সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পুরনো সম্পাদকীয়

আজকাল অনেকে ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে অভিহিত করছেন বলে দেখতে পাচ্ছি। এর অন্যতম কারণ হিসাবে তাঁরা প্রাচীন ভারতের গণরাজ্য বলে অভিহিত কয়েকটি জনপদে একক বংশানুক্রমিক শাসকের অনুপস্থিতির উল্লেখ করেন। কিন্তু, ভারতের এই প্রাচীন গণরাজ্যগুলিতে জননীদের রাজনৈতিক অধিকারের কোনও চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতের প্রাচীন যুগে রচিত ধর্মশাস্ত্রে দেখি সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বা সামাজিক অধিকার, নারীদের কোথাও স্থান নেই, নেই তাঁদের বেদ শিক্ষার অধিকার। আদি মধ্যযুগের স্মৃতিশাস্ত্রে সম্পত্তির অধিকার কিছুটা যদি বা নারীদের দেওয়া হল, তো সংযোজিত হল বিধবাদহনের মতো অমানবিক প্রথা।
মনুস্মৃতিতে (৭.৩-৪) বলা হয়েছে, মানুষের ভয় দূর করতে, তাঁদের রক্ষার্থে, অষ্ট দিকপাল দেবতার সারভূত অংশ গ্রহণ করে প্রভু রাজার সৃষ্টি করেছেন। শাসককে দৈব শক্তির দ্বারা নিযুক্ত বা দেবতাস্বরূপ বলে অভিহিত করার রীতি পৃথিবীর সব প্রাচীন সংস্কৃতিতেই দেখা যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের বহু শাসকই নিজেদের সার্বভৌমত্বের বৈধতা প্রমাণের জন্য ধর্ম ও ঐশী শক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। আজও পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে রাজতন্ত্র রয়ে গিয়েছে, সেখানে ধর্ম ও ইশ্বরের দ্বারাই শাসকের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অতি সাম্প্রতিক কালে যাঁরা গ্রেট ব্রিটেনের তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক দূরদর্শনে দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন। অন্ত-মধ্যযুগের ভারতের শাসকদের সিংহাসনের উপর অধিকারের দৈব স্বীকৃতির প্রতীক হিসাবে তাঁদের দৈব শক্তি বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে পতাকা, রাজদণ্ড বা তরবারি প্রাপ্তির কাহিনি প্রচলনের একাধিক উদাহরণ দেখা যায়। আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকের ক্ষমতার স্বীকৃত উত্স জনসমর্থন। সেই কারণে, সাধারণত আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক দেশের শাসকরা নিজেদের রাষ্ট্রক্ষমতার স্বীকৃতির জন্য সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতীকসমূহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসাবে কোনও রাজশক্তির পরিবর্তে অশোকের স্তম্ভশীর্ষের ধর্মচক্রের চয়ন স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন শাসকদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতার নিদর্শন।