সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পুরনো লেখা

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মৈমনসিংহ গীতিকার প্রকাশ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত শতবর্ষ পুরানো মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ছিল নিবিড়, যা ছিল ঐতিহাসিকও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার বছর চল্লিশের ‘শৈশবকালে’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিভাবকের হাতে এসে পড়েছিল। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, কর্মোদ্যম, শিক্ষাসচেতনতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি দ্রুত দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্মান এনে দিয়েছিল। প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার মতো বাংলা সমাজ জীবনের দলিল মৈমনসিংহ গীতিকার প্রকাশ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তর বিভাগের ঐতিহাসিক দ্বারোদ্ঘাটন প্রায় সমসাময়িক ঘটনা।
“আমি পরমেশ্বরী, পিতৃসূত্রে চিনা ঐতিহ্যের অধিকারী— চিনের ক্যান্টনের মানুষ। আমার পিতা জোহর রাজ্যের শাসক, প্রয়াত সুলতান ইস্কান্দার। আমি বর্তমান জোহর শাসক সুলতান ইব্রাহিম ইবনি আলমারহুম সুলতান ইস্কান্দারের বোন। আমার মা হাজা খালসম আব্দুল্লা একজন ব্রিটিশ মহিলা— যার পূর্বে নাম ছিল যোসেফাইন ট্রেভরো।” জাতি, ধর্ম সংমিশ্রণের প্রকৃতিটি কি সঠিক ভাবে ধরা পরলো? আরও শুনুন— ইস্কান্দার নামটি এসেছে আলেকজান্ডার (দ্য গ্রেট) থেকে। সপ্তদশ শতকের সেজারাহ মেলায়ু (রাজাদের বংশতালিকা) বা ‘মালয় অ্যানালস’ শুরু হয়েছে ম্যাসেডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (ইস্কান্দার শাহ বা সেকেন্দার যালকারনাইন নামেও পরিচিত) দিয়ে। অনেকের মতে শাহ কথাটি এসেছে ইরানের রাজকীয় ফার্সি উপাধি থেকে।
বটতলার বই মানেই মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এক ধরনের আদিরসাত্মক রচনার ছাপা, যেগুলো ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে পড়তেন এক সময়ে। হতে পারে ‘বটতলা’ নামটি এসেছে কলকাতার মুদ্রণ যুগের প্রথম পর্বের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে, কিন্তু এই নামের সঙ্গের যে ধারণা, তার মধ্যে মিশে আছে উচ্চধারার সাহিত্যের তাচ্ছিল্যের ধারাবাহিকতা, প্রোপাগান্ডা, এমনকি প্রকাশক বা বিক্রেতার পাঠককে প্রলুব্ধ করার হাতছানিও। বটতলার বই মানেই যে কেবল আদিরসাত্মক নয়, তা বারবার উল্লেখ হয়ে আসছে সেই সুকুমার সেনের সময় থেকে। এমনকি প্যাট্রিক জে. কারনি তাঁর রচিত A History Of Erotic Literature–এ চার শতকের প্রধানত ইংরেজি ও ফরাসি আদিরসের যে সাহিত্যিক নিদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে দেখা যায় বটতলার ছাপার তুলনায় এলিট সাহিত্যের সংখ্যা এক্ষেত্রে অনেক বেশি। তবুও মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠকের কাছে বটতলার বিষয়গত চরিত্র সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
'একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয় একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।' ছেলেবেলায় দুলে দুলে যখন এই দুই ছত্র মুখস্ত করতাম, তখন তার ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে প্রশ্ন করার বয়স হয়নি। মনেই আসেনি কে বিজয়, আর অর্ণবপোতই বা কী। পরিণত বয়সে তত্ত্ব তল্লাশ করে জানলাম খ্রিস্ট জন্মের প্রায় পাঁচশো বছর আগের বাংলার (নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকবে— ভৌগোলিক সীমারেখার আন্দাজ দিতে নামটি ‘বাংলা’ লিখলাম) রাঢ় অঞ্চলের অধিপতি সিংহবাহু আর তার আপন বোন সিংহসিবলির দাম্পত্যজাত বত্রিশ পুত্রের সবচেয়ে বড়োটির নাম ছিল বিজয় সিংহ। তার জন্মের পর বাকি একত্রিশটি সন্তানের উৎপাদনে ব্যস্ত বাবা মা বিজয়ের কোনো দেখভাল করতে না পারায় এক নিখুঁত লম্পট হয়ে ওঠে সে। তার সপারিষদ উৎপাতে অতিষ্ঠ প্রজাদের উপর্যুপরি অভিযোগে বিরক্ত হয়ে একসময় সিংহবাহু তাকে দেশান্তরী হবার আদেশ দেন।