চা কাহিনী
একটি পছন্দের পানীয় নিয়ে কিছু কথা। যব গেঁজিয়ে প্রাপ্ত পানীয় নয়। জলের পর পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় পানীয়ের কথা। বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস (Camellia sinensis), যাকে নিয়ে অনেক কথা লেখা যেতে পারে কারণ এর ইতিহাস প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরোনো।
প্রথম পর্ব: আবিষ্কারের চিনবদন্তি
চায়ের শুরু চীন দেশে
চায়ের আমি চায়ের তুমি
চা দিয়ে যায় “চিনা”
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি
সাধারণপূর্ব ষষ্ট শতাব্দী। জেন বৌদ্ধধর্মের (Zen Buddhism) প্রবক্তা ভারতীয় সন্ন্যাসী ‘বোধিধর্ম’ গেলেন চিন দেশে। উদ্দেশ্য মূর্তি পূজা বা মন্ত্রোচ্চারণের পরিবর্তে গভীর মনোযোগে ধ্যানের মাহাত্ম্য প্রচার। সংস্কৃতে ধ্যান, ইংরাজিতে মেডিটেশন, চিনে ভাষায় chan আর জাপানিতে zen সবই প্রায় এক। যাইহোক স্থানীয় মহারাজা উডি (Wudi)-র অনুমতিক্রমে ‘বোধিধর্ম’ এক গুহার সামনে ধ্যানে বসলেন। এক-দু’দিন বা এক-দু’বছর নয়। নির্জন গুহার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলেন একটানা ন’বছর। একটা সময় ক্লান্তিতে চোখের পাতা দুটি একত্রিত হয়ে এল। ক্রোধে, হতাশায় ‘বোধিধর্ম’ সেগুলিকে তৎক্ষণাৎ কেটে ফেললেন। ছুঁড়ে দিলেন দূরে। সন্ন্যাসীর প্রোথিত আঁখিপল্লব পল্লবিত হল চিরহরিৎ চা গাছে।
নোবেল বা অস্কার ঘোষণার পর আমরা অনেকে তন্ন তন্ন করে ভারতীয় বা বঙ্গযোগ খুঁজে বেড়াই। কিন্তু বোধিধর্মের গল্পটা শুনে চা আবিষ্কারের কৃতিত্বে নিজেদের পাতে ঝোল টানলে ভুল হবে। কারণ চা আবিষ্কার হয়ে গেছে তার চেয়েও দু’হাজার বছর আগে। অবশ্য এশিয় হিসেবে অবশ্যই গর্বিত হওয়া যায়।
এবার নিয়ে যাই সাধারণপূর্ব দু হাজার সাতশ সাতাশ শতাব্দীতে (২৭৩৭ সাধারণ পূর্বাব্দ )। তৎকালীন চিনের এক মহারাজা শেন নুং বা শান্নং বসেছিলেন বাগানে এক গাছের তলায়। ভেষজ ওষধিতে শান্নং-এর অগাধ বিশ্বাস। আজ্ঞাবশত ভৃত্য রেখে গেলেন এক পাত্র গরম জল। গাছ থেকে উড়ে এসে পড়ল কয়েকটি সবুজ পাতা। পালটে গেল জলের রং। রাজা অম্লান বদনে খেয়ে ফেললেন সেই রঙিন জল। খুশি হলেন, শরীর চাঙ্গা হল। আবিষ্কার হল চায়ের।
পুরাতত্ত্ব অনুযায়ী চা গাছ পৃথিবীতে আছে প্রায় ৫ কোটি বছর ধরে। তার আবিষ্কার নিয়ে অনেক গল্পগাথা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে প্রায় সবগুলোই সেই একই দেশ ঘিরে। আর সেজন্যই আজকের শিরোনামে কিংবদন্তি পালটে চিনবদন্তি!
ক্যামেলিয়া সিনেনসিস প্রথম দিন থেকেই চা নামে পরিচিত ছিল এমনটা নয়। Tu, Te ইত্যাদি নানা নামের মধ্যে দিয়ে শেষে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি Tea তে। আর ম্যান্ডারিন ভাষায় Cha. ভারতের চায়ে (Chai) অবশ্য একটু আলাদা কনসেপ্ট। তার নিজস্বতা নিয়ে অন্য এক দিন কথা বলব।
পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৭০০০ বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত, তবু মূলত tea/cha এই দুটি নামেই চা বিশেষ পরিচিত। এর পিছনেও কারণ আছে। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত চিনের যে অংশ থেকে থেকে সিল্ক রুট দিয়ে চা রপ্তানি হত সেখানে প্রচলিত নাম ছিল Cha. আর ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইউরোপিয়ানরা সমুদ্র পথে চিনের যে অংশের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপন করল সেখানকার লোকেরা বলত Tea. অর্থাৎ একই পাতা সড়ক পথে গেছে চা নামে। আর জলপথে গেছে Tea নামে।
কথায় আছে একজন চায়নাম্যানকে যদি মরুভূমিতে থাকতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে সাতটি জিনিস নেবে। জ্বালানি-কাঠ, চাল, তেল, নুন, সয়া-সস, ভিনিগার এবং চা। শেষের বস্তুটি ওদের জীবনে এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে শান্নং আবিষ্কৃত পানীয়টি সেদেশেই একটি গেরস্থালি নামে পরিচিতি হতে সময় লেগেছে অনেক। বিভিন্ন রাজা মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও রয়েছে Lu Yu (লু ইয়ু) নামের এক চা-ঋষির (Tea Sage) কৃতিত্ব। ৭৬০-৭৬২ সাধারণাব্দ নাগাদ তিনি লিখেছিলেন Cha Jing (চা সূত্র) বা The Classic Of Tea নামে একটি যুগান্তকারী বই। আমাদের গীতার জনপ্রিয়তার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে এই বই। চা কীভাবে বানাতে হবে, কোন পাত্রে, কোন জলে বানাতে হবে সব কিছু নাকি লেখা আছে এই বইয়ে। তবে লু ইয়ু-এর সব কথা যে সবাই মেনেছে তাও নয়। যেমন, উনি ঠাণ্ডা চা খেতে বারণ করেছিলেন। তাতে নাকি বদহজম হয়। কিন্তু আমেরিকায় পঁচাশি শতাংশ চা-ই খাওয়া হয় বরফ মিশিয়ে। গীতার কথা যেহেতু তুললাম তাই বলে রাখি, চায়ের যদি কিছু ধর্মযোগ থাকতে হয় তা হল বৌদ্ধধর্ম। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি নিজেদের এই অভ্যাসও সন্ন্যাসীরা ছড়িয়ে দিয়েছেন নানা দেশে।
এমনিতে চা গাছ বলতে যে দু’তিন ফুটের বনসাইয়ের ছবি ভেসে ওঠে সেটা খানিকটা কৃত্রিম। বাড়তে দিলে ওরা বিশ ত্রিশ ফুট লম্বা হয়ে যেতে পারে কিন্তু বেশি পাতা গজানো আর সেই পাতা সহজে তোলার জন্যে ওদের ছোটো করে রাখা হয়। চাইনিজ মালের লাস্টিং নিয়ে আমার নিজেরও প্রচুর প্রশ্ন আছে। তবে চা গাছের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলে একটু ভাবতে হবে। দার্জিলিংয়ের বাগানগুলো না হয় চার পাঁচশো বছরের পুরোনো কিন্তু ইউহানের সেই ১৭০০ বছরের পুরোনো বাগানটার কথা ভাবুন। এছাড়াও নাকি চিনে এমন সাতখানা গাছ আছে যাদের বয়স চার হাজার বছর!
সীমান্ত সমস্যা নিয়ে দেশে যখন চিনে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয় আমি একটু মুচকি হাসি আর এক কাপ ভালো দার্জিলিং চা খেয়ে ফেলি।
দ্বিতীয় পর্ব: পল্লব-লাস্য
রবি ঠাকুর গেছেন জাপানে। স্থানীয় ভক্ত, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খোশমেজাজে চা খাচ্ছেন। সবাই নিজ নিজ কাপ থেকে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। ব্যতিক্রম শুধু কবিগুরু। কাপের চা প্লেটে ঢেলে খাচ্ছেন। একটু পরেই তাঁর দেখাদেখি সবাই তাই করতে শুরু করলেন। অপ্রস্তুত রবীন্দ্রনাথ বলতে বাধ্য হলেন, আমরা প্রাচীন ভারতীয়রা এভাবেই চা খাই। তোমরা আমাদের অনুকরণ করছ কেন। ব্যাপারটা একদমই তাই। আপনার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চা বানাবেন এবং খাবেন।
শুকনো পাতায় গরম জল ঢালবেন না কি গরম জলে চা পাতা দেবেন? অবান্তর প্রশ্ন, তাই না! কিন্তু শখ করে একটু দামি পাতা কিনে বাড়ি ফেরার পর এটা ভাবেন কি না বলুন? “ডিম আগে না মুরগি আগে”-এর মতো এতখানি জটিল দার্শনিক ধাঁধা না হলেও “জল আগে না পাতা আগে” এটাও কিছু কম ধন্দের নয়।
চা বা চায়ে
“Agony of the Tea Leaves” বলে একটা কথা আছে। চা গাছের মতোনই এই প্রবাদটিও নাকি একটি চিনা আমদানি। প্রথমে ভেবেছিলাম ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে পকোড়া ছাড়ার মতো দেখতে লাগে বলে বোধহয় চিনারা একে Agony বলেছে। পরে বুঝলাম ব্যাপারটা তা নয়। গরম জল পেয়ে দোমড়ানো শুকনো পাতাগুলো যখন নিজেদের মেলে ধরে সেটাকেই বলে Agony of the Tea Leaves। ভালো চা-পাতার সম্পূর্ণ রূপ রস গন্ধ উপভোগ করার নাকি এটাই উপায়। কেউ কেউ আবার এটাকে Dance of The Tea Leaves বলেন। যন্ত্রণা বলবেন না কি নৃত্য বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে আমি এপিসোডের নাম রাখলাম পল্লব-লাস্য। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হলে লাগবে পাতা ভেজানোর জন্য আলাদা একটি কাচের পাত্র। এবার পছন্দমতো তিন থেকে পাঁচ মিনিট ভিজিয়ে রাখা এবং সুদৃশ্য কাপে ঢেলে তার সদ্ব্যবহার করা।
টী-ব্যাগস এর ব্যবহার এখন সর্বত্রব্যাপী। আমার মতে এটি একটি সুবিধাজনক শর্টকাট। ১৯০৮ সালে টমাস সুলিভান নামে এক আমেরিকান চা ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপনের খরচ কমাতে টিনের বাক্সের বদলে সিল্কের পাউচের মুখে সুতো বেঁধে কিছু চা বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। লোকজন ভেবে নিল এটা বুঝি একটি ডিসপোজেবল ইনফিউজার। ব্যাস, আবিষ্কার হয়ে গেল টী-ব্যাগসের! তারপর থেকে এসেছে অনেক পরিবর্তন। গুঁড়ো চা থেকে ভাল পাতা-চা সব কিছুই পাওয়া যায় এতে। তবে ব্যাগগুলি কতখানি পরিবেশবান্ধব, কাগজ ভেজা জল স্বাস্থ্যের জন্য কতখানি নিরাপদ ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। যত যাই হোক ব্যাগ ব্যবহার করলে ভেজানোর পর কালো পাতা সবুজ হয়ে খুলে যাওয়ার দৃশ্য এবং তার সতেজ আঘ্রাণ ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
আসি জলের প্রসঙ্গে। Lu Wu তাঁর Cha Jing বা চা-সূত্র বইয়ে বলছেনঃ
পাহাড়ের জলের স্রোত থেকে তৈরি চা সবচেয়ে ভালো। নদীর জল ঠিক আছে কিন্তু কুয়ার জল বেশ নিম্নমানের। ধীর গতির স্রোত, পাথরে জমা জল বা বিশুদ্ধ ঝর্ণা থেকে পাওয়া জল হল সেরা পাহাড়ের জল। এমন জল থেকে তৈরি চা কখনই খাবেন না যেটি ঝর্ণা থেকে জলপ্রপাত হয়ে ঝরে পড়ে বা প্রস্রবণ থেকে উঠলে ওঠে বা দুরন্ত ঢেউয়ের মতো ছুটে যায়। [অনুবাদ সম্পাদকের]
কিন্তু Lu Wu তো এসব কথা বলেছিলেন অষ্টম শতাব্দীতে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের কী করা উচিত? ট্যাপের জল, না কি অ্যাকুয়াগার্ড না কি ড্রিমগার্ল হেমা মালিনী প্রদর্শিত “সবসে শুদ্ধ্ পানি”? আমি ব্যক্তিগতভাবে যে জল পানযোগ্য মনে করি তা দিয়েই চা বানাই। একাধিকবার ফোটান জল ব্যবহার করলে স্বাদ খারাপ হয়ে যায়। আর ফুটন্ত জলের বদলে জলের টগবগানি বন্ধ হবার পর পাতায় ঢাললে ভাল। প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুতপ্রণালী লেখা থাকলে অতি উত্তম। নচেৎ তিন থেকে চার মিনিট ভিজিয়ে রাখলেই জব ডান।
চা-ভক্ত পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথরিন (Catherine of Braganza) ১৬৬২ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে বিয়ে করলেন। ক্যাথরিন নাকি সেই অর্থে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন না। উচ্চতায় খাটো। সাধারণ দর্শনা এই কন্যাকে পাত্রস্থ করতে পিতা রাজা চতুর্থ জন অঢেল যৌতুক দিতে বাধ্য হলেন। এই যৌতুকের তালিকায় পড়ল ভারতের বোম্বাই (Bom Bahia), মরক্কোর ট্যাঙ্গার (Tangier) শহরের সম্পূর্ণ আধিপত্য এবং বিভিন্ন পর্তুগীজ কলোনিতে ব্রিটিশদের মুক্ত বাণিজ্যের অধিকার। সঙ্গে নগদ পাঁচ হাজার পাউণ্ড পণ। দেনায় ডুবে থাকা রাজপরিবার লুফে নিল সে সুযোগ। আমি নিজেও এই অফারে দেখতে পাচ্ছি পাত্রপক্ষের শুধু লাভই লাভ কিন্তু নিন্দুকেরা এই বিবাহকে কেন “loveless marriage” আখ্যা দিলেন জানা নেই। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের চরিত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করলেন না। রাজপরিবারকে উত্তরাধিকার এনে দিতে ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশ রাজপরিবারে ক্যাথরিন রেখে গেলেন তাঁর চা পানের অভ্যাস। আর রাজামহারাজাদের অভ্যাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। শোনা যায় যৌতুক হিসেবে তাঁর বাপের বাড়ি থেকে বাক্স বাক্স চা-পাতাও পাঠানো হয়েছিল। তবে শুধু শুকনো চা পাতায় যে রাজ পরিবারের মন ভেজেনি তা তো বোঝাই যাচ্ছে। যাকগে পরনিন্দা পরচর্চা ছেড়ে আবার চা-চর্চায় ফেরা যাক।
চায়ের সঙ্গে চিনির সম্পর্কটা অনেক দিনের। শুনেছি চিনে লোকজন চিনি ছাড়া চা খায়। আবার তিব্বতে নাকি নুন বা মাখন দিয়ে চা খাওয়াটাই দস্তুর। তাহলে চায়ে চিনি এল কোথা থেকে? ১৬০০ সালের আশেপাশে ব্রিটিশরা যখন চা খেতে শিখল সেই সময় চা ছিল একটা আভিজাত্যের লক্ষণ। কেবল মাত্র ধনীরাই তা কিনতে পারতো। চিনিও তখন সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু ভারতে পরিস্থিতিটা ছিল আলাদা। গুজরাত চিনি উৎপাদনে এগিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে চা আমদানি করতো সুরাট বন্দর মারফত। তারপর আবার জাহাজে করে নিজদেশে। স্থানীয় মানুষজনের এবং জাহাজের নাবিকদের চায়ে চিনি খাওয়ার অভ্যাস চালান হয়ে গেল বিদেশে।
এবার দুগ্ধ-সংযোগের ইতিহাস। ঢুকতে হবে ১৬৮০ সালের আশেপাশে, ফ্রেঞ্চ সোসাইটিতে। মাদাম দে লা সাবলিয়ার তাঁর সংগ্রহের দুর্মূল্য পোর্সেলিন কাপগুলো নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন। গরম চা সরাসরি তাতে ঢাললে পাছে ফেটে যায় তাই তিনি আগে সেই কাপগুলোর তলায় একটু করে দুধ ঢেলে রাখলেন। অবশ্য তার আরও কারণ থাকতে পারে। তখনকার দিনে চা এত সুগন্ধি ছিল না। একটু তেতোও হত। দুধ ঢাললে হয়তো আর একটু গ্রহণযোগ্য হত।
তবে কি, দামী চায়ের ফ্লেভার পুরোপুরি পেতে গেলে এগুলো এড়িয়ে চলাই ভাল। আর চিনি বেশি না খাওয়ার তো আরও হাজারটা কারণ আছে।
তৃতীয় পর্ব: সাদা সবুজ কালো উলঙ্গ এবং…
একটা বানান বোধহয় ভুল হয়ে গেল। সে মীমাংসা পরে করছি। আজ Know Your Cha অর্থাৎ KYC পর্ব।
Bamboo Pu-Erh Tea, জিংলং চা কারখানার ‘পু-য়ের চা’ বাঁশের খোলকে
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। দার্জিলিং ম্যালে ঘোরাঘুরি করছি। আর পাঁচ জনের দেখাদেখি হঠাৎ গোল্ডেন টিপসে ঢুকে পড়লাম। ওয়েটার জিগ্যেস করলেন “ফার্ষ্ট ফ্লাশ?” একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আমি তো ওটা করতে আসিনি। তাছাড়া ওটা ফার্স্টে কেন করব? ওটা তো লাস্টে করার কথা। তারপর তিনি আমাকে মেন্যু কার্ডটা ধরিয়ে দিলেন। খানিকটা বুঝলাম। একটু বেশি দামের পরোয়া না করে ফার্স্ট ফ্লাশই অর্ডার করলাম। সেই প্রথম জানলাম চায়ের সঙ্গে ফ্লাশের সম্পর্ক।
গরম চা এল। সঙ্গে ছাঁকনি ভর্তি ভেজা সবুজ পাতা। এবার একটু রাগ হল। ছাঁকা চা-পাতা আমার মা গোলাপ গাছের গোঁড়ায় দিত আর এই হতচ্ছাড়া আমার খাবার টেবিলে তুলে দিয়ে গেল! বুঝলাম চা আস্বাদন শুধু জিভ দিয়ে নয়, পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে করতে হয়। দেখবেন বিশেষজ্ঞরা একেবারে প্রথমে দেখেন, এক চিমটে শুকনো পাতা স্পর্শ করেন, ঘ্রাণ নেন। কাপ-প্লেটের টুং টুং আওয়াজে আকর্ষিত হন। তারপর পছন্দের পানীয়ে চুমুক দেন।
একেবারে গোদা বাংলায় ভালো চা বলতে আমরা প্রথমেই বুঝি পাতা-চা, গুঁড়ো নয়। একটা সময় ভাবতাম কলকাতা ট্রাম কোম্পানি যে চা তৈরি তাকে বলে CTC চা। তারপর জানলাম গুঁড়ো চায়ের পোশাকী নাম CTC। আরও পরে জেনেছিলাম ছোট্ট শব্দটির মানে crushed, torn, curled! তাহলে চূর্ণ, ছিন্ন, কুঞ্চিত অবশিষ্ট দিয়ে যদি CTC হয়, ভালো পাতাগুলো কোথায় যায়! আগে বেশির ভাগটাই বিদেশে চলে যেত। এখন সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালেও এসেছে খানিকটা।
এবার ফ্লাশবৃত্তান্ত। গাছ থেকে পাতা তোলার মরশুম অনুযায়ী চায়ের ফ্লাশিকরণ হয়। দীর্ঘ শীতঝিমুনির পর ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে বেঁটেখাটো চিরহরিৎ গাছগুলো বসন্তে আবার জেগে ওঠে। এই মরশুমে যে পাতা তোলা হয় তাদের বলা হয় ফার্স্ট ফ্লাশ। নব পল্লবদল অকারণে চঞ্চল হওয়ার কারণেই বোধহয় এই চায়ের আভিজাত্য এত বেশি। হাল্কা হলুদ লিকার। গন্ধে ম ম। একটু কষাটে (astringent) স্বাদটাই হয়তো আরও আকর্ষণীয় করে তোলে একে। এরপর মে-জুন মাসে বর্ষার বৃষ্টি যখন সদ্য পাহাড়ে পৌঁছয় সেই সময়ে তোলা পাতা থেকে তৈরি হয় সেকেন্ড ফ্লাশ। নামে সেকেন্ড হলেও একে নিম্নমানের ভাবার কোনো কারণ নেই। গন্ধটা একটু চড়া। চমৎকার হলদেটে-বাদামি রংয়ের লিকার। মনে রাখবেন দার্জিলিং এর বিখ্যাত মাসকাটেল (Muscatel) চা কিন্তু সেকেন্ড ফ্লাশ! পাতা তোলার তৃতীয় সিজন আসে অক্টোবর নাগাদ। একে বলে অটাম (autumn) ফ্লাশ। এই চায়ের লিকারে থাকে একটা তামাটে রঙ। গন্ধে অত সুমিষ্ট না হলেও স্বাদে থাকে মাখনের (creamy) ছোঁয়া।
ঘুরে ফিরে সব পাতাই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস, তবু কিছু বর্ণবৈষম্য তো থাকবেই! মূলত জারণ (Oxidation) মাত্রার ওপর নির্ভর করে সাদা, সবুজ, কালো ইত্যাদি নামকরণ হয়। গাছ থেকে কচি পাতা তোলার পর অতি সামান্য প্রক্রিয়াকরণে তৈরি হয় সাদা (white) চা। এই পাতা নাকি এত কচি থাকে যে এর গায়ে সাদা সাদা রোঁয়া লেগে থাকে। একটু বেশি পরিণত পাতা আর একটু জারিত হলে আমরা পাই গ্রীন টী। সবচেয়ে বেশি জারিত হলে হয় ব্ল্যাক টী। লাল, হলুদ, বেগুনি চা পাতাও আছে কিন্তু বাজারে অতটা চালু নয়। চা পাতা নিজে যত জারিত হয় তার অ্যান্টি-অক্সিডেশন বৈশিষ্ট্য তত কমে আসে। এজন্যই সাদা চা এবং গ্রীন টী-এর অ্যান্টি-অক্সিডেশন ক্ষমতা ব্ল্যাক টী-এর চেয়ে ঢের বেশি এবং স্বাস্থ্য সচেতনদের কাছে অধিক প্রিয়। আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে বেশি জারণের ফলে কালো চায়ের স্বাদ সবচেয়ে বেশি।
চিনে ভাষায় Wu মানে কালো, আর Long শব্দের অর্থ ড্রাগন। হয়ত দেখে ওদের সেরকমই মনে হয়েছিল। ‘Oolong’ চায়ের জারণ মাত্রা সবুজ আর কালো চায়ের মাঝখানে। চিনা চাষিরা যে কীভাবে একই গাছ থেকে এত বিভিন্ন রকম চা তৈরি আয়ত্ত করেছিলেন কে জানে! Cultivated Variety বা সংক্ষেপে ‘কাল্টিভার’ হল চা চেনার আর একটি মাপকাঠি। ওয়াইন রসিকরা যেমন দেখে নেন কী ধরনের আঙুর কোন ডিস্টিলারি ইত্যাদি, চা রসিকরাও কাল্টিভার জানার চেষ্টা করেন। দীর্ঘ দিনের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কোনো ভ্যারাইটি যখন নির্দিষ্ট যোগ্যতামান অর্জন করে সেই গাছেরই কলম (Graft) তখন বেশি বেশি করে লাগানো হয়। বাগান বা অঞ্চল বিশেষে এই নিজস্বতা বজায় থাকে। যেমন দার্জিলিং-এর একটি জনপ্রিয় কাল্টিভার AV2।
এবার যে চায়ের গল্প বলব সেটি খেতে গেলে আপনার কুড়ুল-কাটারি লাগতে পারে। Pu-erh বা Pu’er Tea একটি গেঁজানো (Fermentated) চা। শুধু চা বললে ভুল হবে, চা কেক বলা ভাল। নানা ভাবে একে গেঁজানো হয়। একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল বাঁশে ঠুসে। বিক্রিও হয় চায়ের বংশদণ্ড রূপেই! হুইস্কির মতো এরও যত বয়স বাড়ে তত বাড়ে কদর এবং মূল্য। আমার এক চা-গুরু তো পরামর্শ দিলেন ব্লু চিপ শেয়ার ছেড়ে কিছু Bamboo Pu-Erh Tea কিনে রাখতে। চা-কেক শুনে অবাক হবেন না। চিনে খোলা চা পাতা এসেছে মিং রাজবংশের আমলে (১৩৬৮-১৬৪৪)। তার আগে পর্যন্ত এ ধরনের কেক ভেঙেই তৈরি করতে হত পছন্দের পানীয়।
কুলীন চায়ের গল্প অনেক হল। এবার সাধারণ চায়ে আসা যাক। বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে চা শুধু একটি পানীয় নয়। “এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই” টাইপের একটি আবেগ। কিন্তু এ অভ্যাস তো খুব বেশি পুরোনো নয়। সাহেবরা একটা সময় তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য রাস্তা ঘাটে আপিস কাছারিতে আমাদের বিনা পয়সায় চা খাইয়েছে। অবশ্যই সস্তার সিটিসি চা। সবচেয়ে বেশি ফ্রী স্যাম্পলিং হয়েছিল রেল স্টেশন চত্বরে। ফলশ্রুতিতে এখন ভারতীয় রেলের একটি স্টেশনও পাবেন না যেখানে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান নেই। তবে এই দোকানগুলোকে একদম হাল্কা ভাবে নেবেন না। গুজরাতে এরকমই একটি দোকানে বাবাকে সাহায্য করতেন এক কিশোর। তিনি এখন কি করেন আপনারা সবাই জানেন।
চতুর্থ পর্ব: স্মাগলিং না স্মার্টনেস?
“…দেহি…দেহি…দেহি…দ্বিষো জহি…”
লোভী ইংরেজদের তখন বিশ্বজুড়ে একটাই বুলি, “দেহি, দেহি, দেহি!” অন্যদিকে চাইনিজরা শুধু বলে চলেছে “রূপং দেহি, রূপং দেহি।” কারণ, বাণিজ্য চুক্তি তো তাই ছিল। চিন দেবে চা। বিনিময়ে ইংল্যান্ড দেবে রূপা। কিন্তু চুক্তি ভাঙতে আর কতক্ষণ! সাহেবরা তখন চায়ের নেশায় মত্ত। নিজেদের দেশে চাহিদা তুঙ্গে। অথচ চা কিনতে কিনতে রাজকোষে রূপার ভাঁড়ার তলানিতে। অতএব বিকল্প রাস্তা খুঁজতেই হবে। স্থল-গোলার্ধের এক-চতুর্থাংশ তখন ব্রিটিশদের দখলে। রাজমুকুটে উজ্জ্বলতম পালক (দুধেলা গাইও বলা যেতে পারে) ইন্ডিয়া। সে আবার চিনেরই প্রতিবেশী। প্রাকৃতিক মিল তো কিছু থাকবেই। এই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে।
রবার্ট ফরচুন (১৮১২- ১৮৮০)
স্কটল্যান্ডের রাজা (১৩০৬-১৩০৯) তথা জাতীয় আইকন রবার্ট ব্রুসের গল্প কে না জানে! তবে আমার গল্পের রবার্ট ব্রুস সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। ইনিও ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। ভারতে এসেছিলেন ১৮৩২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য রুপে। ঘটনাচক্রে পোস্টিং পেলেন উত্তর আসামে। পরিচয় হল এলাকার হোমড়াচোমড়া এবং ভালো মানুষ বলে পরিচিত মনিরাম দত্ত বড়ুয়া ওরফে মনিরাম দেওয়ানের সঙ্গে। মনিরামের কাছে ব্রুস জানতে পারলেন স্থানীয় সিংফো আদিবাসীরা ফলপ বা খলপ নামের এক রকমের জংলী গাছের পাতা জলে ভিজিয়ে খায়। দেখে শুনে রবার্ট এবং তার ভাই চার্লস ব্রুসের মনে হল এই পাতা নিশ্চয় চা। তাঁরা সেই গাছের নমুনা পাঠালেন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনস সহ আরও বিভিন্ন জায়গায়। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর প্রমাণিত হল সিংফো আদিবাসীদের ফলপ আসলে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস (অসমিয়া ভ্যারাইটি)। প্রতিষ্ঠিত হল আসাম টী কোম্পানি। নিয়ে যাওয়া হল ইংল্যান্ডে। কিন্তু সে চা সাহেবদের মুখে রুচলো না। অতএব চলতে লাগলো সেই বিশেষ চা যা চিনদেশ থেকে আসে।
শুধু গাছ পেলেই তো হবে না। সবুজ সবুজ পাতাগুলো জলে ভিজিয়ে দিলেই তো আর চা তৈরি হয়ে যায় না। মাঝে থাকে অনেক জটিল প্রক্রিয়াকরণ। খোঁজ চলতে থাকল চিনের উন্নত সুস্বাদু চায়ের এবং তার প্রস্তুত প্রণালীর। কিন্তু চিনেরা তা দেবে কেন? কোকো কোলা কোম্পানি কি তার ফর্মুলা বলবে? আর গোপনীয়তা রক্ষাই যে দেশের জাতীয় নীতি তাদের পেট থেকে কথা বের করা কি চাট্টিখানি কথা! কোভিড নিয়ে চিনের রাখঢাক না হয় আমাদের হাল আমলের স্মৃতি কিন্তু তাদের চায়ের গল্প চেপে রাখা যে কিংবদন্তি। চার হাজার বছর ধরে সযত্নে রক্ষিত চাইনিজ গোপনীয়তা ভঙ্গে কোমর বেঁধে নেমে পড়লো ব্রিটিশরা।
এবার নজর সরাসরি চিনে। অস্ত্র হল গাছের বদলে গাছ। নেশার বদলে নেশা। চায়ের বদলে আফিম। তাও আবার সে আফিম ছিল “মেড ইন ইন্ডিয়া!” শুরু হল সরকারি মদতে আফিমের চোরা চালান। নেপথ্যে অবশ্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চিন ততদিনে আফিমের লেনদেন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অথচ নাছোড়বান্দা ব্রিটিশরা ক্যানটন বন্দর দিয়ে নেশাদ্রব্য চালান করেই যাচ্ছে। প্রতিবাদে একদিন চিনেরা বিশ হাজার বাক্স আফিম নষ্ট করে দিল। শুরু হয়ে গেল প্রথম আফিম যুদ্ধ! চলল তিন বছর (১৮৩৯-১৮৪২)। ব্রিটিশদের আধুনিক সমরসম্ভারে চিনারা পর্যুদস্ত হয়ে বাধ্য হল অত্যন্ত অপমানজনক সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করতে। চিন নিজেদের হাত থেকে হারালো হংকং, যা ফেরত পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হল ১৯৯৭ অবধি।
আবার চিনেরা যে ধোয়া তুলসীপাতা তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। ইংল্যান্ডে পাঠানো চা পাতায় ওরা ক্ষতিকারক রং ও ভেজাল মেশাচ্ছিল। সাহেবরা সে কু-কীর্তি সর্বসমক্ষে আনল। সবে মিলে পরিস্থিতি বেশ ঘোরাল হয়ে উঠল। ঘটনাচক্রে বেপরোয়া ব্রিটিশরা তখন খোঁজ পেল আর এক স্কটসম্যানের। নাম রবার্ট ফরচুন। বয়স ত্রিশ অতিক্রান্ত। প্রথাগত ডিগ্রী না থাকলেও কাজেকর্মে তাঁকে উদ্ভিদবিদই বলা যায়। রয়্যাল হর্টিকালচার সোসাইটির মনোনয়নে ফরচুন ইতিমধ্যে বছর তিনেক চিন দেশে কাটিয়ে এসেছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে চর হিসাবে পাঠাল, উদ্দেশ্য চা গাছ চুরি তো বটেই, সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য হাতানো। ফরচুনের ছদ্মবেশ হল প্রত্যন্ত চিনের একজন মানুষের মতো। কপাল থেকে মাথার সামনের দিকের বেশ খানিকটা চুল কামিয়ে দিলেন। নকল পনিটেল লাগালেন। ম্যান্ডারিনদের মতো ভাষাও কিছুটা রপ্ত করলেন। সঙ্গে রাখলেন এক স্থানীয় সহচর। বছর খানেক পর হাজার দশেক চা গাছের চারা এবং অসংখ্য বীজ পাঠালেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে করে। দুঃখজনক ভাবে ভারতে পৌঁছনর পর আর সেগুলোকে কাজে লাগানো গেল না।
ফরচুন দমলেন না। নতুন উদ্যমে আবার নিজের কাজে নেমে পড়লেন। আরও বছর খানেক পরে তিনি আরও বেশি সংখ্যক চারা ও বীজ পাঠালেন। নিজে ফিরে এলেন বেশ কয়েকজন চিনে চা বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে। এসে গেল ব্রিটিশদের ‘বল্লে বল্লে’ সময়! আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না। ঠিক এরকম সময়ে অস্ট্রিয়া থেকে হাতে এল গ্রেগর ইওহান মেন্ডেল-এর প্ল্যান্ট জেনেটিক্সের নানা তত্ত্ব। হাইব্রিড করে করে পাওয়া গেল অতি উন্নত মানের চা গাছ। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে চিনকে টপকে ভারত হয়ে গেল বিশ্বে সর্বাধিক চা রপ্তানিকারক দেশ। শুধু পরিমাণে নয় গুনমানেও। দার্জিলিং হয়ে উঠল চায়ের ‘শ্যাম্পেন’ প্রভিন্স।
ফরচুনকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুমতি দিল নিজের দিনলিপি লিখে ফেলার। উনি লিখলেনও খান তিনেক বই। আজ যে বিশ্বে প্রায় পঞ্চাশটি দেশে চায়ের চাষ হয় তার প্রভূত কৃতিত্ব রবার্ট ফরচুনের। চায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ব্লিডিং হার্ট, পিওনি ইত্যাদি নানা রকমের সুন্দর ফুলও তিনি উপহার দিলেন নিজের দেশকে। সমগ্র ইউরোপবাসীকে বোঝালেন গ্রীন টী আর ব্ল্যাক টী আদতে একই গাছের পাতা ভিন্ন ভাবে তৈরি। আজ যখন ভালো চায়ের কাপে আমরা চুমুকটা দি আমাদের মনে রাখতে হবে এর পিছনে ফরচুনের কতখানি কৃতিত্ব। এরকম বর্ণময় চরিত্রকে আপনি স্মাগলার বলবেন না মহাপুরুষ বলবেন সে বিচারের ভার আপনার হাতে। তবে ফরচুন যে ব্রিটিশদের ফরচুন ফিরিয়ে দিলেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।
পঞ্চম পর্ব: স্বদেশী চা
চায়ের প্রতি ভারতীয় আবেগের গৌরবময় ইতিহাস
সাহেবরা আমাদের চা চেনালেন। বোঝালেন বিকেল বেলায় উঁচু ডিনার টেবিলে রেখে বিভিন্ন খাদ্য সহযোগে খেলে তা হয় High tea. আর নিচু টেবিলে রেখে খেলে তা হয় Low tea! খেটে খাওয়া মানুষজন লাঞ্চ আর ডিনারের মাঝে বিকেলে আর একবার খেতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে তাদের জন্য High tea আর বাবু-বিবিদের জন্য Low tea। সে যাই হোক, আমরা আমাদের মতো করে চা খেতে থাকলাম। এমনকি টী ব্যাগস থেকে গুঁড়ো চা বের করে সসপ্যানে ঢেলে চিনি, দুধ, এলাচ দিয়ে ফুটিয়ে বানিয়ে নিলাম বিশুদ্ধ, সুমিষ্ট অনুপান। আহার পথ্য একীভূত। আর হবে নাই বা কেন? সেই মান্ধাতার আমল থেকে আয়ুর্বেদ মেনে থেঁতো করা আদা, গোলমরিচ, তুলসী পাতা, লবঙ্গ ইত্যাদি গরম জলে ফুটিয়ে, সামান্য মধু দিয়ে আমরা ‘কাড়া’ খেয়ে আসছি। তাতে একটু চা পাতা দিলে আর ক্ষতি কি!
এই মুহূর্তে ভারতীয়দের জাতীয় রোগ নাকি “ভাল্লাগছে না” বা Lassitude, আধুনিক বাংলায় ল্যাদ। আর এই রোগের সর্বাধিক প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ওষধি বোধহয় চা। আমার এই পোস্টের সঙ্গে সংযুক্ত ছবিটি (চিত্র ৬) স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। দেখান হচ্ছে পাঠরত একটি ছাত্র তার বাবা মায়ের সঙ্গে চা খাচ্ছে। অর্থাৎ বাচ্চা বুড়ো সবার জন্য কাজে লাগে এই পানীয়। অন্তত:পক্ষে বিজ্ঞাপনগুলো তাই বলে।
চায়ের জন্য ভিনটেজ বিজ্ঞাপন, এই পানীয়কে ১০০ শতাংশ স্বদেশী (ভারতে তৈরি) বলে ঘোষণা
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের কথা। ইংল্যান্ডের “ডাচেস অফ বেডফোর্ড” প্রিন্সেস অ্যানা-র (Anna) একদিন ভাল্লাগছিল না। বিকেলের দিকে কিছু বন্ধুবান্ধব ডাকলেন। চায়ের সঙ্গে থাকল ছোটো ছোটো কেক আর স্যান্ডউইচ। হল একটা ছোট্ট টী পার্টি। রাজ পরিবারে চালু হল আফটারনুন টী খাবার অভ্যাস।
ভারতীয়দের চা পানের অভ্যাস তো অত পুরোনো নয়। মাত্র শ’খানেক বছরের পুরোনো একটা অভ্যাস এত তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনে এভাবে জড়িয়ে গেল বা অলিখিত জাতীয় পানীয়ের মর্যাদা পেল কি ভাবে? এর এক কথায় উত্তর, সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। লাগাতার প্রচার যে একটা জাতির খাদ্যাভ্যাস বদলে দিতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল চা। আঁতেল আলোচনা থেকে হাল্কা গসিপ সব কিছুতেই আমাদের সঙ্গী চা। কোথাও কড়ক (strong) চা, কোথাও আদ্রক (Ginger) চা, কেরালায় সুলাইমনি চা, কাশ্মীরে গোলাপি রঙের নুন-চা, আর মুম্বাইয়ে পাবেন কাটিং চা। এক কাপ চা ভাগ করে ‘কাটিং’ চা খাওয়ার যে অনাবিল আনন্দ তা কি আর বাঙালিকে শেখাতে হবে? সেই কবে থেকে তারা কফি হাউসে বসে “তিনটে ডবল হাফ” খেয়ে আসছে!
স্বাধীনতার পর চা বাগানের মালিকানা যখন ধনী ভারতীয়দের হাতে এল তাঁরা ব্যাপক প্রচারে মনোযোগ দিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় যারা চা-কে ত্যাজ্য বলেছিলেন তাদের মন গলানোর জন্য এল নতুন কৌশল। দেখানো হল ভারতীয় মহিলা চা খেতে খেতে চরকা ঘোরাচ্ছেন (চিত্র ৭)। শুরু হল চায়ের স্বদেশীকরণ। নেপথ্যে টী বোর্ড অফ ইন্ডিয়া। এই ফাঁকে বলে রাখি ১৯০৩-এ তৈরি হয়েছিল “Tea Cess Committee”। ১৯৩৭-এ তা বদলে হল “Indian Tea Market Expansion Board”। ১৯৫৩-য় আবার নতুন নামকরণ হল Tea Board of India, যার সদর দফতর এখনও কলকাতায়। আস্তে আস্তে দেশে বিভিন্ন স্বীকৃত চা-অঞ্চলের জন্য তৈরি হল আলাদা আলাদা লোগো। ভালো চায়ের প্যাকেট কিনলে দেখবেন দার্জিলিং, আসাম, ডুয়ার্স, কাংরা, নীলগিরি ইত্যাদি সবার নিজ নিজ আগমার্কা ছাপ রয়েছে।
বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চা পাতার গুনমান অনেক উন্নত হয়েছে, দাম বেড়েছে এবং বাড়তেই থাকবে। তাই বলে চা শ্রমিকদের জীবন-মানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে কি না জানি না। শুনেছি এঁদের জীবনে ম্যানেজার গোত্রের মানুষজনের প্রবল প্রভাব। ম্যানেজাররাই এঁদের ‘মাঈবাপ’। প্ল্যানটারদের কর্মজীবনও ভীষণ ব্যস্ত হবারই কথা। তবে উদয়াস্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি তাঁদের বিনোদনের আয়োজনও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে Planters’ Club. লেখাটা যেহেতু পানীয় নিয়ে তাই সে সব ক্লাবের কুটকাচালিতে না ঢুকে বরং “Planters Punch” নামক একটা ককটেলের কথা বলি। এই Punch শব্দটা এসেছে হিন্দি Panch (পাঁচ) থেকে। কারণ, এটি রাম, চিনি, লেবু, জল এবং চা পাঁচটি জিনিসের মিশ্রণ!
আমার মতো যারা চা নিয়ে একটু বাচালতা করেন বন্ধুরা অনেক সময় তাঁদের ভুল করে টী টেস্টার বলে ফেলেন। টী টেস্টার-রা পুরোদমে পেশাদার। বাগানে চা তোলা থেকে আপনার কাপে পৌঁছন পর্যন্ত তাঁদের বিশাল ভূমিকা। কমপক্ষে পাঁচ বছরের ট্রেনিং লাগে একজন যোগ্য টী টেস্টার তৈরি করতে। আমি নিজে খুব বেশি হলে একজন চাপ্রেমী মাত্র।
সূত্র:
1. Roy Moxham, A Brief History of Tea:, Published by Little, Brown Book Group, 2009
2. Beverly Dubrin, Tea Culture, Imagine Publishing, 2011
3. Laszlo Montgomery, The Tea History Podcast:, (www.teacup.media)
4. Learn More About Tea, www.teadrunk.com
5. Sarah Rose, For All the Tea in China: How England Stole the World’s Favorite Drink and Changed History – Viking Publishers, 2009
6. Rekha Sarin & Ranjan Kapoor, Chai The Experience of Indian Tea, Niyogi Books, 2014
7. Snigdha Banerjee, The British Ad Propaganda & The Journey From Tea to Chai, 2021 (www.historyofceylontea.com)
8. Philip Lutgendorf, The Triumph of Tea: (www.tableau.uchicago.edu/articles/2012/03/triumph-tea)
চা নিয়ে নানা কথা জানা হল। এত কিছু জানা ছিল না। ভালো লাগল।
লা জবাব। তুরীয় আনন্দ পেলাম চা খেয়ে। ‘চিনবদন্তি’ যদি বাংলা অভিধানে জায়গা করে নেয়, আহ্লাদিত হব!
রবিবারের সকালে পড়তে বেশ ভালই লাগল। ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে আরও এরকম লেখার আশায় রইলাম।
ভালো লাগলো। আপনি এক্সটেনসিভ পড়াশোনা করে , খুব যত্ন করে , বিশাল একটা টাইমলাইন খুব সুন্দর কভার করেছেন। kudos
অতি কথন বর্জিত একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন। ভালো লাগলো।
চায়ের আড্ডার মত মজাদার, কিন্তু বিপুল তথ্য সম্ভার।
1. Excellent article. I enjoyed reading it.
2. Planters Piunch (not panch) has 4 ingredients, not 5. Traditionally it is “one of sour, two of sweet, three of strong, four of weak” – the “sour” is lime juice, the “sweet” is sugar cane juice, the “strong” is Jamaican rum and the “weak” is water. The concoction originated in the Caribbeans.
3. In between the second flush (summer flush) and the autumn flush is a monsoon flush. And the second flush typically has a mellower bouquet (top note) than the spring flush, which many connoisseurs find a little too aggressive. The palate is comparable.
ভীষণভাবে সমৃদ্ধ হলাম । বইটি পাওয়া যাবে কোথায় জানালে বাধিত হবো।
ধন্যবাদান্তে, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়,,,