সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বিবিধ

১৯০৫ সালে ইউএসএ-র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় প্রাচীন ভারতের খ্যাতনামা নাট্যকার শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের ইংরাজি অনুবাদ ‘দ্য লিটল ক্লে কার্ট’। ‘হার্ভার্ড ওরিয়েন্টাল সিরিজ’-এর অধীনে তখন দু’ এক বছর ছাড়া ছাড়াই প্রকাশিত হতো সংস্কৃত, পালি প্রভৃতি ভাষায় লিখিত বিভিন্ন পুস্তকের ইংরাজি অনুবাদ। আর সে বইগুলো যথেষ্টই সমাদর লাভ করত সুধীসমাজে। কিন্তু এবারের মৃচ্ছকটিকের অনুবাদটা যেন সাড়া ফেলে দিয়েছে পাঠক মহলে। নাটকটা অনুবাদ করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষার ইনস্ট্রাকটর আর্থার উইলিয়াম রাইডার। রাইডারের কাজে মুগ্ধ পণ্ডিত মহল। এক লহমায় পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন রাইডার. আর সেই সূত্রেই, সুদূর পশ্চিম প্রান্তের বার্কলে শহরের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া থেকে অধ্যাপনার ডাক পেলেন।
জীবনে প্রথম রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা এইভাবেই তাঁর সুনিপুন অক্ষরের নকশায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন রাস্কিন বন্ড। সেই বয়সেই তাঁর দেখার চোখ ছিল। পরিতাপের বিষয়, এই ঈশ্বরপ্রদত্ত দৃষ্টি, বর্তমান লেখকের কস্মিনকালেও ছিল না। তবুও এইটুকু মনে আছে, ছোটবেলায় পুজোর সময় ভোরবেলার আকাশ যখন আস্তে আস্তে গোলাপী হয়ে উঠত, তখন হ্যামলিনে বাঁশির মতো রেলগাড়ির হর্নের মায়াবী সুরের টানে বাবা মা-এর হাত ধরে দাঁড়াতাম শেয়ালদার কোনও প্ল্যাটফর্মে। আরব্য রজনী থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য যান প্রবল বেগে ছুটে চলত গন্তব্যের দিকে। জানলা দিয়ে অবাক হয়ে দেখতাম গাছ, বাড়ি, পুকুর, মানুষ, ধানক্ষেত – সবেরই পেছন দিকে দৌড়। আর যখন জুবিলি সেতু আসত, রেলগাড়ি তার উর্ধ্বশ্বাস দৌড় থামিয়ে, ধীর শ্বাস ফেলতে ফেলতে, সকালের সোনাগলানো রোদে চিকচিক করতে থাকা গঙ্গা পার হতো, তখন রাস্কিনের মতোই, পুরো ব্যাপারটাই মনে হতো রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা।
সভ্যতার কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লক্ষণ জাতিগত সৌকর্য এবং নান্দনিকতার চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। বই তাদের মধ্যে অন্যতম একটা সৃষ্টিশীল নিদর্শন। যাদের আমরা সভ্যজাতি বলি তাদের বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলি মানদণ্ডের মধ্যে একটি নিশ্চিত ভাবে বই। তাই বই সমাজের উন্নতির একটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রতিদিন কমবেশি প্রায় পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হয়। এমনকি বাংলা ভাষাতেই প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি বই লেখা হয়। ঠিকভাবে কাকে বই বলা যাবে জাতিপুঞ্জ সেই সংজ্ঞা বেধে দিয়েছে।১ তবে বইয়ের সংজ্ঞায়নের আইন, রীতিনীতি এবং বিতর্কগুলি থেকেও অন্য একটি আকর্ষণীয় দিক আছে। সুনীল চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি বইয়ের শুরুর লাইনটিতেই লিখেছিলেন ‘এটি গ্রন্থ নয়, বই’। হয়তো পাঠ্যপুস্তক লিখতে গিয়ে তাঁর এই ধরনের স্যাটায়ারের ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু তিনি একথা বলে যাননি বই থেকে গ্রন্থ হয়ে উঠতে গেলে কী প্রয়োজন। আমরা কেবল তার ধারণা করে নিতে পারি এইমাত্র।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকায় খ্রিস্টধর্মে মৌলবাদের ধারণা প্রথম উঠে আসে; পরবর্তীকালে অন্যান্য সংস্কৃতিতে তা ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিকতার কিছু দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়া সঞ্জাত হল মৌলবাদ। আধুনিকতা (মডার্নিসম)এর বিপরীত শব্দ হল মৌলবাদ (ফান্ডামেন্টালিসম)। নিজেদের অবস্থান বোঝাতে কথাটি প্রথম ব্যবহার করে আমেরিকান কিছু খ্রিস্টান গ্রুপ। এই অবস্থানটি ছিল, তাদের মতে, আধুনিক বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বসমূহের থেকে বিযুক্ত; অধার্মিক প্রবণতাগুলির বিপরীতে। তাদের মতে খ্রিস্টীয় মতবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং আধুনিক ঐতিহাসিক ভাষাবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বের বাইবেলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।১ (ব্রক্কি এবং আহমেদ, ২০২৩)
ভোরবেলা ওঠা ইন্দুপ্রকাশের অভ্যাস, আর সমুদ্রযাত্রায় তাঁর বরাবরই ঘুম ভালো হয় না। জাহাজের তৃতীয় শ্রেণির ছোট ঘরে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। অবশ্য এই লুসিটানিয়া জাহাজটি অত্যন্ত মনোরম, তার তৃতীয় শ্রেণির ব্যবস্থা অনেক জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণির সমান। ভাড়া বেশি, কিন্তু যুদ্ধের সময়ে অন্য উপায়ই বা কোথায়? অন্যদিন তিনি ভোরের আলো ফুটলেই গায়ে ডেকে গিয়ে সূর্যের প্রতীক্ষা করতেন। কিন্তু আজ বাইরে গাঢ় কুয়াশা, ডেকে ওঠার উপায় নেই। সে না থাক, কাল জাহাজ লিভারপুলে ভিড়বে, ডাঙায় নেমে ভালো করে হাত-পা খেলিয়ে নেবেন ইন্দু। তবে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি করে ইংল্যান্ডে গিয়ে কী জুটবে সেটা চিন্তার বিষয়। গোটা মার্কিন দেশটা দ্রুত উন্নতি করছে, হার্ভার্ডের পড়াশুনার মান অতিশয় ভালো, কিন্তু ইংল্যান্ডের অধ্যাপকেরা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের ধারণা ইংলিশ চ্যানেলের এপারে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল প্রথম শ্রেণির, আর চ্যানেলের ওপারে ফ্রান্স আর জার্মানিতে কয়েকটি দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এছাড়া ত্রিভুবনে বাকি সব দেশ হল অজ মুখ্যুদের দেশ।