছে। কাল সকালে আমার ভবানীপুরের বাড়িতে দেখা করবেন। হতভম্ব চণ্ডী পরদিন সকালে সন্তোষ ঘোষের সঙ্গে দেখা করলে তাঁকে চায়ের টেবিলে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কত টাকা মাইনে আশা করেন?”
অনেক ভেবে ভয়ে ভয়ে চণ্ডীর উত্তর, “তিনশো টাকা।”
— তাহলে আমাদের কাগজে আপনাকে চাকরি দেওয়া গেল না। এখানে পাঁচশোর কমে কারও মাইনে হয় না। যাক গে, টাকার ব্যাপারটা আমরা ঠিক করব।
সালটা ১৯৬২। পাঁচশো টাকার তখন অনেক মূল্য। চণ্ডী লাহিড়ীর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট এই চাকরি। একদিকে আর্থিক নিশ্চয়তা, অন্যদিকে নিজেকে প্রকাশ করার বিস্তৃত পরিসর। এর পর থেকে কার্টুনই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠল। নিজের ড্রইং-কে, কার্টুনের সামগ্রিক উপস্থাপনাকে সমৃদ্ধতর করে তোলার সাধনায় গভীর ভাবে মগ্ন হলেন। প্রথম দিকে কাফী খাঁর প্রভাব ছিল তাঁর কার্টুনে। প্রিয় কার্টুনিস্ট কাফী খাঁকে অনুসরণ করার কথা তিনি নিজেই সশ্রদ্ধায় স্বীকার করেছেন তাঁর একাধিক লেখায়। ধীরে ধীরে আঁকা এবং ক্যালিগ্রাফিতে এতটাই নিজস্বতা তৈরি করেছিলেন যে ছবিতে স্বাক্ষর না থাকলেও দর্শক বুঝে নিতে পারতেন কাজটা চণ্ডী লাহিড়ী ছাড়া আর কারও নয়। তাঁর ছবিই তাঁর সিগনেচার। অতি-দ্রুত ছবি আঁকার দক্ষতাও রপ্ত করেছিলেন ক্রমাগত অনুশীলনে। উনিশশো সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে দূরদর্শন-এ ‘চিচিং-ফাঁক’ নামে ছোটোদের অনুষ্ঠান সহ আরও নানা বিষয়ে কাজ করেছেন। চলমান ক্যামেরার সামনে দ্রুত ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা তাঁর আত্মবিশ্বাস আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ‘দেশ’ পত্রিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক ফিচার ‘সুনন্দর জার্নাল’-এর সঙ্গে ছবির আঁকতেন তিনি। সেই লেখার পাণ্ডুলিপি হাতে এসে পৌঁছোনোর পর প্রেসে দেবার জন্যে সময় থাকত মাত্র তিরিশ-চল্লিশ মিনিট। ওইটুকু সময়ে কল্পনাশক্তি ও অঙ্কনশক্তির জোরে পাঁচ-ছ’টি ছবি এঁকে ফেলতেন অনায়াসে।
আনন্দবাজারে এসে তিনি রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে শুরু করেছিলেন। পাশাপাশি এই পত্রিকাতেই ‘তির্যক’ নামে সমসাময়িক সময় ও সমাজ-বিষয়ক ছোটো কার্টুন প্রকাশিত হতে লাগল। লোকসেবক-এর সাংবাদিক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির শীর্ষমহলে পরিচিতি ছিল। সেই পরিচয় আরও বাড়ল। গুরুত্বও বাড়ল। কারও কারও চক্ষুশূল হলেন (একবার তো তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন কার্টুন দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে গোপনে নির্দেশ দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধই করে দিয়েছিলেন)। আবার অনেকেরই প্রিয় হয়ে উঠলেন। কিন্তু বড়ো বাণিজ্যিক সংবাদপত্রে চাকরির গ্লানি কি ছিল না? তাঁর সৃজনশীলতা প্রথম ধাক্কা খেল বছর তিনেকের মধ্যে যখন আনন্দবাজার-এ তাঁর বড়োমাপের রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা বন্ধ হয়ে গেল। আসলে আনন্দবাজার-এ তাঁকে আনা হয়েছিল কার্টুনিস্ট কুট্টির বিকল্প হিসেবে। কুট্টি তখন আনন্দবাজার ছেড়ে দিল্লির হিন্দুস্থান টাইমস-এ চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিন বছর পরে আবার তিনি ফিরে এলেন। দক্ষিণ ভারতীয় ব্যঙ্গচিত্রী কুট্টির তখন সর্বভারতীয় খ্যাতি। তাছাড়া রাজনৈতিক মহলেও প্রভূত প্রভাবশালী। আনন্দবাজার গোষ্ঠী তাঁকে ফিরিয়েই নিল না শুধু, তাঁর দেওয়া শর্তও মেনে নিল। কুট্টির শর্ত ছিল, তাদের বাংলা ও ইংরেজি দুটো কাগজ আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ চণ্ডীর রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা চলবে না। সেগুলো তিনিই আঁকবেন। সন্তোষকুমার ঘোষ চণ্ডীকে মনখারাপ না করে মনোযোগ দিয়ে ‘তির্যক’ এঁকে যেতে পরামর্শ দিলেন। চণ্ডী লাহিড়ীর মন ভারাক্রান্ত হলেও এটা তাঁর কাছে তখন চ্যালেঞ্জ। নিজের মেধা ও দক্ষতার সমস্তটা ঢেলে তির্যক-এর কার্টুন আঁকতে লাগলেন। সেইসব কার্টুন আজ ধূসর ইতিহাসের বিষয় হয়ে উঠলেও, প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে সে সময় প্রত্যেক সকালে আনন্দবাজারের পাতার ছোট্ট পরিসরে সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষিতে তির্যক-এর তীক্ষ্ণ তিরের মতো মজাদার কার্টুন-কটাক্ষ।
সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সম্পর্কে চণ্ডীর সরস মন্তব্য— “যখন আনন্দবাজারে এলাম, তখন চারিধারে কেবল নেই-নেই ডাক। দোকানে চাল নেই, রেশন দোকানে যা আছে তার কাঁকরের ভাগ এত বেশি যে রান্নার আগে ডেন্টিস্টকে দেখিয়ে ছাড়পত্র নিতে হয়। আটা মানে অর্ধেক সোপস্টোন পাউডার। সিমেন্ট মানে গঙ্গা মৃত্তিকার ভেজাল। স্ট্যান্ডার্ড ক্লথ নামক যে বস্তু রেশনে দেওয়া হত সেই বস্ত্রখণ্ড জলে দিলে মশারি হয়ে যেত।”
এরকম নেই-নেই পরিবেশে তির্যক-এর জন্যে তাঁর বিষয়ের অভাব হয়নি। ভালো কার্টুনিস্ট হওয়ার জন্যে দরকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা। সমাজ-রাজনীতির বিষয়গুলো সেই প্রজ্ঞার আলোয় বিশ্লেষণ করতে না পারলে, কার্টুনিস্ট হিসেবে কোথায় তাঁর দায়বদ্ধতা, তা বুঝতে না পারলে একজন কার্টুনিস্ট কখনও সার্থক হতে পারেন না বলেই মনে করতেন চণ্ডী লাহিড়ী। তাঁর আগে যাঁরা পত্র-পত্রিকায় কার্টুন আঁকতেন, তাঁদের অনেকেই, যথা প্রমথ সমাদ্দার বা রবীন ভট্টাচার্যরা— প্রধানত লক্ষ্যহীন মজার মজার কার্টুন এঁকে মানুষকে বিনোদন দিতেই ব্যস্ত থাকতেন। শিল্পী হিসেবে সমাজের কাছে তাঁদের তেমন কমিটমেন্ট ছিল না।
এই প্রমোদসর্বস্ব কার্টুনের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করেছিলেন চণ্ডী লাহিড়ী। এনটারটেনমেন্ট নয়, কমিটমেন্ট। তাঁর কার্টুনের মধ্যে তিনি রাজনীতি-সমাজনীতির অসঙ্গতিগুলোকে প্রথম থেকেই হিউমার-বিদ্ধ করেছেন। সাধারণ মানুষ তাঁদের প্রতিদিনের জীবনের সমস্যা, ক্ষোভ, কৌতুকবোধের প্রতিফলন দেখতে পেতেন তাতে। কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ীর জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড়ো কারণ এটাই। এ জন্যে তাঁকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে বইকি। রাজনৈতিক দলের হুমকি শুনতে হয়েছে। সরকার পক্ষের হস্তক্ষেপে আনন্দবাজারেই তাঁর কার্টুন ছাপা বন্ধ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রকাশ্য মঞ্চে তাঁর নাম করে আক্রমণ করেছেন। তবু নিজের দায়বদ্ধতা থেকে কখনও সরে যাননি। কখনও আপস করেননি। কার্টুনিস্ট হিসেবে এখানেই চণ্ডী লাহিড়ীর স্বতন্ত্রতা। তাঁর ‘কার্টুনের ইতিবৃত্ত’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন তিনি— “যুগোত্তীর্ণ সব কার্টুনেই আছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ভোরের পূরবী নয়। মেঘ গর্জনের সম-তালে দীপকরাগিনী।” অন্যত্র লিখেছিলেন— “কার্টুনিস্ট হিসেবে আমার কাজ হল দেশের সাধারণ নাগরিকদের সংবিধান যে সব অধিকার দিয়েছে, সেগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, তার খেয়াল রাখা।” জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও পশ্চিমবঙ্গের স্মরণীয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন পর্বে, টিভিতে নিয়মিত ‘চণ্ডীর চণ্ডীপাঠ’ নামে ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদী অনুষ্ঠান করেছেন। সরাসরি রাজনীতি ছাড়াও শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, পুলিশি ব্যবস্থা, পরিবেশ, বন্দিমুক্তি, বিজ্ঞান, নারীমুক্তি, খেলা, পোশাক, অতীতের স্মৃতি, মনস্তত্ত্ব— এমন কোনও বিষয় ছিল না যা তাঁর কার্টুনের আওতায় আসেনি।
আনন্দবাজার-এ অশোক সরকার এবং সন্তোষ ঘোষের আনুকুল্যের কথা তিনি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন। চাকরি জীবনের প্রথম দিকে, নিজেকে গড়ে তোলার দিনগুলোতে, সুবোধ ঘোষ, সরোজ আচার্য, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো সহকর্মীদের বিদগ্ধ সাহচর্যও ছিল তাঁর কাছে অমূল্য। কিন্তু পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানের ‘উদার পারস্পরিক সহযোগিতায় সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ’ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছে তাঁর। এখানে প্রায় তিন দশকের চাকরির অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তিক্ততার পরিমাণ কম ছিল না।— “লক্ষ করেছি, খবরের কাগজ পত্রিকার মালিকদের অজ্ঞাতসারেই তাঁদের আজ্ঞাবহ অফিসারেরা এবং সাংবাদিকরা বেশি ক্ষতি করেন। অশোক সরকার বা তাঁর পুত্ররা প্রত্যক্ষভাবে কোনও অপমানকর কথা ব্যবহার করেননি। কর্মচারীরা ক্ষতি করেছেন অনেক বেশি।”
এই প্রসঙ্গে তাঁর জীবনের একটি চির-দুঃখময় ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। আনন্দবাজার-এ থাকাকালীন ‘তির্যক’ ও ‘থার্ড আই ভিউ’ (হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ) নামে রোজ দুটো করে পকেট-কার্টুন আঁকতেন। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে সেগুলো কাগজ থেকে কেটে তারিখ লিখে রেখে দিতেন একটি আলমারিতে। একসময় অফিসের পুরোনো ফার্নিচার সব বিক্রি হয়ে গেল। সঙ্গে সেই আলমারিটাও। তাতে তাঁর আঁকা হাজার হাজার কার্টুন আর বহু দুষ্প্রাপ্য পত্র-পত্রিকা। ছুটে গিয়ে জেনারেল ম্যানেজারকে সেগুলো ফেরত দিতে বললেন। জবাব পেলেন, “অফিসের আলমারিতে রেখেছিলেন কেন? নিজের জিনিস নিজের বাড়িতে রাখতে পারেন না?”
তিনি চিঠি লিখে মালিকদের জানালেন। কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না।— “সেই অতি মূর্খ অপবিত্র মানুষটি ভুলে গেলেন পঁচিশ বছরের ইতিহাস ধরা আছে ওইসব কার্টুনে।… সাতদিন আলমারিটা নীচের উঠোনে পড়ে রইল। অপবিত্রবাবু আমার পঁচিশ বছরের কার্টুন আমায় নিতে দিলেন না। পরবর্তী পাঁচদিন আমি খাইনি। আমার জীবনে সেটি অন্ধকারতম দিন। প্রতিজ্ঞা করলাম, নিজের গুণে অন্য কোথাও গিয়ে নিজের মনুমেন্ট বসাব। আমি ক্রিয়েটিভ মানুষ।”
আনন্দবাজারের চাকরি ছাড়লেন। সেটা ১৯৯০ সাল। ততদিনে অবশ্য আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে কার্টুন বিষয়টা লোপ পেয়েছিল। শুধু টাকার জন্যে দিনের পর দিন বড়ো কোম্পানির দাসত্ব করাও তাঁর মতো সৃজনশীল মানুষের পক্ষে দুর্বহ হয়ে উঠেছিল। চাকরি ছেড়ে প্রবল অর্থকষ্টে পড়লেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে তৃণা লাহিড়ী তখন ক্লাস টেনের ছাত্রী। পরবর্তীকালে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন। মাস্টার ডিগ্রি করেছেন, এমফিল করেছেন। মেয়েকে দামি বই কিনে দিতে পারেননি। কোনো স্পেশাল গাইডের ব্যবস্থা করতে পারেননি। নিজেই পড়িয়েছেন তাঁকে। মেয়েও ছিলেন শিল্পী। ‘কিরিগ্যামি’ আর্টিস্ট। কিরিগ্যামি এক ধরনের পেপার কাটিং শিল্প। কাগজ কেটে বোর্ডের ওপর সেঁটে ছবি বানাতে হয়। বাংলায় তার বিরল শিল্পী হিসেবে খ্যাতিমতী হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু বাবার জীবিতকালেই ক্যানসার আক্রান্ত হন। বাবার মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যে তিনিও প্রয়াত হয়েছেন। দূরদর্শনের সঙ্গে আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন। সেখানেই কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে সংসার সামলেছেন। কোনও কোনও ঘনিষ্ঠ প্রকাশক ইলাস্ট্রেশনের কাজ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। যদিও তাঁর লড়াইয়ের প্রধান শক্তি ছিলেন স্ত্রী তপতী লাহিড়ী। চণ্ডীর খেয়ালি জীবনের একান্ত অবলম্বন। ১৯৬৮-তে শান্তিপুরের মেয়ে তপতীকে বিয়ে করেছিলেন। প্রথম থেকেই চণ্ডীর প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরতা গভীর ছিল। একবার স্ত্রী সম্পর্কে একটি কৌতুককর ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন চণ্ডী লাহিড়ী।
সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। সদ্যবিবাহিতা তপতীর সঙ্গে তখনও শিবরামের তেমন আলাপ-পরিচয় জমে ওঠেনি। একদিন ঠিক হল শিবরামকে নিয়ে সস্ত্রীক চণ্ডী যাবেন বিশ্বরূপা থিয়েটার হলে নাটক দেখতে। পাশাপাশি তিনটে সিট। শিবরাম চক্রবর্তী ও তপতী আগে পৌঁছে গেছেন। অফিস থেকে যেতে চণ্ডীর কিছুটা দেরি হল। শিবরাম চক্রবর্তী আলাপ শুরু করলেন তপতীর সঙ্গে।
— তুমি তো চণ্ডীকে বিয়ে করলে। তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছিলে আগে?
— আমার খোঁজ নেওয়ার দরকার কী? সে দায় তো বাবার।
— কিন্তু সেই শান্তিপুরে বসে তোমার বাবা কি সব খবর জানতে পেরেছেন? চণ্ডীর যে আরও দুটি গার্লফ্রেন্ড আছে, সেটা কি তোমার বাবা জানতেন?
— থাকলেই-বা দোষের কী? অনেকেরই তো গার্লফ্রেন্ড থাকে।
— মদ্যপান? যা টাকা পায়, অর্ধেক তো মদে ওড়ায়।
— মদ তো অনেকেই খায়। মদ খেলেই যে খারাপ হবে, এমন কোনও কথা নেই।
মদ খেয়ে কবে ঝামেলা করে চণ্ডী গ্রেফতার হয়েছিলেন, কবে পুলিশ তাঁকে নিষিদ্ধ পল্লিতে ধরেছিল, নতুন বউয়ের কাছে সাতকাহন করে সেসবের বিবরণ দিয়ে গেলেন শিবরাম চক্রবর্তী। কিন্তু কোনও কথাকেই আমল দিলেন না তিনি। পরে প্রেক্ষাগৃহে চণ্ডী এসে পৌঁছোলে শিবরাম তাঁকে বললেন, তোমার স্ত্রীকে কিছুতেই ভাঙাতে পারলুম না। চণ্ডী লাহিড়ীর মৃত্যুর পর মেয়ে তৃণা স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন — “বাবা কখনও টাকার চিন্তা করতেন না। তাঁর নীতি ছিল প্লেন লিভিং, হাই থিংকিং। সংসার কীভাবে চলবে তা ছিল মায়ের দায়িত্ব।” স্বামী এবং মেয়েকে হারিয়ে বেশিদিন বাঁচেননি তপতী লাহিড়ীও। কয়েক বছর আগে তিনিও পৃথিবী ছেড়েছেন।
জীবনের শেষদিকে কিছু বছর কলকাতা টিভি চ্যানেলে ছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন জনবিরোধী নীতি ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সেই পর্বেই ওই চ্যানেলে প্রচারিত হত তাঁর জনপ্রিয় কার্টুন অনুষ্ঠান ‘চণ্ডীর চণ্ডীপাঠ’। চণ্ডীর লাহিড়ীর কার্টুন আর অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্যপাঠের যুগলবন্দি। আরও পরে সরকারি ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরের পক্ষে প্রচারমূলক কার্টুন এঁকে জন-সচেতনতার দায়িত্ব পালন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে কার্টুনিস্টদের শিল্পী হিসেবে কোনওকালেই তেমন মর্যাদা নেই। বৃদ্ধ বয়সে রাশিয়া গিয়েছিলেন একটি পুরস্কার নিতে। সেখান থেকে লন্ডন হয়ে ফেরার পথে এয়ারপোর্টে কাস্টমস অফিসারদের কঠোর তল্লাসির পাল্লায় পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কার্টুনিস্ট পরিচয় পাওয়ার পর তাঁদের কাছ থেকে যে আপ্যায়ন পেয়েছিলেন, কলকাতায় তা ছিল অকল্পনীয়।
উনিশশো আশির দশকের পরে সংবাদপত্রগুলো থেকে কার্টুন বিষয়টি প্রায় লুপ্ত হলে কার্টুনিস্টদের দুরবস্থা আরও বেড়েছিল। ভালো কার্টুনিস্টরা অনেকেই রাজনৈতিক বা সামাজিক কার্টুন আঁকা মুলতুবি রেখে বই কিংবা পত্র-পত্রিকায় অলকংরণের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু চণ্ডী লাহিড়ী নানাভাবে নানারকম কাজের মাধ্যমে তাঁর দায়বদ্ধ শিল্পী-সত্তাকে হারিয়ে যেতে দেননি। নাটকের প্রতি গভীর অনুরাগ থাকায় কার্টুনের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন নান্দীকার, সায়ক প্রভৃতি নাট্যদলের সঙ্গে। তাদের অনেক নাটকের প্রচার অথবা মঞ্চের প্রয়োজনে কিংবা কোনো সামাজিক বার্তাকে তুলে ধরতে অর্থাগমের কথা না ভেবেই তুলি-কলমকে হাতিয়ার করেছেন। কন্যা তৃণার সদিচ্ছার সঙ্গী হয়ে কলকাতার একটি হাসপাতালের ক্যানসার ইউনিটে টাঙানোর জন্যে এঁকে দিয়েছেন ছোটোদের মন ভালো করা কার্টুন। ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে অ্যানিমেটেড কমিকসের রমরমায় বাংলায় কার্টুন-শিল্পের অবলুপ্তির আশঙ্কা করে, এতসব কাজের পাশাপাশি, এই শিল্প যে কেবল সাময়িক রঙ্গব্যঙ্গের বিষয় নয়, জনমানসে তার অব্যর্থ প্রভাবের কথা, তার ব্যাপ্তি ও সম্ভাবনার কথা, ছবি এঁকে, লেখায়, বক্তৃতায়, সাক্ষাৎকারে বারংবার বলার চেষ্টা করে গিয়েছেন।
আনন্দবাজার ছাড়া যষ্টিমধু, সরস কার্টুন, পরিবর্তন, খেলা, সত্যযুগ, কোল্ডফিল্ড টাইমস প্রভৃতি বহু পত্রিকায় চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। কুট্টির চাপে আনন্দবাজার-এ রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা বন্ধ হলেও, সে সময়ের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘পরিবর্তন’-এ শ্রীলাহিড়ী নামে প্রচুর রাজনৈতিক কার্টুন এঁকেছেন। পরিবর্তন-এর প্রচারসংখ্যা একসময় এক লাখ পঁচিশ হাজারে পৌঁছেছিল। ফলে প্রচার এবং প্রশংসা দুই-ই পেয়েছেন প্রচুর। আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, কিশোরমন, শিশুসাথী, সন্দেশ, পক্ষীরাজ প্রভৃতি শিশুপত্রিকায় তাঁর অলংকরণ, কার্টুন, কমিকস, ছড়া নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. নিশীথরঞ্জন রায় একবার প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন, চণ্ডী লাহিড়ীর মতো শিল্পী সংবাদপত্রের সেবা করে জীবন কাটিয়ে দেবে এটা খুব আক্ষেপের বিষয়। তাঁকে দেওয়া কথা রাখতে চণ্ডী লাহিড়ী তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কাজ ‘সিন্স ফ্রিডম’ বা ‘স্বাধীনতার পর’ নামে প্রদর্শনী করেছিলেন কলকাতা ইনফরমেশন সেন্টারে। পরে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই সেই সব ছবির সঙ্গে আরও ছবি যুক্ত হয়ে বই হয়ে বেরিয়েছিল। তাতে স্বাধীনতা লাভের দিন থেকে বাবরি মসজিদ ভাঙা পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের ছয় দশকের স্মরণীয় ঘটনা ও অবস্থার বিবরণ পেশ করেছিলেন কার্টুনের মাধ্যমে। কী ছিল সেইসব কার্টুনের বিষয়? — আমলাতান্ত্রিক সরকারি ব্যবস্থা, পুঁজিপতিদের দাদাগিরি, ভারতকে নিয়ে আমেরিকা-রাশিয়ার টানাটানি, সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের ভোটভিক্ষায় গান্ধি-হত্যার সেন্টিমেন্টের ব্যবহার, বিদেশি ঋণ-নির্ভরতা, সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের আকাল, সর্বত্র মানুষের লাইন, বড়ো বাঁধে আদিবাসীদের জীবন-ধ্বংস, জরুরি অবস্থা জারি, মুক্তকণ্ঠ সাংবাদিকদের গ্রেফতারি, সাহিত্যিক-শিল্পীদের স্বাধীনতা হরণ, কালোবাজারির রমরমা, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ফাঁকা আওয়াজ, ঊর্ধ্বমুখী জিনিসের দাম, দারিদ্র্য, মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের পীড়ন ও হত্যা, বন্দিনিগ্রহ, ভাগলপুর জেলে অপরাধীদের চোখে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দেওয়া, শিল্পমালিকদের চক্রান্ত, বিশ্বায়নের ফলে মুক্ত বাজার-ব্যবস্থা, অপ্রয়োজনীয় পণ্য-বিস্তার ইত্যাদি। বইটির ভূমিকায় চণ্ডী লাহিড়ী লিখেছিলেন, তিনি ইতিহাস লিখতে বা দেখাতে চাননি। সংবাদকে তাঁর মতো করে ভেবেছেন, কার্টুন এঁকে দর্শকদের দেখিয়েছেন। কার্টুন ঘটনার নথি বানায়, অ-বলা কথাকে বাণী দেয়।
লেখক হিসেবেও তাঁর অবদান কম নয়। অল্পবয়স থেকে লেখার অভ্যাস ছিল। তাঁর কর্মজীবন শুরুই হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। সেই সময় ‘সমকালীন’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় তাঁর লেখার কথা বলেছি। ‘যষ্টিমধু’ পত্রিকায় লিখতেন চণ্ডী ঠাকুর ছদ্মনামে। সিরিয়াস বিষয়ও তাঁর হাতে ফুরফুরে রসাপ্লুত হয়ে উঠত। ‘লোকসেবক’-এ চাকরি করা-কালেই বেরিয়েছিল ‘বিদেশিদের চোখে বাংলা’। পরবর্তীকালে বিপুল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ে লিখেছিলেন ‘কার্টুনের ইতিবৃত্ত’, ‘গগনেন্দ্রনাথের কার্টুন ও স্কেচ’, ‘বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গ চর্চা’ প্রভৃতি বই। দেশ-বিদেশের অ্যানেকডোট সংগ্রহ করে লিখেছেন ‘কথায় কথায়’, ‘চলমান প্রসঙ্গ’। ছোটোদের জন্যেও লিখেছিলেন বেশ কিছু। ‘বাহারী শৈশব’, ‘এই তো সময়’, ‘মিচকে’, ‘নেংটি’, ‘চচ্চড়ি’, ইংরেজিতে ‘টড্ল ট্রাবল’ ছোটোদের দেওয়া তাঁর উপহার। কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে মেয়ে তৃণা লাহিড়ীর সঙ্গে একত্রে লেখা ‘মানুষ কী করে মানুষ হল’ বইটি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদাস পুরস্কার পেয়েছিল।
তাঁর কার্টুন নিয়ে বইগুলো হল ‘ভিজিট ইন্ডিয়া উইথ চণ্ডী’, ‘চণ্ডী লুক্স অ্যারাউন্ড’, ‘সিন্স ফ্রিডম: এ হিস্ট্রি ইন কার্টুন্স উইথ চণ্ডী’, ‘স্বাধীনতার পর’, ‘চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুন’ ইত্যাদি। ১৯৭৩-এ প্রকাশিত প্রথমোক্ত বইটি রচিত হয়েছিল তাঁর হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এর ‘সিন আসকিউ’ শীর্ষনামে আঁকা কার্টুনের সঙ্গে আরও কিছু কার্টুন যোগ করে। প্রকৃত ভারতকে চেনার এর থেকে ভালো গাইড আর হওয়া সম্ভব কি না সন্দেহ। ‘ছিঁটেফোঁটা’, ‘পরিবেশ ভাবনা’ (প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ছড়ার সঙ্গে) বইগুলোতে রয়েছে পরিবেশদূষণ নিয়ে ভাবনা উদ্রেককারী কার্টুন।
কর্মী হিসেবেও চন্ডী লাহিড়ী ছিলেন অতুলনীয়। ১৮ জানুয়ারি ২০১৮, সাতাশি বছর বয়সে মৃত্যুর কিছুদিন আগেও ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের সচেতনতামূলক কার্টুনের কাজ করেছেন। রাতভর জেগে অশক্ত শরীরেও অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল তাঁর নেশার মতো। অন্তিম অবস্থাতেও হাসপাতালের বেডে শুয়ে আঁকার জন্যে কাগজ চেয়েছেন নার্সদের কাছে। এঁকেওছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বিশিষ্ট শিল্পী এবং কার্টুনিস্ট দেবাশীষ দেব লিখেছিলেন — “চণ্ডীবাবু আপাদমস্তক একজন কার্টুনিস্ট ছিলেন। বাংলা ভাষা এবং দেশবিদেশের ইতিহাস একেবারে গুলে খেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বাঙালির কার্টুনচর্চা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল।”
তাঁর কথা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। কিন্তু জীবিত অবস্থাতেই কার্টুনচর্চার দুর্দিন দেখে যেতে হয়েছিল চন্ডী লাহিড়ীকে। “কার্টুন পুষ্পমাল্য নয়, অস্ত্র”— বলতেন তিনি। বাংলা সংবাদপত্র থেকে কার্টুন-বিদায়ে সেই অস্ত্র প্রয়োগের জায়গা হারিয়েছেন কার্টুনিস্টরা। জীবনে সম্মান, খ্যাতি, জনপ্রিয়তা তিনি কম পাননি। তা সত্ত্বেও তাঁর মতো পেশাদার কার্টুনিস্টকে একরকম অসচ্ছলতার মধ্যে বিদায় নিতে হয়েছে। তাঁর আক্ষেপ ছিল— “কার্টুনিস্টরা মহাপুরুষ নন, রাজনীতিবিদ নন, সমাজ সংস্কারক নন, তাঁদের জীববদ্দশায় দু-একটি ইন্টারভিউ ছাপা হলেও তাঁদের জীবনী কোথাও ছাপা হয় না।” আমরা তাঁর জীবনের একটা সামান্য রেখাচিত্র এঁকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম।
তথ্যঋণ
- চণ্ডী লাহিড়ীর সংক্ষিপ্ত আত্মচরিত ‘কার্টুনিস্টের চোখে দেখা’ (ধ্রুবপদ ২০০২) ও তাঁর লেখা আরও নানা নিবন্ধ এবং পত্র-পত্রিকায় দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার।
- মাতৃশক্তি, চণ্ডী-প্রণাম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৮।
- চণ্ডী লাহিড়ীর ভাই তুলসী লাহিড়ীর সঙ্গে লেখকের কথোপকথন।
- অন্যান্য সূত্র প্রবন্ধে উল্লেখিত।
খুব ভালো লেখা, অনেক কিছু জানলাম